মধুলিড়

মধুলিড়

আমার নূতন প্রতিবেশী গৌরীকান্তবাবু নেহাত সাদামাটা চালের লোক। বিকালের দিকের নির্দিষ্ট নিমতলাটিতে রোজ আমাদের একবার করিয়া দেখা হয়, আমি সে সময় খেলিতে বাহির হই আর তিনি ফেরেন আপিস হইতে। সেই রেলির বাঁশের বাঁটের ভারি ছাতা, উপরে আবার সাদা কাপড় বসানো; রেলির মোটা জিনের চীনে কোট, জিনের প্যান্ট—দুইটিতে স্থূল উদরের মাঝামাঝি হইতে গোল হইয়া বুকের আর পায়ের দিকে যে যাহার ঘুরিয়া গিয়াছে; পায়ে চীনাবাড়ির জুতা—ফিতা-টিতার হাঙ্গামা নাই।

মনটিও এই রকম নির্ঝঞ্ঝাট। দেখা হইলেই মুখে এবং সমস্ত শরীরটিতে হাসির তরঙ্গ তুলিয়া বলেন, “এই যে, টেনিসে চলেছেন! বেশ বেশ, মন্দ নয়। তবে হ্যাপা অনেক, গোড়ালি-চাছা জুতো রে, ব্যাট রে, তার রবাটের জামা রে, ওর চেয়ে একটা বউ পোষা ঢের সহজ।”

আরও জোরে হাসি উঠে।

তাহার পর প্রায়ই আপিসের কোনো একটি গল্প উঠে, খুব আড়ম্বরের সহিত আরম্ভ করিয়া মাঝপথে হঠাৎ ছাড়িয়া দিয়া বলেন, “আমি ওসব সাতেও নেই, পাঁচেও নেই বের দাদা, খাই দাই গাজন গাই, বলি অ্যাকাউন্টের দপ্তর হাতে তুলে নিয়েছি, সেখানে যেদিন কোনো গলদ দেখবে, বলো। যান, আপনার আবার খানিকটা দেরি হয়ে গেল। একদিন আসুন না গরিবের বাসায়, ইয়ে বাবু—কি যে দিব্যি নামটি, আবার ভুলে গেলাম।”

তাঁহার বিশ্লেষণের ভয়ে সঙ্কুচিত হইয়া হয়তো নামটা মনে করাইয়া দিলাম, “গোবর্ধন।”

“ঠিক ঠিক, গোবর্ধনবাবু, গোবর-ধনবাবু; এত লোক আর এত নাম হয়ে পড়েছে যে, আর হিসেব রাখা যায় না। এই এতটুকু শহরটার কথাই ধরা যাক না, কটা করেই বা নাম মিটুচ্ছে বছরে? অথচ কোন্ না শ’খানেক করে বাড়ছে ফি বছরে! দশ বছরের সেন্সস মিলিয়ে দেখুন না। সেদিন পিওন ব্যাটা দাঁত বের করে এসে হাজির—ছুটি চাই। কি রে, ব্যাপারখানা কি? ব্যাপার, পনেরো দিন হল তার একটি ছেলে হয়েছে, তারই নামকরণ। নিন, এই আর একটি বাড়ল

অযথা একটা নামের বোঝা ঘাড়ে করিয়া পৃথিবীতে ভিড় জমাইয়া লোককে কি অসুবিধাতেই ফেলিয়াছে জানিতে পারিয়া অপরাধীর মতো মাথা নীচু করিয়া নিরুত্তর থাকি

কোনোদিন হয়তো বা কথাটা পারিবারিক প্রসঙ্গে আসিয়া ঠেকিল; গৌরীকান্তবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, “পুরুষে অত হাঙ্গাম করে বিয়ে করে কেন মশাই?”

এক কথায় এত বড় সমস্যার কি সদুত্তর হইতে পারে ভাবিতেছি, গৌরীকান্তবাবু নিজেই বলিলেন, “একটু জুতসই করে আহার করতে পাবে—এই তো, না আরও কিছু?”

স্বস্তির সহিত বলিলাম, “কই, আর কোনো উদ্দেশ্য তো চোখে পড়ে না।”

“ওঁরা কিন্তু মনে করেন, স্বামীর শখের জ্যান্ত আসবাব ঘরে উঠলাম; বিশেষ করে যদি আবার লেখাপড়ার বালাই থাকে।”

আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; স্বপক্ষে কি বিপক্ষে কোনো রকম উত্তর না পাইয়া বলিলেন, “তবে গোড়া থেকে আপনাকে বলতে হয়। এ পক্ষের ইনি আসবার অনেক দিন পর্যন্ত আশায় আশায় কেটে গেল; কিন্তু রান্না খোলে না। তারপর টের পাওয়া গেল, কলেজ মাড়িয়ে এসেছেন। আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসলাম রে দাদা। ক্ৰমে সব একে একে দেখা দিতে লাগলেন—শরৎ চাটুজ্জে, ডি. এল. রায়, রবিবাবু, কস্মিনকালে যাঁদের সব নামও শুনি নি, একে একে সব ট্রাঙ্ক থেকে বেরুতে লাগলেন। তখন বুঝলাম ব্যাপারটা, রান্নার হাত দিন দিন এমন হচ্ছে কেন, কোথায় দিন দিন পাকবে, না—। তা শাজাহান তেল-মসলার খবর দেবে কেন ইয়েবাবু? তখন থেকে তক্কে তক্কে রইলাম; যিনি বেরুচ্ছেন তাঁকে আর ঢুকতে হচ্ছে না, বাড়ির ত্রিসীমানার বার করে এসে ট্রাঙ্ক হালকা করতে লাগলাম। বেশিদিন আর লুকনো রইল না কথাটা। দিন কতক রাগ, তম্বি, বাপের বাড়ি—অনেক রকম চলল, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড আর কি! কলকাতার মেয়ে, তার নূতন রক্তের তেজ; আমি কিন্তু কড়া করে রাশ টেনে রাখলাম। ক্রমে রসটি মরে এসেছে; বলতে নেই, হেঁসেলের শ্রী ফিরেছে, আমিও নিশ্চিন্দি হয়ে হাত-পা গুটিয়ে আপনারা যাকে বলেন, পবিত্ৰ দাম্পত্য-জীবন, তাই একটু ভোগ করব করব করছি, এমন সময়—। কি? বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে, না? আচ্ছা, থাক তা হলে; একদিন বলব’খন সব কথা, একখানি আস্ত মহাভারত রে দাদা, বলেন কেন!”

.

সেদিন একটা কাজের হিড়িকে পড়িয়া প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল বলিয়া আর বাহির হইলাম না। বাড়ির সামনে খোলা উঠানটিতে একটা আরাম-কেদারা বিছাইয়া পড়িয়া রহিলাম।

পাশে একটি বাগান করিয়াছি। এতটুকু এক ফালি জায়গা, আমাদের তিনজনের শখে শখে একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, বাড়ির একটি মাত্র মেয়ে যেমন অনেকের স্নেহের নিদর্শনে ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। আমার গোলাপ আছে, ম্যাগ্নোলিয়া আছে, বারো-মেসে ডালিয়া আছে, একটা কেয়ার ঝাড় আছে; ওর আছে মল্লিকা, যূথী, মালতী, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ আরও কত কি; আর এরই মধ্যে মা’র গাম্ভীর্য আর সৌম্যতা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে মা’র শখের সজনেগাছ, বকফুলের গাছ, করঞ্চা গাছ এবং কুমড়া, লাউ, ঝিঙা, উচ্ছে—শত শত হস্তে ফলের ভার তুলিয়া ধরিয়া।

বোধ হয় একটু পরিচ্ছন্নতার অভাব আছে। তা থাক্; ওখানে কিন্তু আমার—মাতা, পুত্র, বধূ তিনজনের সংসারের বাহিরে, এক প্রচুর মুক্তির মাঝে আর এক ভাবে মিলিয়া গিয়াছে।

গরমের এই সময়টা সব ফুল ফোটে। একটু বাতাস ছিল, যেন ফুলের গন্ধের নেশা ধরিয়াছে—ভারি অলস আর একটু দিকভ্রান্ত। সন্ধ্যা গাঢ় হইতে আকাশে চাঁদটা স্পষ্ট হইয়া উঠিল, বোধ হয় পূর্ণিমা কি ওই গোছের একটা তিথি হইবে।

বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিলাম পৃথিবীটার কথা। একে বুঝিয়া উঠা গেল না—এই সৌন্দর্যও আছে, আবার ওই গৌরীকান্তও আছে। কলেজে-পড়া বিড়ম্বিত জীবনটির কথা মনে পড়িল, তাহার পর বোধ হয় এই কথাটাই মনে হইল যে আমরা নারীকে ঠিকমতো পাইতে জানি না। অল্প-বিস্তর ভাবে সব পুরুষই গৌরীকান্ত। সুযোগ আসে, অবসর আসে রচিত মাল্য হাতে লইয়া; আমরা বুঝিতেই পারি না—কখন আসিল, কখন ফিরিয়া গেল!

চাকরটাকে বলিলাম, “আর একখানা ঈজি-চেয়ার নামিয়ে দিয়ে যা তো এখানে।”

চেয়ার বসাইয়া দিলে প্রশ্ন করিলাম “তোর বহুমাঈজী কি করছে রে?”

উত্তর করিল, “ডেকে দোব নাকি?”

সংসার-সংক্রান্ত কোনো কাজ নাই কি না—’হাঁ’ বলিতে কেমন বাধিল একটু। সে ততক্ষণে চলিয়া গিয়াছে কিন্তু।

একটু পরেই সামনের দুয়ারটার পর্দা ঝনাৎ করিয়া এক পাশে সরিয়া গেল। নিজের চেয়ারটা সেই প্রতীক্ষমাণ চেয়ারটার কাছে একটু টানিয়া লইতেছি, এমন সময় পিছনে পুরুষকণ্ঠে শুনিলাম, “এই যে ইয়ে-বাবু—কি যে দিব্যি নামটি, আবার ভুলে গেলাম!”

সত্য গোপন করিয়া লাভ নাই, একটা যেন বিপর্যয় ঘটিয়া গেল,—কোথায় গেল আলো, কোথায় হাওয়া, কোথায় গন্ধ! একখানি রাগিণীর সমস্ত সুরটিকে বিকৃত করিয়া একটা বিসম্বাদীর পর্দা যেন ঝঙ্কার করিয়া উঠিল। একবার করুণ নেত্রে সেই চেয়ারটার দিকে চাহিলাম—এক মুহূর্তের বিভ্রম মাত্র; তখনই আবার নিজেকে সামলাইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম, “এই যে, আসুন আসুন।”

গৌরীকান্ত বসির্তে বসিতে বলিলেন, “আসতেই হল। আপনিও বোধ হয় আমার জন্যেই হাঁ করে বসে আছেন, চেয়ার পর্যন্ত মজুত দেখছি যে! ও হতেই হবে কিনা; রোজকার দেখা-শোনায় একটু অভ্যেস হয়ে গেছে। সেই নিমতলাটিতে আজ আর দেখতে পেলাম না, মনটা বড় খারাপ হয়ে রইল। এ সময়টা আবার প্লেগ-টেগ্‌ আরম্ভ হয়ে থাকে; ভাবলাম, হয়তো প্রথম আমাদের বাঙালীকেই ধরলে এবার। ওখান থেকে বাইরে হাওয়ায় আপনাকে বসে থাকতে দেখে প্রাণটা ঠাণ্ডা হল, না, যা ভেবেছি তবে তা নয়। তবুও মাঝে মাঝে বগলটা টিপে দেখবেন মশাই, সাবধানের মার নেই।’

কথাগুলো চরম গালাগালির এত কাছাকাছি যে কি রকম একটা অস্বস্তি বোধ হইতেছিল। নিরুপায় ভাবে বসিয়া রহিলাম, গৌরীকান্তবাবু বেশ সরল ভাবেই বলিয়া চলিলেন, “সাবধানের কথায় কাল সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে গেল। বেড়িয়ে এসে দেখি, খোলা ছাতে দিব্যি শেতলপাটিটিতে গিন্নি এক রকম গা আদুড় করেই শুয়ে। ওপরে বেশ হাওয়া; আর চাঁদের একটা ঠাণ্ডা এফেক্ট আছে তা তো জানেনই, কাল আবার মশাই পূর্ণিমা ছিল বোধ হয়। জানে এই সময়টা বাড়ি ফিরি আমি তবু জেনেশুনে এই বেয়াক্কেলেপনা। বেড়িয়ে এসে কোথায় একটু আয়েস করব, না দেখে তো গা জ্বলে গেল মশায়। একলা মানুষ—এই দোরসার সময়, দরকার কি চটাচটি করে? বুঝিয়েই বললাম ওগো, এটি হচ্ছে বেহারে প্লেগের সময়। এবারটা এখনও ভালো আছে বলে অতটা এলে দিও না। বড় বিষম রোগ, একবার ধরলে ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ ঘেঁষবে না। খদ্দর তো ভালোবাস বাপু, তবু ওই পাতলা শেমিজটা পরে কেন সময় বুঝে? চুল এলো করা মশায়!—গা ধুয়ে এসে শুয়েছে আর কি, চুলে জল লেগে আছে,—দেখলাম কিনা, চাঁদের আলোয় জায়গায় জায়গায় ঝিকমিক করছে, তাই শুকোনো হচ্ছে আর কি। খোঁচা দিতে ছাড়ব কেন ইয়েবাবু, বললাম সূর্যের আলোতেই চুল শুকোয় জানি, চাঁদ বেচারা—। ঠিক এই পর্যন্ত বলেছি; সে রাগ দেখে কে! গটগট করে নেমে গিয়ে রান্নাঘরে খিল দিলে, সেই গরম গুমট ঘর! কথাগুলো তো শুনলেন, রাগের কিছু পেয়েছেন? ফল হল, ভাত গেল গলে, ডাল গেল ধরে, তরকারি হল নুনে বিষ। কি, না একটু বুঝিয়ে বলতে গিয়েছিলাম বলে। কিসের জন্যে তবে সংসার করা, বলুন না?”

আমি বোধ হয় একটু বেশি রকম অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিলাম, গৌরীকান্তবাবুর কথাতেই আবার চমক ভাঙিল; বলিতেছেন, “আক্কেলখানা দেখে ভাবছেন তো? চুলোয় যাক। কপালের লেখন কে ঠেকাবে বলুন? তা আজ যে বেরোন নি?”

একটা কথা কহিবার সুবিধা পাইয়া তাড়াতাড়ি বলিলাম, “সন্ধ্যের সময় বেরুতাম, কিন্তু চমৎকার জ্যোৎস্নাটির লোভ—”

এতটা বলিয়া হুঁশ হইল, জ্যোৎস্না তারিফ করিবার খুব লোক পাইয়াছি তো।

গৌরীকান্তবাবু ততক্ষণে কথাটা লুফিয়া লইয়াছেন, বলিতেছেন, “হাঁ, দিব্যি জ্যোৎস্নাটা। এ কথা একশো বার স্বীকার করি। তা আপনার আমার আর কি বলুন? লাভ মিউনিসিপ্যালিটির।”

সপ্রশ্ন নেত্রে মুখের দিকে চাহিতে আমার মূঢ়তার জন্য সদয় ভাবে বলিলেন, “সে খোঁজ বুঝি রাখেন না? রাস্তায় ল্যাম্প-পোস্টগুলোর দিকে চেয়ে দেখুন দিকি—জ্বেলেছে একটাও? স্রেফ হিসেবের খেলা। ওই যে সকালে সিঁড়ি ঘাড়ে করে পোস্টে পোস্টে তেল যুগিয়ে বেড়ায়, ওদের বুঝি সোজা ভাবেন? কি তিথিজ্ঞান মশায়! আজ এই মাসের এই তিথি,—এতটা তেল লাগবে। চাঁদ উঠেছে কি আলো নিবল, মুখ-দেখাদেখি নেই। ওই যে বললাম, চাঁদ ওঠে মিউনিসিপ্যালিটির বরাতে; মারা পড়ে কবি, বিরহিণী আর চোর।”

একটু গুমট ছিল খানিকক্ষণ, সেটাকে ছিন্ন করিয়া একটা দমকা হাওয়া বহিল। গৌরীকান্তবাবু হঠাৎ সোজা হইয়া বসিয়া দ্রুত নিশ্বাস টানার সঙ্গে সঙ্গে দুই-তিন বার নাসিকা কুঞ্চিত করিলেন। অনেকটা যেন নিজের মনেই বলিলেন, “ফুলের গন্ধ পাচ্ছি যেন কাছে-পিঠে বাগান-টাগান আছে নাকি?”

ভয়ে একেবারে কাঁটা হইয়া রহিলাম, সাক্ষাৎ ফুলের বাগান রাখার লাঞ্ছনা মনে মনে আন্দাজ করিয়া আর কথা কহিতে সাহস হইল না।

এই সময় বাতাসের ঢেউয়ের গায়ে আর একটা ঢেউ ভাঙিয়া পড়িল, আরও বেশি গন্ধ লুটিয়া আনিয়াছে, আরও বিলাসোচ্ছল।

গৌরীকান্তবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস টানিয়া বলিলেন, “এ যে রজনীগন্ধার গন্ধ ইয়েবাবু, কি যে দিব্যি নামটি, ভুলে গেলাম; বাগানের শখ আছে নাকি আপনার?”

আমতা আমতা করিয়া বলিলাম, “বাগান না ছাই! ওই পাশে এক টুকরো জমি পড়েছিল, ওরা সব কি দু-একটা ফুলের ডাল বুঝি কবে—”

নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব লইতে আর সাহস হইল না। গৌরীকান্তবাবু বলিলেন, “দুটো একটা ফুলের ডালই বা এ কাঠখোট্টার দেশে কে বসাবে বলুন তো? আমি তো এসে পর্যন্ত হা-ফুল জো-ফুল করে বেড়াচ্ছি। কই আপনি তো কখনও বলেন নি আমায়! ইঃ!”

আমি তো নিজের চক্ষু-কর্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলাম না; এই কি সেই গৌরীকান্তবাবু নাকি? বিস্ময়ের উগ্রতায় এমন একটা অবস্থায় আসিয়া পড়িয়াছি, মনে হইতেছে, এখনই বুঝি দেবমূর্তি পরিগ্রহ করিয়া বলেন, বৎস, এতদিন তোমায় ছলনা করিতেছিলাম মাত্র।

সেই মানবমূর্তিতেই বলিয়া যাইতেছিলেন, “উঃ, কি আপসোস বলুন দেখি! আপনাদের বাড়িতে তা হলে দেখছি উল্টো। আপনার স্ত্রীরই শখ। আমার তো তিনি বাড়িতে ফুল দেখলে আগুন হয়ে ওঠেন। আর দুঃখের কথা বলবেন না।”

আচ্ছা সমস্যা তো!

ভাবিলাম, হইতেও পারে; লোকচরিত্র বোঝা কঠিন। মনস্তত্ববিদ হইলে বোঝা যাইত মস্তিষ্কের মধ্যে সৌন্দর্যজ্ঞানের কোন্ সূক্ষ্ম কোষগুলি এঁর বেশি প্রবুদ্ধ! হইতে পারে ফুলের উপরেই নিজের প্রীতিধারা এমন নিঃশেষ করিয়া করিয়া ঢালিয়া দিয়াছেন যে, অন্য কিছুর উপরই আর রসসিঞ্চন হয় না; বাকি সবই ফিকা ওঁর কাছে।

যাক ওসব বড় কথা। লোকটি তাহা হইলে যে একেবারেই নীরস, তাহা নয়। ইদানীং ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে ক্রমেই এত বিব্রত হইয়া পড়িতেছিলাম যে, মনে মনে একটা স্বস্তি অনুভব করিলাম। সাহস করিয়া, যদিও খুব সন্তর্পণের সহিত, বলিলাম—“ওর নাম কি, আমি ও বোধ হয় কখনও দু-একটা এ গাছ সে গাছ লাগিয়ে থাকব।”

“তা হলে উঠতেই হচ্ছে মশায়; ও যে আমার কি নেশা–কোন্ দিক দিয়ে রাস্তা বলুন দিকি?”

দাঁড়াইয়া উঠিয়াছেন। আমি কৃতকৃতার্থ হইয়া গিয়াছি; এ অনাড়ম্বর, প্রচ্ছন্ন সৌন্দৰ্য- উপাসকের দর্শনেও পুণ্য। কিন্তু রাত্রিকাল—। বলিলাম, “এখন না হয় থাক গৌরীকান্তবাবু, বাগানটা একটু জঙ্গুলে, তায় গোটাকতক কেয়া ফুটেছে, গরমের রাত্রি’

“কেয়াফুল! না ইয়েবাবু, আমার ফুলের বাতিক দেখে আপনি নিশ্চয় ঠাট্টা করছেন! এই মরুভূমির মাঝখানে কেয়াফুল! এ হতেই পারে না।”

“না, সত্যিই ফুটেছে। একঝাড় গাছ করেছি কিনা। এঃ, আপনি ফুলের এত ভক্ত জানলে মাঝে মাঝে পাঠিয়ে দিতাম; কত ফুলই যে রোজ নষ্ট হয়!”

“ফুল আমার প্রাণ মশায়, না হলে দিন চলে না; ওই যে বললাম, ফুল এক মৌমাছিই চেনে কি গৌরীকান্তই চেনে, এইটুকু গুমর আমার আছে, হ্যাঁ। কাব্যচঞ্চু মশায় নাম রেখেছিলেন, মধুলিড়, মধু লেঢ়ি অর্থাৎ লেহন করে ইনি মধুলিট্ কিনা ভ্রমর—তাই তো— নাঃ, এখন মোটেই বাগানে যাওয়া সমীচীন নয়, কিনা বলেন? তাঁরা আবার আমাদের চেয়েও শৌখিন, ঘাঁটানো ঠিক নয়।”

আস্তে আস্তে আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। এমন সমদরদী কখনও পাই নাই, মধুলিড়ই বটে, বাহিরটাতে কি আসিয়া যায় তাহার? একটা গুমর ছিল; কিন্তু ফুলের আদর তো দেখিতেছি, আমরা কিছুই জানি না। এঁকে সামান্য একটুও তৃপ্ত করা যায় না? চাকরটাকে ডাক দিলাম। আসিলে বলিলাম, “দেখ দিকিন, আজ ফুল কিছু তুলেছ কি না, থাকে তো নিয়ে আয়।”

প্রায়ই কিছু ফুল তোলা থাকে। একটা তোড়া আর কতকগুলো আলগা ফুল লইয়া আসিল—বেলা, গন্ধরাজ, একটা লবঙ্গলতার গুচ্ছ, হালকা ভাবে জলের ছিটা দেওয়া।

এত আগ্রহ কখনও দেখি নাই, গৌরীকান্তবাবু এক রকম লাফাইয়াই উঠিয়া হাত দুইটি প্রসারিত করিয়া ধরিলেন, বলিলেন, “ইস, স্বর্গ যে উজোড় করে এনেছ! এসব আপনার নিজের বাগানে ফুটেছে? কাল সকালেই আবার বিরক্ত করতে আসছি—যাই না মনে করুন।”

গদগদ হইয়া বলিলাম, “নিশ্চয়ই আসবেন। আমি নয় ডেকে নিয়ে আসব’খন খুব ভোরবেলা; সে সময় যা হয়ে থাকে!”

ছোট শিশুর মতো আনন্দ সমস্ত মানুষটিকে এত স্বচ্ছ করিয়া দিয়াছে—যেন অন্তস্থল পর্যন্ত দেখা যায়। শিশুর মতোই হাসিয়া বলিলেন, “আপনি আমার ডাকবেন? তবেই হয়েছে। দেখবেন, রাত থাকতে এসে হানা দিয়েছি; যা নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন!”

.

আমার যাইবার আগে তিনিই আসিয়া হাজির অতি প্রত্যূষে। প্রথম কথা, “সমস্ত রাত ঘুম হয় নি মশায়; চলুন কোন্ দিকটা?”

বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মুগ্ধ প্রশংসায় গৌরীকান্ত দুয়ারটির কাছে দাঁড়াইয়া রহিলেন। যে দিকটায় চান, দৃষ্টি যেন আর ফিরাইতে পারেন না। মুখে কথা নাই, শুধু একটা আবেগমাখা হাসি।

ফুলের গন্ধও তাহাদের এই ঊষার অতিথিদের অভিনন্দিত করিবার জন্য যেন ভিড় করিয়া পড়িয়াছে।

পরিচয় দিতে লাগিলাম, “এটা ডালিয়া, ঠিক এখন ফোটবার সময় নয়, তবুও একটা না একটা ফুল থাকেই,—এই ফুটন্তদের দলে পড়ে বেচারা যেন চক্ষুলজ্জায় পড়ে গেছে আর কি। এ রকম বেলা আপনি এ তল্লাটে পাবেন না। যোগাড় করতে যা বেগটা পেতে হয়েছে, লিখলে একটা ইতিহাস হয়ে যায়; ওর চেয়ে রাজপুতরা তাদের কনে উঠিয়ে আনত ঢের সহজে। খোশামোদ করতে হয়েছে, ঘুষ খাওয়াতে হয়েছে, তাতেও যখন হল না, তখন চোর বনতে হল। একটা ডাল কেটে এনেছিলাম।”

গৌরীকান্ত বলিলেন, “এ চুরিতে পাপ নেই। আমি তো ভেবেছিলাম সাদা গোলাপ। বেলার এত পাপড়ি। আর রসে যেন ভেঙে পড়ছে পাপড়িগুলো!”

এমন উৎসাহভরে কখনও ফুলের ব্যাখ্যান করি নাই। কোথায় এমন সমঝদারই বা এ রূক্ষ পৃথিবীতে?

গোলাপ ফুটিয়াছে—মার্শাল নীল। তাহার চাঁপার মতো রঙে কোথাও একটু গোলাপী রেখা—কাঁচা সোনা যাহার রঙ তাহারই রাঙা ঠোঁটের হাসির মতো। তুলিতে হাত উঠে না; কিন্তু পূজার আগ্রহটা প্রবল। একটা তুলিয়া হাতে দিলাম। বলিলাম, “সটন্‌স প্রাইড নাম দিয়েছে। এর স্বগোত্র প্যারিস এক্‌জিবিশনে প্রথম প্রাইজ পায়; দেখুন না, ফোটার মধ্যে বেশ একটি দেমাকের ভাব নেই? আর একটা জিনিস দেখাচ্ছি, এই দিকে আসুন।”

পথে মা’র কুমড়ালতা অবহেলায় লঙ্ঘন করিয়া যাইতেছিলাম। গৌরীকান্তবাবু পিছনে আসিতেছিলেন, থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, “ইয়েবাবু! কি যে দিব্যি নামটি, ভুলে গেলাম—”

বলিলাম, “গোবর্ধন।”

“হ্যাঁ, ঠিক। মশায়, এ কি কুমড়োর ফুল?”

বলিলাম, “হ্যাঁ, কাঁচড়াপাড়া থেকে বিচি আনানো; মা’র একেবারে প্রাণ বললেই চলে; বোধ হয় আমি ছেলে হয়েও অত যত্ন পাই নি।”

“এ জিনিস আমার গোটাকতক চাইই চাই—এ যে বাগান আলো করে রয়েছে একেবারে।”

কাল সন্ধ্যার সময় যখন অমন জ্যোৎস্না-রাত্রিটার লাঞ্ছনার কথা শুনিতেছিলাম, মনে মনে ভাবিতেছিলাম, কি করিয়া এই শুষ্ক কাষ্ঠের মতো অতি নীরস মানবটিকে সৌন্দর্যরসে দীক্ষিত করা যায়! এখন দেখিলাম, ইহার মধ্যে রসের গূঢ় রহস্যটি ধরা পড়িয়াছে। এই তো দরদ, যাহা প্রভেদ বোঝে না, যাহা উচ্চনীচ নির্বিশেষে সমস্তর উপরেই উচ্ছ্বসিত হইয়া পড়ে। নূতন চক্ষে কুমড়ার ফুল দেখিতে লাগিলাম। মৃণালের চেয়েও শীর্ণ, সুকুমার বৃত্তের উপর গোলাপী মেশা হলুদরঙের ফুলগুলি, তাহাদের একটি দলেই কি সুষমাই না ফুটিয়া উঠিয়াছে! নিজেকে এমন পরিপূর্ণভাবে মেলিয়া কোনো ফুলই বোধ হয় ফুটিতে পারে না। গোটাকতক তুলিলাম, আমার আঙুলগুলা যখন আবীরে ভরিয়া গেল।

গৌরীকান্তবাবু তাড়াতাড়ি অথচ খুব আলগা হাতে আমার নিকট হইতে ফুলগুলা তুলিয়া লইলেন, বলিলেন, “দেখবেন, ওগুলো হল পরাগ, খুব বাঁচিয়ে, ওই তো আসল। ওই যে রজনীগন্ধা! তাই তো বলি, এত ফুল না হলে কাল অত গন্ধ আসছিল কোথা থেকে! ওর কেরামতি রাত্তিরে, থাক, রাত্তিরেই এসে নিয়ে যাব’খন; ততক্ষণ যতটা রস টানে। চলুন, এইবার আপনার কেয়া দেখি গে, সংস্কৃতে হলেন কেতকী—”

“কেতকীরেণু খদির রসে দিয়া,
শুকায়ে নিও কমল কিশলয়ে।
অধর তাতে সুরভি করে প্রিয়া,
আমারে দিও মরণ বিলাইয়ে।

“একটুখানির মধ্যে কেয়া-খয়েরের ফর্মুলাটি কেমন দিয়ে দিয়েছে। খয়েরের রস করে তাতে কেয়ার ধুলো দিয়ে কচি পদ্মপাতায় শুকিয়ে নেবে। আগেকার তারা সব ফুলপাতার সঙ্গে ঘর করত। সেদিন ওর একখানি বইয়ে দেখছিলাম না! শকুন্তলার জ্বর এল, তক্ষুনি চন্দন ঘষে পদ্মপাতায় লেপে বসিয়ে দিলে; এখন হলে—ছোটা মোটর, ডাক্ সিবিল সার্জনকে—”

.

আমরা পুষ্পলোকে বাস করিতেছি বলিলেও চলে। সমস্ত দিন কেবল ফুল, ফুল আর ফুল।

গৌরীকান্তবাবু সকালে আসেন, সন্ধ্যায় আসেন। সময়টা প্রায়ই বাগানে কাটিয়া যায়। ফুলের পরিচর্যা, ফুলের আলোচনা, আর পাত্র ভরিয়া ফুল সঞ্চয়-—এই কাজ। বলেন, “নন্দনকানন সম্বন্ধে যা শোনা যায় তা কতকটা এই রকম হবে, কি বলেন ইয়েবাবু?”

তাঁহার জন্য একটি সাজি কিনিয়াছি; সেইটিই পূর্ণ করিয়া ফুল দিই। সাজি ভরিয়া ফুল দিয়া মনে হয়, এ পূজা; তাঁহার অন্তরের মন্দিরে যে সৌন্দর্যের দেবতা আছেন, তাঁহাকে অর্ঘ্য দিতেছি।

দেবতার সংস্পর্শে আমার বাগানের শ্রীবৃদ্ধিও হইয়াছে। কোথায় এঞ্জিনীয়ারের বাগান, কোথায় কমিশনার সাহেবের গ্রীন-হাউস, এই সব দুষ্প্রবেশ্য স্থান হইতে কতকগুলি নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য আর দামী ফুল আমার বাগানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; বেশির ভাগই গৌরীকান্তবাবুর চেষ্টায়। সে সবের মধ্যে একটা আছে নীলপদ্ম। কাশ্মীর স্টেট-গার্ডেন্‌স হইতে আমদানি করা, ভূস্বর্গের পারিজাত। বাগানের মাঝখানে ইহারই জন্য একটি হৌস হইবে স্থির হইয়াছে, মাঝখানে থাকিবে একটি ঝরনা।

বলি, “এত কষ্ট করে যোগাড় করে সব আমায়ই দিয়ে দিচ্ছেন, কিছু তো আপনিও রাখলে পারেন।”

বিমর্ষ ভাবে কপাল স্পর্শ করিয়া বলেন, “সে অদৃষ্ট করি নি ইয়েবাবু, তা হলে আর ভাবনা কি! হাজির হতে দেরি হবে না, গিন্নি সঙ্গে সঙ্গে টান মেরে ফেলে দেবেন। কি যে আক্রোশ, দেখেন নি তো! সে পক্ষের সঙ্গে কিছুই মেলে না, মেলে শুধু এইখানটায়।”

রহস্য এইখানেই শেষ নয়, আরও আছে। আজকাল আমাদের দুইটি বাড়ির স্ত্রীমহলেও ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে, আমার স্ত্রী প্রায়ই যান! ফিরিয়া আসিয়া রোজই বলেন, “আচ্ছা, এই যে ঠাকুরপুজোর ভাগ থেকে কেটে কেটে নিত্য সাজি-ভরা ফুল পাঠাও, কই, বাড়িতে তো কোথাও একটা পাপড়িও দেখতে পাই না!”

বলি, “তুমি বোধ হয় খোঁজ কর না।”

উত্তর হয়, “ওমা, অবাক করলে যে! বলে গোয়েন্দাগিরি করতেই আজকাল আমার যাওয়া। আর ফুল কি শুধু দেখতে হবে! যা ফুল যায়, তাতে সারা বাড়িটা গমগম করবে না? কি যে বল!”

বলি, “দু বেলা টাটকা ফুল যাচ্ছে, তাই বাসী হওয়া মাত্রই নিশ্চয় ফেলে দেন। তুমি যাও তো সেই তিনটে-চারটের সময়, তখন বোধ হয় তাই আর দেখতে পাও না।”

তাহাও নয়; কেননা আমার গোয়েন্দাটি দুই দিন পরে আসিয়া খবর দিলেন, “আজ ওত পেতে ছিলাম, কর্তা আপিসে বেরিয়ে যেতেই হাজির হয়েছি, ঠিক এগারোটা দশ। ফুলের বিন্দুবিসর্গ নেই। সাতটা-আটটার সময় তোলা ফুল দশটা-এগারোটার সময় বাসী মনে করে, এমন পুষ্পবিলাসীও আছে নাকি?”

বলিলাম, “ওঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে দেখলে তো পার।”

“সেও হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলেই কথা উল্টে নেয়, মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে পড়ে, তার ওপর খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করা চলে না। এমনিই তো বেশ আমুদে মানুষটি!”

একটু হতবুদ্ধি হইয়া রহিলাম। তাহার পর একটা কথা মনে উদয় হইল, বলিলাম, “হয়েছে গো, নিশ্চয় পুজো-টুজো করেন; কথাটা আমাদের কাছ থেকে গোপন—”

স্ত্রী গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “স্বামী পুজো-আর্চা করলে, নিষ্ঠাবান হলে হিন্দুর মেয়ের লজ্জিত হবার তো কথাই নয়; বরং নাস্তিক, অনাচারী হলে—”

মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে কথাটা পাল্টাইয়া লইতে যাইতেছিলাম, স্ত্রী বলিলেন, “আমি যা ভেবে ঠিক করেছি, শুনবে?”

আমি আগ্রহভরে বলিয়া উঠিলাম, “বল না।” মনে ঠিক আছে; যতই সম্ভবপর আন্দাজ হউক না কেন, একটা খুঁত বাহির করিয়া আক্রোশ মিটাইবই—টাটকা-টাটকি।”

স্ত্রী বলিলেন, “আমার মনে হচ্ছে, সাহেব-টাহেবের বাড়ি ভেট পাঠায়।”

অসম্ভব নয়। আমি কিন্তু তাচ্ছিল্যের সহিত হাসিয়া বলিলাম, “আরে দ্যুৎ, রোজ রোজ—”

তিনি সহজ দৃঢ়তার সহিত বলিয়া চলিলেন, “না হলে সাহেবের কাছে অত খাতির আছে শোনা যায়, সে কি করে হয়? মাইনেও বেড়েছে এরি মধ্যে বলেছিলে। ফুল দিয়ে খোশামোদ করবার ফল নিশ্চয়।”

যুক্তিটা সহজেই খণ্ডন করিবার নয়, সেইজন্যই বেশি অবহেলা দেখাইয়া হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া তর্কটা চাপা দিলাম।

সন্ধ্যার সময় গৌরীকান্তবাবু আসিলে বলিলাম, “মশায়, আপনি ফুলের কি ভাবে সদ্ব্যবহার করেন, সেই নিয়ে আমাদের স্ত্রী-পুরুষে কাল সমস্ত রাত গভীর গবেষণায় কেটেছে। আপনার ভাদ্দরবউয়ের যত আজগুবী আন্দাজ, বলে—বাড়িতে ফুল দেখতে পাই না, নিশ্চয়ই একটু বাসী হলেই ফেলে দেন। বললাম—আরে ধ্যাৎ—একেই বলে মেয়েলী বুদ্ধি! বড় বড় সাহেবদের সঙ্গে আলাপ, তাদের সব ভেট-টেট দেন নিশ্চয়। বলে— হ্যাঁ, তোমার যা বুদ্ধি অমন চমৎকার ফুলগুলো ওই মেলেচ্ছগুলোর পায়ে ঢালতে যাবেন! সাত্ত্বিক মানুষ, নিশ্চয় পুজো-টুজো করে বাসী হলে আবার ফেলে দেন।”

গৌরীকান্তবাবু খুব মনোযোগ সহকারে শুনিতেছিলেন, এইবার প্রবল বেগে হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, “দেখছিলাম, কার কতটা বুদ্ধির দৌড়! সে ধরবার জো নেই তো গবেষণা করে কি হবে? তবুও উনি পুজোর দিকে গেছেন, অনেকটা কাছাকাছি; তবে কার পুজো, ধরতে পারেন নি, হাঃহাঃ—। তবে, আর দেরি নয়, এইবার জানাব। তখন বুঝতে পারবেন, ফুলগুলো এতদিন কি ভাবেই না নষ্ট করে এসেছেন! একটু দেরি করছিলাম, এদিকে মল্লিকার গোড়েটা ঠিক তোয়ের হয় নি এতদিন। এদিকে বোধ হয় পদ্ম দুটোও ঠিক পুরন্ত হয়ে ফুটেছে, আর সেই কেয়াটা—চলুন, দেখা যাক।”

বাগানের মাঝে দাঁড়াইয়া একবার চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন, “না, সব ঠিক আছে। তবে আজই হোক, বুঝলেন ইয়েবাবু? কি যে দিব্যি নামটি—”

বলিলাম, “গোবর্ধন।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। আজ ফুলের বাহার দেখবার নেমন্তন্ন; ওইখানেই পায়ের ধুলো দেবেন। ভাগ্যগুণে আজ খাসা একটি মিরগেল মাছও পাওয়া গেছে। আর ডিম নিশ্চয় খান—ছোট? তবে হ্যাঁ, ঠাকুরটিকে চাই আপনার। গিন্নি বলেন, আমি আজ রান্নাঘরের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে পারব না। কাজ কি ও-জাতকে ঘাঁটিয়ে মশায়? বললাম, বেশ, ওঁর ঠাকুরকে ডেকে আনছি, দেখিয়ে শুনিয়ে দোব’খন, তুমিও তো আজ আমার কাছে থেকেই গুণী। আর ওঁর স্ত্রী বোন সব আসছেন, তোমার এদিকে থাকলে চলবেই বা কেন?”

.

আহারে বসিয়াছি। গলদঘর্ম গৌরীকান্তবাবু সামনে একটি টুলে বসিয়া পাখার হাওয়া খাইতেছেন; এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিলেন। নানা ফুলের একটা ক্ষীণ মিশ্র গন্ধ যেন মাঝে মাঝে নিশ্বাসে ধরা দেয়; কিন্তু ফুল কোথাও দেখিলাম না। শুধু সামনে একটা ছোট ঝুড়িতে আর সব আবর্জনার সঙ্গে সেই পদ্মের কতকগুলা পাপড়ি আর কেয়াফুলের কচিপাতা। বোঝাই যায়, ছোট মেয়েটির কীর্তি। “ফুলের বাহার’ নিশ্চয় উপরে শোবার ঘরে, খাওয়াদাওয়ার পরে লইয়া যাইবেন

বলিলেন, “ঠাকুর, এইবার নিয়ে এস চপ-টপগুলো। কি রকম হয়েছে কে জানে, একেবারে আনাড়ী লোক!”

ঠাকুর একটি রেকাবিতে এক প্রস্থ তরকারি ভাজা আনিয়া হাজির করিল। গৌরীকান্তবাবু প্রবল উৎসাহে নির্দেশ করিতে লাগিলেন, “আগে ওইটে দাও; বাতলান দিকি জিনিসটা কি?”

রজনীগন্ধার বাসের সঙ্গে ছোলার বেসনের সোঁদাটে গন্ধ।

“একেবারে জলের মতো পাতলা করে নিতে হবে বেসনটা—আগার দিকটা কেমন মুচমুচে তো? এইবার গোড়ার দিকটা একটু জিবের চাপ দিন; বেশ একটু মিষ্টি নয়? ওইটি হল মধু, ভাজার কারচুপিটা বুঝুন। এইবার ওইটি দাও বাবাজী। না বললেও নিশ্চয় ধরে নেবেন, গন্ধই যে ওকে ধরিয়ে দিচ্ছে; কেয়াফুলের চপ—মাছটিকে সেদ্ধ করে নিয়ে কাঁটা বেছে ফেলবেন, তারপর আস্তে আস্তে কেয়াফুলের ওপরকার কচি পাতাগুলা তুলে ফেলে ফুলটা কুচি কুচি করে ফেলবেন, মাইন্ড ইউ—কেয়ার ধুলোগুলো সব মাছেই পড়া চাই; তারপর—না না, ও তিনটেই খেতে হবে। গিন্নি করলেও একটা কথা ছিল; দেখছেন তো, যেন ফুলের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে উঠেছি, কম মেহনত! আচ্ছা, অন্তত আর একটা। এইবার এইটে দেখুন তো! দাও ঠাকুর। আপনার সেই নীলপদ্মের ডালনা, আপনি সাধ করে যার নাম রেখেছেন নীলা। কখনও এ ব্যাপার মাথায় ঢুকেছিল? সব পদ্মরই হয়, তবে এমনটি হয় না। এ জিনিসটির জন্যে আমি মাড়োয়ারিদের কাছে ঋণী। দেখবেন, পদ্মের সিজনে দোকানে ঝুড়ি ঝুড়ি পদ্ম কিনে রেখেছে, ভাবছেন বুঝি খদ্দের মারবার জন্যে রামচন্দ্রের মতো অকালবোধন করছে সব, হাঃহাঃহাঃ। আমারও ফুলের দিকে ঝোঁক। একদিন ধরলাম, বলি, শেঠজী—। ও কি ইয়েবাবু! ফুল খাবেন ফুলের মতো তাজা হয়ে, এ যেন ফাঁসিতে উঠতে যাচ্ছেন! নিন, পেয়াদা বসে আছি, হাত গুটোলে ছাড়ছি না। হ্যাঁ, কি যে বলছিলাম, সেই শেঠজীই আমায় বাতলে দিলে। একটু কামড় দিয়ে বললে, বাবু, ফুল তোমরা ব্যাভার করতে জান না। লজ্জায় ঘাড় হেঁট হয়ে গেল মশায়। অথচ এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। প্রথমটা পাপড়ি-টাপড়ি বাজে হিস্যেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিলেন, পাখিটির রোঁয়া তুলে ফেলবার মতো আর কি—দেখবেন নরম প্যাডের মতন একটা জিনিস, ছিঁড়ে ফাটিয়ে ফেলুন—দেখবেন ভাতের মতো দানা দানা, সবই ঘিয়ে ভেজে নিন—ওটা দিয়ে দাও ঠাকুর—খাবেন বইকি। তুমি ততক্ষণ ওদের কাছ থেকে বেলফুলের গোড়ের মোরব্বাটা নিয়ে এস। ওইটি বড় শক্ত জিনিস মশায়, একটু ভাজবার তারতম্য হল, কি রসের বে- আন্দাজ হল তো বাস্–বড্ড মোলায়েম জিনিস কিনা—এ তো আর আমলকিও নয়, কুমড়োও নয়—আপনার ঠাকুর তো এদিককার সব শিখেই ফেললে; যাক, যদি চলেও যাই এখান থেকে তো মাঝে মাঝে নাম করতে হবে। এর পরে কলকেফুলের শুক্তনি, শিউলির ঘণ্ট, চন্দ্রমল্লিকার গুড়-অম্বল—শিখিয়ে দোব’খন।”

ঠাকুর খালি হাতে আসিয়া বলিল, “মাইজী বললেন, আমি ছুঁতে পারব না, নিজে এসে বের করে নিয়ে যেতে বল।”

“ওই, তবু আপনারা কাব্যি করে বলবেন, নারী হল পুষ্পের জাত, মেয়েমানুষেরই ফুলের দিকে টান বেশি। কি যে বিষদৃষ্টি! সে গুমর করব আমি। সেই যে বলছিলাম না? কাব্যচঞ্চু মশায় বলতেন, গৌরীকান্ত, তুমি মধুলিড়।—বসুন, আমি নিজের হাতেই নিয়ে আসছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *