মধুরেণ – ৯

রোববার সকাল ন’টার সময় ঘুম থেকে উঠে দোতলায় নামল মধুরা। খাবার টেবিলের চারপাশে বসে মনোহর, যূথিকা, কৃশানু এবং দিয়া চার রকম কাজে ব্যস্ত। মনোহর কাগজ পড়ছে, যূথিকা রসগোল্লাকে অলিভ অয়েল মাখাচ্ছে, কৃশানু ব্রেকফাস্ট করছে, দিয়া পান্তুয়াকে দুধ খাওয়াচ্ছে। মধুরাকে দেখে দিয়া বলল, “পান্তুয়াকে ধরো তো!”

পান্তুয়াকে কোলে নিয়ে, চেয়ারে বাবু হয়ে বসে মধুরা গান ধরল, “আয় আয় আয়, শেয়ালে বেগুন খায়। তারা নুন কোথায় পায়? তারা দই সন্দেশ চিঁড়ে মুড়কি কিনে এনে খায়…”

“ঘুমপাড়ানি গানেও খাওয়ার কথা?” ফুটন্ত জলে চায়ের পাতা ফেলে বলে সবিতা, “ওই জন্যেই বর ভেগেছে!”

“আহ! সবিতা!” পান চিবুতে চিবুতে বলে যূথিকা, “আমাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে দাও।”

মধুরা আড়চোখে কৃশানুর দিকে তাকাল। চোখের ভাষায় নীরব প্রশ্ন, “মা কি আবার বিয়ে নিয়ে হ্যাজাবে?” কৃশানু চোখের ভাষায় জবাব দেয়, “ডেফিনিটলি!”

“দ্যাখো মধু, তোমার ফেরার পরে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল,” পানের জাবর কাটতে কাটতে বলে যূথিকা, “এ ক’দিন তোমাকে বিরক্ত করিনি। তুমি নানান কাজে ব্যস্ত ছিলে। এবার কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”

“প্রশ্নটা শুনি।”

“এখন কী করবে? চাকরি?”

“না।”

কৃশানু ফুট কাটল, “ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় জয়েন করে যেতে পারিস মধু। তোর লেভেলে এখন অনেকগুলো এনট্রি আছে। পুনে আর বেঙ্গালুরুর পে প্যাকেট বেটার বলে ছেলেমেয়েরা কলকাতায় ফিরতে চাইছে না।”

“থ্যাঙ্কস ফর দ্য ইনফো। আমি চাকরি করব না।”

যূথিকার তেল মাখানো শেষ। রসগোল্লাকে কৃশানুর কোলে দিয়ে সে বলে, “লন্ডন ফিরবে না। চাকরিও করবে না। তা হলে কী করবে কিছু ভেবেছ?”

“একটা আইডিয়া আছে… সেটা ইমপ্লিমেন্ট করতে কিছুদিন সময় লাগবে…”

“যাক! তোমার হাতে যখন কিছুটা সময় আছে, তা হলে এর মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলো।”

“বিয়ে?” যূথিকার দিকে তাকায় মধুরা, “খারাপ আইডিয়া নয়। কিন্তু বিয়ে করতে একটা ছেলে লাগে। সেই মক্কেলকে কোথায় পাব?”

“শারুক খানের মতো ছেলেটা হাত থেকে ফসকে গেল, তোমার লজ্জা করে না?” ঠক করে মধুরার সামনে এক কাপ চা রেখে সবিতা বলে, “বাঙালি ছেলে হয়ে অ্যাংলো মেয়েকে বিয়ে করল… ছি ছি ছি!”

যূথিকা হাত নেড়ে সবিতাকে থামায়, “লাভ ম্যারেজ যখন কপালে নেই তখন দেখাশুনোর বিয়েই করতে হবে। কৃশানুকে বলেছি, পাত্রপাত্রী কলামে অ্যাড দিতে। পাত্রপাত্রীর একটা এজেন্ট ওতোরপাড়ায় থাকে, তাকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলেছি। সামনের রোব্বারে যেন অ্যাড যায়।”

মধুরা চা খেতে খেতে সবাইকে মাপল। শান্ত গলায় ডিক্লেয়ার করল, “অ্যাডে লিখে দিও, পাত্রী ব্যাবসা করে।”

“পাত্রী কী করে?” চিল চিৎকার করে ওঠে সবিতা।

“পাত্রী ব্যাবসা করে।” কেটে কেটে বলে মধুরা। “বাবা যে কাজটা করে আমাদের বড় করেছে, আমিও সেটাই করতে চলেছি। বাবার মফস্‌সলে মিষ্টির দোকান আছে। আমি কলকাতা শহরে পার্টনারশিপে রেস্তোরাঁ খুলতে চলেছি।”

“ব্যাবসা? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?” আঁতকে ওঠে কৃশানু।

“তোমার মাথার থেকে কি খাওয়ানোর ভূত নামবে না?” আবার চেল্লায় সবিতা।

“পার্টনারশিপ? কার সঙ্গে?” মধুরার চোখে চোখ রেখে জানতে চায় মনোহর।

মধুরা বাধ্য হয়ে পুরো ঘটনা বলে। সুলতান সিং থেকে শুরু করে শীল ম্যানশন, ডুঙ্গারমল পারেখ এবং মিস জোনাকি পর্যন্ত। প্রয়োজনীয় এডিটিং সত্ত্বেও মিনিট দশেক লাগল।

মধুরার বকবকানি শুনতে শুনতে যূথিকা কাঁদছিল। কথা শেষ হওয়ার পরে বলল, “দাদুর বয়সি অবাঙালি বুড়ো আর মায়ের বয়সি নাচুনির সঙ্গে ব্যাবসা? আমাদের পরিবারের সম্মান ধুলোয় না মেশালে কি তোর শান্তি নেই? তোরা কী চাস? আমি গলায় দড়ি দিই? না গঙ্গায় ঝাঁপ দিই?”

মধুরা জানত, এই সমস্যা তাকে ফেস করতে হবে। হোমফ্রন্ট সামলানো সবচেয়ে শক্ত কাজ।

“ওই রকম কেন বলছ মা?” ঠোঁট ফুলিয়ে, নাকের পাটা অল্প কাঁপিয়ে, চোখের পাতা ফড়ফড় করে মধুরা বলে, “মিস জোনাকি একজন উকিল। অতীতে নাচতেন। এখন রীতিমতো লিগাল প্র্যাকটিস করেন।”

মনোহর বলল, “তুই লন্ডন থেকে কত টাকা রোজগার করে এনেছিস, তা আমি জানতে চাই না। কিন্তু, দুটো অচেনা লোকের সঙ্গে রেস্তোরাঁ চালানোর মতো ঝক্কির ব্যবসায় নামবি? আর একটু ভেবে দেখলে ভাল হত না?”

“আমার ভাবা হয়ে গেছে বাবা। আমি শুধু তোমাদের অনুমতি চাই।”

যূথিকা কেঁদেই চলেছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। মনোহর বলল, “আমি দেখছি কে এল।”

কৃশানু আর দিয়া রসগোল্লা-পান্তুয়াকে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। সিঁড়ি থেকে মনোহর চ্যাঁচাল, “হ্যাঁগো! শুনছ, তোমার ভাই আর ভাইবউরা কোলাঘাট থেকে এসেছে। তোমার বাবার খুব শরীর খারাপ। হাসপাতালে ভরতি আছে।”

*

মধুরা ইয়ারকি মেরে বলে, “আমার কাছে মামার বাড়ির কোনও স্মৃতি নেই। কোনও ইরানিও নেই।”

বোনের এই অবজার্ভেশানের সঙ্গে কৃশানু একমত। যূথিকা বাপের বাড়ি গেছে, এমন বদনাম তার সবথেকে বড় শত্রু, অর্থাৎ মনোহরও করতে পারবে না। সে উলটে খোঁটা দেয়, “জামাইষষ্ঠীতে ছেলে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। দুদিন পরে জামাই নিয়ে মেয়েও আসবে। আমার আর এই জন্মে ষষ্ঠী খাওয়া হল না।”

এই একটা ঝগড়ায় যূথিকা হেরে যায়।

মনোহর আর যূথিকার লাভ ম্যারেজ। মনোহর বন্ধুদের সঙ্গে দিঘা বেড়াতে যাচ্ছিল। কোলাঘাটের ধাবায় সব বাস জলখাবার খাওয়ার জন্যে আর বাথরুম করার জন্যে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ায়। ধাবাতে চার চোখের মিলন হয়েছিল। যূথিকা তখন ক্লাস সেভেন।

যূথিকা বা মনোহর বিয়ে নিয়ে মুখ খোলে না। টুকটাক বেফাঁস কথা থেকে মধুরা আন্দাজ করতে পারে যে যূথিকা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। সেই কারণেই বাপের বাড়িতে তার প্রবেশাধিকার নেই। যদিও মা মিনতিবালার সঙ্গে সপ্তাহে একবার মোবাইলে কথা বলে। ন’মাসে ছ’মাসে মধুরাকে দিয়ে ‘মানি অর্ডার’ করায়। প্রাপক, কালোসোনা সরকার।

কালোসোনা যূথিকার বাবার নাম। দুই ভাইয়ের নাম অর্জুন আর পিয়াল।

যূথিকার বাবা, মধুরার দাদু কালোসোনার শরীর খারাপ? মধুরার দুই মামা আর দুই মামি এসেছে? উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে এগোয় মধুরা। যূথিকা পিছন থেকে হিসহিল করে বলে, “দয়া করে ওদের ওপরে তুলো না।”

“কেন?” ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায় মধুরা। আজ সে মাকে বাগে পেয়েছে। বিয়ে-বিয়ে করে পাগল করে দেওয়ার শোধ তুলবে।

“আমার হুকুম!”

“অতিথি ভগবানের মতো!” হালকা হেসে মধুরা নীচে নামে।

ভৌমিক ভবনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারজন মানুষ। মধুরা দ্রুত তাদের মেপে নেয়।

প্রথম লোকটির বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। বেঁটে, মোটা, কালো, মাথায় টাক। যেটুকু চুল কানের ওপরে আর ঘাড়ের দিকে আছে, সাদা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। অযত্নে বাড়া গোঁফ আর না কামানো দাড়ির সবটাই সাদা। প্রৌঢ় মানুষটি এত দ্রুত বার্ধক্যের দিকে কেন যাচ্ছে সেটা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। জালার মতো পেট, চোখের নীচে পাউচ, থলথলে চেহারা বলে দিচ্ছে, মানুষটি মদ্যপায়ী। এ মধুরার বড়মামা অর্জুন।

দ্বিতীয় লোকটির চেহারা অর্জুনের ঠিক উলটো। বছর চল্লিশের লোকটি লম্বা এবং রোগা। গায়ের রং ফরসা। মাথা ভরতি বাবরি চুল। ক্লিন শেভ্‌ড। চেহারায় পালিশ আছে। এর নাম পিয়াল।

অর্জুনের পিছনে দাঁড়িয়ে দশাসই চেহারার এক মহিলা। মেরেকেটে সাড়ে চার ফুট হাইট। গায়ের রং দুধে আলকাতরায়। পরনে হলদে রঙের লালপেড়ে শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজ। চপরচপর করে পান চিবোচ্ছে আর মধুরাকে মাপছে। এই রকম মহিলাদের বাংলা ভাষায় ‘খাণ্ডারনি’ বলে।

পিয়ালের পিছনে দাঁড়ানো মহিলার লম্বা, দোহারা চেহারা। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, মুখ শুকনো। শঙ্কিত, জড়োসড়ো বডি ল্যাঙ্গোয়েজ। মুখচোখ দেখে মনে হয়, কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলবে। ইংরিজিতে এদের বলে, ‘ক্রাইবেবি’। বাংলায়, ছিঁচকাঁদুনি।

মধুরার মানুষ মাপা কমপ্লিট। সে হাত জোড় করে বেঁটে লোকটাকে বলল, “আপনিই অর্জুনমামা, তাই তো?”

বেঁটে কিছু বলার আগেই খাণ্ডারনি বলল, “ও তোমার বড়মামা। আমি গীতা, তোমার বড়মামি। তুমি আমায় গীতামামি বলে ডেকো। তুমি মধু, তাই তো? টিভিতে শো করো!”

মধুরা গীতার কথার উত্তর না দিয়ে লম্বার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি তা হলে পিয়ালমামা।” ছিঁচকাঁদুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আপনি…”

“আমার কথা ধোরো না ভাই! আমি মানুষ নই।” মিনমিন করে বলে ক্রাইবেবি, “সবার জন্য খেটে খেটে জান কয়লা হয়ে গেল। সে যে কী কষ্ট, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না ভাই!”

“আলাপ হওয়ার আগেই নাকে কান্না শুরু হয়ে গেল?” দাবড়ানি দেয় গীতা, “এ আমার জা। ওর নাম মিতা। তা আমরা কি বাড়িতে ঢুকতে পারি? অনেক দূর থেকে আসছি। আমাদের গ্রামের দিকে তো আগে জলবাতাসা দিয়ে তারপর নাম ঠিকানা শুধোনো হয়। কলকাতা শহরে শুনেছি অন্য রকমের ব্যাপার!”

“এটা কলকাতা নয়। এটা হাওড়া।” শান্ত গলায় বলে মধুরা, “এটা গ্রাম নয়। তবে শহরও নয়। আপনাদের কখনও দেখিনি তো! তাই ভাল করে দেখে নিলাম। ভেতরে আসুন।”

দোতলার ডাইনিং টেবিলে যূথিকা মাথা নিচু করে বসে। সবিতা বাতের তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মিতা আর পিয়াল তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। অর্জুন বলল, “কেমন আছিস?”

“ভাল নয়,” ছলোছলো চোখে বলে যূথিকা, “হাই সুগার, হাই প্রেশার, সর্বাঙ্গে বাত, হেন রোগ নেই যা শরীরে বাসা বাঁধেনি।” চোখের জল মুছে জিজ্ঞাসা করে, “তোরা কেন এসেছিস বল।”

“বাবার স্ট্রোক হয়েছে,” নিজের থেকে চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছে গীতা, “হাই প্রেশারের রুগি। ওষুধ খেত না। গত সপ্তাহে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরে লোকাল নার্সিং হোমে ভত্তি করেছি। ডাক্তার বলেছে, কোমা। এক সপ্তাহে এক লাখ টাকা বিল হয়েছে। আমরা আর পারছি না। তুমি কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করো।”

মধুরার গীতাকে পছন্দ হল। ধানাইপানাই না করে কাজের কথাটা গোড়াতেই বলে দিল।

গীতা শেষ করতে মিতা শুরু করল, “জানো ভাই, ওই কষ্ট চোখে দেখা যায় না। চোখের পিচুটি মুছিয়ে দেওয়ার লোক নেই, গায়ে পিঁপড়ে ঘুরছে, বিসনাতেই হাগামোতা মেখে পড়ে রয়েছে। আমরা কি ভাই বড়লোক যে বড় নার্সিং হোমে ভরতি করব? আবার সরকারি হাসপাতালে ভরতি করতেও মানে লাগে। মানুষটা, হাজার হোক, আমাদের বাবা বলে কথা।”

“তোমাদের ধাবা কেমন চলছে?” জানতে চায় মনোহর। সে আবার ওপরে চলে এসেছে।

ধাবার কথা শুনে মধুরার অ্যান্টেনা খাড়া! তার মামাবাড়ির লোকেরাও খাওয়ানোর লাইনে আছে!

অর্জুন বলল, “ভাল না।”

পিয়াল বলল, “চালাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু এত রকমের সমস্যা…”

“কী যেন নাম ধাবাটার…” মনে করার চেষ্টা করছে মনোহর। গীতা বলে, “আপনি যখন গিয়েছিলেন, তখন শ্বশুরমশাই চালাতেন। ‘কোলাঘাট ধাবা’ নামে চলত। উনি ছাড়ার পরে আপনার শালারা হাল ধরল। এখন নাম হয়েছে ‘ভাইভাই ধাবা’।”

পানের গুঁটলি ডানগাল থেকে বাঁ গালে পাঠিয়ে গীতা বলল, “সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। ডাক্তার বলেছে, উনি আর বেঁচে নেই। বলেছে, টাকা না মেটালে বডি ছাড়বে না। গাড়িভাড়া করে ক’টা টাকার জন্যে আমরা এসেছি। আমাদের ফিরিয়ে দিয়ো না।”

যূথিকা আবার কাঁদছে। তবে এখন অন্য ইস্যুতে। সবিতাও আঁচলে চোখ মুছছে। অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মনোহর বলল, “শ্বশুরমশাই কি উইল করেছেন?”

অর্জুন আর পিয়াল নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একসঙ্গে বলে, “না।”

“সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ওঁর যা সম্পত্তি আছে, তার মালিক চারজন। আমার শাশুড়ি মিনতিবালা সরকার, আর তোমরা তিন ভাইবোন। অর্জুন সরকার, যূথিকা ভৌমিক, পিয়াল সরকার। ঠিক বললাম তো?”

“হ্যাঁ।” মুখ খুলেছে অর্জুন, “কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার আগেই এইসব আলোচনা কি ঠিক হচ্ছে?”

“হচ্ছে না।” সপাটে জবাব দেয় মনোহর, “কিন্তু আমি নাচার। বিয়ের পরে তোমাদের বাবা ওই বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেননি। নিজের মেয়েকে রাস্তা থেকে বিদেয় করেছেন। নাতিনাতনির মুখ দেখেননি। আমার ছেলেমেয়ে জানে না মামাবাড়ি কী জিনিস! সব তোমাদের বাবার জন্যে। আমি বা আমার বউ কালোসোনা সরকারের জন্যে এক নয়া পয়সা খরচ করতেও রাজি নই।”

“তা হলে কী হবে ভাই!” জানতে চায় মিতা।

“মিনতিবালা দেবীর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর অংশটা মেয়ের নামে গিফ্‌ট ডিড করতে বলো। সামান্য আইনি ব্যাপার। কিছু ফি দিলেই যে-কোনও উকিল করে দেবে।”

“আমাদের সম্পত্তি কেন আমরা বাঁটোয়ারা করতে যাব?” ঝাঁঝিয়ে ওঠে গীতা।

মনোহর বলে, “তোমার সম্পত্তি নিয়ে কিছু বলিনি। আমি কালোসোনা সরকারের সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করছি। যার বর্তমান ভাগীদার তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান।”

মেঝের দিকে তাকিয়ে বাঁশির মতো গলায় পিয়াল বলল, “ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে একফালি জমি আর বাড়ি। আমরা কাঠা আর ছটাকে হিসেব করি। আপনাদের শহুরে হিসেবে বড়জোর হাজার স্কোয়্যার ফুট। আড়াইশো স্কোয়্যার ফিট জমি নিয়ে আপনি কী করবেন?”

বিড়ি ধরিয়ে মনোহর বলল, “আমি দোকানদার মানুষ। আমি বুঝি, ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। ওই সম্পত্তির একের চার তোমার দিদির প্রাপ্য। তোমাদের মাকে বলে আরও একের চার গিফ্‌ট ডিড করো। নার্সিং হোমের টাকা দেব।”

অর্জুন হাঁড়ির মতো মুখ করে বলল, “আইনি ব্যাপার তো লম্বা প্রসেস। আমাদের টাকা এক্ষুনি চাই।”

“টাকা পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই আমার বউ তার বাপের সম্পত্তির ভাগ পাক। ওটা ওর প্রাপ্য।”

মনোহর ইশারায় যূথিকাকে শোওয়ার ঘরে যেতে বলল। যূথিকা বলল, “কত দেব?”

“যা চাইছে দিয়ে দাও।”

অর্জুন বলল, “দাদা, আপনি আমাদের ওপরে ভরসা করে টাকা দিচ্ছেন। যদি নিয়ে পালিয়ে যাই?”

“টাকা চুরি করে আর কোথায় পালাবে ভায়া? তোমাদের বোন তোমাদের সঙ্গে কোলাঘাট যাচ্ছে। নার্সিং হোমে নিজের হাতে টাকা দেবে। তোমাদের হাতে কোনও টাকা আমি দেব না।”

পিয়াল বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “আর উকিলের ব্যাপারটা?”

“তোমরা ওঁর সৎকারের ব্যবস্থা করো। আমার মেয়ে একটু বাদে উকিল নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে।”

মধুরা মনোহরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। মনোহর বলল, “মিস জোনাকি লিগাল প্র্যাকটিস করেন বললি না? ওঁকে বল, তোর সঙ্গে কোলাঘাট যেতে হবে। বিজনেস পার্টনার যখন, এইটুকু নিশ্চয়ই করবেন। আমিও তোর সঙ্গে যাব। শীল ম্যানশনটা একবার দেখে আসব।”

খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে মধুরা পাঁইপাঁই করে তিনতলার দিকে দৌড়োয়।

*

মিস জোনাকির সঙ্গে মনোহরের সাক্ষাৎ বেশ ইন্টারেস্টিং। অর্জুন, পিয়াল, গীতা, মিতা আর যূথিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরে, মধুরার গাড়িতে চেপে শীল ম্যানশনে এল মনোহর। মধুরা বাবার সঙ্গে মিস জোনাকির আলাপ করিয়ে দিল।

মনোহর বলল, “আপনি আমাদের এই কাজটা করে দিন। খুব জরুরি।”

মিস জোনাকি আপত্তি করেনি। মধুরা আর মনোহরের সঙ্গে চলে গেল কোলাঘাট।

যূথিকা আগেই এসে নার্সিং হোমের টাকা মিটিয়েছে, ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছে, শ্মশানে বডি নিয়ে চলে গেছে।

মধুরা, মনোহর আর মিস জোনাকি যখন শ্মশানে পৌঁছল, তখনও কালোসোনার চিতা জ্বলছে। আকাশ অন্ধকার। ভিজে বাতাস বইছে।

রূপনারায়ণের শ্মশানঘাটের সিঁড়িতে বসে মিস জোনাকি যূথিকার হাত ধরল। যূথিকা কাঁদছিল। চোখ মুছে বলল, “আপনার সম্পর্কে আমার খুব বাজে ধারণা ছিল।”

“ধারণা বদলাল কেন?” মৃদু হেসে জানতে চায় মিস জোনাকি, “আর, আপনি নয়, তুমি বলো।”

“কম বয়সে তোমার কয়েকটা বই দেখেছিলাম। সেখানে তুমি ছোট ড্রেস পরে…”

যূথিকার পিঠে হাত বুলিয়ে মিস জোনাকি বলল, “তখন তোমার কম বয়স। আমারও তাই। আজ আর ওসব ভেবে লাভ নেই। আমরা দুই বুড়ি মিলে একটু গপ্‌পো করি, এসো।”

যুথিকা হঠাৎ মিস জোনাকির কাঁধে মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবাকে শেষ দেখেছিলাম বিয়ের আগে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, সেই রাগে জামাইয়ের মুখ দেখেনি, নাতিনাতনির মুখ দেখেনি। আজ তার জন্যে আমি কাঁদছি…”

মিস জোনাকি যূথিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।

কলকাতায় ফিরে এক সপ্তাহের মধ্যে দানপত্রের বয়ান তৈরি করে ফেলল মিস জোনাকি। গিফ্‌ট ডিড নিয়ে বেশ কয়েকবার কোলাঘাট দৌড়োতে হল যূথিকা আর মনোহরকে। আইনি পর্ব ও সইসাবুদ মেটার পরে বিডিও, বিএলআরও, পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে যূথিকার নামে খাজনা জমা করে এসেছে মনোহর।

যূথিকা এখন কোলাঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে মনসাপোতা গ্রামের পাঁচশো স্কোয়্যার ফিটের মালিক। যার মধ্যে রয়েছে একটি বসত বাড়ি, যেখানে সে কখনও যাবে না। একফালি জমি, যেটি বাগান করার বা ফসল ফলানোর অনুপযুক্ত। এবং ‘ভাইভাই ধাবা’ যার থেকে মাসে হাজার দশেক টাকা আয় হয়। ওই টাকায় অর্জুন আর পিয়ালের সংসার চলে না। ওতে যূথিকা ভাগ বসাতে চায় না।

কোলাঘাট পর্ব এখন অতীত। যূথিকা আর মিস জোনাকির মধ্যে মাখোমাখো বন্ধুতা গড়ে উঠেছে। যখন তখন ফোনাফুনি, রান্নার রেসিপি আদানপ্রদান, মায় কখনও কখনও মধুরার হাত দিয়ে মুড়োঘন্ট বা বাটিচচ্চড়ি পাঠানোর কাজও চলছে। দৌত্যের কাজ মধুরা ভালবেসেই করে। কেননা সে চায়, বিজনেস পার্টনারদের নিয়ে মনোহর-যূথিকা যেন বাজে ধারণা পোষণ না করে। তা হলে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *