মধুরেণ – ৮

এবারে বর্ষা এসেছে টাইমটেবিল মেনে। আবহাওয়া দফতর ঘোষণা করেছে, “মনসুন অ্যারাইভস অন ৮ জুন।” মৌসুমীদেবীও লক্ষী মেয়ের মতো একঢাল কালো চুল খুলে, কেরালা থেকে নাচতে নাচতে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়লেন, সাত তারিখ রাত বারোটা পেরোনোর একটু পরে।

কলকাতা শহরের রাস্তায় জল জমতে শুরু করেছে। খবরের কাগজ আর টিভিতে শুরু হয়ে গেছে সরকার আর বিরোধীপক্ষের মধ্যে জলজমা নিয়ে রাজনৈতিক খেউড়।

এই কুচ্ছিত ওয়েদারে মধুরা রোজ সকাল ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে আসে লং স্ট্রিট। সেখানে ডুঙ্গার আর মিস জোনাকির সঙ্গে একপ্রস্থ মিটিং সেরে নেয়। শীল ম্যানশনের রিনোভেশান পর্ব মনিটর করছে ডুঙ্গার। কাজের প্রগ্রেস খতিয়ে দেখে মিস জোনাকিকে নিয়ে বেরোয় মধুরা। গোটা কলকাতা চক্কর কাটে। ফিরে এসে আর একপ্রস্থ মিটিং করে।

জুন মাসের দশ তারিখ। সন্ধে সাতটার সময়ে মধুরা, মিস জোনাকি আর ডুঙ্গার মিটিং করতে বসেছে। ভেনু, শীল ম্যানশনের হলঘর। মিস্তিরি লাগিয়ে ঘরটা সাফসুতরো করা হয়েছে। জানলার ভাঙা খড়খড়ি সারানো হয়েছে, দেওয়ালে হোয়াইট ওয়াশ পড়েছে। নোংরা কাপড়ের ঢাকনি সরিয়ে ঝাড়লন্ঠন প্রকাশ্যে এসেছে। সেটাকে পরিষ্কার করে ইলেকট্রিকাল কানেকশান দেওয়া হয়েছে। ফ্যানের ব্লেডে আর ধুলো জমে নেই। সোফায় বসা যাচ্ছে।

মধুরা আর মিস জোনাকি সোফায় বসেছে। ডুঙ্গার হুইল চেয়ারে। পরনে হাফহাতা ফতুয়া আর ঢোলা পাজামা। নাকে অক্সিজেনের নল।

ল্যাপটপ দেখে মধুরা বলল, “আমরা অলরেডি কোম্পানি আইন অনুযায়ী একটা কোম্পানি খুলেছি, যার নাম ‘ফুড অ্যান্ড বিভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড’। সংক্ষেপে ‘এফ অ্যান্ড বি’। এটা একটা পার্টনারশিপ ফার্ম। মালিক, আমরা তিনজন। আমরা একটা ফিউশান ফুডের রেস্তোরাঁ খুলতে চলেছি। লং স্ট্রিটের ব্যাঙ্কে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। শীল ম্যানশনে প্রাথমিক রেনোভেশানের কাজ চলছে, যাতে অফিস হিসেবে এটা ব্যবহার করা যায়। আমি এই কাজগুলো দেখছিলাম। জোনাকিদি দেখছে লাইসেন্সের ব্যাপারটা। জোনাকিদি, আমি প্রশ্ন করি?”

“কর।”

“এক নম্বর ডকুমেন্ট, ট্রেড লাইসেন্স।”

ফাইল খুলে মিস জোনাকি একটা কাগজ দেখাল, “হয়ে গেছে। দাসবাবু আমার চেনা লোক। কোনও টাকাপয়সা নেননি।”

“কেন নেয়নি? তোমার কাস্টমার ছিল?” মুখোশ সরিয়ে জানতে চাইল ডুঙ্গার।

মিস জোনাকি বলল, “হ্যাঁ। তোমার কোনও আপত্তি আছে?”

“তখন আপত্তি ছিল না। এখন যোগাযোগ থাকলে আপত্তি আছে।”

“এখনও যোগাযোগ আছে। তবে কাস্টমার হিসেবে নয়। বন্ধু হিসেবে।”

“বন্ধু?” হ্যাহ্যা করে হাসে ডুঙ্গার, “হিরোইনরা প্রেম করলে, ইন্টারভিউতে কী একটা স্টক কোটেশান দেয় যেন?”

মধুরা বলে, “উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস!”

“হ্যাঁ হ্যাঁ! মধু ঠিক বলেছে, দাসবাবু আর তুমিও কি তাই? জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস?”

মধুরা তাড়াতাড়ি বলে, “দু’নম্বর আইটেম, ফুড লাইসেন্স।”

“এই যে!” আর একটা কাগজ দেখায় মিস জোনাকি। ডুঙ্গার বলে, “এটাও কি দাসবাবু বানিয়ে দিয়েছে?”

“না!” কৃত্রিম রাগ দেখায় মিস জোনাকি, “এটা মধুরিমা ম্যাডামের জন্য পেয়েছি। তিনহাজার টাকা দিতে হয়েছে।”

“হবেই! মেয়ে যে! জাস্ট গুড ফ্রেন্ড তো নয়!” ফুট কাটে ডুঙ্গার।

“তিন নম্বর, ভ্যাট লাইসেন্স।” ল্যাপটপ দেখে বলে মধুরা।

“হয়ে গেছে,” আর একটা কাগজ দেখায় মিস জোনাকি।

“এটাও কি দাসবাবু?” রুটিন মেনে জানতে চায় ডুঙ্গার। মিস জোনাকি বলে, “এটা ঘোষদার জন্যে হল। উনিও টাকা নিলেন না।”

“আগে ছিল দাসবাবু, এবার হল ঘোষদা। তা, ইনিও কি জাস্ট গুড ফ্রেন্ড?”

“তোমার সব খবরে কী দরকার? তুমি মন দিয়ে অক্সিজেন নাও।”

মধুরা বলে, “চার নম্বর, বাড়িভাড়ার রশিদ।”

“এই যে,” আর একটা কাগজ নাড়ে মিস জোনাকি। ডুঙ্গারের দিকে তর্জনী দেখিয়ে বলে, “এটা ও দিয়েছে। বলেছে, নিয়মরক্ষার্থে ভাড়ার রশিদ দিলাম। মাসে হাজার টাকা ভাড়া। ওই টাকা আমার লাগবে না।”

ডুঙ্গার মন দিয়ে অক্সিজেন নিচ্ছে। মধুরা বলল, “দাসবাবু, ঘোষদার পরে কত্তাবাবু? বেশ বেশ!”

মিস জোনাকি ফচকে হেসে বলল, “উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস!”

“পান্‌চ লাইনটা সলিড দিয়েছ!” ডুঙ্গারের দিকে তাকিয়ে হোহো করে হাসে মধুরা, “পাঁচ নম্বর, সেন্ট্রাল এক্সাইজের রেজিস্ট্রেশান এবং ক্লিয়ারেন্স…”

“পেয়ে গেছি!” আরও দুটো কাগজ দেখায় মিস জোনাকি।

মধুরা লিস্টে টিক মারতে মারতে বলে, “ফায়ার লাইসেন্স।”

“এটা আমাকে দিয়ে হবে না,” অসহায়ভাবে বলে মিস জোনাকি। “ওখানে আমার চেনা ছিলেন ঘোষালবাবু। উনি মারা গেছেন। এখন যারা আছে, তাদের কাউকে চিনি না।”

মধুরা ডুঙ্গারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘোষালবাবুকে নিয়ে তোমার কোনও বক্তব্য নেই? বেচারি মারা গেছে বলে তোমার অ্যাসিড টাং থেকে বঞ্চিত থাকবে?”

ডুঙ্গার চোখ খুলল। অক্সিজেনের মাস্ক সরিয়ে বলল, “তুই একটু আগে কী বললি?”

“কী বললাম?

“আহ! কী যেন একটা বললি?” ডুঙ্গার প্রচণ্ড উত্তেজিত!

“ঘোষালবাবু?”

“না না! তারও আগে।”

“তারও আগে? কী বললাম? ভাড়ার রশিদ? সেন্ট্রাল এক্সাইজ? ফায়ার লাইসেন্স?”

“ওসব নয়।” হাত নাড়ে ডুঙ্গার, “জোনাকি যখন বলল, ‘উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস’, তখন তুই কী বললি…”

মিস জোনাকি বলে, “ও বলেছিল, ‘পান্‌চ লাইনটা সলিড দিয়েছ’।”

“এক্স্যাক্টলি!” এক্সাইটমেন্টের চোটে হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ডুঙ্গার, “আমরা ফিউশান ফুডের রেস্তোরাঁ খুলতে চলেছি। তার নাম কী হবে এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা এখনও শুরু হয়নি।”

“পান্‌চ!” ল্যাপটপের ওপরে ঘুষি মারে মধুরা, “একদম অ্যাপ্ট নেম!”

“পান্‌চ মানে কী?” চেয়ার থেকে উঠে বইয়ের আলমারির দিকে এগোয় মিস জোনাকি।

মধুরা বলে, “পোকায় কাটা ডিকশনারি ঘেঁটে লাভ নেই। আমার মোবাইলে ডিকশনারি আছে।” মোবাইলের ডিকশনারি খুলে মধুরা বলল, “পান্‌চ মানে ঘুষি মারা, পান্‌চ মানে শার্প অবজেক্ট দিয়ে ফুটো করা, পান্‌চ মানে কম্পিউটার বা টেলিফোনের বাট্‌ন প্রেস করা। পান্‌চ ব্যাগে বক্সাররা ঘুষি মারে, মাথায় ঘুষি খেয়ে বক্সাররা পান্‌চ ড্রাঙ্ক হয়ে যায়, পান্‌চ আপ মানে ফিজিক্যাল ফাইট…”

“ওই নামই ফাইনাল!” হাততালি দিয়ে বলে ডুঙ্গার, “নামটা রেজিস্ট্রি করতে হবে নাকি?”

মিস জোনাকি বলে, “সেটা আমি দেখছি। তার আগে নতুন ছেলেমেয়ে নিতে হবে। শুধু পূজাকে দিয়ে চলবে না। বাবুলাল বারুই নামে একটা লোক আর বিনয় মহাপাত্র নামে একটা ছেলে আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছে।”

“ওরা কী করে জানল যে এখানে রেস্তোরাঁ হবে?” সন্দেহমাখা গলায় প্রশ্ন করে ডুঙ্গার।

“বিনয়কে আমি এই প্রশ্নটাই করেছিলাম। ও বলল, নতুন ফুড লাইসেন্স বা লিকার লাইসেন্স বেরোলে ওর কাছে খবর চলে যায়।”

“পারফেক্ট যুক্তি।” ল্যাপটপে নাম এন্ট্রি করে মধুরা বলে, “এরা কোথায় কাজ করে?”

“বাবুলাল থট ফর ফুডের ডোরম্যান ছিল। ওখান থেকে চাকরি গেছে। আমার সঙ্গে দেখা করেছে। আমি বলেছি, সকাল এগারোটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ডিউটি। মাইনে মাসে তিন হাজার টাকা। বাবুলাল রাজি হয়ে গেছে।”

“শুধু ডোরম্যানের কাজ করবে? না অন্য কাজও করবে?”

“রান্না আর সার্ভ করা বাদ দিয়ে সব করবে। লোকটাকে ডিপেন্ডেব্‌ল বলে মনে হল।”

“বিনয় ছেলেটা কে?”

“শেফ। ওকে আজ আসতে বলেছি। কথা বলে নিস।”

ল্যাপটপ বন্ধ করে মধুরা বলে, “এই বৃষ্টিতে আসবে কী করে?”

“সেটা ও-র ব্যাপার।” সোফা থেকে উঠে মিস জোনাকি বলে, “সাতটায় আসতে বলেছিলাম। এখন ক’টা বাজে?”

“আটটা।” ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে ডুঙ্গার বলে, “ফায়ার লাইসেন্সের কী হবে?”

মধুরা বলল, “আমার চেনা একজন ফায়ার ডিপার্টমেন্টে আছে। কাল তাকে ফোন করব।”

এই সময় কলিং বেল বাজল। মিস জোনাকি সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, “হয় বিনয় এল, না হয় অ্যাডনেটের অশোক কর্মকার এল।”

“অশোক কর্মকার আবার কে?” প্রশ্ন করে মধুরা। ডুঙ্গার বলে, “আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে অশোকের অ্যাড এজেন্সি আছে। মিডিয়াম বাজেটের ক্লায়েন্টের জন্য আইডিয়াল। তোর সঙ্গে বসে অ্যাডের প্ল্যানিং করবে বলেছে। ছেলেটা খেতেও ভালবাসে।”

ডুঙ্গারের কথার মধ্যে মিস জোনাকি একটা ছেলেকে নিয়ে ওপরে এসেছে। ডুঙ্গার বলল, “তুমি দেখছি একদম শুকনো। বৃষ্টি কি বন্ধ হয়ে গেছে?”

মধুরা আন্দাজ করল, এ হল বিনয়। কেননা অশোককে ডুঙ্গার চেনে। বিনয় বলল, “আমি লং স্ট্রিটে ঢোকামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। বাধ্য হয়ে সামনের বাড়ির শেডের নীচে দাঁড়িয়েছিলাম।”

মিস জোনাকি ভিতরে চলে গেছে। ডুঙ্গার হুইলচেয়ারে বসে ঢুলছে। মধুরা বলল, “আপনার নাম বিনয় মহাপাত্র?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম।” বিনয়ের অবতার হয়ে বলে বিনয়। ছোকরাকে ভাল করে মাপে মধুরা। তারই মতো বয়স। শ্যামলা গায়ের রং, ব্যাকব্রাশ করা চুল, নাকের নীচে সরু একফালি গোঁফ। পরনে সাদা শার্ট, ফেডেড নীল ডেনিম আর নীল-সাদা স্নিকার। সামনের সোফা দেখিয়ে মধুরা বলল, “বসুন।”

“থ্যাঙ্ক ইয়ু ম্যাডাম।” সোফার একপ্রান্তে জড়োসড়ো হয়ে বসে বিনয়।

“বাড়ি কোথায়?”

“পিংলা।” জবাব দেয় বিনয়ের অবতার।

“কলকাতায় কোথায় থাকা হয়?”

“আমি এখন কাজ করছি সল্টলেকের থট ফর ফুড রেস্তোরাঁয়। ওরাই ফুডিং লজিং দেয়।”

মধুরা প্রশ্ন করল, “‘টিএফএফ’ ছাড়তে চাইছেন কেন?”

বিনয় মেঝের দিকে তাকিয়ে হাত কচলে বলল, “ওখানে আমার কিছু প্রবলেম হচ্ছিল ম্যাডাম…”

“সেই প্রবলেম এখানে হবে না আপনি জানলেন কী করে?”

“আমার প্রবলেম হল…”

“আমি অন্য অফিসের ভেতরের কথা জানতে চাই না। আমি এটাও চাই না যে কেউ নিজের অফিসের কথা অন্য জায়গায় রাষ্ট্র করুক। ব্যাড ওয়ার্ক কালচার।”

মধুরাকে থামিয়ে বিনয় বলল, “টিএফএফ-এর একজন স্টাফের সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার চলছে। আমরা বিয়ে করতে চলেছি। ওখানকার ম্যানেজমেন্ট পলিসি হল, এক অফিসে হাজব্যান্ড-ওয়াইফ কাজ করতে পারবে না। তাই আমি ছাড়ছি। এর মধ্যে কোনও ভেতরের কথা নেই ম্যাডাম।”

ঠিকঠাক যুক্তি। কোম্পানির কোনও দোষ নেই। বিনয়েরও দোষ নেই। মদনদেব কাকে কোথায় তির মারবে কে বলতে পারে?

বিনয় বলল, “একটা কথা ম্যাডাম। আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলুন।”

“ঠিক হ্যায়,” শ্রাগ করে মধুরা, “তুমি কাজ ছাড়ছ কেন? মানে, তোমার বন্ধু ছাড়ছে না কেন?”

“ও ম্যানেজার। আমি শেফ! আমি কম মাইনে পাই।”

“হুম!” ঘাড় নাড়ে মধুরা। বিনয় প্রবলেমে পড়ে চাকরি খুঁজছে। একে নিলে কম স্যালারি দিতে হবে। তবে তার আগে এর স্কিল জাজ করতে হবে। মিনিট পনেরো ধরে আরও নানান প্রশ্ন করে মধুরা বলল, “তুমি এবার এসো। ফোন নাম্বার তো আছেই। আমরা যোগাযোগ করে নেব।”

সোফা থেকে উঠে বিনয় বলে, “আমার একটা কাজের খুব দরকার।”

“আমি দেখছি কী করা যায়।” আলোচনায় ইতি টানে মধুরা। বিনয় হঠাৎ মেঝেয় বসে পড়ে, মধুরার পায়ে মাথা ঠুকে বলে, “আমার খুব প্রবলেম ম্যাডাম! আমাকে রাখুন, প্লিজ! আপনি যা দেবেন, তাতেই আমার চলে যাবে।”

“আরে আরে! এ কী করছেন?” বিব্রত মধুরা উঠে দাঁড়ায়।

ডুঙ্গার সব শুনেছে। সে টিপিকাল বানিয়াদের মতো বলে, “পাঁচ হাজার টাকা মাইনে। দিনে বারো ঘণ্টা ডিউটি। ছুটিছাটা নেই। রাজি থাকলে বলো।”

মধুরা লজ্জায় চোখ বুজে ফেলে। কোনও শেফ এত কম মাইনেয় কাজ করবে না। ছেলেটা বিপদে পড়ে এসেছে বলে এইরকম ভাবে এক্সপ্লয়েট করা ঠিক না। রেস্তোরাঁয় শেফদের সারাক্ষণ আগুনের সামনে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। যে দিনগুলোয় মানুষ আনন্দ করে, যেমন পুজো বা ছুটির দিন, সেই দিনগুলোয় শেফদের কাজ বেড়ে যায়। বিনয়ের মাইনে মিনিমাম পনেরো হাজার টাকা হওয়া উচিত।

“এত কম মাইনে স্যার…” ঘাড় চুলকোচ্ছে বিনয়।

“না পোষালে কোরো না!” বাঁ হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে বিনয়কে যেতে বলে ডুঙ্গার।

এই সময়ে আবার কলিং বেল বাজে। ভেতরের ঘর থেকে মিস জোনাকি বলে, “অশোক এল বোধহয়। মধুরা, তুই অশোককে ভেতরে পাঠিয়ে বাড়ি চলে যা।”

মধুরা ল্যাপটপ ব্যাগে ঢোকায়। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির তেজ কমের দিকে। ল্যাপটপকে জলের কবল থেকে বাঁচিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে হবে।

বিনয় ডুঙ্গারকে বলল, “আর একটু বাড়ান স্যার। টিএফএফএ আমি এর থেকে অনেক বেশি ড্র করি।”

ডুঙ্গার বলল, “আমি তোমাকে ডাকিনি। তুমি নিজে এসেছ। এই টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানে কাজ করলে করো, না হলে যাও। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তুমি কেমন শেফ না জেনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছি।”

মাইনে নিয়ে নেগোসিয়েশান চলছে। মধুরা একতলায় এসে সদর দরজা খুলতে যাবে, এমন সময় আবার বেল বাজল। মধুরা কড়া গলায় বলল, “আসছি আসছি! এত অধৈর্য কেন?” তারপর দরজা খুলে দিল।

“অধৈর্য হওয়ার কারণ আছে,” লম্বা একটা লোক সাঁত করে মধুরাকে টপকে ভেতরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “বাইরে একটা সাপ! ইয়া মোটা!”

“সা-আ-প! ওরে বাবা!” আঁতকে উঠে, টেবিল উলটে দিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে মধুরা, “আমার সাপে খুব ভয়!”

লোকটা বিব্রত হয়ে নিজেকে মধুরার থেকে ছাড়িয়ে বলে, “সাপের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আপনার নাগপাশে বন্দি হয়ে গেছি! আমায় ছাড়ুন। ওটা ঢোঁড়া সাপ।”

টেবিল উলটে যাওয়ার ফলে কাচের ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে। লজ্জায় লাল হয়ে, লোকটাকে ছেড়ে, ভাঙা কাচ বাঁচিয়ে দরজার দিকে এগোয় মধুরা। কেলেঙ্কারি কাণ্ড! সাপের ভয়ে অচেনা লোককে এইভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে? এইভাবে টেবিল উলটে ফুলদানি ভাঙে? ছিঃ! মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয় মধুরা।

“দাঁড়ান দাঁড়ান! কোথায় যাচ্ছেন?” মধুরার পথ আটকে লোকটা বলে, “এইভাবে আমি আপনাকে একা ছাড়তে পারি না। বাইরে সাপটা এখনও আছে! আমার মোবাইলে টর্চ আছে। আসুন, আপনাকে এগিয়ে দিই।”

মধুরা সন্তর্পণে চৌকাঠ পেরোল। তার পায়ের কাছে লকলক করছে টর্চের আলো। ভিজে ঘাস পেরিয়ে সে দৌড় দেয় প্রধান ফটকের দিকে। গাড়িতে উঠে ল্যাপটপের ব্যাগ পাশের সিটে রেখে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে। সাপ! বাবা গো!

লোকটা গাড়ির কাছে চলে এসেছে। জানলার কাচে আঙুল দিয়ে টকটক আওয়াজ করে কী যেন বলছে!

জানলার কাচ সামান্য নামিয়ে মধুরা বলে, “আমাকে সাপের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে থ্যাঙ্ক ইয়ু। আর পরের ব্যাপারটার জন্যে সরি!”

লোকটা বলে, “থ্যাঙ্ক ইয়ুটা নিলাম।”

অর্থাৎ ‘সরি’টা নিল না। মানে, জড়িয়ে ধরাটা পছন্দ হয়েছে। দাবড়ানি দেবে বলে গাড়ির কাচ পুরো নামায় মধুরা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখে বছর আঠাশের এক ছোকরা। লম্বা, ওয়েলবিল্ট, ক্লিন শেভ্‌ড, শ্যামলা গায়ের রং। একমাথা চুল বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। বাঁ কানে হিরের স্টাড। ডান হাতের বাইসেপে আধখাওয়া আপেল ট্যাটু করা রয়েছে। পরনে কালো ডেনিম, বোতল সবুজ রঙের টি শার্ট আর গামবুট।

লোক নয়! এ তো ছেলে!

ছেলেটা হাসছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি তো আছেই, চোখ দিয়েও হাসছে। এ জানে যে একে দেখে মেয়েরা ফিদা হয়।

হঠাৎ শুভ্রর কথা মনে পড়ে যায় মধুরার। এর সঙ্গে শুভ্রর কোনও মিল নেই। তাও! শুভ্র ফরসা, এ কালো। শুভ্রর গোঁফ আছে, এ ক্লিন শেভ্‌ড। এ কানে দুল পরে, হাতে ট্যাটু করে। শুভ্রর ওসব বাতিক ছিল না।

শুভ্রর কথা কেন মনে পড়ল? লজ্জিত মধুরা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনার নাম অশোক কর্মকার?”

“আজ্ঞে!” এখনও চোখ দিয়ে হাসছে অশোক।

“ডুঙ্গার আর মিস জোনাকি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি ভেতরে যান।” ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়েছে মধুরা। অশোক বলল, “জোনাকিদি সিঁড়ি থেকে সব দেখেছে। ভাঙা ফ্লাওয়ার ভাস দেখিয়ে যদি আমায় জিজ্ঞাসা করে, ‘এ কর্ম কার?— তা হলে কী বলব?”

“এ কর্মকার!” মুখের মতো জবাব দিয়ে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি হাঁকায় মধুরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *