মধুরেণ – ৭

এবারে গরম পড়েছে জবরদস্ত। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে গরমের প্যাটার্ন বদলাচ্ছে। উত্তর ভারতের মতো জলীয় বাস্পহীন শুকনো গরমে বাংলার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাথায় ছাতা, চোখে সানগ্লাস, মুখে সানস্ক্রিন, সারাদিনে তিন লিটার জলপানের রুটিন এই গরমে কাজ করছে না। মেয়েরা মাথায় আর মুখে ওড়না জড়িয়ে বেরোচ্ছে, হাতে পরছে কনুই পেরোনো সাদা গ্লাভ্‌স। বাইক আরোহীরা মুখে মাস্ক পরে বেরোচ্ছে। না হলে গরম হাওয়ার ঝলকে নাক ও মুখের ভিতরের ঝিল্লি পুড়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন লোক হিট স্ট্রোক আর হিট এক্সরশানে মারা গেছে।

শুকনো গরম যাওয়ার পরে এল বাংলার নিজস্ব প্যাচপ্যাচে গরম। কিন্তু, উইথ আ টুইস্ট। বাতাসে হঠাৎ করে জলীয় বাস্পের পরিমাণ ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেল। একে গরম, তার সঙ্গে ঝরনার মতো ঘাম— লোকে দার্জিলিং, কাশ্মীর, ইয়োরোপ— যে যেখানে পারে পালিয়ে বাঁচল। দু’-একজন লোক হিট ক্র্যাম্পে মারা গেল। শরীর থেকে দ্রুত অনেকটা নুন বেরিয়ে গিয়ে প্রবল খিঁচুনি। রাস্তায় পড়ে গিয়ে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে মৃত্যু।

‘থট ফর ফুড’ নামের বার কাম রেস্তোরাঁটি ছ’মাস আগে চালু হয়েছে। ককটেল, মকটেল আর ফিউশান ফুডের ঠেক। পকেটসই, কম ক্যালরির ছোট সার্ভিংস। খেলে পকেটের মেদ কমে না, পেটের মেদ বাড়ে না। আইটি সেক্টরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘টিএফএফ’।

বিকেল পাঁচটার সময়ে সব সিট ভরতি। লং আইল্যান্ড আইস্‌ড টি আর বিয়ার বিকোচ্ছে দেদার। সঙ্গে ডামপ্লিংস। কিচেনের ছেলেপুলেদের পাগল পাগল অবস্থা।

প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকল বাবুলাল বারুই। ছোট্টখাট্টো চেহারার মানুষটি ক্যালকাটা ওয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল সিটির সিকিয়োরিটির চাকরি করত। স্যান্ডি তার নামে সিকিয়োরিটি এজেন্সির বসের কাছে অভিযোগ করায় সম্প্রতি চাকরি গেছে। বউ আর মেয়ে নিয়ে বাবুলাল এখন অথই জলে।

মলিন পোশাক পরা বাবুলাল এই রেস্তোরাঁয় বেমানান। গেটম্যান ঢুকতে দিচ্ছিল না। বাবুলাল একদম মালিকের নাম করায় ছেড়ে দিয়েছে।

ওয়েটারকে বাবুলাল জিগ্যেস করল, “প্রকাশ পারেখ কোথায়?”

ট্রে ভরতি মকটেল ব্যালান্স করতে করতে ওয়েটার অফিসের দরজা দেখিয়ে দিল। বাবুলাল দরজায় ঠকঠক করে বলল, “আসব স্যার?”

“কে?” ভেতর থেকে প্রশ্ন করল নেহা।

বাবুলাল দরজা দিয়ে মুখ গলিয়ে বলল, “নেহা ম্যাডাম, আমি বাবুলাল।”

“ভেতরে এসো।” হুকুম করে নেহা। কোণের চেয়ার দেখিয়ে বলে, “বোসো। আমরা একটা মিটিং সেরে নিই। তারপর তোমার কথা শুনব।”

বাবুলাল কোণের দিকের চেয়ারে বসে দেখল অফিসঘরের মস্ত টেবিলের একদিকে বসে নেহা আর প্রকাশ। অন্যদিকে মাঝবয়সি এক বাঙালি মহিলা।

প্রকাশ বলল, “মধুরিমা ম্যাডাম, কী খবর?”

“গতমাসে তিনটে কোম্পানি ফুড লাইসেন্সের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছে। এই তাদের ক্রেডেনশিয়ালস।” একটা কাগজ প্রকাশের হাতে তুলে দেয় মধুরিমা। প্রকাশ ক্যাজুয়ালি কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়।

“এনিথিং রঙ পাপা?” ভুরু কুঁচকে জানতে চায় নেহা।

প্রকাশ কাগজটা নেহার দিকে এগিয়ে দেয়। মধুরিমাকে বলে, “আমি বিজনেসম্যান। আমার কথার দাম আছে। আজ আপনি যে ইনফো আমায় দিয়েছেন, সেটা রুটিন খবর নয়। আজ আপনার রুটিন পেমেন্ট হবে না। ক্যাশ কাউন্টারে যান। আমি বলে দিচ্ছি, যাতে আপনাকে একের বদলে পাঁচ হাজার টাকা দেয়।”

“হঠাৎ?” অবাক হয়ে বলে মধুরিমা।

“উই ভ্যালু পিপ্‌ল।” মুচকি হাসে প্রকাশ। “যোগাযোগ রাখুন। অফিশিয়াল খবর সাপ্লাই করুন। আরও টাকা পাবেন। বাই।”

মধুরিমা অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। ইন্টারকমের মাধ্যমে ক্যাশ কাউন্টারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, ফোন রেখে প্রকাশ মেয়েকে বলল, “কী বুঝলি?”

নেহা কাগজটা দেখছে। কপালে ঘুষি মেরে বলল, “‘ফুড অ্যান্ড বিভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড’ বা ‘এফ অ্যান্ড বি’ নামের একটা পার্টনারশিপ কোম্পানি ফুড লাইসেন্সের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছে। এরা লং স্ট্রিটে ফিউশান ফুডের রেস্তোরাঁ খুলতে চলেছে। মালিক তিনজন। ডুঙ্গারমল পারেখ। জোনাকি দাস। মধুরা ভৌমিক।”

প্রকাশ বলল, “ডুঙ্গারমল পারেখ মানে…”

নেহা বলল, “তোমার বাবা।”

“জোনাকি দাস মানে…”

বাবুলালের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিচু গলায় নেহা বলল, “দ্যাট ব্লাডি হোর!”

“মধুরা ভৌমিক মানে…”

“উই অল নো হার। আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, এরা তিনজন এক জায়গায় এল কী করে?”

“এদের মধ্যে কমন থ্রেড একটাই…”

“সুলতান সিং! লোকটা মরে গিয়েও আমাদের পিছু ছাড়ছে না!” দাঁতে দাঁত চিপে বলে নেহা।

“লং স্ট্রিটের অ্যাড্রেসটা দেখছিস?”

“হ্যাঁ। তোমার পাপার প্রপার্টি। যেটার কথা আমরা আলোচনা করছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন তুমি ফুড কর্পোরেশানের মধুরিমাকে পাঁচহাজার টাকা দিলে। দিস ইজ জেম অফ এ নিউজ!”

“একদম!” নিজের চেয়ার থেকে উঠে প্রকাশ বলে, “আমাদের গেম প্ল্যান কী হবে?”

নেহার কপালে ভাঁজ। চেয়ার থেকে উঠে বলল, “আমার মাথা কাজ করছে না। এই সময় কিছু একটা রান্না করলে মাথাটা খুলত।”

“চল, কিচেনে যাই।” নেহার কাঁধে হাত দিয়ে বলে প্রকাশ। বাবুলালকে বলে, “তুমিও এসো। ওখানেই তোমার কথা শুনব।”

“আমি স্যার বসছি। ওখানে গিয়ে কী করব?” হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়েছে বাবুলাল।

“তোমাকে আসতে বলা হয়েছে। তুমি আসবে।” কঠিন গলায় বলে প্রকাশ।

রান্না করার জন্যে কিচেনে চারটে পয়েন্ট আছে। এখন তিন জায়গায় রান্না হচ্ছে। চতুর্থ বার্নারের সামনে দাঁড়িয়ে নেহা বলল, “সামথিং তিখি… সামথিং স্পাইসি, সামথিং মসালাদার…”

“লঙ্কা দিয়ে তুই যে হায়েদ্রাবাদি ডিশটা বানাস…”

“মির্চ কা সালান,” একমুঠো সবুজ, ঝাল লঙ্কা চপিং বোর্ডে রাখে নেহা। মস্ত চপার বার করে লঙ্কাগুলোকে লম্বালম্বি চিরে দেয়। এই ডিশ বানানোর জন্যে কম ঝাল লঙ্কা বাছা হয়। কিন্তু নেহা বেছেছে মেক্সিকান জালাপেনো। এই লঙ্কা ভীষণ ঝাল।

নেহার চোখ লাল। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। নাক দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। আর এক মুঠো লঙ্কা চপিং বোর্ডে রেখে নেহা বলে, “সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিট আমার চাই! লেমনগ্রাসের বাস্তুতে গন্ডগোল আছে। কাস্টমার কম হচ্ছে। ওই ফুটে শিফ্‌ট করলেই প্রবলেম সল্‌ভড!”

“চাইলেই কি পাওয়া যায় রে?” নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলে প্রকাশ।

নিখুঁত চপার চালাচ্ছে নেহা। “চাইলেই পাওয়া যায়। প্ল্যান অফ অ্যাকশান বলছি। প্রথম ধাপ। ওই রেস্তোরাঁ হতে দেওয়া যাবে না। ফিউশান ফুডের বাজারে আমি নতুন। লেমনগ্রাস যেমন তোমার ব্রেনচাইল্ড, থট ফর ফুড তেমন আমার ব্রেনচাইল্ড। আমার বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্যে আমি মার্ডার করতেও রাজি আছি।”

“ইম্পসিব্‌ল! লাইসেন্স যখন বেরিয়ে গেছে, তখন ওই রেস্তোরাঁর উদ্বোধন হবেই! অ্যান্ড মাইন্ড ইট! মধুরা হ্যাজ গট মানি। বড় করেই বাজারে নামবে।” লঙ্কার ঝাঁঝে প্রকাশের চোখমুখ লাল।

কড়াতে অনেকখানি সর্ষের তেল দিল নেহা। তেল ফুটছে। ঝাঁঝ বাড়ছে। তাতে চেরা লঙ্কা ফেলে ডিপ ফ্রাই করল। টিস্যু পেপারে লঙ্কা ভাজা তুলে রেখে তিল, চিনেবাদাম, ধনেগুঁড়ো, জিরে, লাল লঙ্কা, আদা, পেঁয়াজ আর রসুনবাটা দিয়ে একটা পেস্ট বানাল। কড়াতে আবার সর্ষের তেল ঢেলে তাতে সর্ষে গুঁড়ো আর কারিপাতা দিল। বলল, “নেক্সট অপশন, রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া।”

“কী করে?”

ফুটন্ত তেলে পেঁয়াজকুচি ছাড়ে নেহা। পেঁয়াজ নরম আর স্বচ্ছ হয়ে গেলে হলুদ দেয়। এবার তাতে মশলা পেস্ট মেশায়। কড়ায় আগুন লেগেছে না বার্নারের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে, বোঝা শক্ত। লঙ্কার ঝাঁঝে নাকমুখ জ্বালা করছে। মিনিট তিনেক কাঠের হাতা দিয়ে নেড়ে দেড় কাপ জল ঢালে নেহা। বলে, “কাস্টমার না এলে এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে।”

“মধুরার হ্যাজ গট কানেকশান। ওর রেস্তোরাঁর ইনিশিয়াল ফুটফল ভাল হবে।”

বার্নার সিমে করে দশ মিনিট ধরে ফোটায় নেহা। তেঁতুল জল ঢালে। সব শেষে ভাজা লঙ্কা আর নুন দিয়ে আরও দশ মিনিট ঢিমে আঁচে রান্না করে। পাশের বার্নারে কাজ করছে কমবয়সি এক ছোকরা। সে প্রকাশকে বলল, “স্যার, কাজ হয়ে গেলে একটা দরকার ছিল।”

নেহার রান্না কমপ্লিট। সে একটা প্লেটে মির্চ কা সালান ঢেলে বলল, “কী ব্যাপার বিনয়?”

রান্নায় ব্যস্ত ছেলেটি বলল, “পরে বলব ম্যাডাম। হাতের কাজ সেরে নিই। আজ কাস্টমারের চাপ আছে।”

প্লেট নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে নেহা অফিসে ঢোকে। পিছন পিছন প্রকাশ আর বাবুলাল।

চেয়ারে বসে প্রকাশ বলল, “বলো বাবুলাল।”

বাবুলাল হাতজোড় করে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে বলল, “স্যার, আমার সিকিয়োরিটির কাজটা চলে গেল…”

“চলে গেল মানে?” অবাক হয়ে বলে প্রকাশ, “আর সেই কথাটা বলতে তুমি আমার কাছে কেন? তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আমি ইস্যু করিনি।”

“স্যান্ডি স্যার আমার নামে অফিসে কমপ্লেন করেছেন…”

“তুমি ভাইয়ার নামে আমাদের কাছে কমপ্লেন করতে এসেছ?” চড়া গলায় বলে নেহা, “সাহস তো কম নয়! হাউ ডেয়ার ইয়ু…”

“আহ! নেহা!” মেয়ের পিঠে হাত দিয়ে তাকে থামায় প্রকাশ, “স্যান্ডি কেন কমপ্লেন করেছিল? কী করেছিলে তুমি?”

“আমি স্যার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিলাম। তখন অনেক রাত। স্যান্ডি স্যার ধমক দিতেই আবার ভিতরে ঢুকে যাই।” কাঁদতে কাঁদতে প্রকাশের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবুলাল। “মেয়েটার ম্যালেরিয়া হয়েছিল। খুব কাঁদছিল। দু’মিনিটের জন্যে বাইরে বেরিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম! আপনি স্যান্ডি স্যারকে বলুন, উনি যেন কমপ্লেন তুলে নেন। তা হলে আমি আবার চাকরিটা পেয়ে যাব। ওই চারহাজার টাকা না পেলে বউবাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরব!”

প্রকাশ পা সরিয়ে নিয়েছে। বাবুলাল তাও মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে কাঁদছে। নেহা বলল, “বাবুলাল, ওঠো!”

চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় বাবুলাল। জল না পাওয়া লেটুস পাতার মতো বেরঙিন, শুকনো দেখাচ্ছে তাকে।

মির্চ কা সালানের প্লেট বাবুলালের দিকে এগিয়ে নেহা বলল, “খেয়ে দেখো। কেমন হয়েছে!”

বাবুলাল বলল, “আমার গ্যাসট্রিকের সমস্যা ম্যাডাম। ঝাল মশলা খাওয়া বারণ। পেটে পেন শুরু হয়ে যায়।”

নেহা বাবুলালের কথা শুনতে পায়নি। সে বলল, “সবটা খেয়ে নাও বাবুলাল।”

বাবুলাল পারপ্লেক্সড! সে আবার বলল, “আমার ঝাল খাওয়া বারণ ম্যাডাম!”

প্রকাশ বলল, “তুমি এবার এসো। আমাদের কাজ আছে।”

এতক্ষণে বাবুলাল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। বাপবেটি মিলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। সে যদি ঝাল ডিশটি খায়, তা হলে তার আবেদন শোনা হবে। না হলে পত্রপাঠ বিদায়।

প্লেট হাতে নিয়ে গন্ধ শোঁকে বাবুলাল। ঝালের হলকায় নাক জ্বালা করছে। কিছু না ভেবে বাবুলাল এক চামচ মির্চ কা সালান মুখে দেয়।

চিতার আগুনে ঝাঁপ দিলেও এত কষ্ট হয় না। জিভে জ্বলন্ত কয়লা ঠেকালেও এত জ্বালা করে না! বাবুলালের শিরা আর ধমনি জুড়ে ছুটছে আগ্নেয়গিরির লাভা! শরীরে বাজ পড়ছে মুহূর্মুহু। সব কষ্ট উপেক্ষা করে বাবুলাল আর এক চামচ মুখে দেয়। আর এক চামচ। আর এক…

নাকের জলে চোখের জলে হয়ে, পুরো প্লেট শেষ করে বাবুলাল বলে, “ম্যাডাম, হয়ে গেছে।”

“কেমন খেতে হয়েছে?” জানতে চায় নেহা।

“ঝাল!” হেঁচকি তুলতে তুলতে বাবুলাল বলে, “আমি জল খাব।”

“পরে,” হাত নেড়ে বাবুলালকে বসতে বলে প্রকাশ, “তুমি চাইছ যে আমি তোমার কথা স্যান্ডিকে বলি, তাই তো?”

“হ্যাঁ স্যার! স্যার, আমি একটু জল খেয়ে আসি?”

“আমি বললেও স্যান্ডি আমার কথা শুনবে না।”

প্রকাশের কথা না শুনে বাবুলাল অফিস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি এক গ্লাস জল না খেলে সে মরেই যাবে।

“বাবুলাল, সিকিয়োরিটির চাকরির কথা বলতে পারছি না। তবে তোমার জন্যে এই রেস্তোরাঁয় একটা চাকরি আছে।”

বাবুলাল দাঁড়িয়ে যায়। তার দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে। দুঃখে না আনন্দে, ঝালে না খুশিতে কে জানে! প্রকাশের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, “আপনার জন্যে আমার পরিবারটা বেঁচে গেল স্যার! আমি সারা জীবন আপনার কাছে ঋণী থাকব।”

নেহা ভুরু তুলে প্রকাশের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারেনি, কেন পাপা লোকটাকে চাকরি দিচ্ছে। প্রকাশ ইশারায় মেয়েকে চুপ থাকতে বলল। টেবিলে এক গ্লাস জল রেখে বলল, “বাবুলাল, জল খাও!”

টেবিলের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্লাস নেয় বাবুলাল। চোঁচোঁ করে এক নিশ্বাসে জল শেষ করে বলে, “আর এক গ্লাস…”

মিনারেল ওয়াটার গ্লাসে ঢেলে প্রকাশ বলল, “থট ফর ফুডের ডোরম্যানের চাকরি। সকাল এগারোটা থেকে রাত এগারোটা। বৃহষ্পতিবার ছুটি। মাইনে মাসে তিন হাজার টাকা। ছ’মাস কাজ দেখে মাইনে বাড়ানোর কথা ভাবব। রাজি?”

বাবুলাল কিছু বলার আগে নেহা বলল, “কিন্তু পাপা, আমাদের এখানে ডোরম্যান আছে…”

প্রকাশ হাত উঁচু করে নেহাকে থামাল। বাবুলাল ঢকঢক করে আর এক গ্লাস জল শুষে নিয়ে বলল, “রাজি স্যার। আর এক গ্লাস জল…”

“কাল থেকে জয়েন করে যাও। এই মাসে যে ক’দিন কাজ করবে, সে ক’দিনের মাইনে পাবে। বাই দ্য ওয়ে, বড় পাকানো গোঁফ রাখতে হবে।”

“গালপাট্টা?” আর এক গ্লাস জল খায় বাবুলাল।

“হ্যাঁ। আর, মিনারেল ওয়াটার পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। বাইরের বেসিন থেকে জল খেয়ে নাও।”

“আচ্ছা স্যার!” জামার হাতা দিয়ে চোখমুখ মুছে অফিস থেকে এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাবুলাল।

নেহা বলে, “পাপা! এটা কী হল? আমরা কি গরিব মানুষের সেবা করব বলে চ্যারিটেব্‌ল ট্রাস্ট খুলেছি?”

“ট্রাস্ট মি নেহা! এই লোকটাকে আমাদের দরকার লাগবে। এখানে না হলে অন্য কোথাও। অ্যাজ ফার অ্যাজ আই ক্যান রিমেমবার, মধুরা একবারই আমাদের বাংলোয় গিয়েছিল।”

“তুমি কি সেই জন্যেই বাবুলালকে গোঁফ রাখতে বললে?”

“ডোরম্যানদের মধ্যে একটা মহারাজা লুক থাকে। সেটা একটা কারণ। আর গোঁফ উইল চেঞ্জ হিজ লুক।”

“তুমি কি বাবুলালকে মধুরার রেস্তোরাঁয় ইমপ্লান্ট করার কথা ভাবছ?”

অফিস ঘরের দরজা খুলে উঁকি মারছে বিনয়। তাকে হাত নেড়ে ভেতরে ডাকে প্রকাশ। নেহাকে বলে, “ঠিকই ভেবেছিস। আর সেই জন্য ওর বড় কোনও রেস্তোরাঁয় কাজ করার ক্রেডেনশিয়াল দরকার। অন্য রেস্তোরাঁয় কাজ পেতে সুবিধে হবে।”

নেহা মুচকি হেসে বলল, “তোমার কাছে আমার অনেক কিছু শেখা বাকি আছে, পাপা।”

প্রকাশ বলে, “রান্না একটা আর্ট। কিন্তু রেস্তোরাঁ চালানো একটা ব্যাট্‌ল। চপার, বঁটি, হাতা, খুন্তি, চাকি, বেলুন, গরম তেল, লঙ্কাগুঁড়ো, মরিচগুঁড়ো হল ওয়েপন। এখানে একটাই মন্ত্র। লিভ অ্যান্ড লেট ডাই।”

বিনয় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকাশ বলল, “বিনয়ের অবতার! কী তোমার প্রবলেম? শুনি একটু!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *