মধুরেণ – ৬

দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল। মধুরা নড়েচড়ে বসল। বলল, “এই বাড়িটা আপনার?”

“হ্যাঁ-ও বলতে পারিস, না-ও বলতে পারিস।” বিয়ার শেষ করে প্রচণ্ড জোরে ঢেকুর তোলে ডুঙ্গার। “অঘোরচন্দ্র শীলের নাম শুনেছিস?”

ডুঙ্গারের খাটে বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘পারিজাত’ আর ইংরিজি ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ইভ’এর লেটেস্ট ইস্যু রাখা রয়েছে। ডুঙ্গারের বাংলা উচ্চারণে একবিন্দু জড়তা নেই। বাঙালি আজকাল যেরকম অ্যাংলিসাইজ্‌ড বা হিন্দিসাইজ্‌ড উচ্চারণে কথা বলে, তার তুলনায় ডুঙ্গারের বাংলা একশোগুণ শুদ্ধ।

“না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর মধুরার।

“অঘোর এই প্রাসাদ বানায়। নাম দেয় শীল ম্যানশন। ঠিকানা, সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিট।”

ডুঙ্গারের কথা শুনে লন্ডনের ঝালমুড়িওয়ালা অ্যাঙ্গাস ডিনুনের কথা মনে পড়ে যায় মধুরার। সেও কলকাতার সব বাড়িকে প্যালেস বলত।

ডুঙ্গার বলে, “কলকাতা শহরে অঘোরের কুড়িটা বাড়ি ছিল। বিশ্বনাথ হালদার তার থেকে দশটা বাড়ি কিনে নেয়।”

“বিশ্বনাথ হালদার আবার কে?”

“যুদ্ধের সময়ে স্ক্র্যাপের ব্যাবসা করে হঠাৎ বড়লোক হওয়া বাঙালি। বিশ্বনাথের ছেলে দশটা বাড়িই বিক্রি করে দেয়। রোজ সন্ধেবেলা বন্ধু আর মোসায়েবদের সঙ্গে সোনাগাছি গিয়ে বিলিতি মদের ফোয়ারা— বাঙালির উৎপাতের ধন কীভাবে চিতপাতে গিয়েছে, জানা আছে নিশ্চয়?”

“হ্যাঁ,” রাগরাগ গলায় বলে মধুরা। ডুঙ্গারের মুখ থেকে বাঙালির নিন্দে শুনতে ভাল লাগছে না।

ডুঙ্গার বলে, “ওই বাড়িগুলো কিনে নেয় সুরজমল পারেখ।”

“সুরজমল…”

“আমার ওপরদিকের চোদ্দগুষ্টির কেউ হবে। মারওয়াড়িতে একটা কহাবত আছে, ‘যাঁহা না পৌঁছে বয়েল গাড়ি, ওয়াহাঁ পৌঁছে মারওয়াড়ি।’ মানে, যেখানে এখনও গোরুর গাড়ি পৌঁছয়নি, সেখানে আমরা পৌঁছে যাই। সেইভাবেই বিশ্বনাথের কাছে পৌঁছেছিল সুরজমল। বাকি বাড়িগুলোর কী হল জানি না, কিন্তু শীল ম্যানশন পেয়েছিল আমার বাবা গুলাবচাঁদ পারেখ। আমি পেয়েছি বাবার কাছ থেকে।”

“মালিক বদলাল অথচ বাড়ির নাম চেঞ্জ হল না? আশ্চর্য!”

“বাড়ির হাতবদল আইনি পথে হয়নি। অঘোরের কাছ থেকে বিশ্বনাথ কিনেছিল কাঁচা টাকার বিনিময়ে। মালিকানা বদলের কোনও ডকুমেন্ট নেই। বিশ্বনাথের কাছ থেকে সুরজমল কিনেছিল কাঁচা টাকা দিয়ে। হাতে লেখা একটা কাগজ আমার কাছে আছে। কোর্টে ওই কাগজের কোনও ভ্যালু নেই।”

“কর্পোরেশানের কাগজে সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিট হোল্ডিং ওনারের নাম ‘শীল’ কেটে ‘পারেখ’ করতে কতক্ষণ লাগবে?” ডুঙ্গারের কুযুক্তিতে বিরক্ত হয়ে বলে মধুরা।

ডুঙ্গার মুচকি হেসে বলে, “এটা হাইড্রোসিল নয়, অঘোর শীল। কাটার ঝামেলা অনেক বেশি।”

মধুরা হাসতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। দাদুর বয়সি লোকের মুখে এই জাতীয় রসিকতা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়।

“রাগ করিস না। আমি লোকটা এইরকম।” আবার অক্সিজেনের মাস্ক হাতে নিয়ে ডুঙ্গার বলল, “রান্নাঘরের মেঝেয় একটা থালা রাখা আছে। এনে দিবি?”

চেয়ার থেকে উঠে মধুরা রান্নাঘরে ঢোকে। গ্যাস আর স্টোভ রয়েছে। একটা পুরনো দামড়া ফ্রিজ চলছে ঘরঘর করে। বাঙালি বাড়ির রান্নাঘরের মতো মেঝেয় বঁটি, শিলনোড়া, পেতলের বাসনের ডাঁই পড়ে রয়েছে। তারই মধ্যে কানাউঁচু পেতলের থালায় পান্তাভাত রয়েছে।

ডুঙ্গার এখন পান্তা খাবে? মধুরা অবাক। সবজির ঝুড়িতে উঁকি দেয় সে। পেঁয়াজ… আছে। লেবু… আছে। তেল… আছে। ঝটপট কাজ শুরু করে মধুরা। ফ্রিজে উঁকি মেরে দেখে দু’টুকরো মাছের পেটিও রয়েছে! গুড! পেঁয়াজগুলো চাকাচাকা করে কেটে পান্তার থালার কানা বরাবর সাজায়। সবুজ কাঁচালঙ্কা গুঁজে দেয় পেঁয়াজের চাকের মাঝখানে মাঝখানে। বার্নারে কড়া চাপিয়ে সর্ষের তেল ঢেলে প্রশ্ন করে, “তুমি মাছভাজা খাও?”

“গু খাই না গন্ধ বলে, লোহা খাই না শক্ত বলে।” চেঁচিয়ে উত্তর দেয় ডুঙ্গার। ভুরু কুঁচকোয় মধুরা। লোকটা খুব ইন্টারেস্টিং, কিন্তু থেকে থেকেই ভালগার কথা বলাটা মধুরা জাস্ট নিতে পারছে না।

তেল ফুটছে টগবগ করে। মাছের পেটিতে নুনহলুদ মাখিয়ে ফুটন্ত তেলে ছেড়ে দেয় মধুরা। মাছভাজার গন্ধে জিভে জল আসে। আজকে দুপুরে একজনকে ভাল করে খাওয়াবে, এই ভেবে মন খুশিতে ভরে ওঠে।

কড়কড়ে মাছভাজা পাত্রে সাজিয়ে সে আবার ডুঙ্গারের ঘরে ঢোকে। টেবিল থেকে বিয়ারের বোতল সরিয়ে পেতলের কানা উঁচু থালা রাখে। ডুঙ্গার চেয়ারে মাথা রেখে ঢুলছিল। হঠাৎ নাক টেনে সোজা হয়ে বসে, মাস্ক খুলে বলল, “মাছভাজা?”

“হুঁ। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।”

আবার প্রচণ্ড জোরে ঢেকুর তুলে থালা টেনে নেয় ডুঙ্গার। এক খাবলা পান্তা খায়। পেঁয়াজে কামড় দেয়। কচকচ করে লঙ্কা চিবিয়ে বলে, “মেল্টিং পট, সিজ্‌ন টু থেকে আউট। এখন কী প্ল্যান?”

মধুরা ক্রমশ এই প্রসঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মাথা নিচু করে বলল, “ফুড রিলেটেড কিছু করব।”

পান্তার ওপরে লেবু কচলে ডুঙ্গার বলল, “কিছু মানে কী?”

“ভাবছি একটা রেস্তোরাঁ খুলব। আসলে রান্না করতে আর লোককে খাওয়াতে আমার খুব ভাল লাগে। হ্যাঁগো, মাছভাজাটা কেমন হয়েছে?”

“ভাল হয়েছে,” পান্তাভাত শেষ করে, পান্তার জলটুকু চুমুক দিয়ে খেয়ে ডুঙ্গার বলে, “রান্না করতে পারা আর রেস্তোরাঁ খোলার মধ্যে অনেক তফাত। একটা আর্ট, অন্যটা কমার্স।”

“রান্না করা আর কুকারি শো হোস্ট করার মধ্যেও অনেক তফাত। দুটোই যখন ঠিকঠাক উতরে দিলাম, তখন এটা পারব না কেন?”

“বোকা মেয়ে। রান্নাঘরে ফেইল করলে কিছু যাবে আসবে না। ওটা হোমফ্রন্ট। কুকারি শো হোস্ট করাটা চাকরি। মাসমাইনের বিনিময়ে দিনে দশ থেকে বারো ঘন্টার কাজ। বাকি সময় তোর নিজের। ফেইল করলে তোকে তাড়িয়ে দেবে। তুই আর একটা চাকরি পাবি। কিন্তু রেস্তোরাঁ চালানো মানে ব্যাবসা করা। তোর ইনভেস্টমেন্ট, তোর শ্রম, তোর মেধা, তোর সব কিছু। তুই নিজেই নিজের মালিক। তখন চব্বিশ ঘন্টাই কাজ। যখন শুধু রান্না করতিস, তখন রান্নার কোয়ালিটি-ই একমাত্র বিবেচ্য ছিল। ভাবতিস, লোকে খেয়ে ভাল বলবে তো? যখন কুকারি শো হোস্ট করতিস, তখন নিজের লুক, ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, ডায়ালগ ডেলিভারি, লাইট নেওয়া— এই নিয়ে ভাবতিস। রেস্তোরাঁ খুলতে চাইলে তোকে অন্তত সতেরো রকমের লাইসেন্স জোগাড় করতে হবে। লোকেশান নিয়ে ভাবতে হবে, ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ভাবতে হবে, স্টাফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ভাবতে হবে। রেস্তোরাঁর অ্যাড, ইন্টিরিয়র ডেকরেশান, মেনু সিলেকশান, কাটলারি-ক্রকারি নিয়ে ভাবতে হবে। স্টাফেদের ইউনিফর্ম, মাইনে, ইউনিয়নবাজি, ইনক্রিমেন্ট-গ্র্যাচুইটি-পেনশান নিয়ে ভাবতে হবে। কাস্টমারদের টেস্ট নিয়ে ভাবতে হবে। এবং এত কিছু করার পরেও এটা টলারেট করতে হবে যে দিনের পর দিন কাস্টমার আসবে না। ওভারহেড এক্সপেনডিচারের জন্য ক্যাপিটালে হাত পড়বে। ইএমআই, ইলেকট্রিক বিল, স্টাফেদের মাইনে দিতে গিয়ে আস্তে আস্তে ফতুর হয়ে যেতে হবে। এরপরেও রেস্তোরাঁ খুলবি? বাঙালি মেয়ের সেই কলজের জোর আছে?”

পান্তাভাতের থালা তুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মধুরা বলে, “দুটো জিনিস আমায় ভাবাচ্ছে। একনম্বর হল লোকেশান। দু’নম্বর, সতেরো রকমের লাইসেন্স।”

“বাকিগুলো?” চিৎকার করে জানতে চায় ডুঙ্গার। বিয়ার আর পান্তার ককটেলে তার গলা জড়িয়ে গেছে।

“ওই লম্বা লিস্ট বলে তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পারোনি। কোথাও তো একটা শুরু করতেই হয়। ইংরিজিতে কী একটা কথা আছে। এভরি জার্নি স্টার্টস উইথ ফার্স্ট স্টেপ…”

“ওটা কনফুসিয়াসের কথা। এভরি জার্নি স্টার্টস উইথ এ সিঙ্গল স্টেপ।”

“কনফিউস… সেটা আবার কে?”

“সত্যি মাইরি! দেশের কী অবস্থা! একজন বাঙালি কনফুসিয়াসের নাম জানে না। বলছে, ব্যাবসা করব। আর একজন মারওয়াড়ির টাকা নেই। তাও সে বাড়িতে ‘পারিজাত’ রাখছে আর দুপুরে বিয়ার খেয়ে ঘুমোচ্ছে।”

“আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি দুটো প্রশ্নের উত্তর দাও। একনম্বর, সুলতানদা মারা যাওয়ার আগে কেন লিখে গিয়েছিল, কলকাতায় ফিরে আমি যেন তোমার সঙ্গে দেখা করি?”

মধুরার প্রশ্নে ডুঙ্গার সিরিয়াস হল। অক্সিজেনের মুখোশ পরে কিছুক্ষণ শ্বাস নিল। মুখোশ রেখে বলল, “ট্যালেন্ট স্পটারদের কাজ হল ট্যালেন্ট খুঁজে বার করা। আমি সুলতানকে স্পট করেছিলাম পিলখানার রেড লাইট এরিয়া থেকে। সুলতান আমার গর্ব। সুলতান তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিল রাস্তার ধারের ধাবায়। তুই সুলতানের গর্ব। ও কখনও তোকে আমার কথা বলেনি। কিন্তু আমার কাছে এসে তোর যাবতীয় সাফল্যের খবর দিয়ে যেত। ও আমাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আমার স্পট করা ট্যালেন্টের থেকে ওর স্পট করা ট্যালেন্ট অনেক বেশি প্রতিভাবান। আমার স্পট করা ট্যালেন্ট মরে ভূত হয়ে গেছে। কিন্তু ওর স্পট করা ট্যালেন্ট বিলেত জয় করেছে।”

মধুরা মাথা নিচু করে খোপকাটা মার্বেলের মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সুলতানের জন্য সে কিছুতেই চোখের জল ফেলবে না। কিন্তু লোকটা অতর্কিতে এমন ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমন কাঁদায়…

“তুই লন্ডন চলে গেলি। সুলতান গেল জেলে। জেল থেকে বেরিয়ে আমার কাছে যখন এল, তখন ও একজন হেরে যাওয়া মানুষ। ও জানত ও আর বাঁচবে না। আমিও জানতাম। ওইরকম বাঘের বাচ্চাকে আমাদের সোসাইটি যেভাবে ডিল করল, তাতে আমাদের সব্বার থুথু ফেলে ডুবে মরা উচিত। যে লোকটা বাংলার ফুড অ্যাম্বাস্যাডার হতে পারত, তাকে লাথি মেরে, লাঠির বাড়ি মেরে, জেলে পুরে, বেল না দিয়ে, মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে, তার নামে কলঙ্ক রটিয়ে যেভাবে ম্যালাইন করা হল, তারপর ও সুইসাইড করে বেশ করেছে। আন্ডারডগের সিনেমা পাবলিক খুব খায়। লড়াকু হিরোর সঙ্গে হেরো দর্শক নিজেকে আইডেন্টিফাই করে। সিনেমার শেষে হেরো হিরো হলে, দর্শক খুশ! সে হিরোকে মাথায় তুলে নাচে। কিন্তু হেরো যদি না জেতে? একবার ঝাড় খেয়ে উঠে দাঁড়ায়, দু’বার ঝাড় খেয়ে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু তিনবার? চারবার? পাঁচবার? দশবার? তখন সে আইএসআই ছাপযুক্ত আগমার্কা হেরো। তার জীবনে আর কোনও ফিলিম নেই। সে ফিনিশ্‌ড, সে ডেড, সে সিন থেকে আউট। সুলতান হেরো ছিল না। ওকে জোর করে হেরো বানানো হয়েছিল। ও তাই ঠিক কাজটা করেছে। সময় থাকতে এই কুচ্ছিত পৃথিবী থেকে পালিয়েছে। আমার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে এসে বলেছিল, আমি যেন পারুলকে একটা কাজ দিই। আমি ওর অনুরোধ রেখেছিলাম। শীল ম্যানশনের গায়ে একটা ফুড জয়েন্ট আছে। নাম…”

“ফ্যাট মামা’জ কিচেন।”

“গুড অবসার্ভেশান। ওই জয়েন্টটা আমার। টিমটিম করে চলে।”

কান্না চেপে, মাথা তুলে মধুরা বলল, “দু’নম্বর প্রশ্ন, তোমার ফ্যামিলি কোথায়?”

“আমার গিন্নি ময়নাদেবী আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সুইসাইড করেছে। আমার এক ছেলে। নাম প্রকাশ পারেখ। ওর বউ সারভাইকাল ক্যানসারে মারা গেছে। তিন নাতি নাতনি। বড় নাতি মনোজ মুম্বইতে থাকে…”

ডুঙ্গারকে থামিয়ে দিয়ে মধুরা বলল, “সন্দীপ আর নেহা পারেখ কলকাতায় থাকে। স্যান্ডি আইটি সেক্টরে কাজ করে। নেহা লেমনগ্রাস সামলায়। গতকাল একটা বিয়েবাড়িতে স্যান্ডির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ওর মুখেই লং স্ট্রিটের নাম শুনেছিলাম।”

ডুঙ্গার বলল, “ফ্যামিলির কথা থাক। নিজের কথা বলি। ফ্যাট মামা’জ কিচেন নামে একটা বার কাম রেস্তোরাঁ চালাতাম। ডিলিশাস ফুড, নিত্যনতুন ককটেল, লাইভ ব্যান্ড। ইট ওয়াজ টক অব দ্য টাউন। তারপর আমি একটা ব্যক্তিগত সমস্যায় ফেঁসে গেলাম। রেস্তোরাঁ দেখার কেউ রইল না। কাস্টমারের ফুটফল কমতে কমতে জিরো হয়ে গেল। মাইনে না পেয়ে স্টাফেরা অন্য জায়গায় চলে গেছে। ফ্যাট মামা’জ কিচেন এখন সরকারি আপিসের বাবুদের মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন বিক্রি করে। মাস গেলে হাজার দু’-তিনেক টাকা লাভ হয়।”

“পারুলবউদির আসার আগে এখানে কে রান্না করত? তুমি?”

“আমি বহুকাল কাজ করা ছেড়ে দিয়েছি। ওটা চালায় জোনাকি।”

“জোনাকি আবার কে?”

“মিস জোনাকির নাম শুনিসনি?”

“মিস… জো…না… কি…” থেমে থেমে বলে মধুরা। তার মাথায় একটা মন্তাজ তৈরি হচ্ছে। আশির দশকের কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমার নামকরা ভ্যাম্প মিস জোনাকি! যখন আইটেম ডান্স বলে কোনও শব্দবন্ধ কয়েন হয়নি, তখন একের পর এক সাদাকালো ছবিতে সিডাকটিভ গান থাকত। রেস্তোরাঁ বা গুন্ডার আড্ডায় চিত্রায়িত সেই সব গানের সঙ্গে নাচত মিস জোনাকি। বাঁশপাতার মতো হিলহিলে চেহারা, জোছনার মতো গায়ের রং, বালিঘড়ির মতো ফিগার, বাতাবি লেবুর মতো বুক! হঠাৎ সে সিনেমা জগৎ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ফিল্ম ম্যাগাজিনে মধুরা পড়েছে, এক পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীকে ফাঁসিয়ে মিস জোনাকি বিলেত চলে গেছে। সেই মিস জোনাকি রাস্তার ধারে চাউমিন বিককিরি করে?

“কিছু মনে পড়ল?” মিটিমিটি হাসছে ডুঙ্গার।

“হ্যাঁ… শুনেছি উনি কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীকে…” সাবধানে শব্দচয়ন করে মধুরা, “বিয়ে করে… বিদেশে সংসার করছেন।”

“বিয়ে না ঘেঁচু। জোনাকি আমার কেপ্ট। পিলখানার রেড লাইট এরিয়ায় প্রথম দেখা। পরে ভালবাসা হয়ে যায়। আমিই সেই বড়লোক ব্যবসায়ী। একবার ওকে নিয়ে ইয়োরোপ ঘুরতে গিয়েছিলাম বলে ম্যাগাজিনে ওইসব লেখা হয়েছিল। জোনাকির জন্যে আমার বউ সুইসাইড করে। জোনাকির জন্যে আমার ছেলে আমার খবর নেয় না।”

“বুঝলাম!” সন্তর্পণে নিজের ব্যাগ নেয় মধুরা। হাত জোড় করে বলে, “আমি এবার আসি?”

“আমাকে ‘চরিত্রহীন’ বলে মনে হচ্ছে?”

“শরৎচন্দ্র পড়িনি। তবে সেই রকমই মনে হচ্ছে।”

“ব্যাবসা করার বেসিক জায়গায় তুই ফেল করলি। প্রথম আলাপেই পোটেনশিয়াল পার্টনারকে তার চরিত্র দিয়ে জাজ করছিস।”

“পোটেনশিয়াল পার্টনার? কে? তুমি? তোমাকে পার্টনার করে আমার লাভ?”

“অংশীদারি ব্যাবসার মূল কথা হল, কেউ কাউকে ফেভার করছে না। তুই আমাকে পার্টনার করছিস না। আমিও তোকে পার্টনার করছি না। আমি আর তুই আমাদের অ্যাসেট নিয়ে পরস্পরের কাছে আসছি।”

“কীরকম?” গলার আওয়াজে সার্‌কাজম মেশায় মধুরা। নিজের অ্যাসেট কী সে জানে। বিলেত ফেরত শেফ, পাউন্ডের মালিকের পিছনে এইরকম ধান্দাবাজরা ঘুরবেই। এদের মধুরা চেনে। ট্যাক্‌লও করতে পারে। শুধু সুলতানদার শেষ ইচ্ছে বলে এই লোকটাকে টলারেট করছে। না হলে অনেক আগেই ভেগে যেত।

“রেস্তোরাঁ ব্যাবসার এক নম্বর কথা কী বল তো?” প্রশ্ন করে ডুঙ্গার।

“সোজা প্রশ্ন। এক থেকে তিন নম্বর কথা হল, লোকেশান, লোকেশান, লোকেশান।”

“তোর সাধের রেস্তোরাঁ কোথায় খুলবি? কিছু ভেবেছিস?”

মধুরা থমকাল। পার্ক স্ট্রিট, থিয়েটার রোড, গুরুসদয় রোড— এই সব জায়গায় প্রপার্টি কেনার সামর্থ্য তার নেই। নেক্সট অপশন ভাড়া নেওয়া। নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছে, যে সব জায়গাগুলো ভাড়া দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে, সেগুলো ভাল নয়। হয় গলির মধ্যে, নয় দু’তলা বা তিনতলায়। প্রধান রাস্তার ওপরে, একতলায়, ফ্রন্ট ফেসিং, চওড়া কোনও প্রপার্টি সে পায়নি।

“আমার জায়গা আছে, টাকা নেই। তোর টাকা আছে, জায়গা নেই। দু’জনেরই কমন ইন্টারেস্ট, লোককে খাইয়ে টাকা রোজগার করা। আমরা পার্টনার হতে পারি না?”

মধুরা ঠান্ডা মাথায় ডুঙ্গারের যুক্তি শুনল। বলল, “আমি এই বিষয় নিয়ে এক্ষুনি কিছু বলতে পারছি না। আমাকে ভাবার সময় দাও। তা ছাড়া, আগে তো পেপার ওয়ার্ক। বার-কাম-রেস্তোরাঁ খুলতে গেলে সতেরো রকমের লাইসেন্স লাগে। কথাটা তুমিই আমাকে বললে। আমি আবার এ বিষয়ে কিছুই জানি না।”

“এই বিষয়ে আমি হেল্‌প করতে পারি কি?” সিঁড়ি থেকে হাস্কি মহিলা কন্ঠ ভেসে এল। মধুরা চমকে উঠে পিছন ফিরল।

ডুঙ্গার বলল, “জোনাকি, এই পুঁচকে মেয়েটার নাম মধুরা। আর মধুরা, এ হল জোনাকি। আশি বছরের বুড়োর পঞ্চাশ বছরের রাখেল।”

“মুখে একটু লাগাম দাও। বাচ্চা মেয়েটার সামনে এসব কথা বলার কোনও প্রয়োজন আছে কি?” জানতে চাইল মিস জোনাকি।

মধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সিঁড়ির ব্যাকলাইটে স্নাত জোনাকিকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ সে। এই মহিলা অতীতে ভ্যাম্প ছিলেন? সেক্স-বম্ব ছিলেন? হতেই পারে না। অসম্ভব ব্যাপার!

জোনাকির হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। অসম্ভব ফরসা। শরীরে সামান্য মেদ জমলেও চমৎকার ফিগার। চোখে লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা। পরনে লালপাড় সাদা জমির গরদের শাড়ি। হাতে পেতলের থালায় ঠাকুরের প্রসাদ। মধুরার কাছে এসে বলল, “প্রসাদ খা।”

মধুরা এখনও মিস জোনাকির দিকে তাকিয়ে।

“কী দেখছিস?” মধুরার মুখে দুটো নকুলদানা গুঁজে প্রশ্ন করে মিস জোনাকি। মধুরা বলে, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না…”

“কী বিশ্বাস করতে পারছিস না?” ফুট কাটে ডুঙ্গার, “এই সুশীলা গৃহবধূটি ঘোমটা তুলে খ্যামটা নাচত কী করে?”

ডুঙ্গারের কথায় পাত্তা না দিয়ে মধুরা মিস জোনাকিকে বলল, “আমি তোমার অনেক সিনেমা দেখেছি। সামনাসামনি দেখে মনে হচ্ছে না যে ওই মেয়েগুলোই তুমি।”

“সেটাই তো অভিনয়, তাই না?” পেতলের রেকাবি থেকে আরও দুটো নকুলদানা ডুঙ্গারের মুখে গুঁজে দেয় মিস জোনাকি, “আমি পূজাকে ছুটি দিয়ে দোকান বাড়িয়ে আসছি। তারপর তোমাদের কথা শুনব।”

“দোকান বাড়ানো মানে?” অবাক হয়ে বলে মধুরা। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মিস জোনাকি বলে, “ওটা তুই কত্তাবাবুর কাছ থেকে শুনে নে।”

ডুঙ্গার বলে, “তোরা, বাঙালিরা, কখনও ‘যাই’ বলিস না। বলিস, ‘আসি।’ এটার ব্যাখ্যা কী?”

“যাই বলার মধ্যে বিচ্ছেদের ভাব আছে। তাই উলটোটা বলা হয়।”

“আমরা, মারওয়াড়িরা কখনও বলি না যে ‘দোকান বন্ধ করে দেব।’ ব্যাবসা আমাদের চালিকাশক্তি। তাকে বন্ধ করব কী করে? রাতে দোকান বন্ধ করার সময়ে আমরা বলি, ‘দুকান বাড়ানা হ্যায়।’ অ্যাজ ইফ, দোকানের সম্প্রসারণ হবে। এই কথাটাই জোনাকি বাংলায় বলল।”

“পূজা আবার কে? কী বিচ্ছিরি, ফিল্মি নাম!”

ডুঙ্গার হাসতে হাসতে বলল, “ওর নাম পূজারিনী ভড়। আমি নামটাকে ছোট করে দিয়েছি। পূজা ফ্যাট মামা’জ কিচেনে কাজ করে। পারুল রাঁধত, ও সাপ্লাই করত। পারুল চলে যাওয়ার পরে এখন একাই সব সামলাবে।”

“মিস জোনাকি তোমাকে কী বলে ডাকল?”

“কত্তাবাবু। পিলখানা থেকে আমাকে এই নামেই ডাকে।”

“মিস জোনাকির আসল বাড়ি কোথায়?”

“বর্ধমানের খণ্ডঘোষ না অণ্ডকোষ নামের গ্রামে ও পয়দা হয়েছিল। বাবা হদ্দ গরিব। দেখতে শুনতে ভাল, ডাগরডোগর চেহারা। কমবয়সেই আড়কাঠির হাত ধরে পিলখানার রেন্ডিপাড়ায় চলে আসে।”

“তোমার মুখ খুব খারাপ। মেয়েদের সামনে এইভাবে কথা বলতে নেই।”

মাস্ক টেনে আবার অক্সিজেন নেয় ডুঙ্গার। বলে, “মেয়েদের চিরকাল ‘মাল’ ভেবে এসেছি। ভগবান আজ তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। জোনাকির প্রেমে হাবুডুবু না খেলে বুঝতাম না যে তোরাও মানুষ। তোদেরও সুখদুঃখ আছে।”

মিস জোনাকি ফ্যাট মামা’জ কিচেন বন্ধ করে ফিরে এসেছে। ডুঙ্গার বলল, “আজ কীরকম কাজ হল?”

“সব দিয়েথুয়ে তিনশো টাকা,” ডুঙ্গারের ফতুয়ার পকেটে তিনটে ময়লা একশো টাকার নোট গুঁজে দেয় মিস জোনাকি।

ডুঙ্গার বলে, “ওফ! তা হলে তো বড়লোক হয়ে গেলাম। মধুরা, কী খাবি বল? মোগলাই না কন্টিনেন্টাল?”

মধুরা ম্লান হাসল। সে অবাক হয়ে এই মোটা, থলথলে, হেঁপো বুড়োটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বুড়ো মানুষদের দেখলে একটা ছকে ফেলা হয়। বৃদ্ধাবাস, ওষুধপত্র, লাঠি, মাঙ্কি ক্যাপ, পুজোআচ্চা, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট, হাঁটুর ব্যথা, মর্নিং ওয়াকের ছক। সে যে কখনও যুবক ছিল এ কথা ভুলে যাওয়া হয়। ডুঙ্গার সেই ছকের বাইরে বিলং করে।

পঁয়তিরিশ বছর আগে লোকটা জোনাকির জন্যে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে! আজ প্রতিদিনের রোজগার তিনশো টাকা। তাই নিয়ে কোনও দুঃখবোধ নেই। কোনও হতাশা নেই। হাসিমুখে বলছে, আশি বছর বয়সে তার ‘রাখেল’ আছে।

জোনাকি সেই কথার কোনও প্রতিবাদ করছে না। কেননা সে জানে যে ওগুলো বাজে কথা। যে মেয়ের জন্য ডুঙ্গার নিজের পরিবার ত্যাগ করেছে, পারিবারিক সম্পত্তি ত্যাগ করেছে, সে আর যাই হোক রাখেল নয়। দু’জনের প্রেম কত গভীর হলে এই পজিটিভ অ্যাটিটিউড থাকা সম্ভব?

মিস জোনাকি তিন কাপ চা নিয়ে এসেছে। ডুঙ্গার আর মধুরার হাতে কাপ ধরিয়ে নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “তারপর, এতক্ষণ ধরে আলোচনা করে কী ঠিক হল?”

ডুঙ্গার আবার মুখোশ পরে নিয়েছে। মিস জোনাকি মেঝের দিকে তাকিয়ে। দু’জনেই মধুরার উত্তর শোনার অপেক্ষায় রয়েছে।

“আমি আর ডুঙ্গার মিলে ঠিক করলাম, সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিটে একটা রেস্তোরাঁ খুলব,” মিষ্টি হেসে বলে মধুরা, “ইনভেস্টমেন্ট আমার, লোকেশান ডুঙ্গারের। বাকি সব কাজকর্ম উতরে দিত পারব। কিন্তু সতেরো রকমের লাইসেন্সের ব্যাপারটায় ঘাবড়ে যাচ্ছি।”

ডুঙ্গার মুখোশ খুলে মধুরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি ঝিলমিল করছে। মিস জোনাকি প্রথমে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “তুই ভুল জানিস।”

“মানে?” অবাক হয়ে বলে মধুরা।

“কলকাতা শহরে যে-কোনও রকমের ব্যাবসা শুরু করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে আটটা লাইসেন্স বা ক্লিয়ারিং লাগে। বিভিন্ন রকমের ব্যাবসার জন্য আলাদা আলাদা লাইসেন্স আছে। রেস্তোরাঁ ব্যাবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের সংখ্যা সতেরো নয়। বাইশ।”

“বাপ রে!” হতাশ হয়ে বলে মধুরা, “কাগজ জোগাড় করতে করতে বুড়ো হয়ে মরে যাব তো!”

“ওয়েলকাম টু লাইসেন্স রাজ! ট্রেড লাইসেন্স দেবে কলকাতা কর্পোরেশান। ফুড লাইসেন্স দেবে ফুড কর্পোরেশান। ভ্যাট লাইসেন্স দেবে কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিস। সেন্ট্রাল এক্সাইজের রেজিস্ট্রেশান এবং ক্লিয়ারেন্স থাকলে ভাল হয়। প্রথমটা পাওয়া যাবে পোদ্দার কোর্টের কমিশনার অফ সেন্ট্রাল এক্সাইজের দফতর থেকে, আর পরেরটা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের ব্রাঞ্চ অফিস থেকে।”

“আরও আছে?”

“পলিউশান কনট্রোল বোর্ডের নো অবজেকশান সার্টিফিকেট, এমপ্লয়িদের জন্য ইএসআই আর পিপিএফ, প্রফেশনাল ট্যাক্স, লিকার লাইসেন্স, এক্সপ্লোসিভ ক্লিয়ারেন্স আর ফায়ার লাইসেন্স, ডিজেল জেনারেশান সেট ক্লিয়ারেন্স আর বয়েলার রেজিস্ট্রেশান… আরও আছে। সেগুলোর ফিরিস্তি দিয়ে বোর করব না। আমি শুধু বলতে পারি যে এগুলো আমি করে দেব। আমার কনট্যাক্ট আছে। কম টাকায় হবে। তাড়াতাড়ি হবে। এবং আমি কোনও প্রফেশনাল ফি নেব না।”

মধুরা মনে মনে হিসেব কষছিল। ডুঙ্গারের সঙ্গে পার্টনারশিপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সে হঠাৎ করে নেয়নি। সুলতানদার স্মৃতি অথবা সুলতানদার রেকমেন্ডেশান এখানে কাজ করেনি। ব্যাবসা ইমোশানের জায়গা নয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অঙ্ক কষে। ডুঙ্গারের এই বড়, রাস্তামুখো বাড়িটাই তাকে বাধ্য করেছে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু মিস জোনাকির কাছ থেকে অযাচিত উপকার পেয়ে সে আপ্লুত।

মিস জোনাকি বলল, “রাত হয়েছে। তুই এবার বাড়ি যা।”

“হুম!” উঠে দাঁড়ায় মধুরা, “তোমাদের ফোন নাম্বার দাও।”

ডুঙ্গার নিজের মোবাইল নাম্বার আওড়ে মিস জোনাকিকে বলে, “তোমার ঘ্যাঁট কখন বানাবে?”

“তোমার কী দরকার?” মুখঝামটা দেয় মিস জোনাকি।

দুই বুড়োবুড়ি আবার ঝগড়া মোডে চলে গেছে। মুচকি হেসে মধুরা বলল, “ঘ্যাঁট বানানোর কেসটা কী?”

“আর বলিস না!” ব্যাজার মুখে বলে ডুঙ্গার, “জোনাকির সতীপনা দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। রোজ একবেলা স্বপাক খায়। সেটাও নিরিমিশ। বেস্পতিবারে লক্ষীর পাঁচালি পড়ে। শুক্‌কুরবারে সন্তোষী মায়ের ব্রত করে। নিয়মিত সত্যনারায়ণের পুজো করে। ছেনালির অন্ত নেই।”

“তোমার ভালর জন্যেই করি।” মধুরার হাত ধরে ঘর থেকে বেরোয় মিস জোনাকি। হলঘর পেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বাগান পেরিয়ে গেট পর্যন্ত আসে। বলে, “বাড়ি গিয়ে বাবামায়ের সঙ্গে কথা বল। তারপর ডিসিশান নে।”

মিস জোনাকি শীল ম্যানশনের ভিতরে চলে যাওয়ার পরে মধুরা ঘড়ি দেখল। সাড়ে সাতটা বাজে। প্রথম দিন এসে অনেকক্ষণ সময় কাটাল সে।

এখন লং স্ট্রিটের চেহারা অন্য রকম। শাড়ির বুটিক, সেলুন, জুতোর দোকানের আলোয় ঝলমল করছে রাস্তা। ফুটপাথের দোকানেও বেশ ভিড়। উলটো দিকের ফুটপাথে, বহুতলের একতলা জুড়ে ঝলমল করছে একটা রেস্তোরাঁ। পুরো সামনের দিকটা কাচ দেওয়া। নীচের হাফ ফ্রস্টেড গ্লাস, তাই ঝাপসা। ওপরের হাফ দিয়ে রেস্তোরাঁর ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। জ্বলজ্বলে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে রেস্তোরাঁর নাম।

লেমনগ্রাস।

মধুরার চিরশত্রু নেহা পারেখ এখানে তাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁর নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে। কাল এই রেস্তোরাঁর কথাই স্যান্ডি বলছিল। এখানেই তাকে শেফের চাকরির অফার করেছিল।

আবার নেহার সঙ্গে টক্কর দিতে হবে? আবার?

মধুরার উত্তেজনা হচ্ছে। নতুন কিছু করার আগে শরীরে অ্যাড্রিনালিন রাশ হয়। হার্ট বিট বেড়ে যায়। পেটের মধ্যে প্রজাপতি ওড়ে। মুখ লাল হয়ে যায়।

ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় জয়েন করার দিন হয়েছিল। পাঁচফোড়ন-এর প্রথম শুটিং-এর দিন হয়েছিল। মেল্টিং পট-এর প্রথম শুটিং-এর সময় হয়েছিল।

সেসব এখন অতীত। এখন তার জীবনে শুরু হচ্ছে নতুন গল্প। আসছে পুরনো হিসেব মেটানোর নতুন অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *