মধুরেণ – ৫

জলখাবার খেতে বসে মধুরাকে বেরোনোর জন্য রেডি দেখে যূথিকা বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

মধুরা বলল, “ফিরে এসে বলব।”

সবিতা এক প্লেট ডালিয়া টেবিলে রেখে বলল, “ছেলেটা কে?”

এক চামচ ডালিয়া মুখে দিয়ে মধুরা বলল, “তুমি এক কাপ কফি খাওয়াও।”

“নামটা জানলে ভাল লাগত,” যূথিকাকে ব্যথার তেলের শিশি এগিয়ে দিয়ে বলে সবিতা। এর মধ্যে দিয়া এসে খাবার টেবিলে বসেছে। মুখেচোখে রাত্রি জাগরণের চিহ্ন। পরনে নোংরা, ভিজে ম্যাক্সি। তোয়ালের আড়ালে ঢেকে একটা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সবিতাকে বলল, ‘‘এক কাপ কফি আমাকেও দিয়ো।”

বাচ্চাটার দিকে একপলক তাকিয়ে মধুরা বুঝল, এটা পান্তুয়া। আলোচনা ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে সে দিয়াকে বলল, “রাতে ঘুমোওনি?”

ম্লান হেসে দিয়া বলল, “গত ছ’মাসে আমি ছ’ঘন্টাও ঘুমোইনি।” দিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই শোওয়ার ঘর থেকে বাচ্চার কান্না শোনা গেল। কৃশানু ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “বিছানায় পটি করে ফেলেছে।”

সবিতা তড়বড় করে দিয়ার বেডরুমে ঢুকল। রসগোল্লা আর তার ন্যাতাকানি নিয়ে বেরিয়ে এসে বলল, “আমাদের বাচ্চারা হেগে ফেলত। বিছানায় গু-মুত মাখাত। তোমাদের বাচ্চারা ‘পটি’ করে কেন? ‘পটি’ মানে কী?”

পটি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়ে গেছে। ডালিয়া শেষ করে, থালা সিঙ্কে রেখে মধুরা একতলায় নেমে এল। গাড়ি বার করে গ্যারাজের চাবি ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাউন্টারে রেখে বলে, “বিমলকাকা, বেরোচ্ছি।”

ছানা মাখতে মাখতে বিমল বলল, “তোমার বাবার চা-পব্‌বো চুকেছে? তা হলে নামতে বলো। মালিক যদি আলসে হয়, তা হলে ব্যাবসা চলে কী করে?”

কথা না বাড়িয়ে, সানগ্লাস গলিয়ে মধুরা গাড়িতে স্টার্ট দিল। সে এখন যাচ্ছে সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতার মাটিতে পা দিয়ে মধুরার উচিত ছিল নিজের বাড়ি না ঢুকে সুলতানের সঙ্গে দেখা করা। এই লোকটা তার জন্যে যা করেছে, সে জীবনে ভুলবে না।

কলেজ মোড়ের ফুটপাথ এখন সাফসুতরো। এখানে কোনওদিন কোনও ধাবা ছিল, সেই ধাবার মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কষা খেতে সন্ধেবেলা থেকে গাড়ির লাইন পড়ত, যে খাবারের কথা দ্য টেলিগ্রাম খবরের কাগজের মেট্রো সেকশান ‘টিটি’তে আর টিভির কুলিনারি শো-তে দেখানো হত, কলকাতা সে কথা ভুলে গেছে। আশেপাশের পান-বিড়ি-সিগ্রেটের দোকানে জিজ্ঞাসা করে কোনও লাভ হল না। মন্টুর ঝুপ্‌স ছিল ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরে। সেই ঝুপ্‌সও আর নেই। সেখানে গজিয়েছে ‘জাঙ্ক ফুড’ নামের একটা কিয়স্ক। বার্গার, ডোনাট, পিজা এইসব বিক্রি করছে।

মধুরা আশা করেনি যে এই দোকানের কেউ তাকে সুলতানের সন্ধান দেবে। কিন্তু সেই অবাক করা কাণ্ডটাই ঘটল। বছর পঁচিশের এক ছোকরা মধুরাকে দেখে বলল, “আপনি মধুরা ভাউমিক। সুলতানকে ঢুন্ডতে এসেছেন।”

কথায় অবাঙালি টান স্পষ্ট। ছেলেটা কোনও প্রশ্ন করেনি। দুটো স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সানগ্লাস মাথায় তুলে মধুরা বলল, “আপনাকে চিনতে পারলাম না!”

“হামি উমেদ সিংহ। পিলখানায় থাকি। সুলতানের কাছ থেকে এই এরিয়াটা লিজ নিয়েছি। হম আপকা শো রেগুলার দেখতা হ্যায়।”

“থ্যাঙ্কস। সুলতানদার অ্যাড্রেসটা পাওয়া যাবে?”

উমেদ কিছুক্ষণ ঠান্ডা চোখে মধুরার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, “বেকার কেন যাবেন? লফড়া আছে।”

গন্ডগোলের সামনে মধুরার মাথায় একটা জেদি ফড়িং ফড়ফড় করে পাখা নাড়ে। যে মধুরাকে টেনশানে ফেলছে, তাকে ডবল টেনশানে না ফেললে ফড়িংটার শান্তি হয় না। উমেদের দিকে ঠান্ডা চোখে প্রয়োজনের তুলনায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে রইল মধুরা। উমেদ কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘সাত বাই তেরো বাই ছপ্পন হাইস্কুল লেন। পিলখানায় নেমে কাউকে পুছবেন, হাইস্কুল কোথায়। তার বগল দিয়ে যে রাস্তাটা ডাইনে চলে গেছে…”

*

মধুরার মতে, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ইল-ডেভেলপ্‌ড জেলার নাম হাওড়া। ‘হাওড়’ থেকে যে জেলার নামকরণ হয়েছে, যে জেলাকে ‘কুলিটাউন’ বলা হত, লেদ মেশিনের ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে জেলার নাম একসময়ে হয়েছিল ‘বাংলার শেফিল্ড’ সে জেলা বসবাসের অযোগ্য। নেহাত এইখানে জন্ম, এইখানে তার পরিবার থাকে, তাই পালায়নি।

তবে তার রাজচন্দ্রপুর এই পিলখানার থেকে অনেক ভাল। ওটা স্বর্গ না হতে পারে, কিন্তু এইটা নিঃসন্দেহে নরক। শের শাহ্‌-র আমলে তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা জিটি রোডের দু’দিকে অবস্থিত এই এলাকাকে মিনি ভারতবর্ষ বলা যেতে পারে। সমস্ত ভাষা, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত সংস্কৃতির মানুষ এখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। সাততলা হাইরাইজের পাশেই খাপরার চালের ঘর, পঞ্চাশলাখি এসইউভির পাশে ভাঙাচোরা অটো, বড়বাজারে ব্যাবসা করা শুধ্‌, শাকাহারি জৈনের পাশে ‘হালাল করা চিকেন’-এর দোকানের কসাই; ছয় ফুটিয়া পঞ্জাবি ট্রাক ড্রাইভারের পাশে গুটগুটে তিব্বতি স্কুলগার্ল যে যার নিজের মতো আছে। তবে এটি মূলত শহরের আন্ডারবেলি। অধিকাংশ মানুষের পেশা রহস্যময়, অনৈতিক এবং, সম্ভবত বেআইনি। যে-কোনও লোককে ধরে পুলিশ যদি বলে, “অ্যাই! কী করছিস?” তা হলে সে কান ধরে বলবে, “গলতি হো গয়্যা স্যার! ইস বার মুঝে মাফ কর দিজিয়ে!”

মধুরা গাড়ি রাখল জি টি রোডের ওপরে, পুলিশ কিয়স্কের পাশে। চোখ থেকে সানগ্লাস না খুলে কর্তব্যরত কনস্টেবলকে বলল, “আমার আসতে আধঘন্টা সময় লাগবে।”

কনস্টেবল বলল, “তো?”

সানগ্লাস কপালে তুলে কনস্টেবলকে ভাল করে মাপল মধুরা, “থানা থেকে আপনাকে ব্রিফ করেনি?”

কনস্টেবল গরমে কাহিল হয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আমার ডিউটি একঘন্টা পরে শেষ।”

“গুড!” সানগ্লাস চোখে সেঁটে হাঁটা লাগাল মধুরা। বড় গাড়ি, সানগ্লাস আর অ্যাটিটিউড থাকলে দুনিয়ার সবাইকে বাগে আনা যায়। ওই কনস্টেবল এখন দায়িত্ব নিয়ে তার গাড়ি পাহারা দেবে।

মধুরাকে এখন খুঁজে বার করতে হবে সাত বাই তেরো বাই ছাপ্পান্ন নম্বর হাইস্কুল লেন।

বাড়ি খুঁজে পাওয়ার আগে মন্টুকে পেয়ে গেল মধুরা। হাইস্কুলের লাগোয়া একটা চায়ের দোকানে সসপ্যানে চা বানাচ্ছে। এক বছরে অনেক লম্বা হয়েছে। রোগা আর কালোও হয়েছে। গালে ফুরফুরে দাড়ি গজিয়েছে।

মন্টুর পাশে দাঁড়িয়ে মধুরা বলল, “একটা চা দেখি।”

দিনরাত হিন্দি আর উর্দু শুনে অভ্যস্ত মন্টু পাশ ফিরে তাকাল। মধুরাকে দেখে চমকে উঠে সসপ্যান রেখে দিল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দিদি… এতদিন কোথায় ছিলে? বাবা তো মরে গেছে…”

মন্টুর কথাটা দমাস করে মধুরার পেটে লাগল। এত জোর সেই আঘাত যে তার অভিঘাতে রাস্তায় বসে পড়ে মধুরা।

মন্টুও পাশে বসেছে। মধুরা প্রশ্ন করল, “কেন? কী করে?”

মধুরার গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মন্টু বলল, “তুমি বিলেত চলে যাওয়ার আগের দিন সন্ধেবেলা বাবা পুলিশের কাস্টডি থেকে ছাড়া পেয়েছিল। সাতদিন পরে আবার পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। এবার তিন মাস জেলে রাখল। ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসার সাত দিনের মধ্যে আবার জেলে ঢোকাল। ছাড়ল চারমাস বাদে। রাতে বাড়ি ফিরে আমাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানায় নেই। আমি আর মা ভাবলাম, আবার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। দুপুরের দিকে খবর এল যে বামনগাছি স্টেশানে বাবা নাকি রেললাইনে বডি দিয়েছে। গিয়ে দেখি মুন্ডু একদিকে আর বডি আর একদিকে।”

মধুরার মাথা ঘুরছে। মাথার মধ্যে ভাসছে সুলতানের ছবি। ছ’ফুট লম্বা, গালে নুন-মরিচ দাড়ি, গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় বাঘ ডাকছে। লোকটা মরে গেল? যে লোকটা বুঝেছিল যে মধুরার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে সেই লোকটা মরে গেল? যে লোকটা রান্না শেখানোর নামে মধুরাকে উনুনের সামনে দিনের মধ্যে চোদ্দ ঘন্টা খাটিয়ে মারত, সেই লোকটা মরে গেল? যে লোকটা হাতা আর বেলুন দিয়ে মেরে মেরে মধুরাকে শিখিয়েছিল টক-ঝাল-মিষ্টি, স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ, গ্রিল-বেক-সতে-র মহিমা, সেই সুলতানদা আত্মহত্যা করল? অপরাজিত স্পিরিটের অধিকারী, মধুরার ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড সুলতান সিং আর নেই?

মধুরা চোখে অন্ধকার দেখছে, তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে, সুলতানের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বোঝার চেষ্টা করছে, কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল! কতটা অপূরণীয়! কতটা মর্মান্তিক!

“ওঠো,” মধুরার কানে কানে বলে মন্টু, “লোকে দেখছে।”

“বউদি কোথায়? তোর বাড়িতে আমাকে একবার নিয়ে যাবি?” সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে নাক মুছে বলে মধুরা। একগাদা বোরখা পরা মেয়ে কাঁধে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেছে। সবাই অবাক হয়ে মধুরাকে দেখছে।

মন্টুর দোকানে দু’জন কাস্টমার ছিল। তাদের চা দিয়ে, পয়সা নিয়ে, দোকানের ঝাঁপ ফেলল মন্টু। মধুরাকে বলল, “এসো।”

সরু গলি। তার দু’পাশে বাতিল হয়ে যাওয়া রিকশার কঙ্কাল একে অন্যের ঘাড়ে চড়ে প্রাগৈতিহাসিক স্থাপত্য তৈরি করেছে। দু’চাকার ভ্যানের ওপরে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ, ফুটি, আম, কালোজাম, জামরুল। এই গরমে একজন উনুন ধরিয়ে ডালবড়া ভাজছে। আইসক্রিমের গাড়ি, বরফ গোলার গাড়ি, বুড়ির চুলের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে পরপর। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা টোটো। ব্যাটারি অপারেটেড, তিন চাকার রিকশা। মধুরা মন্টুকে জিজ্ঞাসা করল, “এটা কার?”

“সন্ধেবেলা চায়ের দোকানের ঝাঁপ ফেলার পরে আমি চালাই। কিনেছে আমাদের বাড়িওয়ালা।” টোটোর পাশ দিয়ে একটা গলতায় ঢুকে, টালির চালওয়ালা বাড়ির টিনের দরজায় কড়া নাড়ল মন্টু, “আমরা এখানে ভাড়া থাকি।”

দরজা খুলে উঁকি মারছে পারুল। পরনে ঘিয়ে রঙা তাঁতের শাড়ি। পাড়ের আর ব্লাউজের রং নীল। পায়ে সস্তার চটি। পারুল সিঁদুর পরত কি না, কখনও খেয়াল করেনি মধুরা। আজ দেখল, পাটপাট করে আঁচড়ানো চুলের সিঁথি সাদা। চোখে সস্তার চশমা। হাতে প্লাস্টিকের থলি। মধুরা জিজ্ঞাসা করল, “বেরোচ্ছ?”

“এলে তা হলে!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল পারুল। গত চারমাসে তোমার বাড়িতে তিনবার মন্টুকে পাঠিয়েছি। বাড়ির লোক রাস্তা থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে।”

মধুরা ঘরে ঢুকে বলল, “আমি এসে গেছি। তোমার খবর বলো।”

“আমি লং স্ট্রিটের একটা হোটেলে কাজ করি। এখন বেরোচ্ছি।”

লং স্ট্রিট। পার্ক স্ট্রিটের সমান্তরালে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পিছন দিকের রাস্তাটার নাম লং স্ট্রিট। গতকালই রাস্তাটার নাম মধুরা কার কাছে যেন শুনল। অনেক ভেবেও মনে পড়ল না।

মন্টু বলল, “বোসো।”

মধুরা ঘরটা ভাল করে দেখল। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে একটাই খাট। খাটের পায়ার নীচে ইট পাতা। খাটের নীচে একটা বিছানা গুটোনো রয়েছে। বোঝা যায় যে পারুল খাটের ওপরে আর মন্টু নীচে শোয়। ঘরের বাকি অংশে একটা স্টোভ আর বাসনপত্র রাখা। এখানে খাওয়া, এখানেই শোওয়া। বাথরুমের ব্যাপার বাইরে। স্নান কলতলায়।

মধুরা বলল, “আমি তোমাদের ঠিকানা জোগাড় করেছি খুব অদ্ভুত ভাবে…”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় খটখট। সঙ্গে চিৎকার, “অ্যাই মন্টু, দরজা খোল।”

“বাড়িওয়ালা! নারায়ণ বেরা!” হতাশ হয়ে দরজা খুলে দেয় মন্টু। মধুরা দেখে দরজার বাইরে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে। প্রথম জনের বয়স বছর পঞ্চাশেক। বেঁটে, কালো, গুঁফো, লুঙি আর ফতুয়া পরা লোকটি বলল, “হ্যাঁগো পারুল, আর কতদিন ভাড়া না দিয়ে থাকবে?”

পারুল মিনমিন করে বলল, “নারানদা, আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।”

দ্বিতীয়জন পুলিশ। হাওড়া কমিশনারেটের খাকি উর্দি পরা ছেলেটা বলল, “আমি সুমিত ঘোষাল। গোলাবাড়ি থানার অফিসার ইন চার্জ। নারানবাবু আর নিম্বারামজি আপনার নামে কমপ্লেন করতে থানায় গিয়েছিলেন।”

তিন নম্বর লোকটির নাম নিম্বারাম। সে বলল, “স্যার, হমার দাওয়াখানা থেকে বাইশশো রুপিয়ার দাওয়াই খরিদ করেছে। এখুনো পেমেন্ট করেনি।”

“নিম্বারাম, তুমি থামো।” দাবড়ানি দেয় সুমিত।

মুখের মিল দেখে মধুরা বুঝতে পারে এই নিম্বারাম হল ‘জাঙ্ক ফুড’ কিয়স্কের মালিক উমেদের বাবা। ছেলেটা ঠিকই বলেছিল, এখানে লফড়া আছে।

“স্যার, আপনি তো আমাদের অবস্থা জানেন। বাবা সুইসাইড করার পরে কোনও মতে বেঁচে আছি…” ঘাড় গুঁজে বলে মন্টু। বাড়িওয়ালা নারান গর্জে ওঠে, “তোমার কাঁদুনি শুনে আমার পেট চলবে না। আজ আমি এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব!”

মধুরা পিছন থেকে বলল, “নারানবাবু, আপনি এদের কাছ থেকে কত টাকা পান?”

“আপনি কে?” পুলিশি গলায় প্রশ্ন করে সুমিত।

মধুরা বলে, “আমি এদের আত্মীয়।”

“আপনি কি… বাই এনি চান্স…”, ‘ধরে ফেলেছি’ টাইপের গলায় কথা শুরু করেছে সুমিত। মধুরা সুমিতকে বলল, “আপনি ঠিকই ধরেছেন।” তারপর নারায়ণকে বলল, “নারানবাবু, আপনি কত পাবেন যদি বলেন।”

নারায়ণ তেড়িয়া গলায় বলল, “তিন হাজার টাকা ভাড়া। ছ’মাস বাকি আছে। তার মানে হল গিয়ে আঠেরো হাজার টাকা। আর ইলেকট্রিকের বিল বাবদ প্রতি মাসে তিনশো টাকা করে…”

“আঠেরোশো টাকা। যোগ করে হল উনিশ হাজার আটশো টাকা। নিম্বারাম ওষুধের দাম বাবদ পাবেন বাইশশো টাকা। সব মিলিয়ে হল বাইশ হাজার টাকা।” পার্স খুলে বাইশ হাজার টাকার নোট বার করে পারুলের হাতে তুলে মধুরা বলে, “দিয়ে দাও।”

“এত টাকা নারানবাবু পাবেন না। সেলামি বাবদ ওঁর কাছে পাঁচ হাজার টাকা জমা আছে। সেটা কেটে নিলে উনি পাবেন চোদ্দ হাজার আটশো টাকা।” পাঁচ হাজার টাকা মধুরাকে ফেরত দিয়ে বলে পারুল। মধুরা অবাক হয়ে বলে, “সেলামি ফেরত নিয়ে নিচ্ছ?”

“আমরা আর এখানে থাকব না গো।” নিস্পৃহ গলায় বলে পারুল। “তোমার সঙ্গে দেখা করা খুব জরুরি ছিল, তাই দাঁত কামড়ে পড়েছিলাম। আমার বাপের বাড়ি হাবড়ায়। বাপ, দাদা, ভাই, তাদের বউবাচ্চা মিলে বড় ফেমিলি। দুটো এক্সট্রা পেট গিয়ে পড়লে তাদের অসুবিধে হবে না।”

এই কথার কোনও উত্তর হয় না। মধুরা চুপ করে রইল। পারুলের হাত থেকে নোটগুলো নিয়ে নারায়ণ বলল, “বউদি, আমি কিন্তু অত খারাপ নই। গরমেন্টের ফায়ার ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি। টাকার অভাব নেই। তুমি থাকলে কোনও অসুবিধে ছিল না। আমরা বাড়িওয়ালার জাত। মাঝেমধ্যে ভাড়াটের ওপরে তম্বি না করলে ইজ্জত থাকে না।”

পারুল বলল, “আমি আর মন্টু ঠিক করে রেখে ছিলাম যে দেশে চলে যাব। এর সঙ্গে আপনার তম্বির কোনও যোগ নেই।”

সুমিত এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার নারায়ণকে বলল, “আপনার মশাই কথার দাম নেই। যখন থানায় কেঁদে গিয়ে পড়লেন, তখন মনে হল ভাড়ার টাকা ক’টা না পেলে না খেয়ে মরে যাবেন। এখন আবার উলটো গাইছেন।”

পাশ থেকে নিম্বারাম বলল, “নারানদা গরমেন্টে নওকরি করে, লেকিন ওর আসল ধান্দা দুসরা। কোলাঘাট স্টেশানের বগলে ইলেকট্রিক গুড্‌সের দুকান আছে।”

“আহ! নিম্বারাম!” লজ্জা লজ্জা মুখে দোকানের ভিজিটিং কার্ড বার করে সুমিত, মধুরা আর মন্টুকে দেয় নারান। মন্টু কার্ডটা মধুরার হাতে চালান করে দেয়। দু’-দুটো কার্ড নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে মধুরা সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। কোলাঘাট জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গ না ইথিয়োপিয়ায় এই নিয়ে তার কোনও ধারণা নেই। এই কার্ড তার কোনওদিনও কাজে লাগবে না।

নিম্বারাম আঙুলে থুতু লাগিয়ে টাকা গুনছিল। কাজ শেষ করে বলল, “ঠিক হ্যায়। চলতা হ্যায়।”

সুমিত বলল, “মিউচুয়াল হয়ে গেল। আর আমার এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। চলি ম্যাডাম।” শেষ কথাটা মধুরার উদ্দেশে বলা।

মধুরা সুমিতের দিকে তাকাল। ফুটছয়েক লম্বা, পেটানো চেহারা। সামান্য ভুঁড়ি আছে। তবে টাইট ইউনিফর্মের জন্য সেটা বোঝা যাচ্ছে না। সিন্ধুঘোটকের মতো বিচ্ছিরি ঝুপো গোঁফ ঝুলছে নাকের নীচে। চোখে অ্যাভিয়েটার ফ্রেমের সানগ্লাস। চওড়া জ-লাইন আর হাঙরের পাখার মতো নাকের সঙ্গে এই ফ্রেমটাই সব থেকে ভাল মানায়। কিন্তু ওই ওয়ালরাস মার্কা গোঁফের জন্য পুরো অ্যাপিল নষ্ট হয়ে গেছে। বাঙালি ছেলেরা যে কবে একটু ফ্যাশনেব্‌ল হবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধুরা।

সুমিত সানগ্লাসের আড়াল থেকে মধুরাকে মাপছিল। পকেট থেকে পেন বার করে নারায়ণ বেরার ভিজিটিং কার্ডের পিছনে খসখস করে কী সব লিখে কার্ড মধুরার হাতে ধরিয়ে বলল, “আমার নম্বর। দরকারে ফোন করবেন।”

মধুরার কাছে এখন তিনটে ভিজিটিং কার্ড। সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে বলল, “ধন্যবাদ।”

নিম্বারাম, সুমিত আর নারায়ণ একসঙ্গে অ্যাবাউট টার্ন করল। ব্যাগের সাইড পকেটে কার্ড ঢুকিয়ে মধুরা বলল, “ওফ! এতক্ষণে কথা বলার স্কোপ পেলাম। বউদি, এক গ্লাস জল খাওয়াও।”

পারুল বলল, “আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমার সঙ্গে চলো। তোমায় রাস্তায় জল খাওয়াব।”

“মা!” আপত্তি করে মন্টু, “দিদি আজই প্রথম আমাদের বাড়িতে এল।”

“তুই থাম।” মন্টুকে দাবড়ানি দেয় পারুল, “এসো, তোমার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে। মন্টু, তুইও আয়।” খুপরি ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

বাধ্য হয়ে মধুরা আর মন্টুও বেরোয়। টোটোর পাশ দিয়ে হেঁটে বড় রাস্তায় পড়ে। মধুরা দেখে তার গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছে সুমিত আর সেই কনস্টেবল। একেই সে বলেছিল, “থানা থেকে আপনাকে ব্রিফ করেনি?” কনস্টেবল এখন থানার বড়বাবুর সঙ্গেই কথা বলছে।

এই সব সিচুয়েশান মধুরা খুব ভাল হ্যান্ডল করতে পারে। সে স্মার্টলি সুমিতকে বলল, “আপনি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছেন? এর কোনও দরকার ছিল না।” তারপর কনস্টেবলকে বলল, “আপনি যে এতক্ষণ থাকবেন আমি ভাবিনি।”

কনস্টেবল সুমিতের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। মধুরা ড্রাইভারের সিটে বসে পিছনের দরজা খুলে দিয়েছে। সেখানে উঠে বসল পারুল আর মন্টু। জানলার কাচ নামিয়ে, সুমিতের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল মধুরা। সুমিতও কেবলুর মতো হাত নাড়ল। জানলার কাচ আবার তুলে দিয়ে এসি চালিয়ে মধুরা বলল, “কোথায় যাবে?”

“হাতে সময় আছে?” থমথমে গলায় বলল পারুল। ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে সময় দেখল মধুরা। দুপুর বারোটা বাজে। মধুরা বলল, “অনেক সময় আছে।”

পারুল প্লাস্টিকের থলি থেকে একটা নোংরা কাগজ বার করে বলল, “মন্টুর বাবা রেল লাইনে গলা দেওয়ার আগে এই কাগজটা বিছনার পাশে রেখে গিয়েছিল।”

“সুইসাইড নোট?” ডান হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাঁ হাতে কাগজ নেয় মধুরা। ডবসন রোডের ক্রসিং পেরিয়ে হাওড়া ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোডের দিকে যেতে যেতে কাগজটা পড়ে।

এটা কীরকম সুইসাইড নোট? কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখা। “মধুরা ফিরলে ওকে ডুঙ্গারমল পারেখের সঙ্গে দেখা করতে বোলো।”

“ডুঙ্গারমল পারেখ কে?” কাগজ ফেরত দিয়ে জানতে চায় মধুরা।

“আমরা এখন তাঁর কাছেই যাচ্ছি।” পিছন থেকে উত্তর দেয় পারুল। মধুরার গাড়ি হাওড়া ব্রিজ ক্রস করছে। শনিবারের দুপুরে রাস্তাঘাট ফাঁকা। ব্রাবোর্ন রোড ফ্লাইওভারে উঠে মধুরা বলল, “তিনি কোথায় থাকেন?”

“লং স্ট্রিট।” উত্তর দিল পারুল।

পার্ক স্ট্রিট আর রডন স্ট্রিটের ক্রসিং-এ পৌঁছে ডানদিকে ঘুরল মধুরা। সামান্য এগিয়ে আবার ডানদিকে ঘুরতেই লং স্ট্রিট।

হার্ট অফ দ্য সিটিতে অবস্থিত হলেও রাস্তাটা ফাঁকাফাঁকা। শাড়ি বুটিক, বিউটি পার্লার, জুতোর দোকান, গয়নার দোকানের শোরুম— পরপর কয়েকটা দোকান পেরিয়ে আসার পরে মধুরা বুঝতে পারল, এই রাস্তায় লোক চলাচল কম। ককটেল গ্লাসের মুখে যেভাবে এক চাকতি লেবু দিয়ে গার্নিশ করা হয়, এখানেও সেইভাবে একটুকরো পুরনো কলকাতা আটকে রয়েছে।

একগাদা দোকানের ফাঁক দিয়ে টিনের গেট ঠেলে অদৃশ্য হয়ে গেল পারুল আর মন্টু। মধুরা দেখল সামনে পুরনো আমলের বাঙালি বাড়ি। লোহার তৈরি গেটের দুপাশে দুটি শ্বেতপাথরের সিংহ বসে রয়েছে।

বাড়ির সামনে সারসার গুমটি। চা-পান, বিড়ি-সিগারেট, খইনি-গুটখা, কোল্ড ড্রিঙ্ক-মিনারেল ওয়াটার, ঘুগনি-পাঁউরুটি, মোমো-থুকপা… কী নেই! মায় ‘ফ্যাট মামাজ কিচেন’ নামে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁও রয়েছে। রেস্তোরাঁর বাইরে স্লেটে লেখা “টুডে’জ মেনু, মিক্সড ফ্রায়েড রাইস অ্যান্ড চিলি চিকেন।” উলটো ফুটে সরকারি আপিস রয়েছে। সেখানকার কর্মচারীরাই এই জায়গার কাস্টমার।

মন্টু ভিতর থেকে হাঁক পাড়ল, “এসো গো!”

তড়িঘড়ি টিনের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল মধুরা। বড় বাগান, ফোয়ারা, শ্বেত পাথরের পরি, লোহার তৈরি বসার বেঞ্চি, গাড়িবারান্দা সবই রয়েছে। তবে যত্নের অভাবে বাগানময় ঝোপঝাড়। ফোয়ারায় জল নেই। শ্বেতপরিটি কাক আর পায়রার পূরীষলাঞ্ছিত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রয়েছে। গাড়িবারান্দার একটা খিলান ভাঙা। ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মন্টু ওপরে উঠছে। মধুরা পিছু নিল।

দোতলার সাদাকালো চৌখুপ্পি মেঝেতে ফাটল ধরেছে। জানলার খড়খড়ি ভাঙা। দরজার মাথায় রঙিন কাচের ফ্রেমওয়ার্কে ঝুল আর মাকড়সার জাল। হলঘরের সিলিং-এর ঝাড়বাতি নোংরা কাপড় দিয়ে মোড়া।

হলঘর পেরিয়ে পারুল পাশের ঘরে ঢুকেছে। ঘর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ আসছে। সরু পাইপ দিয়ে বাতাস বইলে যেরকম শব্দ হয়, অবিকল সেই রকম। শোঁ শোঁ… শোঁ শোঁ…

মধুরা আর মন্টু সেই ঘরে ঢুকল। পিছন পিছন মধুরা। দেওয়াল আর সিলিং-এ ড্যাম্প। তিনদিকের জানলায় মাদুরের পরদা টাঙিয়ে তাতে জল ঢালা হয়েছে। মাদুরের ফাঁকফোকর দিয়ে আলো আসছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে, ঘরে একটি ফোরপোস্টার বা পালঙ্ক রয়েছে। পুরু গদির ওপরে বেমানানভাবে কাঠের তক্তা পাতা।

খাটে কেউ নেই। রাস্তার দিকের জানলার ধারে, হুইলচেয়ারে বসে রয়েছে যে মানুষটি, সে-ই ‘শোঁ শোঁ’ শব্দের উৎস। আলোআঁধারির লুকোচুরির মধ্যে হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষটি মধুরার দিকে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল।

করমর্দন না করে নমস্কার করল মধুরা। ডুঙ্গারমল পারেখের মতো চমকপ্রদ মানুষ সে জীবনে দেখেনি।

যে-কোনও মানুষের বর্ণনা দিতে গেলে আগে বলা হয় উচ্চতার কথা। উচ্চতা সবার আগে চোখে পড়ে। ডুঙ্গারের উচ্চতা ছ’ফুটের ওপরে হলেও তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পরে যে-কোনও মানুষ বলবে, “বাপ রে! লোকটা কী মোটা!”

ডুঙ্গারের ওজন একশো আশি কেজির কাছাকাছি হবে। এই কারণেই তাকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়। ডুঙ্গার পরে আছে লুঙি আর ফতুয়া। মাথার সব চুল পাকা। মুগুরের মতো হাতের সব লোম পাকা। ভুরুর লোম পাকা। একসময় অত্যন্ত সুদর্শন ছিল। এখন লোলচর্ম হয়ে গেলেও, “খণ্ডহর ক্যাহতা হ্যায় কি কিসি জমানে মে দিওয়ার বুলন্দ থি।”

ডুঙ্গারের গলায় সরু সোনার চেন। দু’কানে সোনার দুল। বাঁ হাতে সোনার কড়া। মুখে প্লাস্টিকের মাস্ক। মাস্ক থেকে একটা নল চলে গেছে অক্সিজেন সিলিন্ডারে। ডুঙ্গারের শ্বাসটানার কারণে ‘শোঁ শোঁ’ শব্দ হচ্ছে।

হুইল চেয়ারের পাশের ছোট্ট গোল টেবিলের ওপরে একটা বিয়ারের বোতল রাখা। অক্সিজেন মাস্ক খুলে ডুঙ্গার বলল, “তুই-ই মধুরা? প্রিটি ইয়াং!”

পারুল ডুঙ্গারকে বলল, “কত্তাবাবা, মধুরাকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। আমার দায়িত্ব শেষ। তুমি ছুটি দাও। মায়েপোয়ে বাড়ি যাই।”

বিয়ারে চুমুক দিয়ে ডুঙ্গার বলল, ‘“ফ্যাট মামাজ কিচেন’-এর কী হবে?”

“আমি জানি না কত্তাবাবা। আমরা আর এখানে থাকব না। তুমি মন্টুকে জিজ্ঞেস করে দেখো, ও কী চায়?”

ডুঙ্গার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মন্টু বলল, “আমিও থাকব না। মধুরাদি আমাদের ধার শোধ করে দিয়েছে। দিদির কাছে আমরা বাধক রইলাম। দেশে গিয়ে রোজগারপাতি করি, কিছু জমাই, তারপর দিদির ধার শোধ করতে আসব। এখন টাটা।”

মধুরা বলল, “টাকা শোধ করা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই আগে ঠিক কর, কাজে লেগে যাবি, না লেখাপড়া শিখবি।”

“লেখাপড়া আর হবে না গো দিদি। লেখাপড়া শেখা তো পেট চালানোর জন্যে। ওইটুকু জানি। আমি দোকান দেব।” মধুরাকে প্রণাম করে মন্টু।

পারুল বলে, “আজ ফেব্রুয়ারি মাসের আঠাশ তারিখ। মাসের পাওনা মিটিয়ে দাও কত্তাবাবা।”

বিয়ারে চুমুক দিয়ে ডুঙ্গার বলে, “হ্যাঁরে! টাকা ছাড়া কিছু বুঝিস না? এই বুড়োটার জন্যে তোর একটুও মায়াদয়া নেই?”

পারুল মুচকি হেসে বলল, “সার বুঝেছি, টাকাই শেষ কথা। বাকি সব ফালতু। আর, নিজেকে বুড়ো বলে আমার কাছে পার পাওয়া যাবে না। তোমার সব কুকিত্তির কথা আমি জানি।”

“ওফ! বাচ্চা মেয়েটার সামনে আবার ওসব কথা কেন? তুই যা, পূজার কাছ থেকে হিসেব বুঝে নে।”

পারুল আর মন্টু ডুঙ্গারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। চোখের জল মুছে পারুল মধুরাকে বলে, “যার সঙ্গে তোমার আলাপ করালাম, সে কেমন লোক আজও জানতে পারিনি। তুমি পারলে আমায় জানিয়ো।”

মন্টু বলল, “আসি কত্তাবাবা।”

দু’জনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরে এখন মধুরা আর ডুঙ্গার। ঘরে এখন নৈঃশব্দ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *