মধুরেণ – ৪

“বাবুলাল, তু ইধর ক্যয়া কর রহা হ্যায়? তেরা ডিউটি গেট পে হ্যায় না?” রাত বারোটার সময় বাবুলাল বারুইকে প্রশ্ন করে সন্দীপ পারেখ ওরফে স্যান্ডি। বাবুলালের হাতে সস্তার মোবাইল। সে প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে এসে মোবাইলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল। সপ্তাহে একদিন বাড়ি যাওয়া হয়। মেয়েটার জ্বর এসেছে। ‘বাবা! বাবা!’ বলে ঘ্যানঘ্যান করছে।

বাবুলাল ‘ক্যালকাটা ইস্ট ইন্টারন্যাশনাল সিটি’-র প্রধান ফটকের সিকিয়োরিটি। প্রতিদিন, দিনে বারো ঘন্টা, সিকিয়োরিটি রুমের সিসিটিভি মনিটরের সামনে বসে থাকার জন্যে সে মাস গেলে পাঁচ হাজার টাকা পায়। কাজে ফাঁকি দিলে ঝাড় তো খেতেই হবে!

বাবুলাল বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার! মেয়ের ফোন এসেছিল… আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

স্যান্ডি বলল, “সিকিয়োরিটি কা নওকরি মে গলতি কা মতলব সমঝতা হ্যায়? তেরা বসকো আজই ফোন করেগা। কাল সে তু ইধর আনা মত!”

বাবুলাল হাতজোড় করে বলে, “এরকমটা করবেন না স্যার! বউবাচ্চা নিয়ে পথে বসব!”

“হ্যাট বঙ্গালি!” বাবুলালকে পাত্তা না দিয়ে পেল্লাই এসইউভি চালিয়ে অ্যাকশান এরিয়া ফোরে ঢুকে যায় স্যান্ডি।

পূর্ব কলকাতার জলাজমি বুজিয়ে গড়ে উঠেছে স্যাটেলাইট টাউনশিপ, ক্যালকাটা ইস্ট ইন্টারন্যাশনাল সিটি। পাঁচটা ফেজে কাজ হচ্ছে। অ্যাকশান এরিয়া ওয়ান, টু, থ্রি-তে আছে মালটিস্টোরিড বিল্ডিং। ফ্ল্যাটের ন্যূনতম দাম এককোটি টাকা।

অ্যাকশান এরিয়া চার ও পাঁচে বহুতল নেই। আছে আমেরিকান ডিজাইনারের বানানো কটেজ, বাংলো, ফার্মহাউজ। মুম্বইয়ের ফার্ম চেনের তৈরি ফলের বাগান। জাপানি বিশেষজ্ঞের তৈরি করা ফুলের বাগান। প্রতিটি প্রপার্টির দাম পাঁচ কোটি টাকার ওপরে। অ্যাকশান এরিয়া ফোর ও ফাইভ দেড়তলা সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের মাথায় ইলেকট্রিক ফেনসিং। নুড়ি বিছোনো পথ দিয়ে স্যান্ডির এসইউভি পৌঁছল সাত নম্বর কটেজের সামনে। দোতলা কটেজের নাম লেমনগ্রাস। কটেজের দু’দিকে চারটে গ্যারাজ। রিমোট টিপে গ্যারাজের দরজা খুলল স্যান্ডি। গাড়ি ঢুকিয়ে গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে আবার রিমোট টিপল। গ্যারাজের দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। কলিং বেল টিপল স্যান্ডি।

দরজা খুলল জিন্‌স আর টি শার্ট পরা বছর চব্বিশের একটি মেয়ে। “ভাইয়া, ইয়ু আর লেট!”

“অফিস কোলিগের বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। তাই লেট। বাই দ্য ওয়ে, দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে তুই কোনও অভিযোগ করিস না। তুই নিজেই রোজ রাত বারোটায় বাড়ি ঢুকিস।!” ছোট বোন নেহার চুল ঘেঁটে দেয় স্যান্ডি।

নেহা বলে, “হসপিটালিটি ইনডাস্ট্রিতে লেট করে বাড়ি ফেরাটা ন্যাচরাল। পারেখ ফ্যামিলি তিন জেনারেশান ধরে এই লাইনে। এটা তুই না বুঝলে কে বুঝবে?”

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে স্যান্ডি বলে, “মিটমচ্ছি খানেওয়ালা ঘর মে শাদি কা নিমন্ত্রণ থা। হম পানি তক নহি পিয়া। খিদে পেয়েছে। পাপা কি ডিনার সেরে ফেলেছে?”

“না, তোর ফেরার জন্যে ওয়েট করছে।”

ড্রয়িং রুমের বাঁদিকে বিশাল লাইব্রেরি। সেখানে হাইব্যাক চেয়ারে বসে মোবাইলে কথা বলছে প্রদীপ পারেখ, নেহা-স্যান্ডির বাবা। ছেলেকে দেখে হাত নাড়ে সে। স্যান্ডি নেহাকে বলে, “পাপা বড়া ভাইয়াকে ফোন করে মুম্বইয়ের খবর নিচ্ছে?”

“হ্যাঁ। এই কোয়ার্টারে মুম্বইয়ের লেমনগ্রাসের প্রফিট খুব ভাল। মনোজ ইজ ভেরি হ্যাপি।”

প্রকাশের ফোন শেষ। বছর পঞ্চান্নর সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বললেন, “মনোজ আর নেহা ফ্যামিলি ট্র্যাডিশান মেনটেন করছে। তুইই শুধু কুলাঙ্গার!”

মন্তব্যের মধ্যে ঝাঁঝ কম, মজা বেশি। তবে সারসত্য বলা আছে। তিন প্রজন্মের পেশাদার রাঁধুনি পরিবারে একমাত্র ব্যাতিক্রম স্যান্ডি।

প্রকাশের ঠাকুরদা গুলাবচাঁদ পারেখ তাজ গ্রুপের পেস্ট্রি ডিভিশানের শেফ হিসেবে অবসর নেয়। প্রকাশের বাবা ডুঙ্গারমল পারেখের কলকাতায় একাধিক রেস্তোরাঁ ও বার ছিল। ডুঙ্গারের বউ ময়নাদেবী হাউজ ওয়াইফ।

প্রকাশ কলকাতার হোটেল ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পড়াশুনো করেছে। সেখানেই ব্যাচমেট কৃষ্ণার সঙ্গে প্রেম। প্রকাশ জয়েন করে আর এক বিখ্যাত গ্রুপে। কৃষ্ণা অন্য গ্রুপে। পাঁচতারা হোটেলের চাকরিতে এত চাপ যে প্রেম করার সময় পাওয়া যায় না। দু’জনে এক ছাদের তলায় থেকেছে খুব কম সময়ের জন্যে।

লং ডিসট্যান্স ম্যারেজের প্রথম ফসল মনোজ যেদিন জন্মায়, সেদিন প্রকাশ ব্যাঙ্ককে। স্যান্ডি যেদিন জন্মায়, সেদিন মুম্বইতে। নেহা যেদিন জন্মায়, সেদিন লন্ডনে। প্রকাশ কখনও ফ্যামিলির সঙ্গে আনন্দের মোমেন্টস শেয়ার করে উঠতে পারেনি। চল্লিশ বছর বয়সে কমপ্লিট বার্ন্‌ট আউট হয়ে চাকরি ছেড়ে শুরু করল কলকাতার প্রথম অথেনটিক চাইনিজ ফুড জয়েন্ট, লেমনগ্রাস।

সার্কাস অ্যাভিনিউর সেই ছোট্ট ফুড জয়েন্টের এখন কলকাতায় ছ’টা শাখা। সারা ভারতে দশটা। লন্ডনে একটা। মনোজ কলকাতা ছাড়া বাকি ভারতের এবং লন্ডনের রেস্তোরাঁর অপারেশান সামলায়। প্রকাশ সামলায় কলকাতার শাখাগুলো। ছ’মাস আগে বাপবেটি মিলে সল্ট লেকে ফিউশান ফুডের নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে। নাম ‘থট ফর ফুড’। স্যান্ডি এই পেশায় আসেনি। ইনফর্মেশান টেকনোলজির লাইনে গেছে।

“কুলাঙ্গার কেন বলছ পাপা! হসপিটালিটি ইনডাস্ট্রি আমার জন্যে নয়। আই লাভ বোর্ডরুম। আই লাভ কোয়ার্টারলি টার্গেট। আই লাভ ফাইট। আই লাভ আর্ম টুইস্টিং। আই লাভ ‘চাপ’। আই অ্যাম হ্যাপি বিয়িং আ কর্পোরেট হনকো!”

“রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে কত রক্ত, কত ঘাম, কত কান্না, কত চাপ থাকে, তোর কোনও আইডিয়া নেই স্যান্ডি। কম্পিটিটারদের নিকেশ না করলে বাজার নষ্ট হবে। চপার সব সময় রেডি রাখতে হয়। কখনও পাঁঠার মাংস কাটতে, কখনও অন্য রেস্তোরাঁ মালিকের গলা কাটতে।”

“দ্যাট্‌স ট্রু!” হাসছে স্যান্ডি।

“পারেখ ফ্যামিলির ব্যাটন এখন নেহার হাতে। ও লং স্ট্রিটে লেমনগ্রাসের সিক্সথ ব্রাঞ্চ খুলেছে। বাঙালিরা নাকউঁচু জাত। এই কমিউনিটিকে খাইয়ে স্যাটিসফাই করা মানে সবচেয়ে শক্ত হার্ডল পাস করা। সেই কাজে ও সাকসেসফুল। শি ইজ অলরেডি এ সেলিব্রিটি শেফ! পাঁচফোড়ন সিজ্‌ন ওয়ানের উইনার। নিজের ব্লগ আছে, নিজের ওয়েবসাইট আছে, ফেসবুকে ফ্যানক্লাব আছে। ইউটিউবে নিজের শো আছে। সেলিব্রিটি কোশেন্ট একটা রেস্তোরাঁকে আইডেন্টিটি দেয়। রেস্তোরাঁ ঘিরে পাবলিকের মধ্যে উদ্দীপনা আর আগ্রহ তৈরি করে। যাকে ইংরিজিতে বাজ বলে। বাংলায় হইচই। বাজ মানে বিজনেস।”

“পাঁচফোড়ন থেকে যে হইচই আসার কথা ছিল, সেটা তো নেহা মিস করল,” বিরক্ত হয়ে বলে স্যান্ডি, “শোয়ের ডিরেক্টার অর্ণবের সঙ্গে কী সব ঝামেলা করল। সিজ্‌ন টু-তে ওকে আর ডাকলই না।”

নেহা বলল, “অর্ণবের প্রোডাকশান হাউজের অন্য একটা শো চলে স্কুপ চ্যানেলে। সেটার নাম ‘শাশুড়ির কিস্তিমাত, বউমা কুপোকাত’ বা ‘শাকিবকু’। আমাকে একদিন শাকিবকুর শুটিং-এর জন্যে স্টুডিয়োয় ডেকে টানা দশ ঘন্টা বসিয়ে রাখল। একটা শটও নিল না। আমি রেগেমেগে চলে এসেছিলাম। তারপরেই স্কুপ চ্যানেল আমার সঙ্গে কনট্র্যাক্ট ক্যানসেল করেছে। আমাকে পাঁচফোড়ন, সিজন টু-তে ডাকেনি। অর্ণব আমার এগেইন্সটে কেস করেছিল। সেটা পাপা সামলে দিয়েছে।”

“নিজের দোষ স্বীকার করলি তা হলে!” সোফা থেকে উঠে বলে স্যান্ডি।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে নেহা। “সবটাই আমার দোষ, এমনটা নয়। তুই সুলতানের সঙ্গে ঝামেলা করেছিলি। তার ফল আমাকে ভুগতে হয়েছে।”

সুলতানের প্রসঙ্গ ওঠায় স্যান্ডি চুপ। টুক করে ঢুকে গেছে বাথরুমে। গিজারের ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করতে করতে তার মনে পড়ছে সুলতান সিংহ নামের মাঝবয়সি ধাবামালিকের সঙ্গে বিচ্ছিরি ঝগড়ার কথা…

*

সুলতান সিংহর বেড়ে ওঠা হাওড়ার পিলখানায়। পঞ্জাবি বাবা আর বাঙালি মায়ের সন্তান। সে বিহারিদের কাছে লিট্টি আর ঠেকুয়া বানানো শিখেছিল, মুসলমান চাচার কাছে শিখেছিল বিরিয়ানি রান্নার কৌশল, পাহাড়ি মেয়েদের কাছে শিখেছিল মোমো আর থুকপার রেসিপি। পিলখানার রেড লাইট এরিয়ার সেক্স ওয়ার্কাররা কার্তিক পুজো করে। সেখানে কার্তিক পুজোয় একবার সুলতান রান্না করেছিল। সেইদিনই পনেরো বছর বয়সের সুলতানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ডুঙ্গারমল পারেখের। ডুঙ্গারমল, অর্থাৎ স্যান্ডির ঠাকুরদা।

ডুঙ্গারের সঙ্গে প্রকাশ যোগাযোগ রাখে না। স্যান্ডি বা নেহাকেও রাখতে দেয় না। কারণটা স্যান্ডি জানলেও নেহা জানে না।

সুলতানের রান্না করা খাবার খেয়ে ডুঙ্গার বুঝতে পেরেছিল, ছোকরার হাতে জাদু আছে। সে সুলতানকে মকর সংক্রান্তির দিন রান্না করার জন্যে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। সুলতানের রান্না করা ডাল-বটি-চুর্মা, গট্টে কা সবজি, লসন কি চাটনি, বাজরে কা রোটি খেয়ে কলকাতার অবাঙালি সম্প্রদায় ফিদা হয়ে গিয়েছিল।

ডুঙ্গার সুলতানকে বড়বাজারে অফিস করে দেয়, টেলিফোনের কানেকশান দেয়, লেটারহেড আর ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে দেয়। সুলতানের সাফল্যের সেই শুরু। পিলখানার অনপড়, গাঁওয়ার ‘সুলতান হালওয়াই’ ধীরে ধীরে কলকাতার ‘সুলতান মহারাজ’ হয়ে ওঠে। কলকাতার বিত্তশালী সম্প্রদায়ের বিয়েতে সুলতান মহারাজের ক্যাটারিং ছিল বাধ্যতামূলক। কলকাতার বাইরেও সুলতানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

সুলতান নিজে থেকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া কোম্পানির মেনটেন্যান্স ডিভিশনের হেড স্যান্ডির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, না এর পিছনে ডুঙ্গারের হাত ছিল, জানে না স্যান্ডি। সে সুলতানকে অফিস ক্যান্টিনের ক্যাটারিং চালাবার বরাত দেয়।

নেহা হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে কলকাতায় ফেরার পরে স্যান্ডি সুলতানকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ক্যাটারিং-এর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। সুলতান রগচটা লোক। সে স্যান্ডিকে থাপ্পড় কষায়। স্যান্ডি থানায় অভিযোগ করে যে সুলতান তাকে খুনের চেষ্টা করেছে। সুলতানের জেল হয়। তার সুনাম সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাবসা করে যা টাকা জমেছিল, সব খরচ করে তার বউ পারুল সুলতানকে জেল থেকে ছাড়ায়। সুলতান হয়ে যায় একজন হেরো মানুষ।

এক বুক প্রতিহিংসার আগুন নিয়ে সুলতান আর পারুল সেক্টর ফাইভের ফুটপাথে ‘ক্যালকাটা ধাবা’ শুরু করে। একমাত্র ছেলে মন্টুর জন্য ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সামনে চায়ের দোকান বা ঝুপ্‌স বানিয়ে দেয়।

মধুরার সঙ্গে সুলতানের কীভাবে আলাপ হয়েছিল স্যান্ডি জানে না। সে শুধু জানে, স্কুপ চ্যানেলের রান্না নিয়ে রিয়্যালিটি শো ‘পাঁচফোড়ন’এ মধুরা এবং নেহা দু’জনেই নাম দেয়। সুলতানের ট্রেনিং-এ নিয়মিত রান্না প্র্যাকটিস করে, সব রাউন্ডে ভাল স্কোর করে, মধুরা পৌঁছে গিয়েছিল ফাইনাল রাউন্ডে। সেখানে কম্পিটিটার, নেহা। নেহাকে জেতানোর জন্যে উঠেপড়ে লাগে স্যান্ডি।

পাঁচফোড়ন-এ ফার্স্ট হয় নেহা। মধুরা হেরে যায়। কিন্তু ওই শো-তে মধুরার পারফরম্যান্স দেখেই হাই চ্যানেলের একজিকিউটিভ প্রোডিউসার লিজ তাকে ‘মেল্টিং পট’ প্রোগ্রামের হোস্ট হিসেবে সিলেক্ট করে।

এই ঘটনায় স্যান্ডি রেগে গিয়ে লোকাল থানার কমপ্লেন করে, সুলতান ফুটপাথ দখল করে ধাবা চালাচ্ছে। পুলিশ সুলতানকে গ্রেফতার করে লকআপে ঢোকায়।

*

নব ঘুরিয়ে শাওয়ার সিস্টেম বন্ধ করে স্যান্ডি। টাওয়েল দিয়ে ভিজে শরীর মুছতে থাকে। সুলতান বা মধুরাকে নিয়ে সে আর মাথা ঘামায় না। আজই শুভ্রর বিয়েতে মধুরার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

রাতপোশাক পরে বাথরুম থেকে বেরোল স্যান্ডি। ডাইনিং টেবিলে প্রকাশ আর নেহা বসে পড়েছে।

সারাক্ষণের কাজের লোক রামু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। প্রকাশ রাতে শুধু ফল খায়। নেহা খায় একটা রুটি আর তরকারি। স্যান্ডি গুছিয়ে খেতে ভালবাসে। তার জন্যে মেথির পরটা, পালক পনির আর বেক্‌ড রসগোল্লা রয়েছে।

একটা আঙুর মুখে ফেলে প্রকাশ বলল, “নেহা, লং স্ট্রিটের ব্রাঞ্চের খবর কী?”

নেহা বলল, “মোটামুটি। যে বিল্ডিং-এর একতলাটা আমরা ভাড়া নিয়েছি, তার বাস্তু ঠিক নেই। কিচেন আর টয়লেট ভুল দিকে। ফেং শুই এক্সপার্টও একই কথা বলছে। এই কারণেই ওখানে তেমন কাস্টমার হচ্ছে না। এই কোয়ার্টারে আমরা জাস্ট ব্রেক ইভ্‌ন করেছি। আমার মাথায় অন্য একটা আইডিয়া ঘুরছে। আই হ্যাভ টু রিলোকেট। স্পেশালি কাছেই যখন নিজেদের প্রপার্টি রয়েছে।”

স্যান্ডি চুপচাপ খাচ্ছে। প্রকাশ বলল, “নিজেদের প্রপার্টি বলতে তুই কি শীল ম্যানশন মিন করছিস?”

“হ্যাঁ!”

“এটা ঠিক যে সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিটের শীল ম্যানশনের মালিক আমার বাবা। কিন্তু লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আমি দীর্ঘকাল বন্ধ করে দিয়েছি।”

“আমি লোকটাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড নই। ইন্টারেস্টেড লোকটার প্রপার্টি নিয়ে। একমাত্র ছেলে হিসেবে ওই বাড়ি তোমার প্রাপ্য। তুমি ক্লেম করছ না কেন?”

আর একটা আঙুর মুখে ফেলে প্রকাশ বলল, “কী বলি বল তো…”

নেহা হাত নেড়ে রামুকে চলে যেতে বলল। রামু নিঃশব্দে ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল। নেহা এবার বলল, “আমি কখনও জিগ্যেস করিনি। আজ করছি। লোকটা কি বেঁচে আছে?”

আড়চোখে স্যান্ডির দিকে তাকিয়ে প্রকাশ বলে, “মরে গেলে খবর পেতাম।”

“ওকে নিয়ে তুমি আর ভাইয়া এত হাশহাশ কেন?”

এই প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশ থমকাল। সামান্য ভেবে বলল, “এগুলো জানা কি জরুরি?”

“বলতে কোনও আপত্তি আছে?”

“ফ্যামিলির কেচ্ছা শুনতে ভাল লাগবে?”

“ভাল মন্দের কী আছে? ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।”

প্রকাশ বলছে। নেহা আর স্যান্ডি শুনছে।

“ডুঙ্গারমল পারেখ কমবয়স থেকেই চরিত্রহীন। বিয়ের আগে থেকে সোনাগাছি আর হাড়কাটায় যাতায়াত…”

*

অবিবাহিত অবস্থায় পিছুটান ছিল না। বিয়ের পরে লজ্জাশরমের ব্যাপার এসেছে। নতুন ঠেকের সন্ধানে আশেপাশের জেলায় পা দিল ডুঙ্গার। এদিক ওদিক ঘুরে, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে পৌঁছল হাওড়ার পিলখানায়। চামেলির ঠেকে। চামেলি আগে লাইনে ছিল। বয়স হতে পেশা বদলে মাসি হয়েছে।

যে দালালের রেফারেন্স নিয়ে ডুঙ্গার চামেলির কাছে পৌঁছেছিল সে ডুঙ্গারের ব্যাকগ্রাউন্ড চামেলিকে বলে রেখেছিল। চামেলি ডুঙ্গারকে নিজের ঘরে বসিয়ে বলল, “এসি ঘর, ডাবল বেড, অ্যাটাচ টয়লেট, ফেরেশ তোয়ালে, চাদর, বালিশের ওয়াড়। দু’ঘন্টার জন্য দুশো টাকা।”

আশি সালের গোড়ার দিকে দুশো টাকা মানে অনেক টাকা। ডুঙ্গার দরদাম করল না। বলল, “মাল, চাট, জল আর সিগারেট আমি নিয়ে আসব। ওগুলো কেনার জন্য চাপাচাপি করবে না। এক-দু’ঘন্টা বেশি থাকলে এক্সট্রা টাকা চাইবে না। রাতে কখনও থেকে গেলে তার টাকা আলাদা দেব। মেয়েগুলো কই?”

ডুঙ্গার প্রথম যে মেয়েটিকে দেখেছিল, তার নাম জোনাকি। বছর পনেরোর মেয়েটিকে দেখার পরে ডুঙ্গার অন্য মেয়ে দেখেনি।

ডুঙ্গারের স্বভাব হচ্ছে, যে মেয়ের কাছে যায়, তার কাছে একটানা যায়। সপ্তাহে দু’দিন যাবেই যাবে। এক পাঁইট মাল নিয়ে দু’জনে মিলে খেল, গোটাচারেক সিগারেট ফুঁকল, মেয়েছেলেটা সুখদুঃখের কথা বলল, ডুঙ্গার আনমনে শুনল, তারপর উঠে চলে এল। মেয়েটার মধ্যে নির্ভরতার ইঙ্গিত দেখলেই ডুঙ্গার তার কাছ থেকে পালাত। একে কমিটমেন্ট ফোবিয়া বলা যেতে পারে।

চামেলির ঠেকে জোনাকির কাছে একটানা পাঁচমাস গিয়েছিল ডুঙ্গার। প্রথম দিকে সপ্তাহে দু’দিন করে। তারপর থেকে রোজ। রোববারও বাদ পড়ত না। একদিন জোনাকিকে চামেলির ঠেক থেকে তুলে এনে মৌলালির গণপতি বিল্ডিং-এর এক কামরার ফ্ল্যাটে তোলে ডুঙ্গার।

খদ্দের ভাগানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রেডলাইট এরিয়ার পুরো মেশিনারি একে অত্যন্ত সিরিয়াসলি ডিল করে। মেয়ে খুন, বাবু খুন সব কিছু ঘটতে পারে। ডুঙ্গারের ক্ষেত্রে কিছুই হয়নি। কেননা সে চামেলিকে এত টাকা দিয়েছিল যে জোনাকি তার সারা কেরিয়ারে গতর খাটিয়েও অত রোজগার করতে পারত না।

গণপতি বিল্ডিং-এ, ডুঙ্গারের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় জোনাকির গ্রুমিং। একদিকে সে বাড়িতে লেখাপড়া শিখছে, প্রাইভেটে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে, পাশ করে ল কলেজে ভরতি হচ্ছে, ল পাশ করছে… অন্য দিকে ডান্স টিচারের কাছে নাচ শিখছে। টালিগঞ্জ ফিল্ম ইডাস্ট্রির এক ডিরেক্টরের সঙ্গে জোনাকির আলাপ করিয়ে দেয় ডুঙ্গার। সিনেমায় ভ্যাম্পের রোলে পাকাপাকি জায়গা হয়ে যায় জোনাকির। সেই ডিরেক্টার জোনাকির নামের আগে ‘মিস’ বসিয়ে দেয়। মিস জোনাকির জয়যাত্রার সেই শুরু!

এই সময়ে ফিল্ম ম্যাগাজিনে ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিকে নিয়ে একটা আর্টিক্‌ল বেরোয়। বাংলা সিনেমার ভ্যাম্পের সঙ্গে স্বামীর বিলেতযাত্রার খবর শুনে ময়না দেবী ইঁদুরমারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে…

*

প্রকাশ বলছে, “আমার তখন অল্প বয়স। পাপার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারিনি। আমাকে বড় করেছে নানা নানি। নানা গুলাবচাঁদ উইল করে সব সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছে। সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিটের শীল ম্যানশনে পাপা একটা রেস্তোরাঁ চালাত। ওই প্রপার্টিটার মালিক পাপা।”

নেহা বলল, “লং স্ট্রিটে লেমনগ্রাসের নতুন ব্রাঞ্চের ঠিক উলটো দিকের বাড়িটাই শীল ম্যানশন। পাপা, ইয়ু টক টু ইয়োর ফাদার!”

“আমি বেশ কয়েকবার রিকনসাইল করার চেষ্টা করেছি। ওভার টেলিফোন। কিন্তু লোকটা অ্যাডাম্যান্ট। টাকাপয়সা নেই। কিন্তু ওই বাড়ি কিছুতেই বেচবে না। আমাকে তো দেবেই না। ওই প্রপার্টি নিয়ে ভেবে লাভ নেই।”

“যদি আমরা যাই?” জানতে চায় নেহা।

মৃদু হেসে প্রকাশ বলে, “নাতিনাতনির ওপরে মায়ামমতা থাকার কথা। কিন্তু তোরা দু’জনে মিলে এমন একটা কাণ্ড করেছিস যে তোদের সঙ্গে দেখাও করবে না।”

“আমরা আবার কী করলাম” স্যান্ডি অবাক।

প্রকাশ স্যান্ডির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “আমার পাপার জীবনের প্যাশন হল রান্না করা। সুলতান সিংহকে ও আবিষ্কার করেছিল। সেই সুলতানের বারোটা বাজিয়েছিস তুই। তোকে ও কোনও দিনও ক্ষমা করবে না।”

“আর আমার কী দোষ?” জানতে চায় নেহা।

“সুলতানের আবিষ্কার হল মধুরা। যার পিছনে আমরা তিনজনে মিলে লেগেছিলাম। পাঁচফোড়ন থেকে বার করে দিয়েছিলাম। লোকটা আমাদের ঘেন্না করে।”

স্যান্ডি নেহাকে বলে, “আজ যার বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম, সে মধুরার এক্স-লাভার। মধুরা লন্ডন চলে যাওয়ার পরে ওকে ডাম্প করে কোলিগকে বিয়ে করেছে।”

ডিনার শেষ। চেয়ার ছেড়ে উঠে নেহা স্যান্ডিকে বলল, “আই অ্যাম নট বদার্‌ড অ্যাবাউট মধুরা।” প্রকাশকে বলল, “দেখো পাপা, আমার ঠাকুরদা আমাকে ঘেন্না করে। নো বিগ ডিল। ঠাকুরদা সম্পর্কে আমার কোনও ফিলিং নেই। আমি একটা সহজ কথা বুঝি। নাতনি হিসেবে ওই প্রপার্টির ওপরে আমার লিগাল রাইট আছে। ওই প্রপার্টি আমার চাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *