মধুরেণ – ৩

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে খাবার টেবিলে মিটিং বসেছে। মিটিং-এ উপস্থিত মনোহর, যূথিকা, কৃশানু, দিয়া এবং মধুরা। উপস্থিত দুই পুঁচকে এবং সবিতা।

মধুরা ঘোষণা করল, ‘‘আমি পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছি।”

কৃশানু বলল, “আমি আন্দাজ করেছিলাম। ফেরার টিকিট কাটা নিয়ে তুই যে রকম নাটক করলি…”

“নাটক মানে?” ফ্যাঁশ করে ওঠে মধুরা। তাকে থামিয়ে যূথিকা বলে, “চলে এলি কেন?”

“শুটিং শেষ হয়ে গেল বলে চলে এলাম। সিম্পল।”

“শুটিং তো আবার হবে। হাই চ্যানেলে অ্যাড দিচ্ছে।” বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলে মনোহর।

মধুরা অবাক হয়ে বলে, “মেল্টিং পট, সিজ্‌ন টু-এর অ্যাড দেওয়া শুরু হয়ে গেছে? কবে থেকে?”

“কাল থেকে। তোর শোয়ের মাঝখানে দেখাল,” বলে মনোহর, “তোকে অবশ্য দেখায়নি। পুরনো দিল্লির পরোটা গলি আর মুম্বইয়ের কোন একটা জায়গা দেখাল। সেখানে শুধু কাবাব রান্না হচ্ছে।”

“খাবারের কথা বন্ধ করো।” ব্যাজার মুখে বলে যূথিকা, “হ্যাঁরে মধু, তুই চাকরিটা ছেড়ে দিলি কেন?”

“চাকরি আমি ছাড়িনি মা। আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সিজ্‌ন টু-এর জন্য রিচা চাড্‌ঢা নামের একটি মেয়ে সিলেক্টেড হয়েছে।”

“রিচা না ওঁছা, আমার জেনে কাজ নেই। ওই পোগ্রাম আমি আগেও দেখতাম না, এখনও দেখব না। কিন্তু তোর তো আমও গেল, ছালাও গেল।”

“মা, কথাটা পোগ্রাম নয়, প্রোগ্রাম,” শুভ্র-র বিয়ের কার্ড জোরে জোরে পড়ে মধুরা।

“সবিনয় নিবেদন,

শ্রীমতি মুক্তি ও স্বর্গত বীরেশ্বর দত্ত-র পৌত্র

শ্রীমতি মঞ্জুলিকা ও শ্রীগুরুপদ দত্ত-র পুত্র

শ্রীমান শুভ্র

এবং

স্বর্গত ভিক্টর ডি কুনহা ও শ্রীমতি মেরি ডি কুনহা-র কন্যা

অ্যানির

শুভ পরিণয় অনুষ্ঠিত হবে।

এই অনুষ্ঠানে আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাই।

বিবাহ

২৭ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার।

বিবাহবাসর

প্যারিস হল, কলকাতা।”

“কার্ডটা সুন্দর করেছে।” বলে দিয়া।

মধুরা বলে, “খামের ওপরে লেখা রয়েছে, শ্রীমনোহর ভৌমিক ও তাঁর পরিবার। তার মানে কি আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে? অনেকদিন বাঙালি বিয়ের নেমন্তন্ন খাইনি…”

“আচ্ছা, তোর খারাপ লাগছে না?” মধুরার পিঠে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে মনোহর, “ছেলেটা হুট করে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করছে। তোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল?”

মধুরা সোজা কথাটা সোজা করে বলল, “গত দু’মাস শুভ্র-র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তার আগেও যে ছিল, এমনটা নয়।”

যূথিকা বলে, “আমরা কেউই ওই বিয়েতে যাচ্ছি না।”

“তোমরা না যেতে পারো, আমি শুভ্র-র বিয়েতে যাবই। কতদিন মাসিমা-মেসোমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি।”

সবিতা একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল। সে বলল, “তুমি পেগলে গেলে? লাভারের বিয়েতে কেউ যায়?”

“আহ! সবিতা!” ধমক দেয় যূথিকা, “ওইসব বস্তির ভাষা ভদ্রলোকের বাড়িতে চলবে না।” মধুরাকে বলে, “এখন কী করবি ভেবেছিস?”

‘“এখন’ মানে যদি হয় ‘এক্ষুনি’, তবে তার উত্তর হল ঘুমোব। ‘এখন’ মানে যদি হয় ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে’, তা হলে একটা গাড়ি কিনব আর শুভ্র-র বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যাব। আর ‘এখন’ মানে যদি হয় ‘ইন নিয়ার ফিউচার’, তা হলে উত্তর হল, ‘জানি না।’”

সবিতা গজরগজর করতে লাগল, “বিলেতে এক বছর থেকে আরও বিগড়ে গেছে। আগে শুধু ‘ঘর জ্বালানি’ ছিল। এখন হয়েছে ‘ঘর জ্বালানি, পর ভোলানি’।”

আলোচনার পরিবেশ বদলাতে মনোহর বলল, “পুঁচকিগুলোর সঙ্গে আলাপ হয়েছে?”

খাবলা মেরে সবিতার কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে নিজের ট্যাঁকে গুঁজে মধুরা বলে, “এটার কী নাম?”

কৃশানু বলে, “এর নাম অজন্তা।”

দিয়া অন্য বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। সে বলে, “অজন্তা আমার কোলে। ইলোরা মধুর কোলে। তুমি নিজের বাচ্চাদের চেনো না?”

মধুরার হাত থেকে বাচ্চা নিজের কোলে নিয়ে মনোহর বলল, “অত শক্ত নাম রাখলে কেউ মনে রাখতে পারবে না। আমি ওদের যে নাম দিয়েছি, সেগুলো মনে রাখলে বাচ্চা চিনতে অসুবিধে হবে না।”

যূথিকা প্রতিবাদ করে, “আজকালকার দিনে ওইসব নাম চলে না। ইসকুলের বন্ধুরা প্যাঁক দেবে।”

যূথিকার কথায় পাত্তা না দিয়ে মনোহর বলে, “এই দ্যাখ। এই মেয়েটার নাকটা দেখে তোর কীসের কথা মনে হচ্ছে?”

মধুরাকে ভাবতে হল না। শ্যামলা মেয়ের গোল নাক দেখে একটা জিনিসের কথাই মনে হয়। মধুরা বলল, “পান্তুয়া।”

“গুড! পরীক্ষায় পাশ।” পান্তুয়াকে কৃশানুর কোলে চালান করে দিয়ার কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে মধুরাকে দেখায় মনোহর, “একে দেখে কীসের কথা মনে হচ্ছে?”

রসগোল্লার মতো সাদা আর গোলগাল বাচ্চাটা দেখে মধুরা বলল, “বাবার নোমেনক্লেচার অনেক বেশি সায়েন্টিফিক। আমি এখন থেকে এদের রসগোল্লা আর পান্তয়া বলে ডাকব।”

“কী আমার বাপসোহাগি মেয়ে হয়েছে,” হাঁটুতে ব্যথার তেল মালিশ করতে করতে বলে যূথিকা, “বাড়ির মেয়ে বাড়ি এসেছ। এক হপ্তা জিরিয়ে নাও। তার পরে তোমার জন্যে পাত্র খুঁজতে বেরুব। এই আমি বলে দিলুম!”

*

রাত্তিরে তিনতলায় নিজের ঘরে শুয়ে, ‘শুভবিবাহ’ লেখা কার্ড হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদল মধুরা। শুভ্র তাকে আর ভালবাসে না? শুভ্র বিয়ের খবর জানানোর প্রয়োজনও বোধ করল না? আর, বিয়ে করছে কাকে? মধুরার প্রাক্তন কোলিগ, তার বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যানি ডিকুনহাকে। যার মা মেরি ডিকুনহাকে মধুরা মেরিমাসি বলে ডাকে। যার কাছে একসময় সে রান্না শিখত।

সারারাত কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়ল মধুরা। বেলা আটটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে মেরিকে ফোন করল।

অ্যানি আর মেরি ডিকুনহা থাকে এলিয়ট রোডের রোজ অ্যাপার্টমেন্টে। মেরি ‘ডিপ ফোকাস’ নামে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি চালায়।

মেরি ফোন ধরে বলল, “তুই আমার ওপরে খুব রেগে আছিস?”

“তোমার ওপরে রেগে থাকলে তোমাকে ফোন করতাম না মেরিমাসি।”

“কার ওপরে রেগে আছিস? শুভ্র না অ্যানি?”

“শুভ্র, অ্যানি, শুভ্রর বাবা মা— তুমি ছাড়া সব্বার ওপরে।”

“কেন মধু?”

“ওরা শুভ্রকে বোঝাতে পারল না যে একজনের সঙ্গে দীর্ঘকাল ঘোরাঘুরির পরে তাকে ডিচ করা অপরাধ?”

মেরি চুপ।

“দেখো মেরিমাসি, আমি জানি যে অ্যানি তোমার মেয়ে। শুভ্র তোমার জামাই হতে চলেছে। এই জাতীয় কথা তোমাকে বলা উচিত নয়। কী করব বলো, তোমার কাছেই আমি এগুলো বলতে কমফর্টেব্‌ল ফিল করছি।”

মেরি চুপ।

“কী গো? কিছু বলো?”

মেরি ঠান্ডা গলায় বলল, “যা বলব, তা তোর পছন্দ হবে না।”

“রিয়্যালি? শুনি, তুমি কী বলতে চাও!” মধুরার গলায় সারকাজ্‌ম।

“আমি একটা পুরনো কথা বলব। অভিযোগের তর্জনী একজনের দিকে তাক করলে হাতের বাকি আঙুলগুলো অভিযোগকারীর দিকেই তাক করা থাকে।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে সব দোষ আমার?”

“আমি বলছি, তুই একটু ইনট্রোস্পেক্ট কর। ঠান্ডা মাথায় ভাব। শুভ্রর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? বুক ভেঙে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে যে মরে যাব?”

“ধ্যাত! তাই আবার কারও হয় নাকি?”

“পাঁচফোড়ন-এর ফাইনাল রাউন্ডে হেরে যাবার পরে কীরকম লেগেছিল?”

“খুব কষ্ট হয়েছিল। ডিপ্রেশানে চলে গিয়েছিলাম।”

“তা হলে তোরও কষ্ট হয়। তবে প্রেমে ঝাড় খেয়ে নয়। প্যাশনের জায়গায় ঝাড় খেয়ে।”

“তুমি কী বলতে চাইছ?”

মেরি মৃদু হাসল। বলল, “আমি বাইবেল যেমন পড়েছি, তেমন গীতাও পড়েছি। শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ মনে রাখ। যা হয়েছে ভালর জন্যে হয়েছে। যা হবে, তা ভালর জন্যই হবে। কেমন?”

‘কেমন’ শব্দটির মধ্যে ফোনালাপ শেষ করার ইঙ্গিত ছিল। মধুরা বাধ্য হয়ে বলল, “শুভ্র আমাকে বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে। আমি যাব। প্যারিস হলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। রাখছি।”

*

ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গায়ে এখন দুটো গ্যারাজ। ডানদিকেরটায় থাকে কৃশানু-দিয়ার হ্যাচব্যাক। বাঁদিকেরটায়, মধুরার এসইউভি। বাড়ি ফেরার পরদিনই শলপের অটোমোবাইলের শোরুমে গিয়ে তুঁতে রঙের গাড়িটা কিনেছে মধুরা।

মধুরা গাড়ি কিনেছে নগদ টাকা দিয়ে। কৃশানু আপত্তি করে বলেছিল কার লোন নিলে ইনকাম ট্যাক্সে ছাড় পাওয়া যায়। মধুরা শোনেনি।

মধুরা ফিরেছে ৮ ফেব্রুয়ারি। শনিবার। আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, গাড়ির শোরুম, মোটর ভেহিক্‌লের দফতর হাজার জায়গায় ছোটাছুটি করে কয়েক সপ্তাহ চলে গেল। আজ সন্ধেটা মধুরা আলাদা ভাবে প্ল্যান করে রেখেছে। আজ সে একাই গাড়ি নিয়ে বেরোবে। আজ শুভ্রর বিয়ে।

গির্জা সংলগ্ন এলাকাকে ‘প্যারিস’ বলা হয়। সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল সংলগ্ন প্যারিস হল নানা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। শুভ্র আর মেরির বিয়ের রিসেপশান এখানেই হচ্ছে। প্যারিস হলের সামনেটা গাড়িতে থিকথিক করছে। ভিতরের পার্কিং ফুল হয়ে গেছে।

প্যারিস হলের বাইরে গাড়ি পার্ক করে আয়নায় নিজেকে দেখে নিল মধুরা। গেটের কাছে এসে দেখল গুরুপদ, মঞ্জুলিকা আর মেরি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মধুরাকে দেখে গুরুপদর ভুরু কুঁচকে গেছে।

গুরুপদ আর মঞ্জুলিকাকে প্রণাম করে, মেরির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে মধুরা বলল, “আমি কিন্তু পাত্রপক্ষ। অ্যানি আমায় নেমন্তন্ন করেনি।”

গুরুপদর মুখে হাসি ফুটল। সে দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “আয়!” মধুরা গুরুপদকে জড়িয়ে ধরে ভাবল, এই লোকটা তার শ্বশুর হতে পারত! মধুরার কাঁধে হাত রেখে প্যারিস হলের বাগান দিয়ে হাঁটতে হাটতে গুরুপদ বলল, “জানিস তো, আমি এখন ট্রান্সফার হয়ে পার্ক স্ট্রিট থানায় চলে এসেছি।”

“তাই?” অন্যমনস্ক গলায় বলে মধুরা। অ্যানির জন্যে কেনা গিফ্‌ট গুরুপদর হাতে তুলে দেয়।

গুরুপদ জিজ্ঞাসা করল “কী আছে?”

“রুপোর চামচ। শুভ্র আর অ্যানির বাচ্চার জন্যে।”

“আমি শুভ্রকে বলেছিলাম তোকে নেমন্তন্ন না করতে। ও শুনল না। আমি অবশ্য ভাবিনি যে তুই আসবি।”

ওয়েটারের হাত থেকে আমপান্নার গেলাস নিয়ে মধুরা বলল, “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি শুভ্রর সঙ্গে কোনও অন্যায় করেছি। নেমন্তন্নর কার্ড পাঠিয়ে ও আমার ওপরে প্রতিশোধ নিচ্ছে। অথচ প্রতিশোধ নেওয়ার কথা আমার!”

“মেরির সঙ্গে তোর কী কথাবার্তা হয়েছে আমি জানি। আমার ভাবতে খুব অবাক লাগছে যে তুই তোর প্রবলেমটা বুঝতে পারছিস না।”

“আমার আবার কী প্রবলেম?”

“গত এক বছর তুই শুভ্রর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলি?”

“প্রথম দু’মাস ছিল। তারপর কমে গিয়েছিল। আসলে কাজের এত চাপ!”

“যোগাযোগ রাখতে গিয়ে লন্ডনে তোর যে সমস্যা হচ্ছিল, সেটা ভারতে বসে আমরা কী করে জানব? শুভ্র ফোন করলে তুই ফোন ধরছিস না, শুভ্র এসএমএস করলে তুই রিপ্লাই করছিস না, শুভ্র মেল করলে তুই উত্তর দিচ্ছিস না, ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাস আপডেট করে জানান দিচ্ছিস যে তুই এখন টোটেনহ্যাম কোর্ট রোডে শুটিং করছিস অথচ সেই স্ট্যাটাসে শুভ্র যখন লিখছে, ‘প্লিজ আমার ফোন ধরো’, তুই দেখেও দেখছিস না… কত উদাহরণ দেব মধু? শুধু শুভ্র কেন, আমি আর শুভ্রর মা-ও তোকে ফোন করেছি। তুই ফোন ধরিসনি। আমরা এর থেকে কী সিদ্ধান্ত নেব?”

“ওফ! তোমরা পাগল নাকি? আমি তখন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমি কী ট্রিমেন্ডাস প্রেশারের মধ্যে কাজ করতাম এই নিয়ে তোমার কোনও ধারণা আছে? দিনে আঠেরো ঘন্টা শুটিং, শনি রোববারেও ছুটি নেই। সকালে ভাইননিয়ার্ড, দুপুরে রেস্তোরাঁর ফিতে কাটা, সন্ধেবেলা ওয়াইন সমেলিয়ার হওয়া…”

“জীবন শুধু তোকে দিয়ে তৈরি নয় মধু। পৃথিবী তোর চারিদিকে ঘোরে না। এখানে আমরাও আছি। আমরা কী ভাবছি, কী করছি, কীভাবে রিঅ্যাক্ট করছি এটাও গুরুত্বপূর্ণ। তুই টিভি দর্শকের কাছে সেলেব্রিটি হতে পারিস, কিন্তু কাছের লোকের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করবি না? শুভ্রকেও ঘ্যাম দ্যাখাবি?”

মধুরার মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে। সে বুঝতে পারে, মেরিমাসি ঠিক বলেছিল। এখন শুভ্রর বাবাও ঠিক বলছে। সাফল্য পেয়ে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। ভেবেছিল তার ব্যস্ততার মানে সবাই বুঝতে পারবে। সে সেলিব্রিটি, সে স্টার হোস্ট। তার শিডিউলের সঙ্গে বাকিরা অ্যাডজাস্ট করে নেবে। শুভ্রকে ‘ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর’ ধরে নেওয়া তার জীবনের মস্ত ভুল।

প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। শুভ্রর জীবনের ফাঁকা জায়গায় এনট্রি নিয়েছে অ্যানি। যূথিকা ঠিকই বলেছিল। মধুরার আমও গেল, ছালাও গেল। মেল্টিং পট সিজ্‌ন টু-তে কাজ না পেয়ে সে পেশাগত ভাবে লুজার হয়েছিল। এবার ব্যক্তিজীবনে লুজার হল।

আমপান্নার গেলাস রাখার অজুহাতে গুরুপদর কাছ থেকে পালায় মধুরা। শুভ্রর সঙ্গে দেখা করে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।

ভাবতে না ভাবতেই সামনে শুভ্র। মেরুন-সাদা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন পোশাকে ফিল্মি বরের মতো লাগছে। মধুরাকে দেখে নমস্কার করে বলল, “স্বাগতম।”

মধুরা বলল, “আমপান্নাটা খুব টেস্টি। আসল আম দিয়ে তৈরি। এসেন্স দিয়ে নয়।”

“তুমি বদলালে না মধুরা। রান্নাবান্না ছাড়া তোমার জীবনে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।”

লজ্জা পেয়ে মধুরা বলল, “আয়্যাম সরি। কনগ্র্যাচুলেশানস। উইশিং ইয়ু অ্যান্ড অ্যানি আ হ্যাপি ম্যারেড লাইফ।”

“থ্যাঙ্কস মধুরা।”

ওয়েটারের ট্রে থেকে একটুকরো রেশমি কাবাব নিয়ে টিস্যু পেপারে মুড়ে মধুরা বলল, “বিয়ে কবে হল?”

“আজ।”

“আজ বিয়ে, আজই বউভাত?”

“হ্যাঁ। একটাই অনুষ্ঠান করা হয়েছে। সকালে দত্ত ম্যানশনে হিন্দু মতে বিয়ে হল। রেজিস্ট্রিও হল। তারপর চার্চের পাদরির উপস্থিতিতে খ্রিস্টান মতে। এখন রিসেপশন।”

“একবার খাইয়ে খরচ কমাচ্ছ?” রেশমি কাবাবে কামড় দিয়েছে মধুরা। “কাবাবটা ডিলিশাস হয়েছে! লাভলি ম্যারিনেশান!”

“আবার খাবারের কথা?” কৃত্রিম ধমক দেয় শুভ্র।

মধুরা হেসে ফেলে। সে আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে। মেনে নিচ্ছে নিজের ভবিতব্য।

“একটাই অনুষ্ঠান করা হচ্ছে কারণ হল, আমাদের সামনে এখন অনেক খরচ। মেরির সারভাইকাল ক্যানসার হয়েছে।”

“যাঃ!”

“যাঃ নয়, হ্যাঁ। মেরি রোজ অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে। ডিপ ফোকাস বিক্রি করে দিয়েছে কর্মচারীদের। ও এখন দত্ত ম্যানশনে আমাদের সঙ্গে থাকে। হার ডে-জ আর নাম্বার্ড।”

“আই অ্যাম সরি!” ফিসফিস করে বলে মধুরা। সে না জেনে মেরির সঙ্গে টেলিফোনে কী দুর্ব্যবহারটাই না করেছে!

“সরি বোলো না। মেরিমাসি রেগে যাবে। শি ইজ ভেরি হ্যাপি রাইট নাও। আজ এই আলোচনা থাক। চলো, তোমাকে স্যান্ডির সঙ্গে দেখা করাই।”

স্যান্ডি মানে সন্দীপ পারেখ। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় মধুরার বস। এই লোকটার জন্যে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় তার চাকরি গেছে। এই লোকটার জন্যে সে পাঁচফোড়নে হেরে গেছে। এই লোকটার জন্যে তার রান্নার জগতের ফ্রেন্ড, ফিলজফার এবং গাইড সুলতান সিং জেলে গেছে। স্যান্ডি তার নেমেসিস!

চিরশত্রুর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে মধুরার আগ্রহ নেই। সে বলল, “ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় স্যান্ডি নানা ইললিগাল কাজ করেছিল। তুমি সেইসব কুকীর্তির কথা জানিয়ে মুম্বইয়ের হেড অফিসে মেল করেছিলে। এরপরে স্যান্ডির তো তোমার ওপরে খচে থাকার কথা!”

“স্যান্ডি ওই কারণেই অন্য ডিভিশানে ট্রান্সফার্ড হয়েছে। আর আমি প্রোমোটেড হয়েছি স্যান্ডির পোস্টে। রেগুলার লিয়াসঁ মিটিং করতে হয়। নেমন্তন্ন না করে উপায় আছে?”

“শত্রু এখন বন্ধু?” বাঁকা হাসি হাসে মধুরা।

“জগতে কিছুই পার্মানেন্ট নয় মধুরা। প্রেম নয়, বন্ধুত্ব নয়, শত্রুতাও নয়। তুমি স্যান্ডির সঙ্গে কথা বলো। ভাল লাগবে। ওই তো! স্যান্ডি এই দিকেই আসছে!”

এই প্রথম মধুরা প্রাক্তন প্রেমিকের বিয়েতে আসার জন্য রিগ্রেট করল। মধুরা ভেবেছিল শুভ্রকে দেখিয়ে দেবে, তাকে বিয়ে না করার ফলে শুভ্র কত কী হারাল। মধুরা ভেবেছিল অ্যানিকে দেখিয়ে দেবে সে কতটা সুপিরিয়র। মধুরা ভেবেছিল মঞ্জুলিকা আর গুরুপদকে দেখিয়ে দেবে, ‘হম কিসিসে কম নেহি’! মধুরা ভেবেছিল মেরিকে দেখিয়ে দেবে শুভ্রকে বিয়ে করতে না পেরে তার কিছু আসে যায় না।

মধুরা ভাবেনি যে তার নেমেসিস সন্দীপ পারেখের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

“হ্যালো মধুরা! কেমন আছ? যে বিয়েতে তোমার বউ হওয়ার কথা ছিল, সেই বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে কেমন লাগছে?” দুই হাত জোড় করে জানতে চাইছে স্যান্ডি। সে পরে আছে গিলে করা পাঞ্জাবি আর চুনট করা ধাক্কা পাড়ের ধুতি। কোঁচাটি নিখুঁত ভাবে ধরা। পায়ে বিদ্যেসাগরি চটি। গা দিয়ে ভুরভুর করে গোলাপজলের গন্ধ আসছে। জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা চুল চকচক করছে। বাঙালি পোশাক পরে শয়তানের প্রতিমূর্তি স্যান্ডি মধুরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

“তোমাকে এই পোশাকে বেশ মানিয়েছে।” সংক্ষিপ্ত উত্তর মধুরার।

“থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। তা, তুমি এখন কী করছ? মেল্টিং পট, সিজ্‌ন টু থেকে তো আউট। ওরা রিচা চাড্‌ঢাকে নিয়েছে। হাই চ্যানেলেই আছ, না ইন্ডিয়ায় ব্যাক করেছ?”

“কলকাতায় ব্যাক করেছি।”

“দ্যাটস ভেরি গুড!” হাতে হাত ঘষে স্যান্ডি। “তোমার মতো একজন স্টার শেফ আর স্টার কুকারি শো হোস্টের কলকাতায় আসা খুব জরুরি। হসপিটালিটি ইন্ডাসট্রিতে ক্যালকাটা ইজ স্টিল ব্যাক অব বেয়ন্ড।”

“থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট।” স্যান্ডির ধন্যবাদা তাকেই ফেরত দেয় মধুরা।

“আমাদের রেস্তোরাঁ লেমনগ্রাসে জয়েন করবে? নেহা লং স্ট্রিটে নতুন একটা ব্রাঞ্চ খুলেছে। কলকাতায় ভাল চাইনিজ শেফের খুব অভাব! আর, আমাদের পে প্যাকেট কিন্তু বেস্ট ইন দ্য মার্কেট!”

অপমানে মধুরার কান ঝাঁঝাঁ করছে। স্যান্ডি আবার তার পুরনো ট্রিক ব্যবহার করছে। অপমান করার ট্রিক। মধুরা পাঁচফোড়নের ফাইনাল রাউন্ডে হেরে যাবার পরে বলেছিল ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিষ্টি বিক্রি করতে। আজ বলছে ওদের রেস্তোরাঁয় রান্না করতে। কী সাহস!

“তোমার হাবি সুলতান সিং-এর কী খবর?” মুচকি হেসে বলে স্যান্ডি, “যে বুড়োটার সঙ্গে তোমার অ্যাফেয়ার ছিল? ফুটপাথের ধাবাওয়ালা সুলতান থেকে আইটি সেক্টরের ম্যানেজার শুভ্র— তুমি সবাইকে দিলে। শুধু আমি কিছু পেলাম না!”

“নেহাত এটা বিয়েবাড়ি! তাই পাছায় একটা লাথি কষালাম না!” হিশহিশ করে বলে মধুরা, “ফারদার লুজ টক করলে তোর বল্‌স দিয়ে তোর মুখ বন্ধ করে দেব! বাই!”

রাগে গনগন করতে করতে মধুরা গেটের দিকে এগোচ্ছে। তাকে দেখে মেরি জিজ্ঞাসা করল, “চোখমুখ লাল কেন? কাঁদছিলি?”

“না মেরিমাসি!” মেরিকে জড়িয়ে ধরে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে মধুরা। মেরি কী বুঝেছে কে জানে! সে মধুরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “যা হয়, তা ভালর জন্যেই হয়! দুঃখ করিস না।”

চোখ মোছে মধুরা। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়। পিছনে পড়ে থাকে সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল, পিছনে পড়ে থাকে প্যারিস হল, পিছনে পড়ে থাকে শুভ্র। মধুরা গাঁগাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *