মধুরেণ – ২

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে প্লেন ল্যান্ড করল দুপুর বারোটা চল্লিশে। গতকাল হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে ছেড়েছিল দুপুর দেড়টায়। ভোর চারটেয় মুম্বইয়ে যখন স্টপওভার নিল, তখন মধুরা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।

বিজনেস ক্লাসের ব্রেকফাস্ট ভীষণ ভাল। ফ্রেশলি গ্রিল্‌ড ব্রিটিশ বেকন, স্ক্র্যাম্বল্‌ড এগ্‌স আর টাটকা বেদানার রস। খাওয়াদাওয়া শেষ করে মধুরা রিয়্যালিটি চেক সেরে নিল।

বয়স চব্বিশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। শিক্ষাগত যোগ্যতা, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েট। মাসিক রোজগার এই মুহূর্তে শূন্য হলেও ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ঈর্ষণীয়।

গত এক বছর ধরে সে প্রতি মাসে দশহাজার পাউন্ড আয় করেছে। লন্ডনে থাকতে প্রতি মাসে পাঁচহাজার পাউন্ড খরচ হত। এক বছরে নিট আয় ষাট হাজার পাউন্ড। এই টাকা বাড়ি পাঠিয়েছে মধুরা। এক পাউন্ড মানে একশো টাকা। ইনকাম ট্যাক্স কাটার পরে যে টাকা পড়ে আছে, সেটা অনেক। যশ, খ্যাতি, স্পটলাইট, এক বছর লন্ডনবাসের অভিজ্ঞতা পিছনে ফেলে মধুরা ভৌমিক আবার হাওড়ার রাজচন্দ্রপুরের ভৌমিক ভবনে ফিরছে।

যাওয়ার সময়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। অসম্ভবকে সম্ভব করার জেদ ছিল। ‘সব কিছু জিতে নেব’— এই উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। ফেরার সময়ে কিস্‌সু নেই। জাস্ট কিস্‌সু নেই। মধুরা নিজেকে বলল, “ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান!”

লফ্‌ট থেকে হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে গা ভাসায় মধুরা। পাশ থেকে একজন বলে, “মধুরা ভৌমিক, আই প্রিজিউম!”

“ইয়াপ!” ক্যাজুয়ালি হেসে ঘাড় ঘোরায় মধুরা। গলার আওয়াজ চেনা চেনা লাগছে।

“আমি করণ সিং। আমি তোমার শোয়ের বিরাট ফ্যান।” পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে, হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নব্বই দশকের বলিউডের এক নম্বর হিরো। করণের প্রথম ছবি ‘ইয়ে দোস্তি’ ব্লকবাস্টার হয়েছিল। মুম্বইয়ের মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে ছবিটা টানা পঞ্চাশ সপ্তাহ চলেছিল। করণ তারপরে আরও গোটা পঞ্চাশ সিনেমা করেছে। বেশির ভাগ মুভিই হিট বা সুপারহিট। সেই জমানায় ভারতের প্রতিটি মেয়ে করণের প্রেমে পাগল ছিল।

করণ বিয়ে করেছিল বাঙালি শেফ-কাম-মিক্সোলজিস্ট মণিকা বাগচীকে। মণিকা এখন ভারতের এক নম্বর মহিলা উদ্যোগপতি। তার ‘গুডফুড প্রাইভেট লিমিটেড’ ইন্ডিয়ার এক নম্বর রেস্তোরাঁ চেন। ভারতের সবকটি শহরে শাখা তো আছেই, আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং দুবাইতেও ব্রাঞ্চ আছে।

করণ এখন ছবির প্রোডিউসার হয়ে গেছে। বছরে একটা ছবিতে অভিনয় করে। স্টার ভ্যালু একটুও কমেনি।

নব্বই দশকের বলিউডের বেতাজ বাদশা করণ সিং মধুরার নাম জানে? মধুরা নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ব্লাশ করতে করতে সে হাত থেকে লাগেজ ফেলে দিল।

“কী হল? এনি প্রবলেম?” মুচকি হেসে লাগেজ লুফে নিয়েছে করণ। ফ্যানগার্লদের এই প্রতিক্রিয়ায় সে অভ্যস্ত।

মধুরা নিজেকে কনট্রোল করে। লাগেজ নিয়ে বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ! আপনি হঠাৎ কলকাতায়? নতুন সিনেমার শুটিং?”

“ঠিকই ধরেছ। আমার প্রোডাকশানের নতুন ছবির জন্যে রেকি করতে এসেছি।”

রেকি মানে শুটিং-এর আগে লোকেশান ঘুরে দেখা। “কী ছবি?” জানতে চায় মধুরা।

বাকি যাত্রীদের এগোতে দিয়ে করণ বলল, “আমি আমার স্টারেদের সঙ্গে এনডিএ করে রেখেছি। তা হলে নিজে মুখ খুলি কী করে?”

এনডিএ মানে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট।’ অর্থাৎ নতুন ছবি সংক্রান্ত কোনও কথা স্টারেদের কেউ সংবাদ মাধ্যমকে বলতে পারবে না। যদি বলে, এবং সেটা যদি করণ জানতে পারে, তা হলে সে স্টারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে।

সব যাত্রী নেমে গেছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানবালা করণের দিকে বাতিল বোর্ডিং পাস বাড়িয়ে, একগাল হেসে বলল, “অটোগ্রাফ প্লিজ!”

খসখস করে সই করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে করণ মধুরাকে বলল, “হোপ ইউ আনডারস্ট্যান্ড।”

“শিয়োর আই ডু,” সিঁড়ি দিয়ে নামছে মধুরা। টারম্যাকে করণের জন্য ফাঁকা বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। করণ মধুরাকে বলে, “তুমি আমার সঙ্গে এসো।”

“না না! ঠিক আছে। আমি পরের বাসে যাব।” আপত্তি করে মধুরা।

“বাজে বকা বন্ধ করো!” ধমক দেয় করণ, “বাই দ্য ওয়ে, তুমি ক’দিনের ছুটিতে এসেছ?”

“দেখি!” ক্যাজুয়ালি উত্তর দেয় মধুরা। সে যে আর ফিরবে না, এই কথাটা মুখ দিয়ে বেরোল না।

করণ মুচকি হেসে বলল, “তোমারও এনডিএ?”

মধুরা উত্তর না দিয়ে শ্রাগ করল। বাসে উঠে মধুরার পাশে বসে আই-ফোন বার করে করণ বলল, একটা সেল্‌ফি নিচ্ছি, কেমন?”

“টুইটারে দেবেন?” লেনসের দিকে তাকিয়ে পাউট করে মধুরা।

“অবশ্যই দেব,” ছবি তুলে করণ বলে, ‘‘সঙ্গে টুইট, ‘কামিং টু কলকাতা উইথ মধুরা ভৌমিক, স্টার-শেফ অফ মেল্টিং পট, সিজ্‌ন টু।’ ভাল হবে না?”

মধুরা তড়াক করে বাসের সিট থেকে ওঠে। “চলুন, এবার নামতে হবে। আপনার জন্যে স্পেশাল ব্যবস্থা। আমাকে কিন্তু কেবিন লাগেজের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে।”

“তুমি এগোও। আমি পরে যাব,” সানগ্লাস চড়িয়ে করণ বলে, “বাই দ্য ওয়ে, তোমার ফোন নাম্বারটা পাওয়া যাবে?”

বিপদে পড়ল মধুরা। লন্ডনের সিমকার্ড সে ছেড়ে এসেছে। তার সঙ্গে এখন দুটো মোবাইল ফোন আছে বটে, কিন্তু সেগুলোয় কলকাতার সিমকার্ড ঢোকালে তবে চালু হবে। বিনয়ের সঙ্গে সে বলল, “ইন্ডিয়ার কোনও নম্বর আমার কাছে নেই। আর ওখানকার নম্বরটা…”

করণ কী বুঝল কে জানে! নিজের বোর্ডিং কার্ড ছিঁড়ে ফোন নম্বর লিখে বলল, “এটা আমার নম্বর। সামনের মাসে ‘তুঝ পে দিল কুরবান’ ছবির শুটিং-এর জন্য লন্ডনে যাচ্ছি। দু’মাস থাকব। তুমি ওখানকার ফুড জয়েন্টগুলো নিয়ে আমায় একটু গাইড করবে?”

“আচ্ছা,” করনকে টাটা করে মধুরা। এয়ারপোর্টের সিকিয়োরিটি পেরোনোর সাথে সাথে করণকে ঘিরে ধরেছে পারসোনাল সিকিয়োরিটি। ছয় ফুটিয়াদের ভিড়ে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

কনভেয়র বেল্টের দিকে এগোয় মধুরা। নিজের লাগেজ নামায়। দু’কাঁধে দুটো ন্যাপস্যাক, এক হাতে একটা হ্যান্ডব্যাগ, অন্য হাতে ট্রলির হ্যান্ডেল ধরে ল্যাগব্যাগ করতে করতে প্রধান ফটকের দিকে এগোয়। করণকে নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। যে দিন ও জানতে পারবে যে মধুরা আর মেল্টিং পট হোস্ট করছে না, সে দিনই মধুরাকে ভুলে যাবে। উৎসাহী হবে রিচা চাড্‌ঢাকে নিয়ে। ইউ আর অ্যাজ গুড অ্যাজ ইয়োর লাস্ট পারফরম্যান্স!

শূন্য রানে আউট হয়ে মধুরা ফিরে আসছে বাড়িতে। আবার সেই কলকাতা শহর। আবার সেই পলিউশান। আবার সেই ট্র্যাফিক জ্যাম! আবার সেই ধূসর অতীতে বসবাস!

এই ডিপ্রেশানের মধ্যে একটা সুখবর আছে। একটা না, টু বি প্রেসাইস, দুটো। মধুরার দাদা কৃশানুর দুটো মেয়ে হয়েছে। গত বছর মধুরা যখন কলকাতা ছাড়ছে, তখন তার বউদি দিয়ার ইউরিনের প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট সবে পজিটিভ এসেছে। লন্ডনে থাকাকালীন ফোনে দিয়া খবর দিত। প্রথম যেদিন আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার পরে জানল যে টুইন বেবি আছে, সে দিন ভয়ের চোটে ফোনে কেঁদে ফেলেছিল। মধুরা সান্ত্বনা দিয়েছিল, “আরে! ঘাবড়াও মত! নো বিগ ডিল!”

“ভেরি বিগ ডিল মধু,” দিয়া বলেছিল, “বাচ্চা হওয়া একটা বড় ইস্যু। তার থেকেও বড় ইস্যু আমার চাকরি। দুটো বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে আমায় চাকরি ছাড়তে হবে।”

“ম্যাটারনিটি লিভ পাওয়া যায় তো!”

“যায়। আমি সেই লিভ নেবও। কিন্তু আমি ইভের চিফ সাব–এডিটর। বেশিদিন ছুটি নেওয়া যাবে না।”

দিয়া চাকরি করে ‘ইভ’ নামের ইংরিজি ফ্যাশন অ্যান্ড লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে। পাক্ষিকটির সার্কুলেশান দেড় লাখের কাছাকাছি। ওখানে অত ছুটি পাওয়া যায় না।

বাচ্চা হওয়ার পরে দিয়া চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কৃশানু ডিজিটাল ইন্ডিয়াতেই আছে। তবে তার প্রোমোশান হয়েছে। রাজচন্দ্রপুর থেকে ধর্মতলা যাতায়াত করতে দিয়ার অসুবিধে হচ্ছিল বলে নাগেরবাজারে একটা ফ্ল্যাট কিনে কৃশানু আর দিয়া শিফ্‌ট করেছিল। এখন দিয়া অফিস যাচ্ছে না। নাগেরবাজারের ফ্ল্যাট এক বছরের জন্য লিজে এক ওয়ার্কিং কাপ্‌লকে ভাড়া দিয়ে কৃশানু-দিয়া ভৌমিক ভবনে ফেরত এসেছে। দিয়া চাকরি ছাড়ার পরে সংসারে আয় কমেছিল। ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার পরে কিছুটা হলেও সুরাহা হয়েছে।

বাড়ির সঙ্গে ফোনে মধুরার শেষ কথা হয়েছে গত সপ্তাহে। ফেয়ারওয়েল ডিনারের পরের দিন বিকেলে। ফোন ধরেছিল মনোহর। মধুরার বাবা। মধুরা বলেছিল, “আমি নেক্সট উইকে বাড়ি ফিরছি।”

“ওগো শুনছ,” চিৎকার করে উঠেছিল মনোহর, “আমাদের মধু বাড়ি আসছে।”

মধুরার চোখে জল। বাবার গলা। বাড়ির গলা। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে আসা আওয়াজ! কী যে মধু মেশানো আছে, কে জানে! যতবার মধুরা শোনে, ততবার বুকের বাঁ দিকে তারসানাই বেজে ওঠে।

ফোনে এখন যূথিকা, মধুরার মা। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে প্রবল ক্যাঁওম্যাও শোনা যাচ্ছে। দুটো বাচ্চা মিলে ভৌমিক ভবনের সাউন্ডস্কেপ একদম বদলে দিয়েছে। পান চিবুতে চিবুতে, বাতের ব্যথায় কোঁতাতে কোঁতাতে, কোনও একটা বাচ্চাকে আদর করতে করতে যূথিকা বলল, “কবে ফিরছিস? আমি এয়ারপোর্ট যাব।”

“উফ! তুমি বউদিকে দাও! আমি বুঝিয়ে বলছি। তোমার মাথায় ঢুকবে না।”

দিয়ার বদলে ফোন ধরল কৃশানু। “আমায় বল। তোর বউদি এখন হালুয়া টাইট। দু’ শিফ্‌টে দুধ খাওয়াতে হচ্ছে।”

“তিন শিফ্‌টে নয় বলছিস?”

“খালি বাজে কথা। কাজের কথা বল। কবে ফিরছিস? দমদমে অ্যারাইভাল ক’টায়? এই বান্দা গাড়ি নিয়ে হাজির থাকবে।”

“৭ ফেব্রুয়ারি হিথরো থেকে ডিপারচার দুপুর দেড়টায়। কলকাতায় অ্যারাইভাল ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর বারোটা চল্লিশে। দয়া করে ঠিক সময়ে আসিস। আমার সঙ্গে অনেক লাগেজ থাকবে।”

“ক’দিনের জন্য আসছিস? আমি কি ফেরার টিকিট কেটে রাখব? এই সময় এনআরআইগুলো বাৎসরিক দেশভ্রমণ সেরে ফেরত যায়। প্লেনে উদুম রাশ হবে।”

“এখনও বাড়ি ফিরলাম না, এখনই ভাগানোর প্ল্যান করছিস?” মধুরা খচে লাল!

কৃশানু আমতা আমতা করে বলে, “সরি বাবা! আমি তোর ভালর জন্যেই বলছিলাম। এখানে এসেই তো চ্যাঁচাবি, মেল্টিং পট, সিজ্‌ন টু-এর শুটিং শুরু হতে আর এক সপ্তাহ বাকি। আমার টিকিট কই?’ তখন সব ঝক্কি আমাকে সামলাতে হবে।”

“হবে না। তুই শুধু এয়ারপোর্টে আয়।” ফোন কাটার আগে নিচু গলায় বলেছিল মধুরা।

দমদম এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাসের প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে কৃশানুকে দেখতে পেয়ে সেই ফোনালাপ মনে পড়ে গেল। নাঃহ! পুরনো কথা মনে করে নিজেকে কষ্ট দেবে না মধুরা। এখন খুশি থাকবে। খুব মজা করবে। খুব, খু-উ-ব মজা!

কৃশানুর সঙ্গে এসেছে মনোহর এবং যূথিকা। গত এক বছরে মনোহর সেরকম বুড়োয়নি। কিন্ত যূথিকার চেহারায় বার্ধক্য এসে গেছে।

হাওড়ার রাজচন্দ্রপুরের মেন রাস্তার ওপরে তিনতলা ভৌমিক ভবন এবং তার মালিক মনোহর ভৌমিককে এলাকার লোকে একডাকে চেনে। গঙ্গার এই পারে এত ভাল মিষ্টির দোকান আর দুটো নেই। ওদিকে বেলুড় মঠ থেকে এদিকে শ্রীরামপুর পর্যন্ত এলাকার লোকজন এই দোকানের কমলাকান্ত আর আশাপূর্ণা বলতে অজ্ঞান। প্রথমটি কমলাভোগের ভ্যারিয়েশান। পরেরটি জলভরা তালশাঁস। চব্বিশ বছরের পুরনো এই দোকানের খুবই রমরমা।

ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ ভাল চাকরি করে। তা সত্ত্বেও মনোহর নোংরা ফতুয়া আর লুঙি পরে দোকান চালায়, দিনে এক প্যাকেট ‘১ নং ঘড়ি বিড়ি’ খায়, মিষ্টির কারিগর বিমল মোদকের সঙ্গে গোপনে চুল্লু টানে।

মনোহরের ব্লাড সুগার হাই। ব্লাড প্রেশারও বেশি। নিয়মিত ইনসুলিন চলছে, চলছে প্রেশার কমানোর ওষুধ। কৃশানু, দিয়া আর মধুরা মনোহরকে বুঝিয়েছে চুল্লু না খেয়ে ভাল কোয়ালিটির হুইস্কি খেতে। মনোহর সেসব শোনার বান্দা নয়। বিমলের বউ সবিতা ভৌমিক ভবনের হোম ফ্রন্ট সামলায়। সে বুদ্ধিমতীর মতো এই প্রসঙ্গে একদম মুখ খোলে না।

যূথিকা হাঁটুর ব্যথায় সারাক্ষণ ‘বাপ রে! মা রে!’ করে বেড়ায়। অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, নেচারোপ্যাথি— কোনও কিছুতে লাভ হয়নি। শেষ ভরসা হিসেবে এক হেকিমকে ধরেছে। সে প্রতি সপ্তাহে এসে এক বোতল ব্যথা-বিনাশ তেল সাপ্লাই করে একশো টাকা নিয়ে যায়। মনোহর বলে, ‘ওটা সাপের বিষ আর তার্পিন তেলের কম্বিনেশান।’ কথাটা শুনলে যূথিকা বেজায় রেগে যায়। কিন্তু সবিতাকে দিয়ে হাঁটু মালিশও করায়।

মধুরাকে দেখে মনোহর বিড়ি ফেলে দিয়ে, দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “আয়।” আর, মধুরা, সিনেমায় যেমন হয়, লাগেজ-ফাগেজ ফেলে দিয়ে, দৌড়ে এসে মনোহরের কোলে মাথা গুঁজল। তার চোখে জল। যূথিকা পাশ থেকে বলল, “বাপ-বেটির ধাষ্টামো শেষ হলে বোলো, মধুর সঙ্গে আমার কথা আছে।”

“কী কথা মা?” মনোহরকে ছেড়ে যূথিকাকে জড়িয়ে ধরেছে মধুরা। কৃশানু লাগেজ তোলায় ব্যস্ত ছিল। চেঁচিয়ে বলল, “ওফ! মা! মেয়েটা সদ্য এল। আগে বাড়ি ঢুকুক। তার পরে ওসব হবে।”

“কী ব্যাপার দাদা?” মধুরার অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেছে।

“কিছু না। তুই গাড়িতে ওঠ।” ডিকিতে লাগেজ তুলে ড্রাইভারের আসনে বসে কৃশানু। পাশে বসে মধুরা বলল, “সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অফ ডেনমার্ক।”

মনোহর আর যূথিকা পিছনের সিটে বসেছে। কৃশানু বলল, “শেক্‌সপিয়ারের দেশে গিয়ে হেব্বি উন্নতি হয়েছে দেখছি। আগে তো ফেসবুকের স্ট্যাটাস আপডেট আর চেতন ভগতের বেস্টসেলার ছাড়া কিছু পড়তিস না।”

“ওসব বাদ দে। কাজের কথা বল। মা কী বলতে চাইছে?” কৃশানুকে চেপে ধরেছে মধুরা। উত্তর না দিয়ে কৃশানু গাড়িতে স্টার্ট দিল।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যশোর রোড ধরে সামান্য এগোলেই বাঁদিকে শুরু হয়েছে চকোলেটের মতো মসৃণ বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। স্পিডোমিটারের কাঁটা একলাফে আশিতে। শুভ্রর এনফিল্ডে চেপে এই রাস্তা দিয়ে বহুবার গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছে মধুরা।

শুভ্র… দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধুরা। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কলিগ, চূড়ান্ত মেয়েবাজ শুভ্র দত্ত কী দেখে তার প্রেমে পড়েছিল, কে জানে! কিন্তু পড়েছিল। মধুরা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরে যখন দেখল যে শুভ্রর তরফে ভালবাসাটা খাঁটি, তখন আপত্তি করেনি। হাজার হোক, বাগবাজারের জয়েন্ট ফ্যামিলির ছেলে। দেখতে সুন্দর, ভাল মাইনের চাকরি করে, নেশাভাং করে না… আর কী চাই? শুভ্রর বাবা গুরুপদ দত্ত কলকাতা পুলিশে চাকরি করে। শুভ্র-র মা মঞ্জুলিকা হোমমেকার। দু’জনেই মধুরাকে মেনে নিয়েছে। মনোহর আর যূথিকা তো আহ্লাদে আটখানা। পারলে তক্ষুনি মধুরার বিয়ে দেয়।

স্কুপ চ্যানেলের কুকিং রিয়্যালিটি শো ‘পাঁচফোড়ন’-এর ফাইনালে মধুরার কম্পিটিটার ছিল নেহা পারেখ। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় মধুরার বস সন্দীপ পারেখ ওরফে স্যান্ডির বোন নেহা। স্যান্ডি নানা কলকাঠি নেড়ে তার বোনকে ফার্স্ট করে। মধুরা ফাইনাল রাউন্ডে হেরে যায়।

এই ঘটনার পরে মধুরা ঠিক করেছিল, বিয়েটা সেরে ফেলবে। কিন্তু মেল্টিং পট-এর অফার চলে আসার পরে লাস্ট মোমেন্টে ডিসিশান বদলায়। শুভ্রকে বলে, “আমার অ্যাজেন্ডায় এখন বিয়ের কোনও প্ল্যান নেই।”

শুভ্র অভিমান করে বলেছিল, “আমি আছি তো?” শুভ্রকে চকাম করে চুমু খেয়ে মধুরা বলেছিল, “ভীষণ ভাবে আছ।”

লন্ডনে যাওয়ার পরে প্রথম দু’মাস সিরিয়াসলি শুভ্র-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল মধুরা। রোজ সকালে মেল করা, শুটিং-এর ফাঁকে মোবাইল থেকে ফেসবুকে ঢুকে টুকটাক কমেন্ট, লাইক আর শেয়ার; রাতে শোওয়ার আগে স্কাইপে ভিডিয়ো চ্যাট, মায় মাসে একটা চিঠি লেখা!

সবার আগে বন্ধ হল চিঠি লেখা। তারপর বন্ধ হল মেল আর ভিডিয়ো চ্যাট। শুভ্র নিয়মিত তাকে ফোন করত। মেল করত। ফেসবুকে নানা কমেন্ট করত।

মধুরা ফোন ধরার সময় পেত না। মেল পড়া বা উত্তর লেখা আরও অসম্ভব। শুভ্র গত মাসদুয়েক ফেসবুকেও চুপচাপ। কেন কে জানে! আজই বাড়ি ফিরে ফোন করতে হবে।

গাড়ি এখন দক্ষিণেশ্বরে। এইখানে সারা বছর জ্যাম লেগে থাকে। সরকারি আর বেসরকারি বাস, অটো আর শাট্‌লের গাড়ি, ট্যাক্সি আর রিকশায় জ্যামজমাট রাস্তা। যূথিকা দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বিড়বিড় করে কী সব বকছে। মনোহর বলল, “ঠাকুরকে ঘুষ দিয়ে লাভ নেই। হাতির মতো চেহারা হলে হাঁটুর বারোটা বাজবেই।”

“বাজে বোকো না তো!” ঝাঁঝিয়ে ওঠে যূথিকা, “হাতির হাঁটু ব্যথা হয় না।”

“কী করে জানলে? তুমি কি ভেটেরেনারি পড়েছ?”

“তোমার মতো ছাগলের সঙ্গে ঘর করে ওই সাবজেক্টে আমার ডিপ্লোমা করা হয়ে গেছে!”

মনোহর-যূথিকার ঝগড়ার মধ্যে কৃশানুর হ্যাচব্যাক বালি ব্রিজ পেরিয়ে গেল। এসে গেল রাজচন্দ্রপুর। চলে এল ভৌমিক ভবন। তিনতলা বাড়ির একতলার ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে একগাল হাসছে বিমল। বাড়ির সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবিতা।

ভৌমিক ভবনের একতলায় পা রেখে মধুরা বড় একটা শ্বাস নিল। এক বছর বাদে বাড়ি ফিরল সে। বাবা-মা, দাদা-বউদি, কোলিগ-প্রেমিক, এদের ছেড়ে সে এতদিন কীভাবে ছিল কে জানে!

বউদির কথা মনে পড়ায় এক-এক লাফে তিনটে সিঁড়ি টপকে দোতলায় ওঠে মধুরা। দুটো গুবলু গুবলু বাচ্চা নিয়ে দিয়া কী করছে দেখা যাক!

দিয়ার শোওয়ার ঘরটা একদম বদলে গেছে। আগে ছিল ঝকঝকে তকতকে। মেঝেতে একটুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখা যেত না। এখন এটা শোওয়ার ঘর না গুদাম ঘর বোঝা মুশকিল! ডাব্‌ল বেডের পাশে একটা সিঙ্গল বেড ঢুকেছে। দুটো খাটময় ছোট ছোট কাঁথা শুকোচ্ছে। ওয়ার্ডরোবের পাল্লা হাট করে খোলা। সেখানে কৃশানু বা দিয়ার কোনও পোশাক দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চাদের পোশাকে ঠাসা। চেয়ারে গোটাকয়েক নোংরা ম্যাক্সি দলা পাকিয়ে রাখা রয়েছে। কম্পিউটার টেবিল ভরতি নানা মাপের ওষুধের শিশি-বোতল, ফিডিং বট্‌ল, বাচ্চাদের পরার জন্য কাগজের ন্যাপকিন। সিঙ্গল বেডে একটা বাচ্চা ঘুমোচ্ছে। তার ওপরে গোল মশারি চাপা দেওয়া। আর একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দিয়া বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে।

মধুরা অবাক হয়ে দেখল, দিয়া আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে। গাল ঢুকে গেছে, চোখের নীচে কালি, মাথার চুল উঠে গেছে, বেশ কিছু চুল পেকে গেছে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ইভ’-এর চিফ সাব এডিটর দিয়া ভৌমিককে দেখে কষ্ট হল মধুরার। কোনও রকমে বলল, “হাই! তোমার অবস্থা খুব খারাপ দেখছি।”

বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দিয়া বলল, “আমার যা হবার হয়ে গেছে। এবার তোর পালা।”

“মানে?” খাটে শুয়ে থাকা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে জিজ্ঞাসা করল মধুরা।

“তোকে কেউ কিছু বলেনি?”

“মা কী একটা বলার চেষ্টা করছিল। দাদা থামিয়ে দিল। কী ব্যাপার বল তো?” বাচ্চাটাকে শুইয়ে প্রশ্ন করে মধুরা। দিয়া একটা বিয়ের কার্ড এগিয়ে দেয়।

মধুরা কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখে, খামের ওপরে লেখা রয়েছে ‘অ্যানি ওয়েডস শুভ্র’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *