মধুরেণ – ১৮

১৮

সকালে মধুরার ঘুম ভাঙল মাথা যন্ত্রণা নিয়ে। পুরো কপাল দপদপ করছে। রগে ব্যথা। মুখের ভিতরটা শুকনো। ঘাড়, পিঠ, কোমরেও অসম্ভব ব্যথা। গা ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে। তার মানে জ্বর আসছে। তলপেটেও ব্যথা।

চোখ খোলার আগে মধুরা ভাবল, বাড়ি গেলে ভাল হত। যাবে নাকি, একবার? ক্যালকাটা ধাবার ভবিষ্যৎ জানা হয়ে গেছে। বাবা-মা’র হাতেপায়ে ধরে ছাদের ঘরটায় এনট্রি পাওয়া যাবে না?

ধুস! আজেবাজে চিন্তা! চোখ খুলে মধুরা মোবাইল হাতে নেয়। ক’টা বাজে?

ন’টা? আঁতকে ওঠে মধুরা। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছে আর এপাশ ওপাশ করেছে। ভোরবেলায় চোখটা জুড়ে এসেছিল। তা বলে ন’টা? কেউ তাকে ডাকল না কেন? ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিই বা কোথায়?

বিছানা ছেড়ে উঠে মধুরা দরজা খুলল। এখান থেকে ক্যালকাটা ধাবার সামনের দিকটা দেখা যায়। মধুরা যা দেখল, তাতে তার মাথা ঘুরে গেল!

ক্যালকাটা ধাবার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো এসি বাস। বাস অনেকক্ষণ আগেই এসেছে। কেননা প্যাসেঞ্জাররা বাথরুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে না। তা হলে তারা কোথায়?

পাখির মতো উড়ে ঘর থেকে বেরোয় মধুরা। হরিণের ক্ষিপ্রতায় সিঁড়ি দিয়ে নামে। তার মনে নেই যে সে মুখ ধোয়নি। তার মনে নেই যে সে নাইট ড্রেস পরে রয়েছে। তার মনে নেই যে চুল উসকোখুসকো।

মাঝসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়ে মধুরা। এখান থেকে সে সব দেখতে পাচ্ছে। সব শুনতে পাচ্ছে। সব কিছুর গন্ধ পাচ্ছে।

মধুরা কী দেখতে পাচ্ছে? দেখতে পাচ্ছে যে অন্তত কুড়িজন লোক ক্যালকাটা ধাবায় ছড়িয়েিছটিয়ে বসে। তাদের মধ্যে পাঁচজন মধুরার চেনা। উমেদ, পূর্ণিমা, ওদের বাচ্চা, নিম্বারাম এবং নারায়ণ বেরা।

ডুঙ্গার কোণের চেয়ারে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে দুটি কমবয়সি কলেজ পড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলছে। মিস জোনাকি ক্যাশ কাউন্টারের ডেস্কটপ কম্পিউটারে কী সব করছে। তার পাশে পাঁচজনের এক শিখ পরিবার। অর্জুন আর মিতা টেবিলে সার্ভ করছে। গীতাকে দেখা যাচ্ছে না।

মধুরা কী শুনতে পাচ্ছে? শুনতে পাচ্ছে, পূর্ণিমা হাত নেড়ে তাকে বলছে, “মাইমাকে বলেছিলাম তোমাকে যেন না ডাকে।”

উমেদ বলল, “কাল রাতে বাড়ি ফিরতেই ওয়াইফের আবদার, দিঘা যাওয়ার সময় তোমার ধাবায় খানা খাবে। তাই চলে এলাম। পাপাকো সাথ মে লে লিয়া।”

নিম্বারাম বলল, “নারানদাকো ভি বুলা লিয়া। আমি বুড়ো মানুষ। একা একা দিঘায় গিয়ে বোর হব নাকি?”

মিস জোনাকি সর্দারনিকে বলছে, “আপনারা পাঁচজন উইদাউট বুকিং দিঘা যাচ্ছেন। উইকেন্ডে দিঘায় সাংঘাতিক রাশ হয়। ইট মে হ্যাপেন, যে আপনারা কোনও হোটেলের কোনও রুম পেলেন না। রাস্তায় রাত কাটাতে হল।”

“সওয়াল হি নহি হ্যায়!” আপত্তি করে সর্দারনি।

“তার থেকেও বাজে ব্যাপার হবে, যখন একটা সিঙ্গল রুমে আপনাদের পাঁচজনকে ঢুকিয়ে একরাতের জন্য পাঁচ হাজার টাকা চাইবে। আর আপনারা ঘরে ঢুকে দেখবেন যে মেঝেতে ড্যাম্প, দেওয়ালে ড্যাম্প, বিছানায় ছারপোকা, দেওয়ালে টিকটিকি আর মাকড়সা, টিউবলাইট খারাপ, ফ্যান চলছে না, বাথরুম বাইরে অ্যান্ড দ্যাট টু ইজ ওভার ফ্লোয়িং।”

“ইইক্‌স!” আঁতকে উঠেছে সর্দারনি। সর্দার বলল, “হোয়াট্‌স দ্য ওয়ে আউট?”

“উই আর নিউ ইন দিস লোকেশান!” সহজ সরল কনফেশান মিস জোনাকির, “আমাদের দিঘায় চেনাশোনা নেই। বাট ইন্টারনেট মে হেল্‌প। অনলাইনে দিঘার সব হোটেলের খবর থাকবে না। কিন্তু কিছু থাকবে। লেট মি চেক!”

ডুঙ্গার কলেজ পড়ুয়াদের বলছে, “দেখো ভাইলোগ, হমারে পাস আভি লিকার লাইসেন্স আয়া নহি। হম আপকো বিয়ার নহি সার্ভ কর সকতা হ্যায়!”

এক ছোকরা বলল, “সার্ভ করনে কে লিয়ে কওন বোলা হ্যায় বাবাজি? আপ দশ টিনা দে দিজিয়ে, ব্যস! অওর কুছ নহি চাহিয়ে!”

“তুম লোগ পাঁচ আদমি হ্যায় না?”

“হাঁ বাবাজি!”

“দশ সে হো জায়েগা?” মুচকি হেসে বলে ডুঙ্গার!

ছোকরা আনন্দে লাফিয়ে উঠে ডুঙ্গারের গালে চুমু খেয়ে বলে, “বাবাজি কা জয় হো!”

মিস জোনাকি বলল, “সি মারমেড হোটেল… সমুদ্রের ধারে… সি ফেসিং ডাব্‌ল বেডরুম… বার-কাম-রেস্তোরাঁ… কন্টিনেন্টাল ফুড… নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড… হিন্দি ফিল্ম ব্যান্ড… চলবে?”

“খুব চলেগা দিদি!” সর্দার বেজায় খুশি, “অনলাইন বুকিং হোগা কেয়া?”

“ফোন নম্বর আছে, আমি দেখছি…” মোবাইল থেকে ফোন করছে মিস জোনাকি। পাকা কথা বলে ইন্টারনেটে রুম বুক করছে। টুয়েন্টি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স পেমেন্ট ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে হয়ে গেল। তার রিসিপ্ট চলে এল মিস জোনাকির মেল আইডিতে। শিখ ফ্যামিলি সেটা সংগ্রহ করে খেতে বসল। সর্দারনি বলল, “আমি সোচতেও পারিনি যে কলকাত্তার বাইরে এইরকম ফেসিলিটি পাওয়া যাবে। ইয়ু পিপ্‌ল আর টু গুড! ভওয়ানিপুরকা শিখ বেরাদরি আজ সে ইস ধাবা পে হি আয়েগা!”

ডুঙ্গার ছোকরাদের বলছে, “ডু ইয়ু নো হোয়াট ইজ সিক্স প্যাক?”

“হাঁ বাবাজি!” এক ছোকরা টি শার্ট তুলে নিজের পেট দেখাচ্ছে। ডুঙ্গার বলছে, “ট্রু! বাট দিস ইজ অলসো সিক্স প্যাক!” তার হাতে বিয়ার ক্যানের কার্টন বা বাক্স। প্রতিটি বাক্সে ছ’ ক্যান বিয়ার আছে। “মাই সাজেশান ইজ, টেক টুয়েল্ভ ক্যানস। দিঘায় গিয়ে আবার পেয়ে যাবে। দিস ইজ জাস্ট ফর দ্য রোড!”

“বাবাজি কা জয় হো!” আবার ডুঙ্গারকে ধন্যবাদ দেয় ছেলেরা।

মধুরা কীসের গন্ধ পাচ্ছে? রান্নাঘর থেকে নির্ভুল ভেসে আসছে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ। মধুরা সিঁড়ি দিয়ে উড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। দাঁত মাজে, মুখে সাবান দেয়, চুল বাঁধে, পোশাক বদলায়! সব মিলিয়ে সময় লাগল দশ মিনিট। এক দৌড়ে নীচে নেমে রান্নাঘরে ঢোকে সে। অনেক দিন বাদে তার আবার রান্না করতে ইচ্ছে করছে!

গীতা হেঁশেলে নারকেল কুরোচ্ছে। মধুরাকে দেখে বলল, “ঘুম ভাঙল? চা দেব?”

মধুরা বলল, “এখন চা খাব না। ইলিশমাছ ভাজার গন্ধ পেলাম। কী রাঁধছ?”

“চা খাবে না কেন?”

“ইলিশটা আমি রাঁধব। তুমি ভাতটা দেখো।” ভাজা ইলিশ সরিয়ে রেখে চাকা চাকা পিস করা ইলিশ নেয় মধুরা। মাছ ধুয়ে নিয়ে নুন আর আদাবাটা মাখায়। ইলিশের পিস দেখেই মালুম, এটা মেয়ে ইলিশ। মেয়ে ইলিশের পেট চওড়া। ওপর আর নীচটা সরু, কী সেক্স অ্যাপিল! নোনা জলের মাছ ঘোর বর্ষায় স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে মিষ্টি জলে চলে আসে ডিম পাড়ার জন্যে।

মধুরা গীতাকে জিজ্ঞাসা করে, “মেনু কী?”

গীতা বলল, “কাস্টমাররা বলেছে বাঙালি রান্না খাবে। তাই ভাত, আলু পোস্ত, সোনামুগের ডাল, পাবনার নারকেলি ইলিশ আর আনারসের চাটনি…”

গীতার মুখের কথা কেড়ে মধুরা বলল, “নারকোল দিয়ে ইলিশটা আমি করছি।” গীতা উত্তর না দিয়ে আনারস কাটতে থাকে।

মধুরার মনে পড়ছে পান্‌চের কথা। এক দেশের রান্নার সঙ্গে অন্য দেশের রান্না, এক দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য দেশের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল সে। প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণে। কিন্তু সেই ভেনচার থেকে একটা বড় শিক্ষা পেয়েছে মধুরা। ফিউশান ফুড আসলে অ্যাকোয়ার্ড টেস্ট। যে মানুষ অনেক দেশে ঘুরেছে, নানান রকমের খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত, তারাই ফিউশন ফুডের ক্লায়েন্ট। ফিউশান ফুডের আবেদন দীক্ষিত ভোজনরসিকের মস্তিষ্কে। আমবাঙালির জন্যে নয়। আমবাঙালি হৃদয় দ্বারা তাড়িত এক জাত। তারা ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। তারা নস্ট্যালজিয়ায় বাস করতে ভালবাসে। তারা কমফর্ট ফুড পছন্দ করে। তারা পছন্দ করে মাছ-ভাত।

তবে তাই হোক! মধুরা এখন থেকে শুধু মাছ-ভাত রাঁধবে। রান্না করা তার জীবনের একমাত্র টারগেট। লাল কার্ড দেখিয়ে তাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে সাইডলাইনে বসে থাকার পাত্রী সে নয়। সে খেলবেই। তার জন্য যদি সারা জীবন মাছ-ভাত রান্না করতে হয়, তাই সই। ধাবা দাঁড়িয়ে যাক, তার পরে খেলার নিয়ম বদলানো যাবে। কবে মাছ-ভাতের মধ্যে মিশে যাবে অক্টোপাস স্যালাড, কেউ জানে না!

কড়াইতে সাদা তেল ঢালে মধুরা। তেল গরম হচ্ছে। তেল ফুটছে। ম্যারিনেট করা ইলিশ মাছের টুকরোগুলো হালকা সাঁতলে নেয় সে। কড়াতে পেঁয়াজবাটা দেয়। ইলিশ মাছের সঙ্গে খুনসুটি করছে পেঁয়াজ। রং বদলাচ্ছে। সোনালি হয়ে আসছে। এই সোনালি রং হল সিগন্যাল! ওরা খেলার সাথি চাইছে। মধুরা একে একে কড়াইতে দেয় আদা-রসুন বাটা, হলুদ, শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো, সাদা মরিচ গুঁড়ো। প্রাণকাড়া গন্ধে চারিদিক মম করছে! কিন্তু এখনও খেলা শেষ হয়নি। মধুরা পরিমাণমতো নুন, মিষ্টি দিল। কচি ডাবের শাঁস দিল। গুবগুব শব্দে ইলিশ মাছ ফুটছে। জলের রূপালি শস্যের গা ছেঁচে বেরিয়ে আসছে তেল।

তেল বেরোনো হল দ্বিতীয় সিগন্যাল। এবার এই মিশ্রণে ঢালতে হবে নারকোলের দুধ। তা হলেই পাবনার নারকেলি ইলিশ তৈরি। স্টেনলেস স্টিলের থালার ওপরে গোল করে কাটা কলাপাতা রাখছে গীতা। মিতাও এখন রান্নাঘরে। সে বাটিতে ভাত নিয়ে ধোওয়া কলাপাতার ওপরে চূড়া করে সাজিয়ে দিচ্ছে। এক পাশে রাখছে নুন, লেবু, লঙ্কা। কাঁচা পিঁয়াজের টুকরো। স্টিলের বড় বাটিতে সোনামুগের ডাল ঢালছে গীতা। ছোট বাটিতে আলুপোস্ত দিচ্ছে মিতা। অর্জুন দৌড়ে এসে দুই হাতে দুই থালা নিয়ে বেরোচ্ছে। গীতা আর মিতাও একই কাজ করছে। মধুরাও দু’হাতে দুটো থালা নিয়ে বেরোল। একটা রাখল নিম্বারামের সামনে। অন্যটা, নারায়ণ বেরার সামনে। বলল, “অতিথি হল নারায়ণ! কথাটা এই ভাবে সত্যি হবে কখনও ভাবিনি।”

বাকি কাস্টমারদের টেবিলেও পৌঁছে গেছে ভাতের থালা, ডাল আর পোস্তর বাটি। পূর্ণিমা হাত নেড়ে মধুরাকে ডেকে বলল, “এই যে, আমার ছেলে!”

মিস জোনাকির দেওয়া ওআরএস খেয়ে এই বাচ্চাটাই ভাল হয়েছিল। মধুরা বাচ্চাটার গাল টিপে বলল, “কী সুইট বাচ্চা! বাবা আর মা দু’জনের রূপই পেয়েছে।”

শুনে খুব খুশি হল উমেদ। ডাল দিয়ে ভাত মেখে বলল, “কী আর বলব দি’, আপনার লাক ভাল। কাল হামাদের ইউনিয়নের মিটিং ছিল। হামি সেক্রেটারি, জানেন তো?”

“জানি না আবার? স্বামীর গর্বে গিন্নি সবসময় মটমট করছে। ফোনে আমাকে সব কথা বলেছে।”

“যাঃ! তুমি না বড্‌ডো বেশি বাড়াবাড়ি করো।” আড়চোখে পুর্ণিমাকে দেখে হাসে উমেদ, “এই রুটের প্রাইভেট বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর তাদের ফ্যামিলি নিয়ে দিঘা বেড়াতে আসার প্ল্যানিং হচ্ছিল। হোটেল বুকিং কমপ্লিট। ডিসেন্ট প্যালেসে খাবার প্রোগ্রামও ফিক্সড। বাড়ি ফিরে ওয়াইফের মুখে শুনলাম আপনি ফোন করেছেন। ওয়াইফ বলল, পুরো ট্যুরে কে কোথায় কী করবে, আমি দেখতে যাব না। শুধু যাবার আর ফেরার সময়ে আমরা ডিসেন্ট প্যালেসের বদলে ক্যালকাটা ধাবায় খাব।”

পূর্ণিমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মধুরার চোখে জল চলে এসেছে। কিন্তু এখন কাঁদার সময় নয়। এখন স্বাদের ফাঁদে কাস্টমার ধরার সময়। এখন পাবনার নারকেলি ইলিশ সার্ভ করার সময়।

মস্ত ট্রেতে করে ধোঁয়া ওঠা ইলিশের বাটি নিয়ে আসছে অর্জুন আর কুমার পিয়াল। যাত্রার হিরো কখন এসেছে মধুরা খেয়াল করেনি। সে তাড়াতাড়ি অন্য অতিথিদের কাছে গেল।

শিখ পরিবারটি খুব মন দিয়ে আলুপোস্ত খাচ্ছে। মধুরাকে দেখে সর্দারনি বলল, “হমারে ওঁয়াহা খসখস সে আফিম বনতা হ্যায়। ইস লিয়ে খসখস কা ফার্মিং বন্ধ হো গয়া।”

“অ্যায়সা বাত নহি হ্যায় ম্যাডামজি!” তালে তাল মেলায় মধুরা, “বঙ্গালমে ভি খসখস ইয়ানে কি পোস্ত সে আফিম বনতা হ্যায়। লেকিন আপ জ্যায়সা লোগ আফিম সে আলুপোস্ত কে নশে জ্যাদা পসন্দ করতে হ্যায়!”

“সহি বাত!” মধুরার ডিপ্লোম্যাটিক উত্তরে খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ে সর্দারজি।

কলেজ পড়ুয়াদের টেবিলে পৌঁছে গেছে ইলিশ মাছ। সেখানে পৌঁছে বাতাসে বিয়ারের গন্ধ পেল মধুরা। গন্ধ উপেক্ষা করে বলল, “কোন কলেজ?”

এক ছোকরা কলেজের নাম বলল। মধুরা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে বলল, “যদি ক্যালকাটা ধাবার খাবার ভাল লেগে থাকে, তা হলে আমাদের নাম কলেজের বন্ধুদের রেফার কোরো। হোটেল বুকিং না করে এলেও হবে। এখান থেকে আমরা অনলাইনে বুক করে দেব।”

ছেলেটি কার্ড নিয়ে বলল, “সেসব বলতে হোবে না। বাবাজি আমাদের সোব বলে দিয়েছে। হমরা এখন বাবাজির ফ্যান।”

আর এক ছেলে বলল, “হমলোগ আভি ইস ধাবা কা নয়া নাম দিয়া। বাবাজিকি গুফা!”

এদের সঙ্গে ডুঙ্গার পাবলিক রিলেশান সেরে ফেলেছে। মধুরা ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টর এবং তাদের ফ্যামিলির দিকে যায়। হাতে আর অল্পই সময়। ইলিশ মাছ শেষ হলেই পাতে পড়বে আনারসের চাটনি। তার আগে কলকাতা থেকে দিঘাগামী প্রাইভেট বাসের ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টরদের বউ-বাচ্চাদের ইমপ্রেস করতে হবে। সেটা হয়ে গেলে বাকিটা ছেলেখেলা!

মধুরা পারল। পরবর্তী পনেরো মিনিটের মধ্যে প্রতিটি বাচ্চার হাতে ধরাল চিপ্‌সের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল, ট্যাজো এবং ইয়োইয়ো। মোবাইল ক্যামেরায় প্রত্যেকের ছবি তুলল। বউদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে প্রত্যেকের মোবাইল নম্বর নিল। একটি বউ প্রাইভেট ব্যাঙ্কে রিসেপশনিস্টের কাজ করে। তার মেল আইডি নিল। ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরদের কাছে গিয়ে খাবারের কোয়ালিটি নিয়ে আলোচনা করল। এদের ফোন নাম্বার সে নেবে। সরাসরি নয়। বউদের কাছ থেকে।

খাওয়া শেষ। সর্দার ফ্যামিলি আর কলেজ পড়ুয়াদের দল টাকা মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। মধুরা নিম্বারাম আর নারায়ণ বেরাকে বলল, “আপনারা এসেছেন, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!”

নারায়ণ বলল, “আচ্ছা মধুরা, তোমার এখানে কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স লাগবে না? চিমনি, ব্লেন্ডার, মিক্সার, ওটিজি, মাইক্রোআভেন…”

“সব লাগবে দাদা! আপনারা একটু সাহায্য করুন।” নারায়ণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে মধুরা, “একটু লোককে বলুন যে ক্যালকাটা ধাবায় রিজনেব্‌ল প্রাইসে, পকেট ফ্রেন্ডলি দামে মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। বলুন যে এখানে ইনফর্মেশান কিয়স্ক থেকে দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর বা শঙ্করপুরের হোটেল বুকিং করা হয়। ট্রেন, গাড়ি বা ট্যুরিস্ট স্পট সংক্রান্ত খবর দেওয়ার জন্য আমরা সার্ভিস চার্জ নিই না।”

“সামনের মাস থেকে এখান থেকে অফিশিয়ালি লিকার কিনতে পারবেন।” ডুঙ্গার চ্যাঁচাচ্ছে, “আমরা খুব শিগ্‌গিরি একটা বারও খুলছি।”

নারায়ণ হাসতে হাসতে বলে, “আমি যেই নিজের দোকানের সফ্‌ট মার্কেটিং শুরু করেছি, ওমনি মধুরাও তার ধাবার মার্কেটিং শুরু করেছে।”

মধুরা বলে, “সফ্‌ট মার্কেটিং বলে কিছু হয় না নারায়ণদা। হয় অল আউট খেলুন। না হলে সাইডলাইনে বসে যান। আমি যেমন এই দাদাদের ওপেন অফার দিচ্ছি।” ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল মধুরা, “আপনারা এই ধাবার সামনে বাস দাঁড় করান। ক্যালকাটা ধাবায় আপনাদের লাঞ্চ ফ্রি। কলকাতা ফেরার সময়ে পুঁচকিগুলোর জন্য চমৎকার গিফ্‌ট থাকবে।”

“অত কিছুর দরকার নেই মা।” নিম্বারাম মধুরার মাথায় হাত রেখে বলে, “আসা-যাওয়ার পথে এদের একটু যত্ন করে, একটু ভালবেসে খাইয়ে দিয়ো। ওরা গিফ্‌ট চেনে না। ওরা যত্ন আর ভালবাসা চেনে। রাস্তায় রাস্তায় দিনরাত কেটে যায়। যেখানে আতিথেয়তা পাবে, চেনা মুখ পাবে, ভদ্র ব্যবহার পাবে—ওরা সেখানে ফিরে ফিরে আসবে। কী রে, তাই তো?”

কেউ কোনও উত্তর দিচ্ছে না। সবাই মৌরি চিবোতে ব্যস্ত। পূর্ণিমা মধুরার কানে কানে বলল, “চিন্তা কোরো না। তোমার মতো অতিথিপরায়ণ মেয়ে যেখানে আছে, সেখানে কাস্টমার হতে বাধ্য।”

সবাই বাসে উঠছে। পরপর দুটো স্টেট বাস এসে দাঁড়াল। বাস থেকে নামল মধুরার চেনা মুখ। গতকাল এই ড্রাইভারই এখানে ঢুকতে চায়নি। প্যাসেঞ্জারদেরও আসতে দেয়নি।

মধুরা এগিয়ে গিয়ে বলল, “কাল তো ডিসেন্ট প্যালেসে খেলেন। আজ একবার ক্যালকাটা ধাবায় পায়ের ধুলো দিন।”

ড্রাইভার মধুরাকে পাত্তা না দিয়ে উমেদকে বলল, “কী বস? এখানে?”

উমেদ ড্রাইভারকে এককোণে টেনে নিয়ে গিয়ে কথা বলছে। ড্রাইভার ঘাড় নেড়ে আপত্তি করছে। অর্জুনের দিকে আঙুল দেখিয়ে কী সব বলছে। উমেদ তাকে ধমকাচ্ছে। ড্রাইভার অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে।

উমেদের বাস ছেড়ে দিচ্ছে। বাসে ওঠার আগে উমেদ বলল, “চললাম দি’! ফেরার সময়ে আবার দেখা হবে।”

হাত নাড়ে মধুরা, “দেখা হবে।” সরকারি বাসের ড্রাইভারকে বলে, “আপনার প্যাসেঞ্জাররা ডিসেন্ট প্যালেসে যাক। আপনি আর আপনার পার্টনার একবার আমার ধাবায় পায়ের ধুলো দিন!”

“হুম!” সন্তর্পণে ক্যালকাটা ধাবায় পা রাখে ড্রাইভার। পিছু পিছু কন্ডাক্টর। বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার ডিসেন্ট প্যালেসে চলে গেছে। কমবয়সি, মফস্‌সলি এক নবদম্পতি টুকটুক করে এখানে ঢুকেছে। মিস জোনাকি নবদম্পতির দায়িত্ব নিয়েছে। ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরকে মধুরা বলে, “আপনারা হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি ভাত আনছি।”

দু’হাতে ভাতের থালা ব্যালান্স করে ফিরে এসে মধুরা দেখে দুই পার্টনার হাত ধুয়ে রেডি। তাদের সামনে থালা রাখে মধুরা। মিতা নিয়ে এসেছে ডাল আর আলুপোস্তর বাটি। মধুরা রান্নাঘর থেকে বাটিতে করে ইলিশ মাছের পেটি এনে দেখল, ডাল আর পোস্ত দিয়ে ভাত শেষ করে দিয়েছে দুই পার্টনার। ইলিশ মাছের দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

টেবিলে বাটি রেখে মধুরা বলল, “ভাল মাছ ওঠা শুরু হয়েছে। এখন ইলিশের টেস্ট ক্রমশ ভাল হবে। কাল পরশু এলে আরও ভাল কোয়ালিটির মাছ খাওয়াব।”

ড্রাইভার গম্ভীর মুখে ভাত মাখে। জুঁই ফুলের মতো সাদা, ধোঁয়া ওঠা ভাতে মিশে যায় ইলিশের স্বাদ আর গন্ধ, নারকেলের মিষ্টত্ব আর তেলের ঝাঁঝ, শুকনো লঙ্কার ঝাল আর লেবুর অম্লভাব। ড্রাইভার মুখে একগ্রাস ভাত দিয়ে আরামে চোখ বুজে ফেলে। বোঝা যায় তার জিভে স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটেছে। চোয়াল নাড়তে নাড়তে সে বলে, “আহ!”

মধুরা মনে মনে তিনপাক নেচে নেয়। খাবারের এই এক গুণ। শত্রুকেও এক নিমেষে বন্ধু বানিয়ে ফেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *