মধুরেণ – ১৭

১৭

‘ক্যালকাটা ধাবা’র উদ্বোধন হল শনিবার ভোরবেলায়। পুরুতমশাই এসে সত্যনারায়ণ পুজো করল। মিস জোনাকি সিন্নি বানিয়েছিল। মনসাপোতার বউঝিরা লাইন দিয়ে সিন্নি নিয়ে গেল। সকাল আটটার মধ্যে পুজো কমপ্লিট। ধাবা ফাঁকা। তাড়াবার জন্য একটা মাছিও নেই।

ক্যালকাটা ধাবা নামটা মধুরার মাথা থেকে বেরিয়েছে। কলেজ মোড়ে সুলতানের ধাবার নাম ছিল ক্যালকাটা ধাবা। কোলাঘাটে এসে রান্নার গুরুকে স্মরণ করে এই নামকরণ।

ধাবার নাম বদল নিয়ে অর্জুন বা পিয়াল কিছু না বললেও গীতা আপত্তি করেছে। সে মধুরার সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলে না। একদিন সটান এসে বলল, “পুরনো নাম বদলে দিয়ে ঠিক করলে? ওই নামেই কাস্টমাররা এই ধাবাকে চিনত।”

“কোন কাস্টমারদের কথা বলছ? আমি তো ফ্লাইং ছাড়া আর কোনও কাস্টমার দেখিনি। তাদের কাছে ভাইভাই ধাবা আর ক্যালকাটা ধাবার মধ্যে কোনও তফাত নেই।”

কাউন্টারে বসে সেই মিটিং-এর কথা ভাবছিল মধুরা। পার্টনারশিপ ডিড বানায় সৌমেন। তারপর ধাবা রেনোভেশানের কাজ শুরু হয়। হাতে টাকাপয়সা একদম নেই। জেমস গুপ্তর পরামর্শ মেনে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে, কোয়ালিটি মেনটেন করে ধাবা সাজিয়েছে। নজর ছিল ফাংশনালিটির দিকেও। ধাবায় যেমন হয়, খাটিয়া পেতে দিয়েছে সারি সারি। পুরনো চেয়ার টেবিল আছে, তবে সেগুলো অন্যদিকে। ডুঙ্গারের পরামর্শ মেনে ধাবার বাইরে, সবার চোখে পড়ে এমন জায়গায় শৌচালয় বানিয়েছে।

বাইরের দেওয়ালে ক্যাঁটকেটে লাল রঙে লেখা, ‘মহিলা’ এবং ‘পুরুষ’। ডুঙ্গার চেয়েছিল ‘প্রস্রাবখানা’ লিখতে। মধুরার আপত্তিতে ‘শৌচালয়’ লেখা হয়েছে। শৌচালয়ের ভিতরের দেওয়ালে ‘ক্যালকাটা ধাবা’র লিফলেট সাঁটা।

মিস জোনাকি লিকার লাইসেন্সের জন্য দৌড়োদৌড়ি করছে, তবে এখনও পাওয়া যায়নি। আপনমনে হাসে মধুরা। পান্‌চের উদ্বোধনের সময় কত কী করেছিল! গাদাগাদা অফিশিয়াল পেপার; কাগজে-টিভিতে-রাস্তায় অ্যাড, ইন্টিরিয়র ডেকরেশান, দামি ক্রকারি আর কাটলারি, ফিউশান মেনু, মকটেল-ককটেল, সেলেব্রিটিকে দিয়ে ইনগরেশান, প্রেসের লোককে স্পেশাল ইনভিটেশান কত্ত কী!

আর এখন সে বসে রয়েছে সানমাইকা লাগানো টেবিলের পিছনে, কাঠের চেয়ারে। সানমাইকা ভাঙা, চেয়ারের পায়া নড়বড় করছে। রান্নাঘরে সবজি কাটছে মিতা। ময়দা মাখছে গীতা। অর্জুন আজ আর মুড়ি-শিঙাড়া-তেলেভাজা নিয়ে রাস্তায় বসবে না। ধোপদুরস্ত পোশাক পরে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যত সরকারি-বেসরকারি বাস বা প্রাইভেট কার যাচ্ছে, তাদের ইশারা করছে, যেন দাঁড়ায়। এখনও পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায়নি। কেউ কেউ স্লো হয়েছে। তখন বাস বা গাড়ির জানলা দিয়ে লিফলেট ছুড়ে দিয়েছে। তাতে লেখা…

সুখবর!

কোলাঘাটে সুখাদ্যের নতুন ঠেক!

ক্যালকাটা ধাবা!

বাঙালি, নর্থ ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায়।

চিপ অ্যান্ড বেস্ট।

টেস্ট দ্য টেস্ট!

বিস্ময়সূচক চিহ্ন কন্টকিত লিফলেটটি বানিয়ে দিয়েছে কুমার পিয়াল। ক্যালকাটা ধাবা বিষয়ে এই তার একমাত্র কনট্রিবিউশান। সে এক নয়া পয়সা দেয়নি। জানিয়ে দিয়েছে, ভাইভাই ধাবার পুরনো অংশীদারির লাভেই সে খুশি। ক্যালকাটা ধাবার লাভ বা ক্ষতি কোনও কিছুর দায় নেবে না।

কুমার পিয়ালের এই সিদ্ধান্তে অর্জুনও পিছিয়ে গেছে। একলাখ টাকা ইনভেস্ট করার প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে সে মধুরার নির্দেশ মেনে চলছে। ধাবার নামবদল এবং অল্পবিস্তর ভোলবদলে আপত্তি করেনি।

মিতা মধুরার নির্দেশ মানলেও গীতাকে নিয়ে চিন্তিত মধুরা। যারা কম কথা বলে, তাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়।

লন্ডনে কাজ শিখে গ্রামবাংলায় ধাবা খুলে মধুরা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে। সে বুঝে গেছে, জেদের বশে পাগলামি করছে। টাকার শ্রাদ্ধ, সময় আর এনার্জির শ্রাদ্ধ, রিলেশানশিপের শ্রাদ্ধ! লন্ডনের রোজগারের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। গাড়ি নেই। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাবামায়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুধু ফোনে। অশোক সপ্তাহে একবার ঘন্টাচারেকের জন্য আসে। কিন্তু তারও কাজ আছে। রাতে থাকে না।

রাতে থাকা সম্ভবও নয়। দোতলায় একটাই বেডরুম। আলাদা কোনও গেস্টরুম নেই। এটা কলকাতা শহর নয় যে কে এল আর কে গেল তার খবর কেউ রাখে না।

একটা স্টেট বাস এসে দাঁড়াল। আজ শনিবার, দিঘা যাওয়ার ধুম লেগেছে। বাস ভরতি লোক। হুড়মুড় করে বাস থেকে বরবউ, এন্ডিগেন্ডি, বুড়োবুড়ি, বন্ধুর গ্রুপ, ফুত্তি করতে আসা পাড়ার বউদি ও বেপাড়ার দেওর! সারা রাস্তা জল খেয়ে খেয়ে এদের ব্লাডার এখন জয়ঢাক। সব্বাই বাথরুম যাবে। ডুঙ্গার এই সিচুয়েশান আন্দাজ করেই রেস্তোরাঁর বাইরে বাথরুম বানিয়েছে।

ক্যালোরব্যালোর করে সবাই বাথরুমে ঢুকছে। অর্জুন অক্লান্ত চেঁচিয়ে যাচ্ছে, “লুচি-আলুরদম, কচুরি-ছোলার ডাল, মেচেদার ভেজিটেবিল চপ দেখলে জিভে জল, খেলে চোখে জল। চলে আসুন, চলে আসুন, চলে আসুন।”

ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর ডিসেন্ট প্যালেসে খেতে চলে গেল। কাস্টমাররাও সেখানেই ঢুকল। অর্জুন তেড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একজন কাস্টমারও ঢুকল না। ঠিক হ্যায়, কোই পরোয়া নহি! আবার বাস আসবে! টিম স্পিরিট চাঙ্গা করতে মধুরা বলল, “ও মিতামামি, একটু চা-ফা খাওয়াও!”

“দিচ্ছি বাবা দিচ্ছি!” ফুশিয়া রঙের শাড়ি পরে মিতা মুখঝামটা দিল। তার ব্লাউজের রং গেরুয়া। শাড়ির পাড়ের রংও গেরুয়া। পান্‌চের কালার কম্বোকে মধুরা ভোলেনি। সে নিজে পরে আছে ফুশিয়া কুর্তি আর গেরুয়া লেগিংস। মিস জোনাকি আর গীতা একই ডিজাইনের শাড়ি পরেছে। অর্জুন আর ডুঙ্গার পরেছে গেরুয়া শার্ট আর কালো প্যান্ট। তাদের কলারে আর পকেটে ফুশিয়ার ছোঁয়া।

আর একটা বাস এসে দাঁড়াল। বাস থেকে নেমে ড্রাইভার ডিসেন্ট প্যালেসের দিকে পা বাড়াল। অর্জুন দৌড়ে গিয়ে বলল, “একবার আমাদের এখানে পায়ের ধুলো দিন স্যার।!”

“না না!” হাত দিয়ে মাছি তাড়ায় ড্রাইভার। “তোমাদের খাবার কোয়ালিটি খুব খারাপ। প্যাসেঞ্জার আমাকে ক্যালাবে!”

“না স্যার! আমরা রেনোভেট করেছি!” হাতজোড় করে বলে অর্জুন।

“ধুস! তুমি শালা চুল্লু খেয়ে টাল্লি হয়ে থাকো। তোমার কথার কোনও ভরসা নেই।” অর্জুনকে ফুটিয়ে দিয়ে ড্রাইভার হাঁক পাড়ে, “পার্টনার, পাবলিককে নিয়ে জলদি এসো। পেটে ছুঁচোয় ডন মারিতং!”

কন্ডাক্টর সব প্যাসেঞ্জার নিয়ে ডিসেন্ট প্যালেসে ঢুকে গেল। অর্জুন আড়চোখে মধুরার দিকে দেখল। ডুঙ্গার মধুরার পাশে এসে বসেছে। সে বলল, “ভাইভাই ধাবার ব্র্যান্ড পোজিশানিং খুব স্ট্রং!”

“তুমি বাজে বোকো না তো!” মিস জোনাকি ধমক দেয়, “একে ব্র্যান্ড পোজিশানিং বলে?”

“বলেই তো,” মিস জোনাকিকে বোঝায় ডুঙ্গার, “ভাইভাই ধাবা মানে খারাপ ফুড কোয়ালিটি, ভাইভাই ধাবা মানে নোংরা পরিবেশ, ভাইভাই ধাবা মানে খারাপ ব্যবহার, ভাইভাই ধাবা মানে চুল্লুখোর স্টাফ। এই ইমেজ এক দিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভাইভাই ধাবাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে সবাই। মধুরার সাধ্য কী, এক দিনে তাকে বদলাবে?”

গীতা ডুঙ্গারের কথা শুনেছে। সে বেসিনে পানের পিক ফেলে বলল, “অনেক তো বয়স হল। এখনও ঢ্যামনামি গেল না? কোথায় সকালে উঠে ভগবানের নাম নেবে! তা না, আমাদের নিন্দে করছে!”

ডুঙ্গার গীতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মিস জোনাকি ডুঙ্গারের পিঠে হাত দিয়ে বলল, “আজেবাজে কিছু বোলো না! প্লিজ!”

ডুঙ্গার মৃদু হেসে মিস জোনাকিকে বলল, “মুখে যা এসেছে, তা বলা যাবে না।” গীতাকে বলল, “নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে, চা খান।”

অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে মিতা চা নিয়ে এসেছে। মধুরা একটা ভাঁড় তুলে নিল। চায়ে চুমুক দিল মধুরা। ডুঙ্গার মিতাকে মশলা-চা বানানোর কায়দা শিখিয়েছে। সেই চা খেয়ে মধুরার মেজাজটা একটু ইমপ্রুভ করল। দেখা যাক পরের বাস কখন আসে!

ভাবতে না ভাবতে টুরিস্টে ঠাসা দুটো বাস এসে দাঁড়াল। অর্জুনের সঙ্গে মিস জোনাকিও জয়েন করল কাস্টমারদের ডাকার জন্যে। অর্জুন ড্রাইভারকে বলল, “পার্টনার, একবার এদিকে এসে দেখো! পুরো ঝিঙ্কু ধাবা বানিয়েছি।”

ড্রাইভার একপলক অর্জুনকে দেখে বলল, “গেল বর্ষায় এখানে টায়ার পামচার হয়েছিল। তুমি আমাদের ঢুকতে পর্যন্ত দাওনি। আমি সব্বাইকে বলে দিয়েছি। তোমার এখানে কেউ আসবে না। তা ছাড়া, তুমি রাতে এখান থেকে বাংলু বিককিরি করো। এই জায়গা ফেমিলি ক্রাউডের জন্য নয়।”

ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর চলে গেল ডিসেন্ট প্যালেসে। সঙ্গে নিয়ে গেল অন্য বাসের কন্ডাক্টর আর ড্রাইভারকে। প্যাসেঞ্জাররা কথোপকথন শুনেছে। তারা এদিকে এলই না।

মধুরা ঘড়ি দেখল। সকাল মাত্র ন’টা বাজে। উদ্বোধনের পরে একঘন্টাও হয়নি। সে এত উতলা হচ্ছে কেন? শনিবার এলেই বাঙালি দিঘা যায়। আজও যাচ্ছে। আরও অনেক বাস আসবে। ঘাবড়ানোর কিস্‌সু হয়নি।

দশটা বাজল। এগারোটা। বারোটা। দুপুর থেকে দিঘাগামী বাসের সংখ্যা কমে। বাস আসার ঢল কমল। ক্যালকাটা ধাবায় একজনও কাস্টমার হল না। মধুরা দুপুরের খাওয়া সেরে একঘন্টা রেস্ট নিল। আবার ফিরে এল কাউন্টারে। বিকেল থেকে কলকাতাগামী বাসের সংখ্যা বাড়বে।

বিকেল, সন্ধে, রাত। একের পর এক বাস আসছে। এইসব বাসে যাত্রীসংখ্যা কম। ট্যুরিস্ট নেই। কেজো লোকেরা বসে রয়েছে। তারা বাথরুম সেরে, একভাঁড় চা খেয়ে বাসে উঠছে।

রাত আটটা বাজল। বারো ঘন্টায় একজনও কাস্টমার এল না। সকালের সবজি, ময়দার লেচি, মাছ, মাংস ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়েছে। মধুরা আজ পর্যন্ত বাসি জিনিস দিয়ে বানানো খাবার কারও প্লেটে তুলে দেয়নি। কাল বোধহয় সেই কাজটাই করতে হবে।

অবশ্য যদি কাল কাস্টমার হয়।

ক্যালকাটা ধাবার বাইরে, অন্ধকারে কয়েকজন ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। অর্জুন এগিয়ে গেল। বাংলু আর চুল্লু বিক্রি শুরু করছে নাকি? মধুরা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।

পিছন থেকে হিসহিস করে গীতা বলল, “আমাদের ভাত মেরো না। তুমি শখ মেটাতে এসেছ। দু’দিন বাদে চাঁটিবাটি গুটিয়ে চলে যাবে। আমাদের এখানেই থাকতে হবে।”

অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে মুরগির নাড়িভুঁড়ি দিয়ে চাট বানিয়েছে মিতা। সেটা নিয়ে গীতা গেটের কাছে যাচ্ছে। মধুরা আটকাতে গেল। গীতা মধুরাকে কনুইয়ের এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মধুরার মনে পড়ে গেল প্রথম দিনের ভাইভাই ধাবার অভিজ্ঞতা। সেদিন গোটাচারেক কাস্টমার ছিল। বাচ্চাসমেত এক দম্পতি, উমেদ আর পূর্ণিমা, ওদের ডায়ারিয়া হওয়া বাচ্চা…

উমেদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায় মধুরার। “বাবা কলকাতা-দিঘা রুটের বাসের পারমিট বার করে দিল। এখন এই রুটে আমার পাঁচটা বাস চলে। তিনটে এসি বাস। আর দুটো এমনি বাস। এইসব সামলে আর দোকান দেখার সময় পাই না।… দিনরাত ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর চরিয়ে মুখটা খারাপ হয়ে গেছে…”

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে উমেদের মোবাইল নম্বর ডায়াল করে মধুরা।

“বলো দি’,” মহিলাকন্ঠ শোনা যায়।

মধুরা আন্দাজ করল, এটা পূর্ণিমার গলা। এটাও আন্দাজ করল যে উমেদ তার নম্বর মোবাইলে সেভ করে রেখেছে।

“আমি মধুরা ভৌমিক বলছি। কোলাঘাট থেকে…” যেহেতু উমেদ ফোন ধরেনি, তাই নিজের পরিচয় দেয় মধুরা।

“আমি জানি দি’। তোমার জন্য বাচ্চাটা বেঁচে গেল। তুমি সেদিন ইলেকট্রিকের জল না খাওয়ালে কী যে হত!”

মধুরা কাজের কথায় আসে, “উমেদ কোথায়?”

“আগামীকাল ড্রাইভার কন্ডাক্টর আর তাদের ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে। সেই নিয়ে ইউনিয়নের মিটিং চলছে। মিটিং থেকে এখনও ফেরেনি। মোবাইলটা ভুলে ফেলে গেছে। গাদাগাদা ফোন আসছে। ওকে কী বলতে হবে বলো।”

মধুরা ইতস্থত করছে। এসব কথা কি পূর্ণিমাকে বলা ঠিক হবে?

পূর্ণিমা কিছু একটা আন্দাজ করেছে। বলল, “তুমি আমাকে বলতে পারো দি’। আমাকে বললে পাঁচকান হবে না।”

“পাঁচকান নিয়ে আমি বদার্ড নই। আসলে একটা ঝামেলায় পড়ে ফোনটা করলাম। আমার মনে হল উমেদ প্রবলেমটা সল্‌ভ করতে পারবে…”

“গাড়ির লাইনের কিছু? তা হলে ও করে দেবে। কিন্তু আগে পবলেমটা বলতে হবে।

মধুরার মনে হল পূর্ণিমাকে বলা যায়। একে বললে কথাটা উমেদের কানে পৌঁছবে। হয়তো বেশি অভিঘাত নিয়ে পোঁছবে।

মধুরা বলল, “যেখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সেই ধাবাটার আমি এখন মালিক। পুরো মালিক নয়, অংশীদারির ব্যাবসা। মুশকিল হল…”

মধুরার কথা শেষ হল পনেরো মিনিট পরে। পূর্ণিমা বলল, “অনেক রাত হয়েছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

মধুরা বলল, “তুমি উমেদকে খবর দেবে, না আমি পরে ফোন করব?”

খিলখিলিয়ে হেসে পূর্ণিমা বলে, “আজ আর ফোন কোরো না। ওর ফিরতে রাত হবে। কাল যখন খুশি ফোন করে নিয়ো।”

“আচ্ছা,” শুভরাত্রি জানিয়ে ফোন কাটে মধুরা।

ক্যালকাটা ধাবার সামনে এখন অনেক লোকের ভিড়। ধড়াদ্ধড় বিক্রি হচ্ছে চুল্লুর পাউচ। বিক্রি হচ্ছে গীতার এসপেশাল চাট। ক্যালকাটা ধাবা আবার ভাইভাই ধাবায় বদলে যাচ্ছে। কুমার পিয়াল মহলা শেষ করে বাড়ি ফিরছে। তার গলায় গান, “বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায়! বিনা কারণে…”

মধুরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এই জীবন তার প্রাপ্য ছিল? এই জীবন? মনসাপোতা গ্রামের পাইস হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে বসে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করার জীবন? দুই ধুরন্ধর মামা, দুই বদমাইশ মাইমা, এক আশি বছর পেরোনো হেঁপো রুগি আর এক ষাট বছর পেরোনো ভ্যাম্পের সঙ্গে রাস্তার ধারে বসে লুচি-আলুর দম বিক্রি করা?

দ্রুত চোখের জল মোছে মধুরা। মনে মনে হিসেব করে কী কী সুযোগ সে ছেড়েছে!

মেল্টিং পট সিজন ওয়ান শেষ হওয়ার পরে লিজ অফার দিয়েছিল, মেল্টিং পট সিজন টুয়ের ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে থাকতে। মধুরা রাজি হয়নি।

শুভ্র তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। মধুরা গুরুত্ব দেয়নি। শুভ্র বিয়ে করে নিয়েছে।

অশোক তাকে বারবার বলছে, বাড়িতে বিয়ের কথা পাড়তে। মধুরা এখনও রাজি হয়নি।

ডিসপিউটেড প্রপার্টিতে পান্‌চ খোলার ডিসিশান মধুরার। পান্‌চ আর নেই।

লিজ অফার দিয়েছিল ‘নমস্তের ইন্ডিয়া’তে সঞ্জয় কপুরের কো-হোস্ট হতে। মধুরা সটান ‘না’ বলে দিয়েছে।

নেহার সঙ্গে যুদ্ধে গোহারান হেরে গিয়ে কোলাঘাটে এসে ধাবা খোলার ডিসিশানও মধুরার।

কথায় আছে, একটা মাত্র সুযোগ মানুষের জীবন বদলে দেয়। মধুরার সামনে বারবার অজস্র সুযোগ এসেছে, মধুরা সুযোগ ফসকেছে। যা ফল তাই-ই হয়েছে। ভাঙা ক্যাশ কাউন্টারের সামনে বসে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও অপশন নেই।

মধুরার কান্না বিনা কারণে নয়। এ পরাজয়ের কান্না। প্যাশানের পিছনে দৌড়োতে গিয়ে ক্রমাগত জীবনের বাকি অপশনগুলোর দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে, এক সময় মানুষ বুঝতে পারে এত দৌড়ে সে কোথাও পৌঁছতে পারেনি। এখন ফেরার পথও বন্ধ। পিছনের ব্রিজ সে নিজের হাতে পুড়িয়ে দিয়েছে।

বাঁধনহারা, একবগ্‌গা দৌড়ের একটা লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যে পৌঁছলে সেই দৌড় সফল। যাত্রাপথের যাবতীয় ডিসিশান তখন ঠিক।

কিন্তু লক্ষ্যে পোঁছতে না পারলে? সফল না হলে? তখনই শুরু হয় কাটাছেঁড়া। আতসকাচ আর মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে প্রতিটি পদক্ষেপের বিচার হয়।

জার্নি ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান দ্য ডেস্টিনেশান। যাত্রাপথটাই গুরুত্বপূর্ণ। গন্তব্যে পৌঁছনোটা নয়। এইরকম একটা কথা বাজারে চালু আছে না? চোখ মুছতে মুছতে মধুরা বুঝতে পারল, কথাটা তৈরি করেছে তার মতো হেরো আর ফেকলু কোনও মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *