মধুরেণ – ১৫

১৫

“কী-ই-ই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? কাল রাতে ভাগনি বলে রেয়াত করেছিলাম। আজ কোনও ছাড়াছাড়ি নেই। পেটে কিল মারতে যে আসবে সে আমার শত্তুর। তাকে আমি ছেড়ে কথা কইব না!” চিল চিৎকার করে উঠল গীতা।

মিতা বলল, “ভাই মধু, তোমার পেটে পেটে এত শয়তানি? কাল রাতে খাবার দিতে সামান্য দেরি হয়েছে বলে তুমি সাতসকালে ধাবায় ঢুকে গুন্ডামি করবে? এর ফল ভাল হবে না ভাই! কারও কিছু হয়ে গেলে আমরা জবাবদিহি করতে পারব না। এই কথা বলে দিলুম!”

অর্জুন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। নিমের দাঁতন চিবোতে চিবোতে, বিকট জোরে বাতকম্ম করে বলল, “ফালতু কথা বলে টাইম নষ্ট করছ কেন? আমায় কড়া করে এক কাপ চা খাওয়াও। মাথাটা ধরে আছে।”

কুমার পিয়াল স্নান করে রেডি। ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে গার্গল করছে। পুচুত করে কুলকুচো করে গান ধরল, “আমি ভবে একা দাও হে দেখা, প্রাণসখা রাখো পায়ে…”

মধুরা সবাইয়ের দিকে তাকাল। টেবিলে একটা কাগজ রেখে বলল, “এটা একটা গিফ্‌ট ডিড। এতে পরিষ্কার বলা আছে যে শ্রীমতি যূথিকা ভৌমিক কোলাঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে মনসাপোতা গ্রামের পাঁচশো স্কোয়্যার ফিটের মালিক। যার মধ্যে রয়েছে একটি বসত বাড়ি, একফালি জমি এবং ভাইভাই ধাবা।”

“ওই কাগজের কপি আমাদের কাছে আছে। তোমার মাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসা হয়। আবার কী চাও?” খাণ্ডারনি গীতা মধুরার দিকে তেড়ে আসে।

মধুরা আর একটা কাগজ টেবিলে রেখে বলে, “এটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি। যাকে বাংলায় বলে মোক্তারনামা। এই কাগজ বলছে যে শ্রীমতি যূথিকা ভৌমিক তাঁর কন্যা মধুরা ভৌমিককে সজ্ঞানে ওই পাঁচশো স্কোয়্যার ফিট দান করেছেন। অর্থাৎ আমাকে। ভাইভাই রেস্তোরাঁর অর্ধেক মালিকানা এখন আমার নামে।”

“ওই কাগজের মুখে আগুন!” গীতা টেবিল থেকে কাগজ তুলে ফ্যাঁসফ্যাঁস করে ছিঁড়ে ফেলে, “নাও! এবার কী করবে করো!”

“তুমি এত বোকা কেন?” বিরক্ত মধুরা বলে, “তুমি ভাবলে কী করে যে এটা অরিজিনাল কাগজ? তা ছাড়া, অরিজিনাল কাগজ ছিঁড়লেও সেটা আবার তৈরি করা যায়।”

“তোমার মা কিন্তু এসব কথা আমাদের বলেনি।” ঝগড়ার আবহে কিছুটা হলেও যুক্তির আলো ছড়াল অর্জুন।

“মা বলেনি বলেই এই কাগজ মিথ্যে হয়ে যায় না। তুমি মা’র সঙ্গে কথা বলে নাও।” অর্জুনের দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দেয় মধুরা।

অর্জুন বলে, “যূথিকা এমনটা কেন করছে? আমরা তো ওকে টাকা দিচ্ছি!”

“সেটা আমার জানার কথা নয়। তুমি তোমার বোনের সঙ্গে কথা বলো। তবে এটা মাথায় রেখো যে আমি এখন থেকে এখানে থাকব। একটা বাড়ি বানাব। ধাবার কাজও নিজের হাতে নেব।”

“ওগো মা! কী সাহস!” কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠে মিতা। ককিয়ে ককিয়ে বলে, “আগেকার দিনে ডাকাতরা দিনক্ষণ বলে ডাকাতি করতে আসত। এ যে দেখি ফিমেল গব্বর সিংহ! এসেই দনাদ্দন গুলি চালিয়ে সব সাফ করে দিচ্ছে। এবার আমি কোথায় যাই?”

বউকে সাহস দিতে এগিয়ে এসেছে কুমার পিয়াল, “ঘাবড়ানোর কিছু নেই গিন্নি। এ তো আর শোলে বইয়ের রামগড় নয়। এটা মনসাপোতা গ্রাম। এখানে অনেক কিছু পুঁতে ফেলা যায়।”

মধুরা আড়চোখে অশোকের দিকে তাকাল। সে কুমার পিয়ালের দিকে খুনে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ডুঙ্গার আর মিস জোনাকি মাথা নিচু করে বসে।

*

কাল রাতে ডিসেন্ট প্যালেসে ডুঙ্গার, মিস জোনাকি আর অশোক মিলে কী ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ই না শুরু করেছিল! ডুঙ্গার বলেছিল, “আইন মধুর পক্ষে। কারও বাবা কিছু করতে পারবে না। তোমরা কেউ মাথা গরম করবে না। মধু ঠান্ডা মাথায় কথা বলবে। জোনাকি বোঝাবে আইনি ব্যাপার।”

“ওরা ঝামেলা করবে!” অশোক উত্তেজিত।

“স্বাভাবিক! তুমি তাদের ভাতকাপড়ে ভাগ বসাতে যাচ্ছ, আর ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে? বেঙ্গলে সব জিনিসে পঞ্চায়েতি! এলাকার গুন্ডাদের ডেকে এনে তোমাদের মারধর খাওয়াতে পারে!”

“মামদোবাজি! মারধর করলেই হল? দেশে আইন বলে কিছু নেই নাকি?” তড়পেছিল মিস জোনাকি।

ডুঙ্গার অবাক হয়ে বলেছিল, “আছে নাকি? জানি না তো!”

মধুরা বলেছিল, “তোমরা ঘুমোও। আমি শুতে চললাম।”

অশোকও বেরিয়ে এসেছিল। বলেছিল, “বাওয়াল হবেই! সেটা সামলানোর চেষ্টা করতে হবে। তোমার চেনা কে যেন একটা মেচেদায় আছে না? তাকে ফোন করবে নাকি?”

“আমার চেনা অনেকেই আছে। তুমি সৌমেনকে ফোন করো। ও যেন কাল আসে।”

“আসবে! আসবে! তুমি চাপ নিয়ো না। তোমায় খুব টেন্‌সড লাগছে। বেশি টেনশান হলে সুষুম্না কাণ্ডে জট পাকিয়ে যায়। তখন মাসাজ নিলে ঠিক হয়ে যায়।”

“মাসাজ? খারাপ বলোনি। ডিসেন্ট প্যালেসে কোনও ডিসেন্ট ম্যাশিয়োর আছে?” অশোকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল মধুরা, “রিসেপশানে ফোন করে দেখো না! লক্ষীটি!”

“এখানে ম্যাশিয়োর থাকবে না। তবে আমি ভাল মাসাজ জানি। থাই, সুইডিশ, ফিলিপিনো…”

“তুমি ফুট মাসাজ জানো? এয়ারপোর্টে করে দেয়। পাঁচশো টাকায় আধঘন্টা! জাস্ট ফ্যাব!”

“বলছি সুষুম্না কাণ্ডের কথা, আর এ বলছে পা টিপে দিতে! ধুস্‌শালা!” রুমে ঢুকে যায় অশোক।

মধুরা নিজের রুমে ঢোকার আগে বলে, “পা বেয়ে ওপরে উঠেছ কখনও?”

“না!” বন্ধ দরজার ওপার থেকে উত্তর এসেছিল।

“উঠলে দেখতে, ওপরদিকে দুটো সবুরের মেওয়া ফলে আছে!” দরজা বন্ধ করেছিল মধুরা। মোবাইল ফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে পরিচিত একটা নাম খুঁজেছিল। সুমিত ঘোষাল…

*

সকালবেলায় অশোককে দেখে মনে হচ্ছে, মারদাঙ্গা করা জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত। অশোকের প্রসঙ্গ মন থেকে তাড়িয়ে মধুরা বলল, “আমি আজ থেকেই এখানে থাকার ব্যবস্থা শুরু করব। ইটবালি সাপ্লায়ারের দোকান কোথায়?”

“সাহস তো কম নয়?” পান মুখে গুঁজে গীতা বলে, “কোথাকার কে, দুটো আমড়াভাতে দে! বেরো মাগি এখেন থেকে! আমাদের ধাবা এখন বন্ধ। আর মিতা, তুই পুকুরপাড়ে গিয়ে হাঁক পাড় তো। কেলাবের ছেলেগুলোকে ডাক! পাটি আপিসে খবর দে। আজ এই মাগির একদিন কি আমার একদিন!”

কুমার পিয়াল বলল, “আমি পার্টি অফিসে যাচ্ছি। দেবুদা একটা পার্ট চেয়েছিল। এই সুযোগে কাজের কথাও হয়ে যাবে।”

অর্জুন বলল, “পঞ্চায়েতে খবর দিলে সালিশির মিটমাট হয়ে যাবে। পরে কিন্তু ফিস্টির টাকা দিতে হবে। ওদের আজকাল বড্‌ডো খাঁই হয়েছে। আস্ত খাসি, পরোটা, রামের বোতল ছাড়া কাজ করে না।”

“ওদের গিয়ে বলো, বউদি বলেচে জোড়া পাঁঠা খাওয়াবে। শুধু তার আগে গোটা চারেক বলি দিতে হবে।”

মধুরা অশোকের দিকে তাকিয়ে দেখল। অশোকের চোখমুখ লাল। নাকের পাটা ফুলছে। রগ দপদপ করছে। অশোকের পিঠে হাত রেখে মধুরা নিচু গলায় বলল, “মাথা ঠান্ডা রাখো।” গলা তুলে বলল, “ক্লাবের ছেলে, পঞ্চায়েতের মেম্বার, পার্টির দাদা সবাইকে ডাকুন। সকলের সামনে ফয়সালা হয়ে যাক। কাল থেকে যেন আর ঝামেলা না হয়।”

মধুরার কথা শেষ হতে না হতেই বাড়ির পিছন থেকে মিতার চিৎকার শোনা গেল। “ওলো! তোরা কে কোথায় আছিস লো! একবার আমাদের এখেনে আয় লো! বাড়িতে ডাকাত পড়েছে! বাঁচাও! বাঁচাও!”

অশোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? নিজেরা বসে কথা বললেই তো প্রবলেম সল্‌ভ করা যায়। পাড়ার লোকেদের ডাকার কী দরকার?”

“ও সব তোমাদের কলকাতা শহরে হয় বাছা!” ডানগালের পান বাঁ গালে পাঠিয়ে, পিচ করে পানের পিক ফেলে গীতা। “গেরামের দিকে পাঁচজনের মাঝখানে বিচার হয়। পঞ্চাত নিদেন দেয়, কী করা হবে। উলটো করে ঝুলিয়ে রাখবে, না হাতপা বেঁধে রাস্তায় ফেলে রাখবে।”

গীতার কথার মধ্যে হইহই রব শোনা গেল। মধুরা পিছন ফিরে দেখল হাইওয়ে দিয়ে পিলপিল করে লোক এইদিকে আসছে। সেই দঙ্গলে মেয়ে-বউ, এন্ডি-গেন্ডি, বাচ্চা-বুড়ো, জোয়ান-মরদ, বুড়ো-বুড়ি সব আছে। মায় কয়েকটা কুকুর পর্যন্ত ঘেউঘেউ করতে করতে দৌড়ে আসছে।

এরা কেউ বিপজ্জনক নয়। এদের মাঝখানে ফতুয়া আর ধুতি পরা, ফরসা চেহারার এক বৃদ্ধ আসছে। মধুরা বুঝে গেল, এ হচ্ছে পালের গোদা। পঞ্চায়েত প্রধান। এই লোকটাই সবথেকে বেশি ঝামেলা পাকাবে। মোবাইলের দিকে তাকায় সে। এখন একটা ফোন আসার কথা।

মিনিটখানেকের মধ্যে ভাইভাই ধাবার সামনে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গোলের কেন্দ্রে মধুরা, অশোক, গীতা আর অর্জুন। মিতা উইংসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রয়োজনে এনট্রি নেবে। কুমার পিয়াল গন্ডগোল দেখে স্পটলাইট ফেলে হাওয়া হয়ে গেছে।

“দেখুন দেবুদা, আমাদের অবস্থা দেখুন! কথায় আছে, যম জামাই ভাগনা, এ তিন নয় আপনা। এই মেয়েটা আমার ভাগনি। যমের অরুচি। যমের থেকেও সাংঘাতিক। দুটো কাগজ দেখিয়ে বলছে, এই সম্পত্তির আধখানা ওর। এখেনে বাড়ি করবে। ধাবার কাজ সামলাবে। দেশে কি আইন বলে কিছু নেই?” গড়গড় করে নামতা পড়ে অর্জুন।

দেবুদা চেয়ারে জমিয়ে বসে মধুরাকে বলল, “তুমি কে? অর্জুন যা বলছে তা ঠিক?”

মধুরা কিছু বলার আগে ভিড়ের থেকে এক ছোকরা বলল, “অত কথার কী আছে? পুকুরধারে নিয়ে গিয়ে রগড়ে দিলেই দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে!”

“তোর খালি দুধের দিকে নজর! আমি ভাবছি কাত্তিকটার কথা। এটাকে নিয়ে কী করা যায় বল তো?” মিতা ভিড় থেকে ফুট কাটল।

“ওটাকে ন্যাংটো করে পিছনে জলবিছুটি ঘষে দাও। এক ছুটে কলকাতা চলে যাবে।”

মধুরা জানে এগুলো যুদ্ধের ট্যাকটিক্‌স। খুচরো কালিপটকা। এই সব কথায় উত্তেজিত হয়ে একবার যদি গলা তুলে চিৎকার করা হয়, অথবা কারও গায়ে হাত তোলা হয়, তা হলে এদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। কেলিয়ে বেন্দাবন তো দেখাবেই, থানাপুলিশ, পঞ্চায়েত, সালিশি মিটিং-এর নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতা শুরু হয়ে যাবে।

এখন একটাই কাজ। মাথা ঠান্ডা রাখা। দেবুদার দিকে তাকিয়ে মধুরা বলল, “নমস্কার, আমার নাম মধুরা ভৌমিক। আমার মা যূথিকা ভৌমিক। আমার দিদিমা মিনতিবালা সরকার।”

“মনসাপোতা তা হলে তোমার মামার বাড়ি। আগে কখনও দেখিনি কেন?” চিবুকে হাত বোলাচ্ছে দেবুদা।

“আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার মামা-মাইমা দিতে পারবে।” মুচকি হেসে গীতার দিকে তাকায় মধুরা। গীতা বাঁ গালের পান ডানগালে পাঠিয়ে বলল, “আমার শ্বশুর কখনও মেয়ের মুখ দেখতে চায়নি। তাই ওরা আসেনি। সেসব কথা বাদ দাও। কাজের কথাটি বলে ফেলো দেখি! আমাদের সম্পত্তি গাপ করতে এসেছ, সেই কথাটা বলো।”

মিতা সুর মিলিয়ে বলে, “বাপ রে! ভাবলেই বুক ধড়াস ধড়াস করে! এইটুকু মেয়ের পেটে পেটে এত?”

মধুরা অশোকের দিকে তাকাল। সে এই ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে, হাইওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। দু’-একটা চামচাও জুটিয়ে নিয়েছে। যারা দুধ বা জলবিছুটির কথা বলছিল, তারাই সিগারেট চেয়ে খাচ্ছে। ভিড় একটু পাতলা হয়েছে।

মধুরা বলল, “আমি যা বলছি, আপনাকে শুনতে হবে। আমি মিথ্যে বললে মামামামি শুধরে দেবে…” এই বলে সে মামামামির প্রথমবার ভৌমিক ভবনে আসা থেকে অর্ধেক সম্পত্তি কেনার কথা সবটা বলল।

সব শুনে দেবুদা বলল, “এই মেয়েটা যা বলছে, ঠিক বলছে?”

“এখনও অবধি ঠিক আছে।” বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে অর্জুন, “বাকিটা শুনে দেখুন, কী ডেঞ্জারাস মেয়ে!”

ডুঙ্গার পাশ থেকে বলল, “এক কাপ চা পাওয়া যাবে?”

“কিস্‌সু পাওয়া যাবে না!” হুংকার ছাড়ে গীতা, ‘“ভাইভাই ধাবা’ এখন বন্ধ আছে!”

“একটু খাবার জল?”

“বললাম না, ধাবা বন্ধ!”

“ওই তো, মিনারেল ওয়াটার রয়েছে!”

“থাকুক! ওটা আপনার জন্যে নয়!” চিক্কুর ছাড়ে গীতা। বড় শ্বাস নিয়ে ডুঙ্গার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। সে কুলকুলিয়ে ঘামছে।

মধুরা দেবুদার দিকে কাগজ এগিয়ে বলে, “আমার মা এই প্রপার্টি আমার নামে গিফ্‌ট ডিড করেছে। আমি প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়েই এসেছি। আমি এখন থেকে এখানে থাকব এবং ধাবার দেখভালের দায়িত্ব নেব।”

দেবুদা কাগজটা ছুঁয়েও দেখল না। মধুরাকে প্রশ্ন করল, “এরা কারা?”

“এরা মানে?”

“এই দুই বয়স্ক মানুষ আর ওই ছেলেটি। তুমি তোমার মামামামির সঙ্গে দেখা করতে এসেছ। এর মধ্যে ওদের কী ভূমিকা?”

“এরা দু’জন আমার ব্যাবসার পার্টনার। আর ওই ছেলেটি আমার ব্যাবসার বিজ্ঞাপনের দিকটা দেখে।” সচেতনভাবে অশোক সম্পর্কে কম কথা বলল মধুরা। কোথাও কোথাও নিজেকে চেপে রাখতে হয়।

“কলকাতায় তোমাদের একটা রেস্তোরাঁ ছিল। সেটার নাম ‘পান্‌চ’। সেটা উঠে গেল কেন?” মিটিমিটি হেসে প্রশ্ন করল দেবুদা। মধুরা ঢোঁক গিলল। এই প্রশ্ন সে আশা করেনি। ‘জবরখবর’ নিউজ চ্যানেলে একদিন কী দেখিয়েছে, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে এটা ভাবেইনি। কিন্তু এই বুড়ো তো আসল জায়গায় ঘা দিয়েছে! একে কীভাবে ম্যানেজ করা যায়?

দেবুর প্রশ্ন শুনে গীতা অবাক। সে বলল, “এদের কলকেতায় একটা খাবারের দোকান আছে, আবার এখানে এসে থাবা বসাচ্ছে? কেন বলো তো দেবুদা?”

“সে অনেক কথা! তোমাদের না জানলেও চলবে! এটুকু জেনে রাখো যে এই মেয়েটা যে আইনি কাগজ নিয়ে এসেছে, সেটার ভিত্তিতে ও নিজের জায়গায় বাড়ি বানাতে পারে। এই ধাবার কাজে নাক গলাতে পারে!”

“পারে?” অবাক হয়ে বলে অর্জুন আর গীতা। মিতা কপাল চাপড়ে বলে, “আমাদের তা হলে কী হবে?”

দেবুদা অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা ঘাবড়িও না। আমি দেখছি, কীভাবে মিউচুয়াল করা যায়!” তারপর মধুরার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “কলকাতায় রেন্ডিখানা চালিয়ে সুবিধে করতে পারোনি বলে এইখানে এসেছ?”

ডুঙ্গার ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “একটু জল…”

গীতা বলল, “তোমাদের এখেন থেকে বের না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। জল তো দূরের কথা, পারলে হাওয়াও বন্ধ করে দিই।”

মধুরা দেবুদাকে দেখছে। মিউচুয়াল করার নামে এই লোকটা তার থেকে পয়সা খাবে। মামা-মাইমার থেকেও পয়সা খাবে। এবং পরবর্তীকালে এখানে এসে ‘পান্‌চ’-এর জুজু দেখিয়ে নিয়মিত ব্ল্যাকমেল করবে। এর চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে সেটা হবে মধুরার জীবনের সেরা ভুল।

মধুরা বলল, “আপনি আমার সামনে আজেবাজে শব্দ ব্যবহার করছেন? মহিলাদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারেন না?” মধুরা জানে যে গলা তুলে কথা বলা অত্যন্ত ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু এখন উপায় নেই। পান্‌চ থেকে আলোচনা সরাতে গেলে এ ছাড়া রাস্তা নেই।

দেবুদা মধুরার শাসানিতে ভয় পেল না। গীতাকে চেঁচিয়ে বলল, “তোর ভাগনির কিত্তি জানিস?” মধুরাকে নিচু গলায় বলল, “বাড়াবাড়ি কোরো না। মার খেয়ে মরে যাবে। তোমাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। রূপনারায়ণের ইলিশের টেস্ট ভাল কেন জানো? ওরা নিয়মিত মানুষের মাংস খায়। তোমার ওই মোটা স্যাঙাতকে পেলে ওরা খুব খুশি হবে।”

ডুঙ্গার কথাটা শুনতে পেয়েছে কি না কে জানে। সে হঠাৎ চেয়ার থেকে পড়ে গেল।

অত বড় চেহারার একজন মানুষকে পড়ে যেতে দেখে সবাই দৌড়ে এল। মধুরা আর দেবুদার আলোচনা ধামাচাপা পড়ে গেছে। মধুরা দৌড়ে গিয়ে দেখল, ডুঙ্গার কুলকুল করে ঘামছে, বুকের বাঁ দিকে হাত, চোখমুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে, ঠোঁটের কোনা দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে, চোখ বন্ধ। পাল্‌সে হাত দেয় মধুরা। খুব উইক। মিস জোনাকির দিকে তাকিয়ে বলে, “কী হল বলো তো?”

“ন্যাকামো হচ্ছে?” চিৎকার করে উঠে মধুরাকে থাপ্পড় কষায় মিস জোনাকি। “আশি বছরের বুড়ো মানুষকে নিয়ে ধাষ্টামো হচ্ছে? আমি আগেই বলেছিলাম যে এখানে আসব না। লোকটার হার্টের ব্যামো আছে। দিনরাত ওষুধ আর অক্সিজেনের ওপরে থাকে। তাকে এই যমের দক্ষিণ দুয়ারে না আনলে হচ্ছিল না? তখন থেকে লোকটা জল চাইছে। কেউ একফোঁটা জল দিল না। উলটে বলল, ‘পারলে হাওয়া বন্ধ করে দেব’। সেই কথাটাই বোধহয় সত্যি হল। লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস বোধহয় চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।”

“আমি… আমি… কী করলাম?” গালে হাত বোলায় মধুরা। অন্য হাত ডুঙ্গারের নাকের সামনে রাখে। শ্বাস চলছে। ক্ষীণ!

“তুমি আর তোমার বাড়ির লোকের কোঁদলে আমাদের জড়িয়ো না। এই লোকটাকে ইমিডিয়েটলি কোনও হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে চলো। যদি প্রাণে বাঁচে, তা হলে কিছু বলব না। কিন্তু যদি কিছু হয়ে যায়…” দাঁতে দাঁত চিপে দেবুদার দিকে তাকায় মিস জোনাকি। তাকায় খিল্লি ওড়ানো পাবলিকের দিকে। মিস জোনাকির আগুন ঝলসানো চোখের দিকে তাকিয়ে কয়েকজন পিছু হটেছে।

গীতার দিকে তাকিয়ে, মিতার দিকে তাকিয়ে, অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মিস জোনাকি বলে, “আমি প্র্যাকটিসিং ল ইয়ার। যদি এই লোকটার কিছু হয়ে যায়, তা হলে আমি ভাইভাই ধাবার এগেনস্টে মামলা করব, আপনাদের সবার এগেনস্টে মামলা করব। খুনের মামলা!”

মেয়েবউরা পিছু হটছে! সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এন্ডিগেন্ডিদের। জোয়ানমরদ আর বুড়োবুড়িরা এখনও দাঁড়িয়ে। প্রথম দল দেখতে চাইছে এই মহিলার কলজের জোর কত। দ্বিতীয় দলের কোথাও যাওয়ার নেই।

অশোক দৌড়ে এসেছে। সঙ্গে ছেলেছোকরাদের দল। তারা ডুঙ্গারকে চ্যাংদোলা করে তুলছে। এক ছোকরা বলল, “কাছাকাছির মধ্যে একটা হেল্‌থ সেন্টার আছে। আর রিভারভিউ নার্সিং হোম আছে। কোথায় নিয়ে যাব?”

অশোক এসইউভির ড্রাইভারের সিটে বসে বলছে, “নার্সিং হোম! কুইক!”

মধুরার এসইউভি ইউ টার্ন করে বেরিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ঢুকছে পুলিশের জিপ। জিপ থেকে নামছে কোলাঘাট থানার অফিসার ইন চার্জ। দেবুদাকে বলছে, “আপনি এখানে?”

দেবুদা কোনও কথা না বলে চেয়ার থেকে উঠছে।

মিস জোনাকি বলছে, “আপনি উঠবেন না! আপনি মনসাপোতা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। আপনি সালিশি করতে এসেছিলেন, সালিশি করে ফেরত যাবেন।”

বড়বাবু বলছে, “কীসের সালিশি?”

মিস জোনাকি বলছে, “সেটা ওর মামা-মাইমা জানে। যারা বুড়ো মানুষটাকে মরার আগে এক ফোঁটা জল দেয়নি।”

দেবুদা বলছে, “আমাকে এ সবের মধ্যে জড়িয়ো না। অর্জুন ডেকেছিল বলে এসেছিলাম। এখন তো দেখছি মেয়েটির সব কাগজ ঠিকঠাক আছে।”

অর্জুন, গীতা আর মিতা চমকে উঠল।

মধুরা বলল, “আইনি কাগজ ঠিক থাকবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি বুঝতে চাইছি, আপনি আমার কলকাতার রেস্তোরাঁর পুলিশি রেড নিয়ে এত চিন্তিত কেন? আপনি কেন আমাকে বললেন যে, ‘বাড়াবাড়ি করলে মার খেয়ে মরে যাবে’? কেন বললেন, ‘তোমাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না’?”

“আমি ঠিক ওভাবে বলিনি…” হনহন করে হাঁটছে দেবু। মধুরার উদ্দেশ্য সফল। এই গন্ডগোলের মধ্যে সে পান্‌চে পুলিশ রেডের প্রসঙ্গ তুলেছে। এবং এই বিষয়ে দেবুদা আর মুখ খোলেনি। ভবিষ্যতেও এই নিয়ে কথা বলার মুখ রইল না।

তা-ও কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে মধুরা চ্যাঁচাল, “ও দেবুদা, কলকাতায় আমার রেস্তোরাঁ পান্‌চে পুলিশের রেড কেন হয়েছিল, সেটা আমার মামামাইমাদের বলে যান। আপনি না বললে আমি বলব। কিন্তু ভাইভাই ধাবা থেকে মিউচুয়াল করার নামে টাকা নেওয়া বন্ধ করুন।”

দেবুদা দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল। পিছন থেকে দেখে মনে হল, তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালিয়ে গেল। যখন এসেছিল, সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসেছিল। যখন গেল, তখন একা।

দেবুদার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মিতা প্রশ্ন করে, “দেবুদা তোমার কাছেও টাকা চেয়েছিল?”

“হ্যাঁ।” মিতার হাত ধরে মধুরা, “আমি শিয়োর যে তোমাদের কাছ থেকেও চেয়েছিল।”

অর্জুন হ্যাক করে মেঝেতে থুতু ফেলে বলল, “সব শালা চোর!”

মধুরা বলল, “এখানে লোকে খেতে আসে। এখানে থুতু ফেলো না। আর, থানার বড়বাবুকে একগ্লাস জল না খাওয়ালে এই ধাবার বদনাম হবে।”

অর্জুন ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বার করছে। গীতা বলল, “তোমার সাহস তো কম নয়। বাইরের একটা মেয়েছেলে বলল আর তুমি জলের বোতল বার করছ?” তারপর মধুরার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, “অনেক নাটক হয়েছে। এবার এখেন থেকে ফোট। পঞ্চাত চোর হতে পারে, পুলিশ টাকা খেতে পারে, কিন্তু যতদিন গীতারানি সরকার বেঁচে আছে, ততদিন এখেনে তুই ঢুকতে পাবি না। এই ধাবা আমার।”

মধুরা বড়বাবুর দিকে তাকাল। গতকাল রাতে মধুরা সুমিতকে ফোন করে সব বলেছিল। সুমিত বলেছিল, “কোলাঘাট থানার বড়বাবু আমার বন্ধু। আমি ওকে আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। ও আপনাকে ফোন করে নেবে।”

একটু পরেই বড়বাবুর ফোন এসেছিল। সে বলেছিল, “আমি নিজের থেকে নাক গলাব না। তবে কোনও গন্ডগোল হলে যেতে হবে। কাগজপত্র যদি আপনার পক্ষে থাকে, তা হলে কারও বাবার ক্ষমতা নেই যে কিছু করবে।”

মধুরা বলেছিল, “আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেব। এমন কিছু করব না যে আপনাকে ডাকতে হবে। তাও… ইন কেস… বলা তো যায় না! নতুন জায়গা! আমি ফোন করলে একবার মুখ দেখিয়ে যাবেন।”

“উইথ প্লেজার!” ফোন কেটেছিল বড়বাবু। আজ ঠিক সময়ে চলেও এসেছে। কিন্তু ওর সাহায্য লাগল না। মধুরা নিজেই প্রথম হার্ডল পেরোচ্ছে। আর একটাই কাজ বাকি। গীতাকে বাগে আনা।

মধুরা ফ্রিজের দরজা খুলে জলের বোতল বার করল। বড়বাবুর হাতে বোতল ধরিয়ে বলল, “এই নিন, জল। দাঁড়ান, আপনার জন্যে একটু মিষ্টির ব্যবস্থা করি।”

আবার তেড়ে এল গীতা। মধুরার বাঁ-হাত চেপে ধরে বলল, “এত বড় সাহস যে আমার জিনিসে হাত দিচ্ছিস। আজ তোর একদিন কি আমার এক দিন!”

মধুরা এই সময়টার জন্যে অপেক্ষা করছিল। যে, কখন তার গায়ে, কেউ হাত দেবে। সেই সময় এসেই গেল। মধুরা ডানহাত তুলল। বাংলায় যাকে বলে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়, তাকে তিন দিয়ে গুন করে দুশো ছেচল্লিশ সিক্কার এক চড় পেশ করল গীতার গালে।

গীতার গাল নিমেষে লাল! পাঁচ আঙুলের দাগড়া দাগড়া দাগ ফুটে উঠেছে। গীতা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে মধুরার দিকে তাকিয়ে। যন্ত্রণার অভিঘাতে তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

হাত জ্বালা করছে মধুরারও। এত জোরে চড় সে আজ পর্যন্ত কাউকে মারেনি। কিন্তু এটার দরকার ছিল। গীতা, মিতা আর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে সে কেটে কেটে বলল, “বাঙালি মেনুর গোড়ায় শুক্তো থাকে। এই থাপ্পড়টা শুক্তো ছিল। এরপরে পোলাও, কালিয়া, রসগোল্লা, পান্তুয়া আসবে। কিন্তু তার জন্য ধৈর্য এবং মেহনত লাগবে। এই ধাবাকে ফাংশানিং করতে হবে। নিজেদের মধ্যে গজল্লা, মদ টেনে পড়ে থাকা, যাত্রাপালার রিহার্সাল এইসব ধাষ্টামো বন্ধ করতে হবে। আমি এই ধাবা রেনোভেট করব। আমি ইনভেস্ট করব। আমি টিম তৈরি করব। সেই টিমের আমি হেড। আমার কথা না শুনলে কপালে দুঃখ আছে। ক্লিয়ার?”

কেউ কোনও কথা বলছে না। বড়বাবু নিজের জিপের দিকে এগোচ্ছে। মধুরা বলল, “আমি এখন নার্সিং হোমে যাচ্ছি। ফিরে এসে খাব। কে রান্না করবে?”

কেউ কোনও কথা বলছে না। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ধাবার রান্নাঘর বেরিয়ে এল থুত্থুরে এক বুড়ি। মধুরার দিদিমা মিনতিবালা।

খুনখুনে গলায় সে বলল, “গলার আওয়াজ শুনেই বুঝেছি, এ হল যূথিকার মেয়ে। আমার নাতনি। তোর কোনও চিন্তা নেই। যতদিন আমি বেঁচে আছি, এখানে তোর ডালভাতের অভাব হবে না।”

মধুরা এগিয়ে গিয়ে মিনতিবালার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *