মধুরেণ – ১৪

১৪

সৌমেন, মিস জোনাকি, যূথিকা আর মধুরা সকালবেলা বেরিয়েছিল গিফ্‌ট ডিড তৈরি করার জন্যে। কোর্টের কাজ চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা।

কৃশানু এখনও বাড়ি ফেরেনি। দিয়া বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত। মধুরা বলল, “আমি আসছি।”

পান্তুয়ার ন্যাপি বদলে দিয়া মুচকি হেসে বলল, “তুই আবার চাকরি খুঁজছিস? আমি একটা চাকরির সন্ধান দিতে পারি।”

অনেক দিন বাদে দিয়া ঠিকঠাক, সেনসিব্‌ল কথা বলছে। মধুরা বলল, “কী চাকরি? টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশান্‌স কী?”

“মেয়েদের জন্যে বাড়িতে বসে চাকরি।”

“ধুস! ওইসব টেলিকলার মার্কা কাজ আমি করতে পারব না।”

“কাউকে ফোন করতে হবে না। তবে দিনে চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি। সপ্তাহে সাতদিন। মাসে তিরিশদিন। কোনও ছুটিছাটা নেই।” রসগোল্লাকে ঘুম পাড়াচ্ছে দিয়া।

“ভ্যাট! তুমি আমার সঙ্গে ইয়ারকি মারছ।”

“ইয়ারকি মারব কেন? কত মেয়ে এই চাকরি করে তার হিসেব নেই।”

“ইল্লি আর কী! তুমি আমাকে ঢপ দিচ্ছ। মাইনে কত দেবে?”

“মাইনে দেবে না।” পান্তুয়াকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে দিয়া।

“তোমার মাথাফাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?” দিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মধুরা।

দিয়া পিছন থেকে বলল, “এটা মা হওয়ার চাকরি!”

মধুরা দাঁড়িয়ে গেল। সারা জীবন বাবা মায়ের ওপরে কী পরিমাণ অত্যাচার চালিয়েছে, সেটা ভেবে চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে। জল মুছে, মনোহর আর যূথিকাকে প্রণাম করে সে।

যূথিকা আশীর্বাদ করে বলল, “জলে না পড়লে সাঁতার শেখা যায় না। এটা তোর দরকার ছিল।”

ডুঙ্গার রেডি হয়ে বসে রয়েছে। সে গাড়িতে উঠল। মিস জোনাকি আর অশোক গাড়ি থেকে নামেনি। ভৌমিক ভবন থেকে গাড়ি ছাড়ল সন্ধে ছ’টার সময়। সাড়ে সাতটার সময় বাগনান। আকাশের অবস্থা দেখে অশোক বলল, “বৃষ্টি নামবে। ওয়েদার খুব বাজে।”

এসইউভি যখন কোলাঘাট ব্রিজের ওপরে, চারিদিক অন্ধকার করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ভিজিবিলিটি শূন্য। অশোক বলল, “নেহাত ওয়ান ওয়ে রাস্তা, তাই চালিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।”

মধুরা জানলা দিয়ে রূপনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটু আগেও আকাশ আর জলের সীমা বোঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ অসময়ের বৃষ্টি এসে সব একাকার করে দিল।

অশোক বলল, “কোলাঘাটের ব্রিজ পেরিয়ে এলাম। সামনেই মেচেদা। তোমার মামাদের ধাবাটা কোথায়?”

“জানি না…” গাড়ির জানলায় নাক ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মধুরা, “রাস্তার বাঁ দিকে, এইটুকু জানি।”

“এখানে রাস্তার দু’দিকেই অনেক খাবারের দোকান। বৃষ্টির মধ্যে কীভাবে খুঁজবে? একবার পেরিয়ে গেলে খুব ঝামেলায় পড়ব। ব্যাক গিয়ারে যাওয়া যাবে না। সামনে কোথায় ইউ টার্ন আছে, জানি না।”

শনশন করে ওয়াইপার চলছে। জানলার কাচের বাইরে ময়েশ্চার জমেছে। জলীয় বাষ্প হাত দিয়ে মুছে, কাচ পরিষ্কার করে মধুরা চেঁচিয়ে ওঠে, “ওই তো! ভাইভাই ধাবার সাইনবোর্ড!”

অশোক সন্তর্পণে বাঁদিকে গাড়ি ঘোরায়।

এই বৃষ্টির মধ্যেও এখানে দুটো স্টেট বাস দাঁড়িয়ে। তাদের পাশে গাড়ি পার্ক করে অশোক বলল, “রাতে থাকার কী করবে?”

মিস জোনাকি জানলার কাচ সামান্য নামিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। বলল, “সামনে ‘ডিসেন্ট প্যালেস’ নামে একটা হোটেল দেখতে পাচ্ছি।”

ডুঙ্গার বলল, “হোটেলের নাম ইনডিসেন্ট হলেও দেখতে শুনতে খারাপ না। ওখানেই তাঁবু গাড়া যাক।”

মধুরা বলল, “অশোক, বৃষ্টি কমে গেছে। তুমি আমাদের নামিয়ে, ডিসেন্ট প্যালেসে গিয়ে একটা ডাব্‌ল আর দুটো সিঙ্গল রুম বুক করো। আমরা ততক্ষণ ভাইভাই হোটেলে বসছি।”

ডুঙ্গার অবাক হয়ে বলল, “তোরা ডাব্‌ল রুমে থাকবি? কী সাহস!”

“ন্যাকামি কোরো না!” ডুঙ্গারকে চিমটি কাটে মধুরা, “ওটা তোমাদের জন্য। আমার একা শোওয়ার অভ্যেস। পাশে কেউ শুলে ঘুম আসে না।”

অশোক গাড়ি নিয়ে ডিসেন্ট প্যালেসের দিকে চলে গেল। মিস জোনাকি ছাতা হাতে নেমে পড়েছে। মধুরা ডুঙ্গারকে হাত ধরে নামিয়েছে। তিনজনে মিলে এগোল ভাইভাই ধাবার দিকে। মধুরা শুনল, ডুঙ্গার বিড়বিড় করছে, “লোকেশান, লোকেশান…”

কারণটা মধুরা খুব ভাল করে জানে। যে ধাবার সামনে বৃষ্টির মধ্যে দু-দুটো বাস দাঁড়িয়ে, তার আবার কাস্টমারের অভাব?

রাস্তার ধারে জল জমেছে। তার ওপরে ইট পাতা। ডুঙ্গার ইটে দাঁড়াতে পারবে না। গোড়ালি ডোবানো জলে থপথপিয়ে হেঁটে সে শুকনো জায়গায় দাঁড়াল। বলল, “এত কাস্টমার! কিন্তু একজনও তোর মামাদের হোটেলে ঢোকেনি। কী ব্যাপার বল তো?”

“দ্যাখা যাক!” ধাবায় ঢুকল মধুরা।

নামেই ধাবা। আসলে এটা একটা পাইস হোটেল। লম্বায় আন্দাজ চল্লিশ ফুট। চওড়াতে পঁচিশের আশেপাশে। শান বাঁধানো মেঝেতে এন্তার চিড় ধরেছে। ইটের দেওয়ালে জমেছে শ্যাওলা। অ্যাসবেস্টসের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার পটর পটর আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ শুনলে মনে হয়, মাইক্রোআভেনে পপকর্ন ফুটছে।

ধাবায় সাতটা টেবিল পাতা রয়েছে। টেবিলপিছু চারটে করে চেয়ার। এই জায়গাটা আঠাশজন বসার পক্ষে ঠাসাঠাসি। তবে এখন এক মাঝবয়সি দম্পতি আর তাদের বছর দশেকের মেয়ে ছাড়া অন্য কোনও কাস্টমার নেই।

এত বড় জায়গায় আলো দিচ্ছে একশো ওয়াটের দুটো বাল্‌ব। গায়ে ধুলো আর ঝুল লেগে রয়েছে বলে বাল্‌বদুটো আলো ছড়াচ্ছে কম, অন্ধকার বেশি। বাদলা পোকার দল ভনভন আওয়াজ করে বাল্‌বের চারদিকে উড়ছে।

মধুরা, ডুঙ্গার আর মিস জোনাকি আলোর উৎস থেকে সবচেয়ে দূরের টেবিলের দখল নিল। নিজেদের পরিচয় না দিয়ে দেখা যাক, হোটেল কেমন চলছে। মিতা আর গীতা মধুরাকে ভৌমিক ভবনে দু’বার দেখেছে। চিনতে পারার কথা। অবশ্য এই অন্ধকারে কেউ আয়নায় নিজেকে দেখলেও চিনতে পারবে না। ধুলো আর ঝুল জমে দেওয়ালের রং কালো। যার ফলে রেস্তোরাঁয় আলো আরও কমে গেছে। এই রকম ডিপ্রেসিং হোটেলে কেউ খাওয়াদাওয়া করে?

অশোক ডিসেন্ট প্যালেসে রুম বুক করে চলে এসেছে। চেয়ারে বসে বলল, “একদম ফাঁকা হোটেল। ইজিলি ঘর পাওয়া গেল। রুম রেন্টও রিজনেব্‌ল। কিন্তু খাবার খুব কস্টলি। এক প্লেট রুটি-তড়কার দাম দেড়শো টাকা। লোকে তাই-ই খাচ্ছে!”

“কেন?” জানতে চায় ডুঙ্গার।

“কারণ আর কোনও অপশন নেই। দুটো বাসের সব যাত্রী ওইখানে খাচ্ছে। আমাদের মতো চারপিস দুর্ভাগা ছাড়া এখানে কেউ আসেনি!” টেবিলে গাড়ির চাবি রেখে অশোক মিস জোনাকিকে বলল, “খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে?”

মিস জোনাকি বলল, “তোমার আসার জন্যে ওয়েট করছিলাম। কী খাবে বলো।”

মিস জোনাকির বলার ধরনে অশোক হেসে ফেলল। “তুমি এমন করে বললে, যেন যা চাইব, তাই-ই পাব! তুমি বরং কোনও একজন স্টাফকে ডাকো।”

মিস জোনাকি সুরেলা গলায় বলল, “কে আছেন?”

ধাবার কাস্টমার দম্পতির কত্তা মুখ খুলল। “ওইভাবে ডাকলে কেউ আসবে না। ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে হবে। এটা ধাবা নয়, ধাপা।”

মধুরা ভুরু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকাল। সে মনে মনে ভাইভাই ধাবা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ধাবার নিন্দে তার গায়ে লেগেছে। কিন্তু কাস্টমার ইজ কিং। কাস্টমার যখন বলেছে, এখানকার সার্ভিস খারাপ, তখন সত্যিই খারাপ। কতটা খারাপ জানতে মধুরা চেয়ার থেকে ওঠে। সে এতক্ষণ ভাবছিল তাকে কেউ চিনে ফেলবে। এখন মনে হচ্ছে, চেনার মতো কোনও লোকই নেই! মধুরা এদিক ওদিক দেখল।

ধাবার একদম কোণের টেবিলে বসে রয়েছে অর্জুন। অন্ধকারের মধ্যে চোখে পড়ছে না। কালো, বেঁটে, মোটা লোকটা রামের বোতল আর গেলাস নিয়ে একা বসে মদ খাচ্ছে। অর্জুনকে এড়িয়ে বাঁদিকের ঘরে উঁকি মারে মধুরা। সেখান থেকে নানান আওয়াজ আসছে।

এটা ভাঁড়ার ঘর। দৃশ্য দেখে তার মাথা গরম হয়ে যায়। টুলে বসে, সারস পাখির মতো ঘাড় উঁচু করে মুন্ডুটা টিভির পরদায় ঠেকিয়ে ‘শাশুড়ির কিস্তিমাত বউমা কুপোকাত’ নামের গেম শো দেখছে মিতা। যূথিকা এবং সবিতাও খুব মন দিয়ে ‘শাকিবকু’ নামের এই সাবানপালা দেখে।

ঘরের অন্যদিকে দামি মোবাইল কানে গুঁজে গীতা বাজখাঁই গলায় বলছে, “মাল কেনা হয়েচে পোঁয়োরো দিন আগে। এর মধ্যে ট্যাকা চাইচিস? তোর জিব কুচিকুচি করে কেটে যদি কাস্টমারদের না খাওয়াই, আমার নাম কোলাঘাটের গীতা লয়!”

হঠাৎ বছর আটেকের একটা হোঁতকা মেয়ে দৌড়ে এসে মিতাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি গলায় বলল, “জানো তো মামমাম, কথিকার মা না, ওকে না, একটা ললিপপ কিনে দিয়েছে। অনেকটা লম্বা আর অনেকটা মিষ্টি! কথিকা আর প্রিয়ঙ্কা ভাগ করে খেল। আমায় ডাকল না। কথিকা খুব বাজে মেয়ে। না মা?”

মিতা অন্যমনস্ক ভাবে আঁচলের খুঁট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে মেয়ের হাতে ধরিয়ে বলল, “কাল তুই আর কানুপ্রিয়া মিলে ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে দুটো ললিপপ খাবি। এখন যা!”

রান্নাঘর কোথায় রে বাবা? মধুরা অর্জুনের সামনে গিয়ে বলল, “আমরা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। খাবারের অর্ডার কে নেবে?”

“আমি কাস্টমার। আমাকে বলে লাভ নেই। এই ধাবায় কেন এসেছেন? বাজে, ফালতু ধাবা!” জড়ানো গলায় বলে অর্জুন।

মধুরা বেজায় অবাক হয়ে বলল, “আপনি কাস্টমার? তা হলে মালিক কে?”

“মালিক যাত্রা করতে গেছে।”

“আর কেউ নেই?”

“জানি না বাবা! শান্তিতে মালটাও খেতে দেবে না!” জড়ানো গলায় হাঁক পাড়ে অর্জুন, “মা, ওমা, খাবার হল?”

মা? মানে মধুরার দিদিমা? মানে মিনতিবালা? সে এখানেই আছে নাকি? মধুরার কৌতূহল বাড়ছে। সে বলল, “রান্নাঘরটা কোথায়?”

“ডানদিকে দেখে নিন। আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমি কাস্টমার।”

মধুরা নরম গলায় বলল, “এখানে মদ পাওয়া যায়?”

“পাওয়া যায়। তবে শুধু ব্যাটাছেলেরা কিনতে পারে।”

মধুরা রান্নাঘরে ঢুকল। দেখল এক বৃদ্ধা মহিলা উনুনে রান্না চাপিয়েছে। গন্ধে মালুম, তড়কা রান্না হচ্ছে। পাশের থালায় রুটি সাজানো। স্যালাডও কাটা রয়েছে। বুড়ি বিরক্ত হয়ে বলছে, “ওরে বুলটি, খাবারটা দিয়ে আয় মা! ওরা অনেকক্ষণ বসে রয়েছে যে!”

মিতার হোঁতকা মেয়ে বুলটি ঠাকুমার পাশে বসে ছোটা ভীমের কমিক্‌স পড়ছে। সে বলল, “জানো ঠাম্মা, কানুপ্রিয়া না, কাল আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে চকলেট খেল। আমায় দিল না। কানুপ্রিয়া খুব খারাপ, না ঠাম্মা?”

মিনতিবালা বুলটির কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “ও গীতা, তুমি একবার এসো না।”

এবারও কোনও সাড়া নেই। মধুরা চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে, চেয়ারে বসে থাকা ক্ষুধার্ত পরিবারের কর্তাকে বলল, “যে লোকটা কোণে বসে মদ খাচ্ছে, ও এই ধাবার মালিক। দুটো থাপ্পড় কষান গিয়ে।”

লোকটা এই কথায় উত্তেজিত হয়ে অর্জুনের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। বলল, “আমরা একঘন্টা আগে খাবারের অর্ডার দিয়েছি। খাবার কই?”

“আমি কাস্টমার মহাই! আমিই খাবার পাইনি। আপনি ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলুন।” সোজা রান্নাঘর দেখিয়ে দেয় অর্জুন।

এইসময়ে ধাবায় ঢুকল চেনা মুখ। লম্বা, রোগা, ফরসা কুমার পিয়াল একমাথা চুল দুলিয়ে গান গাইছে, “বঁধুয়া কোথায় তুমি, এদেশ যে রণভূমি, প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ। বঁধুয়া কোথায় গেলে, আমাকে ভাগাড়ে ফেলে, প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ।”

ডুঙ্গারের গানটি খুব পছন্দ হয়েছে। সে বলল, “প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ…”

মিস জোনাকি বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি থামবে?”

অশোক বলল, “এবার এরা ক্যালানি খাবে।”

এই গন্ডগোলের মধ্যে গীতা খাবারের প্লেট দম্পতির টেবিলে রেখে বলল, “একটু দেরি হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না। খুব বৃষ্টি পড়ছে তো!”

খাবার পেয়ে এরা বেজায় খুশি। কথা বাড়াল না। অশোক বলল, “আমাদের অর্ডার কে নেবে?”

অর্জুন বলল, “ধাবা বন্ধ হয়ে গেছে।”

অশোক বলল, “আপনি কাস্টমার। আপনি যতক্ষণ থাকবেন, আমরাও ততক্ষণ থাকব।” অশোকের কথার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যে গীতা তড়িঘড়ি টেবিলে এসে বলল, “আপনারা কী নেবেন?”

মধুরার মাথা নিচু। হতে পারে ধাবায় অন্ধকারের চাষ হচ্ছে, কিন্তু সে রিস্ক নিতে চাইছে না। সে আর একটু দেখে নিতে চাইছে। একটা ধাবা কত খারাপ হতে পারে, তার প্যারামিটার বুঝে নিতে চাইছে।

ডুঙ্গার বলল, “তাড়াতাড়ি কী দিতে পারবেন?”

“রুটি, ডিম তড়কা আর স্যালাড।” নোংরা ন্যাতা দিয়ে টেবিল মুছছে গীতা।

“চার প্লেট পাঠিয়ে দিন।” হুকুম করে অশোক।

“হুকুম কোরো না।” ঝাঁঝিয়ে ওঠে গীতা, “সময় লাগবে। বসতে পারলে বোসো। না পারলে অন্য হোটেল দেখো।”

অশোক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হোটেলের সামনে একটা হ্যাচব্যাক গাড়ি প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল। গাড়ি থেকে নামল বছর পঁচিশের একটা ছেলে। তার কোলে বাচ্চা। ছেলেটা বলল, “মিনারেল ওয়াটার মিলেগা?”

“না।” কোণ থেকে বলে অর্জুন।

ছেলেটা ফ্রিজ দেখিয়ে বলে, “এই তো রয়েছে। দিন না এক বোতল।”

“হবে না। ধাবা বন্ধ!” আবার বলে অর্জুন।

মধুরা ছেলেটাকে দেখছিল। উদভ্রান্ত চেহারা। কোলের বাচ্চার বয়স মেরেকেটে এক বছর। গাড়ি থেকে ছেলেটার বউও নেমে এসেছে। ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগে মধুরার। কোথায় যেন দেখেছে একে! ঠিক প্লেস করতে পারছে না!

ছেলেটাই আগে মধুরাকে চিনল। বলল, “হাই দি! হমাকে চিনতে পারছ? হামি উমেদ!”

উমেদ? মধুরা এখনও চিনতে পারেনি। দিদিকে ‘দি’ বলার কায়দাটাও তার হজম হয়নি।

উমেদ বলল, “কলেজ মোড়! জাঙ্ক ফুড! সুলতানদা!”

ও হরি! এ হল উমেদ সিংহ। কলেজ মোড়ের ফুটপাথের মন্টুর ঝুপ্‌স কিনে নিয়ে সেখানে ‘জাঙ্ক ফুড’ নামের ফাস্ট ফুডের দোকান খুলেছে। এর বাবার নাম নিম্বারাম সিংহ। নিম্বারামের ওষুধের দোকান আছে।

“তুমি তো উমেদ সিং!” একগাল হাসে মধুরা। “ও কি তোমার বউ?”

“আমার নাম পূর্ণিমা,” পরিষ্কার বাংলায় বলে মেয়েটি। চুলে সোনালি স্ট্রিক করা। ঘাড়ে শিব ঠাকুরের ট্যাটু। “আমরা দিঘা বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাচ্চা বুকের দুধ ছাড়া কিছু খায়নি। ফেরার পথে সারা রাস্তা পিচকিরির মতো পায়খানা করছে। এখন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে।”

মিস জোনাকি নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে জলের বোতল আর একটা প্যাকেট বার করল।

পূর্ণিমা বলল, “ওটা কী?”

“নুন-চিনি-লেবু মেশানো পাউডার। বোতলের জলে পাউডার গুলে বাচ্চাকে বারেবারে খাওয়াও। ঠিক হয়ে যাবে।”

পূর্ণিমা খুব একটা কনভিন্সড নয়। উমেদ কড়া গলায় বলল, “জো বোল রহা হ্যায় সুন লে! এত রাতে দাওয়াই কাঁহা মিলেগা?”

পূর্ণিমা ব্যাজার মুখে বোতলে পাউডার মেশাতে লাগল।

কাস্টমার দম্পতির খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট। কর্তাটি টাকা মেটাচ্ছে। খাবারের দাম নিয়ে গীতার সঙ্গে মৃদু ঝামেলাও হচ্ছে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে মধুরা আর উমেদ ধারের দিকের একটা টেবিল দখল করল। এখানে বসে নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে। মধুরা উমেদকে বলল, “জাঙ্ক ফুড কেমন চলছে?”

“সেল করে দিয়েছি দি’।” একগাল হেসে বলে উমেদ।

“কেন?” মধুরা অবাক!

“পাপা কলকাতা-দিঘা রুটের বাসের পারমিট বার করে দিল। এখন এই রুটে আমার পাঁচটা বাস চলে। তিনটে এসি বাস। দুটো এমনি বাস। এইসব সামলে দোকান দেখার সময় পাই না।” লাজুক মুখে বলে উমেদ, “ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরগুলো মহা খচ্চর…”

মধুরা ভুরু কুঁচকে উমেদের দিকে তাকাল।

“সরি দি’! মুখ খারাপ করে ফেললাম,” জিভ কাটে উমেদ, “দিনরাত ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর চরিয়ে মুখটা খারাপ হয়ে গেছে। শালারা খুব হারা…” আবার জিভ কাটে উমেদ।

পার্স থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে মধুরার দিকে বাড়ায়। ভিজিটিং কার্ড থেকে উমেদের মোবাইল নম্বর সেভ করছে সে। একটা মিস্‌ড কলও মেরে দেয়।

“তোমার বাবা কেমন আছেন?” প্রসঙ্গ বদলায় মধুরা।

“ভাল। দাওয়াখানা ভালই চলছে। আপনাকে তো আর টিভিতে দেখছি না।”

আবার মেল্টিং পট-এর প্রসঙ্গ। মধুরার যা ভাল লাগে না, সেইসব কথা আবার!

“আমি ওই শো-টা ছেড়ে দিয়েছি উমেদ,” ক্যাজুয়ালি বলে মধুরা।

“বিয়া করবেন?”

উমেদ খুব ভদ্রভাবে প্রশ্নটা করেছে, কিন্তু মধুরার বিরক্ত লাগল। আজ সারাদিন যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়েছে, তারপরে এই সব আটভাট কথা জাস্ট নেওয়া যায় না। মধুরা বলল, “তোমার বাচ্চাকে দেখো।”

বাচ্চার প্রসঙ্গ উঠতেই উমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পূর্ণিমার কাছে গেল। পূর্ণিমা উমেদের কানে কী সব বলল।

উমেদ একগাল হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইয়ু দি’। বাচ্চার পটি বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এগোলাম।”

“এসো,” হাত নাড়ে মধুরা। উমেদ বলে, “আপনারা কি দিঘা বেড়াতে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ…” আলতো একটা মিথ্যে বাতাসে ভাসিয়ে দেয় মধুরা। মিথ্যে কথা বলতে ভাল না লাগলেও কিছু করার নেই! উমেদের সঙ্গে পথের আলাপ। একে সব কথা বলার কোনও মানেই হয় না।

“পাপা বলছিল আপনার সঙ্গে নারানদার দেখা হয়েছিল। মেচেদায় ওর ইলেকট্রনিক গুডসের দোকান আছে। হোল উইক ওর ছেলেরা সামলায়। নারানদা স্যাটারডে-সানডে বসে। পারলে ফেরার সময় একবার দেখা করে যাবেন।”

নারানদার দোকানের তিনটে ভিজিটিং কার্ড মধুরার ব্যাগে থাকার কথা। সে বলল, “চেষ্টা করব।”

পূর্ণিমা নিচু গলায় কিছু বলল। উমেদ সেটা শুনে মধুরাকে বলল, “আমরা আসছি। আমার মিসেস আপনাকে থ্যাঙ্ক ইয়ু বলতে বলল।”

মধুরা হাত নাড়ল। উমেদ বউ-বাচ্চা নিয়ে গাড়িতে উঠল। অশোক হুংকার ছাড়ল, “এক ঘন্টা ধরে বসে আছি। আমাদের খাবার হল?”

“চিল্লিয়ো না!” রান্নাঘর থেকে গর্জে ওঠে গীতা। মিতা আর গীতা খাবার থালা টেবিলে রাখল। মধুরা দেখল, একটা থালায় একগাদা পোড়া রুটি। চারটে বাটিতে ট্যালটেলে ডিমের কারি। একটা প্লেটে একগাদা শসা, পেঁয়াজ, মুলো আর টমেটো কেটে রাখা হয়েছে।

নোংরা থালা আর না ধোওয়া বাটি দেখে গা গুলিয়ে ওঠে মধুরার। মাথা নিচু করে সে রুটি টেনে নেয়। রুটি এত শক্ত যে দু’হাতে ছিঁড়তে হল। ডিমের ঝোল হলুদ আর নুনে পোড়া। স্যালাডে মুলো বেশি, পেঁয়াজ নামমাত্র। কোনও কথা না বলে চারজনে খাওয়া শেষ করল। বারবার খাবার জল চেয়েও পাওয়া যায়নি।

খাওয়া শেষ হতেই গীতা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল বড় হাই তুলে বলল, “আপনাদের হয়েছে চারশো টাকা।”

“পোড়া রুটি আর ডিমের কারির দাম চারশো?” উঠে দাঁড়িয়েছে অশোক। অর্জুন টলতে টলতে সামনে আসছে। ভেতর থেকে চলে এসেছে পিয়ালও। গীতা কোমরে আঁচল জড়িয়ে বলল, “এত রাতে খেতে দিয়েছি, এই যথেষ্ট। চটপট টাকা বার করো। এ তোমাদের কলকেতা শহর নয় যে হুজ্জুতি চলবে।”

মধুরা মাথা নিচু করে বসেছিল। ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বার করে বলল, “চেঞ্জ হবে?”

গীতা নোট নিয়ে বাল্‌বের সামনে ধরে উলটে পালটে দেখে, ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে বলল, “অ্যাই মিতা, একশো টাকার একটা নোট দে তো!”

মিতা এতক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল। সে একশো টাকার নোট দিয়ে বলল, “এত রাতে এসব আমার আর ভাল লাগে না ভাই! মানুষের কি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? আমরা কি দোকান বন্ধ করব না? আমাদের কি সংসার নেই?”

মিতার হাত থেকে নোট নিয়ে মধুরা বলল, “ভাল আছ?”

মিতা ভুরু কুঁচকে মধুরাকে দেখল। চিনতে পারার পরে তার মুখের অনুভূতির বদল হল নাটকীয়! বিরক্তি বদলে গেল অবিশ্বাসে। অবিশ্বাস বদলে গেল অসহায়তায়। মেকি চাটুকারিতা আর দেঁতো হাসিতে মুখ ভরে গেল। “আরে! মধু, তুমি! আগে বলবে তো! ওগো দেখো! ও দিদি, তুমি আগে দেখোনি? আমাদের মধু এতক্ষণ খাচ্ছিল। হ্যাঁগো, তোমরা কী গো…”

গীতা দৌড়ে আসছে পাঁচশো টাকার নোট ফেরত দিতে। অর্জুন জড়ানো গলায় কী একটা বলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পিয়াল বলল, “মাটির ঘরে আজ নেমেছে চাঁদ রে, আজ নেমেছে চাঁদ…”

ডুঙ্গার টেবিল বাজিয়ে বলল, “প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ!”

মধুরা বলল, “আমরা ডিসেন্ট প্যালেসে উঠেছি। কাল সকালে কথা হবে।”

চারজনের সারা রাতের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে অন্য চারজন ধাবা ছাড়ল। মধুরা শুনতে পেল, রান্নাঘর থেকে মিনতিবালা বলছে, “কে এল বউমা! কে?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *