মধুরেণ – ১৩

১৩

সকাল সাতটার সময়ে মনোহরের চিৎকারে ঘুম ভাল মধুরার। “ওরে মধু, দরজা খোল। সব্বনাশ হয়ে গেছে!”

কী হল রে বাবা! ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে মোবাইল হাতে নেয় মধুরা। মোবাইলের পরদা বলছে ‘ফিফটি মিস্‌ড কল্‌স!’

পঞ্চাশটা মিস্‌ড কল? এক লাফে বিছানা ছাড়ে মধুরা। দরজা খুলে জানতে চায়, “কী হয়েছে?”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মনোহর কাঁদছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অশোক। তার কাঁধ ঝোঁকানো। দৃষ্টি মেঝের দিকে। মধুরা জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”

“গতকাল রাতে কর্পোরেশানের লোক এসে পে লোডার দিয়ে শীল ম্যানশন গুঁড়িয়ে দিয়েছে! পান্‌চ আর নেই।” চোখ মুছে বলল মনোহর।

মধুরার মাথা ঘুরছে। নাকি, সে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে আর পৃথিবী ঘুরছে? মনোহর ঘুরছে, অশোক ঘুরছে, ঘর ঘুরছে। সিঁড়ি উঠে আসছে ওপর দিকে! মধুরা দরজা ধরতে যায়, দরজা দূরে চলে যায়। মধুরা মনোহরকে ধরতে যায়, মনোহর দূরে চলে যায়। তার বদলে মেঝে চলে আসে কাছে, সিঁড়ি চলে আসে কাছে, চৌকাঠ চলে আসে কাছে। মধুরা মেঝেতে মাথা ঠুকে পড়ে যায়।

মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে মধুরা বলল, “আমি যা-আ-আ-ব!”

*

অশোক আর কৃশানু মিলে মধুরাকে উত্তরপাড়ার নার্সিং হোমে ভরতি করেছিল। ডাক্তার আশিস সরকার আর কৃশানু উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। অসুখবিসুখে সে-ই ভরসা।

অজ্ঞান অবস্থাতেই মধুরার মাথার সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে হয়। রিপোর্ট দেখে আশিস বলেছে মাথায় কিছু হয়নি।

মধুরার জ্ঞান ফিরল সকাল সাড়ে আটটায়। তখনই অক্সিজেনের মাস্ক খুলে, আইভি চ্যানেলের সুচ বার করে তুলকালাম বাঁধাল। বাধ্য হয়ে আশিস ঘুমের ইনজেকশান দিয়ে বলল, “সাত-আট ঘন্টা এফেক্ট থাকবে। তারপর কী হবে জানি না। মধু খুব স্ট্রেসে রয়েছে।”

দুপুর আড়াইটেয় ঘুম ভাঙার পরে মধুরাকে আটকানো যায়নি। নিজেই রিস্ক বন্ডে সই করে নার্সিং হোম থেকে ছুটি নিয়েছে। একটাই কথা বিড়বিড় করছে, “আমি যাব… আমি যাব…”

মনোহর বাধ্য হয়ে বলল, “চল। আমিও তোর সঙ্গে যাব।”

অশোক ড্রাইভারের আসনে বসল। পিছনের সিটে বাপ-বেটি। জিটি রোড ধরে হাওড়া, ডালহৌসি আর ধর্মতলার জ্যাম পেরিয়ে লং স্ট্রিটে আসতে সময় লাগল পাক্কা দেড়ঘন্টা। সেলুন, জুতোর দোকান, লেমনগ্রাস রেস্তোরাঁ পেরিয়ে গাড়ি দাঁড়াল সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিটের সামনে। ঘড়িতে বিকেল চারটে। গাড়ি থেকে নামে মধুরা।

লং স্ট্রিটের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডাম্পার। পে-লোডার দিয়ে রাবিশ তুলে ডাম্পারে ফেলা হচ্ছে। ডাম্পারের লাইন টপকে মধুরা দৌড়োল শীল ম্যানশনের পাঁচিলের দিকে।

ছ’ফুট উঁচু পাঁচিল গায়েব। পাঁচিলের গায়ে গজিয়ে ওঠা পুঁচকে খাবারের দোকানগুলো আর নেই। মধুরার সামনে ফাঁকা মাঠ। এই মাঠেই কি শীল ম্যানশন ছিল? গত রাত পর্যন্ত এখানেই কি ছিল ‘পান্‌চ’ নামের একটা ফিউশান ফুড রেস্তোরাঁ?

শ’খানেক লেবার মিলে হাতুড়ি পিটিয়ে শীল ম্যানশনের যে ক’টা থাম্বা অবশিষ্ট আছে, তাদের ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। ধুলো-বালি, সিমেন্ট-রাবিশ, চুন-সুরকির গুঁড়োয় বাতাসে মিহি আস্তরণ তৈরি হয়েছে। মায়াবী সেই পরদার আড়ালে, মাঠের ওপরে, হুইলচেয়ারে বসে রয়েছে ডুঙ্গার। নাকে অক্সিজেনের মাস্ক। তার পাশে, মাঠে বসে রয়েছে মিস জোনাকি। মধুরা ধীর পায়ে তাদের দিকে এগোয়।

“তোকে অনেকবার ফোন করেছিলাম রে!” মাঠ থেকে উঠে শাড়ির ধুলো ঝাড়ছে মিস জোনাকি।

“জানি,” থাম্বাগুলোর দিকে তাকিয়ে মধুরা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে, গাড়িবারান্দা কোথায় ছিল। কোথায় ছিল একতলার হলঘর, যেটাকে সে অনেক খরচ করে অফিসে বদলে দিয়েছিল।

“স্টাফেরা তোর খোঁজ করছিল। যখন জানল তুই অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভরতি হয়েছিস, তখন সবাই বাড়ি চলে গেল। ওরা আর ফিরবে না।”

“জানি।” মাঠের দিকে তাকিয়ে মধুরা খুঁজছে কোথায় ছিল ডুঙ্গারের বেডরুম, কোথায় ছিল সিঁড়ি। কোথায় ছিল কার পার্কিং।

“আমাদের আর কোনও থাকার জায়গা নেই মধু,” মিস জোনাকি কেঁদে ফেলেছে। ডুঙ্গারকে জড়িয়ে ধরে বলছে, “কত্তাবাবু আজ পথের ভিখিরি। খাট-আলমারি, চেয়ার-টেবিল, বিছানা-বালিশ, বাসন-কোসন রাস্তায় পড়ে আছে রে! তুই কেন ফোন ধরলি না? তুই কেন পার্ক স্ট্রিট থানায় ফোন করলি না? তা হলে গুরুপদবাবু এই অত্যাচার বন্ধ করতে পারতেন। আমি আর কত্তাবাবু মিলে কত ঝগড়া করব? ওদের সঙ্গে মিনিমাম কুড়িটা মুশকো বাউন্সার ছিল। আমাদের চ্যাংদোলা করে বাইরে বার করে দিল। সব জিনিসপত্র ওপর থেকে ছুড়ে ছুড়ে নীচে ফেলল। পূজা বেধড়ক মার খেয়েছে। আমিও খেয়েছি। এই দ্যাখ!” আঁচল সরিয়ে পিঠ দেখাচ্ছে মিস জোনাকি। সেখানে লাঠির দাগড়া দাগড়া ছাপ।

ফাঁকা মাঠ থেকে মধুরা তুলে নিয়েছে একটা নুনদানি। গেরুয়া আর ফুশিয়া রঙে রাঙানো নুনদানি দেখতে দেখতে সে বলল, “বিনয় কোথায়? ওর গত রাতে ডিউটি ছিল।”

“বিনয়?” ডুঙ্গারের দিকে তাকিয়ে বলে মিস জোনাকি, “ওকে রাতে আর দেখিনি তো!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মধুরা বলে, “তোমরা আমার গাড়িতে ওঠো। আপাতত ভৌমিক ভবনে চলো। তারপর দেখছি, কী করা যায়।”

“আমি যাব না।” অক্সিজেন মাস্কের আড়াল থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় ডুঙ্গার বলল, “আমি আমার বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যাব না।”

“বাড়ি আর নেই কত্তাবাবু,” মিস জোনাকি বোঝানোর চেষ্টা করে।

“জমিটা তো আছে। এই জমি আমার নামে। এখান থেকে কেউ আমাকে উৎখাত করতে পারবে না!”

মধুরা ডুঙ্গারের হুইলচেয়ার ঠেলে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এল। অশোক ডুঙ্গারকে ধরে গাড়ির পিছনের সিটে বসাল। নিজে ড্রাইভারের সিটে বসে বলল, “মধু, তোমার বাবা এখানে রয়ে গেলেন। আমি একটা লরির ব্যবস্থা করেছি। লরিতে সব মাল তুলে দিয়ে, লরিতেই ফিরবেন।” মিস জোনাকি বসল পিছনের সিটে। মধুরা অশোকের পাশে।

গাড়ি চলছে। সব কাচ তোলা। এসি চলছে। ডুঙ্গারের হাঁপের টান বাড়ছে। অক্সিজেনের নল মুখে ঢুকিয়ে সে শোঁ শোঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। মিস জোনাকি ডুকরে কেঁদে ওঠে। “আমাদের কী হবে মধুরা?”

মধুরা চুপ। উত্তরটা সেও জানে না।

*

ভৌমিক ভবনের একতলায় মিস জোনাকি আর ডুঙ্গার থাকছে, সে প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেল। ডুঙ্গার অবশ্য এক সপ্তাহ পরে এসেছে। শ্বাসকষ্টের জন্যে তাকে নার্সিং হোমে ভরতি করতে হয়েছিল।

অ্যাজমার পেশেন্ট একটানা কয়েক ঘন্টা খোলা আকাশের নীচে, চাপ চাপ ধুলো আর রাবিশের মধ্যে বসেছিল। বাড়াবাড়ি তো হবেই! বুকে কফ বসে, ইনফেকশান হয়ে, প্রবল শ্বাসকষ্ট। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছিল ডুঙ্গার। আশিসের চিকিৎসায় সাতদিনের মাথায় খাড়া হল। এখন অসম্ভব দুর্বল। দিনরাত ঝিমোচ্ছে। কাউকে চিনতে পারছে না।

ডুঙ্গারের ছুটির দিন মধুরা গিয়েছিল। ক্যাশ কাউন্টারে পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখল, বিল হয়েছে বারো হাজার টাকা।

আশিসকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য চেম্বারে ছুটেছিল মধুরা। আশিসের সপাট জবাব, “এলাকার সেলেব্রিটির জন্য এটুকু করতেই হয়। আমার নার্সিং হোমের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে তোকে ডাকব। বিনে পয়সায় অ্যাপিয়ারেন্স দিয়ে যাবি। পারলে নিজের কনট্যাক্ট ইউজ করে দু’-একটা সেলেব্রিটি ধরে আনবি। তখন যদি ভাও খাস, তা হলে দেখবি মজা।”

মধুরার খুব কান্না পাচ্ছিল। দুনিয়ায় এখনও কিছু ভাল মানুষ রয়ে গেছে তা হলে! সবাই নেহার মতো হয়ে যায়নি!

ডুঙ্গার বাড়িতে আসার পরে সবাই চুপচাপ। মনোহর বা যূথিকা মুখ খুলছে না। কৃশানু আর দিয়াও নয়। সবিতা অবশ্য বলেছে, “কুটুম আর মাছ তিনদিনের বেশি বাড়িতে থাকলে পচা গন্ধ বেরোয়।”

এই প্রবাদটা মধুরা জানে। কিন্তু এই দিশেহারা অবস্থায় সে কী করতে পারে?

মিস জোনাকি রোজ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। সৌমেনের সঙ্গে হাইকোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে শীল ম্যানশন সংক্রান্ত আইনি জটিলতা কাটানোর চেষ্টা করছে। তবে প্রগ্রেস খুব হতাশাজনক। শীল ম্যানশনের মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্রে এত মারপ্যাঁচ আছে যে সেসব এড়িয়ে ওখানে একটা ইট গাঁথাও সম্ভব নয়।

ভৌমিক ভবনে আসার পরে ডুঙ্গার যূথিকার হাতে একটা চেক ধরিয়ে বলেছে, “মাথার ওপরের ছাদ হারিয়ে আপনার বাড়িতে ঢুকেছি মানে এই নয় যে আমি ভিখিরি। ভগবানের কৃপায় আমার টাকাপয়সার অভাব কোনও দিনও ছিল না। এখনও নেই। এটা আপনি গ্রহণ করলে যে ক’দিন আপনার আতিথ্যে থাকব, অপরাধবোধহীন হয়ে থাকব।”

যূথিকা চেকে চোখ বুলিয়ে দেখে, টাকার পরিমাণ এক লক্ষ। পান চিবিয়ে সে বলে, “দুই বুড়োবুড়ির খাইখরচা এত হয় না। আর আমার বাড়িটা হোটেল নয় যে এখানে ফুডিং-লজিং-এর টাকা নেওয়া হয়। আপনাকে সম্মান করার জন্যে কাগজের টুকরোটা নিলাম। যে দিন নতুন বাসায় যাবেন, ফেরত দিয়ে দেব।”

“ধন্যবাদ।” হাত জোড় করে ডুঙ্গার। মধুরা ঘরে ঢোকামাত্র তাকে অনুরোধ করে ভাড়া বাড়ি খুঁজে দেওয়ার জন্য।

ইন্টারনেটের সূত্রে ভাড়ার জন্যে বাড়ি খোঁজার কাজ সোজা হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে লোকেশান হিসেবে রাজচন্দ্রপুর এবং তার আশেপাশের এরিয়া সিলেক্ট করতে পাঁচজন বাড়িওয়ালার খবর এল। সঙ্গে ফ্ল্যাটের ছবি। মোবাইল ক্যামেরায় তোলা, কিন্তু প্রাথমিক আন্দাজ পাওয়া যায়। পাশে বাড়িওয়ালার মোবাইল নম্বর দেওয়া রয়েছে।

পাঁচটার মধ্যে তিনটে বাদ হয়ে গেল, কেননা সেগুলো তিন বা চারতলায়। এবং ফ্ল্যাটে লিফ্‌ট নেই। বাকি দুটোর মধ্যে একটায় ফোন করতে জানা গেল যে অলরেডি ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। যেটা পড়ে আছে, সেটা দেখতে মধুরা আর অশোক বেরিয়েছে।

ডানকুনি যে এতটা শহর হয়ে গেছে, মধুরার ধারণা ছিল না। একের পর এক ফ্ল্যাট, ঝাঁ চকচকে দোকান আর শোরুমে রাস্তার দু’দিক থিকথিক করছে। বাস, শেয়ারের ট্যাক্সি, অটো, টোটো, ম্যাজিক ট্যাক্সিতে এলাকা সরগরম। তারই মধ্যে লম্বা আর রোগা পাঁচতলা বাড়ির একতলায় ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট। একপলক দেখে পছন্দ হল মধুরার। এসি এবং ইনভার্টার বসানো আছে। ফার্নিচার নিয়ে আসতে হবে। এগারো মাসের এগ্রিমেন্ট।

ফেরার পথে অশোক গাড়ি চালাচ্ছে। মধুরা পাশে বসে ভুরু কুঁচকে ভাবছে। অশোক বলল, “কী হল?”

“আচ্ছা, আমরা কি প্রেম করছি?” মধুরার ভুরু এখনও কুঁচকে রয়েছে।

“প্রেম করা মানে, অ্যাজ ইন, টু মেক লাভ?”

“না… আমি ভালবাসার কথা বলছি। মানে, তোমার কি আমাকে না দেখলে মন খারাপ লাগে? মনে হয়, কখন আবার দেখা হবে?”

“হয় তো। রোজ হয়!”

“আমার কিন্তু হয় না। কোনও দরকার পড়লে তোমার কথা মনে পড়ে। অন্য সময় আমি পান্‌চ নিয়ে ভাবি, মনে মনে নতুন ডিশ কনসিভ করি, মনে মনে নেহার মুখে ঝামা ঘষে দিই… আই মিন, আগে আমি তোমাকে দেখে খুব এক্সাইটেড হতাম। দিনরাত খারাপ খারাপ চিন্তা আসত। এখন কিছু মনে হয় না। আচ্ছা, আমি ফ্রিজিড নই তো?”

ন্যাশনাল হাইওয়ের একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অশোক বলল, “দাঁড়াও। দেখি, তোমার সমস্যাটা কোন জায়গায়!”

মধুরা বলল, “একটু চুমুফুমু খাও তো! বুকে হাতফাত দাও। দেখি কেমন লাগে। ভাল না লাগলে সন্নিসি হয়ে হরিদ্বার চলে যাব! উম্‌ম্‌!”

মধুরার কথা শেষ হল না। অশোকের চাষাড়ে হাত তার কুর্তির ভিতরে ঢুকে গেছে। অশোকের ঠোঁট মধুরার গালে ঘুরপাক খাচ্ছে। গরম শ্বাস পড়ছে গালে, কানে, ঘাড়ে। মধুরা হাঁকপাক করে অশোকের টি শার্ট তুলে রোমশ বুকে মুখ ঘষতে লাগল।

মিনিট দুয়েক পরে অশোক বলল, “বাস থেকে লোকজন আমাদের দেখছে।”

অশোক গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, “চলো, তোমার ছাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে আড্ডা মারি।”

“বিয়ের আগে বাবামা বাড়িতে সেক্স অ্যালাও করবে না।”

“উফ! আমি আড্ডার কথা বলেছি। মেক আউটের কথা বলিনি।”

ভৌমিক ভবন চলে এসেছে। মধুরা চুল আঁচড়ে, ভব্যিযুক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে বলল, “গাড়ি তুলে ভেতরে এসো। দুপুরে খেয়ে যাবে।”

অশোক গ্যারাজে গাড়ি ঢোকাচ্ছে। মধুরা ডুঙ্গারের ঘরে ঢুকতে গিয়ে মহিলা কন্ঠ শুনতে পেল। “তুমি পারেখ খানদানকে রেকগনাইজ না করলেও আমি তোমাকে দাদু বলে মানি। আমি তোমার কাছে এসেছি, নট অ্যাজ আ পোটেনশিয়াল বায়ার, বাট অ্যাজ ইয়োর গ্র্যান্ডডটার! লং স্ট্রিটের জমিটা তুমি আমাকে বেচে দাও দাদু! আই উইল পে অ্যাকর্ডিং টু দ্য মার্কেট প্রাইস।”

নেহা পারেখ! সেদিন বলেছিল, “ইট মে বি হসপিটালিটি বিজনেস, বাট ইট্‌স বেসিক্যালি ওয়ার। দেয়ার উইল বি লট্‌স অফ কেচাপ অন দ্য রোড।” আজ সেই কথা সত্যি প্রমাণ করে ছাড়ল। রেস্তোরাঁ ধুলোয় মিশিয়ে শান্তি হয়নি, এখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে জমি কেড়ে নেওয়ার ধান্দা করছে। মধুরা নিশঃব্দে দাঁড়াল। সে শুনতে চায়, নাতনির কথায় ডুঙ্গার কী বলে!

ডুঙ্গার বলল, “আপনি ওই জমির মার্কেট প্রাইস জানেন?”

“তুমি আমাকে ‘তুমি’ বলো। আমি তোমার পোতি!” মিষ্টি গলায় বলে নেহা, “আমি মার্কেট প্রাইস জানি দাদু। কিন্তু মুখের কথায় এত বড় ডিল হয় না। তোমার ল ইয়ারের সঙ্গে আমার ল ইয়ার কথা বলবে। বাড়ির ট্যাক্স কত ছিল জানতে হবে। অরিজিনাল পেপার্স দেখতে হবে। কোনও ডিসপিউট আছে কি না স্টাডি করতে হবে। ইট্‌স আ লং প্রসেস।”

মধুরা আর পারল না। ঘরে ঢুকে নেহাকে বলল, “তুই কাকে বলে আমাদের বাড়ি ঢুকেছিস?”

মধুরাকে পাত্তা না দিয়ে নেহা বলল, “দাদু, এইরকম শ্যাবি বাড়িতে কেন থাকছ? তুমি তোমার নিজের বাড়ি চলো।”

“আমার বাড়ি নিয়ে কোনও আজেবাজে কথা শুনতে আমি রাজি নই,” চিৎকার করে মধুরা।

নেহা আর মধুরার মধ্যে অদৃশ্য এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখানকার বাতাসে বারুদের গন্ধ! সেখানে ঝিকিয়ে উঠছে বিদ্যুৎ। সেখানকার আকাশে কড়কড় করে মেঘ ডাকছে।

নেহা বলল, “তোর বাবা তো ময়রা! মিষ্টির দোকান চালায়। ডিজিটাল ইন্ডিয়া থেকে তোর চাকরি গিয়েছে। পাঁচফোড়নে তুই আমার কাছে গোহারান হেরেছিস। তোর লাভার তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছে। লন্ডনে তোর কুকারি শোয়ের কেরিয়ার শেষ। তুই জম্ম লুজার! তোকে নিয়ে আমি বদার্ড নই। কিন্তু তুই কেন আমার দাদুর বাড়িতে ব্রথেল খুলেছিস?”

“ওখানে ব্রথেল খোলার চেষ্টা আমি করিনি। করেছিলি তুই। বাবুলালকে স্পাই হিসেবে ওখানে তুই ঢুকিয়েছিলি। কর্পোরেশানের লোকজনকে হাত করে শীল ম্যানশন ভাঙলি তুই। এখন ডুঙ্গারকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে জমি হাতানোর চেষ্টা করছিস। কিন্তু ডুঙ্গার তোর সঙ্গে যাবে না। আমার বাড়িতেই থাকবে।”

মধুরার কথা হাত দিয়ে উড়িয়ে নেহা বলল, “দাদু, প্লিজ কাম উইথ মি। আই উইল গিভ ইয়ু প্রপার মেডিকেশান অ্যান্ড গুড নার্সিং কেয়ার।”

ডুঙ্গার চোখ পিটপিট করে নেহাকে মাপল। বলল, “নেহা, এক্সকিউজ মি, আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবে আমার লিভ ইন পার্টনার মিস জোনাকি। আমরা দু’জনেই মাছ-মাংস খাই, ড্রিঙ্ক করি। ইজ দ্যাট ওকে উইথ ইয়ু?”

“আপ বঙ্গালি কে তরাহ মিট-মচ্ছি খাতে হ্যায়?” নাক সিঁটকোয় নেহা, “ঘিন নহি লগতা?”

“আপনি লেমনগ্রাসে ফিশ অ্যান্ড মিট সার্ভ করেন না?” হাঁফাতে হাঁফাতে বলে ডুঙ্গার।

“দ্যাটস বিজনেস দাদু! ইয়ু ক্যান সেল ড্রাগস, বাট ইয়ু ক্যান্‌ট ডু ইট।”

ডুঙ্গার কথাটা শুনে ঘাড় নেড়ে বলল, “সরি নেহা, আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। আমি আপনার বাড়িতে মরে গেলেও যেতাম না। জাস্ট দেখছিলাম, আপনি কতটা আনকুথ হতে পারেন। আপনি এখন আসুন। আমার কাজ আছে।”

প্রবল হাসিতে ফেটে পড়ে নেহা বলে, “কোথা থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ? এই বাড়িটা তোমার নয়!”

মিস জোনাকি এবার মুখ খুলেছে। “যার বাড়িই হোক না কেন, তুমি এখান থেকে যাও।”

“আয়্যাম নট টেকিং অর্ডার ফ্রম অ্যান ওল্ড হোর!” মিস জোনাকিকে হাতের ইশারায় উড়িয়ে দেয় নেহা, “বাই দ্য ওয়ে দাদু, হোরহাউস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তোমার কোনও কাজ নেই। রেগুলার রামনাম জপ করছ তো?”

মধুরা আর পারল না। ডুঙ্গারকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ডুঙ্গারের অনেক কাজ আছে। আমরা আবার রেস্তোরাঁ খুলছি।”

এখনও হাসছে নেহা। তর্জনী তুলে বলছে, “হোরহাউস খোল, মিষ্টির দোকান দে, তেলেভাজা বিক্রি কর… আই কেয়ার আ ড্যাম! শুধু একটা কথা! কলকাতা শহরের ত্রিসীমানায় যেন না দেখি!”

“মানে?” চিৎকার করে ওঠে মধুরা।

“চ্যাঁচাবি না!” চাপা গলায় বলে নেহা, “দাদুর প্রপার্টি আমি নেবই। বাই হুক ওর বাই ক্রুক! বঙ্গালিরা কলকাতার জমিবাড়ি বেচে দিয়ে হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুরে পালিয়ে গেছে। এবার সেখান থেকেও উৎখাত করব। কেউ কিস্‌সু করতে পারবে না।”

যূথিকা আর মনোহর নীচে নেমে এসেছে। গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে চলে এসেছে অশোক। সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নেহার সাহস দেখে অবাক হয়ে যায় মধুরা। একটা থাপ্পড় কষালেই তো উলটে পড়বে।

রাস্তার দিকে চোখ গেল মধুরার। নেহার এসইউভির পাশে একটা জিপ। জিপ ভরতি গুন্ডা টাইপের ছেলে। এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, ওরা গান ক্যারি করছে।

নেহা মধুরার থুতনি নেড়ে বলল, “কলকত্তা আর বঙ্গালিদের নেই। কথাটা ভুলিস না। যদি মনে করি, তা হলে তোর বাড়িটা কিনে নিয়ে এখানেই লেমনগ্রাসের ব্রাঞ্চ খুলব। শুধু চাকরবাকরদের আমরা কলকাতায় অ্যালাও করছি। ডোন্ট ট্রাই টু বি মোর দ্যান আ সারভ্যান্ট। জিপের দিকে তাকা। তোর চেনা দু’জনকে দেখতে পাবি।”

মধুরা রাস্তার দিকে তাকায়। জিপে অনেকের সঙ্গে বসে রয়েছে বাবুলাল আর বিনয়। মধুরাকে দেখে দু’জনে মুখ নামিয়ে নিল।

“অবাক হোস না,” শয়তানি হাসি হাসে নেহা, “বঙ্গালিরা একটা কাজ খুব ভাল পারে। দালালি করতে। বিনয় আর বাবুলালকে হোরহাউসে প্লান্ট করেছিলাম স্পায়িং করতে। দে আর সাকসেসফুল। ওরা এখন লেমনগ্রাসে চাকরি করে। তুই চাইলে তোকেও লেমনগ্রাসের চাকরের কাজ দিতে পারি। করবি?”

মধুরার চোখে জল। অপমানে মাথা ঝাঁঝাঁ করছে। অপমানের জ্বালা বুকে লঙ্কাবাটা ঘষে দিচ্ছে। হেরো মধুরা, লুজার মধুরা, ব্যাবসা করতে ব্যর্থ মধুরা, কলকাতা থেকে বিতাড়িত মধুরা কোনওরকমে বলল, “গেট লস্ট!”

নেহা বেরিয়ে যাওয়ার আগে যূথিকাকে বলল, “আন্টি নমস্কার। ভাল আছেন?”

যূথিকা নেহাকে আপাদমস্তক মেপে বলল, “তুমি কে বাছা? এক গাড়ি ব্যাটাছেলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ!”

“ওরা আমার চাকরবাকর। সঙ্গে থাকে। আপনি চাইলে আপনার মেয়েকেও নিতে পারি। বাই।” তিনধাপ সিঁড়ি টপকে নেমে রাস্তায় নেমে এসইউভিতে উঠে বসল নেহা। এসইউভি আর জিপ রাজচন্দ্রপুরের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

যূথিকা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকে ডুঙ্গারকে বলল, “আপনি কেমন ব্যাটাছেলে? নাতনির কানের গোড়ায় থাবড়া কষাতে পারলেন না?”

ডুঙ্গার মাথা নিচু করে বলল, “বয়স থাকলে মারতাম। এখন রামনাম জপ করার সময়। এখন যাওয়ার সময়। নাতনি এসে শিখিয়ে গেল।”

মিস জোনাকি বলল, “মেয়েটা আমাদের রেস্তোরাঁ ভেঙে দিয়েছে। আমাদের বাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এখন আপনার বাড়িতে এসে আপনার মেয়েকে হুমকি দিচ্ছে। সে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আমরা কোন ছার!”

“তুই দু’ঘা দিলি না কেন?” মধুরার হাত চেপে ধরেছে যূথিকা।

মধুরা বিরক্ত হয়ে বলল, “মা, নেহা এক গাড়ি গুন্ডা নিয়ে এসেছিল। গুলিফুলি চালিয়ে দিলে কী হত?”

“আমার পাড়ার লোক নেই? থানাপুলিশ নেই? গুলি চালানো অতই সোজা?”

“তোমার পাড়া আর আগের মতো নেই মা। তোমার বাংলাও আর আগের মতো নেই। শুনলে তো, বলে গেল যে এই বাড়িটাও কিনে নেবে,” যূথিকার কাঁধে হাত দিয়ে মধুরা বলে, “ডানকুনিতে এক কামরার ফ্ল্যাট দেখে এসেছি। ওখানে ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিকে শিফ্‌ট করে দিচ্ছি। তারপর আমি কোনও একটা চাকরিতে জয়েন করে যাব। রোজ এই টেনশান আর অপমান আমি জাস্ট নিতে পারছি না।”

যূথিকা কেঁদে ফেলেছে। আঁচলে চোখ মুছে ডুঙ্গারকে বলল, “আমাকে কেউ অপমান করলে সাতদিন ঘুম হয় না। আর আমার মেয়েটাকে ঘরে বাইরে রোজ হাজার অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। কেন? না সে লোককে খাওয়াতে ভালবাসে। সে একটা রেস্তোরাঁ খুলতে চায়। দেখি কে ওকে আটকায়!”

অশোক এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। সে এবার বলল, “কাকিমা, রেস্তোরাঁ খোলা অত সহজ নয়। জায়গা লাগে, ক্যাপিটাল লাগে, ম্যানপাওয়ার লাগে।”

যূথিকা বলল, “জায়গা আমি দেব। বাবা মারা যাওয়ার পরে কোলাঘাটের ভাইভাই রেস্তোরাঁর অর্ধেক শেয়ার আমার নামে। আমার অংশ আমি মধুরাকে লিখে দেব। তুমি উকিল ডাকো।”

মনোহর অবাক হয়ে বলল, “মধু কোলাঘাটে রেস্তোরাঁ খুলবে? তুমি কি পাগল হলে?”

যূথিকা চিৎকার করে বলল, “ওই মেয়েটা যখন শাসিয়ে গেল যে কলকাতায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে তখন রা কাড়োনি। এখন একটাও কথা বলবে না। এখন থেকে আমি যা বলব, তাই হবে। ডুঙ্গারবাবু আমাকে একলাখ টাকার যে চেকটা দিয়েছে, ওটা আমি ফেরত দিচ্ছি। ওই টাকায় তোরা ভাইভাই ধাবাকে বড় কর।”

“মা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?” যূথিকাকে ধমক দেয় মধুরা।

যূথিকা ঠান্ডা গলায় বলে, “সারা জীবন তোর পাগলামি মাথা পেতে নিয়েছি। এবার আমার পাগলামি সহ্য করার দিন এসেছে। আমি অর্জুনকে ফোন করে দিচ্ছি। তোরা আগামীকাল রওনা হয়ে যা। উকিলের কাগজ পরে পৌঁছবে।”

মধুরা বলল, “তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছ?”

“হ্যাঁ। দিচ্ছি। পরের ধনে পোদ্দারি অনেক হল। বাবার হোটেলে খেয়ে অনেক ন্যাকামি করা যায়। চাকরি ধরা যায়, চাকরি ছাড়া যায়, বিদেশ যাওয়া যায়, বিদেশ থেকে ফিরে আবার বাবার হোটেলে ওঠা যায়। কিন্তু আজ থেকে বাবার হোটেল বন্ধ। নিজে রোজগার করো। নিজে খাও। পাশাপাশি আমাদের মাসে মাসে টাকা পাঠাও। ঠিক আছে?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *