১২
আইনের নিজস্ব একটা গতি আছে। তাকে কেউ আটকাতে পারে না। অশোক না থাকলে মধুরা কী করত কে জানে! অশোকের ফিল্মমেকার কাম উকিল বন্ধু সৌমেন পাল অনেক সাহায্য করল। গুরুপদ কেস ডায়রিতে বেলেব্ল আইপিসি দিয়ে ডুঙ্গার, মিস জোনাকি আর মধুরাকে ছেড়ে দিল।
মধুরা থানা থেকে বেরোল রাত একটার সময়। গাড়িতে ওঠার আগে গুরুপদ ডেকে বলল, “তোর পিছনে যারা লেগেছে তারা খুব পাওয়ারফুল। ভাল পলিটিকাল কানেকশান আছে। তোকে ওরা সহজে ছাড়বে না।”
“আমার আর কী ক্ষতি করবে বলতে পারো? পান্চের এক্সটিরিয়র আর ইন্টিরিয়র ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। ওই জায়গা নতুন করে সাজাতে আমার যা টাকা লাগবে, সেটা খরচ করার পরে আমার কাছে লিকুইড ক্যাশ কিছুই থাকবে না। সুনাম যেটুকু অর্জন করেছিলাম, সেটা জলাঞ্জলি গেল। আমি নিয়ারলি ফিনিশড।”
“নিয়ারলি ফিনিশড মধু। পুরোপুরি নয়। পান্চ এখনও বেঁচে আছে। নেহা পারেখের সেটা পছন্দ নয়। আমি ভেতরের খবর বলছি। কলকাতা কর্পোরেশান থেকে শীল ম্যানশনকে অতীতে কনডেম্ড বিল্ডিং হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল। বিল্ডিং ডেমলিশ করে নতুন মালটিস্টোরিড তোলার প্ল্যান তলায় তলায় চলছে। যেহেতু বিল্ডিংটা কনডেম্ড, তা এই প্রসেসটা পারফেক্টলি লিগাল। ওরা খুব ফাস্ট এগোচ্ছে।”
মধুরা দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “আমি এত সহজে জমি ছাড়ব না। লড়াই যখন শুরু হয়েছে তখন এর শেষ দেখব।”
ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিকে শীল ম্যানশনে ছেড়ে দিয়ে ভৌমিক ভবনে পৌঁছতে রাত তিনটে। মনোহর, যুথিকা, কৃশানু, দিয়া সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে বসে রয়েছে সবিতা। মধুরাকে বাড়ি ঢুকতে দেখে বলল, “কিছু খাবে?”
টক করে একটা ঘুমের ওষুধ গলায় ফেলে মধুরা বলে, “কাল সকালে ঘুম থেকে তুলবে না”
সকাল দশটার সময় ঘুম থেকে উঠে দোতলায় নেমে মধুরা দেখে মনোহর আর যূথিকা টিভি দেখছে। জবরখবর চ্যানেলে মধুরার সাংবাদিককে চড় মারার ভিডিয়োটা বারবার দেখাচ্ছে। মিছিলের ভিডিয়োটাও বারবার দেখাচ্ছে। অথচ পান্চ ভাংচুরের কোনও ভিডিয়ো নেই। পান্চের দেওয়ালে লেখা অশ্লীল শব্দগুলো নেই।
মধুরাকে দেখে টিভি অফ করে দিল মনোহর। মধুরা খবরের কাগজ হাতে নিল।
বাংলা কাগজ দেখে মধুরার চোখ কপালে উঠল। কলকাতার পাতার প্রধান ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মুখে ওড়না আর রুমাল চাপা দিয়ে ছেলেমেয়েরা প্রিজন ভ্যানে উঠছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পান্চের নাম জ্বলজ্বল করছে। খবরে চোখ রাখে মধুরা।
রেস্তোরাঁয় মধুচক্র।
নিজস্ব সংবাদদাতা: মধ্য কলকাতার একটি রেস্তোরাঁর পার্কিং লট থেকে দশজোড়া ছেলেমেয়েকে গ্রেফতার করল পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ। লং স্ট্রিটের শীল ম্যানশনে মাত্র একমাস আগে ফিউশান ফুডের রেস্তোরাঁটি চালু হয়েছে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে অফিসার গুরুপদ দত্তের নেতৃত্বে পার্ক স্ট্রিট থানা পুলিশি অভিযান চালিয়ে মধুচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে। রেস্তোরাঁর মালিকরা জানিয়েছেন, মধুচক্রের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানতেন না। মালিকরা বেল পেয়ে গেলেও পুলিশ রেস্তোঁরাটি সিল করে দিয়েছে।
ওই এলাকার অন্যতম প্রধান রেস্তোরাঁ লেমনগ্রাসের কর্ণধার নেহা পারেখ অভিযোগ করেছেন যে উদ্বোধনের দিন থেকেই ওখানে অসামাজিক কাজকর্ম চলত। রাত বাড়লে মাতাল, যৌনকর্মী ও বাইকবাহিনীর দাপটে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেত না। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, শীল ম্যানশনের মালিক এবং তাঁর সঙ্গিনী মিলে বহুদিন ধরেই বাড়িতে মধুচক্রের আসর বসাতেন। রেস্তোরাঁ খুলে তাঁরা দেহব্যাবসাকে আরও আধুনিক করতে চাইছেন। এ বিষয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন।
মধুরা নিঃশব্দে ব্রেকফাস্ট শেষ করে গাড়ি নিয়ে বেরোল। গন্তব্য শীল ম্যানশন। অশোক আর সৌমেন আসবে।
লং স্ট্রিটে গাড়ি রেখে সময় দেখল মধুরা। কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও ভাল ঘুম হয়নি। বেশ টায়ার্ড লাগছে। গাড়ি থেকে নামার আগে সানগ্লাস গলায় মধুরা। এদিক ওদিক দেখতে সুবিধে হবে।
রাস্তায় লোকজন নেই। দোকানপাটও বন্ধ। মাত্র কয়েকঘন্টা আগে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে বলে মনেই হচ্ছে না।
পান্চের পার্কিং লটে চেয়ার পেতে বসে পূজা, বিনয়, সার্ভিস স্টাফ আর বাউন্সাররা গজল্লা করছে। মধুরাকে দেখে সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। পূজা এগিয়ে এসে বলল, “ম্যাডাম, আমাদের কী হবে?”
মধুরা এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। অপ্রস্তুত হেসে বলল, “তোমরা বোসো। দেখছি, কী করা যায়!”
শীল ম্যানশনের দোতলার হলঘরে অশোক, মিস জোনাকি, ডুঙ্গার আর সৌমেন বসে রয়েছে।
মধুরাকে দেখে মিস জোনাকি বলল, “বোস। তোর জন্যে চা নিয়ে আসি।”
“চা পরে হলেও চলবে।” চেয়ারে বসে বলে মধুরা, “আমি আগে একটা জিনিসের উত্তর চাই। পান্চে এত সেক্স ওয়ার্কার ঢুকল কী করে?”
জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ডুঙ্গার বলল, “মধু এই অভিযোগটা করবে আমি জানতাম। ও ফিনান্সার। ওর টাকা নিয়ে ব্যবসায় আমি নেমেছি।”
“আমি আমি করছ কেন?” ডুঙ্গারকে থামায় মিস জোনাকি, “বলো আমরা। আমিও তো সমান দোষে দোষী।”
অশোক সবাইকে থামিয়ে বলে, “সবার আগে একটা জিনিস জানতে চাই। অংশীদারি ব্যাবসা ডুবে যাওয়ার প্রধান কারণ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। তোমরা আগে ঠিক করো, ‘এফ অ্যান্ড বি প্রাইভেট লিমিটেড’ কোম্পানিটা রাখবে না তুলে দেবে। সেই মতো সৌমেন সিদ্ধান্ত নেবে।”
“কোম্পানি তুলে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। মধুরা ভৌমিক এত সহজে হারতে শেখেনি। আমি শুধু ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিকে তাদের দায়িত্বগুলো স্মরণ করিয়ে দিলাম।” কড়া গলায় বলে মধুরা।
ডুঙ্গার মধুরার দিকে আড়চোখে তাকাল। তার চোখে ঝিলমিল করছে হাসি। মিস জোনাকি বলল, “এই বুড়োবুড়ি দুটোকে অনেক বকেছিস। এবার চুপ কর।”
সৌমেন বলল, “তা হলে ‘এফ অ্যান্ড বি’ কোম্পানি থাকছে। পরের অ্যাজেন্ডা, জোনাকিদি আমাদের চা খাওয়াবে।”
মিস জোনাকি রান্নাঘরের দিকে এগোল। সৌমেন বলল, “তৃতীয় অ্যাজেন্ডা, বাবুলাল। এটা খুব ক্লিয়ারলি বুঝতে হবে যে গতকালের ঘটনার জন্যে দায়ী বাবুলাল। কিন্তু পুলিশ ওকে নিয়ে বদার্ড নয়। ওকে ইনভল্ভ করাতে হলে তোমাদের ওর এগেনস্টে মামলা করতে হবে। তোমরা কি সেটা চাও?”
“না।” একসঙ্গে বলে মধুরা আর ডুঙ্গার।
সৌমেন বলল, “চার নম্বর অ্যাজেন্ডা, শীল ম্যানশন। এই নিয়ে ডুঙ্গারবাবুর সঙ্গে আমার কথা আছে।”
মিস জোনাকি ট্রেতে পাঁচকাপ চা নিয়ে এসেছে। অশোক মিস জোনাকির হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখল। সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে, নিজের কাপ নিল। সৌমেন সড়াৎ করে কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “কর্পোরেশান থেকে এই বাড়িকে অতীতে তিনবার কনডেম্ড ডিক্লেয়ার করে নোটিশ জারি করেছে। তাই তো ডুঙ্গারবাবু?”
চায়ে চুমুক দিয়ে ডুঙ্গার বলল, “কর্পোরেশানের কাজ নোটিশ দেওয়া। সে নোটিশ দিয়েছে। আমার কাজ নোটিশ ছিঁড়ে ফেলা। আমি তাই করেছি।”
ডুঙ্গারের কথা শুনে মধুরা খচে লাল। চায়ের কাপ ঠকাত করে টেবিলে রেখে বলল, “গাঁটে গাঁটে রজতজয়ন্তী হয়ে গেছে, বয়সের গাছপাথর নেই, এখনও বদমায়েশি গেল না? কোম্পানি খোলার আগে এইসব কেচ্ছার কথা আমায় বলোনি কেন?”
“তা হলে তুই রাজি হতিস না!” ফিচেল হেসে বলে ডুঙ্গার। মধুরা পরিষ্কার বুঝতে পারে, কম বয়সে এই ‘গুডলুকিং রাস্কাল’ ইমেজ দিয়েই মেয়ে পটাত লোকটা!
সৌমেন মন দিয়ে ঝগড়া শুনছিল। বলল, “পার্টনারদের মধ্যে ইউনিটি থাকলে আমরা আর একটু এগোতে পারি।”
মধুরা চুপচাপ চায়ে চুমুক দিল। ডুঙ্গার সৌমেনকে বলল, “এগোও।”
“আমার ধারণা, নেহা পারেখ খুব শিগ্গির ঠিকঠাক জায়গায় ফুল বেলপাতা দেবে। কনডেম্ড বিল্ডিং ভাঙার জন্যে চার নম্বর নোটিশটা তাড়াতাড়ি বেরোবে। চাই কী, পে লোডার নিয়ে ডেমলিশন টিমও হাজির হয়ে যেতে পারে।”
মধুরা বলল, “যদি সিচুয়েশান এতটা গ্রেভ বলে মনে হয়, তা হলে আমরা আদালতে আবেদন করে স্টে অর্ডার বার করতে পারি।”
“স্টে অর্ডার বার করাই যায়,” মধুরার দিকে তাকিয়ে বলে সৌমেন, “কিন্তু ইট্স আ লং লিগাল প্রসেস। রেস্তোরাঁটা অন্য কোথাও শিফ্ট করা যায় না?”
“প্রশ্নই নেই,” সৌমেনের প্রস্তাব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মধুরা বলে, “আমি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পান্চ চালু করব। যত টাকা লাগে লাগুক, যত লোক লাগে লাগুক। আমি, ডুঙ্গার আর মিস জোনাকি এই দিকটা সামলাচ্ছি। আপনি আইনি ঝামেলা সামলান।”
“তবে তাই হোক,” চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে সৌমেন। অশোককে বলে, “আমার এই সব কথা বলা সাজে না, তাও বলছি। শীল ম্যানশনের বাইরে সিকিয়োরিটি রাখলে ভাল হয়। আবার যদি এখান থেকে কয়েক জোড়া ছেলেমেয়ে ধরা পড়ে, তা হলে এই বাড়ির জন্যে আর কিছু করা যাবে না।”
সৌমেনের কথায় যুক্তি আছে। মধুরা বলল, “এখানে পুলিশ পোস্টিং-এর জন্যে পার্ক স্ট্রিট থানায় বলতে পারি।”
“পুলিশকে বলে কিছু হবে না। ওরা ক’দিন পাহারা দেবে?”
“আমরা যদি নিজেরা পাহারা দিই?” মিস জোনাকি প্রস্তাব দেয়, “দিনের বেলা কোনও সমস্যা নেই। রাতের বেলা দু’জন দু’জন করে জেগে থাকলেই হল। আমাদের স্টাফেদের এখন কোনও কাজ নেই। ওরা রাজি হয়ে যাবে।”
ডুঙ্গার ভুরু কুঁচকে বলল, “এর মধ্যে স্টাফেদের ঢোকানো কি ঠিক হবে? একজন স্টাফ তো বারোটা বাজিয়ে চলে গেল।”
আপত্তি করে মিস জোনাকি, “ওরা না করলে কে করবে? তুমি?”
মধুরা চেয়ার থেকে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। পান্চের পার্কিং লটে চেয়ার পেতে বসে ছেলেমেয়েগুলো এইদিকে তাকিয়ে রয়েছে।
রান্না করা মধুরার প্যাশন। প্যাশন পেশায় বদলে গেছে। এখন সে ব্যবসায়ী। নিজে রোজগার করার পাশাপাশি অন্য অনেকের রুটিরুজির দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে। কাস্টমারদের মুখে অন্ন তুলে দিতে গিয়ে কর্মচারীদের অন্নদাত্রী হয়ে গেছে। অন্নপূর্ণার ঝুলি কখনও শূন্য থাকে না। এদের পাতে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার ঘাড়ে। ধার করে হলেও সে পান্চ চালু করবে। মধুরা ডুঙ্গারের হাত ধরে বলল, “চিন আপ ডার্লিং! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মধুরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ডুঙ্গার বলে, “লাইফটা রূপকথা নয় ডার্লিং! ফারদার খরচ করার আগে ভেবে দেখ!”
মধুরা কথা না বাড়িয়ে নেমে আসে। সামনে অনেক কাজ।
*
কোনও নতুন অ্যাড না দিয়ে, কাউকে ইনভাইট না করে, পুলিশি হানার পনেরো দিনের মাথায় পান্চের রিলঞ্চ হল।
এই দু’সপ্তাহে জলের মতো টাকা খরচা করেছে মধুরা। তার সেভিংস অ্যাকাউন্টে আর মাত্র আশি হাজার টাকা আছে। যত ফিক্সড ডিপোজিট ছিল, সব ভেঙে টাকা তুলেছে। কোথাও আর তার কোনও সেভিংস নেই। প্রথম মাস থেকেই পান্চ লাভ না করলে, স্টাফেদের মাইনে দিতে বা ওভারহেড কস্ট মেটাতে মধুরাকে ওই আশি হাজার টাকায় হাত দিতে হবে। তার টেনশান হচ্ছে। পান্চ দাঁড়িয়ে যাবে তো?
ভগবানের কৃপায় প্রথম দিনই বারোজন কাস্টমার হয়েছে। দু’সপ্তাহ আগে এখানে কী হয়েছিল, সেটা নিয়ে কলকাতার খাদ্যরসিকরা বদার্ড নয়। অশোক বলছিল, ‘এনি পাবলিসিটি ইজ গুড পাবলিসিটি।’ দেখা যাচ্ছে, কথাটা ঠিক।
রাতপাহারা নিয়ে স্টাফেরা সিরিয়াস। স্পেশালি বিনয়। সে নিজেই রোস্টার বানিয়েছে। প্রত্যেক স্টাফ সপ্তাহে দু’রাত করে জাগছে। ডুঙ্গারকে রোস্টারের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সে জোর করে শনিবার রাতে ডিউটি নিয়েছে।
শনিবার রাতে ডিউটি নেওয়ার কারণ, সেদিন পান্চে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে। সারাদিন কাজ করে সবাই হেদিয়ে যায়। ডুঙ্গারকে একা রাখা যাবে না। বিনয় বলেছে, “আমি স্যারের সঙ্গে থাকব। রাত বারোটা থেকে আড়াইটে অবধি স্যার টেনে দিন। বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
রাতপাহারায় মধুরার ডিউটি শুক্রবার আর মঙ্গলবার। ডিউটির সময় অশোক আসে। দু’জনে গপ্পো করতে করতে দিব্যি রাত কেটে যায়।
দু’সপ্তাহ পরে, শনিবার সন্ধেবেলা মধুরার টেনশান একটু কমল। রোজই কাস্টমার বাড়ছে। দুপুরের দিকে ফিশফিশ আর বিয়ারের বিক্রি মোটামুটি। সন্ধে থেকে ফ্যামিলি গ্যাদারিং শুরু হয়। কলকাতার আপমার্কেট ক্লায়েন্টের মধ্যে পান্চের নাম দ্রুত ছড়াচ্ছে। ফেসবুক পেজে কয়েকজন খাদ্যরসিক পান্চের ফুড কোয়ালিটি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে।
কাল সারারাত জাগতে হয়েছে। আজ সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে। মধুরা বেশ টায়ার্ড। রাত্তির সাড়ে এগারোটার সময় গাড়ি বার করে লেমনগ্রাসের দিকে তাকায় মধুরা। রেস্তোরাঁর বাইরে গাড়ির লাইন। অন্তত চল্লিশজন কাস্টমার খানাপিনায় মত্ত। এই মুহূর্তে পান্চে কাস্টমার আছে চারজন। কোথায় লেমনগ্রাস আর কোথায় পান্চ! ডেভিডের সঙ্গে গলিয়াথের পাঙ্গা বাইবেলেই সম্ভব। বাস্তবে নয়। নেহা কেন তাকে নিয়ে বদার্ড হচ্ছে?
লেমনগ্রাস হাইলি রেসপেক্টেড ব্র্যান্ড। সারা ভারত জুড়ে উপস্থিতি। ন্যাশনাল লেভেলে যে কোম্পানি ব্যাবসা করে, তারা বাজারে মনোপলি ধরে রাখার জন্যে এত নীচে নামতে পারে?
লেমনগ্রাসের বাইরে বিশাল এসইউভির গায়ে হেলান দিয়ে নেহা মোবাইলে কথা বলছে। নেহার পাশে এসে গাড়ি আস্তে করে মধুরা। জানলার কাচ নামিয়ে বলে, “হাই নেহা!”
ঘাড়ের কাছে কথা বলায় নেহা ভয়ের চোটে লাফিয়ে উঠল। হাত থেকে পড়ে গেল দামি ট্যাবলেট। সেটা কুড়োতে গিয়ে দাঁতের ফাঁকে বলল, “বিচ!”
মুহূর্তের মধ্যে মধুরার মেজাজ গরম! গাড়ি থেকে নেমে নেহার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “বিচ বললে কেন? ভদ্রতা জানো না?”
“ভদ্রতা কা মতলব কেয়া হোতা হ্যায়?” সরু চোখে মধুরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে নেহা, “আই অ্যাম রানিং আ বিজনেস। ডোন্ট এক্সপেক্ট মি টু বি ‘ভদ্র’ উইথ মাই কম্পিটিটার। ইট মে বি হসপিটালিটি বিজনেস, বাট ইট্স বেসিক্যালি ওয়ার। দেয়ার উইল বি লট্স অফ কেচাপ অন দ্য রোড।”
মধুরা একবার ভাবল নেহার গালে ঠাস করে থাপ্পড় কষায়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। উৎপলের গায়ে হাত তুলে যথেষ্ট কেলেংকারি বাঁধিয়েছে। আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। তবে ‘বিচ’ বলার শোধ তো নিতেই হয়। নেহার চোখে চোখ রেখে, নিখাদ বাংলায়, মা-বাপ তুলে কাঁচা খিস্তি করল মধুরা। শুনে নেহা প্রথমে ভেবলে গেল। তারপরে মুখ লাল করে বলল, “হাউ ডেয়ার ইয়ু…”
“চুপ কর কুত্তি! আর একটা কথা বললে মারব পাছায় তিন লাথ!” গর্জন করে মধুরা। নেহা ভয়ের চোটে লেমনগ্রাসের দিকে দৌড়োয়। মধুরা ফুরফুরে মেজাজে গাড়িতে ওঠে।
ভৌমিক ভবনের সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে। মধুরা স্নান আর ডিনার সেরে শুতে যাবে, এমন সময় মোবাইলের কলকলানি। মোবাইলের স্ক্রিন চেনা নম্বর দেখাচ্ছে। হাই চ্যানেলের একজিকিউটিভ প্রোডিউসার এলিজাবেথের নম্বর। ফোন কানে দিয়ে মধুরা বলে, “হাই লিজ!”
“হ্যালো মধু, তোমার ওখানে এখন রাত একটা। বিরক্ত করলাম না তো?”
“না না! আমি দেরি করে শুই। বলো।”
“মেল্টিং পট সিজ্ন ওয়ানের ফেয়ারওয়েল ডিনারের সময় তোমাকে বলেছিলাম সিজ্ন টুয়ের ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে থেকে যেতে। তুমি আমার কথা শুনলে না!”
মধুরা ভুরু কুঁচকে ভাবছে। এত রাতে খেজুর করতে লিজ ফোন করেনি। জেনুইন দরকারে ফোন করেছে। দরকারটা কী মধুরা জিজ্ঞাসা করবে না। সেটা লিজকেই বলতে হবে। তালে তাল মিলিয়ে মধুরা বলে, “হ্যাঁ… সেই…”
“আসলে ক্যামেরার সামনে একবার চলে গেলে ক্যামেরার পিছনে আসতে ইচ্ছে করে না। স্টারডম খুব অ্যাডিকটিভ।”
“সেরকম কিছু না।”
“কী করছ এখন? ওখানকার টিভিতে শো করছ?”
“না।” মনো সিলেব্লে উত্তর দেয় মধুরা। সে নিজের থেকে কোনও কথা বলবে না। যা বলার, লিজকেই বলতে হবে।
“কোনও হোটেলে জয়েন করেছ?”
“না।”
“কিছুই যখন করছ না, তখন আবার এখানে চলে এসো। আমরা নতুন একটা শো কনসিভ করেছি।”
“কী শো?”
“সঞ্জয় কপুরকে মনে আছে?”
বেশি কথা না বলার শপথ ভেঙে মধুরা বলে, “ইন্ডিয়ার এক নম্বর সেলিব্রিটি শেফকে কেউ ভোলে নাকি?”
“হাই চ্যানেলের জন্যে একটা নতুন শো কনসিভ করা হয়েছে। নাম, ‘নমস্তে ইন্ডিয়া’। সঞ্জয় ইন্ডিয়ার আঠেরোটা শহরে ঘুরবে। সেখানকার স্ট্রিট ফুড থেকে ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার, মিড্ল ক্লাস হোম স্টে থেকে রয়্যাল ফ্যামিলির খাবার, সব চেখে দেখবে। তারপর প্রতি এপিসোডে একটা ইন্ডিয়ান ডিশ নিজের স্টাইলে রাঁধবে।”
“ফ্যাব আইডিয়া! ফ্যাব! এ তোমার আইডিয়া লিজ। আমি শিয়োর, তোমার!”
“এটা হাই-এর কনসেপ্ট। আমরা সঞ্জয়ের কো-হোস্ট হিসেবে তোমাকে ভেবেছি। ইন্ডিয়ান অরিজিন হিসেবে তোমাকে রিসার্চ টিমে রাখা যেতে পারে। তার জন্যে আলাদা সম্মানদক্ষিণা আছে।”
মুহূর্তের জন্য মধুরার মাথা দুলে ওঠে। চুলের মধ্যে খেলা করে লন্ডনের ভিজে বাতাস। নাকে আসে টিপিক্যাল ব্রিটিশ ব্রেকফাস্টের গন্ধ। আবার সেই দিনে আঠেরো ঘন্টা কাজ! আবার সেই আর্লি মর্নিং মিটিং! আবার সেই লোকেশান হান্টিং! আবার কুড়ি-তিরিশজনের সঙ্গে একবছর ধরে কেরালা, গোয়া, পুনে, মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, যোধপুর, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, শ্রীনগর ঘুরে বেড়ানো! আবার শুটিং! আবার রান্না! আবার রিসার্চওয়ার্ক!
তবে এবার চেনা টার্ফ। এবার সঙ্গী হিসেবে অসম্ভব ভদ্র, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক শেফ। এত ভাল অপরচুনিটি আর হয় না! মধুরার যে কী এক্সাইটেড লাগছে!
কাজটা মধুরা নিতেই পারে। টিভিতে তাকে আবার নিয়মিত দেখা গেলে, পান্চের ওভারহেড কস্ট মেটানো যাবে। ব্যাঙ্ক ব্যালান্সে হাত পড়বে না।
পরমুহূর্তে মনে হয়, এখন সে মাইনে পায় না, মাইনে দেয়। এখন সে মাস পয়লার দিকে তাকিয়ে থাকে না। মাস পয়লায় অন্য লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন সে আর চাকুরিজীবী নয়। এখন সে ব্যবসায়ী। এখন তার পক্ষে আর অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। মধুরা ঠান্ডা মাথায় কথা সাজায়। “আমি গর্বিত যে হাই আবার আমার কথা ভেবেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অন্য একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। আমার পক্ষে সময় বার করা সম্ভব নয়।”
লিজ চুপ। মধুরা বলল, “লিজ, তুমি আমার কথা শুনতে পেলে?”
“শুনেছি মধু। তুমি কী নিয়ে ব্যস্ত জানতে পারি?”
“আমি কলকাতায় একটা রেস্তোরাঁ খুলেছি। মাত্র একমাস বয়স আমার বেবির। একে ছেড়ে অন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় লিজ!”
“থ্যাঙ্কস ফর বিয়িং অনেস্ট।” হালকা হাসে লিজ, “আমাদের কোম্পানির পলিসি হল, যদি আমাদের আমন্ত্রণ কেউ রিফিউজ করে, তা হলে ভবিষ্যতে কখনও, মাইন্ড ইট, কখনও, তাকে ডাকা হয় না। পলিসি তোমাকে জানিয়ে দিলাম। এবার ফাইনাল উত্তর দাও।”
“ফাইনাল উত্তর আমার দেওয়া হয়ে গেছে লিজ। আমার প্রায়রিটি বদলে গেছে। আমি আর টিভির কুকারি শোয়ের হোস্ট হতে চাই না। আমি সাকসেসফুল রেস্তোরাঁ চালিয়ে মানুষকে ভালমন্দ খাওয়াতে চাই।”
“আমি তোমার সাফল্য কামনা করি। টেক কেয়ার। বাই!” লিজ লাইন কেটে দিল। মধুরা ঘুমিয়ে পড়ার আগে মোবাইল সায়লেন্ট মোডে পাঠাল। আবার যদি রাত্তিরে কারও ফোন আসে! ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
মধুরা জানেও না, সে কত বড় ভুল করল!