মধুরেণ – ১১

১১

“মাসের গোড়ায় ‘সীতা অওর গীতা’ এয়েচে গো! মনে হয় ট্যাকা দেবে!” দোতলার জানলা দিয়ে নীচে উঁকি মেরে বলে সবিতা। যূথিকা চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা তুলে হাঁটুতে তেল মাখছিল। তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে বলল, “দরজা খুলে দে। বিমলকে বল দু’প্লেট মিষ্টি পাঠাতে।”

“দাদাবাবুকে ডাকব?” সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় প্রশ্ন করে সবিতা। যূথিকা বলে, “একদম নয়। এখানে এলেই তো ফুকফুক করে বিড়ি ফুঁকবে। বাপের বাড়ির কাছে আমার মানসম্মান নেই?”

কৃশানু আর দিয়া বাচ্চা দুটোকে নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞর কাছে গেছে। মধুরা মুখে ফেসিয়াল প্যাক লাগিয়ে টিটি আর বার্তা প্লাসের রিভিউ পড়ছে। এক মাস আগে পান্‌চের উদ্বোধনের খবর আজ বেরিয়েছে।

টিটির ফুড ক্রিটিক পিয়ালী লোকেশান, ডেকর, সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট, মেনু, ফুড কোয়ালিটি এবং দাম সবকিছুর উল্লেখ করেছে। ‘পকেট পিঞ্চ ফর টু’ অর্থাৎ দু’জনে মিলে খেতে কত লাগবে, এই প্রসঙ্গে লিখেছে ‘থাউজ্যান্ড রুপিজ অনওয়ার্ডস’।

বার্তা প্লাসের নবনীতা নিশিগন্ধার একটা ছবি দিয়ে দু’লাইন খবর করেছে। তবে পান্‌চের ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার উল্লেখ করেছে।

কাগজ পড়তে পড়তে কান খাড়া করে মধুরা। এখন এখানে বড়সড় বাওয়াল হবে।

ভাইভাই ধাবার হাফ মালিক যূথিকা। আইনি কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পরে ধাবার কথা সে একদম ভুলে গিয়েছিল। পান্‌চের উদ্বোধনের পরের দিন মধুরা মাকে বলেছিল, “প্রতি মাসে ধাবার লাভের অর্ধেক টাকা তোমার প্রাপ্য। টাকা চাও। নিজে থেকে কেউ দেবে না।”

“বলছিস?” যূথিকা ল্যান্ডফোন থেকে ডায়াল করেছিল অর্জুনের মোবাইল নম্বরে। প্রথম ফোনালাপ ছিল সৌহার্দমূলক। তারপর প্রতি দু’দিন অন্তর যূথিকাকে ফোনে লম্বা লম্বা ঝগড়া করতে শুনেছে মধুরা। তাতে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল, পুলিশকে খবর দেওয়ার ধমক, আইনি ব্যবস্থার চমকানি, হুমকি সবই ছিল। এতদিন বাদে সুফল ফলেছে। অর্জুন আর পিয়ালমামা না এলেও গীতা আর মিতামামি এসেছে।

“তোমার জ্বালায় তো ব্যাবসা চালানো দায় হয়ে গেল যূথিকা!” ঘটাং করে চেয়ার টেনে বসে, পচরপচর করে পান চিবিয়ে বলে খাণ্ডারনি গীতা। যূথিকা মন দিয়ে দ্য টেলিগ্রামের টেন্ডারের পাতা পড়ছিল। চোখ না তুলে বলল, “তাই?”

“হ্যাঁ ভাই। তুমি এই রকম করলে আমরা তো পথে বসব। গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না!” কাঁদোকাঁদো গলায় বলে ছিঁচকাঁদুনি মিতা।

কাগজ নামিয়ে যূথিকা বলে, “গত মাসের হিসেব এনেছ?”

মায়ের ‘নো ননসেন্স’ বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে মধুরার বেদম হাসি পাচ্ছে, কিন্তু প্যাক মাখা অবস্থায় হাসা যাবে না।

“ক’পয়সা রোজগার হয় ভাই? সারা দিনে একটা বাসও দাঁড়ায় না। লোকাল লোককে খাবার বেচে কি দোকান চলে?” মিনমিন করছে মিতা।

যূথিকা গীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্জুন রোজ বোতল নিয়ে বসে। কী খায়? দিশি না বিলিতি?”

ঝগড়ুটে গলায় গীতা বলে, “কে বলল যে আমার বর নেশা করে?”

“ফোনে অর্জুনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।”

হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ে গীতা বলে, “সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করলে পারতে!”

“করেছি। রোজ ওর একটা বিলিতি পাঁট লাগে। দিনে একশো টাকা করে হলে মাসে তিন হাজার টাকা। কোত্থেকে আসে এই টাকা?”

জোঁকের মুখে নুন পড়ল। পাশঝোলা থেকে সরু খাতা বার করে গীতা বলল, “হিসেব দেখে নাও। মদের হিসেব ওতেই ধরা আছে। তোমার ভাই বলে, লোকাল পুলিশ, পার্টির লোক, ক্লাবের ছেলে এদের নাকি হাতে রাখতে হয়।”

খাতায় হাত না দিয়ে মিতার দিকে তাকিয়ে যূথিকা বলল, “পিয়ালের কোনও নেশাই নেই। মদ সিগারেট দেখলে ওর গলা খারাপ হয়ে যায়!”

“কী আর বলব বোন,” কপালে চাপড় মারে মিতা, “নেশাভাং করলে তাও বুঝতাম! ভেবে নিতাম, একটা বোতল বা এক ছটাক ধোঁয়া গিলে পয়সা নষ্ট করেছে। কিন্তু এ তো পয়সা ঢালছে যাত্রার পিছনে। ‘লোকশিক্ষা যাত্রা সংস্থা’ নামে একটা দল আছে। পাঁচটা ঘরের-খেয়ে-বনের-মোষ-তাড়ানো বাউণ্ডুলের সঙ্গে মিলে প্রতি ছ’মাসে একটা করে পোডাকসান নামায়। সবক’টা পোডাকসানে সে-ই হিরো। কায়দা করে নিজের নাম রেখেছে কুমার পিয়াল। এদিকে একটা যাত্রার ছ’টা শো-ও হয় না। আমার বরটা হাঁদা! যাত্রার নাম দেয়, ‘রামের বনবাস’, ‘ইতিহাস কাঁদছে’, ‘কেঁদো না পিতা’। এইসব নাম কখনও চলে? মা-বোন তুলে পালার নাম না হলে কেউ দেখবে? যাত্রার নাম হবে ‘শ্বশুর বেইমান, শাশুড়ি পরেশান’; কিংবা ‘চিতায় চড়ছে চৈতালী’; কিংবা ‘কলকাতার কালকেউটে’। তবে না যাত্রা জমবে! এ তো শুধু লোসকান!”

“যাত্রায় শুনি অনেক পয়সা?”

“সে তোমাদের কলকাতার বড় কোম্পানির ভাই! আমাদের শুধু লস আর লোসকান!”

যূথিকা গীতাকে জিগ্যেস করল, “যাত্রার টাকা কি ভাইভাই ধাবা থেকে যায়?”

“তা ছাড়া আবার কী?” ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে গীতা, “আমার বরের বোতল। আর ওর বরের যাত্রা। এই দুই শত্তুর মিলে সব্বোনাশ করে দিল। লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে নিচ্ছে। গত মাসে লাভ হয়েছে দশ হাজার টাকা। তার মধ্যে তোমায় যদি পাঁচহাজার টাকা দিতে হয়, তা হলে আমরা কোথায় যাই?”

“তুমি আমায় পাঁচ হাজার টাকা দিতে এসেছ? লজ্জা করে না? তোমাদের যাত্রাপালা আমি বুঝি না ভেবেছ?” গীতাকে প্রবল দাবড়ানি দেয় যূথিকা।

মিতা ধড়ফড় করে চেয়ার থেকে উঠে যূথিকার পা ধরে বলে, “বোন, বিশ্বাস করো, ওর বেশি এক নয়া পয়সা লাভ হয়নি। তুমি জহ্লাদ হলে আমরা না খেতে পেয়ে মরে যাব।”

সবিতা দু’প্লেট মিষ্টি নিয়ে এসেছে। মিতা আবার চেয়ারে বসে চোখের জল মুছে, মন দিয়ে কমলাকান্ত আর আশাপূর্ণা খেতে লাগল। গীতা মিষ্টি না ছুঁয়ে সবিতাকে বলল, “আমি বরকে না দিয়ে খাই না। আমায় প্যাকেট করে দাও।”

যূথিকা গীতাকে ধমক দিয়ে বলল, “এটা হোটেল নয় যে প্যাকেট হবে। তুমি খাও। ভাইদের জন্য আমি মিষ্টি রেডি করে দিচ্ছি।”

মধুরার মুখের প্যাক শক্ত হয়ে গেছে। সে চেয়ার ছেড়ে উঠল। স্নান সেরে জিন্‌স আর কুর্তি পরে বেরিয়ে দেখল গীতা অ্যান্ড মিতা বিদেয় হয়েছে। মনোহর আর যুথিকা খাবার টেবিলে বসে টাকা গুনছে।

মধুরা বলল, “টাকা গোনা শেষ হলে বোলো। আমার একটা কথা আছে।”

টাকা গোনা মুলতুবি রেখে মনোহর বলল, “বলে ফেলো। তুমি কিছু বলবে শুনলেই আমাদের ভয় করে।”

“আজ অবধি এমন কিছু বলেছি কি, যাতে লজ্জায় তোমাদের মাথা নিচু হয়ে গেছে?”

“লিস্টি দিলে মহাভারত!” ফুট কাটে যূথিকা।

প্রিন্টআউটের তাড়া টেবিলে ফেলে মধুরা বলল, “পান্‌চ থেকে, সব দিয়েথুয়ে, গতমাসে আমার হাতে এসেছে দশহাজার টাকা। এর থেকে আমি তোমাদের কত টাকা দেব?”

যূথিকা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এর থেকে অনেক বেশি আয় হয়।”

মুহূর্তের মধ্যে মধুরার মাথা গরম। যূথিকার সামনে বসে, চোখে চোখ রেখে বলল, “এটা প্রথম মাস মা! এবং এটা পার্টনারশিপের ব্যাবসা। আসল লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। পান্‌চ প্রথম মাসে ব্যাবসা দিয়েছে তিনলাখ টাকার। মানে দিনে দশহাজার টাকা। ওভারহেড, স্টাফের মাইনে, অন্যান্য বিল, ইএমআই এসব মেটাতে হবে না?”

যূথিকা বলল, “কোম্পানির খবর শুনে আমি কী করব? আমি বুঝি যে, কোলাঘাটের ‘ভাইভাই ধাবা’ থেকে লাভ হয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা। কলকাতার রেস্তোরাঁ থেকে দশহাজার। আর মফস্‌সলি মিষ্টির দোকান থেকে মাসে পঞ্চাশহাজার টাকা।”

মনোহর যূথিকাকে থামিয়ে বলে, “তোর মা বরাবরের গাম্বাট। ওকে কিছু বোঝানো যাবে না। দোকানে ভাল কাজ হচ্ছে। তুই চালিয়ে যা। আর ওই টাকাটা ব্যাঙ্কে ফেলে দে। আমাদের কিছু লাগবে না।”

“ঠিক হ্যায়!” বেরোনোর জন্যে রেডি হচ্ছে মধুরা। মনোহর বলল, “এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছিস? দোকানে কোনও কাজ আছে?”

‘ওটা দোকান নয় বাবা, রেস্তোরাঁ। আর আমি এখন পান্‌চে যাচ্ছি না। অশোকের সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছি।”

সবিতা কোথায় ছিল কে জানে! হাতে ঝাঁটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে এসে বলল, “অশোক কে?”

“দ্যাট্‌স নান অফ ইয়োর বিজনেস।”

“তোমার ব্যাবসা তুমি সামলাও। নাক গলাব না। আমি জানতে চাইছি অশোক কে?” সিঁড়ির সামনে, দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে ‘যেতে নাহি দিব’ পোজে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবিতা।

পিছন থেকে যূথিকা বলল, “ছেলে পছন্দ হলে আমাদের বলে দে। বাড়ির সঙ্গে কথা বলি।”

মধুরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, “আমার ছেলেটাকে বেশ পছন্দ। ছেলেটার আমাকে পছন্দ কি না জানি না!”

হাত থেকে ঝাঁটা ফেলে সবিতা বলে, “উরিত্তারা! পুরো উলটো কেস!”

*

তিনটের সময় পান্‌চে পৌঁছল মধুরা। কেউ জানে না যে সে আসবে। তার অনুপস্থিতিতে কী হয়, জানা জরুরি।

দুপুরবেলায় কাস্টমার থাকে না। দুপুর দুটো থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত সময়কে ‘হ্যাপি আওয়ার’ ঘোষণা করা হয়েছে। হার্ডকোর মাতাল ছাড়া কেউ আসে না। এই সময়ে ড্রিঙ্কের ওপরে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ অফার চালু আছে। মাছের ফিলে আর মুসুম্বির রস দিয়ে বিনয় একটা ডিশ বানায়, যেটা মাতালরা ফিঙ্গার ফুড হিসেবে খুব পছন্দ করে। বিনয় ডিশটার নাম দিয়েছে ‘গ্রেপফ্রুট ফিশ’। ডিশটা মাতালদের মধ্যে ‘ফিশফিশ’ নামে চালু হয়ে গেছে।

মধুরা উঁকি মেরে দেখল, একজন কাস্টমার হুইস্কি আর ফিশফিশ নিয়ে বসে রয়েছে।

কিচেনে সবাইকে পাওয়া গেল। বিনয় এককোণে বসে কাগজ পড়ছে। পূজা, বাবুলাল আর মিস জোনাকি নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর করছে। অন্যান্য স্টাফরা বিশ্রামের মুডে।

মধুরাকে প্রথম খেয়াল করল বাবুলাল। চমকে উঠে বলল, “ম্যাডাম? আপনি? এখন?”

“এলে আপত্তি আছে মনে হচ্ছে?” ভুরু নাচায় মধুরা। বাবুলাল মাথা নুইয়ে বলে, “তা বলিনি। আপনি তো এই সময়ে আসেন না। তাই…”

বিনয় আর পূজার সঙ্গে কথা বলে দোতলায় যায় মধুরা। ডুঙ্গারকে বলে, “অশোকের বন্ধু, সৌমেন পাল একটা বাংলা সিনেমা বানিয়েছে। ছেলেটা উকিল। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে, কিন্তু ফিল্মপাগল। বড় ব্যানার ছাড়া, স্টারহীন কম বাজেটের ছবি বানিয়েছে। নাম ‘বুনোগাধা’। আমার এইসব সিনেমায় আগ্রহ নেই। অশোক যেতে বলল, তাই যাচ্ছি।”

ডুঙ্গার বলল, “অশোক ছেলেটা দেখতে সুন্দর, স্ট্রিট স্মার্ট, পোশাকের সেন্স ভাল, ভাল রান্না করে…”

“আমি ওকে বিয়ে করার কথা ভাবছি না।”

“ভাবতে পারিস। তোর মতো দজ্জাল মেয়েছেলের পক্ষে আইডিয়াল!”

“উফ! তুমি না!” ডুঙ্গারের পিঠে গুম করে কিল মেরে পান্‌চ থেকে বেরোয় মধুরা।

*

অশোকের সঙ্গে সিনেমা দেখা মানে খানিকটা সময় কাটানো। বুনোগাধা দেখতে দেখতে মধুরা ভাবছিল, অশোক তাকে প্রোপোজ করছে না কেন!

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে মধুরা বলল, “এবার?”

অশোক ঘড়ি দেখে বলল, “সাড়ে আটটা বাজে। স্ট্র্যান্ড রোডে ‘ওয়াটারফ্রন্ট’ নামে নতুন একটা ইটারি হয়েছে। যাবে নাকি?”

“নট আ ব্যাড আইডিয়া।” গাড়িতে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয় মধুরা। ফার্স্ট গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে গিয়ে বলে, “লোকে টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এই সিনেমা কেন দেখবে?”

“মধুরা…” ডানহাত মধুরার কাঁধে রেখে অশোক বলে, “লোকে টাকা দিয়ে গপ্‌পো-উপন্যাস কেনে। আবার কবিতার বইও কেনে। তাই তো?”

মধুরার কাঁধে কেউ যেন গরম সুপ ঢেলে দিল। কুর্তির হাতা ভিজিয়ে, চটচটে সুপ নেমে আসছে পেটে। মধুরার দম আটকে আসছে। স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে, আড়চোখে অশোকের দিকে তাকিয়ে সে বলে, “এটা কি সিনেমার কবিতা?”

“একদম ঠিক বলেছ। আমরা টালিগঞ্জ বা মুম্বইতে লিনিয়ার স্টোরি লাইন দেখে অভ্যস্ত। সেগুলো দেখে দেখে গল্পওয়ালা সিনেমার প্রতি তোমার অ্যাপেটাইট তৈরি হয়েছে। ওইসব মুভি ডিকোড করতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু সেলুলয়েডে কবিতা দেখেছ কখনও?”

মধুরার মাথায় এখন কবিতা বা সেলুলয়েড নেই। আছে সুপ। গিয়ার বদলানোর অছিলায় সে অশোকের বাঁ থাই ছুঁয়ে বলল, “আমি কবিতা বুঝি না অশোক।”

অশোক আড়চোখে মধুরার স্পর্শ করা জায়গাটা দেখল। ডান হাত মধুরার কাঁধ থেকে সরিয়ে মধুরার হাতের ওপরে রাখল। বলল, “তা হলে কী বোঝো?”

“এরকম কোরো না। অ্যাকসিডেন্ট হবে।” ফিশফিশ করে বলে মধুরা। তার গলা কাঁপছে। হাত সরিয়ে নিয়ে অশোক গুনগুন করে গান ধরল, “না তুনে সিগনাল দেখা, না ম্যায়নে সিগনাল দেখা, অ্যাক্সিডেন্ট হো গ্যয়া রব্বা রব্বা।”

মধুরা পরের লাইন গাইল। “অ্যাক্সিডেন্ট হো গ্যয়া, এগ্রিমেন্ট হো গ্যয়া, পার্মানেন্ট হো গ্যয়া রব্বা রব্বা!”

অশোক বলল, “আমি এই গানটা গেয়ে প্রোপোজ করলাম।”

“বাজে কথা বোলো না। প্রোপোজ আমি করলাম। সেকেন্ড লাইনটাতে প্রোপোজের ব্যাপারটা আছে।”

“সেকেন্ড লাইনে? কোথায়? অ্যাক্সিডেন্টের কথা প্রথম লাইনে আছে।”

“এগ্রিমেন্টের কথা তো পরের লাইনে আছে।”

“এগ্রিমেন্ট? আমি তো জাস্ট প্রেমের কথা বলতে চাইছিলাম!”

“আমি বিয়ের কথা বলতে চাইছি।”

“একেবারে বিয়ে? এখনও ভাল করে চেনাশোনা হল না। কেউ কারুর বাড়ি নিয়ে কিছু জানি না…”

“ইয়ু হ্যাভ নো অপশন ড্যুড!” স্ট্র্যান্ড রোডে গাড়ি পার্ক করে পাশ ফিরে অশোকের চুলের মুঠো ধরে নিজের দিকে টেনে আনে মধুরা। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবোয়। শার্টের ওপরে হাত বোলায়।

অশোক খাবি খেতে খেতে নিজেকে এগিয়ে দেয়। শার্টের বোতাম পটাপট খুলে মধুরাকে সাহায্য করে। নিজেও হাত বাড়ায় মধুরার কুর্তির ভিতরে।

মিনিট পাঁচেকের ভালবাসাবাসির শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে মধুরা বলে, “ভাল করে না হলেও মোটামুটি জানাশোনা হয়ে গেল। বাড়ির ব্যাপারটা কাল সেট্‌ল করব। তুমি সকাল ন’টায় চলে এসো।”

অশোক জামার বোতাম লাগাচ্ছে। “আমি কিন্তু একটা প্রেম করতাম।”

“মাত্র? আমার তিনটে প্রেম ছিল। একটা বিরাট সিরিয়াস।”

“সিরিয়াস মানে?”

“আমি শুয়েছি কি না জানতে চাইছ? অনেকবার শুয়েছি। আমার কাছে ভার্জিনিটি এক্সপেক্ট কোরো না।”

“আরে! আমি তাই বলেছি নাকি?”

“না বললেও ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দেওয়া ভাল। বাই দ্য ওয়ে, তুমি ভার্জিন তো? আমি কিন্তু ভার্জিন ছেলে ছাড়া বিয়ে করব না।”

“ছেলেদের ভার্জিনিটি বলে কিছু হয় না, মধুরা।”

মধুরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে তার মোবাইল বেজে উঠল। ড্যাশবোর্ডে রাখা মোবাইলের স্ক্রিন দেখে মধুরা অবাক হয়ে বলল, “গুরুপদ দত্ত? এর নম্বর এখনও আমি সেভ করে রেখেছি?”

“সে কে?”

“আমার প্রাক্তন প্রেমিকের বাবা। যে আমার শ্বশুর হওয়ার চান্স মিস করল।” ফোন ধরে মধুরা বলল, “হ্যাঁ কাকু!”

ও প্রান্ত থেকে গম্ভীর গলা শোনা গেল, “তুই এখন কোথায়?”

“স্ট্র্যান্ড রোডে। কেন বলো তো?”

“সিক্সটি নাইন লং শর্ট স্ট্রিটে পান্‌চ রেস্তোরাঁটার মালিক কি তুই?”

মধুরা স্পিকার ফোন অন করে বলে, “এটা পার্টনারশিপের ব্যাবসা। কী হয়েছে কাকু? তুমি কি ওখানে খেতে গিয়েছ? খাবারের কোয়ালিটি খারাপ?”

“শুভ্রর বিয়ের দিন তোকে বলেছিলাম যে আমি এখন পার্ক স্ট্রিট থানায় পোস্টেড। ভুলে গেলি?”

মধুরা অশোকের হাত খিমচে ধরেছে। “কী হয়েছে কাকু, আমাকে বলো। আমি এক্ষুনি আসছি।”

“তাড়াতাড়ি আয়।” গুরুপদ লাইন কেটে দিয়েছে।

মধুরার হাত কাঁপছে। সে অশোককে বলল, “পান্‌চে পুপ… পুলিশ এসেছে।”

“তুমি এদিকে এসো।” গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের আসনের দিকে চলে এসেছে অশোক। মধুরা গিয়ার টপকে ড্রাইভারের পাশের আসনে বসল। তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে।

অশোক গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে। ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার, আবার ফার্স্ট গিয়ার। সন্ধের কলকাতায় কুড়ি কিলোমিটার পার আওয়ারের বেশি স্পিড উঠছে না। হাওড়াগামী স্ট্র্যান্ড রোড থেকে উলটোদিকে যাওয়া টাফ টাস্ক।

ফ্লাইওভারের নীচে ঢুকে, পুলিশের হাতেপায়ে ধরে, বেরাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে, অন্য বেরাস্তা দিয়ে বেরিয়ে, ট্রাফিক সিগন্যাল টপকে অবশেষে ডালহৌসি পৌঁছয় অশোক। এসি চলছে পুরোদমে। মধুরা তাও ঘামছে। একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে। প্রথমে ডুঙ্গার।

রিং হয়ে গেল।

মিস জোনাকি।

রিং হয়ে গেল।

বিনয়, পূজা, বাবুলাল, অন্য স্টাফ…

রিং হয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি এখন মেয়ো রোডে। সামনেই পার্ক স্ট্রিট। আবার মধুরার ফোন বাজছে। আবার গুরুপদ ফোন করেছে।

“বলো কাকু।”

গুরুপদর গলা গম্ভীর। “তুই কোথায়?”

“পার্ক স্ট্রিট। আর পাঁচ মিনিট। কী হয়েছে কাকু?” প্রশ্ন করে মধুরা। গুরুপদ ফোন কেটে দিয়েছে।

পার্ক স্ট্রিটের জ্যাম টপকে লং স্ট্রিটে আসতে আরও পনেরো মিনিট। এখানেও জ্যাম। গাড়ির নয়। মানুষের। এখানে এত লোক কেন? অশোক গাড়ি নিয়ে এগোতে পারছে না। গাড়ি থেকে নেমে ভিড় টপকে পান্‌চের এনট্রান্সের দিকে এগোয় মধুরা। আশপাশ থেকে টুকরোটাকরা কথা ভেসে আসছে।

“ক্যালানো উচিত শালাদের!”

“পুরো কলকাতাকে রেন্ডিখানা বানিয়ে দিল!”

“কটা কাপ্‌ল ধরা পড়েছে?”

“কাপ্‌ল ক্যায়া বস! খুল্লম খুল্লা গ্রুপ হো রহা থা!”

কী বলছে এরা? কীসের কথা বলছে? কোন জায়গার কথা বলছে? কেন বলছে? মধুরার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সে পান্‌চের ভেতরে ঢুকতে যায়।

মধুরার হাত ধরেছে খাকি পোশাক পরা এক মহিলা পুলিশ। হাত ধরে টানতে টানতে মধুরাকে সে পান্‌চের পার্কিং জোনে নিয়ে যায়।

ওই তো ডুঙ্গার! ওই তো মিস জোনাকি! ওই তো বিনয়, পূজা, বাবুলাল… সব্বাই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। আশেপাশে গোটাবিশেক পুরুষ ও মেয়েমানুষ। ছেলেদের বয়স কুড়ি থেকে ষাটের মধ্যে। মেয়েদের, কুড়ি থেকে তিরিশ। এদের ঘিরে রয়েছে একগাদা পুলিশ। তাদের মধ্যে গুরুপদকে দেখে এগিয়ে যায় মধুরা, “কী হয়েছে কাকু?”

গুরুপদ বলল, “দশটা কাপ্‌লকে অ্যারেস্ট করেছি। মেয়েরা সবাই পেশাদার যৌনকর্মী। ছেলেদের মধ্যে পাঁচজন রেগুলার কাস্টমার। পাঁচজন ফার্স্ট টাইমার। এদের সব্বার জন্যে ইম্‌মরাল ট্রাফিকিং অ্যাক্ট লাগু হবে। রেস্তোরাঁটা ব্রথেল হিসেবে ইয়ুজ হচ্ছে, এটা তুই জানতিস?”

ব্রথেল? বেশ্যাখানা? মধুরার সাধের ‘পান্‌চ’ দেহ ব্যাবসার আখড়া? মাথায় কিছু ঢুকছে না। মধুরা ডুঙ্গারের দিকে তাকাল। ডুঙ্গারের কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। নোংরা রুমাল কপালে চেপে সে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মধুরা কাছে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

ডুঙ্গার নীরব।

মধুরা মিস জোনাকিকে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”

মিস জোনাকি মাথা নিচু করে বসেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে মধুরার হাত ধরে টানতে টানতে এক কোণে নিয়ে গেল। “বিশ্বাস কর মধু, আমি বা ডুঙ্গার কিচ্ছু জানি না। লাস্ট পেগ সার্ভ করার পরে আমি আর ও ক্যাশ নিয়ে ওপরে চলে এসেছিলাম। রোজ যেমন আসি। ঘন্টাখানেক বাদে পূজা বা বিনয় এসে চাবি দিয়ে যায়। আজ ওপরে আসার আধঘন্টার মধ্যে নীচে চ্যাঁচামিচি শুরু হল। প্রথমে ভেবেছিলাম মাতালের হট্টগোল। বাউন্সার সামলে দেবে। চিৎকার বাড়ায় নীচে নেমে দেখি প্রচুর লোক পার্কিং লট অবরোধ করেছে। গোটাপাঁচেক ছোকরা রেস্তোরাঁ ভাঙচুর করছে। আমি একটা ছেলেকে ধরতে যাওয়ায় সে আমাকে লাথি মেরে মেঝেয় ফেলে পালিয়ে গেল। ডুঙ্গার নেমে এসেছিল। ও-ও মার খেয়েছে। এই ছেলেমেয়েগুলো কোথা থেকে এল, কখন এল জানি না।”

মধুরা খেয়াল করেনি যে গুরুপদ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মধুরার হাত ধরে বলল, “আমি সব শুনেছি। কিপ কাম। মাথা ঠান্ডা রাখো।”

“কী হবে এবার?” অসহায়ের মতো বলে মধুরা। গুরুপদ বলে, “ছেলেমেয়েগুলোকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। ওদের কনট্যাক্টস আছে। ওরা ঠিক ছাড়া পেয়ে যাবে। বিপদে পড়লি তুই। আমি এই রেস্তোরাঁ সিল করতে বাধ্য হচ্ছি।”

“রেস্তোরাঁ সিল করে দিচ্ছ?” মধুরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। “এটা কী বলছ কাকু? আমার অনেক টাকার ইনভেস্টমেন্ট আছে। পান্‌চের বয়স মাত্র একমাস! পান্‌চ আমার স্বপ্ন।”

মধুরার মাথায় হাত বুলিয়ে গুরুপদ বলে, “তোর স্বপ্নের পান্‌চের কী অবস্থা, দেখে আয়!”

পা টিপে টিপে রেস্তোরাঁয় ঢোকে মধুরা। তারপর হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। এ কী অবস্থা হয়েছে?

সমস্ত দরজা আর জানলার কাচ ভাঙা। গেরুয়া আর ফুশিয়ার কম্বিনেশানে রাঙানো দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা, ‘রেন্ডিখানা’, ‘হোর হাউস’, ‘বেশ্যাখানা’। দেওয়ালে যত পোস্টার আর পেইন্টিং ছিল, সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আটটা টেবিল এবং সবকটা চেয়ারের পায়া ভাঙা হয়েছে। ফুশিয়া আর সাদা রঙের টেবিলক্লথ ছুরি দিয়ে ফালাফালা করা হয়েছে। ডাইনিং এরিয়ার প্রতিটি অংশকে খুব প্ল্যানফুলি ডেসট্রয় করা হয়েছে।

মধুরা কুকিং এরিয়ায় ঢোকে। এখানেও একই অবস্থা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আভেন, চিমনি, এসি – সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভাঙা হয়েছে ক্রকারি, কাটলারি। রান্নার বাসন তুবড়ে দেওয়া হয়েছে। ফ্যানের ব্লেড বাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত আলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

তা সত্বেও রেস্তোরাঁয় আলোর অভাব নেই। কেননা, ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ‘জবরখবর’ চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান পরিমল মন দিয়ে ছবি তুলছে। সঞ্চালক উৎপল বুম হাতে, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বকবক করছে।

মুহূর্তের মধ্যে মধুরার মাথা গরম। এরা কী করে খবর পেল? পরিমলের কলার ধরে সে বলল, “আপনি কার পারমিশন নিয়ে ছবি তুলছেন?”

গুরুপদ পিছন থেকে মধুরার হাত ধরে বলল, “মধু, না।”

মিস জোনাকি চিৎকার করে বলল, “মধু, জার্নালিস্টদের সঙ্গে মিসবিহেভ কোরো না।”

মধুরা কথা শুনলে তো! সে সপাটে চড় কষিয়েছে পরিমলের গালে। পরিমল থাপ্পড় খাওয়ার জন্যে রেডি ছিল না। ক্যামেরা বাঁচাতে গিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।

উৎপল চড় মারার দৃশ্য মোবাইলে রেকর্ড করেছে। সে পরিমলের হাত ধরে তুলল। পরিমলের ক্যামেরা এবার মধুরার দিকে। সাপের ফণার মতো ঝিকোচ্ছে ফ্ল্যাশ। মধুরার দিকে বুম বাড়িয়ে উৎপল বলল, “পান্‌চের ট্যাগলাইন ছিল ‘ওয়াইন। ডাইন। সিক্সটি নাইন।’ আপনি সত্যি সত্যিই সিক্সটি নাইনের ব্যবস্থা রেখেছেন?”

মধুরা চুপ।

উৎপল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, “লং স্ট্রিটের নতুন রেস্তোরাঁ পান্‌চ থেকে কুড়িজন পুরুষ ও নারীকে অসামাজিক কাজকর্মের জন্য গ্রেফতার করেছে পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাত্র এক মাস আগে উদ্বোধন হওয়া এই রেস্তোরাঁয় প্রথম দিন থেকেই অশালীন কাজকর্ম চলত। নিত্যনতুন মেয়েদের এখানে ঢুকতে ও বেরোতে দেখে স্থানীয় বাসিন্দারাই থানায় যোগাযোগ করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক হলেন মধুরা ভৌমিক, যিনি স্কুপ চ্যানেলের কুকিং রিয়ালিটি শো পাঁচফোড়ন, সিজ্‌ন ওয়ান-এ চতুর্থ স্থান দখল করেছিলেন। এই মধুরা ভৌমিকই হাই চ্যানেলের ফুড শো, মেল্টিং পট সিজ্‌ন ওয়ান-এর হোস্ট ছিলেন।”

এইরকম লজ্জাজনক মুহূর্তে সবাই মুখে কাপড় চাপা দেয়। মধুরা দিল না। সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা একটা চক্রান্ত। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।”

“এলাকার মানুষ বলছে যে এই বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে দেহ ব্যাবসা চলছে। ইনফ্যাক্ট, আপনার পার্টনার, মিস জোনাকিকে নিয়ে অতীতে নানা বিতর্ক হয়েছে। আপনি সে সম্পর্কে কিছু জানেন?”

দাঁতে দাঁত চেপে মধুরা বলে, “আমি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।”

“আপনার আর এক পার্টনার, মিস্টার ডুঙ্গারমল পারেখের পারিবারিক জীবনেও নানা বিতর্ক আছে। এলাকার মানুষের বক্তব্য, মিস্টার পারেখ আর মিস জোনাকি মিলে এই ব্রথেল চালাতেন।”

“আমার এই বিষয়ে কোনও বক্তব্য নেই।” রাগে ফুঁসছে মধুরা। যে-কোনও মুহূর্তে আবার তার হাত চলবে।

“আপনি চিত্রসাংবাদিক পরিমলকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করেছেন। এই নিয়েও নিশ্চয় আপনার কোনও বক্তব্য নেই?”

মধুরার কাঁধে অশোকের হাত। সে মৃদু চাপ দিল। যেন বলতে চাইল, মাথা ঠান্ডা করো।

মধুরা দু’বার ডিপ ব্রিদ করল। ঠান্ডা মাথায় বলল, “আমি এর জন্যে আন্তরিক ভাবে লজ্জিত, দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আমি যা করেছি ভুল করেছি।”

পরিমল ক্যামেরা অফ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে উৎপল। পান্‌চ এখন অন্ধকার।

লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে সবকিছু কিনতে। কত পরিশ্রম হয়েছে এই রেস্তোরাঁ বানাতে। কত মেধা ব্যয় হয়েছে ‘ব্র্যান্ড পান্‌চ’ তৈরি করতে। সব কিছু পাঁচ মিনিটের গুন্ডামিতে নষ্ট হয়ে গেল।

নিজেকে শক্ত করে মধুরা। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গুরুপদকে বলে, “কাকু, আমার সুনাম গেছে যাক। কিন্তু এই গুন্ডামির পিছনে যার হাত আছে, সে কে আমি জানতে চাই।”

গুরুপদ বলল, “আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দে। আমি এই কুড়িজনকে গ্যারেজ করে আসছি।”

পরিমল ক্যামেরা বাগিয়ে রেডি। রেডি উৎপলও। পুলিশ কুড়িটা ছেলেমেয়েকে ভ্যানে তুলছে। ছেলেরা মুখে রুমাল চাপা দিয়েছে। মেয়েরা ওড়না। একগাদা পাবলিক স্লোগান দিচ্ছে, “ভদ্রপাড়ায় নোংরামি চলবে না!” “রেস্তোরাঁর আড়ালে দেহ ব্যাবসা চলবে না!” “পান্‌চের মালিক মধুরা ভৌমিক দূর হটো!”

সার্কাসটা চলল মিনিট দশেক। দুই প্রিজন ভ্যান ভরতি করে কুড়িজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে পুলিশ চলে যেতেই সব ভোঁভাঁ। স্লোগান দেওয়ার পাবলিক উধাও, জবরখবরের পরিমল আর উৎপল উধাও।

মধুরার মাথায় এখন একমনি পাথর বসানো। কোনও রকম অনুভূতি কাজ করছে না। অশোক তার হাত ধরে রয়েছে। অশোকের হাতে হাত রেখে সে পার্কিং স্পেসে এল।

ডুঙ্গার মাথা নিচু করে বসে। মিস জোনাকি ডুঙ্গারের কপালের ক্ষতয় ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে। গুরুপদ আর বাবুলাল নিচু গলায় কথা বলছে। পূজা চেয়ারে বসে মোবাইলে গুজগুজ করছে।

মধুরাকে ডেকে নেয় গুরুপদ। বলে, “এখানে বোস। এ কী বলছে শোন।”

“কী?” চেয়ার টেনে বসে জানতে চায় মধুরা।

বাবুলাল হাঁউমাউ করে কেঁদে বলে, “আমার কোনও দোষ নেই ম্যাডাম। এই কাজ না করলে আমার চাকরি থাকত না।”

মধুরা কিছু বুঝতে পারছে না। সে বলল, “কী কাজ?”

বাবুলাল বলল, “ডুঙ্গার স্যার আর জোনাকি ম্যাডাম ওপরে চলে যাওয়ার পরে আমি বাইরের দরজা খুলে দিয়েছিলাম। বাউন্সার আর অন্য স্টাফেদের কুকিং এরিয়ায় ডেকে নিয়েছিলাম। আমি আর কিছু জানি না।”

ডুঙ্গার উঠে দাঁড়িয়ে থপথপ করে এগিয়ে এসে বলল, “আমি বুঝেছি। মেয়েগুলো আর ওদের কাস্টমারদের আগে থেকে ফিট করা ছিল। বাবুলাল গেট খুলে কিচেনে আসতেই ওরা পার্কিং প্লেসে ঢুকে পড়ে।”

“পান্‌চের ল্যান্ডফোন থেকে পার্ক স্ট্রিট থানায় ফোন কে করেছিল? বাবুলাল, তুমি?” প্রশ্ন করে মিস জোনাকি।”

“না ম্যাডাম। আমি করিনি।” বাবুলাল কাঁদছে।

ডুঙ্গার বলল, “তুই বললি যে এই কাজ না করলে তোর চাকরি থাকত না। কেন বললি?”

“থট ফর ফুডের নেহা ম্যাডাম অফিশিয়াল কনফার্মেশান দেননি। বলেছেন এই কাজটা করে দিলে পার্মানেন্ট করে দেবেন!”

“থট ফর ফুডের মালিক নেহা পারেখ? আমি সেখানকার দুজন স্টাফকে রিক্রুট করেছি?” দাঁতে দাঁত চিপে বলে মধুরা।

বিনয় হঠাৎ তেড়ে আসে। বাবুলালের গালে ঠাস ঠাস করে দুই থাপ্পড় মেরে বলে, “হারামি! নেমকহারাম! যার নুন খাস তার সব্বোনাশ করতে লজ্জা করে না? তুই তো থট ফর ফুডে চলে যাবি। পান্‌চ বন্ধ হয়ে গেলে আমার কী হবে?”

বিনয় আরও মারত। মিস জোনাকি তার হাত টেনে ধরে। বিনয় চিৎকার করে বলে, “মায়ের জন্যে মাসে এক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। বাবা স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ফিজিয়োথেরাপির জন্যে মাসে আরও দু’হাজার। ভাইটা নেশা করে পড়ে থাকে। অনেক কষ্টে এই কাজটা জুটিয়েছিলাম। আমার ফ্যামিলির কিছু হয়ে গেলে তোকে খুন করব কুত্তা!”

বাবুলাল সবাইকে চমকে দিয়ে এক দৌড়ে পার্কিং স্পেস থেকে বেরোয়। মধুরা চিৎকার করে, “ধর! ধর!”

বিনয় আর পূজা বাবুলালের পিছনে দৌড় লাগায়।

গুরুপদ চেঁচিয়ে বলে, “আমার কাছে ওর অ্যাড্রেস আছে। ওকে ধরতে প্রবলেম হবে না। কিন্তু ওকে ধরে হবেটা কী?”

“আমি নেহা পারেখের এগেন্সটে মামলা করব।” হুমকি দেয় মধুরা।

ডুঙ্গার বলল, “দোষ আমার মধু। এত কম টাকায় কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে…আমার বোঝা উচিত ছিল।”

“বোঝোনি কেন? তুমি না বাই বার্থ ব্যাবসায়ী? এইসব জিনিস আমি তোমাকে শেখাব?” ঝাঁঝিয়ে ওঠে মধুরা।

গুরুপদ বলে, “তোদের একবার থানায় যেতে হবে মধু।”

“আমাদের? থানায়? কেন?” মধুরা অবাক।

“তুই, মিস জোনাকি আর মিস্টার ডুঙ্গারলাল পারেখের বিরুদ্ধে একগাদা এফএইআর লঞ্চ হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা নন বেলেব্‌ল আইপিসি আছে।”

“আইপিসি? নন বেলেব্‌ল?” মধুরা ঘামছে, “আমার কি জেল হবে?”

“সেটা হবে না। রাত্তিরে মেয়েদের কাস্টডিতে নেওয়ার অনেক লাফড়া আছে। তুই তাড়াতাড়ি উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ কর।”

“আমি অলরেডি করেছি।” পাশ থেকে বলে অশোক। “আমার বন্ধু সৌমেন পাল হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। সে অলরেডি থানায় পৌঁছে গেছে।”

“থ্যাঙ্কস অশোক,” মিস জোনাকির চোখে কৃতজ্ঞতা, “আমি না হয় রাতে থানায় থেকে যাব। কিন্তু এই লোকটা পারবে না।”

পুলিশের জিপে উঠল গুরুপদ, মিস জোনাকি আর পূজা। মধুরা এসইউভির ড্রাইভারের সিটে বসল। পাশে বসল ডুঙ্গার। সে অল্প অল্প হাঁফাচ্ছে। পিছনের আসনে অশোক আর বিনয়। গভীর রাতের ফাঁকা পার্ক স্ট্রিট দিয়ে এক মিনিটের মধ্যে থানায় পৌঁছে গেল সবাই।

পার্ক স্ট্রিট থানার সামনেটা কিন্তু ফাঁকা নয়। এখানে রয়েছে জবরখবরের পরিমল আর উৎপল। অন্যান্য বাংলা নিউজ চ্যানেলও চলে এসেছে। এসে গেছে সেই স্লোগান বাহিনী। তারা স্লোগান দিচ্ছে, “ভদ্রপাড়ায় নোংরামি চলবে না!” “রেস্তোরাঁর আড়ালে দেহ ব্যাবসা চলবে না!” “পান্‌চের মালিক মধুরা ভৌমিক দূর হটো!”

একাধিক মুভি ক্যামেরার লেন্স, মাইকের বুম মধুরার এসইউভির দিকে ধেয়ে এল। মধুরা গাড়ি থেকে নামতেই ঝলসে উঠল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ভিড় ঠেলে মধুরা পার্ক স্ট্রিট থানায় ঢুকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *