মধুরেণ – ১০

১০

সকাল সাড়ে সাতটার সময় নারায়ণ বেরা বাজার করতে বেরোবে বলে দরজা খুলে মধুরাকে দেখে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আবার কী ঝামেলা পাকাতে এলেন?”

“আগের বার এসে ঝামেলা পাকিয়েছিলাম নাকি?” তম্বি করে মধুরা।

“পাকাননি? গোলাবাড়ি থানার কনস্টেবলকে কী সব ভুলভাল বলেছিলেন। সে সুমিত স্যারকে রিপোর্ট করেছিল।”

গোলাবাড়ি থানার অফিসার ইন চার্জ সুমিত ঘোষালকে দিব্যি মনে আছে মধুরার। সিন্ধুঘোটকের মতো ঝুপো গোঁফ আর বিয়ার বেলি না থাকলে ছেলেটাকে ভালই দেখতে!

“সুমিত ঘোষালের নাম্বার আমার কাছে আছে। ফোন করে কড়কে দিচ্ছি, দাঁড়ান।” নারায়ণকে অভয় দিয়ে সুমিতকে ফোন করে মধুরা। নারায়ণের ভিজিটিং কার্ডের পিছনে সুমিত নিজের নাম্বার লিখে দিয়েছিল। মধুরা সেই নম্বর মোবাইলে সেভ করে রেখেছে।

ফোন ধরে সুমিত বলল, “ম্যাডাম, নমস্কার! মোক্ষম সময়ে ফোন করেছেন। আপনার কথাই হচ্ছিল।”

বাজে পিকআপ লাইন। মধুরা মুখ বেঁকিয়ে হাসে। এক্ষুনি যদি সে চেপে ধরে জানতে চায়, কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, কেন হচ্ছিল— তা হলে তোতলাবে। মধুরা বলে, “নারায়ণবাবুর কাছে এসেছিলাম। ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। অবশ্য আপনারা যা ব্যস্ত!”

“আপনি পিলখানায়? আরে বাঃ! পাঁচ মিনিট দাঁড়ান। আমি আসছি।”

উফ! কী ইগারনেস! মধুরা লাইন কেটে দেয়। আসুক সুমিত। ততক্ষণে নারায়ণের সঙ্গে কথা সেরে নেওয়া যাক।

রেস্তোরাঁর ফায়ার লাইসেন্স নিয়ে মধুরার সমস্যা শুনে নারায়ণ বলল, “একটা প্রেয়ার লিখে, সব ডকুমেন্ট অ্যাটাচ করে অফিসে টাকা জমা করুন। দিনকয়েক বাদে আমাদের লোক ইন্সপেকশানে যাবে। সব কিছু ঠিক থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে কাগজ পেয়ে যাবেন।।”

“আপনি করে দিন প্লিজ!” ফায়ার লাইসেন্স সংক্রান্ত ফাইল নারায়ণের হাতে গুঁজে দেয় মধুরা। নারায়ণ বিরক্ত হয়ে বলে, “নিজের কাজ নিজে করুন। মিড্‌লম্যান ধরার অভ্যেস বন্ধ করুন।”

“নারানদা প্লিজ!” লোকটার হাত ধরে করুণ মিনতি করে মধুরা।

“আচ্ছা দিন। করে দেব।” ব্যাজার মুখে বলে নারায়ণ।

“আপনার নম্বর আমার কাছে আছে। নেক্সট উইকে ফোন করে নেব। কেমন?” নারায়ণকে টাটা করে রাস্তার দিকে তাকায় মধুরা। ছয়ফুটিয়া সুমিত বুলেট চেপে এদিকেই আসছে।

সিন্ধুঘোটকের মতো গোঁফটা সুমিত কামিয়ে ফেলেছে! বিয়ার বেলিও গায়েব! সুমিতকে খুব হ্যান্ডসাম আর সেক্সি লাগছে। মধুরা অবাক হয়ে বলল, “কী করেছেন মশাই! পুরো শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি!”

সুমিত নাকের নীচে হাত চাপা দিয়ে লাজুক হেসে বলল, “গোঁফ কামিয়ে বাজে লাগছে, না?”

“আগের থেকে হাজার গুন ভাল লাগছে। পুরো হিরো!” ফিচেল হাসে মধুরা। পুলিশ লজ্জা পেলে কী কিউট লাগে!

সুমিতের আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মধুরার সময় নেই। গাড়ি হাঁকিয়ে সে রওনা দিয়েছে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে। অশোক কর্মকারের অফিসে।

অশোক কর্মকার! মধুরা ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। এবং, হেড ওভার হিল্‌স ইন লাভ।

কিন্তু অশোককে নিজের অনুভূতির কথা বলে উঠতে পারছে না মধুরা। কী বোকা বোকা ব্যাপার! এসব তো উত্তম আর সুচিত্রার মধ্যে হত। তাই বলে এখন? নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকে?

প্রেমে পড়ার কথা ভেবে ভীষণ লজ্জা পায় মধুরা। গাল আর কানের লতি লাল হয়ে ওঠে। পেটের মধ্যে প্রজাপতি ফড়ফড় করে। সে পাগল ফাগল হয়ে যাবে না তো? একবার সাইকায়াট্রিস্টের কাছে যাবে নাকি?

হাওড়া ব্রিজ পেরোতে পেরোতে ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখে মধুরা। সকাল সাড়ে আটটা। অশোক বলেছে ন’টার সময় অফিসে থাকবে।

ব্র্যাবোর্ন রোড ফ্লাইওভারের নীচে গাড়ি পার্ক করা খুব ঝামেলার কাজ। যে ছোকরা পার্কিং-এর টিকিট ধরায়, সে প্রশ্ন করল, “কতক্ষণ থাকবেন?”

“একঘন্টা ম্যাক্স।” গাড়ি থেকে নেমে, ছোকরার হাত থেকে টিকিট নিয়ে বলে মধুরা।

ছোকরা বলে, “দশটার পরে এলে গাড়ি বার করতে কালঘাম ছুটে যাবে।”

টিকিট নিয়ে হাঁটা লাগায় মধুরা।

ব্রাবোর্ন রোড আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউকে জুড়েছে সরু একফালি রাস্তা। যার নাম আর্মেনিয়ান স্ট্রিট। দু’দিকের ফুটপাথ দখল করে বসে আছে হকারের দল। জুতো পালিশ, তেলেভাজা, ছাতুগোলা, আইস গোলা, লটারির টিকিট, টাকা থেকে রেজগি, ঘটিগরম— কী নয়! তাদের ওপাশে, প্রতিটি বাড়ির গায়ে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি। সেখানে আর একদল লোক করেকম্মে খাচ্ছে। সেলুন, মিষ্টির দোকান, ভুজিয়া, পাপড়ি চাট, অনলাইন ট্রেডিং, ডিটিপি–ল্যামিনেশান-স্পাইরাল বাইন্ডিং, ঘাগরা চুন্নির এমব্রয়ডারি… যাকে বলে আলপিন টু এলিফ্যান্ট।

এই এলাকার বাড়িগুলো হয় উনিশ শতকের বাবুদের তৈরি প্রাসাদ, নয় সেই সময়ের আশেপাশে বাংলায় ভাগ্যান্বেষণে আসা বানিয়াদের হাভেলি। দু’রকমের বাড়িই সময়ের নিয়মে নিজের জাত খুইয়েছে। বাবুর প্রাসাদ বা বানিয়ার হাভেলি চার হাত ঘুরে এখন অবাঙালি উদ্যোগপতির হাতে। একতলার বারান্দায় প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসা মুটেমজুররা সকালে গামছা পরে স্নান করে, রাতে নীলসাদা ডোরাকাটা আন্ডারউইয়্যার পরে, লিট্টি আর চোখা খেয়ে শুয়ে পড়ে।

লম্বাচওড়া ঘরগুলোকে কাঠের পার্টিশান দিয়ে মৌমাছির চাকের মতো খুপরি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে অজস্র অফিস। মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে এখানে টেবিল-চেয়ার-টেলিফোন নম্বর ভাড়া পাওয়া যায়।

আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের মাঝামাঝি একটি বহুতলের নাম ‘ঝগড়া কোঠি’। পাঁচতলা বাড়ির স্থাপত্যে প্রাসাদ বা হাভেলির ছাপ নেই। গত শতকের তিরিশের দশকের আশেপাশে, রাজগড়িয়া ফ্যামিলি এই কোঠি তৈরি করে। লোকে বলে, কোঠিতে এত জোরে ঝগড়া হত যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোঠি তাক করে জাপানিরা বোমা ফেলেছিল। সেই বোমা হাতিবাগানে গিয়ে পড়ে।

ঝগড়া কোঠির দোতলার বারান্দায় সারসার দরজার মধ্যে যে দরজাটা সেগুন কাঠের তৈরি, সেটাই অ্যাডনেটের অফিস। দরজার সামনে পৌঁছে মধুরা মোবাইলে সময় দেখল। ন’টা বাজতে পাঁচ। সে একটু আগে এসেছে। তবে অফিস খোলা। অশোক রাত জেগে কাজ করেছে।

চুল ঠিক করে, পুঁচকি আয়নায় নিজেকে মেপে নিয়ে কলিং বেল টেপে মধুরা। আবার তার কান আর গাল লাল হতে শুরু করছে। আবার পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ছে। কী ঝামেলা বাবা! উফ!

বারমুডা, টিশার্ট, হাওয়াই চপ্পল পরা অশোক দরজা খুলল। চোখে রাত জাগার ক্লান্তি। বলল, “ম্যাটার ল্যাপটপে রেডি আছে। আপনি দেখুন। আমি ততক্ষণে ধোপদুরস্ত হই।”

মধুরা আড়চোখে অশোকের পা দেখে নিয়েছে। খেলোয়াড়ের ওয়েল মাসল্‌ড পা। কাফ মাস্‌লের ভলিউম দেখে বোঝা যায়, এ লম্বা রেসের ঘোড়া। মধুরা হতাশ হয়ে ভাবল, সানগ্লাস পরে এলে আর একটু পা দেখা যেত। ধুস!

ক্যাবিনেট থেকে জামাপ্যান্ট আর টাওয়েল বার করে বাথরুমের দিকে এগোয় অশোক। ল্যাপটপ নিজের দিকে ঘুরিয়ে মধুরা অ্যাডনেটের বিজ্ঞাপনের স্ট্র্যাটেজি দেখতে থাকে।

পান্‌চ-এর লোগো এবং ক্যাচলাইন নিয়ে ডুঙ্গার, মিস জোনাকি আর মধুরার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রেন স্টর্মিং করেছে অশোক। পুরাণ, পপুলার ফিকশান, ফোটোগ্রাফ, পেইন্টিং, ক্যালেন্ডার আর্ট, সিনেমা, টিভি সিরিয়াল যাবতীয় রেফারেন্স নিয়ে কথা হয়েছে। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হয়েছে ফিউশান ফুডের কনসেপ্ট, টার্গেট অডিয়েন্স, বাজেট, মিডিয়া।

ফাইনাল লোগোটা চমৎকার হয়েছে। গেরুয়া আর ফুশিয়া রঙের কম্বো। হরফ নির্বাচনেও ফিউশান আছে। ক্যাচলাইন হল, “ওয়াইন। ডাইন। সিক্সটি নাইন।”

শীল ম্যানশনের পোস্টাল অ্যাড্রেস আর যৌনতার সিক্সটি নাইন পোজিশান নিয়ে এই পান বেশ ইন্টারেস্টিং।

অশোক বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। স্নান করে, শেভ সেরে, জিন্‌স-টিশার্ট-স্নিকার পরে, গালে বুনো গন্ধের আফটার শেভ লাগিয়ে। মধুরার মাথা ঝিমঝিম করছে। ছেলেদের পারফিউম নিয়ে তার কোনও ধারণা নেই।

মধুরা জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্র্যান্ডের গন্ধ মেখেছেন?”

মধুরার সামনে বসে ল্যাপটপ নিজের দিকে ঘুরিয়ে অশোক বলে, “ফ্লেক্সের ডিজাইন পছন্দ হল?”

শয়তানটা ব্র্যান্ড বলল না! মনে মনে রেগে গেছে মধুরা। কিন্তু এখন রাগ দেখানো যাবে না। সে বলল, “এত বড় হোর্ডিং দেওয়ার জন্যে ভালই গ্যাঁটগচ্চা হবে।”

“কলকাতার মেইন দশটা পয়েন্টে হোর্ডিং দিতে খরচ হবে…” ল্যাপটপের ক্যালকুলেটরে মাসিক ভাড়ার হিসেব কষছে অশোক। মধুরা আবার ঘ্রাণ নিল। বৃষ্টির পরে এইরকম জংলা গন্ধ আসে। ছোটবেলায় রাজচন্দ্রপুরের মাঠে খেলতে গিয়ে এই গন্ধ পেত সে।

“দেখুন, প্রজেক্টের টোটাল বাজেটের থার্টি পার্সেন্ট অ্যাডে খরচা করা উচিত। আপনি দোকান খুলে বসে রইলেন আর খদ্দের এল না, এই রকম ব্যাবসা করার কোনও মানে হয় না। বড় হোর্ডিং না চাইলে ছোট হোর্ডিং দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে খরচা কমবে, কিন্তু দশটার বদলে কুড়িটা জায়গায় থাকবে। ভিজিবিলিটি বাড়বে।”

আর একবার ঘ্রাণ নেয় মধুরা। “প্রিন্ট মিডিয়ায় অ্যাডের কী হবে?”

“টেলিগ্রাম আর আনন্দবার্তা ছাড়া অন্য কোথাও দেওয়ার দরকার নেই। আপনি যে ক্লায়েন্ট খুঁজছেন এই দুই কাগজে অ্যাড দিলে তাঁরা জেনে যাবেন।”

“ওদের অ্যাডের রেট বড্ড হাই।”

“কিছু করার নেই। টেলিগ্রামে কোয়ার্টার পেজ অ্যাডের ম্যাটার এইটা,” ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দেখায় অশোক, “আনন্দবার্তায় ওই টাকায় আরো ছোট অ্যাড যাবে। ছোট জায়গায় ভিজিবিলিটি বাড়ানোর জন্য আমি টিজার বানিয়েছি। এই যে…”

মধুরা দেখল, গেরুয়া আর ফুশিয়া রঙের প্যানেলে সুকুমার রায়ের আঁকা হাঁসজারুর ছবি। পাশে লেখা, ‘হাঁস ছিল সজারু ব্যাকরণ মানি না। হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না।’ নীচে লেখা, ‘ফিউশান কাকে বলে এই নিয়ে কনফিউশান? দেব এক পান্‌চ!”

অন্য টিজারে বকচ্ছপের ছবির পাশে লেখা, “বক কহে কচ্ছপে বাহবা কি ফুরতি। অতি খাসা আমাদের এই বকচ্ছপ মূর্তি।” নীচে লেখা, ‘ফিউশান কাকে বলে এই নিয়ে কনফিউশান? দেব এক পান্‌চ।”

এই রকম তিনটে টিজার। মধুরার পছন্দ হল।

“আমি আজ থেকে আউটডোরের কাজ শুরু করছি। সামনের সোমবার থেকে পরপর ছ’দিন কাগজে অ্যাড যাবে, টিভিতে স্পট যাবে, রাস্তায় হোর্ডিং যাবে। উদ্বোধন শনিবার, তাই তো?”

পান্‌চের উদ্বোধনের কথা মাথায় আসতেই মধুরার মাথা থেকে প্রেমভাব উড়ে গেছে। সে বলল, “আমাকে এবার উঠতে হবে। ওদিককার কী অবস্থা কে জানে!”

“জোনাকিদি আছে তো। আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি বরং আমার পেমেন্ট নিয়ে ভাবুন। কিছু টাকা পেলে কাজটা এগোত…”

“কত?”

“আপাতত ফর্টি পারসেন্ট দিন।”

আহা রে! বেচারি! মধুরার মায়া হয় অশোকের জন্য। ক’টা টাকার জন্য রাত জেগে কাজ করেছে। ব্যাগ থেকে চেকবুক বার করে খসখস করে চেক লিখে অশোকের হাতে ধরিয়ে কেজো গলায় মধুরা বলে, “কাজ শুরু না হতেই ফর্টি পারসেন্ট? আপনি তো মশাই মানুষ মারবেন! আপাতত টুয়েন্টি পারসেন্ট দিলাম। দু’দিন যাক। কেমন রেসপন্স দেখি, তারপর বাকি কথা।”

ব্রাবোর্ন রোড ফ্লাইওভারের নীচ থেকে গাড়ি উদ্ধার করে লং স্ট্রিটে এল মধুরা। রেস্তোরাঁর ইন্টিরিয়রের কাজ প্রায় শেষ। গোটাদশেক মিস্ত্রি মিলে গত এক মাস ধরে শীল ম্যানশনের ভোল বদলে দিয়েছে। সামনের বাগান ঢেকে দিয়ে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডুঙ্গারের বক্তব্য, রেস্তোরাঁয় ওপ্‌ন স্পেস রাখলে মানুষ প্রকৃতি দেখতে শুরু করে। খেতে চায় না।

এখন পার্কিং করা হচ্ছে না, ভবিষ্যতে হবে। একতলার হলঘর ডাইনিং এরিয়ায় রূপান্তরিত। একপাশে কিচেন আর সার্ভিস এরিয়া। অন্য পাশে ওয়াশরুম। বড় ছোট মিলিয়ে আটটা টেবিল আর পঞ্চাশটা চেয়ার। দেওয়াল, টেবিল, চেয়ার, আপহোলস্ট্রি, মেনিউ কার্ড সর্বত্র গেরুয়া আর ফুশিয়ার কম্বিনেশান।

মধুরাকে অবাক করে দিচ্ছে বিনয়। পিংলার ছোকরা একের পর এক ফিউশান ফুডের ডিশ ডেলিভারি করছে। সবাই খেয়ে ‘ওয়াহ্‌ ওয়াহ্‌’ করছে। ওয়াসাবি আলু টিক্কি, পারস্নিপ রিসোটো উইথ গরম মশলা, স্পাইসি কর্ন সালসা, নুড্‌ল সামোসা এই সব খাবার কলকাতার ফুড ম্যাপে এখনও আসেনি। শেষপাতে গুলাব জামুন চিজকেক বা চকোলেট রসমালাইয়ের জবাব নেই। পান্‌চের ফুড কোয়ালিটি নিয়ে নিশ্চিন্ত মধুরা।

বাবুলালও জয়েন করেছে। বিরাট গালপাট্টাওয়ালা লোকটা অনেক কাজ করে দিচ্ছে। পূজা আর অন্য স্টাফেরাও দিব্যি কাজ করছে।

শীল ম্যানশনের একতলায় একটা অফিস বানিয়েছে মধুরা। সারাক্ষণ সেখানে বসেই তদারকি করে। দুপুরে খেতে ওপরে যায়। বিনয়ের রান্না ডুঙ্গার আর মিস জোনাকির সঙ্গে ভাগ করে নেয়।

অফিসে এসে একের পর এক মিটিং, ফোনাফুনি, মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি, কখন যে দিন শেষ হয়ে গেল, মধুরা বুঝতেও পারল না। রাত ন’টায় ডুঙ্গার আর মিস জোনাকিকে টাটা করে গাড়ি চালিয়ে যখন ভৌমিক ভবনে ফিরল তখন শরীরে কিছু নেই। সামান্য কিছু খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে মধুরা। এবার কালকের প্রস্তুতি…

ফোন বাজছে! অশোক ফোন করেছে।

মধুরা ঠিক করল, একটু ঘ্যাম নিতে হবে। ফোনটা ধরবে না।

রিং শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মনে মনে একশো গুনল মধুরা। তারপর রিংব্যাক করল।একবার রিং হতেই ফোন ধরেছে অশোক।

“হ্যালো, আপনি ফোন করেছিলেন? আমি স্নান করছিলাম।” নিরাসক্ত গলায় বলে মধুরা।

“সকালে আমার স্নানের সময় আপনি আমাকে বিরক্ত করেছেন। এখন আপনার স্নানের সময় আমি আপনাকে বিরক্ত করলাম। শোধবোধ!”

মধুরার কান আবার গরম! বুকের বাঁদিকে আবার ছ্যাঁকছোঁক! সে প্রচণ্ড কেজো গলায় বলল, “কাজের কথা বলুন।”

“আচ্ছা!” হতাশ হয়ে বলে অশোক, “ইনগরেশানের দিন মিডিয়াকে নেমন্তন্নর কাজ সেরে ফেলেছি। তবে আপনাকে পারসোনালি কয়েকটা জায়গায় ফোন করতে হবে। ডিটেল মেল করেছি।”

মেলটাই দেখছে মধুরা। টিভি চ্যানেলের ফুড বেস্‌ড শো ধরে ধরে ইনভিটেশান করা আছে। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে যেসব শো হয়, তাদেরকেও নেমন্তন্ন করেছে। দ্য টেলিগ্রামের সাপ্লিমেন্ট ‘টিটি’ এবং আনন্দবার্তার সাপ্লিমেন্ট ‘বার্তা প্লাস’কে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। অন্যান্য ইংরিজি কাগজের মেট্রো সেকশানেও ইনভিটেশান গেছে।

সেলেব্রিটি গেস্টের লিস্টে নাম রয়েছে স্কুপ চ্যানেলের নন ফিকশান শো পাঁচফোড়ন-এর ডিরেক্টর অর্ণব, হোস্ট জিজা, তিন বিচারক শেফ মিজান চৌধুরী মনু, শেফ ও ফুড রাইটার আব্রাহাম সেন এবং অভিনেত্রী নিশিগন্ধা সেনগুপ্তর।

“আপনার কোনও সাজেশান আছে?” জানতে চাইছে অশোক।

“আমি আরও একজনকে নেমন্তন্ন করতে চাই। মেরি ডিকুনহা।”

“অ্যাড্রেস আর কনট্যাক্ট নাম্বার?”

“আমি ফোন করে নেব।”

“ওকে! কাল থেকে তা হলে অ্যাডের ব্লিৎজক্রিগ শুরু হচ্ছে।” ফোনের ওপার থেকে সেক্সি হাসে অশোক। মধুরার ক্লান্তি মুহূর্তের মধ্যে উধাও। আড্ডা মারার মুডে সে বলে, “কী করছেন, এখন?”

“শুনতে ভাল লাগবে না। ব্যাচেলার ছেলেরা বাড়ি ফিরে যা যা করে সেসব কথা শোনার নয়।”

“তাই?” গলার আওয়াজে এক চিমটে রহস্য এনেছে মধুরা। “খুব খারাপ কিছু নির্ঘাত?”

“খুব খারাপ। লোকে জানলে জুতোপেটা করবে।”

“এত খারাপ? ইস!”

“আপনার কাছ থেকে কত টাকা পাব হিসেব করছি। কালকেই তাগাদা দিতে হবে তো!” ফটাং করে লাইন কেটে দিয়েছে অশোক।

*

হইহই করে চলে এল পান্‌চের উদ্বোধনের দিন। গত কয়েকদিনে কাগজে এবং টিভিতে দেখা গেছে অশোকের তৈরি টিজার। বকচ্ছপ, হাতিমি, হাঁসজারুর ছবির পাশে লেখা, ‘ফিউশান কাকে বলে এই নিয়ে কনফিউশান? দেব এক পান্‌চ!’

কলকাতার বিভিন্ন রাস্তার ক্রসিং-এ ঝুলছে ঝকঝকে ফ্লেক্স। তাতে লেখা, “ওয়াইন, ডাইন, সিক্সটি নাইন।” দু’রকম বিজ্ঞাপনেই প্রোডাক্টের নাম লেখা নেই। মিল বলতে গেরুয়া আর ফুশিয়া রঙের কম্বিনেশান।

অশোক তার ল্যাপটপ থেকে ফেসবুক পেজ আর টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলেছে। টুইটার অ্যাকাউন্টে ফলোয়ার দশজন। কিন্তু ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। পান্‌চ নিয়ে মার্কেটে বাজ বা হইহই শুরু হয়েছে।

শনিবার সকালবেলা মনোহর আর যূথিকাকে প্রণাম করে মধুরা বলল, “আজ ওপেনিং। রাতে না ফিরলে চিন্তা কোরো না। ওখানে এনাফ শোওয়ার জায়গা আছে।”

মনোহর আনন্দবার্তা পড়তে পড়তে বলল, “পান্‌চের অ্যাড খুব সুন্দর হয়েছে।”

মধুরা কাগজ উলটে দেখল। গেরুয়া আর ফুশিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা, ‘ফিউশান ফুডের নতুন ঠিকানা। পান্‌চ! সিক্সটি নাইন লং স্ট্রিট, কলকাতা।’

মধুরার মাথায় হাত রেখে মনোহর বলল, “আমি যখন ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার শুরু করেছিলাম, তখন একটা টালির চালা, একটা শোকেস, একটা উনুন আর কিছু হাঁড়িকুড়ি ছিল। কাঁচামাল আসত ধারে। মিষ্টি বিক্কিরি হলে ধার মেটাতাম। বিমল আর তোর মাকে পেয়েছিলাম, তাই বেঁচে গেলাম। রোজ রাতে আমরা প্ল্যান করতাম, নতুন কী বানাব? রসগোল্লা, পানতুয়া আর সন্দেশ খেয়ে বাঙালির জিভে কড়া পড়ে গেছে। সেই জিভে অন্য কী দেব? তোর মা বলেছিল কমলাকান্তর কথা। কমলাভোগের মধ্যে একফোঁটা চকলেট। আমি ভেবে বার করেছিলাম আশাপূর্ণা। জলভরা তালশাঁসের ভিতরে তালের রসের এসেন্স। এও তো ফিউশান ফুড, না রে?”

মনোহরের গলা কাঁপছে। চোখে জল। “ব্যাবসা করে তোদের মানুষ করলাম। তিনতলা বাড়ি করলাম। তবু ভয় যায় না। মনে হয়, মেয়েটা চাকরি করুক। বিয়েথা করে সংসার করুক। আমরা এমন কেন রে?”

মনোহরকে জড়িয়ে ধরে মধুরা বলে, “তুমি ঘরপোড়া গোরু বাবা। তোমার শ্বশুর ধাবা মালিক হয়েও চায়নি যে ময়রার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হোক। তোমাকে ভালবাসার অপরাধে আমৃত্যু মায়ের মুখ দেখেনি। লোক খাওয়ানোর ব্যাবসাকে তুমি ভয় পাও বাবা।”

যূথিকা ফুট কাটল, “নাটক না করে এবার এগোও।”

বাবা মাকে প্রণাম করে, দাদা বউদিকে টাটা করে, রসগোল্লা আর পান্তুয়ার গাল টিপে নীচে নামে মধুরা। আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম।

*

সবার প্রথমে এল মেরি ডিকুনহা। শুভ্রর বিয়ের দিন যে মেরিকে দেখেছিল মধুরা এই মেরি তার থেকে আলাদা। রোগা হয়ে গেছে, কালো হয়ে গেছে, দুর্বল হয়ে গেছে। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে গেছে বলে মাথায় উইগ পরেছে। কিন্তু প্রাণশক্তি যায়নি। সাদা রঙের একটা শাড়ি পরেছে, যার গায়ে ডিজিটাল প্রিন্টের লালনীল রিকশা আঁকা। ওয়াকিং স্টিকও লাল রঙের। একগাল হেসে মধুরাকে বলল, “কেমন আছিস?”

মধুরা বলল, “খুব ভাল। আমার নতুন ভেনচার কেমন লাগছে?”

“দিব্যি হয়েছে। জোনাকি আর ডুঙ্গার কোথায়?”

“তুমি এদেরকেও চেনো?”

“আমাদের সময়ে কলকাতার নাইটলাইফ খুব ছোট ছিল। সবাই সবাইকে চিনত।”

মিস জোনাকি এগিয়ে এসেছে, মেরিকে জড়িয়ে ধরল। মিস জোনাকি মধুরাকে বলল, “আরও গেস্ট আসছে। তুই ওদের দেখ। আমি মেরিকে ডুঙ্গারের কাছে নিয়ে যাই।”

মিস জোনাকির কথার মধ্যে অর্ণব, জিজা, আব্রাহাম আর মিজান ঢুকল। টিটির তরফে পিয়ালী আর বার্তাপ্লাসের তরফে নবনীতা এসেছে। জবরখবর চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান পরিমল আর অ্যাঙ্কর উৎপলও চলে এসেছে। এদের সঙ্গে ঢুকল অশোক।

পূজা আর বাবুলাল সবাইকে আপ্যায়ন করে বসাচ্ছে। ডুঙ্গার এক কোণে বসে খর দৃষ্টিতে পুরো রেস্তোরাঁয় নজর রাখছে। তার পাশে মেরি।

মধুরা নিজের হাতে প্রথম ডিশ নিয়ে এল। টেবিলে রেখে বলল, “ফিউশান ফুড নিয়ে কলকাতার লোকের বেশ কনফিউশান। হাতের কাছে যা পাচ্ছে, মিশিয়ে দিয়ে বলছে, এটাই ফিউশান ফুড। পোস্তর সঙ্গে পাস্তা মেশাচ্ছে, পেস্তার সঙ্গে পোস্তো মিশিয়ে বলছে, এটাই ফিউশান ফুড। সব জিনিস যে সবার সঙ্গে যায় না, এটা কে বোঝাবে? কে বোঝাবে, যে এদের ডিএনএ আলাদা। এরা মিলবে না! এমন দু’জনকে পরস্পরের কাছে আনতে হবে, যাদের মধ্যে অগ্নিসাক্ষী রেখে মিলন হবে। একে অপরের গুণ বাড়িয়ে দেবে। ডিমের সঙ্গে নিম মেশালে, পাঁঠার সঙ্গে পিঠে মেশালে কলকাতার লোক খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাবে।”

মধুরার কথার মধ্যে নিশিগন্ধা সেনগুপ্ত ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে টিভি আর কাগজের ক্যামেরাওয়ালারা পোজিশান নেওয়ার জন্য গুঁতোগুঁতি শুরু করল। টলিউডের এক নম্বর হিরোইন কুড়ি মিনিটের অ্যাপিয়ারেন্সের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে। পুরোটাই অ্যাডভান্স। এবং ক্যাশ।

নিশিগন্ধা পুরোদস্তুর প্রফেশনাল। মধুরাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে কথা বলল, যেন রোজ দু’বেলা দেখা হয়! রেস্তোরাঁর এক্সটিরিয়র, ইন্টিরিয়র, ফার্নিচার, লাইট অ্যারেঞ্জমেন্ট, ক্রকারি, কাটলারি, মেনু সিলেকশান, সব নিয়ে আলাদা আলাদা বাইট দিল। বড় চ্যানেলকে বেশি, ছোট চ্যানেলকে কম। টিটি এবং বার্তা প্লাস ইন্টারভিউ নিল। কুড়ি মিনিটের বদলে আধধন্টা থেকে বেরিয়ে গেল নিশিগন্ধা। রেস্তোরাঁয় যেন ঝড় বয়ে গেল।

মধুরা খুশি। নিশিগন্ধার পারফরম্যান্সের পরে বেশি কথা বলার দরকার নেই। সে বলল, “আজকের প্রথম ডিশ, দুই বাঙালি খাবারের মেলবন্ধন। আপনারাই বলুন কেমন হয়েছে।”

“কী নাম?” জানতে চাইল মেরি। সবার আগে তার প্লেটে খাবার ঢেলে মধুরা বলে, “ডিমের মালাইকারি।”

ধবধবে সাদা প্লেটে সোনালি ঝোলের কারিকুরি। নারকেলের দুধ সর্ষের তেলে মিশে তৈরি করছে অসাধারণ আলোকসজ্জা, যা ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। ডিমের কুসুমের হলুদ আর অ্যালবুমিনের সাদা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। দুটো সবুজ আর দুটো লাল লঙ্কা ফচকে ছোঁড়ার মতো উঁকিঝুঁকি মারছে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনে, জিরে আর গরমমশলা মিলে গন্ধের নহবত বসিয়েছে।

মেরি এক চামচ ঝোল মুখে দেয়। মধুরার হার্ট বিট বাড়ছে। মেরি কী বলবে? কেমন হয়েছে পান্‌চের প্রথম ডিশ? প্রথম কাস্টমারের অভিজ্ঞতা কেমন?

মধুরা পাশ? না ফেল?

মেরি চামচ দিয়ে একটুকরো ডিম কেটে মুখে দিয়ে বলল, “অপূর্ব হয়েছে! একেবারে মেড ফর ইচ আদার!”

মিস জোনাকি আর ডুঙ্গার হাততালি দিচ্ছে। মধুরা কান্না চেপে সবার প্লেটে ডিমের মালাইকারি সার্ভ করতে করতে বলল, “আপনারা খান। আমি পরের ডিশ নিয়ে আসছি।”

অশোক পাশ থেকে বলল, “মে আই হেল্‌প ইউ?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *