মধুরেণ সমাপয়েৎ

মধুরেণ সমাপয়েৎ

হঠাৎ কলকাতার রাত্রি হয়ে উঠল বিভীষিকা৷

ব্ল্যাক আউটের অন্ধকার যে ভয়াবহ সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ কেবল ভয়াবহ নয়, মারাত্মক!

তৃতীয় শ্রেণির মাসিক পত্রিকায় পদ্য প্রেরণ করা যাঁদের একমাত্র পেশা, তাঁরা যখন কলকাতার আকাশে অর্ধচন্দ্র দেখে শিবনেত্র হয়ে কবিত্বের স্বপ্নচয়নের চেষ্টা করছিলেন, তখন শূন্যে হল জাপানি উড্ডীয়মান নৌকার উদয় এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী উপহার লাভ করল কতিপয় মুখর বোমা৷ এক দিন নয়, পর পর তিন দিন!

নবাব মীরকাশিমের যুগে বাংলা দেখেছিল শেষ যুদ্ধ৷ তারপর থেকে কিছু কম দুই শতাব্দী ধরে বাঙালির সঙ্গে যুদ্ধের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে কেবল পুঁথিপত্র বা সংবাদপত্রের ভিতর দিয়ে৷ চায়ের সঙ্গে যুদ্ধের তর্ক যেমন মুখরোচক, তেমনই নিরাপদ৷ অনভ্যাসের ফলে বাঙালিরা ভুলে গিয়েছিল, একদা তারাও আবার যুদ্ধে মরতে পারে৷

কলকাতার উপরে শেষ অগ্নিবৃষ্টি করেছিল নবাব সিরাজদ্দৌলার সেকেলে কামান৷ তারপর সেদিন আচম্বিতে যখন আকাশচারী খ্যাঁদা জাপানিরা কলকাতার বুকে আবার নতুন অগ্নিবাদল সৃষ্টি করে গেল এবং কয়েকজন বাংলার মানুষ যখন বিনা নোটিশে হাজির হল গিয়ে পরলোকে, তখন সারা কলকাতা হয়ে গেল ভীত, চকিত, হতভম্ব৷ ভাবল, এ আবার কীরকম যুদ্ধ বাবা! আগেকার লড়াইয়ে কত লোক মরত রণক্ষেত্রে গিয়ে৷ কিন্তু এ-যুদ্ধে শয়নগৃহে ঢুকে স্ত্রীর আঁচল ধরে শয্যায় শুয়েও দস্তুরমতো খাবি খেতে হয়! এমন যুদ্ধের কথা তো রামায়ণ-মহাভারতেও লেখে না৷

তা লেখে না৷ সুতরাং সুখশয্যায় নিরাপদ নয় এবং বাইরের রাস্তা নাকি ততোধিক বিপজ্জনক৷ যুদ্ধ এসেছে কলকাতার মাথার উপরে৷ অনভ্যস্ত বাঙালির পিলে গিয়েছে চমকে৷ শহরবাসীরা ব্ল্যাক আউটকে তুচ্ছ করে রাতে পথে পথে করত বায়ুসেবন৷ কিন্তু তিন দিন জাপানি বোমার চমকদার ধমক খেয়ে সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই রাজপথকে করল প্রায় বয়কট৷

গ্যাসপোস্টের আলোগুলো জ্বলে না, ‘জ্বলছি’ বলে মিথ্যা ভান করে৷ দোকানদাররা তাড়াতাড়ি ঝাঁপ তুলে দিয়ে সরে পড়ে৷ থিয়েটার, সিনেমা ও হোটেল বা রেস্তোরাঁরও সামনে নিবিড় অন্ধকার যেন দানা পাকিয়ে থাকে৷ বাদুড় ও প্যাঁচারা কলকাতার উপর দিয়ে ওড়বার সময় মনে করে, এমন খাসা শহর দুনিয়ায় আর কোথাও নেই৷ এবং গুণ্ডা, চোর ও পকেটমারের দল মনেপ্রাণে জাপানের খ্যাঁদা নাকগুলোর মঙ্গলকামনা করে বেরিয়ে পড়ে পথে-বিপথে৷

এমনই সময়ে-অর্থাৎ জাপানিরা শেষ যে-রাতে কলকাতায় বোমা ছুড়ে গেল ঠিক তার পরদিনই, তিন বন্ধু-অটল, পটল ও নকুল হঠাৎ এক বিচিত্র ঘটনার আবর্তে গিয়ে পড়তে বাধ্য হল৷ অতঃপর সেই ইতিহাসই বলব৷

আহিরিটোলা অঞ্চল৷ ঘুটঘুটে কালো রাত-জুতোর কালির চেয়ে কালো৷ চারিদিক সার্কুলার রোডের গোরস্থানের মতো নিস্তব্ধ৷ শহরের সমস্ত লোক যেন মরে গিয়েছে৷ কিংবা এ যেন কোনো পরিত্যক্ত ও অভিশপ্ত নগরের মৃত পথ৷ গত রাত্রে ঠিক এই অঞ্চলেই একটি বোমা পথের উপরে এসে পড়ে পক্ক দাড়িম্বের মতো বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তাই এদিককার গৃহস্থদের কেউ আর দরজার বাইরে পা বাড়াতে রাজি নয়৷ পাড়ার বার-ফটকা ডানপিটে ছেলেরাও বাইরের নাম মুখে আনছে না আজ৷

কিন্তু এমন রাতেও পরস্পরের গলা ধরাধরি করে, তিনজোড়া জুতোর শব্দে রাজপথকে চমকিত করে এগিয়ে আসছে অটল, পটল ও নকুল-জনৈক রসিক যাদের নাম দিয়েছে ‘গৌড়বাংলার থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’৷ ব্যাপার কী? তাদের কি প্রাণের ভয় নেই?

না৷

আজকাল আহারের নিমন্ত্রণ পেলে শেয়ালের মতো কাপুরুষও হয়ে ওঠে সিংহের মতো সাহসী৷

বাজার যা আক্রা! আগেকার সস্তার দিনে বাড়িতে দুই শত লোককে খেতে ডাকলে অন্তত শতকরা পঁচিশ জন নিমন্ত্রণ রক্ষা করত না৷ কিন্তু এখন? দুইজনকে আহ্বান করলে সাড়া দেয় চারশো জন! মাছ-মাংস, তরি-তরকারি, দুধ-ঘি-তেল সমস্তই অগ্নিমূল্য! যাদের আয় মাসিক একশো টাকার মধ্যে (এবং এই শ্রেণির লোকই বাংলা দেশে বেশি), তারা তো মাছ-মাংস, লুচি বা সন্দেশ-রসগোল্লা প্রভৃতির স্বাদ ভুলেই যেতে বসেছে৷ এমন অবস্থায় বিনামূল্যে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সদ্ব্যবহার করবার নিমন্ত্রণ পেলে সে-সুযোগ ত্যাগ করে না কোনো নির্বোধই৷

আহিরিটোলা অঞ্চলের কোনো উদার বন্ধু পোলাও কালিয়া কোপ্তা কাবাব ও ফাউলকারি প্রভৃতি খাওয়াবার লোভ দেখিয়েছিলেন৷ সে লোভ ত্যাগ করা অসম্ভব৷ তাই উদরের সম্মান রক্ষার জন্যে প্রাণ হাতে করে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল আজ, অটল, পটল আর নকুল৷

অবশ্য কেউ যেন না মনে ভাবেন যে, আমরা অটল-পটল-নকুলকে উদর-পিশাচ বলে অভিহিত করতে চাইছি৷ মোটেই নয় মশাই, মোটেই নয়৷

বন্ধুবর কেবল ভুঁড়ি-ভরা ভুরিভোজনেরই লোভ দেখাননি, সেইসঙ্গে এ লোভও দেখিয়েছিলেন, তাঁর বাড়িতে আজ রীতিমতো জলসার আয়োজন৷ আসর অলংকৃত করবেন দুম-তা-নানানা খাঁ, সা-রে-গা-মা সাহেব ও গিটকিরি মিঞা প্রমুখ গাইয়েরা এবং ধেড়ে-কেটে-তাক সিং ও দি-রি-দা-রা-দা-রা আলি প্রমুখ বাজিয়েরা৷ যাকে বলে আকর্ষণের উপরে আকর্ষণ- নৈবেদ্যের উপরে চূড়া-সন্দেশ৷

আমাদের অটল-পটল-নকুল সংগীতকলার একান্ত ভক্ত৷ তুচ্ছ দু-চারটে বোমার ভয়ে এমন বিমল আনন্দকে ত্যাগ করবার ছেলে তারা নয়৷

অটল বলল, ‘দুম-তা-নানানা খাঁ যখন তান ধরে তাল ঠোকেন, তখন পেশাদার পালোয়ানরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে যায়! এমন গাইয়ে আর হবে না৷’

পটল সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল, ‘আমরা পালোয়ান নই৷ তাকে সহ্য করতে পারব তো?’

নকুল বলল, ‘দি-রি-দা-রা-দা-রা আলি যখন প্রিং প্রিং করে সেতার বাজান তখন সন্দেহ হয়, ঠিক যেন তিনি পট পট করে রাগ-রাগিণীর পাকা চুল উৎপাটন করছেন৷’

পটল অভিভূত হয়ে বলল, ‘এর উপরে আর কথা চলে না৷’

অতএব তিন বন্ধু যথাসময়ে হাজির হল যথাস্থানে৷ গানের আসর ভাঙল রাত বারোটায়৷ আহারের আসর দেড়টায়৷ তারা পথে যখন বেরোল ঘড়িতে বাজল রাত দুটো৷

হোক গে অন্ধকার-তৃপ্ত উদর, চিত্তে আনন্দ৷ নকুল খানিক আগে শোনা একটি গান গাইতে গাইতে পথ চলছিল-

‘কানহা রে মেরে নাহি রে চুনহারিয়া৷’

হঠাৎ টর্চের একটা তীব্র আলোকরেখা তাদের তিন জনেরই মুখের উপর দিয়ে খেলে গেল এবং তার পরেই জাগল ফিরিঙ্গি কন্ঠের একটা ক্রুদ্ধ গর্জন!

সর্বাগ্রে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারল নকুল৷ সে ভীতস্বরে বলল, ‘মার দৌড়!’

তিন ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তিন তিরের মতো তিন মূর্তি ছুটে চলল একদিকে৷

সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক সার্জেন্ট এবং এক পাহারাওয়ালা৷ সার্জেন্ট চিৎকার করল, ‘পাকড়ো, পাকড়ো!’ (আসামি ভাগতা হ্যায়!)

পাহারাওয়ালা ছুটল৷ সার্জেন্টও৷

ব্যাপারটা এই৷ দিন দশেক আগেকার কথা৷ কলকাতার রাস্তার এক দেয়ালের গায়ে লেখা ; Commit no nuisance.

অটল বেকায়দায় পড়ে বাধ্য হয়ে সেই নিষেধ বাক্য মানতে পারেনি৷ ঠিক সময়েই সার্জেন্টের আবির্ভাব৷ সে তাকে থানায় নিয়ে যেতে উদ্যত হয়৷ অটল বাধা দেয়, কারণ থানায় যাওয়া তার পক্ষে ছিল আপত্তিকর৷ সার্জেন্ট তাকে একটা ঘুসি মারে৷ অটল মারে তাকে দুটো ঘুসি৷ এবং পটল ও নকুল সার্জেন্টের উপর চালায় আরও গোটাকয়েক ঘুসি৷ সার্জেন্ট পপাতধরণীতলে৷ তিন বন্ধুর অন্তর্ধান!

সার্জেন্ট এর মধ্যেই তাদের মুখ ভুলতে পারেনি৷ মণিহারা ফণীর মতো তার দুই চক্ষু ছিল সতর্ক৷ এমনই বোমা-ভয়-ভরা আঁধার রাতে কার গান গাইবার শখ হয়েছে, কৌতূহলী হয়ে তাই দেখবার জন্যে সে হাতের টর্চ ব্যবহার করেছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত তিন মূর্তিকে পুনরাবিষ্কার করে ফেলেছে৷

হিংস্র জন্তুর চেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে যম৷ এবং যমের চেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে বাংলা দেশের পুলিশ৷ এই হচ্ছে তিন বন্ধুর মত৷

অতএব পুলিশের কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে যাবার জন্য তিন বন্ধু কিছুমাত্র চেষ্টার ত্রুটি করল না৷

নকুল জানে, প্রথম জীবনে স্পোর্টসের দৌড় প্রতিযোগিতায় বরাবরই সে প্রথম স্থান অধিকার করেছে৷ সুতরাং একটা গরুখোর সার্জেন্ট ও একটা ছাতুখোর পাহারাওয়ালা যে দৌড়ে তাকে হারাতে পারবে না এ বিষয়ে সে ছিল নিশ্চিত৷

পটল সম্বন্ধেও সে হতাশ নয়৷ কারণ হচ্ছে, সে বাঁখারির মতো রোগা লিকলিকে৷ তাই তার নাম হয়েছে মানুষ-হাড়গিলে৷

ভয় তার কেবল অটলকে নিয়ে৷ অটলকে তারা ডাকত নরহস্তী বলে এবং ওজনে সে দুই মণ সাড়ে আটত্রিশ সের৷ একবার তেতলার সিঁড়ি ভাঙলেই সে হুস হুস করে হাঁপ ছাড়ত পাঁচ মিনিট ধরে এবং আধ মাইল রাস্তা হাঁটতে হবে শুনলেই ট্যাক্সি ডাকতে বলত৷

কিন্তু নকুলের দুশ্চিন্তা অমূলক৷ ভয় পেলে মহা মোটা হিপোপটেমাসও তার খুদে খুদে পা চালিয়ে দৌড়ে যে-কোনো মানুষকে হারিয়ে দিতে পারে৷ এবং ভয় পেয়ে পালাবার দরকার হলে যে-কোনো গুরুভার বাঙালিরও দেহ হয়ে যায় যে তুলোর মতন হালকা, আজ তার একটা চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেল!

ছুটতে ছুটতে নকুল বলল, ‘অটল পিছিয়ে পড়লে বাঁচবে না!’

ছুটতে ছুটতে পটল বলল, ‘অটল, তোমাকে নিয়েই ভাবনা!’

অটল কিছু বলল না, কিন্তু এক দৌড়ে বন্দুকের বুলেটের মতো বেগে পটল ও নকুলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল!

পটল ও নকুল এখন পুলিশের কথা ভুলে প্রাণপণে অটলের নাগাল ধরবার চেষ্টা করতে লাগল-কিন্তু অসম্ভব, সে মাটি কাঁপিয়ে ধেয়ে চলেছে যেন ঝোড়ো হাতির মতো! পটল ও নকুল চমৎকৃত৷

অটল ছুটছে, ছুটছে, ছুটছে৷ সে খালি ছুটছে না, নিজের দৃষ্টিকেও করে তুলেছে বিড়ালের মতো অন্ধকারভেদী! নইলে এই ব্ল্যাক আউটের রাতে কলকাতার শতবাধাময় পথে দৌড় প্রতিযোগিতার সফল মনোরথ হবার সম্ভাবনা অল্প৷ পিছনে ধাবমান পুলিশের দ্রুত পদশব্দ শুনতে শুনতে তারা ঢুকে পড়ল একটা গলির ভিতরে-প্রথমে অটল, তারপর নকুল, তারপর পটল৷

ছুটতে ছুটতে অটল দেখল, একেবারে ঠিক তার সামনেই পথ জুড়ে শুয়ে আছে একটা বিরাট সাদা ষাঁড়ের দীর্ঘ ছায়া৷ তখন তাকে আর পাশ কাটাবার সময় নেই, অতএব অটল বিনা দ্বিধায় অমন বিপুল বপু নিয়েও একটা চমৎকার লং-জাম্প মেরে ষাঁড়টাকে পার হয়ে গেল অনায়াসেই৷ তারপর লাফাল নকুল৷ তারপর পটল৷

সচমকে ঘুম ভেঙে গেল ষাঁড়ের৷ বিপুল বিস্ময়ে মুখ তুলে সে দেখল, তার দেহ ও মাথার উপর দিয়ে তিড়িং তিড়িং করে লাফ মেরে চলে গেল তিনটে মূর্তি! এমন কাণ্ড সে আর কখনো দেখেনি৷

নিজের ষণ্ডবুদ্ধিতে ব্যাপারটা সে তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছে, এমন সময় তার সুদীর্ঘ কর্ণে প্রবেশ করল আবার কাদের নতুন পায়ের শব্দ! সে আন্দাজ করল, এ দুরাত্মারাও হয়তো তার পবিত্র দেহের উপর দিয়ে লম্ফত্যাগ করবে৷ সে এমন অন্যায় আবদারকে আর প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়৷ ঘৃণ্য ও তুচ্ছ মনুষ্যজাতীয় জীববৃন্দকে হার্ডল রেসে সাহায্য করবার জন্যে সে ষণ্ডজীবন ধারণ করেনি৷ অতএব ভীষণ এক গর্জন করে ধড়মড়িয়ে দণ্ডায়মান হল ষণ্ডপ্রবর৷ এবং পরমুহূর্তেই ফিরে, শিংওয়ালা মাথা নেড়ে, পতাকার মতো লাঙ্গুল ঊর্ধ্বে তুলে নতুন পদশব্দের উদ্দেশ্যে হল সতেজে ও সবেগে ধাবমান৷ মুখে তার ঘন ঘন ঘাঁৎ ঘাঁৎ হুংকার৷

সেই ভীষণ মূর্তি দেখেই পাহারাওয়ালা ও ফিরিঙ্গিপুঙ্গবের চক্ষুস্থির! তারাও ফিরে অদৃশ্য হতে দেরি করল না৷

পিছনের পাপ যে বিদায় হয়েছে, তিন বন্ধু তখনও তা টের পায়নি৷ তারা তখনও ছুটছে উল্কাবেগে৷

হঠাৎ সামনে জাগল প্রায় ছয়-সাত হাত উঁচু প্রাচীর৷ কিন্তু কী ছার সেই বাধা, পুলিশকে ফাঁকি দেবার জন্যে তারা চীনের প্রাচীরও পার হতে প্রস্তুত৷

অটল আজ যেন ইচ্ছে করলে পাখির মতো শূন্যে উড়তে পারে৷ লাফ মেরে সে উঠল প্রাচীরের টঙে এবং আর এক লাফে অদৃশ্য হল প্রাচীরের ওপারে৷ তারপর একে একে পটল ও নকুল করল তার অনুসরণ৷

সেই বোমা-ভীত, অস্বাভাবিক স্তব্ধ রাতে যখন একটা সুচ পড়লেও দূর থেকে শোনা যায়, তখন নকুল ও পটল-বিশেষ করে অটলের মতো সুবৃহৎ দেহের ধুপ ধুপ ধুপ করে লম্ফত্যাগের শব্দ অন্য লোকের শ্রুতিগোচর হবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

প্রাচীরের উপর থেকে তিন বন্ধু লাফ মেরে অবতীর্ণ হল একটা অজানা বাড়ির অন্ধকার উঠানের উপরে৷

তারা কিঞ্চিৎ হাঁপ ছাড়বার চেষ্টা করছে, হঠাৎ বিকটস্বরে চিৎকার হল-‘চোর, চোর, ডাকাত!’ সঙ্গে সঙ্গে বহু কন্ঠের গোলমাল ও ছুটোছুটির শব্দ৷ সর্বনাশ, এ যে তপ্ত কড়া থেকে জ্বলন্ত উনুনে!

তিন বন্ধু আঁতকে আবার উঠল, আবার ছুটল৷ সামনেই একটা দরজা৷ ঠেলা মারতেই খুলে গেল, তারা একটা ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল৷

ওরে বাপ রে বাপ! সেখানে আবার একটিমাত্র মেয়ে-গলার ঘর-ফাটানো কী বিকট চিৎকার!

‘খুন করলে খুন করলে-ডাকাত খুন করলে গো!’

অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, শোনা যায় কেবল চিৎকারের পর চিৎকার৷

তিন বন্ধু সিকি সেকেন্ড থমকে দাঁড়াবারও অবসর পেল না৷ টাল খেতে খেতে আবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল . . .

ওদিকে চারিদিক থেকে ছুটে এল বাড়ির পুরুষরা-চাকর-বাকর, দারোয়ান৷ তাড়াতাড়িতে হাতের কাছে যে যা পেয়েছে সংগ্রহ করে এনেছে-বঁটি, কাটারি, লাঠি৷

বাড়ির কর্তা হন্তদন্ত হয়ে ঘটনাস্থলে এসে বললেন, ‘কই রে প্রমদা, কোথায় ডাকাত?’

একটি আধাবয়সি মেয়ে ঘরের কোণ ছেড়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘ওই যে দাদা, ওই যে আবার বেরিয়ে গেল গো৷’

‘কজন?’

‘এক কাঁড়ি লোক গো, এক কাঁড়ি লোক! কী সব রাক্ষুসে চেহারা, ইয়া গালপাট্টা, ইয়া গোঁফ, আর রং যেন কালি-মাখানো হাঁড়ি!’

একটি যুবক বিরক্ত স্বরে বলল, ‘কী যে বল পিসিমা, তোমার কথার কোনো মানে হয় না!’

প্রমদা কপালে দুই চোখ তুলে বলল, ‘ছেলের কথা শোনো একবার! দেখলাম এক কাঁড়ি আস্ত ডাকাত-তবু বলে, মানে হয় না!’

যুবক বলল, ‘সত্যি কথাই বলছি পিসিমা! এই ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, এর মধ্যেই তুমি দেখতে পেলে ডাকাতদের গায়ের রং কালো হাঁড়ির মতো, আর তাদের মুখে ইয়া গোঁফ আর ইয়া গালপাট্টা৷’

প্রমদা বলল, ‘নিমে, তুই তো সেদিনকার ছেলে, তুই কী করে জানবি বল? আগুনের আঁচ কি চোখে দেখে বুঝতে হয়, গায়ে লাগলেই টের পাওয়া যায় যে! ডাকাতদের চেহারা অন্ধকারেও আন্দাজ করা যায় রে, অন্ধকারেও আন্দাজ করা যায়৷’

কর্তা অধীরস্বরে বললেন, ‘চুলোয় যাক যত বাজে কথা৷ বলি ডাকাতগুলো গেল কোন দিকে?’

প্রমদা বলল, ‘ওই দিকে দাদা, ওই দিকে!’

কিন্তু সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনোদিকেই ডাকাতদের আর পাত্তা পাওয়া গেল না৷

কর্তা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘যাক গে, আপদ গেছে৷ ব্যাটারা পালিয়েছে বলে আমি দুঃখিত নই৷’

কর্তা আবার নিজের শয়নগৃহে এসে ঢুকলেন৷ তিনি বিপত্নীক৷ একলাই শয়ন করেন৷

আলো নিভিয়ে তিনি খাটের উপর গিয়ে উঠলেন৷ তারপর শুয়ে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিযুক্ত হলেন৷ কিন্তু মন যখন উত্তেজিত ঘুম সহজে আসে না৷

-‘হ্যাঁচ্চো!’

কর্তা সবিস্ময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলেন৷ তাঁর ঘরে হেঁচে ফেলল কে?

আবার-‘হ্যাঁচ্চো!’

হাঁচির জন্ম খাটের তলায়, এটা বোঝা গেল৷ কিন্তু খাটের তলায় হাঁচি কেন বাবা? কর্তা তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে পড়ে আলোর সুইচ টিপতে গেলেন৷

এবার আর হাঁচি নয়, খাটের তলা থেকে নির্গত হল মানুষের কন্ঠস্বর৷

কে বলল, ‘খবরদার!’

কর্তা ম্রিয়মান কন্ঠে বললেন, ‘খবরদার বলছ কে, বাবা?’

‘আমি৷’

‘তুমি কে, বাবা?’

‘মনুষ্য৷’

‘অর্থাৎ ডাকাত?’

‘আমরা ডাকাত নই৷’

‘ও, তাহলে তোমরা যিশুখ্রিস্ট!’

‘আমরা যিশুখ্রিস্ট নই৷’

‘উত্তম৷ তোমাদের পরিচয় জানতে চাই না৷ কিন্তু দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে এখানে কেন?’

‘পথ ভুলে৷’

‘ভুলটা বিস্ময়কর৷’

‘কিন্তু অসম্ভব নয়৷’

‘পথ ভুলে আমার খাটের তলায়? না বাপু, একথা জজে মানবে না৷’

‘খাটের তলা হচ্ছে অতি নিরাপদ ঠাঁই৷ খাসা আছি মশাই৷’

‘বুঝলাম৷ কিন্তু আমাকে কী করতে বলো?’

‘চ্যাঁচাবেন না৷ আলো জ্বালবেন না৷ আবার বিছানায় গিয়ে উঠে বসুন৷’

‘কথা যদি না শুনি?’

‘আমার কাছে ভোজালি আছে৷’

আর একটা কন্ঠস্বর বলল, ‘আমার কাছে রিভলভার আছে৷’

আর একটা কন্ঠস্বর বলল, ‘আমার কাছে বন্দুক আছে৷’

‘দেখছি, দলে তোমরা ভারী৷ কিন্তু আর কিছু সঙ্গে আননি? কামান-টামান?’

‘বিছানায় উঠলেন না? আবার ঠাট্টা হচ্ছে? আচ্ছা!’

খাটের তলায় একাধিক ব্যক্তির হামাগুড়ি দেওয়ার শব্দ শোনা গেল৷

ডাকাতরা বাইরে বেরিয়ে আসছে৷ কর্তা সুড়সুড় করে আবার খাটের উপরে গিয়ে উঠলেন বিনা বাক্যব্যয়ে৷

‘এইবার আমরা কী করব জানেন?’

‘আমার গলায় ছুরি দেবে?’

‘না৷ আপনার হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলব৷’

‘এত দয়া কেন?’

‘আমরা চাই না যে আপনি চ্যাঁচান বা আমাদের তাড়া করেন৷’

‘আমি কিছুই করব না, তোমরা নির্ভয়ে প্রস্থান করো৷’

‘আপনার কথায় বিশ্বাস নেই৷’

‘জয় গুরু!’

‘কী বললেন?’

‘জয় গুরু! বিপদে বা সমস্যায় পড়লেই-জয় গুরু বলা আমার স্বভাব৷’

‘আশ্চর্য! আমার মেসোমশায়েরও ঠিক ওই স্বভাব৷’

‘কার?’

‘আমার মেসোমশায়ের৷ আপনার গলার আওয়াজও তাঁর মতো৷’

‘আমার ভায়রা-ভাইয়ের ছেলের গলাও তোমার মতো৷ কিন্তু সে তো ডাকাত নয়৷’

‘আপনিও আমার মেসোমশায় নন৷ কারণ তাঁর বাসা বৌবাজারে৷’

‘কী বললে?’

‘এটা বৌবাজার হলে আপনাকেই আমার মেসো বলে সন্দেহ হত৷’

‘তোমার মেসোর নাম কী?’

‘চন্দ্রনাথ সেন৷’

‘বারে আমারও নাম ওই৷ আমিও বৌবাজারে থাকতাম, আজ দশ দিন হল এই নতুন বাসায় উঠে এসেছি৷’

অটল ফস করে আলো জ্বালল৷

কর্তা বললেন, ‘অটল!’

অটল বলল, ‘মেসোমশাই!’

অল্পক্ষণের স্তব্ধতা৷ কর্তা কঠিন কন্ঠে বললেন, ‘অটল, এ ব্যবসা কতদিন ধরেছ?’

অটল কর্তার দুই পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি ডাকাত নই মেসোমশাই, আগে আমার কথা শুনুন৷’

অটল একে একে সব কথা খুলে বলল৷

কর্তার অট্টহাস্যে খালি বাড়ি নয়, রাত্রির বুক পর্যন্ত যেন কাঁপতে লাগল-‘হো হো হো হো, হা হা হা হা! ওরে অটলা, আজ আমি হেসে হেসেই খাবি খাব রে! হি হি হি হি! ওরে প্রমদা, তোর গালপাট্টাওয়ালা কেলে হাঁড়ির মতন ডাকাতের মুখগুলো একবার দেখে যা রে! হো হো হো হো, হা হা হা হা হা হা . . .’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *