মধুরা নিরুদ্দেশ – সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

মধুরা নিরুদ্দেশ – সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

মধুরা মিত্র, নবম শ্রেণি, বিদ্যাসুন্দরী হাই স্কুল, হুগলি। কম্পিউটারে তৈরি করা কাগজটা ব্যাগ থেকে বার করে উলটেপালটে দেখছিলেন মায়াদি। এটা তা হলে মধুরার ব্যাগ। নাম, স্কুলের ঠিকানা সেই কথাই বলছে। ব্যাগ দিতে আসা ছেলেটিকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মধুরার বাড়িতে ফোন করলেন তিনি।

স্কুলে এখন টেন, টুয়েলভের টেস্ট চলছে। সাড়ে চারটের পরে তাঁরা কয়েকজন খাতা গুছিয়ে ঘরে তালা দিয়ে বেরোবার ব্যবস্থা করছিলেন। আর একটু পরে এলেই ছেলেটি তাঁদের পেত না। তাঁরাও ছেলেটিকে ধরতে পারতেন না।

ব্যাগটা কোথায় পেলে ? পুরনো প্রশ্নটাই আবার করছিলেন প্রতিমাদি, চুল উসকোখুসকো জামায় তালি লাগানো নেহাতই সাধারণ চেহারার ছেলেটি চায়ের দোকানে কাজ করে। বারবার নানারকম জেরার উত্তর দিতে দিতে হাঁফিয়ে উঠছিল।

“নদীর ধারে যে ডাস্টবিনটা আছে, আমাদের দোকানের সব ময়লা তো ওখানেই ফেলতে যাই। ওটার পাশে দেখি দু’-একটা কুকুর ব্যাগটা নিয়ে টানাটানি করছে। ভিতরে টিফিন কৌটোয় খাবার ছিল, গন্ধ পেয়েছে মনে হয়। ঢিল মেরে কুকুর দুটোকে তাড়িয়ে দিলাম। তারপর আপনাদের স্কুলের নাম দেখে এখানে নিয়ে এসেছি।”

“তুমি পড়তে পারো ?”

মাথা চুলকোয় ছেলেটা। “নাইন অবধি পড়েছি। তারপর বাবা মরে গেল। মা, ভাইবোনেরা সব না খেয়ে থাকবে…। তা দু’বছর হল কাজে লেগেছি। এবার আমি যাই, ব্যাগটা আপনাদের দিয়ে, দোকানের বাজার করতে হবে।”

“এক্ষুনি তো যাওয়া চলবে না।” গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢোকেন স্কুলের সেক্রেটারি নীলমাধব রায়। মধুরার পাড়ার লোক। ছেলেটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলেন, “এই মেয়েটি হারিয়ে গেছে দু’দিন হল। ওর সম্বন্ধে খবর পেলেই থানায় জানানো হচ্ছে। থানা থেকে বড়বাবু মধুরার বাবাকে নিয়ে এলেন বলে।”

রোদে পুড়ে ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। “আমি তো কিছু জানি না। শুধু ব্যাগটা পেয়ে নামটা দেখে…।”

“জানো না যে, তাই ওদের বলবে। ভয়ের কিছু নেই। আমরা তো আছি।”

নীলমাধববাবুর কথা শেষ হলে নিরুপায় ভঙ্গিতে বেচারি চেয়ারে হেলান দেয়। ঘরের অন্য মানুষগুলো চুপচাপ বসে আছে। গত দু’দিন মধুরা নিরুদ্দেশ। ঝড় বয়ে যাচ্ছে স্কুলের উপর দিয়ে। স্কুলে টেস্ট চলছে। টেন, টুয়েলভের এটাই শেষ পরীক্ষা। দুটো হাফে পরীক্ষার মাঝে, টিফিন ব্রেকের সময় নাইন আর এইটকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। ছুটিটা আগের দিনই নোটিস করা হয়। হাফ-ইয়ারলি, গার্জেন-টিচার মিটিং, অনেকগুলো ঘর লাগবে। মেয়েরা যেমন যায় তেমনই চলে গিয়েছে। চারটের পরে মধুরার গার্জেন এসে হাজির। দুটোর সময় মধুরা বাড়ি না গিয়ে গেল কোথায় ? বেশ বুদ্ধিমতী ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে। এদিক-ওদিক আড্ডা মারবে না যে দেরি হলেও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। তবু মায়াদি বলেছিলেন, একটু দেখুন, হয়তো কোনও বন্ধুর বাড়ি গিয়েছে।

না, পাওয়া গেল না কোথাও। হাসপাতাল, নার্সিংহোম সব জায়গায় খোঁজ করা হয়েছে। গেল কোথায় ? জলজ্যান্ত মেয়েটা। উবে যেতে পারে না। যদি বা একটা খবর এল, কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। স্কুলের মাঠে স্কুটারের আওয়াজ। বড়বাবুকে নিয়ে মধুরার বাবা এসেছেন, টিচারদের ফাঁকা কমনরুমে সবাইকে বসান বড়দি, ছেলেটাকে মেন্টাল সাপোর্ট দিতে হবে, মনে মনে ভাবেন তিনি, ভাল কাজ করতে এসে থানায় গেলে ওর ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। সেটা তো তিনি হতে দিতে পারেন না। বড়বাবু ঢোকেন, সঙ্গে মধুরার বাবা, আধময়লা জামাকাপড় মুখে ভরতি দাড়ি, হতেই পারে, পুরো আড়াই দিন মেয়েটার খোঁজ নেই।

বড়বাবু চেয়ারে বসা ছেলেটির মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে চেপে বসেন। তরপর ছেলেটাকে ফের সেই পুরনো প্রশ্ন করেন। “আচ্ছা এবার বল তো, ব্যাগটা ঠিক কোথায় পেলি ?”

একটা ঝকঝকে ঘরের ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে মধুরা। না শুয়ে বইও পড়তে পারত। ঘরে তাকভরতি অনেক বই। টিভি নেই। এই একটা ব্যাপারই ওকে হতাশ করেছে। বাইরের পৃথিবীর কোনও খবরই পাওয়া যাবে না। কোনও কিছু যে থাকবে না তা জানাই আছে। চোখ রগড়ে আবার চারদিকে তাকায় মধুরা, অন্য বিছানাগুলোতে তিনটি অচেনা মেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওরাও কি ওর সঙ্গেই এসেছে ?

ঘরের লাগোয়া বাথরুমে যাবে বলে উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা হঠাৎ টলে যায়। ওকে কি ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল ? তাই হবে। না হলে শুধু শুধু এত মাথা টলবে কেন ? সম্ভবত চারপাশের মেয়েগুলোকেও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এতটুকু নড়াচড়া নেই।

বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে বেশ করে জলের ঝাপটা দেয়। ঘুম অনেকটাই কেটেছে। ঘুমের ঠিক আগের অবস্থাটা কিছুতেই খেয়ালে আসছে না। এই ঘরটাও একেবারে নতুন ওর কাছে। তা হলে কি ঘুমন্ত অবস্থাতেই এখানে এসেছে ?

না, তা তো নয়। পরিষ্কার মনে আছে টিফিনে ছুটি হয়ে যেতে স্কুল থেকে বেরিয়েছিল। স্কুলের সামনের ‘ছাত্রবন্ধু’ দোকান থেকে খাতা কিনেছে। পেনের রিফিল পালটেছে। দোকানে ভিড় ছিল। পনেরো মিনিট বাদে বেরিয়ে দেখে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। গেটের সামনে দারোয়ানজি দাঁড়িয়ে। আর কেউ নেই কোথাও।

স্কুল থেকে বাড়ির হাঁটা দূরত্ব মিনিট কুড়ির। একা থাকলে অন্যদিন রিকশায় যায়। শীতকাল তাই হাঁটার ইচ্ছা হয়েছিল। জি. টি রোড-এর পাশের ফুটপাতে কাচের কাপডিশ, ফুল, রঙিন ফিতে, ক্লিপের দোকানগুলো তখন বন্ধ। প্রায় দুটো বাজে। রিকশাওয়ালারা এই সময় খেতে যায়।

গাড়িটা খুব আস্তে এসেছিল। কোনওরকম আওয়াজ ওর কানে যায়নি, অথবা ও-ই অন্যমনস্ক ছিল। গাড়ি পাশে দাঁড় করিয়ে বিনোদবিহারী লেনে কীভাবে যাবেন জিজ্ঞেস করছিলেন এক ভদ্রলোক। তারপর ঝপ করে মুখে কিছু একটা চাপা পড়ে, পরের ঘটনা আর মনে নেই।

দুইয়ে দুইয়ে চার করলে বাকিটা সহজেই অনুমান করা যায়। এই ধপধপে বিছানা আর মোটরগাড়ির মধ্যের ফাঁকটার কোনও স্মৃতি ওর নেই। তবে নিশ্চয়ই ও অজ্ঞান ছিল। না হলে যারা ওকে নিয়ে এসেছে এত সহজে তারা ছাড়া পেত না। ক্যারাটেতে স্কুলেই হলুদ বেল্ট পেয়েছিল। তারপরে ও ভরতি হয়ে শিখেছে। খুব একটা খারাপ ছাত্রী ছিল না। কিছুক্ষণ অন্তত যুঝতে পারত।

ওসব আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল মধুরা। চারপাশে যারা শুয়ে আছে সবাই ওরই বয়সি। ওরা না জাগা অবধি অন্য ব্যাপারগুলো দেখা যাক। দরজাটা ভাল করে টেনে দেখল বন্ধ আছে। জানলাগুলো ভিতরের দিকে, টানা বারান্দার দেওয়াল, দেখা যায় পরদা সরালে। বাইরের দিকে কোনও জানলা নেই, বাথরুমের জানলার গ্রিল অনেক উঁচুতে। পালানোর কোনও সুযোগ নেই। বিছানায় বসে বসে ভাবছিল কী করা যায়। ঠিক সেই সময়েই দরজার চাবি খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আর ও ঝপ করে বিছানায় গড়িয়ে দিল শরীর, একটা হাত চোখের উপর আড়াআড়ি রাখা, দেখলে মনে হবে অঘোরে ঘুমোচ্ছে বুঝি।

ঘরে ঢুকেছে দু’জন। দু’জনেই পুরুষমানুষ। গলার আওয়াজ শুনতে শুনতেই মধুরার মনে হল অন্য বিছানাগুলোর দিকে ওরা এগিয়েছে। হাতের আড়াল থেকে ওদের অনায়াসে দেখা যায়।

একজনের লম্বা পেটা চেহারা, চুল বা চেহারার গড়ন দেখে মনে হয় বয়স ত্রিশ ছাড়ায়নি। আর একজন পঞ্চাশ বা ষাটের কোঠায়। বেশ ভারিক্কি গলার আওয়াজ। কমবয়সি লোকটা ওর কথা মন দিয়ে শুনছে। মনে হয় ও-ই সবকিছু ঠিক করে থাকে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ওরা।

“ব্যবস্থা হয়ে গেছে ?”

“চলছে। টিকিট কাটা হয়েছে।”

“নামগুলো ঠিকঠাক ?”

“হ্যাঁ। ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”

“বাঃ। এরই মধ্যে ভুলে গেলে গতবছর তো ওই নিয়েই কেলেঙ্কারি হল। পাশপোর্ট রেডি ?”

“না। ওটার ব্যাপারে কথা হয়েছে। টাকাও দিয়েছি ঠিক জায়গায়, মনে হয়, হয়ে যাবে।”

“মনে হয় মানে ? হতেই হবে।”

“অন্যদিকগুলোর খবর রাখেন ? পুলিশ তোলপাড় করছে, বাজার বেশ গরম। আজকের বেশিরভাগ কাগজই কভার করেছে, এ-সময়ে ঠিকমতো গা-ঢাকা না দিতে পারলে…।”

“কী হবে ? আর তো ক’টা দিন। অপারেশন সাকসেসফুল হলে এখানে আর ফিরছি না।”

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মধুরা বুঝতে পারল লোকদুটো ঝুঁকে তাকে দেখছে। যতদূর সম্ভব স্থির হয়ে পড়ে রইল সে। খুব ভয় করছিল, ভেতরের উত্তেজনা না বাইরে বেরিয়ে আসে।

ওরা চলে যাওয়ার পরও বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজেই শুয়ে ছিল সে। দরজা লক হয়ে যাওয়ার পর সেই ঘরে শুধু ঘড়ির টিকটিক। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। মা’র মুখ, বাবার মুখ মনে পড়ছিল। প্রতিদিন দাদির কাছেই শোয়, সেদিনও দাদি বলেছিলেন, শোনো দিদিভাই, বড় হচ্ছ। রাস্তাঘাটে সাবধানে চলাফেরা করবে। কতরকম দুষ্টু লোকজন থাকে।

দাদির কথায় খুব হেসেছিল। তুমি এমন বলো-না। আমি যেন ছোট বাচ্চা, কেউ তুলে নিয়ে চলে যাবে, অবশেষে দাদির কথাই সত্যি হল।

চোখ বুজে থাকতে থাকতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। চটকা ভেঙে গেল দরজার আওয়াজে। টয়লেটের দরজা খুলছে একটি মেয়ে। আর একটি মেয়েও ওই আওয়াজে বিছানার উপর উঠে বসেছে। শুধু অঘোরে ঘুমোচ্ছে একজন। ওর ডোজটা হয়তো বেশি হয়ে গিয়েছে।

মধুরা চোখ খুলতেই ওদের সঙ্গে চোখাচোখি, মুখে কোনও কথা না বলেই বাকি দু’জন এসে চুপচাপ বসে গেল ওর বিছানায়। মধুরার মনে হল প্রবলেমটা তাকেই সলভ করতে হবে। ওরা খুব নার্ভাস প্রকৃতির। ফরসা মেয়েটি কথা শুরু করে। “আমার নাম মৌসুমী, নৈহাটিতে থাকি।” ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখিয়ে ও বলে, “ওকে বোধহয় সবার শেষে এনেছে। এখনও ঘুম ভাঙেনি।” অন্য মেয়েটির বিষন্ন ভাব মুখেচোখে ফুটে উঠেছে। কোনওরকমে উচ্চারণ করে, “আমি শতরূপা। শ্রীরামপুরের মাহেশের কাছে আমার বাড়ি।”

মধুরার দিকে দু’জনেই তাকিয়ে, ও হাসে। “আমি মধুরা, হুগলির…।”

আর কোনও কথা শুরু করার আগেই দরজার চাবি খোলার শব্দ। ঘরে ঢুকেছে একজন আধবুড়ো লোক, তার হাতে একটা বড় ট্রেতে ধোঁয়া ওঠা খাবার, চাউমিন আর চিলি চিকেন।

মৌসুমীদের মুখ শুকনো, খাবে কি খাবে না ভাবছে। মধুরাই প্রথম হাত বাড়াল। ওকে দেখেই কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করল ওরা। খাওয়া শেষ হলে লোকটা ফাঁকা প্লেট নিয়ে চলে গেল। দরজা বাইরে থেকেই লক হল আবার। আশ্চর্য ! আর-একজন তখনও জাগেনি।

মোটামুটি আলোচনায় বোঝা গেল ওদের তিনজনকেই প্রায় একই পদ্ধতিতে ধরা হয়েছে। মধুরা ছাড়া এরা কেউই জানে না এদের উদ্দেশ্য কী। সবটা খুলে বললে আরও ঘাবড়ে যাবে, তাই ওদের সম্ভাব্য বিদেশযাত্রার ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল মধুরা। কিছুক্ষণ বাদেই ওই মেয়েটিরও ঘুম ভাঙল।

ঘুমন্ত মেয়েটি উঠে বসতেই আবার খাবার এল। মধুরা এবার নিশ্চিন্ত হল, এ ঘরে কোথাও ক্যামেরা লাগানো আছে ? অন্য ঘরে বসে ওদের গতিবিধি সবই জেনে নিচ্ছে ওরা। দরজা লক হতেই সবার অনুমতি নিয়ে আলো নিভিয়ে দিল ও। তবে সে আর কতক্ষণ। দিনের আলো ফুটলে তো আর কোনও কিছুই আড়াল করা যাবে না।

নতুন মেয়েটির নাম মৌ। এসেছে উত্তরপাড়া থেকে। সবাইকে ফিসফিস করে একটা কথাই বলল মধুরা, “তোমরা বুঝেছ নিশ্চয়ই আমরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি। তবে ওই গানটা মনে আছে তো ? বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”

মধুরাদের ছবি বড় বড় করে ছাপা হয়েছে কাগজে। একই দিনে কাছাকাছি চারটি শহরের স্কুলপড়ুয়া চারজন মেয়ে নিখোঁজ। এ তো আর ভোজবাজি নয়। প্রচুর বকুনি খেয়ে পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে, তবু সুরাহা কিছুই হচ্ছে না।

এসব খবর মধুরারা জানে না। ওদের এক সপ্তাহের বন্দিজীবনে নতুন কোনও ঘটনা ঘটেনি। সেই একই ঘরে আছে। হঠাৎ ওদের তৎপরতা বেড়ে গেল। নতুন নতুন লোক ঘরে আসছে-যাচ্ছে। মধুরা বুঝল, এবার যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে।

এতদিন খাওয়ার শোওয়ার কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য রাখেনি ওরা। এমনকী পরার জন্যও দু’সেট জামাকাপড় দিয়েছে। চুল আঁচড়াবার আয়না-চিরুনি, গায়ে মাখার সাবান, পাউডার, দাঁত মাজার পেস্ট-ব্রাশ, একদম হোটেলের ব্যবস্থা।

আগে খেতে দেবার লোকটি ছাড়া নিয়মিত ঘরে আর কেউ আসছিল না। ও-ই ছাড়া জামাকাপড় নিয়ে যেত। সেদিন রাতে অন্য একজন এসে তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে হাইট মেপে নিল। মনে হয় বিশেষ কিছু পোশাকআশাক তৈরি হবে। যাবার সময় বলে গেল কোনও কারণেই ঘরের আলো নেভাবে না। ঘরের কোথায় যে টিভির ক্যামেরা লাগানো আছে, মধুরা আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি। যদিও নিশ্চিতভাবেই বুঝেছে শুধু ছবি নয় ওদের কথাবার্তাও যাতে পৌঁছে যায় সে ব্যবস্থা আছে।

আলো নেভানোর উপায় নেই। ফলে সাধারণ গল্পগুজব ছাড়া কোনও কথাই হচ্ছে না। পালাবার প্ল্যানিং বন্ধ।

মধুরা ভাবছিল যা করার তা পথেই করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না।

গাড়ির মধ্যে বসেছিল ওরা। সিস্টার রোজি, সিস্টার মেরি, সিস্টার লারা আর সিস্টার রীনা, ওদের সঙ্গে আরও একজন ফাদার আর সিস্টার আছেন। বেরোবার আগে প্রথমদিনের চোখ বুজে থাকা অবস্থায় দেখা ভদ্রলোক এসেছিলেন ওদের ঘরে। উনি বলেছিলেন খুব সংক্ষেপে তবে তার কথা বুঝতে ওদের একটুও অসুবিধে হয়নি।

“শোনো মেয়েরা, এক্ষুনি একজন মেকআপম্যান আসবেন। তিনি তোমাদের পোশাক পরতে সাহায্য করবেন। তোমাদের হাবভাব যেন নর্মাল থাকে। সঙ্গে আরও দু’জন যাচ্ছেন। তা ছাড়াও সামনে পেছনে আমাদের পাহারা আছেই। এতটুকু এদিক-ওদিক দেখলে গুলি ছুড়তে দেরি হবে না। কথাটা বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই।”

ওরা ঘাড় নেড়েছিল। “গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পর আমাদের ছুটি। তার আগে সারা রাস্তা তোমরা মুখ বন্ধ রাখবে।”

“আমরা কোথায় যাচ্ছি।” জিজ্ঞেস করেছিল মৌ। মেয়েটার বয়স বেশি নয়, সেভেনে পড়ে। “আমি জানি না,” ভদ্রলোক যথারীতি গম্ভীর।

দু’দিন ধরেই মেয়েটা মুষড়ে আছে, কিছুই খাচ্ছে না। এবার চিৎকার করে ছুটে গেল ভদ্রলোকের দিকে। ওঁর জামা চেপে ধরেছে। “দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন। প্লিজ, একটু দয়া করুন। আমরা কাউকে কিছু বলব না।”

মৌসুমী আর শতরূপা মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছে। খালি মধুরার চোখ রাগে জ্বলছে। ভাবছিল ক্যারাটের এক প্যাঁচে শয়তানটাকে শায়েস্তা করা যায়, কিন্তু লাভ কী তাতে ?

ভদ্রলোক কিছু না বলে মৌয়ের হাত থেকে জামা ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

দেওয়ালে নখের আঁচড় কেটে দিনের হিসাব রাখছিল মধুরা, জ্ঞান আসার পর, দিনদশেক কেটেছে। ওরা ওদের গন্তব্যে চলেছে।

যাওয়ার ঠিক আগেই প্রতিদিনের মতো দুধের গ্লাসের ট্রে নিয়ে এসেছিল বুড়ো মতন লোকটা, তখন ওদের সিস্টারের পোশাকে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুড়ো কোনওদিন কথা বলে না। কেন যে হঠাৎ বলে উঠল, “দুধ আর বিস্কুট খেয়ে নিন। অনেক দূর যেতে হবে।”

কী মনে হতে দুধের গ্লাস হাতে বিষম লাগার ভান করে বাথরুমে ঢুকে পুরো দুধটাই বেসিনে ফেলে দিয়েছিল ও। তারপর বেসিন থেকে জল নিয়ে চুমুক দিয়ে খাওয়ার ভান করেছে।

গাড়িতে যেতে যেতে দেখছিল শতরূপা, মৌ, মৌসুমী সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ ওর চোখে ঘুম নেই। মিছিমিছি চোখ বুজে বসে ছিল, এরকম উদ্বিগ্ন অবস্থায় ওদেরও ঘুমনোর কথা নয়। নিশ্চয়ই ওষুধের রি-অ্যাকশান।

রাস্তায় গাড়িটা একবার থেমে গেল। ফাদার ড্রাইভারকে বললেন, “এনি প্রবলেম ?”

“হ্যাঁ দেখছি।” ড্রাইভার নামল গাড়ি থেকে।

মধুরা চোখ খোলেনি, এমনকী যখন গাড়ি ঠেলার জন্য অনেক লোকজন হাজির হল তখনও চুপচাপ ছিল। ফাঁকা রাস্তায় সুযোগ নেওয়াটা ওর যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।

এয়ারপোর্টে রিপোটিং-এর পর থতমত খেয়ে গেল ওরা সকলেই। ভয় পেলেও কাঁদা চলবে না। মৌয়ের মুখ থমথম করছে, বেশ বোঝা যায় কোনওরকমে কান্না আটকাচ্ছে। চারপাশে সুসজ্জিত মানুষের ভিড়। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। লাউঞ্জের সোফায় বসে সবদিকেই নজর যাচ্ছিল ওর। যদিও শতরূপাদের ঝিমুনির সঙ্গে তাল রেখে মধুরা নিজেও ঢুলছে, তবু নজর এড়ায়নি সোফার আশপাশে বেশ কিছু মানুষ হাতে কাগজ বা ম্যাগাজিন নিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

এখানেও ক্যারাটের প্যাঁচ চলবে না। বুঝেছিল ও। এরা বেশ সংগঠিত। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। তবু কেন জানি না মধুরার মনে হল ওকে কিছুতেই ওরা নিয়ে যেতে পারবে না। পাশেই ফাদার। কিছু দূরেই শতরূপার পাশে বসে আছেন সিস্টার। বোর্ডিং কার্ড চেক হয়ে গিয়েছে। মালপত্র ওজন হচ্ছে। রানওয়ে অবধি বাস যাবে। বাসে ওঠার ডাক এখনও আসেনি। ঢুলতে ঢুলতেই ভাবছিল মধুরা এবার আকাশে উড়বে। বাবা, মা বা আর কেউ ওদের সন্ধান পাবে না।

বাসে ওঠার আগে মেটাল ডিটেকটারের মধ্যে দিয়ে যেতে হল ওদের সবাইকে। মধুরা লক্ষ করল ফাদার, সিস্টার দু’জনেই অবলীলাক্রমে গলে গেলেন। তার মানে কাছে কোনও রিভলভার বা ছোরাছুরি নেই। শতরূপা, মৌ, মৌসুমী, মধুরা চলেছে লাইন করে। সামনে ফাদার পেছনে সিস্টার, মধুরা ফাঁক খুঁজছে, দেখছে এদিক-ওদিক। সবাই এগিয়ে যেতে ব্যস্ত। সিস্টার এসে নিঃশব্দে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন।

এইবার ও বুঝতে পারল, ওর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখেছেন ওঁরা। প্লেনে পাশাপাশি সিট সবার। সবগুলো টিকিটই ফাদারের হাতে। তিনজনের বসার ব্যবস্থা। ফাদারের পাশে শতরূপা, মৌ। পরের সারিতে সিস্টার, ও আর মৌসুমী। এ ছাড়া প্লেনের ভেতর ওদের আর কোনও লোকজন আছে কি না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

বিরাট গর্জন করে চাকা গড়াতে শুরু করল। প্লেন এবার ছুটছে। দূরের ঘরবাড়ি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। প্লেন উড়তে শুরু করতেই খুব গা গুলিয়ে উঠল মধুরার। একহাতে মুখ চেপে টয়লেটের দিকে ছুটল। পিছনে সিস্টার। বাথরুমে ঢোকার আগেই এয়ার হোস্টেস এসে গিয়েছেন। যত্ন করে ওকে ধরে ঢুকিয়ে দিতে দিতে সিস্টারকে ফিরে যেতে বললেন উনি।

বম্বে এয়ারপোর্টে নামার পর মুখ বুজে চলছিল ওরা চারজন। কেবল উত্তেজনায় ফুটছিল মধুরা। এখান থেকেই আসল উড়ান শুরু হবে ওদের। এতগুলো দিন কেটে গেল। শেষপর্যন্ত মুক্তি ঘটল না।

গেটের মুখেই এবারও গাড়ি তৈরি। মৌসুমী ফিসফিস করে বলল মধুরাকে, “তোমার উপর ভরসা ছিল।” জবাবে ঠোঁট উলটে নিরুপায়ের ভঙ্গি করে ও।

বড় বড় বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। হাঁ করে শহর দেখার কথা। চওড়া রাস্তা, বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। কিন্তু গাড়ির মধ্যে নকল সিস্টারেরা মুখ নিচু করে বসে আছে। চারপাশে দেখার কোনও উৎসাহই নেই।

গাড়িটা সাদা একটা দোতলা বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢুকল। সামনে সুন্দর বাগান। নুড়ি পাথরের পথ। গাড়ি থেকে নেমে মৌয়ের হাত ধরে এগোচ্ছেন ফাদার। দারোয়ান পেছনের গেট বন্ধ করতে যাবে, হঠাৎ হুড়মুড় করে হর্ন বাজিয়ে চারটে জিপ ঢুকে পড়ল ভেতরে। জিপগুলো থেকে বেশ কিছু পুলিশ নেমেই ঘিরে ফেলল ওদের। ফাদার চট করে সরে যাবার চেষ্টা করতেই ক্যারাটের প্যাঁচে ওকে ধরাশায়ী করল মধুরা।

কিছুক্ষণ বাদে পুলিশের জিপে বাড়ি ফিরছিল ওরা। হাসি হাসি মুখে মৌসুমী জিজ্ঞেস করে মধুরাকে, “বমিটা তা হলে তোমার সত্যি সত্যি পায়নি।”

মধুরাও হাসে। “একেবারে পায়নি তা নয় তবে একটু পাওয়াটাকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটাই নাটক। বাথরুমের কাছে এয়ারহোস্টেসের দাঁড়িয়ে থাকাটা আগেই লক্ষ করেছিলাম, একটা চান্স নিয়ে নিলাম। ভদ্রমহিলা বুদ্ধিমতী, সবকিছু সুন্দর ম্যানেজ করেছেন।”

সামনে বসে থাকা পুলিশ অফিসার এবার ঘাড় ঘুরিয়ে হাসেন। “কে বেশি বুদ্ধিমতী, তা নিয়ে তর্ক করছি না। তবে এ বছরের সাহসিকতার প্রেসিডেন্ট মেডেলের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে তোমার নামটাই নমিনেশান পাবে।”

২ জুলাই ২০০৩

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *