মধুরভাব

মধুরভাব

রবিবার জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা ষষ্ঠী তিথি, ১৫ই জুন, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। (১-১০-১) শ্রীরামকৃষ্ণ গেছেন সুরেন্দ্রের বাগানবাড়িতে। সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, ঠাকুর বলতেন, সুরেশ বা সুরেন্‌দর। এই সেই ভক্ত যাঁর আর্থিক সাহায্যে কাশীপুরের বাগানবাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, পরে বরানগরের মঠ হল। সুরেন্দ্রের বাগানবাড়ি কাঁকুড়গাছিতে। সেখানে অনেক ভক্তের সমাগম হয়েছে। মাথুর কীর্তন হচ্ছে। মাথুর মানে—শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেছেন বৃন্দাবন ছেড়ে, শ্রীমতী এবং গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কাঁদছেন। কীর্তনের আসরে ঠাকুর উপস্থিত। ঠাকুর সকাল নয়টা হইতে ভক্ত সঙ্গে আনন্দ করিতেছেন। ⋯মাথুর গান হইতেছে। (ঐ)

কীর্তনিয়া প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা গাহিতেছেন। (ঐ) এই হচ্ছে নিয়ম। ‘গৌরচন্দ্রিকা’ অর্থাৎ প্রথমে শ্রীচৈতন্যদেবের সম্বন্ধে কিছু গান গাওয়া হয়, তারপরে মূল কীৰ্তন শুরু হয়। গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস করিয়াছেন (চৈতন্যদেবের সন্ন্যাসের আগের নাম গৌরাঙ্গ)— কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হইয়াছেন। তাঁর অদর্শনে নবদ্বীপের ভক্তেরা কাতর হইয়া কাঁদিতেছেন। তাই কীর্তনিয়া গাহিতেছেন— গৌর একবার চল নদীয়ায়। (ঐ)।

গৌরচন্দ্রিকার পর মূল কীর্তন শুরু হয়েছে। কীর্তনিয়ারা শ্ৰীমতীর বিরহ-অবস্থা বর্ণনা করে গান গাইছেন। কীর্তন শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। হঠাৎ দণ্ডায়মান হইয়া অতি করুণ স্বরে আখর দিতেছেন⋯। (ঐ) আখর কি? গানের একটা ভাষা আছে। সেই ভাষা ব্যবহার না করে গানের ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাঝে মাঝে নিজের একটা ভাষা সংযোজন করাকেই ‘আখর’ দেওয়া বলে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘improvisation’। ‘কথামৃতে’ অনেক জায়গায় দেখি, কীর্তন হচ্ছে আর শ্রীরামকৃষ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আখর দিচ্ছেন। ভাল আখর দেওয়া বেশ কঠিন।। যার ভিতরে খুব ভাব আছে সেই ভাল আখর দিতে পারে। ঠাকুর খুব ভাল আখর দিতে পারতেন। গানের ভাবটাকে তা আরও ফুটিয়ে তুলত। ‘কথামৃতে’ দেখতে পাই কী সুন্দর আখর দিচ্ছেন তিনি। বলছেন: সখি! হয় প্রাণবল্লভকে আমার কাছে নিয়ে আয়, নয় আমাকে সেখানে রেখে আয়। (ঐ) হয় শ্রীকৃষ্ণকে আমার কাছে এনে দে, নয়তো আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চল। ঠাকুরের শ্রীরাধার ভাব হইয়াছে। কথাগুলি বলিতে বলিতেই নির্বাক হইলেন। (ঐ) স্পন্দহীন, সমাধিস্থ। অনেকক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হলেন। আবার সেই করুণ স্বর। বলিতেছেন, ‘সখি! তাঁর কাছে লয়ে গিয়ে তুই আমাকে কিনে নে।’ (ঐ) আমি তোদের ক্রীতদাসী হয়ে থাকব যদি আমাকে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে পারিস। বলছেন: আমি তোদের দাসী হ’ব! তুই তো কৃষ্ণপ্রেম শিখায়েছিলি! প্রাণবল্লভ!’ (ঐ) নিজেকে রাধা মনে করছেন ঠাকুর, রাধা মনে করে শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কাঁদছেন। এই রাধাভাব বা মধুরভাব তখনকার দিনে অনেকেই ভাল চোখে দেখতেন না। স্বামীজী বা অন্যান্য যাঁরা পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত তাঁরা বলতেন: এই রাধা আবার কে? রাধা বলে কেউ কি ছিল? শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: দেখ বাপু, নাহয় তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম রাধা বলে কেউ ছিল না। সেটা মুখ্য নয়, সেটা গৌণ। তবে মুখ্যটা কি? রাধার যেমন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ, সেই অনুরাগটাই হচ্ছে মুখ্য। রাধা হচ্ছেন সেই অনুরাগ, সেই আকৃতি, ঈশ্বরের জন্য সেই ব্যাকুলতার প্রতীক। ঠাকুর বলছেন; রাধাকৃষ্ণলীলা মানো আর না মানো, ঐ ব্যাকুলতাটুকু মানো। ঠাকুর তো সমন্বয় করতে এসেছিলেন। সব মত, সব পথের সমন্বয় করেছেন তিনি। ধর্মজগতের এমন কোন ভাব নেই, যে ভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ সাধন করেননি। তাঁর এই যে মধুরভাবে সাধন এরও একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। তিনি নিজের জীবনে প্রমাণ করলেন যে, মধুরভাব মিথ্যে কল্পনা নয়। এ যুগেও এ সত্য, এ পথেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। মধুরভাবের প্রতি লোকের যে অশ্রদ্ধা ছিল সেটা তিনি দূর করে দিলেন। আমরা স্বামীজীকেও দেখি পরবর্তী জীবনে বলছেন: মধুরভাব মিথ্যে নয়। কামগন্ধহীন, দেহবুদ্ধিহীন এই যে অনুরাগ—এর তুলনা ইতিহাসে আর দেখতে পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিকই, সাধারণের জন্য এ পথ নয়। যতক্ষণ একটুও দেহবুদ্ধি আছে, ততক্ষণ এ বোঝা যায় না। সেইজন্য মধুরভাবের অনেক সময় বিকৃতি হয়েছে। স্বামীজী তাই বারবার সাবধান করে দিয়েছেন: যেখানে সেখানে এই মধুরভাবের কথা প্রচার করা উচিত নয় বা যেখানে সেখানে মধুরভাবাত্মক কীর্তন করা উচিত নয়—সাধারণে এর কদর্থ করবে।

আসলে রাধাকৃষ্ণলীলার মধ্যে কিন্তু অপবিত্র কিছু নেই। রাধা হচ্ছেন ভক্ত, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান, রাধা হচ্ছেন জীবাত্মা আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমাত্মা। ‘রাধা’ কথার অর্থ হচ্ছে:‘রা’ মানে লাভ করা, ঈশ্বর বা মুক্তি লাভ করা, ‘ধা’ মানে ধাবিত হওয়া—ঈশ্বরের দিকে বা মুক্তির দিকে ধাবিত হওয়া। ঈশ্বর লাভের জন্য মানুষ যখন দ্রুতগতিতে ধাবিত হয়, তখন তার যে ব্যাকুলতা, আর যে আকূতি, তারই প্রতীক হচ্ছেন রাধা। লজ্জা, ঘৃণা, ভয় সব ত্যাগ করেছি আমি। ভগবান একদিকে আর সমস্ত জগৎসংসার আর একদিকে। গোপীদের মধ্যেও দেখি এই ভাব। কৃষ্ণ আমার সর্বস্ব, কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু জানি না। কৃষ্ণ কে? না, যিনি আকর্ষণ করেন। ‘কৃষ্’ ধাতু থেকে এসেছে ‘কৃষ্ণ’। ‘কৃষ্’ ধাতুর একটা অর্থ ‘আকর্ষণ করা’। শ্রীকৃষ্ণ সকলকে আকর্ষণ করেন। তিনি চুম্বক, ভক্ত লোহা। চুম্বকের আকর্ষণ কি লোহা উপেক্ষা করতে পারে? নদী কি পারে সমুদ্রের দিকে না গিয়ে উলটো দিকে যেতে? তেমনি শ্রীকৃষ্ণ ভক্তকে নিজের কাছে টানছেন। তাঁর যে বাঁশি, এ বাঁশি কি? এ তাঁর আহ্বান, অনন্তের আহ্বান, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছেন: এস, আমার কাছে এস। সেই আহ্বান শুনে আমি ছুটে চলেছি। স্বামী-সংসার সব তুচ্ছ। লোকনিন্দা হবে, লোকে পাগল বলবে, বলবে কুলটা—যে যা খুশি বলুক, আমি কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু জানি না। শ্রীচৈতন্যের মধ্যে দেখেছি এই ভাব। তিনি নিজেকে রাধা ভাবছেন, কৃষ্ণের বিরহে কাঁদছেন। আবার ইদানীংকালে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও একই জিনিস দেখতে পাই। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য আর কান্তা—এই পাঁচটি ভাব আশ্রয় করে ভক্ত ভগবানকে চিন্তা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গভীর হচ্ছে এই কান্তাভাব বা মধুরভাব। এই ভাবের মধ্যে শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য —সব ভাব আছে। মধুরভাব সম্বন্ধে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলছেন: ‘সেই প্রেমা নৃলোকে না হয়’—এইরকম ভালবাসা আর কোথাও দেখা যায় না। শ্ৰীমতী এবং গোপীদের এই ভাব। গোপীরা শ্ৰীমতীর সখী। মধুরভাবের পরাকাষ্ঠা হচ্ছেন শ্রীমতী। যাঁরা মধুরভাবে চলেন তাঁরা সবাই শ্ৰীমতীর মতো হতে চেষ্টা করেন। শ্ৰীমতীই তাঁদের আদর্শ। তাঁরা ভাবেন যে, তাঁরা রমণী, আর শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের স্বামী। মীরাবাঈ-এর একটা গল্প আছে। মীরাবাঈ মধুরভাবের সাধিকা ছিলেন। কৃষ্ণকে তিনি স্বামী বলে জানতেন। সেই মীরাবাঈ এসেছেন বৃন্দাবনে। শুনলেন, রূপ গোস্বামী সেখানে আছেন। মীরাবাঈ রূপ গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। রূপ গোস্বামী বলে পাঠালেন: না, নারীর সঙ্গে আমি দেখা করব না।—

গোসাঞি কহেন মুঞি করি বনে বাস।

নাহি করি স্ত্রীলোকের সহিত সম্ভাষ।।

তখন মীরাবাঈ বলছেন: তাহলে আপনি কিছুই বোঝেননি, কিছুই জানেন না আপনি। যতক্ষণ আপনি নিজেকে পুরুষ ভাবছেন, ততক্ষণ বুঝতে হবে আপনি বৃন্দাবন-লীলা কিছুই বোঝেননি। একমাত্র পুরুষ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। বলছেন:

এত দিন শুনি নাই শ্ৰীমন্ বৃন্দাবনে।

আর কেহ পুরুষ আছয়ে কৃষ্ণ বিনে।।

এই হচ্ছে মধুরভাব বা কান্তাভাব—আমরা সবাই নারী, পুরুষ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ।

এই যে মধুরভাবে সাধনা, ঈশ্বরকে স্বামী ভাবা—এ কিন্তু খ্রীষ্টান ভক্তদের মধ্যেও আছে। যেসব খ্রীষ্টান সন্ন্যাসিনীদের আমরা দেখি, তাঁরা যখন সন্ন্যাসের জীবন বরণ করে নেন, শপথ নেন যখন, তখন তাঁরা এই ভাবেন যে, তাঁদের যেন যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে। এক জায়গা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: It is an essential feature of the Carmelite spirituality to consider Christ as the bridegroom of the soul ard to find in that loving union (spiritual marriage) the most perfect transformation into God. …’ অর্থাৎ এইসব খ্রীষ্টান সন্ন্যাসিনীরা খ্ৰীষ্টকে পতি জ্ঞান করেন, আর তাঁকে পতি বলে ভাবতে ভাবতে তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে যান। আবার আর একটা বইতে বলছে: ‘The veil of a Christian nun symbolizes continence in flesh and spirit, holiness to the Lord. It signifies an espousal (marriage), not that harmonious union of two unlike human beings on which conjugal happiness depends, but a far more perfect union of two unlikes—viz. of the human soul and Christ, effected by means of prayer, obedience, and the sacraments.’ খ্রীষ্টান সন্ন্যাসিনীরা মাথায় এক প্রকারের ঘোমটা পরেন। এই ঘোমটার কি অর্থ? এ একটা প্রতীক। এর দ্বারা এটাই সূচিত হচ্ছে যে, এসব সন্ন্যাসিনীরা ঈশ্বরের পাদপদ্মে আত্মনিবেদন করে শরীর ও মনের শুচিতা ও সংযমের শপথ গ্রহণ করেছেন। ঘোমটা ঐ শপথের প্রতীক। খ্রীষ্টের সতীসাধ্বী স্ত্রী তাঁরা। প্রেম, পবিত্রতা ও প্রার্থনার ভিতর দিয়ে তাঁরা খ্রীষ্টের সঙ্গে মিলিত হতে চেষ্টা করছেন। এ মিলন স্বর্গীয় মিলন। St. Teresa of Avila এইরকম একজন সন্ন্যাসিনী। ষোড়শ শতাব্দীর লোক। ইনি নিজেকে বলতেন: little flower of Christ’ —যীশুখ্রীষ্টের ফুল আমি। আবার কখনও কখনও বলতেন আমি যীশুখ্রীষ্টের বিবাহিতা নারী।

আবার মুসলমান ভক্তদের মধ্যেও এ ভাবটা দেখতে পাওয়া যায়। সুফীসাধক ফার্দৌসী, সুফী-কবি আবু সায়েদ, ওমর খৈয়াম প্রমুখের জীবনেও আমরা একই ভাবের প্রকাশ দেখি। সব মধুরভাব। যদি এঁদের কবিতাগুলি পড়ি, তাহলে দেখতে পাব, সেখানে সুরার কথা আছে। সুরা মানে ঈশ্বরপ্রেম, মদ নয়। ওমর খৈয়ামের একটি কবিতার অনুবাদ উদ্ধৃত করছি। এব আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করলে ভুল করা হবে। বলছেন:

ভোরের মোরগ ডাকল যখন—রুদ্ধ সরাই দ্বারে

দাঁড়িয়ে ছিল যাত্রী যত, হাঁকল বারে-বারে,—

দুয়ার খোলো ত্বরায় ওগো দুয়ার খোলো দ্বারি,

বিদায় হ’লে ফেরা মোদের কঠিন হবে ভারী।

তোমার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দাও। ঈশ্বর তোমাকে ডাকছেন, তিনি তাঁর দূত পাঠিয়েছেন, তুমি দেরি কোরো না। তিনি যদি ফিরে যান, তবে হয়তো আর আসবেন না। দুয়ার খোল, সময় নষ্ট কোরো না। তা নাহলে ‘ফেরা মোদের কঠিন হবে ভারী’। এ আহ্বান প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমাস্পদের, ঈশ্বরের সঙ্গে ভক্তের মিলনের।

কীর্তনিয়াদের গান চলছে। শ্রীমতী বলছেন; সখি! যমুনার জল আনতে আমি যাব না। কদম্বতলে প্রিয় সখাকে দেখেছিলাম, সেখানে গেলেই আমি বিহ্বল হই। (ঐ) আমি আর সেখানে যাব না।

ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়েছেন, বলছেন: ‘আহা’, ‘আহা’! কীর্তনিয়ারা গাইছেন: শ্ৰীমতীর উক্তি—শীতল তছু অঙ্গ হেরি সঙ্গসুখ লালসে (হে)।⋯(নাহয় তোদের হবে, আমায় একবার দেখা গো)। (ঐ) কৃষ্ণ নাহয় তোদেরই হবে। আমি শুধু তাঁকে একবার দেখতে চাই। (ভূষণের ভূষণ গেছে আর ভূষণে কাজ নাই) (ঐ)—তিনি থাকলেই ভূষণ সার্থক, নাহলে এ ভূষণ বৃথা। কীর্তনিয়ারা আখর দিচ্ছেন; (আমার সুদিন গিয়ে দুর্দিন হ’য়েছে) (দুর্দশার দিন কি দেরি হয় না)। (ঐ) শ্রীকৃষ্ণ নেই, আমার দুর্দিন এখন। এই দুর্দিন কবে শেষ হবে? ঠাকুর আখর দিচ্ছেন: (সে কাল কি আজও হয় নাই) (ঐ)—কবে আসবেন তিনি? সে সময় কি এখনও উপস্থিত হয়নি?

তারপরে পুরো গানটি এখানে দেওয়া আছে—বিদ্যাপতির গান। মৈথিলী ভাষা, ব্রজবুলি। তার মাঝে মাঝে এই গানে বাংলা ভাষা যোগ করা হয়েছে। গান হচ্ছে:

মরিব মরিব সখি, নিশ্চয় মরিব,

(আমার) কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব।

না পোড়াইও রাধা অঙ্গ, না ভাসাইও জলে,

(দেখো যেন অঙ্গ পোড়াইও না গো)

(কৃষ্ণ বিলাসের অঙ্গ ভাসাইও না গো)

(কৃষ্ণ বিলাসের অঙ্গ জলে না ডারবি,

অনলে না দিবি)

মরিলে তুলিয়ে রেখ তমালের ডালে।

(বেঁধে তমালের ডালে রাখবি)

(তাতে পরশ হবে)

(কালোতে পরশ হবে) (কৃষ্ণ কালো তমাল কালো)

(কালো বড় ভালবাসি) (শিশুকাল হইতে)

(আমার কানু অনুগত তনু)

(দেখ যেন কানু ছাড়া ক’রো না গো)। (ঐ)

শ্ৰীমতীর দশম দশা।(ঐ) ভগবানের নাম করতে করতে মানুষের কতগুলো ‘দশা’ হয়। কি কি সেই দশা? শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, অৰ্চন, বন্দন, পাদসেবন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন এবং স্বীয়ভাব। শ্ৰীমতীর ‘দশম দশা’, অথাৎ সমাধি হয়েছে। সমাধি যে শুধু জ্ঞানীর বা যোগীর হয় তা নয়, ভক্তেরও সমাধি হয়। তাই দেখছি, রাধার সমাধি হয়েছে। সমাধিকেই বলা হচ্ছে দশম দশা বা স্বীয়ভাব।

আবার গান হচ্ছে: ধনি ভেল মূরছিত, হরল গেয়ান, (নাম করিতে করিতে) (হাট কি ভাঙ্গলি রাই) তখনই তো প্রাণসখি মুদিল নয়ান। (ধনি কেন এমন হলো) (এই যে কথা কইতেছিল) কেহ কেহ চন্দন দেয় ধনির অঙ্গে; কেহ কেহ রোউত বিষাদতরঙ্গে। (সাধের প্রাণ যাবে ব’লে) কেহ কেহ জল ঢালি দেয় রাইয়ের বদনে (যদি বাঁচে) (যে কৃষ্ণ অনুরাগে মরে, সে কি জলে বাঁচে)। (ঐ) রাধা মূৰ্জিত হয়েছেন, অর্থাৎ সমাধিস্থা হয়েছেন। তাই দেখে সখীরা কৃষ্ণনাম করছেন। ‘কৃষ্ণনামে’ রাধার জ্ঞান ফিরে এল। চোখ মেলে দেখেন তমাল গাছ। তমাল দেখে ভাবছেন, স্বয়ং কৃষ্ণ এসেছেন। কারণ কৃষ্ণের রং তমালের রঙের মতো।

তারপরেই আবার গান শুরু—শ্যাম নামে প্রাণ পেয়ে, ধনি ইতি উতি চায়, না দেখি সে চাঁদমুখ কাঁদে উভরায়। (ঐ) ‘উভরায়’ অর্থাৎ চিৎকার করে। চিৎকার করে কাঁদছেন রাধা। জ্ঞান হওয়ার পর শ্রীকৃষ্ণকে দেখার আশায় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন না। তখন কাঁদতে কাঁদতে রাধা কৃষ্ণসখা শ্রীদামকে বলছেন: (তোরা যার নাম শুনাইলি কই) (একবার এনে দেখা গো)। (ঐ) সামনে দেখতে পেলেন একটা তমাল গাছ, আর সেই তমাল গাছে একটি ময়ূর বসে আছে। রাধা তমালগাছ দেখে ভাবছেন শ্রীকৃষ্ণ, আর ময়ূর দেখে ভাবছেন শ্রীকৃষ্ণের চূড়া। বলছেন: (আমার কৃষ্ণের ঐ যে চুড়া) (চূড়া দেখা যায়) (ঐ) —কী একটা অবস্থা! ঈশ্বরের জন্য এই যে ব্যাকুলতা, এই ব্যাকুলতাই হচ্ছে সমস্ত রাধাকৃষ্ণ-কাহিনীর মাধুর্য।

আমাদের দেশে রাধার এই ব্যাকুলতা নিয়ে কত গান, কত পদ রচনা হয়েছে। আমাদের যে ভক্তিশাস্ত্র, কী ভাবসমৃদ্ধি তার! এ একটা আলাদা জগৎ। আমরা সেই জগতে প্রবেশ করি না। কিন্তু যদি একবার প্রবেশ করি, বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হয় না। এই বাস্তব জগৎ —এ এত কঠিন, এত নীরস, এত নির্দয়—যে ভাল লাগে না তখন। সেই জগতেই থাকতে ইচ্ছে করে। চণ্ডীদাস বর্ণনা করছেন রাধার বিরহ-অবস্থা:

রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা।

বসিয়া বিরলেথাকয়ে একলে

না শুনে কাহারো কথা।।

সদাই ধেয়ানেচাহে মেঘ-পানে

না চলে নয়ান-তারা।

বিরতি আহারেরাঙ্গাবাস পরে

যেমত যোগিনী-পারা।।

—রাধা যোগিনী হয়েছেন, গেরুয়া কাপড় পরেছেন আর খাওয়াদাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছেন। একলা বসে কি যেন তিনি ভাবছেন। সবসময় মেঘের দিকে চেয়ে আছেন। উদাস দৃষ্টি। চোখের তারা স্থির। মেঘের রঙ শ্যামের রঙের মতো। তাই একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে চেয়ে আছেন।

চণ্ডীদাসের ঐ পদেই দেখছি, রাধা মাথায় ফুল দিয়ে খুব সেজেছেন। কিন্তু পরে মনে হল, তাঁর কালো চুলটা তো ফুলে ঢাকা পড়ে গেল। কালো চুলটা তো দেখতে হবে, কারণ কালো চুল দেখলে শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়বে। তাড়াতাড়ি তিনি চুল খুলে ফেলেছেন: ‘এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি দেখয়ে খসায়ে চুলি’—ফুলগুলি সরিয়ে দিয়ে চুল দেখছেন। এই কৃষ্ণবর্ণ চুল এ আমারই চুল—কিন্তু দেখতে ভাল লাগছে। কারণ, আমার যিনি প্রিয়তম, শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আবার বলছেন: ‘হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে কি কহে দুহাত তুলি’—তাঁর মুখে হাসি, মেঘের দিকে চেয়ে আছেন তিনি, আর দু-হাত তুলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। মেঘের রং কালো—মেঘ দেখে কৃষ্ণের কথা মনে পড়ছে। মনে করছেন মেঘের মধ্যে যেন কৃষ্ণ আছেন—তাই তাঁর সাথে কথা বলছেন। অন্তর কৃষ্ণময়—তাই বাইরেও কৃষ্ণ দেখছেন। একদিঠ করি ময়ূর-ময়ূরী-কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে’ —ময়ুরের গলার কাছটা নীলাভ। শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রঙও নীলাভ—কালো, কিন্তু তার সঙ্গে নীলের একটা আভা আছে। রাধা একদৃষ্টে ময়ূর-ময়ূরীর কণ্ঠ নিরীক্ষণ করছেন। শ্রীকৃষ্ণের রং-এর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে—তাই তা সুন্দর লাগছে। কৃষ্ণকে কাছে পাচ্ছেন না—কিন্তু মন সবসময় কৃষ্ণের কথা ভাবছে। যা কিছু কৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাই নিয়ে তিনি আছেন। কৃষ্ণকে ভালবাসেন, তাই যার মধ্যে কৃষ্ণের সামান্য অনুষঙ্গও আছে —সে মানুষ হতে পারে, প্রকৃতি হতে পারে নয়তো অন্য কিছুও হতে পারে—তাই তাঁর কাছে সুন্দর মনে হচ্ছে। কালো চুল, কালো মেঘ, ময়ূরের গলার নীল রং সেইজন্য এত ভাল লাগছে তাঁর। ‘চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয় কালিয়া বঁধুর সনে’—শ্রীকৃষ্ণের সাথে যেন নতুন করে পরিচয় হচ্ছে রাধার। কত চেনা, তবুও যেন মনে হচ্ছে নতুন। ভক্তের কাছে ভগবান চিরনতুন। ভক্ত তাঁকে যতই দেখে, আশ মেটে না। প্রতিটি দর্শনই সমান নতুন, সমান মধুর। আমরা তাঁর উদ্দেশে একই মন্ত্র বলি, একই অর্ঘ্য নিবেদন করি, এক স্তোত্র বারবার উচ্চারণ করি—তবুও খারাপ লাগে না। ভগবান কখনও পুরনো হন না। নতুন তিনি—ভক্তের কাছে তিনি চিরনতুন। চণ্ডীদাস তাই বলছেন: ‘নব পরিচয় কালিয়া-বঁধুর সনে।’ আবার আর একটা পদ দেখছি চণ্ডীদাসের। রাধা বলছেন:

সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।

আকুল করিল মোর প্রাণ।।

না জানি কতেক মধু শ্যাম-নামে আছে গো

বদন ছাড়িতে নাহি পারে।

জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো

কেমনে পাইব সই তারে।।

—কে আমাকে শ্যাম-নাম শোনাল? কানে শোনার পর থেকে সেই নাম আমাকে পাগল করে তুলেছে। এই শ্যাম-নামে যে কি মাধুর্য আছে বলতে পারি না। আমি চেষ্টা করেও এই নাম ছাড়তে পারি না। আমার মুখ সবসময় এই শ্যাম-নাম উচ্চারণ করে চলেছে, আর সেই নাম উচ্চারণ করতে করতে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি কেমন করে শ্যামকে পাব, বলে দাও।

আর একটা পদ উল্লেখ করছি। এবার পদকর্তা—স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি অবশ্য একটা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে যে এগুলি তৈরি করেছেন তা নয়। কীর্তন হচ্ছে, তার সাথে তিনি আখর জুড়ে দিয়েছেন। ‘কথামৃতে’ই আছে একদিনের বর্ণনা। ঠাকুর গেছেন একজায়গায়, সেখানে কীর্তন হচ্ছে, খোল বাজছে, আর ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হয়ে গোপিকার ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের রূপ বর্ণনা করতে করতে আখর দিচ্ছেন।

(সখী! রূপের দোষ, না মনের দোষ?)

(আন্ হেরিতে শ্যামময় হেরি ত্রিভুবন!) (২-৪-২)

—রাধা কৃষ্ণের রূপে মুগ্ধ হয়েছেন। বলছেন: আমার এ কি অবস্থা হল? আমি শ্যামময় ত্রিভুবন দেখছি। সর্বত্র কৃষ্ণকে দেখছি—কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এ কি কৃষ্ণের রূপের দোষ, না আমার মনের দোষ? বুঝতে পারছি না আমি। ঠাকুরের সংযোজন এই কথাগুলি। অল্প কয়েকটা কথায় রাধার ব্যাকুলতার চিত্রটা ফুটিয়ে তুলেছেন ঠাকুর। বাস্তবিক অবাক হয়ে যেতে হয় যে, কতটা ঐ ভাব নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারলে এত সুন্দর একটা আখর সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারা যায়!

কী একটা অদ্ভুত অবস্থা রাধার! রাধা হচ্ছেন ভক্তশ্রেষ্ঠ। ভক্ত কিরকমভাবে ভগবানকে চাইবে, ভক্তের কিরকম অবস্থা হওয়া উচিত ভগবানের জন্য—তা আমরা দেখতে পাই রাধা চরিত্রের মধ্যে। মধুরভাবে যাঁরা সাধন করেছেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে এই ব্যাকুলতা দেখা যায়। যেমন, মীরাবাঈ। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পথে বেরিয়েছিলেন তিনি। ‘মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরা ন কোঈ’—শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আমার কেউ নেই। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, রাজৈশ্বর্যের আকর্ষণ—সব তুচ্ছ তাঁর কাছে। চৈতন্যভাগবতে আছে মাধবেন্দ্রপুরীর কথা। শ্রীচৈতন্যের গুরু ঈশ্বরপুরী, ঈশ্বরপুরীর গুরু মাধবেন্দ্রপুরী। তাঁর সম্বন্ধে বলা হচ্ছে: ‘মাধবেন্দ্র কথা অতি অদ্ভুত কথন’—অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কেন অবিশ্বাস্য? না, ‘মেঘ দেখিলেই মাত্র হয় অচেতন’—মেঘ দেখা মাত্র তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণময় তাঁর অন্তরটা। সবসময় শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবছেন। মেঘের রং দেখে শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেতনা হারাচ্ছেন। এই ব্যাকুলতার চরম রূপ আমরা দেখি রাধার মধ্যে। রাধার সমস্ত সত্তা শ্রীকৃষ্ণে সমর্পিত হয়ে আছে। রাধা বলছেন: চক্ষু গেল, শ্রবণ গেল, ঘ্রাণ গেল, ইন্দ্রিয় সকলে চলে গেল,—(আমি একেলা কেন বা র’লাম গো)।(ঐ)—শ্রীকৃষ্ণ আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছেন। আমার চোখ, কান, সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁর সঙ্গে চলে গেছে। কারণ, এগুলি শুধু তাঁর কথাই শুনছে, তাঁর কথাই বলছে, তাঁকেই দেখছে সর্বত্র—শুধু আমিই পড়ে আছি দূরে। আমিও কেন তাঁর সঙ্গে চলে গেলাম না? চণ্ডীদাস বলছেন:

যত নিবারিয়ে তায় নিবার না যায় রে।

আন পথে যাইতে সে কানু-পথে ধায় রে।।

এ ছার রসনা মোর হইল কি বাম রে।

যার নাম নাহি লই লয় তার নাম রে।।

এ ছার নাসিকা মুঞি যত করি বন্ধ।

তভু ত দারুণ নাসা পায় শ্যামগন্ধ।।

সে না কথা না শুনিব করি অনুমান।

পরসঙ্গ শুনিতে আপনি যায় কাণ।।

ধিক রহুঁ এ ছার ইন্দ্রিয় মোর সব।

সদা যে বলিয়া কানু হয় অনুভব।।

—রাধার কথা বর্ণনা করছেন চণ্ডীদাস। রাধা বলছেন: আমার মন আমার কথা শোনে না। তাকে আমি বলছি, শ্রীকৃষ্ণের কথা ভুলে যেতে। কিন্তু সে তো শুনবে না। শ্রীকৃষ্ণের দিকেই ছুটে চলেছে আমার মন। আমি শ্রীকৃষ্ণের নাম করতে চাই না—কিন্তু আমার জিভ এমন অবাধ্য যে, সেই শ্রীকৃষ্ণের নামই করবে সে। আমার নাক আমি বন্ধ করে রেখেছি—কিন্তু কী অদ্ভুত এই নাক, তবুও সে শ্যামের গন্ধ পাচ্ছে। আমি ঠিক করেছি, শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনব না। কিন্তু আমার কান তাঁর কথা শুনবেই শুনবে। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। সর্বদা তারা শ্রীকৃষ্ণকে অনুভব করছে। এই হচ্ছে রাধার অবস্থা। ‘শ্যামময় ত্রিভুবন’—রাধার ত্রিভুবন ‘শ্যামময়’।

এরপর আবার সুরেন্দ্রের বাগানবাড়ির ঘটনা উল্লেখ করছি। সেখানে কীর্তন চলছে। শ্রীকৃষ্ণের বিরহে রাধা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছেন। তাঁর ব্যাকুলতা দেখে সখীরা যুক্তি করে মথুরায় একজন দূত পাঠিয়েছেন গিয়ে কোনরকমে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে এস, গিয়ে বল শ্ৰীমতীর এই অবস্থা। সেই দৃতী মথুরায় পৌঁছেছেন, তাঁর সঙ্গে একজন মথুরাবাসিনীর পরিচয় হল: এক রমণী সমবয়সিনী, নিজ পরিচয় পুছে। (১-১০-১) রমণী জিজ্ঞেস করছেন দূতীকে: তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ? দূতী বলছেন; আমি বৃন্দাবন থেকে এসেছি, শ্ৰীমতীর দূতী আমি। তোমরা কেউ একবার শ্রীকৃষ্ণকে এই খবরটা দাও। বলছেন: এই খবরটা পেলে কৃষ্ণ নিজেই চলে আসবেন, আমায় ডাকতে হবে না। (ঐ)

এই যে ভক্ত-ভগবান সম্পর্ক—এ বড় অদ্ভূত। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: চুম্বক যেমন লোহাকে টানে তেমনি তিনি ভক্তকে টানেন। আবার কখনও কখনও ভক্ত চুম্বক, ভক্ত ভগবানকে আকর্ষণ করে। ভক্তের এই টান ভগবান উপেক্ষা করতে পারেন না। ঠাকুর বলতেন; তুমি যদি ভগবানের দিকে এক পা এগিয়ে যাও, তিনি তোমার দিকে দশ পা এগিয়ে আসবেন। তিনি যেন আসবার জন্য পা বাড়িয়ে আছেন। আবার বলছেন: ভক্ত হন পদ্ম, ভগবান হন অলি—মৌমাছি। ভক্তের ভক্তির সৌরভে ভগবান ছুটে আসেন। ভক্ত বলে: আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী, আমি রথ তুমি রথী। ভক্ত-ভগবানের এই লীলা—এ চিরকালের। ভক্ত চায় না ভগবানের সঙ্গে তার এই খেলা কখনও শেষ হোক। ভগবান নিজেও তা চান না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: এই যে রাধাকৃষ্ণলীলা—রাধা কৃষ্ণ এক, কিন্তু দুই হয়েছেন নিজের মাধুর্য আস্বাদন করবেন বলে। চৈতন্যচরিতামৃতেও ঠিক সেই কথাই বলছে:

রাধা কৃষ্ণ এক-আত্মা, দুই দেহ ধরি।

অন্যোন্যে বিলসে, রস আস্বাদন করি।।

একটা গান আছে, তাতে ভক্ত বলছে:

মোরা শ্যামসাগরে ভাসি মীন।

শ্যামসাগরে মোরা ভাসি নিশিদিন।।

নীল নভে শোভে শশী, মোরা তায় তারারাশি,

শশীসনে পরকাশি হই তাহে লীন।।

হেরি নব-ঘন-পাশে , অচলা চপলা হাসে,

মোরা ভাসি সুখে সদা শোকতাপহীন।।

—মাছ যেমন জলে ভাসে, আমরা তেমনি শ্যামরূপ সাগরে নিশিদিন ভেসে থাকি। আকাশে চাঁদ শোভা পাচ্ছে, তার পাশে তারাও দেখা যাচ্ছে। চাঁদ উদিত হলে তারাগুলো উদিত হয়, আবার চাঁদ অস্ত গেলে অর্থাৎ ভোর হলে তারাও অস্ত যায়। আমাদেরও সেই রকম, শ্যাম যতক্ষণ ততক্ষণই আমরা, শ্যাম না থাকলে আমরাও নেই। মেঘের গায়ে বিদ্যুৎ হাসছে। ভগবানকে পাশে পেয়ে আমরাও সেরকম হাসি। যতক্ষণ ভগবান আমাদের সঙ্গে, ততক্ষণ আমরা শোকতাপহীন।—এই হচ্ছে ভক্ত-ভগবান সম্পর্ক। ভাগবতে বলছে:

সাধবো হৃদয়ং মহং সাধুনাং ‘হৃদয়ন্ত্বহম্।

মদন্যত্তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি।।

—সাধুরাই আমার হৃদয় আর আমিও তাদের হৃদয়স্বরূপ। তারা যেমন আমাকে ছাড়া কিছু জানে না, আমিও তাদের ছাড়া আর কিছু জানি না। শুধু ভক্তই যে ভগবানের জন্য পাগল তা নয়, ভগবানও ভক্তের জন্য পাগল। ভগবান বলছেন: ‘অহং ভক্তপরাধীনঃ’—আমি ভক্তের অধীন। ‘অস্বতন্ত্রঃ’—আমার কোন স্বাধীনতা নেই, পৃথক অস্তিত্ব নেই, ভক্তের কাছে আমি পরাধীন হয়ে আছি। ভক্তের ভালবাসায় তিনি বাঁধা পড়ে আছেন। এই যে দূতী বলছেন, আমায় ডাকতে হবে না, তিনি আপনি আসবেন—কিসের জোরে বলছেন? ঐ ভালবাসার জোরে। ভালবাসা হচ্ছে রজ্জু। ভক্ত ভালবাসা দিয়ে ভগবানকে বেঁধে রাখে।

তারপর দেখছি, দূতীর ঐকথা শুনে মথুরাবাসী রমণী হাসছেন, বিদ্রূপ করছেন। কারণ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন রাজা, আর এ হচ্ছে সামান্য গ্রাম্য মেয়ে। না ডাকতেই তিনি চলে আসবেন, এ কি সম্ভব? মধুপুর নাগরী, হাঁসি কহত ফিরি, গোপী কোঁয়ারী (হায় গো) (কেমন করে বা যাবি গো) (এমন কাঙালিনী বেশে)। (ঐ) দূতী হচ্ছে গোয়ালার মেয়ে, কিছু জানে না। তাই এমন কাঙালিনীবেশে রাজপ্রাসাদে যেতে চায়। জানে না যে রাজপ্রাসাদে যাওয়ার আলাদা সাজসজ্জা, আদবকায়দা আছে। রাজা শ্রীকৃষ্ণ বসেন সাত দেউড়ি পারে—সপ্তম দ্বার পারে⋯। (ঐ) সেখানে কেমন করে যাবি, সে কি এখানে? আর রাজা কি রাস্তার উপর বসে আছেন যে গেলেই দেখা হবে! সাতটা দেউড়ি পার হয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া কি সহজ কথা! কত পাহারা কত কি! আমিই লজ্জা পাচ্ছি তোর সাহস দেখে। বলছেন: (তোর সাহস দেখে লাজে মরি বল কেমনে যাবি)। (ঐ) সেই দূতী তখন মথুরানগরের রাজপথ দিয়ে যাচ্ছে আর চিৎকার করে কৃষ্ণকে ডাকছে। তার তখন লজ্জা ঘৃণা কিছু নেই। কাঁদছে আর বলছে: হা হা নাগর গোপীজনজীবন (কাঁহা নাগর দেখা দিয়ে দাসীর প্রাণ রাখ!) (কোথায় গোপীজনজীবন প্রাণবল্লভ!) (হে মথুরানাথ, দেখা দিয়ে দাসীর মন প্রাণ রাখ হরি, হা হা রাধাবল্লভ!) (কোথায় আছ হে, হৃদয়বল্লভ লজ্জানিবারণ হরি) (দেখা দিয়ে দাসীর মান রাখ হরি)। (ঐ)—হে প্রাণবল্লভ, তুমি এস, আমার মান রক্ষা কর, দেখা দাও।

কোথায় গোপীজনজীবন প্রাণবল্লভ! এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। কীর্তনান্তে কীর্তনিয়ারা উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন। (ঐ) সাধারণত প্রথমে পালাকীর্তন হয়, তারপরে নামকীর্তন হয়ে থাকে। প্রভু আবার দণ্ডায়মান! সমাধিস্থ! কতক সংজ্ঞা লাভ করিয়া অস্ফুট স্বরে বলিতেছেন, ‘কিট্ন কিট্ন’ (কৃষ্ণ কৃষ্ণ)। (ঐ) কথা সরছে না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবে নিমগ্ন। নাম সম্পূর্ণ উচ্চারণ হইতেছে না। রাধাকৃষ্ণের মিলন হইল। কীর্তনিয়ারা ঐ ভাবের গান গাহিতেছেন। ঠাকুর আখর দিতেছেন। (ঐ) বলছেন:

ধনি দাঁড়ালো রে।

অঙ্গ হেলাইয়ে ধনি দাঁড়ালো রে।

শ্যামের বামে ধনি দাঁড়ালো রে।

তমাল বেড়ি বেড়ি ধনি দাঁড়ালো রে। (ঐ)

শেষ পর্যন্ত ভক্ত আর ভগবানের মিলন হল। আগে ব্যাকুলতা, বিরহজ্বালা, তারপর মিলন। সাধারণত কীর্তনের এই নিয়ম। শুধু বিরহ নয়, মিলনও চাই। মিলন দিয়ে কীর্তন শেষ করতে হয়। রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ বর্ণনা করছেন কীর্তনিয়া:

নিধুবনে শ্যামবিনোদিনী তোর।

দুঁহার রূপের নাহিক উপমা প্রেমের নাহিক ওর।।(২-৪-২)

—নিধুবনে রাধা আর শ্রীকৃষ্ণ এক সাথে আছেন। রাধা ও কৃষ্ণের রূপের যেমন কোন তুলনা হয় না, তেমনি তাঁদের মধ্যে যে প্রেম, তারও কোন সীমা নেই। এ প্রেম ইন্দ্রিয়াতীত জিনিস। রাধাকৃষ্ণের সম্পর্ক চিরকালের সম্পর্ক। অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

হিরণ কিরণ আধ বরণ আধ নীল মণি-জ্যোতি।

আধ গলে বন-মালা বিরাজিত আধ গলে গজমতি।।

… … …

আধ শিরে শোভে ময়ুর শিখণ্ড আধ শিরে দোলে বেণী।

কনক কমল করে ঝলমল, ফণী উগারবে মণি।।(ঐ)

—রাধাকৃষ্ণের মধ্যে একজনের রং সোনার রঙের মতো। রাধার রং সোনার রঙের মতো। আর শ্রীকৃষ্ণের রং নীলকান্তমণির মতো। শ্রীকৃষ্ণের গলায় বনফুলের মালা, রাধার গলায় গজমতি। শ্রীকৃষ্ণের মাথায় ময়ূরপুচ্ছ আর রাধার মাথায় বেণী। উভয়ে পাশাপাশি আছেন—দেখে মনে হচ্ছে যেন সোনা আর পদ্ম পাশাপাশি রয়েছে, কিংবা যেন সাপ মণিসুদ্ধ শোভা পাচ্ছে।

রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়েছে। এইবার নাম-সঙ্কীর্তন। (১-১০-১) খোল করতাল বাজিয়ে ভক্তেরা সব নাম-সঙ্কীর্তনে মেতে উঠেছেন। সকলেই ভাবে উন্মত্ত, নাম করছেন:“রাধে গোবিন্দ জয়!”⋯ ঠাকুর নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া আনন্দে নাচিতেছেন! মুখে “রাধে গোবিন্দ জয়, রাধে গোবিন্দ জয়।” (ঐ) একটা আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের নৃত্য সম্বন্ধে এখানে একটু আলোচনা করতে চাই। অদ্ভুত নৃত্য করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ—তার কোন তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন শিল্পী। যা কিছু করতেন, সবই সুন্দর, অতি গোছানো। চিন্তাতে এলোমেলো নেই, আচরণে এলোমেলো নেই, আর কথাতেও এলোমেলো নেই। তিনি যে নাচতেন, তাতেও অদ্ভুত ছন্দ। নৃত্য একটা মহৎ শিল্প, শ্রীরামকৃষ্ণ সেই শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। যখন তিনি নাচতেন সকলে সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখত। যাঁরা উপস্থিত থাকতেন, তাঁরা স্থান-কাল-পরিবেশ সব ভুলে যেতেন, তাঁদের মনে হত তাঁরা যেন অন্য জগতে চলে গেছেন। ‘কথামৃতে’ সেসব বর্ণনা আছে, লীলাপ্রসঙ্গেও আছে। এখানে একটা ব্রাহ্ম পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, তা থেকে কিছুটা বোঝা যাবে ঠাকুরের নৃত্য দেখে লোকে কিরকম মুগ্ধ হত। পত্রিকাটির নাম ‘ধর্মতত্ব’। যে-দিনের বিবরণ সেটা হচ্ছে, ১ নভেম্বর, ১৮৭৯।‘… বিগত ৩১ ভাদ্র বেলঘরিয়াস্থ তপোবন (ওঁরা সব একসঙ্গে গিয়ে সাধনভজন করতেন, সেজন্য নাম দিয়েছিলেন তপোবন) ২৫-৩০ জন ব্রাহ্ম সম্মিলিত হইয়াছিলেন। সেখানে ভক্তিভাজন রামকৃষ্ণ পরমহংস মহাশয়ের শুভাগমন হইয়াছিল। তাঁহার ঈশ্বরপ্রেম ও মত্ততা দেখিয়া সকলে মোহিত হইয়াছিলেন। এমন স্বর্গীয় মধুর ভাব আর কাহার জীবনে দেখা যায় না। (ভাবতে অবাক লাগে যে একটি ব্রাহ্ম পত্রিকায় একথা বলছে, যাঁরা নাকি অনেক বিষয়েই ঠাকুরের সঙ্গে একমত ছিলেন না) শ্ৰীমদ্‌ভাগবতে প্রমত্ত ভক্তের লক্ষণে উল্লিখিত হইয়াছে: “ক্বচিদ্ৰুদন্ত্যচ্যুতচিন্তয়া ক্বচিদ্ধসন্তি নন্দন্তি বদন্ত্যলৌকিকাঃ, নৃত্যন্তি গায়ন্ত্যনুশীলয়ন্ত্যজং ভবন্তিতূষ্ণীং পরমেত্য নির্বৃতাঃ।” “ভক্তগণ সেই অবিনাশী ঈশ্বরের চিন্তনে কখন রোদন করেন, কখন হাস্য করেন, কখন আনন্দিত হয়েন, কখন অলৌকিক কথা বলেন, কখন নৃত্য করেন, কখন তাঁহার নাম গান করেন, কখন তাঁহার গুণ কীর্তন করিতে করিতে অশ্রু বিসর্জন করেন।” পরমহংস মহাশয়ের জীবনে এই সকল লক্ষণ সম্পূর্ণ লক্ষিত হয়। তিনি সে দিন ঈশ্বর দর্শন ও যোগ প্রেমের গভীর কথা সকল বলিতে বলিতে এবং সঙ্গীত করিতে করিতে কত বার প্রগাঢ় ভুক্তিতে উচ্ছ্বসিত ও উন্মত্ত হইয়াছিলেন, কত বার সমাধিমগ্ন হইয়া জড় পুত্তলিকার ন্যায় নিশ্চেষ্ট ছিলেন, কত বার হাসিয়াছেন, কাঁদিয়াছেন, নৃত্য করিয়াছেন, সুরামত্তের ন্যায় শিশুর ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন, সেই প্রমত্ততার অবস্থায় কত গভীর গূঢ় আধ্যাত্মিক কথা সকল বলিয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়াছেন। বাস্তবিক তাঁহার স্বর্গীয় ভাব দর্শনে পুণ্যের সঞ্চার হয়, পাষণ্ডের পাষণ্ডতা নাস্তিকের নাস্তিকতা চূর্ণ হইয়া যায়। ৬ই রবিবারে অপরাহ্ণে আচার্য মহাশয়ের ভবনেও (বোধহয় কেশব সেনের বাড়িতে) পরমহংস মহাশয় পদার্পণ করিয়াছিলেন। সে দিনও তাঁহার সমুদায় ভক্তিভাব প্রকাশ পাইয়াছিল। কেবল সুমধুর নৃত্য হয় নাই।১০ সব হয়েছে, শুধু এই একটা দুঃখ, এই একটা অভাব—‘সুমধুর নৃত্য হয় নাই’। ঠাকুরের নৃত্যের কিরকম আকর্ষণী-শক্তি, সেটা একটু আন্দাজ করতে পারি এ থেকে। আসলে সবই তো ভাব। এই যে আমরা কথা বলি, সে তো শুধু শব্দ—যদি তার পেছনে ভাব না থাকে। ভাবই হচ্ছে প্রাণ, ভাবই তো সবকিছুকে মধুর করে, সবকিছুতে রসসঞ্চার করে। নৃত্যের একটা ছন্দ আছে, মাধুর্য আছে। তার মধ্য দিয়ে একটা ভাব বা ‘message’ ফুটে ওঠে। তখনই নৃত্য সার্থক হয়ে ওঠে, যখন শিল্পী তাঁর নৃত্যের ভিতর দিয়ে একটা ভাব পরিবেশন করতে পারেন। সেইজন্য নৃত্য ভাল লাগে যদি তার পেছনে ভাব থাকে। ঠাকুর তো ভাবসম্রাট। সেইজন্য তাঁর কথা যেমন লোকের ভাল লাগত, গান যেমন লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনত, তেমনি তাঁর নাচও লোকে অবাক হয়ে দেখত। স্বর্গীয় দৃশ্য! সে দৃশ্যের কোন তুলনা হয় না। লীলাপ্রসঙ্গে এরকম একটি বর্ণনা আছে।১১ পাণিহাটির মহোৎসবে ঠাকুর নৃত্য করেছিলেন, সেই বর্ণনা। পাণিহাটির মহোৎসবের ইতিহাস হচ্ছে, সেখানে নিত্যানন্দ এসেছিলেন। আর রঘুনাথ গোস্বামী তাঁকে সেখানে দর্শন করতে গেছিলেন। রঘুনাথ গোস্বামীকে নিত্যানন্দ প্রভু বলেন: আমাকে এবং আমার যত ভক্ত আছে, সবাইকে তুমি কিছু খাওয়াও। রঘুনাথ তখন নিত্যানন্দ প্রভুকে এবং যত ভক্ত সেখানে এসেছিলেন সবাইকে চিঁড়ে, দই, দুধ, কলা ইত্যাদি খাইয়েছিলেন। আর নিত্যানন্দ প্রভু খুব প্রসন্ন হয়ে তাঁকে বলেছিলেন: তোমার সময় হয়েছে, তুমি এখন সংসার ত্যাগ করে নীলাচলে এসো, সেখানে মহাপ্রভু তোমার ভার গ্রহণ করবেন। সেই থেকে বৈষ্ণবরা প্রতিবৎসর ঐদিনে ঐ উৎসব করে আসছেন। তাঁদের বিশ্বাস, মহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ প্রভু এর ফলে তাঁদের কৃপা করবেন—যেমন তাঁরা রঘুনাথ গোস্বামীকে কৃপা করেছিলেন। চিঁড়ে খাওয়ানোর নিয়ম—সেইজন্য এই উৎসবের নাম ‘চিঁড়ার মহোৎসব’। সেই উৎসবে ঠাকুর গেছেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের জ্যৈষ্ঠমাস। ঠাকুরের তখন গলার অসুখ সবে শুরু হয়েছে। নানা জায়গায় বিভিন্ন দলে কীর্তন হচ্ছে। সবাই ভয় পাচ্ছেন, পাছে ঠাকুর কীর্তনে মেতে ওঠেন। কারণ, তাতে ঠাকুরের গলার ব্যথা বেড়ে যাবে। সেইখানে একজন গোস্বামী, তিনি খুব সেজেগুজে এসেছেন আর খুব অঙ্গভঙ্গী করে নাচছেন—যেন কত ভাব হয়েছে। এদিকে ট্যাঁকে কিছু পয়সা বাঁধা আছে। লোকে পয়সা দিয়েছে, সেগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। ঠাকুর নাচ দেখছেন আর তাঁর সঙ্গে যেসব যুবক ভক্ত আছেন নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ, গোস্বামীকে দেখিয়ে তাঁদের বলছেন: দেখছিস, কি রকম ঢং করছে। এইরকম ঠাট্টা করছেন—হঠাৎ কেউ কিছু বুঝবার আগেই ঠাকুর লাফ দিয়ে একেবারে কীর্তনের দলের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে নাচতে শুরু করে দিয়েছেন। আর ভক্তেরা সব গোস্বামীজীকে ছেড়ে দিয়ে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। লীলাপ্রসঙ্গকার তার বর্ণনা দিচ্ছেন: ‘তিনি কখন অর্ধবাহ্যদশা লাভপূর্বক সিংহবিক্রমে নৃত্য করিতে এবং কখন সংজ্ঞা হারাইয়া স্থির হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভাবাবেশে নৃত্য করিতে করিতে যখন তিনি দ্রুতপদে তালে তালে কখন অগ্রসর এবং কখন পশ্চাতে পিছাইয়া আসিতে লাগিলেন, তখন মনে হইতে লাগিল তিনি যেন “সুখময় সায়রে” মীনের ন্যায় মহানন্দে সন্তরণ ও ছুটাছুটি করিতেছেন। মাছ যেমন জলের মধ্যে ভেসে বেড়ায়—তার মধ্যে কোন আড়ষ্টতা নেই, যেন কোন চেষ্টা করতে হচ্ছে না তাকে, স্বচ্ছন্দ, সাবলীল—ঠাকুরের নাচ দেখে সেইরকম মনে হচ্ছে। আনন্দসাগরে তিনি যেন সাঁতার দিচ্ছেন। আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছে তাঁর মধ্য থেকে। আর যাঁরা দেখছেন, তাঁদেরকেও সেই আনন্দ স্পর্শ করছে। ‘প্রতি অঙ্গের গতি ও চালনাতে ঐ ভাব পরিস্ফুট হইয়া তাঁহাতে যে অদৃষ্টপূর্ব কোমলতা ও মাধুর্য-মিশ্রিত উদ্দাম উল্লাসময় শক্তির প্রকাশ উপস্থিত করিল, তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব। স্ত্রী-পুরুষের হাবভাবময় মনোমুগ্ধকারী নৃত্য অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু দিব্য ভাবাবেশে আত্মহারা হইয়া তাণ্ডবনৃত্য করিবার কালে ঠাকুরের দেহে যেরূপ রুদ্র-মধুর সৌন্দর্য ফুটিয়া উঠিত, তাহার আংশিক ছায়াপাতও ঐ সকলে আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই।’ এমন অদ্ভুত ঠাকুরের নৃত্য।

এরপর আবার সুরেন্দ্রের বাগানবাড়ির কীর্তনের আলোচনায় ফিরে আসছি। দেখছি, কীর্তন শেষ হয়ে গেছে, ঠাকুর পশ্চিমের কামরায় দু’চারজন ভক্তের সহিত কথাবার্তা কহিতেছেন। (১-১০-৩) আবার সেই প্রসঙ্গ এসেছে—শ্রীরাধাকৃষ্ণ ও গোপীপ্রেম। (ঐ) মাস্টারমশাইকে বলছেন: আহা, গোপীদের কি অনুরাগ! তমাল দেখে একেবারে প্রেমোন্মাদ! (ঐ) শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেছেন, গোপীরা খুব কান্নাকাটি করছেন তাঁর জন্য। উদ্ধব বৃন্দাবনে এসে তাঁদের বলছেন: তোমরা শ্রীকৃষ্ণকে দেখবার জন্য এত ব্যাকুল হয়েছ কেন? কৃষ্ণ তো সর্বভূতে রয়েছেন। তাঁর ধ্যান কর, সাধনভজন কর—যাতে নিজের ভিতরে তাঁকে দেখতে পার। গোপীরা বলছেন:১২ ‘উধো, মন নাহী—দস বীস। এক হুতো সো গয়ো হরি কে সঙ্গ, কো আরাধৈ তুব ইস?’—আমাদের তো দশটা-বিশটা মন নেই, একটা করে মন আছে। সেই মন তো চলে গেছে সেখানে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ আছেন। মনই যদি চলে গেল, তাহলে কি দিয়ে আমরা তাঁর ধ্যান-ভজন করব? আমরা মূর্খ নারী, আমরা বুঝি না শ্রীকৃষ্ণ সর্বভূতে আছেন কি না। আমরা শুধু জানি—তিনি আমাদের ব্রজের রাখাল, আমাদের একান্ত আপনার জন, আমাদের সঙ্গে এই বৃন্দাবনে কত লীলা করেছেন তিনি। বলছেন:১৩

উধৌ! জোগ-জোগ হম নাহী।

অবলা গ্যান-সার কহ জানৈঁ, কৈসৈঁ ধ্যান ধরাহীঁ।।

—উদ্ধবকে ওঁরা ‘উধো’ বলে ডাকছেন। বলছেন, উধো, ঐসব যোগ-টোগ আমাদের দ্বারা হবে না। আমরা অবলা নারী, কোথা থেকে আমরা এসব জ্ঞানের কথা জানব? ধ্যানই বা করব কি করে? ওসব আমাদের দিয়ে হবে না।

তেঈ মূঁদন নৈন কহত হৌ, হরি-মূরতি জিন-মাহীঁ।

ঐসী কথা কপটকী মধুকর! হমতৈঁ সুনী ন জাহীঁ।।

—তুমি যে বলছ আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকতে, কি করে চোখ বন্ধ করি বল দেখি! এই চোখ দিয়ে যে সব সময় আমরা শ্রীকৃষ্ণকে দেখছি, সেই চোখ তুমি বন্ধ করতে বলছ? তাহলে যে তাঁকে দেখতে পাব না, এটা তুমি বুঝছ না? খুব চটে গেছেন গোপীরা তখন, বলছেন: তুমি কপট। খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা তোমার, কিন্তু আসলে তুমি কপট। তোমার এসব কথা আমরা শুনব না।

স্রবন চীরি, সির জটা বঁধাবহু, য়ে দুখ কৌন সমাহীঁ।

চন্দন তজি অঙ্গ ভসম বতাবত, বিরহ অনল অতি দাহীঁ।।

জোগী ভ্ৰমত জাহি লগি ভূলে, সো তৌ হৈ অপ-মাহীঁ।

সুর, স্যামতেঁ ন্যারি ন পল-ছিন, জ্যৌ ঘটতৈঁ পরছাহীঁ।।

—যোগীদের মতো আমরা কান ফোটাব, আর চুলে জটা বাঁধব? কে এই কষ্ট করবে? আমরা নারী, আমরা অত কষ্ট করতে পারব না। গায়ে চন্দন মাখব না? ছাই মাখব? কিন্তু আমরা যে দিন-রাত বিরহ-অনলে পুড়ছি, পুড়ে ছাই হচ্ছি—আর আমাদের ছাই মাখার কি দরকার? তারপরে বলছেন: দেখ উধো, যাঁকে যোগীরা ধ্যান করে পাওয়ার জন্য—তাঁকে আমরা পেয়েছি। তিনি আমাদের আপনার জন। এক পলের জন্যও তিনি আলাদা নন আমাদের থেকে। কিরকম জান? ‘জ্যৌঁ ঘটতৈঁ পরছাহীঁ’—যেমন ঘট আর তার ছায়া। কায়া আর ছায়া যেমন আলাদা হয় না কখনও তেমনি শ্রীকৃষ্ণ আর আমরা কখনও আলাদা হই না। এই হচ্ছে গোপীদের ভাব—শুদ্ধা ভক্তি, কেবলা ভক্তি। কৃষ্ণ আমাদের সর্বস্ব। সমস্ত জগৎ কৃষ্ণময়। ঠাকুর এক জায়গায় বর্ণনা করছেন: গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করছেন, করতে করতে তাঁরা দেখছেন যে, সর্বভূতে শ্রীকৃষ্ণ। এমনকি নিজেদেরও মনে করছেন শ্রীকৃষ্ণ। আবার ভাবছেন, সমস্ত পৃথিবী যেন শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করছে, শ্রীকৃষ্ণের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে। বলছেন; এই যে তৃণ দেখছ পৃথিবীতে, এ কি জান? এ আর কিছু নয়—পৃথিবীর রোমাঞ্চ। শ্রীকৃষ্ণকে স্পর্শ করায় পৃথিবীর গায়ে কাঁটা দিয়েছে, আনন্দে ধরিত্রী রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছেন—এই তৃণ হচ্ছে সেই রোমাঞ্চ। গাছ দেখে বলছেন: এরা এরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন জান? শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে এরা তন্ময় হয়ে গেছে। কী অদ্ভুত কল্পনা! ঠাকুর সেইজন্য বলতেন: বৃন্দাবনের ভাবই আলাদা। তার কোন তুলনা হয় না। ভগবানের জন্য এরকম সর্বস্ব পণ, সর্বস্ব বিস্মরণ—এ আর কোনও ভাবে এতটা দেখা যায় না।

ঠাকুর বলছেন: শ্ৰীমতীর এরূপ বিরহানল যে চক্ষের জল সে আগুনের ঝাঁঝে শুকিয়ে যেতো—জল হ’তে হ’তে বাষ্প হয়ে উড়ে যেতো। (ঐ) গোপীরা সব শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কাঁদছেন, কিন্তু শ্ৰীমতীর চোখে জল নেই। শ্রীমতী সখীদের বলছেন: তোরা তো কৃষ্ণের বিরহে এত কাঁদছিস, কিন্তু দেখ, আমার হৃদয় কি কঠিন, আমার চোখে এক বিন্দুও জল নেই। তখন বৃন্দা আবার শ্রীমতীকে বলছেন: রাধা, তোর চোখে যে জল নেই তার কারণ তোর অন্তরে বিরহ-অগ্নি সবসময় জ্বলছে, চোখে জল দেখা দেওয়া মাত্র সেই আগুনের তাপে জল শুকিয়ে যাচ্ছে। রাধার চোখে যে জল নেই, তার মানে এই নয় যে, অন্যদের চেয়ে তাঁর বিরহ কম। অন্য সবার চেয়ে তাঁর বিরহ বেশী। তাই তাঁর চোখে জল নেই। একটা কবিতা আছে, ‘Home They Brought Her Warrior Dead’। একজন সৈনিক মারা গেছেন, তাঁর মৃতদেহ বাড়িতে আনা হয়েছে! স্ত্রী মৃতদেহ দেখছেন, কিন্তু কাঁদছেন না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন। এত শোক যে কান্না পর্যন্ত আসছে না। পাথর হয়ে গেছেন শোকে। সবাই বলাবলি করছে: এ ভাল নয়, এঁর কাঁদা উচিত। তখন একজন বৃদ্ধা মহিলা সৈনিকের যে-একটি শিশুসন্তান ছিল, তাকে তাঁর কোলে বসিয়ে দিল। তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন, তাঁর মধ্যে যে শোকটা জমে ছিল সেটা খানিকটা বেরিয়ে গেল। বাস্তবিক, বেদনা যখন খুব গভীর হয়, তখন প্রকাশ পায় না। রাধার যে বিরহ, এত গভীর বিরহ যে, প্রকাশ পাচ্ছে না বাইরে। খুব সুন্দর বর্ণনা করছেন বিদ্যাপতি। বলছেন:১৪ রাধার অবস্থা কিরকম?

নয়নক লোর লেশ নাহি আওত ধারা অব নাহি বহই।

বিরহক তাপ অবহুঁ নাহি জানত অনিমিখ লোচনে রহই।।

—চোখে একবিন্দুও জল নেই, বিরহের আগুনে অশ্রুধারা শুকিয়ে গেছে। আর চোখে পলকও পড়ছে না তাঁর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাধা। এত বিরহ।

মাস্টারমশাই বলছেন: আজ্ঞে হাঁ, গৌরাঙ্গেরও ঐ রকম হয়েছিল। বন দেখে বৃন্দাবন ভেবেছিলেন, সমুদ্র দেখে যমুনা ভেবেছিলেন।(ঐ) চৈতন্যচরিতামৃতে আমরা শ্রীগৌরাঙ্গের এই ভাবের কথা দেখতে পাই:১৫

বন দেখি হয় ভ্রম—এই বৃন্দাবন।

শৈল দেখি মনে হয়—এই গোবর্ধন।।

আবার সমুদ্র দেখে ভাবছেন যমুনা:১৬

এইমত মহাপ্রভু ভ্রমিতে-ভ্রমিতে।

এক টোটা হৈতে সমুদ্র দেখে আচম্বিতে।।

চন্দ্ৰকান্ত্যে উছলিত তরঙ্গ উজ্জ্বল।

ঝলমল করে যেন যমুনার জল।।

যমুনার ভ্রমে প্রভু ধাইয়া চলিলা।

অলক্ষিতে যাই সিন্ধুজলে ঝাঁপ দিলা।।

—‘কোথায় শ্রীকৃষ্ণ’ ‘কোথায় শ্রীকৃষ্ণ’ করে মহাপ্রভু কাঁদছে, আর আকুল হয়ে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ এক বাগান থেকে (‘টোটা’ মানে বাগান) সমুদ্র দেখতে পেলেন। নীল সমুদ, তার উপরে চাঁদের আলো পড়েছে। চাঁদের আলো পড়ে সমুদ্রের জল ঝলমল করছে। মহাপ্রভু ভাবলেন—এ যেন যমুনার জল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি, যমুনা মনে করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই হচ্ছে অনুরাগ, ব্যাকুলতা। একেই বলে প্রেমোন্মাদ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: তোমরা ‘প্যাম’ ‘প্যাম’ কর; কিন্তু প্রেম কি সামান্য জিনিস গা? চৈতন্যদেবের ‘প্রেম’ হয়েছিল। (২-৩-৩) প্রেম কি যদি বুঝতে চাও তাহলে চৈতন্যদেবের জীবন দেখ। চৈতন্যচরিতামৃতে প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে:১৭ ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা—ধরে “প্রেম” নাম। কাকে প্রেম বলা হচ্ছে? কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা। আমার যিনি প্রেমাস্পদ, শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর আনন্দবিধান করব, ভগবানের সেবা করব, তাঁর প্রীতি-উৎপাদন করব—এ ছাড়া আর কোন ইচ্ছা আমার নেই। এই যে প্রীতি-ইচ্ছা তাকেই বলে প্রেম। চৈতন্যদেবের প্রেম হয়েছিল। ঠাকুর বলছেন: প্রেমের দুটি লক্ষণ। (ঐ) কি কি? প্রথম হচ্ছে: জগৎ ভুল হয়ে যাবে।(ঐ) আমরা জগৎ বলতে কি বুঝি? জগৎ বলতে বুঝি ‘আমি’। আমাকে নিয়েই পরিবার, আমাকে নিয়েই সমাজ, আমাকে নিয়েই জগৎ। আমাকে বাদ দিয়ে জগৎ নেই। সব জায়গায় ‘আমি’কে প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমরা। নিজেকে খুব বড় করে দেখি। বড় হয়তো হয়ে আছি—যতটা বড় আমি, তার চেয়েও বড় ভাবি নিজেকে। আমাদের যা কিছু কর্মপ্রচেষ্টা সব ‘আমি’কে কেন্দ্র করে। ধন, মান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা—সবকিছুই ‘আমি’কে কেন্দ্র করে। আর তাই নিয়েই জগৎ। প্রেম হলে সেই জগৎ ভুল হয়ে যাবে। আমি দূর হয়ে যাবে—সেটা ‘তুমি’ হয়ে যাবে। জগৎ নেই আর—সেই জায়গায় ঈশ্বর। আমি যা কিছু করছি তখন অ-লৌকিক। সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে না। তাদের যে হিসেব, আমার হিসেব তার সঙ্গে মেলে না। আমার সবকিছুই তখন বেহিসেবী হয়ে যায়। চৈতন্যদেবের কথা বলছেন যে, তাঁর এত ঈশ্বরেতে ভালবাসা যে বাহ্যশূন্য! (ঐ) একটু আগেই যেমন দেখলাম যে, বন দেখে তিনি বৃন্দাবন ভাবছেন, সমুদ্র দেখে ভাবছেন যমুনা। সাধারণ মানুষ যা দেখছেন তিনি তা দেখছেন না। তিনি দেখছেন—শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল। একজন ভক্ত বলছেন* ‘প্রিয়তম ছবি নয়নন বসী পর ছবি কহাঁ সমায়?’—আমার চোখে রয়েছে প্রিয়তমের ছবি, অন্য কার ছবি আমি আর দেখব? আমার চোখে আমি শ্যাম ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না—সর্বত্র শ্যামকে দেখছি শুধু। কবীর একটা সুন্দর কথা বলছেন:১৮

কবীর রেখ স্যন্দূর কী, কাজল দিয়া ন জাই।

নৈন রমইয়া রমি রহ্যা দূজা কহাঁ সমাই।।

—চোখে কাজল দেব? কাজল দেওয়ারও জায়গা নেই চোখে। আমার চোখ জুড়ে বসে আছেন—আমার প্রিয়তম। দ্বিতীয় একটা জিনিস দেওয়ার জায়গা কোথায় সেখানে? এই হচ্ছে প্রেম। বাইরের জগৎ দেখতে পাচ্ছি না—ঈশ্বরকে দেখছি শুধু। প্রেমের দ্বিতীয় লক্ষণ হল: নিজের দেহ যে এত প্রিয় জিনিস, এর উপরও মমতা থাক্‌বে না, দেহাত্মবোধ একেবারে চলে যাবে। (ঐ) দেহটা আছে কি নেই সেই খেয়ালই নেই। এই দুটি লক্ষণ প্রেমের। চৈতন্যদেবের মধ্যে এই দুটো লক্ষণই দেখা যেত। এক জায়গায় চৈতন্যদেব নিজের ভাষায় তাঁর প্রেমোন্মাদ অবস্থার কথা বর্ণনা করছেন। বলছেন:১৯

যুগায়িতং নিমেষেণ চক্ষুষা প্রাবৃষায়িতং।

শূন্যায়িতং জগৎ সর্বং গোবিন্দবিরহেণ মে।।

এর বাংলা করা হয়েছে:২০

উদ্বেগে দিবস না যায়, ক্ষণ হৈল যুগসম।

বর্ষার মেঘপ্রায় অশ্রু বরিষে নয়ন।।

গোবিন্দবিরহে শূন্য হৈল ত্রিভুবন।

তুষানলে পোড়ে যেন না যায় জীবন।।

—দিন আর কাটছে না যেন। একেকটা মুহূর্তকে মনে হচ্ছে যেন একেকটা যুগ। চোখ দিয়ে বর্ষার ধারা নামছে। গোবিন্দকে পাইনি—তাই সমস্ত জগৎ আমার কাছে শূন্য মনে হচ্ছে। বিরহবেদনা আমার মধ্যে তুষানলের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। যদি মৃত্যু হত তাহলে ভাল হত। কিন্তু তা তো হচ্ছে না, বিরহের আগুন আমাকে অনুক্ষণ দগ্ধ করছে।

এবার আর চৈতন্যদেব নিজে নন, নরহরি সরকার তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন। বলছেন:২১

সোনার বরণগৌরাঙ্গ সুন্দর

পাণ্ডুর ভৈ গেল দেহ।

শীতে ভীত যেনকাঁপয়ে সঘন

সোঙরি পুরব লেহ।।

কিছু না কহইদীঘ নিশ্বাসই

চিত্রের পুতলী পারা।

নয়ন যুগলবাহি পড়ে জল

যেন মন্দাকিনী ধারা।।

ঘামে তিতি গেলসব কলেবর

না জানি কেমন তাপে।

কখন সঙ্গীতকখন রোদন

কিবা করে পরলাপে।।

—শ্রীচৈতন্যের সোনার মতো গায়ের রং এখন পাণ্ডুর হয়ে গেছে। কখনও তাঁর দেহে কম্পন দেখা দিচ্ছে—যেন খুব শীত করছে তাঁর। কখনও তিনি ছবির মতো নির্বাক, নিশ্চল। অথচ বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। কখনও চোখ দিয়ে অবিরাম জল পড়ছে—যেন মন্দাকিনার ধারা। কখনও তাঁর সমস্ত দেহে স্বেদ দেখা দিচ্ছে, কখনও তিনি গান করছেন, কখনও কাঁদছেন, কখনও পাগলের মতো কি যেন বলছেন। —শ্রীকৃষ্ণের বিরহে এইরকম অবস্থা তাঁর।

একটা জিনিস এখানে মনে রাখতে হবে। বৃন্দাবনলীলা পুনরুজ্জীবিত করলেন কিন্তু চৈতন্যদেবই। শ্রীচৈতন্যদেব না এলে আমরা মনে করতাম রাধাকৃষ্ণের লীলা কল্পনা মাত্র, মধুরভাবে সাধনা কল্পনা মাত্র। শ্রীচৈতন্য নিজের জীবনে দেখালেন রাধা-ভাব কি জিনিস। তিনি হচ্ছেন রাধার শ্রীকৃষ্ণের জন্য যে ব্যাকুলতা তার প্রতীক, জীবাত্মার পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের যে আকূতি তার প্রতীক। ঠাকুর বলছেন: ভিতরে তিনি চরম অদ্বৈতবাদী, বাইরে মধুরভাব। লোককল্যাণ সাধনের জন্য বাইরে তিনি মধুরভাব রেখেছিলেন। আর কী ত্যাগ তাঁর! কী সংযম! ত্যাগ না হলে যে মধুরভাবে চলা যায় না, তার প্রমাণ হচ্ছেন চৈতন্যদেব। তাঁর সম্বন্ধে শোনা যায় যে, তাঁর একজন সন্ন্যাসী-শিষ্য—খুব প্রিয় শিষ্য তাঁর-এক ভক্তমহিলার কাছে ভিক্ষে নিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। এত কঠোর ছিলেন তিনি সন্ন্যাসীদের বিষয়ে। এ সবকিছু কিন্তু আদর্শ স্থাপনের জন্য, লোককল্যাণের জন্য। অথচ দেখছি, কী প্রেম তাঁর, কী করুণা! ঘরে ঘরে গিয়ে নাম বিতরণ করছেন, পাপী-তাপী সবাইকে কোল দিচ্ছেন। বস্তুত, ত্যাগ শেষ পর্যন্ত প্রেমে পর্যবসিত হয়। যিনি নির্বিচারে ত্যাগ করতে পারেন, তিনিই আবার নির্বিচারে ভালবাসতে পারেন। শ্রীচৈতন্য সম্বন্ধে বল হয় যে, তিনি একদেহে রাধা এবং কৃষ্ণ। অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃ রাধা। তাঁর সম্বন্ধে একজন বলছেন:২২

গৌরাঙ্গ নহিত তবে কি হইত

কেমনে ধরিত দে।

রাধার মহিমা প্রেম রসসীমা

জগতে জানাত কে।।

মধুর-বৃন্দা বিপিন-মাধুরি

প্রবেশ চাতুরি সার।

বরজ যুবতী ভাবের ভকতি

শকতি হইত কার।।

—যদি গৌরাঙ্গ না আসতেন, রাধার মহিমা, রাধার প্রেম—এসব আমরা বুঝতে পারতাম না। বৃন্দাবন-লীলার মাধুর্য আস্বাদ করবার ‘চাতুরী’ বা কৌশল যেন তিনি আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি এসেছিলেন বলেই বৃন্দাবনের গোপীদের ভাব, ভক্তি ইত্যাদি আমরা বুঝতে পারছি। ভক্তিশাস্ত্রে রাধার বিরহের যা-যা বর্ণনা আছে সব দেখা গেছে তাঁর জীবনে:২৩

রাত্রি-দিবসে কৃষ্ণ-বিরহ স্ফুরণ।

উন্মাদের চেষ্টা করে প্রলাপ বচন।।

শ্রীরাধার প্রলাপ যৈছে উদ্ধব-দর্শনে।

সেই মত উন্মাদ-প্রলাপ করে রাত্রি দিনে।।

—কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলে রাধার যা অবস্থা হয়েছিল, আমরা ঐ সুরেন্দ্রের বাগানবাড়িতে কীর্তনে যার বর্ণনা পেলাম, চৈতন্যদেবেরও ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিল। উদ্ধব বৃন্দাবনে এলে রাধা যেমন তাঁর কাছে বিলাপ করেছিলেন, তিনিও সেইরকম বিলাপ করছেন। নিজেকে তাঁর মনে হচ্ছে রাধা।

আজ আমরা বৃন্দাবন বলে যাকে জানি, সে চৈতন্যদেবেরই আবিষ্কার। তাঁর আগে লোকে ভুলে গেছিল, কোথায় বৃন্দাবন। চৈতন্যদেবই আবার আবিষ্কার করলেন বৃন্দাবন। একটা বইয়ে সুন্দর বর্ণনা আছে এ সম্বন্ধে:২৪ ঘুরতে ঘুরতে চৈতন্যদেব বৃন্দাবনে এসে পৌঁছেছেন। তখনও তিনি জানেন না, এই বৃন্দাবন। কিন্তু বৃন্দাবনের সমস্ত মানুষ বৃক্ষ লতা পশু তাঁকে চিনতে পেরেছে— এই তো সেই লোক যিনি কত লীলা করে গেছেন এখানে, আমরা তার সাক্ষী। আজ তিনি নতুন রূপে। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করছে: ‘কপট-ঠাকুরটির এ আবার কি অভিনব খেলা!’ কৃষ্ণ, তিনি তো ছলনা করতে ওস্তাদ—কত ছলনা তিনি আমাদের সঙ্গে করেছেন। এ বুঝি তাঁর নতুন কোন ছলনা—তাই নতুন রূপ ধরে এসেছেন। ‘কৃষ্ণবর্ণটি কোথায় লুকাইলেন?’ —তাঁর গায়ের যে রং আমরা চিনি সে হচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ। সেটা তিনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? ‘এ যে দেখি রাধারূপে ঢাকা’—চৈতন্যদেব তো গৌরবর্ণ। রাধার গায়ের রংও তাই। তাই বলছেন: এ যে দেখি রাধারূপে ঢাকা, ‘শুধু বদনে কৃষ্ণনাম’—ভেতরে তুমি সেই শ্রীকৃষ্ণ—বাইরে তোমার রাধা-রূপ। মুখে সর্বদা ‘কৃষ্ণনাম’। এ ছাড়া বাইরে আর ‘কৃষ্ণে’র কোন প্রকাশ নেই। রাধাকৃষ্ণ, তাঁরাই লোককল্যাণের জন্য, লীলা করবার জন্য চৈতন্যদেবের মধ্যে একদেহে আবির্ভূত হয়েছেন। ঐ বইতেই উদ্ধৃত আছে:

প্রভু দেখি’, বৃন্দাবনের বৃক্ষলতাগণ,

অঙ্কুর পুলক মধু অশ্রু বরিষণ!

ফুল ফল ভরি’ ডাল পড়ে প্রভু পায়—

বন্ধু দেখি’ বন্ধু যেন ভেট লৈয়া যায়।

—বৃন্দাবনের সমস্ত তরুলতা তাঁকে চিনতে পেরেছে। তারা ফুল-ফলসুদ্ধ তাদের ভালবাসা চৈতন্যদেবের পায়ে লুটিয়ে দিচ্ছে। বন্ধু যেন বন্ধুকে প্রীতি-উপহার দিচ্ছে। আর শ্রীচৈতন্যও তাদের আলিঙ্গন করছেন। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে তিনি শুনলেন শুক-সারি নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের ভাষা তিনি বুঝতে পারছেন। শুক বলছে:

বংশীধারী জগন্নারীচিত্তহারী চ শারিকে

বিহারী গোপনারীর্ভিজীয়ান্মদনমোহনঃ।।

—শ্রীকৃষ্ণ, তিনি বাঁশি বাজাচ্ছেন। সেই বাঁশির শব্দে তিনি জগতের সকল নারীকে মুগ্ধ করে রেখেছেন। এখানে নারী মানে কিন্তু রমণী নয়, ভক্ত। জগতে একমাত্র পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ—আর সবাই নারী। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁশির শব্দে জগতের সমস্ত ভক্তের চিত্ত হরণ করে রেখেছেন। সমস্ত গোপনারীকে নিয়ে তিনি আনন্দ করছেন। অতএব তাঁর জয় দাও। তখন সারি উত্তর দিচ্ছে:

রাধাসঙ্গে যদা ভাতি তদা মদনমোহনঃ

অন্যথা বিশ্বমোহোহপি স্বয়ং মদনমোহিতঃ।

—সারি বলছে: তুমি শ্রীকৃষ্ণের জয় দিলে, রাধার কথাটা ভুলে গেলে? রাধা যদি সঙ্গে থাকেন তবেই তিনি মদনমোহন। রাধা না থাকলে তিনি আর মদনমোহন নন। সমস্ত বিশ্বকে মুগ্ধ করলেও তখন তিনি ‘মদনমোহিতঃ’—নিজেই তিনি মুগ্ধ হয়ে আছেন। কী অদ্ভুত কথা! ব্ৰহ্ম আর মায়া, পুরুষ আর প্রকৃতি, শিব আর শক্তি—ভিন্ন নয়। এই জ্ঞানগর্ভ কথা শ্রীচৈতন্য শুনছেন। বুঝলেন: এই তাহলে বৃন্দাবন। যেখানে পাখিরা এইভাবে সংলাপ করে, সে বৃন্দাবন না হয়ে যায় না। বৃন্দাবন আবিষ্কার হল এইভাবে। এ সবই হয়তো কল্পনা। কিন্তু কল্পনাও যদি হয়, কী অদ্ভুত কল্পনা! আমাদের জীবনে কল্পনারও তো স্থান আছে। কল্পনা অনেক সময় আমাদের জীবনকে মধুর করে তোলে। আর একে কল্পনাই বা বলি কি করে? ভক্তের কাছে এ কল্পনা নয়, বাস্তব।

অনেকে প্রশ্ন করেন: রাধাকৃষ্ণ সত্যি সত্যিই ছিলেন কি? তাঁরা জানতে চান, বৃন্দাবনলীলার ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু? বৃন্দাবনলীলার ঐতিহাসিক সত্যতা যে নেই, তাও অবশ্য কেউ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারেননি। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, রাধাকৃষ্ণ বলে কেউ ছিলেন না, গোপীরা ছিলেন না, ব্ৰজের সেই রাখালরা কেউ ছিলেন না, শ্রীদাম, উদ্ধব—সব কাল্পনিক চরিত্র, তাহলেই বা কি এসে যায়? আমি যদি ভক্ত হই তাহলে তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। ভক্তের হৃদয়েই তো বৃন্দাবন। ভক্ত দেখে তার নিজের মধ্যেই বৃন্দাবন। নিত্যকাল সেখানে রাধাকৃষ্ণের লীলা হয়ে চলেছে। বাইরের বৃন্দাবনে আমরা যাই ভিতরের বৃন্দাবনকে খুঁজতে। ঠাকুর গান করতেন:‘খুঁজ্ খুঁজ্ খুঁজলে পাবি হৃদয় মাঝে বৃন্দাবন।’ হৃদয়ের মধ্যে যদি বৃন্দাবনকে খুঁজে পাই, তাহলেই আমি ধন্য হয়ে যাই। রাধাকৃষ্ণলীলা ঐতিহাসিক সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, রাধার শ্রীকৃষ্ণের জন্য যে আকুলতা। রাধাকৃষ্ণলীলার মধ্যে সবচেয়ে বড় সত্য, সবচেয়ে শিক্ষণীয় জিনিস হচ্ছে ঐ আকুলতা। শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবন আবিষ্কার করলেন, অর্থাৎ রাধার শ্রীকৃষ্ণের জন্য যে আকূতি, সেই আকূতিকে তিনি নিজের জীবনে মূর্ত করলেন। সেই আকূতি যেন রূপ গ্রহণ করল তাঁর মধ্যে। তাঁকে দেখে মানুষ বুঝল: ঈশ্বরের জন্য এতটা ব্যাকুলতা অসম্ভব নয়, অবাস্তব কিছু নয়। ঠাকুর বলছেন: আহা, সেই প্রেমের যদি একবিন্দু কারু হয়! কি অনুরাগ! কি ভালবাসা! শুধু ষোল আনা অনুরাগ নয়, পাঁচ সিকা পাঁচ আনা! এরই নাম প্রেমোন্মাদ। (১-১০-৩)

বর্তমান যুগে ঠাকুরের মধ্যেই আমরা আবার সেই প্রেমোন্মাদ দেখলাম। তাঁকে দেখে আমরা আবার বুঝলাম, মধুরভাব মিথ্যে কল্পনা নয়। মধুর ভাবে সাধনা করার সময় ছ-মাস তিনি রমণী সেজে ছিলেন। শাড়ি পরছেন, অলঙ্কার পরছেন, মেয়েদের যতরকমের বেশভূষা সব তিনি পরছেন। আবার লম্বা চুল চাই, নাহলে তো খুঁত থেকে গেল। রাতারাতি চুল বড় করবার কোন উপায় নেই—তাই পরচুল দিয়ে লম্বা চুল করা হল। মথুরবাবু সবসময় প্রস্তুত ঠাকুরের এইসব খিদমত খাটবার জন্য। ঠাকুর তখন কায়মনোবাক্যে নিজেকে নারী ভাবছেন। মনে করছেন: তিনি যেন ব্ৰজরমণী। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বামী। সেই ভাবে তিনি এতটা তন্ময় হয়ে গেছেন যে, তাঁর চিন্তা, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সব মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল, হাঁটছেন পর্যন্ত মেয়েদের মতো, মেয়েদের মতো বাঁ পা-টা আগে এগিয়ে দেন। তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, শারীরিক যত চিহ্ন সব বদলে যাচ্ছে, নারীসুলভ সব বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। হৃদয়, তাঁর ভাগ্নে, তিনি তো সবসময় তাঁর মামাকে দেখছেন। একদিন মথুরবাবু তাঁকে বাড়ির সব মেয়েরা যেখানে বসে আছে, সেখানে নিয়ে গিয়ে বললেন: বল দেখি, তোমার মামা এর মধ্যে কে? ঠাকুর নারী সেজে সেখানে বসে আছেন—হৃদয় চিনতে পারছেন না। একদিন মথুরবাবু নিজেই চিনতে পারেননি। বাড়িতে দুর্গাপূজা, আরতি হচ্ছে। ঠাকুর নারীবেশে চামর দুলিয়ে মাকে হাওয়া করছেন। মথুরবাবু বাড়ির ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন: দেখ, একটি মেয়েকে দেখলাম মাকে হাওয়া করছে। মেয়েটি কে বল তো? মথুরবাবুর স্ত্রী বললেন: ও, তুমি ‘বাবা’কে চিনতে পারলে না। উনি তো আমাদের ‘বাবা’! আশ্চর্য! এ তো অভিনয় নয়, সাধন। অভিনয় এতটা নিখুঁত হয় না। এ সাধন, অদ্ভুত সাধন।

অনেকে মনে করতে পারে এসব অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু অসম্ভব নয়। দেখা যায় যে, আমরা যা চিন্তা করি, আমাদের যেটা মানসরূপ, সেটা বাইরেও ফুটে ওঠে। ভাল চিন্তা করলে সেটা যেমন খানিকটা ফুটে উঠবে, মন্দ চিন্তা করলে সেটাও ফুটে উঠবে। ঠাকুরের জীবনে যেমন দেখি, কোন একটা সাধনপদ্ধতি পুরোপুরি অনুসরণ করার ফলে তাঁর চেহারা চালচলন সব বদলে যাচ্ছে, একই ধরনের ঘটনা কিন্তু খ্রীষ্টসাধকদের মধ্যেও দেখা গেছে। ভগবান যীশুকে ক্রুশে বেঁধে হাত-পায়ে পেরেক মেরে হত্যা করা হয়। তাঁর গায়ে অনেকগুলি ক্ষতচিহ্ন আমরা ছবির মধ্যে দেখতে পাই। খ্রীষ্টভক্তরা ভগবান যীশুর চিন্তা করেন, আর মনে করেন—খ্রীষ্ট নন, আমি খ্রীষ্টের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, আমার গায়ে পেরেক মারা হচ্ছে আর আমার গা থেকেই রক্ত ঝরে পড়ছে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, অনেক খ্ৰীষ্টভক্তের এই অনুভূতি এত গভীর হয় যে, ঐসব ক্ষতচিহ্ন তাঁদের দেহেও ফুটে ওঠে। St. Francis of Assisi, St. Catherine of Sienna-এঁদের জীবনে এরকম হতে দেখা গেছে। কয়েক বছর আগে একজন ইতালিয়ান সাধু দেহরক্ষা করলেন, অনেক বয়স হয়েছিল তাঁর; তাঁর দেহেও ঐসব ক্ষতচিহ্ন আপনা থেকেই ফুটে উঠেছিল। কাজেই, ঠাকুরের এসব ঘটনাও অসম্ভব কিছু নয়।

মধুর ভাবে ঠাকুর যখন সাধনা করছেন—এত বিরহ তাঁর যে, আহার-নিদ্রা সব ভুলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে শরীরের লোমকূপ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। আবার কখনও একেবারে বাহ্যশূন্য হয়ে পড়ে থাকছেন। ভক্তিগ্রন্থে রাধা বা শ্রীচৈতন্যের বিরহের যেসব বর্ণনা আছে—সব বর্ণনা তাঁর অবস্থার সাথে মিলে যাচ্ছে। এইভাবে চলতে চলতে প্রথমে তিনি রাধারানীর দর্শন পেলেন। দেখলেন: অপূর্ব মূর্তি রাধারানীর, যেমন পবিত্র তেমন সুন্দর। সেই মূর্তি এসে তাঁর শরীরে মিলিয়ে গেল। আর রাধারানীর যেমন মহাভাব হত, চৈতন্যদেবের যেমন মহাভাব হত, তাঁর শরীরেও তেমনি মহাভাবের সমস্ত লক্ষণ দেখা গেল। মহাভাব সম্বন্ধে বলা হয় যে, উনিশ রকমের ভাব একসাথে হলে তাকে মহাভাব বলে। ঠাকুরের মধ্যে সেই উনিশ রকম ভাব একসাথে হয়েছিল। তারপরে একদিন তিনি শ্রীকৃষ্ণেরও দর্শন পেলেন। শ্রীকৃষ্ণও এসে তাঁর শরীরে মিশে গেলেন। তখন তাঁর এমন অবস্থা হল যে সর্বত্র দেখছেন শ্রীকৃষ্ণকে—কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু দেখছেন না। এমন কি, নিজেকে পর্যন্ত কৃষ্ণ মনে করছেন—ভক্তিশাস্ত্রে আমরা যেমন দেখি, রাধা শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করতে করতে নিজেকে কৃষ্ণ বলে মনে করছেন। এই সময়ই তাঁর আর একটি দর্শন হয়েছিল। একদিন দক্ষিণেশ্বরে ভাগবত পাঠ শুনছেন। শুনতে শুনতে তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ জ্যোতির্ময় মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন, আর শ্রীকৃষ্ণের শরীর থেকে একটা জ্যোতি বেরিয়ে এসে ভাগবত এবং তাঁর নিজের শরীরকে স্পর্শ করে রয়েছে। ঠাকুর বুঝতে পারলেন যে, ভাগবত অথাৎ যাতে ঈশ্বরের কথা আছে, ভক্ত—যিনি ঈশ্বরকে ভালবাসেন, এবং ঈশ্বর স্বয়ং—এই তিনটি জিনিস আলাদা নয়, অভিন্ন। মধুরভাব সম্বন্ধে বা রাধাকৃষ্ণলীলা সম্বন্ধে ভক্তিশাস্ত্রে যা যা আছে—সব তিনি নিজে অনুষ্ঠান করে দেখালেন।

শ্রীচৈতন্য মধুরভাবকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তারপরে অপাত্রে পড়ে এর অনেক বিকৃতি হয়েছিল; শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সেইজন্য এর সম্বন্ধে একটা অশ্রদ্ধা দেখা দিয়েছিল। ঠাকুর সেই অশ্রদ্ধা দূর করলেন, মধুরভাবকে সাধক-সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। দেখালেন যে এ পথও পথ। তবে বড় কঠিন পথ। মধুর পথ—কিন্তু কঠিন পথ। এ পথ দুর্বলের জন্য নয়। পরিপূর্ণ সংযম, পরিপূর্ণ ত্যাগ, দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ—এসব না হলে এই পথে চলা যায় না। সেইজন্য বলছেন যে, সাধারণের জন্য মধুরভাব নয়। যোগ্য অধিকারী ছাড়া আর কারও কাছে এই মধুরভাবের কথা প্রচার করা উচিত নয়। স্বামীজী অশ্বিনী দত্তকে বলেছিলেন যেখানে শুনবেন রাধাকৃষ্ণের কীর্তন, ডাইনে-বামে চাবকাবেন। আর কিছু না, রাধাকৃষ্ণ বা মধুরভাবের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়—মধুরভাবের নামে এতটা অনাচার উনি দেখেছিলেন যে, কঠোর ভাষায় সেই অনাচারের সমালোচনা করেছেন।

ঠাকুর বলছেন: রাধাকৃষ্ণ মানো আর নাই মানো, এই টানটুকু নাও; ভগবানের জন্য কিসে এইরূপ ব্যাকুলতা হয়, চেষ্টা করো। ব্যাকুলতা থাকলেই তাঁকে লাভ করা যায়। (১-২-৬) কথাটা এই তাঁকে ভালবাসতে হবে। তাঁর জন্য ব্যাকুল হ’তে হবে। (১-১০-৩) কিরকম ব্যাকুলতা? শ্রীমতীর যেমন ব্যাকুলতা, গোপীদের যেমন ব্যাকুলতা, শ্রীচৈতন্যের যেমন ব্যাকুলতা বা তাঁর নিজের জীবনে যেমন দেখি ব্যাকুলতা। ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা কতটা হতে পারে, তার এঁরা আদর্শ। ব্যাকুলতা যেন এঁদের মধ্যে মূর্তি গ্রহণ করেছে। সেই মূর্তি সামনে রেখে আমরা চলব। এঁরা যেমন ঈশ্বরের জন্য সর্বস্বত্যাগ করেছিলেন, নিন্দা-স্তুতি-কুল-মান-ভয় সব তুচ্ছ মনে করেছিলেন—আমরাও সেইরকম করব। এঁরা যেমন ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়েছিলেন, আমরাও সেইরকম পাগল হতে চেষ্টা করব। এঁদের মতো অবশ্য হতে পারব না। কারণ, এঁরা তো অবতার—এঁরা যা পারেন সাধারণ জীব তা পারে না। ঠাকুর বলতেন: আমি ষোল টাং করেছি, তোরা এক টাং কর। এঁদের আদর্শ সামনে রেখে যতটা আমরা এগিয়ে যেতে পারব, তাতেই আমাদের কল্যাণ। আমরা তো সবাই পাগল আছি-ই। কেউ নামযশের জন্য পাগল, কেউ টাকা-পয়সার জন্য পাগল, কেউ বা অন্য কিছুর জন্য। একবার চেষ্টা করে দেখব না কেন, ঈশ্বরের জন্য পাগল হতে পারি কিনা? ঠাকুর বলছেন: সংসারের জিনিস লয়ে কেন পাগল হবে? যদি পাগল হ’তে হয়, তবে ঈশ্বরের জন্য পাগল হও! (ঐ)

আকর-তালিকা

 । চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ

 । Prabuddha Bharata, June 1957 ‘The Sanctity of St. John of the Cross and of St. Teresa’ by Dr. R. Panikker

 । A Catholic Dictionary, William E. Addis and Thomas Arnold. 1955, London, p.592

 । রোবাইয়াত্-ই-ওমরখৈয়াম, ‘স্পর্শমণি’ কর্তৃক অনূদিত, ১ম সংস্করণ, পৃঃ ৯

 । চৈতন্যভাগবত, বৃন্দাবন দাস, আদিখণ্ড, ৮ম অধ্যায়

 । চণ্ডীদাসের পদাবলী, বিমানবিহারী মজুমদার, ১৩৬৭, পৃঃ ১৪৮

 । চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪র্থ পরিচ্ছেদ

 । ভাগবত, ৯/৪/৬৮

 । ঐ, ৯/৪/৬৩

১০। উদ্ধৃত: সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ, পৃঃ ১২-৩

১১। লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় ভাগ, ‘ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ’, ‘১৩৮৬, পৃঃ ২৪৪-৫০

১২। ভ্রমরগীত সার, সুরদাস, ১ম সংস্করণ, পৃঃ ৪৩৩

১৩। সুর-গ্রন্থাবলী (সুরদাস), ৪র্থ খণ্ড, দোঁহা ৩৯২১

১৪। উদ্ধৃত: পদাবলী সাহিত্য, কালিদাস রায়, ১৩৬৮, পৃঃ ২১৫

১৫। চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ১৭শ পরিচ্ছেদ

১৬। ঐ, অন্ত্যলীলা, ১৮শ পরিচ্ছেদ

১৭। ঐ, আদিলীলা, ৪র্থ পরিচ্ছেদ

১৮। কবীর গ্রন্থাবলী, সম্পাদনা: সাবিত্রী শুক্ল ও রাজেশ্বরপ্রসাদ চতুর্বেদী, ১৯৬৮, পৃঃ ১৪১

১৯। শিক্ষাষ্টকম্, ৭

২০। চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা, ২০শ পরিচ্ছেদ

২১। উদ্ধৃত; পাঁচশত বৎসরের পদাবলী, বিমানবিহারী মজুমদার, ১৩৬৮, পৃঃ ৫৭-৮

২২। বৈষ্ণব পদরত্নাবলী, ডঃ সতী ঘোষ, পৃঃ ৩১

২৩। উদ্ধৃত; শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব, স্বামী সারদেশানন্দ, ১৩৮৪, পৃঃ ৩১১

২৪। উদ্ধৃত; মহাপ্রভু গৌরাঙ্গসুন্দর, সুধা সেন, পৃঃ ১৪৪-৪৫

* সম্পূর্ণ দোঁহাটি এই:

প্রিয়তম ছবি নয়নন বসী পর ছবি কহাঁ সমায়?

ভরী সরায় রহীম লখি, পথিক আপ ফিরি জায়।

—রহীম

উদ্ধৃত: ভ্রমরগীত সার, সুরদাস; সম্পাদনা: রাজেশ্বরপ্রসাদ চতুর্বেদী, ১ম সংস্করণ, পৃঃ ১৮৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *