মধুচন্দ্রিমা
জিপের ড্রাইভার বলল, জিপ থামিয়ে, স্যার। একটা বড়ো পুরুষ গণ্ডারকে পূর্ণিমার রাতে ওই ময়না গাছটার নীচে চরে বেড়াতে দেখা যায় অথচ কোনো ফরেস্ট গার্ডই গণ্ডারটাকে চেনে না।
বলো কী?
বনবিভাগের প্রিন্সিপাল চিফ কনসার্ভেটর থাপলিওয়াল সাহেব বললেন।
তার পর, বললেন, প্রতিপূর্ণিমাতেই দেখা যায়?
না। কখনো-কখনো।
সঙ্গে জলদাপাড়ার রেঞ্জার সাহেবও ছিলেন। বললেন, কথাটা ঠিক স্যার।
বলেই বললেন, গণ্ডারটাকে দেখতে অনেকটা আমাদের মধুর মতো।
মধু! মধু তো কবেই মারা গেছে।
থাপলিওয়াল সাহেব বললেন।
রেঞ্জার সাহেব বললেন, সেইজন্যেই তো স্যার। কথাটা তো সকলে বলাবলি করে। সেইজন্যেই।
বুলশিট!
থাপলিওয়াল সাহেব বললেন। যত্ত গাঁজাখুরি গপ্পো তোমাদের।
বনে-জঙ্গলে কত কী ঘটে যায় স্যার। এ কি আর শহর কলকাতা?
স্টপ ইট।
থাপলিওয়াল সাহেব বললেন।
২
একটা জোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল মধু। নাকের সামনের ঘাসপাতা নড়ে উঠল। মধু ওপরে তাকাল। বৈশাখ মাস। কিন্তু মেঘ করে আছে। ঠাসা মেঘ নয়। ছেঁড়া ছেঁড়া। আর তার মাঝে চাঁদটা মুখ দেখাচ্ছে আধখানা যদিও তার আকার তখন থালারই মতো প্রায়। দিন তিন-চার পরই পূর্ণিমা।
সামনেই একটা মস্ত ময়না গাছ। তার নীচে একজোড়া শঙ্খচূড়ের বাস। মধু কখনো সাপের কামড় খেয়ে দেখেনি। খাবার পরও বাঁচবে কি না জানে না। তবে সাপেরাও তাকে এড়িয়ে চলে। তার গতরখানা যা, তাতে দুজনে মিলে একসঙ্গে কামড়াতে হবে। তা ছাড়া মধুর গায়ের চামড়াখানাও যে-প্রকার পুরু, তাতে দাঁত বসালেও দাঁত আদৌ বসবে কি না সন্দেহ।
বাঁ-দিকে কতগুলো চিকরাশি গাছ, আকাতরু, ওদাল। কালো গায়ের বাকরা শিরীষ। প্রথম প্রথম এই জলদাপাড়াতে এসে মনে হত অন্য দেশেই এসেছে, দু-পেয়ে মানুষদের মনে, প্রথম বার বিলেতে বা আমেরিকায় গিয়ে যেমন হয় আর কী!
একজোড়া ইয়ালো ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ হট্টিটি-হুট, হট্টিটি হুট, ডাকতে ডাকতে তার লোহার জালের বেড়া দেওয়া এলাকার বাইরে দিয়ে চলে গেল। একজোড়া প্যাঁচা রোজই আসে বেড়া পেরিয়ে মধ্যিখানে। প্রথম রাতে আর শেষ রাতে।
ধীরে ধীরে মধু এই অনুষঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তবে সে খুশি নয়—সে যে বুনো। কোন বুনোর আর জালে-ঘেরা বিচরণভূমিতে বাঁচতে ইচ্ছে করে? সে বুনো জানোয়ারই হোক কি মানুষ।
ওর জন্ম হয়েছিল কত বছর আগে, তা ও নিজেই জানে না কিন্তু একথা ও জানে যে, তার জন্ম হয়েছিল কাজিরাঙার পেলিক্যান কাঠোনির কাছে। সেখান থেকে মিহিমুখ বিল দেখা যায়। মায়ের পেছনের দু-পায়ের মধ্যে মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের দুধ খেতে খেতে মধু মিহিমুখ বিল-এর গন্ধ, কাদার গন্ধ পেত নাকে। বেঙ্গল ফ্লোরিকান পাখি সাদাটে কালচে ঝিলিক তুলে উঠে যেত, ডাকতে ডাকতে। হুলালপথ নদীর আপাতস্থির কিন্তু তীব্র গতিষ্মান জলে নিশুতি রাতে মস্ত মস্ত চিতল মাছ ঘাই মারত। কাজিরাঙার গাছগাছালি, পাখপাখালি সবই অন্যরকম ছিল। পশ্চিমবঙ্গের এদিকে তিস্তা, তোরসা, রাইডাক, মূর্তি এসব নদী আছে, কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নেই। ব্রহ্মপুত্র, ব্রহ্মপুত্রই। এমন বৈশাখ মাসের রাতে হাওয়ার দমকে ব্রহ্মপুত্রের গায়ের গন্ধ ভেসে আসত। এজারম নামে একরকমের গাছ হয় কাজিরাঙায়, বৈশাখ মাসে সুন্দর গোলাপি-রঙা ফুল ফোটে। আর শিমুল রে! কী শিমুল! শিমুলের বীজফাটা সাদা তুলোর স্বপ্নিল সাদা আঁশগুলো যখন দিকে দিকে উড়ে যায় নাচতে নাচতে ছন্নমতি হাওয়াতে ভর করে, তখন মনের মধ্যে যে কেমন করে তা যে জানে, সে-ই জানে। সে জানোয়ার হোক কি মানুষ!
মধু যুবক হতেই তাকে একদিন ঘুমপাড়ানি ওষুধভরা গুলি মেরে ঘুম পাড়িয়ে মস্ত ট্রাকে করে পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগ অসমের বনবিভাগ থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিনে এই জলদাপাড়াতে নিয়ে আসে। যাতে, গণ্ডারের বংশবৃদ্ধি হয় পশ্চিমবঙ্গে।
মধুর মাঝে মাঝেই এখন মনে হয়, অনেক মানুষের বুদ্ধি গণ্ডারের চেয়েও বুঝি কম এবং গায়ের চামড়া গণ্ডারদের গায়ের চামড়ার চেয়েও মোটা। অনেক মানুষ দেখল তার শৈশব থেকে। ট্যুরিস্ট, পুলিশ, বনবিভাগের কর্মী, সবাইকে দেখে এসব মনে হয়।
এখানের পুরুষগণ্ডারেরা কি তাদের এই অপমান সহ্য করতে পারে? মানুষ হলেও কি পারত? যে যত বড়ো অক্ষম ওইসব ব্যাপারে, তার জাঁক তত বেশি। এখানের গণ্ডারেরাও ব্যতিক্রম নয়। তখন জলদাপাড়ারই মধ্যে একটি মস্ত এলাকাতে জালের বেড়া দিয়ে তারমধ্যে মধুকে রেখে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে তার শরীরের আঘাতের ঘা শুকিয়ে আসে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে নানা ওষুধপত্রও দেওয়া হয়। মানুষডাক্তার ডাক্তারি করে তার ওপরে। শারীরিকভাবে সে ক্রমশই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু শরীরের এবং মনের মধ্যেও অনেক শরীর এবং মন থাকে। বাহ্যিক আঘাতই একমাত্র আঘাত নয়, বাহ্যিক শান্তিই একমাত্র শান্তি নয়। সে পূর্ণযুবক হয়ে ওঠার পর তার শরীরের নানা চাহিদা জাগে। কথা পর্যন্ত বলবে যে এমন একটিও গণ্ডার নেই তার কাছে। দূর থেকে ভেসে আসা বাসন্তী হাওয়াতে সে যুবতী গণ্ডারের গন্ধ পায়, ছটফট করে। এখানের ঘাসপাতাও তার মুখে রোচে না। অথচ গণ্ডারের খাদ্য তো ঘাসপাতাই।
মাসের পর মাস যায়, বছরের পর বছর, মধুর বয়েস বাড়ে কিন্তু সেই বেড়া-দেওয়া জায়গাটুকুর মধ্যেই ও বাস করে। বেড়াটা অবশ্য দেওয়া হয়েছিল অনেক টাকা খরচ করে তার ভালোর জন্যই, তাকে অন্য পুরুষগণ্ডাররা যাতে আর মারতে না পারে। সেই মারের হাত থেকে সে বেঁচেছে নিশ্চয়ই কিন্তু অন্য অনেক মার সে নীরবে হজম করে। সেইসব মারের রকম কী, তা পুরুষগণ্ডারের মতো পুরুষমানুষও জানে নিশ্চয়ই, জানেন বনবিভাগের কর্তারাও। কিন্তু বোঝেন না। মানে,অমন ঘেরাটোপের মধ্যে ওকে রাখা হয় ওর নিজেরই ভালোর জন্যে। কিন্তু ভালোর যে অনেকরকম হয় তা তাঁরা বোঝেন না।
তাকে একবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে সে আবার বুনো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যারা প্রকৃত বুনো তারা বুনো হয়ে যাওয়া কারোকে আর গ্রহণ করে না। মধু নিজেই ফিরে এসেছিল তার নিরাপদ বেড়াজালে। বড়ো মার মেরেছিল বুনোরা তাকে প্রথম বার দলবেঁধে। সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি সে আর চায় না।
তার নাম নাকি বন্যপ্রাণীদের জন্য যে-উপদেষ্টা বোর্ড আছে তার মিটিং-এর এজেণ্ডাতে প্রায়ই থাকে। ‘মধু’। মধুকে নিয়ে কী করা উচিত, তা নিয়ে বাঘা বাঘা বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা মাথা ঘামান সেইসব মিটিংয়ে। কিন্তু মধুর জীবন যেমন একাকী ও নির্জন তেমনই থাকে। তার মনের দুঃখ, শরীরের জ্বালা বাড়তেই থাকে।
ইতিমধ্যে আর এক কান্ড ঘটেছে। একটা বাচ্চা-গণ্ডারকে এখানে বাঘে ধরে। সব জায়গার বাঘই হাতির আর গণ্ডারের বাচ্চা খেতে খুব ভালোবাসে।
বন্যপ্রাণীদের জীবনটাই খেয়োখেয়ির—এ ওকে খাচ্ছে আর ও, অন্যকে। ওরা, এই তৃণভোজী প্রাণীরাই শুধু ঘাসপাতা খেয়ে বাঁচে। অন্য কোনো প্রাণীকে মেরে খেয়ে বাঁচে না। অবশ্য গাছপাতারও নাকি প্রাণ আছে। মধুর বাবা, কাজিরাঙার মাস্তান পটকান গণ্ডার বলেছিল তাকে। মধুকেও ওর শৈশবাবস্থাতে একটি বাঘে ধরেছিল। মধুর মা মামণি এসে বাঘকে খড়গ দিয়ে এমন মেরেছিল যে বাবার নাম করতে করতে বাঘ মধুকে ছেড়ে পালিয়েছিল।
জলদাপাড়ার সেই আহত বাচ্চা গণ্ডারটাকে বনবিভাগের লোকেরা উদ্ধার করে নিয়ে এসে মধুর থাকার জায়গার পাশেই একটি খাঁচামতো বানিয়ে তাতে রেখে তার চিকিৎসা করেছে। চারজন লোক আছে তার দেখাশোনার জন্য। চিকিৎসা ও শুশ্রূষা এখনও চলছে। জলদাপাড়া থেকে ভেট সাহেব এসে মাঝে মাঝেই দেখে যান তাকে। ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন দিয়ে যান। বাচ্চাটা বাঁচবে কি না কে জানে? বাঁচলেও সে পঙ্গু হয়ে থাকবে। মধু যেমন মনে পঙ্গু ও শরীরে পঙ্গু হয়ে থাকবে। এর চেয়ে না বাঁচাই ভালো।
মধুকে তো জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিলেনই বনবিভাগের কর্তারা কিন্তু মধুই তো নিজে ফিরে এসেছিল বেড়ার মধ্যে। ভয়ে। আবারও মার খাওয়ার ভয়ে। তা ছাড়া বনবিভাগের কর্মীরা তার দেখভাল করেন। বেড়ার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ারও অভাব নেই। বস্তা বস্তা নুনও এনে ফেলে দেন কর্মীরা। বাঁচতে মধুর কোনো শারীরিক কষ্ট নেই শুধু মনটা কষ্টে থাকে। মাঝে মাঝেই শরীরটা রিকিঝিকি করে। ব্রহ্মপুত্রের পারে বিস্তীর্ণ আদিগন্ত তৃণভূমি কাজিরাঙার জন্যেও কষ্ট হয়।
বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডের মিটিং আবার বসছে। এবারে উত্তরবঙ্গের মূর্তিতে। নতুন ঝিং চ্যাক বাংলো বানানো হয়েছে কিছুদিন হল মূর্তি নদীর ওপারে। এখানেই গৌরীপুরের লালজি হস্তী-কন্যা পার্বতী বড়ুয়ার বাবা প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া ক্যাম্প করেছিলেন বেশ কিছুদিন তার দুটি হাতি নিয়ে, বুনোহাতি খেদাবার জন্যে। একটি হাতি ছিল গণেশ। মস্ত গণেশ—বাঁ-দাঁতি। রাতের বেলা গোরুমারার গণ্ডাররা চরতে চরতে চলে আসত শুখার বা শীতের দিনে নদীরেখা ধরে মূর্তি-বাংলোর একেবারে সামনে। গাছে বাঁধা গণেশ ভয় পেত। এসব কথা মধু শুনেছে, বনবিভাগের কর্মীদের কথাবার্তাতেই। এই মিটিংয়েও নাকি মধুর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। এজেণ্ডাতে মধু আছেই। আগেও যেরকম ছিল, প্রায় পার্মানেন্ট ফিচার হয়ে।
এখন রাত কত কে জানে! পেটের মধ্যে একটা বেদনা বোধ করছে সে, বহুদিন হল। কাজিরাঙার মধ্যে ও যতরকম ঘাসপাতা পেত তা এখানে নেই, তা ছাড়া এদের রকমও অন্য। নাকি মুখ বদলাবার জন্যে বেশি নুন খেয়েই হল। এখন মধু প্রমাণমাপের। কিন্তু প্রকান্ড শরীরের প্রাপ্তবয়স্ক গণ্ডারও মানুষের শিশুদেরই মতো। পেটে ব্যথা হলে বলতে পারে না। কোথায় ব্যথা তাও। শুধু কাঁদে, কিন্তু সে কান্নায় আওয়াজ থাকে না। নীরবে কাঁদে। গণ্ডারদের বা হাতিদের বিধাতা কাঁদতেও শেখাননি, কাঁদবার ক্ষমতা দেননি। তীব্র যন্ত্রণা হলে দু-চোখের কোণে জল এসে জমে শুধু। তার পরে গড়িয়ে পড়ে নীচে। ফিসফিসে শিশিরের মতো।
এবারের মিটিংয়ে নাকি মধুর একটা হেস্তনেস্ত হবেই। ওঁরা যা-ই করেছেন সবই মধুর এবং বনবিভাগের ভালোরই জন্যে। কিন্তু মানুষের ভালো আর জানোয়ারের ভালোর মধ্যে যে অনেকই তফাত। দুজনে যে দুজনের ভাব বোঝে না।
সেই প্যাঁচা দুটো ঝগড়া করতে করতে আবার রোজ রাতেরই মতো আজও এল শেষরাতে। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে একটা এই বসন্ত-শেষে। শিমুল-পলাশ-অশোক এসব ফোটা শেষ। এখানের জঙ্গলে এই সময়ে মাদারের লাল আর জারুলের বেগুনির বাহারও প্রকৃতিকে সুন্দর করে। পাগলের মতো কোকিল ডাকে। সারারাত পিউ কাঁহা ডাকে চাঁদভাসি আকাশে। আর দীর্ঘশ্বাস পড়ে মধুর। দূরে হলং নদীর ধারে বড়ো বাঘ ডাকে, গণ্ডারেরা ঢংক ঢংক করে ওঠে। টাঁউ টাঁউ করে চিতল হরিণেরা বাঘের খবর পেয়ে ব্বাক ব্বাক করে, মানুষদের কুকুরের মতো ডাকে। সংক্ষিপ্ত এবং পৌনঃপুনিক ডাক ডাকে বার্কিং-ডিয়ার বা কোটরারা। রাত ঢলে পড়ে দিনের দিকে। মধুর পেটের ব্যথাটা তীব্র হয়। বেড়ার মধ্যেও খোলামতো জায়গাটাতে পৌঁছে সে, জলের পাশে বসে পড়ে জল খায়। পেটের যন্ত্রণাটা এমনই তীব্র হয় যে, মধুর আর উঠে দাঁড়াবার অবস্থা থাকে না।
৩
মূর্তিতে বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডের মিটিং চলছে। বনবিভাগের নানা বিষয় নিয়েই আলোচনা হয় সে-মিটিংয়ে, শুধুই যে বন্যপ্রাণী নিয়ে হয় তা নয়। ম্যারাথন মিটিং। বনমন্ত্রী, রাষ্ট্রমন্ত্রী, ফরেস্ট সেক্রেটারি, প্রিন্সিপাল চিফ কনসার্ভেটর। চিফ কনসার্ভেটরেরা, কনসার্ভেটর এবং ডি এফ ও-রা, সভাধিপতিরা, পুলিশের এবং প্রশাসনের বড়ো বড়ো আমলারা। এবং আমন্ত্রিত দুজন বেসরকারি সভ্যও উপদেষ্টা বোর্ডের। চার ঘন্টা ধরে চলল সেই মিটিং। মধুর ব্যাপারে স্থিরীকৃত হয় যে মধুর বেড়া দেওয়া এলাকার মধ্যে মধুর চেয়ে ছোটো একটি মেয়ে গণ্ডারকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে যাতে মধু পুরো স্বাভাবিক না হলেও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এই প্রস্তাবে খুশির গুঞ্জন উঠেছিল মিটিংয়ে। মধুর জন্য কিছু একটা করতে পেরে সকলেই খুশি।
৪
খবরটা যখন জলদাপাড়ার রেঞ্জ অফিসে এল, ওয়্যারলেসে তখন রেঞ্জ অফিসের সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ডি এফ ও কল্যাণ দাসকে ফোনে খবর দেওয়া হল জলপাইগুড়িতে, কনসার্ভেটর উজ্জ্বল ভট্টাচার্যকেও। তখন চিফ কনসার্ভেটর ওয়াইল্ড লাইফ উদয়ন দাশগুপ্তও পশ্চিমবঙ্গের সর্বজ্ঞ গভর্নর অনারেবল হিজ এক্সেলেন্সি ভীরেন জে শা-কে জঙ্গলে খাতির করার জন্যে এসেছিলেন। ভেট চলে এসেছিলেন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জলদাপাড়ার হেড কোয়ার্টার থেকে। পোস্টমর্টেম না করলে তো মৃত্যুর কারণ জানা যাবে না। সাপের কামড়েই মারা গেল, না কী হল? কোথায় মধু মধুচন্দ্রিমা যাপন করবে নতুন স্ত্রীর সঙ্গে আর মৃত্যু কিনা এসে তখনই থাবা বসাল তার জীবনে। ‘হোয়াট আ ট্রাজিক হ্যাপেনিং’। বনবিভাগের প্রত্যেকেই মধুর মৃত্যুতে আত্মীয় বিয়োগের যন্ত্রণা পেলেন। বাইরের মানুষে সেই যন্ত্রণার কথা ঠিক বুঝতে পারবেন না।
ভেট বললেন, সিরোসিস অফ লিভার।
দাশগুপ্ত সাহেব বললেন, সেকী। মদ খান আমার দাদা পিপে পিপে আর সিরোসিস অফ লিভার হল মধুর!
ডি এফ ও কল্যাণ দাস বললেন, স্যার, হাতি হলেও না-হয় বোঝা যেত, হাঁড়িয়ার গন্ধ পেলেই শুঁড় তুলে সেদিকে দৌড়োয় তারা। কিন্তু আমাদের টি-টোটালার মধু।
ভেট বললেন, অকৃতদার সুরেশ মজুমদারও সিরোসিস অফ লিভারে মারা গেছিলেন অথচ জীবনে মদ ছোঁননি। বেশি ফল খেয়ে খেয়ে সিরোসিস অফ লিভার হয়েছিল।
মধুর মৃতদেহকে কবর দেওয়া হবে সেই খোলামতো জায়গাতেই যেখানে সে বসেছিল, আর উঠতে পারেনি, সেখানেই। মাটি কোপানো শুরু হয়ে গেছে। শকুনেরা এ-গাছে ও-গাছের মাথাতে এসে জড়ো হয়েছে। মন্দভাগ্য ওদের। মধু ওদের ভোজ্য হবে না। মন্দভাগ্য মধুরও। মন্দভাগ্য সেই ছটফটে যুবতী গণ্ডারটিরও যার সঙ্গে বনবিভাগের কর্তারা তার বিয়ে দেবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। যুবতীর অভাব নেই এখানে। সবল পুরুষেরই অভাব ছিল। সে কারণেই মধুকে আনা হয় কাজিরাঙা থেকে। একভোগ্যা হয়ে থাকত মধুর সঙ্গে তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে হত, জলদাপাড়ার গণ্ডারের সংখ্যা আরও বাড়ত। ট্যুরিস্টরা দেখে খুশি হত। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।
মধু এখন কোথায় কে জানে! অশরীরী সে কি জলদাপাড়াতেই আছে নাকি কাজিরাঙাতেই ফিরে গেল ব্রহ্মপুত্রের গায়ের গন্ধের কাছে তার বাল্যকালের কোনো সঙ্গীরই কাছে? মধুকে বনবিভাগের সকলেই জানতেন, তাকে ভালোও বেসেছিলেন কিন্তু… বড়ো দেরি হয়ে গেছিল বোধ হয়…..
বনবিভাগের নানা কর্মচারী, যাঁরা দিনে-রাতে এই অভয়ারণ্যে ডিউটি করেন তাঁরা চাঁদনি রাতে প্রায়ই নাকি আজও দেখতে পান যে, সেই ময়না গাছটার নীচে তার পাহাড়ের মতো বিরাট শরীরটা নিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে জলদাপাড়ার ঘাসবনে।