প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

মধু

মধু

চল্লিশে গুনগুন, পঞ্চাশে সোচ্চার। কী হল? পৃথিবীতে এসে কী পেলুম! চোখ বাঁধা কলুর বলদের মতো সংসারের ঘানিতে ঘুরেই গেলুম, দু-চার ফোঁটা তেল যা বেরোল তাইতে দিনকতক খুব তেলানি হল; এখন আর বয়সের সরষেতে তেল নেই। চাকা শুধু ঘুরেই চলেছে। খোল ছাড়া আর কিছুই বেরোচ্ছে না। সবসময় একটা হাহাকার, ‘জীবন আমার বিফলে গেল। লাগিল না কোনও কাজে।’

ছাত্রজীবনটা যা হয় চাবকানি খেয়ে কেটে গেল। শিক্ষক মহাশয়রা আর অভিভাবকরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কান টেনে পরীক্ষাসমুদ্র পার করালেন। ফল ভাল হলে অভিভাবকরা নড়া ধরে তুলে দেখালেন, ‘আমার সোনার চাঁদ, আমার হীরের টুকরো।’ পরীক্ষার আগে খুব ক’দিন ঘি, দুধ, ডিম, ছানা, নরমপাক, কড়াপাক। ফল খারাপ হলে, ‘ওটা একটা অপদার্থ ষাঁড়ের নাদ। ওর পেছনে খরচ করা মানে ভস্মে ঘি ঢালা।’ তখন পুত্র বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা। গোটা সংসারে বিষন্ন সানাইয়ের পোঁ—’এর দ্বারা আর কী হবে! অঙ্কে তিরিশ। ইংরেজিতে ছত্রিশ। বাংলায় পঞ্চাশ। ইতিহাসে ফেল। কী আর করবে বলো! ছাতুফাতু খেয়ে শরীর বাগাও। তোমার ভবিষ্যৎ তো রিকশা টানা, ঠেলাগাড়ি চালানো।’

গোঁফের রেখা বেরোল, বয়সা লাগল গলায়। অঙ্ক পারি না পারি, রেখা, লেখা, শ্যামা, শ্যামলীদের দিকে আড়ে-আড়ে তাকাতে পারি। দু-চার জোড়া প্রেমপত্র চালাচালি করতে পারি। তখন দুনিয়াটা হয়ে গেল প্রেমের। ফ্যালফ্যালে, ভ্যালভ্যালে অবস্থা। কপালে ঝুলছে চুলের থোপা। একফুট, দেড়ফুট এক একটা প্রেমপত্রের সাইজ। ইয়ার বন্ধুদের থেকে-থেকে প্রশ্ন, পড়ার খবর নয়, পরীক্ষার খবর নয়, শ্যামলীর খবর। কাঁঠালের রসের মতো, প্রেমের রস কতটা ঘন হল! সে-সব কি বুলেটিন! আজ শ্যামলী আড়চোখে একবার তাকিয়েছে। কাল শ্যামলী মুচকি হাসি ছেড়েছে। পরশু শ্যামলী আমার দেড়ফুটের বদলে একটা ইঞ্চিতিনেক খত বের করেছে। সাত বন্ধু সাত দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রথম সম্বোধনটাই কী বিস্ফোরক, ‘প্রিয় মামদো ভূত, তোমার সব চিঠি মা উনুনে দিয়ে দিয়েছে। এখনও বাপিকে বলেনি। শুধু বলেছে—আহা, অমন সনাতনবাবুর একটি মাত্র ছেলে, এমন বাঁদর হয়ে গেল! যে অসুখের যা ওষুধ, মাথার আধখানা কামিয়ে, ও-পিঠ, এ-পিঠ বেশ করে চিনে বাড়ির জুতোপেটা করলেই দামড়াটার প্রেমের ব্যামো কমে যাবে। সাতইয়ারে ছেলেটার সর্বনাশ করে দিলে। কাঁঠালে পাকলে কোনও ক্ষতি ছিল না, সনাতনবাবুর যেমন বরাত, ছেলে এঁচড়ে পেকে বসে রইল। বছর-বছর গোল্লা, এদিকে প্রেমের দীর্ঘশ্বাস। মা তোমার জন্যে মুড়ো ঝ্যাঁটা রেডি রেখেছে। ইতি তোমার সাঁড়াশি।’ বিশেষজ্ঞ বন্ধুরা বললে ঘাবড়াবার কিছু নেই। প্রেমে অমন দু-চারবার টার্গেট মিস করতেই পারে। প্রেম হল সাধনা। সাধতে-সাধতে কার মনের কোনও নীরব বীণা একদিন ঝঙ্কার দিয়ে উঠবে আগেই কি বলা যায়! প্রেম কি যাচিলে মেলে সহসা উদয় হয় শুভ যোগ পেলে। সঙ্গে-সঙ্গে হাতে এসে গেল গালিব। যে অসুখের যা পথ্য—ছাদের আলসে, হাতে গালিব, বুলবুল নয়, কাকের কর্কশ কা কা ধ্বনি, ‘দিলসে নিকলা পে ন নিকলা দিলসে / হৈ তেরে তীরকা পৈকান অজীজ।।’ বড় খটমট ভাষা। তা হোক, অসুখ অনুসারে ওষুধ। প্রেমে ধরলে ওমর খৈয়াম আর প্রেম লাথি মারলে গালিব। খুঁজে-খুঁজে মানে বের করি—হৃদয় থেকে বেরিয়ে গিয়েও যে চলে গেল না, সে তীর নখরের ঘা—আমারই প্রিয়।

জীবনের এই পর্যায়টা কাটতে বেশি দেরি হয় না। বারসত্তর দাড়ি গোঁফ কামাবার পরই ভূত ছেড়ে যায়। পিতার অবসর নেওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। মাকে ধরে গেঁটে বাতে। বোনের বিয়ের বয়স চলে যায়। চারপাশ থেকে চেপে ধরে সংসারের দেওয়াল। সাত বন্ধু সাতদিকে চেপে বসে জীবিকার ঘোড়ায়। কেউ রেলে। কেউ পোস্টাপিসে। কেউ রাইটার্সে। তখন জ্ঞাননেত্র খুলে যায়। সংসার এক কারখানা। জীবন আর জীবিকায় মিলে মানুষ এক-একটা আকৃতি পাবেই। প্রেম নয় উপার্জন, চরিত্র নয় অর্থ, অর্থ আর পদ এই দুটো দেখেই এগিয়ে আসেন মানবীর পিতা। একটা চারপায়া, এভারলাস্টিং একটা ছোবড়ার জগদ্দল গদি, একটা তোশক, এক জোড়া বালিশ, গোটাকতক বেড কভার, স্টিলের একটা আলমারি, আলনা, সাজুগুজু করার একটা ড্রেসিং টেবিল, কয়েক ভরি সোনা নিয়ে জীবনের ঘোড়সওয়ারি লাগাম হাতে উপস্থিত। প্রথমে মৃদুকণ্ঠী। মাসে-মাসে ভল্যুম চড়তে-চড়তে শেষে চিরস্থায়ী লাউডস্পিকার। কোথায় কৈশোরের প্রেমিকা। এ যে আমার হান্টারওয়ালি। হ্যাট ঘোড়া হ্যাট। কোথায় প্রেমপত্র। বাপের বাড়ি থেকে পত্র—’টাকা পাঠাও। খোকার ফুড কিনতে হবে। বুড়ির মেয়ের ভাত। সোনার নোলক না দিলে প্রেস্টিজ পাংচার। ওখানে সোনার দোকানে সত্তর টাকা ধার আছে, শোধ করে দিও। আমার আয়রন টনিক ফুরিয়েছে। ভুসভুস করে চুল উঠে যাচ্ছে। তোমার জন্যে শেষে দেখছি টাক পড়ে যাবে। যা হয় একটা কিছু করো। আমার কী, লোকে তোমাকেই ছ্যাছ্যা করবে। বলবে টেকো বউ। মায়ের শরীরটা ভালো নয়। বাবার হাই সুগার। পটলা খেলতে গিয়ে পা ভেঙে এসেছে। অধিক আর কি! সাবধানে থেকো। ভোরবেলা খালি পেটে ভরতি-ভরতি এক গেলাস জল খেতে ভুলো না।’ সবই প্রায় নিজের কথা। আমার জন্যে ব্যবস্থা এক গেলাস জল। এদিকে ছাদ বেয়ে জল পড়ছে। ওদিকে সদ্য সন্তানের জননীর চুল পড়ছে। এদিকে গর্ভধারিণী কুঁই-কুঁই করে বলছেন—’আগে ফুটোফাটা মেরামত করো, বউমাকে সামলাও, তারপর আমার চিকিৎসা! আমার তো যাওয়ার সময় হয়েই এল। দেখি, জপের মালাটা ছিঁড়ে বসে আছে।’ পিতার ইসকিমিক হার্ট। তিনি বারান্দায় বসে হাহাকার করছেন—’হায় প্রভু! এই আমার সারা জীবনের পুরস্কার। ছেঁড়া লুঙ্গি, ফুটো গেঞ্জি, নুন ছাড়া তরকারি, ষাট টাকা কেজি গুমো গন্ধওয়ালা চা, আর হৃদয় নয় এত বড় একটা ইসকিমিক হার্ট।’ এদিকে আমার হাহাকার—হায় প্রভু! একটু বাড়াও। ছোট্ট একটা প্রমোশন। বাজারদরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছি না আর। পাখির ছানা হল এরপর পোনা হবে, তাদের অসুখ, তাদের আহার, বিহার, শিক্ষা, প্রেম, সংসার, সন্তান। সংসারের সেই একই চক্র। তিনটে জিনিস বাড়ে—বয়েস, দেনা, আর চিনি। আর বাড়ে দুশ্চিন্তা, কর্তব্য। যে দরজা দিয়ে জীবন বেরিয়ে মৃত্যুর প্রাঙ্গণে গিয়ে পড়ে, সেই দরজার পাশে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে মিছিল চলেছে— মাথা চাপড়াতে-চাপড়াতে হাহাকার করতে-করতে। চলেছে পিতামহ, পিতা, পুত্র, তস্যপুত্র। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এক দুয়ারে প্রবেশ, অন্য দুয়ারে নিষ্ক্রমণ। অভিজ্ঞতা—মধুর নিষ্পেষণ।

1 Comment
Collapse Comments

KOTO BORO SATYO

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *