মদন ঘোষের বদনে হাসি – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

মদন ঘোষের বদনে হাসি – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

ভট্টাচার্য মহাশয়

আমি মদন ঘোষ। আমার বদনে আপনারা হাসি দেখিতেছেন। নূতন আমার বিবাহ হইয়াছে। সেইজন্য আমার মুখে এত হাসি। কিন্তু তা’ বলিয়া আমি বে-পাগলা নই। তবে মনের মত পত্নীলাভ হইলে চিত্ত একটু প্রফুল্ল হয়। আমারও তাই হইয়াছে। তাই হাসি-মুখে সকলকে আমি সম্ভাষণ করিয়া বলিতেছি—‘গুড মর্নিং।’

সরস্বতী দেবীকে পূজা করিয়া লোকে বিদ্যালাভ করে। সে বস্তু আমি কতটুকু লাভ করিয়াছি, তাহা এই গল্পটি পাঠ করিলেই সকলে বুঝিতে পারিবেন। তাহা ব্যতীত আমি আর একটি বহুমূল্য রত্নলাভ করিয়াছি। দেবীর কৃপায় আমি রাধারাণীকে পাইয়াছি। রাধারাণী আমার গৃহের একাধারে লক্ষ্মী-সরস্বতী।

কলিকাতায় যখন আমি স্কুলে পড়িতাম, তখন প্রতি বৎসর শ্রীপঞ্চমীর সময় আমি বাড়ি যাইতাম। বাড়ি আমাদের বর্ধমান জেলা—সামান্য একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে। বাড়ি গিয়া ভক্তিভাবে দেবীকে অঞ্জলি প্রদান করিতাম। বৈকালবেলা মাঠে গিয়া দাঁড়াগুলি খেলিতাম।

যে বৎসর আমার প্রথম চাকরি হইল, সে বৎসর শ্রীপঞ্চমীর সময় আমি দেশে যাইতে পারিলাম না। কলিকাতাতেই সে বৎসর মায়ের শ্রীপাদ-পদ্মে অঞ্জলি প্রদান করিলাম। সেই সূত্রে আমি রাধারাণীকে লাভ করিলাম।

সে বৎসর প্রাতঃকালে উঠিয়া, আমি আমার দোয়াতটিকে ভাল করিয়া ধুইলাম। পুরাতন নিবগুলি ফেলিয়া, কলমে নূতন নিব পরাইলাম। চারি পয়সা দিয়া একটি সরস্বতী ঠাকুর কিনিয়া আনিলাম। ছোট একখানি চৌকির মাঝখানে ঠাকুরটিকে বসাইয়া, তাঁহার সম্মুখে ও দুই পার্শ্বে দোয়াত-কলম ও পুস্তক সাজাইলাম। শুভ্রবর্ণের ফুল ও পূজার অন্যান্য উপকরণও আহরণ করিলাম।

এসব আয়োজন করিলাম বটে, কিন্তু পুরোহিতের কি হইবে? কলিকাতায় আমি কখন ক্রিয়াকর্ম করি নাই। সে নিমিত্ত পুরোহিতের প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু আজ—উপায়?

ভাবিতে ভাবিতে আমার বাসার দ্বারে গলিতে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমাদের বাসায় আর যত লোক আছেন, পূজা-পাঠের তাঁহারা ধার ধারেন না। নন্দী-ভৃঙ্গীর সন্ধান বরং তাঁহারা জানেন ; কিন্তু পুরোহিতের সন্ধান তাঁহারা কিছুই জানেন না। তাই মনে করিলাম যে, পথে যদি সাত্ত্বিক গোচের মানুষ দেখিতে পাই, তাহা হইলে তাঁহাকে পুরোহিতের কথা জিজ্ঞাসা করিব।

ভাগ্যে আমার বাসার নিকট দুই-তিনখানি খোলার বাড়ি ছিল, তাই আমাকে অধিকক্ষণ আর পথে প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতে হইল না। খোলাঘরের লক্ষ্মীগণের সরস্বতীর প্রতি বিদ্বেষ নাই। কার্তিক ঠাকুরের প্রতি তাঁহাদের যেরূপ ভক্তি, সরস্বতী ঠাকুরাণীর প্রতিও তাঁহাদের সেইরূপ ভক্তি। মহাসমারোহের সহিত আজ তাঁহারা দেবীর পূজা করিতেছেন। ঘরের মাঝখানে তাঁহারা একথানি প্রতিমা খাড়া করিয়াছেন। প্রতিমার সম্মুখে বড় একখানি থালা রাখিয়াছেন, সেই থালে ঝমা-ঝম প্রণামী পড়িতেছে।

কলিকাতায় পূজা-করা ব্যবসাটি নিতান্ত মন্দ নহে। বড় পূজার সময় নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের নিকট হইতে অনেকে প্রণামীস্বরূপ এত টাকা আদায় করেন যে, বার মাস সুখে-স্বচ্ছন্দে তাঁহাদের সংসার চলিয়া যায়।

আমি গলির পথে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময়ে নিকটের একখানি খোলার বাড়ি হইতে একজন ব্রাহ্মণ বাহির হইলেন। বর্ণ তাঁহার কালো নহে; শ্যামবর্ণ বলিলে যাহা বুঝায়, তাঁহার বর্ণ সেইরূপ ছিল। তাঁহার মুখে বসন্তের দাগ ছিল। কপালে তাঁহার সুদীর্ঘ একটি ফোঁটা ছিল ; গায়ে একখানি নামাবলি ছিল। তিনি যে পুরোহিত, তাঁহাকে আর জিজ্ঞাসা করিতে হয় না।

ভক্তিভাবে আমি তাঁহাকে প্রণাম করিলাম। হাত তুলিয়া জয়-অস্তু বলিয়া তিনি আমাকে আশীর্বাদ করিলেন। আমার ঘরে গিয়া মায়ের পূজা করিতে তাঁহাকে আমি অনুরোধ করিলাম। আমার কথায় তিনি সম্মত হইলেন। তাঁহার পূজা ও আমার অঞ্জলি প্রদানের পর, আমি তাঁহাকে দক্ষিণা প্রদান করিলাম। আজ আমার মুখে হাসি দেখিয়া আপনারা কত কি মনে করিতেছেন, কিন্তু সেদিন তাঁহার প্রফুল্ল ডায়মনকাটা মুখখানি যদি দেখিতেন, তাহা হইলে বলিতেন যে, হাঁ! হাসি বটে! তাহার কারণ এই যে, দক্ষিণাটি কিছু আশাতিরিক্ত হইয়াছিল।

সেই প্রফুল্লবদনে ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে বলিলেন, ‘দেখ, বাপু! আজকালের ছোকরাদের মতি-গতি নিতান্ত মন্দ হইয়াছে। সব সাহেবী ধরন—সাহেবী মত। কিন্তু তুমি ছোকরা দেখিতেছি ভাল। ধর্মেকর্মে তোমার মতি আছে। তোমার নাম কি বাপু।’

আমি উত্তর করিলাম, ‘আমার নাম মদনমোহন ঘোষ। আমরা সদ্‌গোপ।’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘বা! চমৎকার নামটি। মদনমোহন! অতি সুন্দর নাম।’

আমার নামটি যে ভাল, জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত তাহা আমি জানিতাম। মনে মনে কত আমি আমার নামের গৌরব করিতাম। ভট্টাচার্য মহাশয়ও আজ সেই নামের প্রশংসা করিলেন। তাঁহার প্রতি আমার প্রগাঢ় ভক্তি হইল।

আমার নিবাস কোথায়, আমার পিতা-মাতা বর্তমান আছেন কি না, এইরূপ নানাপ্রকার পরিচয় গ্রহণ করিয়া, ভট্টাচার্য মহাশয় সেদিন বিদায় গ্রহণ করিলেন। তাহার পর মাঝে মাঝে তিনি আমার বাসায় পদধূলি প্রদান করিতেন। প্রণামীস্বরূপ টাকাটা-সিকিটা দিয়া আমি তাঁহার সম্মান করিতাম। ক্রমে আমি জানিতে পারিলাম যে, পুরোহিতগিরি ব্যতীত তিনি ঘটকালীর ব্যবসায়ও করিয়া থাকেন। সে নিমিত্ত আমার যে তখনও বিবাহ হয় নাই, কথায়-বার্তায় তাঁহাকে আমি জানাইলাম।

ভট্টাচার্য মহাশয় কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ‘এমন সুপাত্র! বিদ্বান্! চাক্‌রে! এখনও বিবাহ হয় নাই!’

আমি চুপ করিয়া রহিলাম। উত্তর আর কি করিব! প্রতিদিন আমি সাবান মাখিয়া স্নান করি। এখন আর আমার পাড়াগেঁয়ে চেহারা নাই। নানারূপ সুগন্ধযুক্ত তৈলে সিক্ত করিয়া, চুলগুলি ফিরাইতে প্রতিদিন আমি আধঘন্টাকাল অতিবাহিত করি। আরশিতে যখন আমি আমার মুখ দেখি, তখন ভট্টাচার্য মহাশয় যাহা বলিলেন, আমিও তাহাই মনে মনে ভাবি। নিজের সুখ্যাতি নিজের করিতে নাই। কিন্তু আপনারা বরং আমার বন্ধু-বান্ধবকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবেন, সকলেই বলিবে যে, মদন একজন সুন্দর পুরুষ বটে। ফল কথা, আমার নাম মদন, আমি কাজেও মদন।

কিছুদিন পরে ভট্টাচার্য মহাশয় পুনরায় আমার বাসায় আগমন করিলেন। সেদিন আসিয়া বলিলেন, ‘দেখ, আমি ব্রাহ্মণ-কায়স্থের ঘটকালী করি ; তোমাদের জাতির ঘটকালী কখন করি নাই। কিন্তু যে স্থানে আমার বাসা, তাহার ভিতর-বাটী—এক প্রবীণ ভদ্রলোক ভাড়া লইয়াছেন। তিনি তোমাদের জাতি ; উপাধি পাল। পাল মহাশয়কে সঙ্গতিপন্ন লোক বলিয়া বোধ হয়। তাঁহার নিবাস শুনিয়াছি, হুগলি জেলার কোন স্থানে। তাঁহার এক বয়স্থা কন্যা আছে। কন্যাটির বয়ঃক্রম বার কি তের হইবে। তোমাদের জাতিতে এতবড় কন্যা থাকে না। কিন্তু তাহার কারণ আমি কতকটা পাইয়াছি। আমি যে বাড়িতে থাকি, সেই বাড়ির নিচের তলায় একটি ঘরে তোমাদের জাতীয় আর এক ব্যক্তি বাস করেন। তাঁহারও নিবাস হুগলি জেলায়। সকলে তাঁহাকে নিয়োগী মহাশয় বলিয়া ডাকে। তাঁহার পুত্র পীড়িত হইয়াছে। চিকিৎসার নিমিত্ত তাহাকে তিনি কলিকাতায় আনিয়াছেন। আমি শুনিয়াছি যে, এই পুত্রের সহিত পাল মহাশয়ের কন্যার বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির হইয়াছিল। তাহার পীড়াবশত এখনও বিবাহ হয় নাই। আমার বোধ হয়, এ বিবাহ কখন হইবেও না ; কারণ, নিয়োগী মহাশয়ের পুত্র কাসরোগ দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছে। কিন্তু এখনও সকলে তাহার আরোগ্যলাভের আশা করিতেছে। সেজন্য পাল মহাশয়ের নিকট এখন আমি তোমার কথা উত্থাপন করিতে পারি না। কিন্তু তুমি এক কাজ কর। তুমি গিয়া পাল মহাশয়ের সহিত আলাপ-পরিচয় কর। তাহা করিতে পারিলে, যথা সময়ে এ কাজের অনেক সুবিধা হইবে।’

দ্বিতীয় অধ্যায়

গোঁফ-ছাঁটা বিভীষণ

বিবাহের কথা শুনিয়া প্রাণ আমার উল্লাসে পরিপূর্ণ হইল। কারণ, আমার নাম মদন। প্রাণের কথা আমি খুলিয়া বলিতেছি, সেজন্য আমাকে আপনারা পাগল মনে করিবেন না। বিবাহের সময় আপনাদের বোধ হয়, এইরূপ আনন্দ হইয়া থাকিবে। তবে আপনারা প্রকাশ করেন না, এই যা।

আমি ভট্টাচার্য মহাশয়কে বলিলাম, ‘পাল মহাশয় প্রবীণ, সঙ্গতিপন্ন, আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাঁহার সহিত আমি কিরূপে আলাপ-পরিচয় করিব?

ভট্টাচার্য মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘তুমি এক কাজ কর। আমাদের বাড়িতে তুমি একটি ঘর ভাড়া করিয়া সেই স্থানে বাস কর। দোতলার অন্দর মহলের দিকে, ঠিক পাল মহাশয়ের ঘরের পার্শ্বে, একটি ঘর খালি আছে। তুমি সেই ঘরটি ভাড়া লও। এক বাড়িতে বাস করিতে করিতে ক্রমে পাল মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় হইবে।’

প্রাতঃকালে ভট্টাচার্য মহাশয়ের সহিত আমার এইরূপ কথাবার্তা হইল। আফিস হইতে আসিয়া সেই দিন সন্ধ্যাবেলা আমি তাঁহার বাসায় গমন করিলাম। যে বাড়িতে তিনি থাকেন, সেই বাড়িটি আমি দেখিলাম। ইহা দক্ষিণ-দ্বারী চক্-মিলান দোতলা বাড়ি। সম্মুখেই পূজার দালান, তাহাতে একজন স্বর্ণকার কাজ করে। বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া, একতলার দক্ষিণদিকে যে ঘরটি, তাহাতে ভট্টাচার্য মহাশয় বাস করেন। বামদিকের ঘরটিতে একজন উৎকলবাসীর মুড়ি-মুড়কির ও তেলেভাজা-কচুরির দোকান। পূর্বদিকে একখানি ঘরে পীড়িত পুত্র লইয়া নিয়োগী মহাশয় আছেন। একতলায় পশ্চিমদিকে একখানি ঘরে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ থাকেন। তাঁহার কি মোকর্দমা আছে। সেই মোকর্দমার কথা একবার জিজ্ঞাসা করিলে আর রক্ষা নাই। দুই ঘন্টা ধরিয়া তোমাকে তিনি সেই পরিচয় প্রদান করিবেন। তুমি তখন মনে করিবে যে, একথা জিজ্ঞাসা করিয়া কি কুকর্ম করিয়াছি। বাহির-বাটীর উপরের ঘরগুলিতে আফিসের বাবুদের বাসা। কোনও ঘরে একজন, কোনও ঘরে দুইজন, কোনও ঘরে বা তিন-চারিজন বাবু বাস করেন। নিচের তলায় অবশিষ্ট ঘরগুলিতে তাঁহাদের রন্ধন হয়। উপরের একটি ঘরে একজন সামান্য গোচের দালাল থাকেন। কেশব সেন জীবিত থাকিতে তিনি ঘোরতর ব্রাহ্ম ছিলেন। মাঘোৎসবের সময় তিনি পথে নিশান ধরিয়া যাইতেন। এখন পুনরায় হিন্দু হইয়াছেন। এখন আর তিনি মুরগী ভক্ষণ করেন না। ভিতর-বাড়িতে দোতলার পশ্চিমদিকে সারি সারি যে তিনটি ঘর আছে, তাহা ব্যতীত অন্দর মহলে এখন আর অন্য বাসোপযোগী ঘর নাই। বাড়িটি পুরাতন ও ভগ্ন। ভিতর-বাটীর বাকী সমুদয় ঘর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। পশ্চিমদিকে বাসোপযোগী সেই তিনটি ঘরে পাল মহাশয় একেলা সপরিবারে বাস করেন। তাঁহার পরিবার অধিক নহে, কেবল স্ত্রী ও সেই কন্যা। ভিতর-বাড়ির দোতলায় যে ঘরে পাল মহাশয় নিজে থাকেন, ঠিক তাহার পার্শ্বে বাহির-বাটীতে একটি ঘর খালি আছে। সেই ঘরটি ভাড়া লইবার জন্য ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমার ঘরের সম্মুখে বারেণ্ডা আছে। সেই বারেণ্ডা বরাবর পাল মহাশয়ের ঘরের সম্মুখ দিয়া ভিতরবাটীতে চলিয়া গিয়াছে। ভিতর-বাটী ও বাহির-বাটীর মাঝে এই বারেণ্ডায় একটি দ্বার আছে। এই দ্বার দিয়া বাহিরবাটী হইতে ভিতর-বাটীতে যাইতে পারা যায়। কিন্তু এখন ইহা সর্বদা ভিতরে খিল ও বাহিরে শৃঙ্খল দ্বারা বদ্ধ থাকে। বাড়ির দক্ষিণে প্রশস্ত রাজপথ, পশ্চিমে একটি গলি। গৃহস্বামীর অবস্থা এক্ষণে মন্দ। সেজন্য বাড়ি ভাড়া দিয়া তিনি কাশীতে গিয়া বাস করিয়াছিলেন। বাড়িটি ভট্টাচার্য মহাশয়ের জিম্মায় আছে। ভাড়া আদায় করিয়া প্রতি মাসে তিনি গৃহস্বামীর নিকট প্রেরণ করেন। সেজন্য ভট্টাচার্য মহাশয় যে ঘরে থাকেন, তাহার ভাড়া তাঁহাকে দিতে হয় না। বাড়িটির অবস্থা ভালরূপ অবগত হওয়া আবশ্যক। সে নিমিত্ত আমি এই বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিলাম।

ভট্টাচার্য মহাশয়ের পরামর্শ অনুসারে আমি উপরের সেই ঘরটি ভাড়া লইয়া, তাহাতে বাস করিতে লাগিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল, পাল মহাশয়ের সহিত আমার আলাপ-পরিচয় হইল না ; তাঁহার কন্যাকেও আমি দেখিতে পাইলাম না। আমার ঘরটি ভিতর-বাটীর ঠিক নিকটেই ছিল ; সেজন্য কখন কখন তাহার কণ্ঠস্বর ও মলের শব্দ শুনিতে পাইতাম। পাল মহাশয় বাড়ির ভিতর হইতে বড় বাহির হইতেন না ; অন্তত প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যার সময় আমি যখন বাড়িতে থাকিতাম, তখন তাঁহাকে বড় বাহিরে আসিতে দেখিতাম না। দুই দিন কেবল ক্ষণকালের নিমিত্ত আমি তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম। একখানি পুস্তক হাতে লইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া তিনি কোথায় গমন করিতেছিলেন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশের অধিক হইবে। তাঁহার মুখ দেখিলে তাঁহার প্রতি ভক্তি হয়; কিন্তু মুখখানি অতিশয় বিষণ্ণ। তিনি যেন ঘোর দুঃখে সর্বদাই নিমগ্ন আছেন। হাতে পুস্তক দেখিয়া বুঝিলাম যে, তিনি লেখাপড়া জানেন। সেই বিষণ্ণবদনে লক্ষ্মীশ্রী দেখিয়া আমি ভাবিলাম যে, যদি কপালে থাকে, তাহা হইলে এ লোকের আমি জামাতা হইব।

কিন্তু আর একজনের সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির হইয়া আছে। সে কিরূপ, তাহা আমাকে দেখিতে হইবে। কিন্তু তাহার পিতা অর্থাৎ নিয়োগী মহাশয়ের ভাব দেখিয়া আমার ভয় হইতে লাগিল। নিয়োগী মহাশয়ের মুখখানি অনেকটা বিভীষণের মত। মুখের দুই পাশে দুই গাল যেন দম্ভ করিয়া আগে বাড়িতেছে। তাহার মাঝখানে আধ-পাকা আধ-কাঁচা ছাঁটা গোঁপগুলি সব খোঁচা খোঁচা হইয়া আছে। তাঁহাকে দেখিয়া আমি মনে করিলাম যে, লোকে যে গোঁপ-ছাঁটা বদমায়েশের কথা বলে, ইনি একজন তাই। সে যাহা হইক, আমি অনেক কৌশল করিয়া তাঁহার পুত্রের সহিত আলাপ করিলাম। তাঁহার পুত্রের মুখমণ্ডলে সুলক্ষণ আমি কিছু দেখিলাম না। পিতার বদমায়েশি ভাব যেন পুত্রের মুখেও প্রতিফলিত হইয়াছে। কিন্তু রোগে এখন তাহার শরীর জীর্ণ হইয়াছে, মুখ তাহার শুষ্ক ও মলিন হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় তাহার জন্য আমার মনে দুঃখ হওয়া উচিত ; কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি, তাহা আমার হয় নাই। তাহার প্রতি বরং আমার হিংসা হইল। আমি এমন সুন্দর পুরুষ,—যাহাকে মনে মনে পত্নীরূপে বরণ করিয়াছি, সে এই মর্কটের হাতে পড়িলেও পড়িতে পারে, সে চিন্তা আমার অসহ্য হইয়া উঠিল। সত্য বটে, সেই সুন্দরীকে আমি এখনও চক্ষেও দেখি নাই। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়! তাহার পায়ের চারি গাছি মলের রুণু-রুণু শব্দ সর্বদাই যে আমার কানে লাগিয়া আছে! আফিসে চাবি খোলার শব্দ হয়, আর আমার প্রাণটা ধড়াস করিয়া উঠে; আমি ভাবি, এ বুঝি আমার হৃদয়-আসীনা আমার প্রাণদেবীর পদনিঃসৃত সেই কিঙ্কিণী শব্দ। তাহাকে আমি দেখি নাই সত্য ; কিন্তু ভট্টাচার্য মহাশয়ের বিবরণ অবলম্বন করিয়া আমার মানসক্ষেত্রে তাহার চিত্র আঁকিয়া লইয়াছিলাম।

নিয়োগী-পুত্রের পীড়া সঙ্কট ; সর্বদাই সে ঘরের ভিতর শুইয়া থাকে ; উঠিয়া বেড়াইবার শক্তি বড় নাই ; তথাপি সে মাঝে মাঝে বাটীর ভিতর গিয়া পাল মহাশয়ের পরিবারবর্গের সহিত সাক্ষাৎ করে। পাল মহাশয়ের সহিত নিয়োগী মহাশয়ের বহুদিন ধরিয়া আলাপ-পরিচয় আছে। শুনিলাম যে, দেশে ভূমিসম্পত্তি লইয়া একবার পাল মহাশয়ের কি মোকর্দমা হইয়াছিল। তাহাতে জাল করিয়া ও মিথ্যা সাক্ষীর যোগাড় করিয়া নিয়োগী মহাশয় তাঁহার অনেক উপকার করিয়াছিলেন। সেই অবধি দুই পরিবারের বিলক্ষণ সদ্ভাব জন্মিয়াছিল। এইসব কথা শুনিয়া মাঝে মাঝে আমি নিরাশ হইয়া ভাবিতাম যে, কে হে তুমি মদন ঘোষ! যে পাল মহাশয়ের কন্যার প্রতি কটাক্ষ কর? তবে আশা এই যে, নিয়োগী মহাশয়ের পুত্র বোধ হয়, এ যাত্রা রক্ষা পাইবে না। সে যাহা হউক, আমি সেই পীড়িত যুবকের নিকট মাঝে মাঝে বসিয়া তাহার সহিত গল্প করিতাম। গল্পচ্ছলে পাল মহাশয়ের কথা, তাঁহার পরিবারের কথা, তাঁহার কন্যার কথা জিজ্ঞাসা করিতাম। নিয়োগী-পুত্র ভাল করিয়া আমাকে পরিচয় প্রদান করিত না। কথার ছলে আমার সন্দেহ হইল যে, পাল মহাশয়ের সংসারে কোনরূপ একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। সে কথা সাধারণের নিকট প্রকাশ করিবার নহে। ইতিপূর্বে বন্ধু-বান্ধব ও কুটুম্বদিগের দ্বারা আমি পাল মহাশয়ের বংশ-পরিচয় গ্রহণ করিয়াছিলাম। সেই সময়ে একজন আমাকে বলিয়াছিল যে, পাল মহাশয়ের এক পুত্র আছে। সে পুত্র এখন কোথায়? সে কথার কোন সন্ধান আমি পাইলাম না। নিয়োগী-পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে আমার উপর রাগিয়া উঠে।

তৃতীয় অধ্যায়

রাক্ষস না ভূত

এইরূপে কিছুদিন গত হইল। পাল মহাশয়ের সহিত আমার পরিচয় হইল না। ভট্টাচার্য মহাশয়ের সহিত সর্বদা আমি সাক্ষাৎ করিতাম। তিনি বলিতেন, ‘ব্যস্ত হইও না। নিয়োগী-পুত্রের জীবনের আশা থাকিতে তোমার কোন আশা নাই। অপেক্ষা কর, দেখা যাউক কি হয়।

আমাদের বাটীর সম্মুখে রাস্তার অপর পারে একখানি মুদির দোকান আছে। একদিন রবিবার বৈকালবেলা দেখিলাম যে, পাল মহাশয় সেই দোকানে বসিয়া আছেন। তাঁহার মুখ সেইরূপ বিষণ্ণ ও চিন্তায় আচ্ছন্ন। একখানি পুস্তক তিনি পাঠ করিতেছিলেন ও কদাচ কখন কখন এক একবার মুখ তুলিয়া কাহারও সহিত দুই-একটি কথা কহিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমি দোকানে প্রবেশ করিয়া যে তক্তপোশের উপর তিনি বসিয়াছিলেন, তাহার এক পার্শ্বে উপবেশন করিলাম। কোন দ্রব্য আমার প্রয়োজন আছে কি না, মুদি আমাকে জিজ্ঞাসা করিল। আমি বলিলাম, ‘না।’ তক্তপোশের উপর আরও তিন ব্যক্তি বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন। পাল মহাশয়ের ন্যায় তাঁহারাও প্রবীণ। তাঁহাদের মধ্যে কেহ আমাকে কোন কথা বলিলেন না। পাল মহাশয় পুস্তক হইতে মুখ তুলিয়া আমার দিকে একবার চাহিয়াও দেখিলেন না। আমি যুবক ; সামান্য একটা ছোঁড়া বলিলেও হয় ; আর তাঁহারা সকলেই প্রবীণ। তাঁহাদের সহিত প্রথম কথা কহিতে আমি সাহস করিলাম না। তাঁহারা, প্রথম আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবেন, সেই প্রত্যাশায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসিয়া রহিলাম; কিন্তু আমার সহিত কেহ একটিও কথা কহিলেন না। নিরাশ হইয়া সে স্থান হইতে আমি প্রস্থান করিলাম। কিন্তু পাল মহাশয় একমনে কি পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন, তাহা দেখিয়াছিলাম। তিনি কালী সিঙ্গির মহাভারতের শান্তিপর্ব পাঠ করিতেছিলেন।

সেই দিনই আমি সেই পুস্তক ক্রয় করিলাম ; আর সেই রাত্রি হইতে তাহা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করিতে লাগিলাম। ভিতর-বাটীতে পাল মহাশয়ের ঘর, আর বাহির-বাটীতে আমার ঘর, দুইয়ের মাঝখানে কেবল একটি প্রাচীর ব্যবধান ছিল। আমি মনে করিলাম যে, আমার মহাভারত পাঠের শব্দ প্রাচীর পার হইয়া, পাল মহাশয়ের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবে। তাহা হইলে আমার প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা হইবে। কিন্তু ঠিক বিপরীত ফল হইল। আমার ঘরের সম্মুখে বারেণ্ডা আছে ; আর সেই বারেণ্ডার উত্তর-সীমায় বাটীর ভিতর যাইবার জন্য দ্বার আছে। সেই দ্বার সর্বদা বন্ধ থাকে। একদিন রাত্রিকালে আমি যথারীতি উচ্চৈঃস্বরে মহাভারত পাঠ করিতেছি, এমন সময় বাটীর ভিতর দিক হইতে সেই দ্বারে কে ধাক্কা মারিতে লাগিল। মহাভারত পাঠে আমার মন তখন নিমগ্ন ছিল, সুতরাং সে শব্দ প্রথম আমি শুনিতে পাই নাই। ক্রমে ধাক্কার শব্দ বৃদ্ধি হইয়া যখন আমার কণ্ঠ-শব্দকে পরাজয় করিল, তখন সে শব্দ আমি শুনিতে পাইলাম।

তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া সেই দ্বারের নিকট গিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে গা! কে শব্দ করিতেছে!’ ভিতর হইতে পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘একটু ধীরে ধীরে যদি বাপু তুমি পুস্তক পাঠ কর, তাহা হইলে এ বাড়িতে আমি তিষ্ঠিতে পারি, তা না হইলে আমাকে অন্যত্র পলায়ন করিতে হইবে।’

ঘোরতর অপ্রতিভ হইয়া আস্তে আস্তে পড়িবার নিমিত্ত আমি তাঁহার নিকট অঙ্গীকার করিলাম। অঙ্গীকার করিয়া সে রাত্রিতে যখন লজ্জায় ও ঘৃণায় অভিভূত হইয়া পুনরায় আমি আমার ঘরে প্রবেশ করিলাম, তখন যদি আপনারা আমাকে দেখিতেন, তাহা হইলে এই মদনের বদনে আপনারা বিন্দুমাত্রও হাসি পাইতেন না। রাগ করিয়া আমি মহাভারত দূরে নিক্ষেপ করিলাম। সেইদিন হইতে আর সে পুস্তক আমি স্পর্শ করিলাম না।

পাল মহাশয়ের সহিত আমার আলাপ-পরিচয় হইল না। বরং মহাভারত পাঠের নিমিত্ত তাঁহার নিকট আমি লাঞ্ছিত হইলাম। গোঁপ-ছাঁটা নিয়োগী মহাশয় বক্ষস্থল স্ফীত করিয়া দম্ভের সহিত বিচরণ করেন। তাঁহাকে দেখিলে আমার সর্বশরীর জ্বলিয়া যায়। ডাক্তারগণ আসিয়া তাঁহার পুত্রকে পনের দিনের মধ্যে ভাল করিয়া দিবেন বলিয়া আস্ফালন করে। কিন্তু তাহার কাসি যায় না, জ্বরও কমে না, শরীরে সে বলও পায় না। ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে ক্রমাগত আশ্বাস প্রদান করেন। তাঁহার কৃপা আমি কখনও ভুলিতে পারিব না। এইভাবে আরও কিছুদিন কাটিয়া গেল।

ক্রমে চৈত্র মাস পড়িল। তখন নূতন গ্রীষ্ম পড়িয়াছে। রাত্রিতে সহসা আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। তাহার পর পুনরায় নিদ্রা যাইবার নিমিত্ত অনেকক্ষণ চেষ্টা করিলাম ; কিছুতেই আর নিদ্রার আবেশ হইল না। শয্যা হইতে উঠিয়া আমি আলো জ্বালাইয়া ঘড়িতে দেখিলাম যে, একটা বাজিয়া গিয়াছে। আমার ঘরের পশ্চিমদিকে দুইটি জানালা ছিল। তাহার একটি জানালা খুলিয়া দাঁড়াইলাম। আমার ঘরের নিম্নেই গলি পথ। গলির ভিতর পাল মহাশয়ের দিকে দূরে একটি গ্যাসের আলো। গলির ওপারে অন্যান্য লোকের বাড়ি। আমরা যে বাটীতে থাকি, তাহার উত্তরে একটি অশ্বখগাছ ছিল। তাহার নিম্নে ষষ্ঠী ঠাকুরের অনেকগুলি নোড়া-নুড়ি ছিল। সেই অশ্বথগাছের ডাল, পাল মহাশয়ের তিনটি ঘরের মধ্যে দুইটি ঘরের ঠিক গায়ে লাগিয়াছিল।

জানালার দিকে দাঁড়াইয়া সহসা আমার সেই গাছের দিকে একবার দৃষ্টি পড়িল। সর্বনাশ! সেই গাছের উপর, নিবিড় শাখা-প্রশাখা ও পত্রের ভিতর হইতে বাহির হইয়া, কি একটা জন্তুর মত সেই স্থূল ডালটির উপর আসিয়া বসিল। তাহার পর ধীরে ধীরে সেই বৃক্ষ-শাখার উপর দিয়া সে পাল মহাশয়ের দ্বিতীয় ঘরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। একটু দূরে গ্যাসের আলোক ছিল, তাই আমি তাহাকে দেখিতে পাইলাম ; নতুবা সে অন্ধকার রাত্রিতে আমি তাহাকে দেখিতে পাইতাম না। যখন সে আরও অগ্রসর হইল, তখন আমি দেখিলাম যে, সে কোনরূপ জন্তু নহে। তাহার আকৃতি কতকটা মানুষের মত। মানুষের মত বটে ; অথচ তাহাকে মানুষ বলিয়া আমার বোধ হইল না। ঘোড়ার মত তাহার মুখ লম্বা ছিল। মুখের বর্ণ সবুজ। বন্য-শূকরের ন্যায় বড় বড় দাঁত। যে স্থানে চক্ষু থাকে, তাহার সেই স্থানে গোল গোল দুইটি গর্ত ছিল। শরীরের নিম্নভাগ মানুষের মত ছিল। কিন্তু সে মানুষ নহে, ভূতও নহে। আমি ভাবিলাম যে, যখন ইহার সবুজ কপালের উপর রক্তচন্দনের দীর্ঘ ফোঁটা রহিয়াছে, তখন এ নিশ্চয়ই রাক্ষস। আর, তাহার কি দাড়ি! ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এমন চাঁপদাড়ি তো কখনও দেখি নাই! গোঁফে ও দাড়িতে তাহার সেই সবুজ লম্বা মুখমণ্ডলের অধোদেশটি আবৃত হইয়াছিল। ভয়ে আমি বিহ্বল হইয়া পড়িলাম, আতঙ্কে স্তম্ভিত হইয়া আমি আর জানালা বন্ধ করিয়া দিতে পারিলাম না, সে স্থান হইতে পলাইতেও পারিলাম না, কি চিৎকার করিতেও পারিলাম না!

আরও অদ্ভুত কথা। সেই রাক্ষসটা ক্রমে অগ্রসর হইয়া পাল মহাশয়ের দ্বিতীয় অর্থাৎ মাঝের ঘরের জানালার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পর সেই জানালাতে সে অঙ্গুলি দ্বারা টোকা মারিয়া ইঙ্গিত করিতে লাগিল। এইরূপ কিছুক্ষণ অতি ধীরে ধীরে জানালায় শব্দ করিবার পর ভিতর হইতে কে জানালা উদঘাটন করিল, গ্যাসের আলোকে নিমিষের নিমিত্ত আমি তাহার হস্তটি দেখিতে পাইলাম। সেই হাতে সোনার বালা ছিল। মৃণাল-সদৃশ সেই কোমল বাহু,—পাল মহাশয়ের বয়স্ক গৃহিণীর নহে, সে হস্ত তাঁহার কন্যার। সবুজ রাক্ষসের সহিত পাল মহাশয়ের কন্যার সম্বন্ধ!

চতুর্থ অধ্যায়

সবুজ রাক্ষস

জানালার ধারে অশ্বত্থ ডালের উপর রাক্ষস বসিয়া রহিল। তাহার আকৃতি দেখিয়া আমার কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া গেল। ভয়ে আমি কাঁপিতে লাগিলাম। চিন্তা-শক্তি একেবারে আমার লোপ পাইয়া গেল। একদৃষ্টে আমি তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম।

পাল মহাশয়ের কন্যা প্রথম জানালাটি উদ্ঘাটন করিল। তাহার পর আমি শব্দে বুঝিলাম যে, জানালার দুইটি রেল খুলিয়া সে ভিতর দিকে টানিয়া লইল। রেল তুলিয়া রাক্ষসের জন্য সে পথ করিয়া দিল। রাক্ষস জানালা দিয়া, ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল।

রাক্ষস যেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, আর সেই সময়ে আমার একটু জ্ঞানের উদয় হইল। তাড়াতাড়ি আমি আমার জানালাটি বন্ধ করিয়া দিলাম। জানালা বন্ধ করিয়া আরও আমার একটু সাহস হইল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আর একটি ভয়ের বিষয় আমার মনে উদয় হইল। আমার ঘরের পর পাল মহাশয়ের ঘর ; তাহার পর যে ঘর, সেই ঘরে রাক্ষস প্রবেশ করিয়াছে। দূর অধিক নহে, ভিতর ও বাহির-বাটীর মাঝখানে বারেণ্ডায় সেই একমাত্র দ্বার। সেই পথে আসিয়া রাক্ষস যদি আমাকে খাইয়া যায়? পাল মহাশয়ের কন্যার সহিত তাহার প্রণয়, কারণ, তাহার ইঙ্গিত-শব্দ শ্রবণমাত্র জানালা খুলিয়া রেল তুলিয়া, কত কষ্ট করিয়া, তাহাকে সে ঘরে আসিতে দিয়াছে। নিজের প্রণয়িনীকে সে ভক্ষণ করিবে না। প্রণয়িনীর পিতামাতাকেও সে ভক্ষণ করিবে না। থাকিবার মধ্যে নিকটে আছি আমি। যদি সে বলিয়া বসে যে, আমার ক্ষুধা পাইয়াছে, কিছু জলযোগ করিতে আমার ইচ্ছা হইয়াছে, আর তাহাকে পরিতুষ্ট করিবার নিমিত্ত যদি পাল মহাশয়ের কন্যা আমাকে দেখাইয়া দেয়, তাহা হইলে আমি কি করিব?

বিবাহের লোভে কেন যে মরিতে এ স্থানে আসিয়াছিলাম। একবার মনে করিলাম যে, সে বাটী হইতে পলায়ন করি। আর একবার মনে করিলাম যে, চিৎকার করিয়া পাঁচজনকে আহ্বান করি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম যে, কাজ নাই বাপু! আর দ্বার খুলিবার শব্দ পাইয়া রাক্ষস চাই কি কুপিত হইতে পারে। রাক্ষসের কোপে পড়িয়া শেষে কি প্রাণটা হারাইব। আজ হয়, দুই দিন পরে হয়, সুবিধা পাইলেই সে আমাকে খাইয়া ফেলিবে।

এইরূপ চিন্তা করিয়া বিছানায় আমি শুইয়া পড়িলাম। শয়ন করিয়া পাল মহাশয়ের কন্যার কথা ভাবিতে লাগিলাম। এই বালিকাবয়সে রাক্ষসের সহিত প্রণয়! ছি! ভাল কন্যাকে বিবাহ করিতে আমার মন-প্রাণ এত আকুল হইয়াছিল। এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে নিদ্রায় আমি অভিভূত হইয়া পড়িলাম। ইহার পর কি হইল, আর আমি কিছুই জানি না।

পরদিন প্রাতঃকালে, দিনের আলোকে আমার অনেকটা সাহস হইল। গত রাত্রির ঘটনা বার বার চিন্তা করিতে লাগিলাম। একবার মনে করিলাম, সে সমুদয় মিথ্যা, স্বপ্নমাত্র। কিন্তু ভালরূপে অনুধাবন করিয়া অবশেষে স্থির করিলাম যে, না, সে স্বপ্ন নহে; সত্য সত্যই আমি এক অপূর্ব জীব দর্শন করিয়াছিলাম; সে জীব রাক্ষস হউক, আর ভূতই হউক, আর যাহাই হউক। গত রাত্রিতে মনে করিয়াছিলাম যে, এ বাটীতে আর থাকিব না, অন্য স্থানে গিয়া বাসা করিব। কিন্তু প্রাতঃকালে সে কল্পনা পরিত্যাগ করিলাম। মনে করিলাম যে, ইহার সবিশেষ তত্ত্ব আমাকে লইতে হইবে।

পাল মহাশয়ের বালিকা কন্যা যে সেই কিম্ভূতকিমাকার সবুজ রাক্ষসের প্রেমে আবদ্ধ হইয়াছে, একথা বিশ্বাস করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না। তাহা ব্যতীত সহসা বাটী পরিত্যাগ করিয়া অন্য বাটীতে বাসা করিলে পাছে রাক্ষসের কোপে আমি পতিত হই, সে আশঙ্কাও আমার মন হইতে দূর হয় নাই।

আমি ভট্টাচার্য মহাশয়ের ঘরে গমন করিলাম। তাঁহাকে একেলা পাইয়া গত রাত্রির সমস্ত বিবরণ তাঁহার নিকট বর্ণন করিলাম। তাঁহার ঘরের ভিতর দাঁড়াইয়া, তাঁহাকে আমি এই বিবরণ প্রদান করিতেছিলাম। আমার কথা প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে চক্ষু টিপিলেন। তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আমি ঘরের দ্বারের দিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, দ্বারের নিকট একটু অন্তরালে দাঁড়াইয়া গোঁপ-ছাঁটা নিয়োগী সমুদয় কথা শুনিতেছে। আমি যেই ফিরিয়া চাহিলাম, আর তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে সে প্রস্থান করিল। ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘নিয়োগী ভালমানুষ নহে। পাল মহাশয়ের এ বন্ধু, কটুম্ব ও হবু বৈবাহিক। তোমার কথা এ শুনিয়া ফেলিল। কাজটা বড় ভাল হইল না।’

তাহার পর ভট্টাচার্য মহাশয় পুনরায় বলিলেন, ‘বড়ই আশ্চর্য কথা তুমি বলিলে। যাহা বলিলে, তাহা সত্য কি স্বপ্ন, আমি বুঝিতে পারিতেছি না। কিন্তু যখন তাহার বড় বড় দাঁত, চক্ষু স্থানে কেবল কোটর, রং সবুজ, আর কপালে লাল ফোঁটা, তখন সে নিশ্চয় রাক্ষস, সামান্য ভূত নহে। আমাদের গ্রামের নিকট একবার এইরূপ একটা রাক্ষস আসিয়াছিল।’

পঞ্চম অধ্যায়

হারাণ সুরের গল্প

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হইয়াছিল?’ ভট্টাচার্য মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘সে তোমাদের জাতি। তাহার নাম ছিল হারাণ সুর। লোকালয় হইতে কিছু দূরে গ্রামের প্রান্তভাগে মাঠের ধারে হারাণ সুর আপনার স্ত্রী ও দুইটি শিশুপুত্র লইয়া বাস করিত। হারাণ সুরের পীড়া হইল। কিছুদিন পীড়া ভোগ করিয়া একদিন রাত্রিতে তাহার মৃত্যু হইল। শিশু দুইটিকে ছাড়িয়া লোক ডাকিবার নিমিত্ত, তাহার স্ত্রী সে রাত্রি বাহির হইতে সাহস করিল না। শিশু দুইটিকে লইয়া স্বতন্ত্র একটি শয্যাতে শয়ন করিয়া, সে কাঁদিতে লাগিল। যখন ঘোর রাত্রি হইল, তখন কে একজন বাহিরে আসিয়া ঘরের আগড় ঠেলিতে লাগিল, “মাসি! আগড় খুলিয়া দাও।” হারাণের স্ত্রী মনে করিল যে, আমার বোন্‌পো তো কেহ নাই; এ ঘোর রাত্রিতে বিপদের সময় কে আসিয়া ডাকাডাকি করে। সেজন্য প্রথম উত্তর দিল না। কিন্তু বাহিরের সে ব্যক্তি পুনরায় সবলে আগড় ঠেলিয়া বলিল, “শীঘ্র দ্বার খুলিয়া দাও, মাসি! মেসো মহাশয়ের পীড়ার কথা শুনিয়া আমি আসিয়াছি। শীঘ্র আগড় খুলিয়া দাও।”—হারাণের স্ত্রী ভাবিল যে, দুরসম্পৰ্কীয় তাহার কোন ভগিনী থাকিতে পারে। কর্তা হয়তো তাহার পুত্রের নিকট সংবাদ প্রেরণ করিয়াছিলেন। সেজন্য সে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এইরূপ মনে করিয়া চক্ষের জল ফেলিতে ফেলিতে সে শয্যা হইতে উঠিয়া আগড় খুলিয়া দিল। সেই মুহুর্তে ভয়ঙ্কর এক মূর্তি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। ঘরে মিটমিট করিয়া একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। সেই আলোকে হারাণের পত্নী সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখিতে পাইল। তাহার বর্ণ সবুজ, তাহার মুখ ও পেট যেন এক-একটি জালা। তাহারও কপালে ফোঁটা ছিল! সেই জন্য আমার বোধ হয় যে তুমি কাল রাত্রিতে যাহাকে দেখিয়াছিলে, সেও রাক্ষস—ভূত নহে। কারণ, ভূতে ফোঁটা কাটে না, আর তাহাদের রং সবুজ হয় না।’

এতদূর বলিয়া ভট্টাচার্য মহাশয় চুপ করিলেন। অতি আগ্রহের সহিত আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘হারাণ সুরের ঘরে তাহার পর রাক্ষস কি করিল?’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখিয়া, হারাণ সুরের পত্নীর প্রাণ উড়িয়া গেল! তাড়াতাড়ি সে ছেলে দুইটির নিকটে গিয়া তাহাদের মাঝখানে শয়ন করিল। ভাগ্যে শীতকাল ; সেজন্য বিছানায় বড় একখানি কাঁথা ছিল। সেই কাঁথা দিয়া ছেলে দুইটিকে সে ঢাকা দিল! নিজেও কাঁথা মুড়ি দিয়া কাঁদিতে ও কাঁপিতে লাগিল।

‘রাক্ষস কিন্তু তাহাদিগকে কিছু বলিল না। ঘরের অপর পার্শ্বে যে স্থানে একটি মাদুরের উপর হারাণ সুরের মৃতদেহ পড়িয়াছিল, রাক্ষস বরাবর সেই স্থানে গিয়া মাদুরের উপর উপবেশন করিল। তাহার পর, মড়াৎ করিয়া হারাণের একটি হাত ভাঙ্গিয়া কড়মড় শব্দে চিবাইতে লাগিল। সে হাতটি সমাপ্ত হইলে পুনরায় আর একটি হাত ভাঙ্গিয়া সেইরূপে ভক্ষণ করিল। হাত দুইটি শেষ হইলে একটি পা ভাঙ্গিয়া খাইতে লাগিল। ঘরের ভিতর ক্রমাগত চপ্‌-চপ চপ্‌-চপ্‌, কড়্‌-মড়্‌ কড়-মড়্‌ শব্দ হইতে লাগিল। সেই শব্দে শিশু দুইটির নিদ্রাভঙ্গ হইল। গা টিপিয়া মাতা তাহাদিগকে কাঁদিতে নিষেধ করিল। কাঁদিবে কি, চিৎকার করিবে কি, তোমার মত তাহারাও ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল। ভয়ে জড়সড় হইয়া কাঁথার ফাঁক দিয়া তিনজনে এই ভীষণ ও বীভৎস ব্যাপার দর্শন করিতে লাগিল। হারাণের স্ত্রী ভাবিতে লাগিল, স্বামীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাক্ষস যেরূপ শীঘ্র শীঘ্র ভক্ষণ করিতেছে, তাহাতে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে সমুদয় শরীরটা খাইয়া শেষ করিবে। ইহার পেটটি যেরূপ জালার মত দেখিতেছি, তাহাতে একটি দেহ খাইয়া ইহার পেট ভরিবে না। তখন আমাদের তিনজনকেই হয়তো খাইয়া ফেলিবে। নিজের যাহা হউক, শিশু দুইটিকে যে সে ভক্ষণ করিবে, প্রাণ থাকিতে তাহা তো আমি দেখিতে পারিব না। এইরূপ চিন্তা করিয়া হারাণের স্ত্রী গা টিপিয়া শিশু দুইটিকে উঠিয়া বসিতে ইঙ্গিত করিল। তাহারা উঠিয়া বসিল। তখন সে ছেলে দুইটির হাত ধরিয়া ঘর হইতে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিল। আগড়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইয়াছে, এমন সময় রাক্ষসের দৃষ্টি তাহাদের উপর পড়িল। চক্ষুর্দ্বয় রক্তবর্ণ করিয়া, দন্ত কড়মড় করিয়া অতি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাস্‌?”—হারাণের পত্নী সভয়ে অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “কোথাও যাই নি, বাবা! ছেলে দুইটি এখনি বিছানা ভিজাইয়া দিবে, সেজন্য তাহাদিগকে একবার বাহিরে লইয়া যাইতেছি।”—রাক্ষস বলিল, “শীঘ্র আসিস্‌।”—হারাণের পত্নী বলিল, “হাঁ, বাবা, শীঘ্র আসিব।”—এই কথা বলিয়া আগড় খুলিয়া ছেলে দুইটিকে লইয়া, সে ঘর হইতে বাহির হইল। ঊর্ধ্বশ্বাসে তিনজনে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়া, এক প্রতিবেশীর গৃহে গিয়া আশ্রয় লইল। প্রতিবাসী দিগের নিকট সকল বিবরণ প্রকাশ করিল। কিন্তু সে রাত্রিতে রাক্ষসের সম্মুখে যাইতে কেহই সাহস করিল না। পরদিন প্রাতঃকালে অনেক লোক একত্র হইয়া লাঠি-সোঁটা লইয়া হারাণের গৃহে গিয়া দেখিল যে, সে রাক্ষস নাই, হারাণের দেহও নাই, কেবল দুই-চারিখানি অতি ক্ষুদ্র হাড়ের কুচি ঘরের ভিতর মাদুরের উপর পড়িয়া আছে। সমুদয় দেহটি ভক্ষণ করিয়া, রাক্ষস প্রস্থান করিয়াছে।’

ষষ্ঠ অধ্যায়

পত্রের অর্থ

এই গল্প শুনিয়া আমার বড় ভয় হইল। আমি বলিলাম, ‘ভট্টাচার্য মহাশয়! আর আমি এ বাটীতে থাকিব না। গত রাত্রিতে রাক্ষসের বোধ হয় ক্ষুধা ছিল না, তাই আমার প্রাণ বাঁচিয়া গিয়াছে। কিন্তু এবার যেদিন সে আসিবে, সেদিন যদি তাহার ক্ষুধা থাকে, তাহা হইলে কি হইবে? নিকটে পাইয়া নিশ্চয় সে আমাকেই খাইবে। অতএব অদ্যই আমি এ বাসা হইতে উঠিয়া যাইব। প্রাণটা থাকিলে অনেক কন্যা জুটিবে, অনেক বিবাহ হইবে। পাল মহাশয়ের কন্যায় আর আমার প্রয়োজন নাই।’

ভট্টাচার্য মহাশয় হাসিয়া উত্তর করিলেন, ‘তুমি ইংরেজী পড়িয়াছ। ইংরেজী পড়িয়া ভূত প্রেত রাক্ষসে এত তোমার ভয় কেন? এ কলিকাতা শহর। আমি অনেকদিন কলিকাতায় আছি। এ স্থানে কখনও রাক্ষসের উপদ্রব হইতে শুনি নাই। কলিকাতা শহরে একটি মানুষকেও কখন রাক্ষসে খায় নাই। তোমার কোন ভয় নাই। ব্যস্ত হইও না। দেখ না কি হয়! রাত্রিতে একটু সতর্ক থাকিবে। রাক্ষস যদি পুনরায় আগমন করে, তাহা হইলে আমাকে বলিবে। আজ আমি তোমাকে রাম-কবচ লিখিয়া দিব। তাহা ধারণ করিলে, আর তোমার কোন ভয় থাকিবে না।’

রাম-কবচ ধারণ করিয়া আমার ভয় দূর হইল। সে বাসা পরিত্যাগ করিয়া, অন্য স্থানে আমি আর গমন করিলাম না। তাহার পর দুই রাত্রি আমি একটা পর্যন্ত জাগিয়া রহিলাম। মাঝে মাঝে জানালা খুলিয়া, অশ্বত্থগাছের দিকে দেখিতে লাগিলাম। কিন্তু আর রাক্ষস দেখিতে পাইলাম না। তৃতীয় দিনে আফিস হইতে আসিয়া বারেণ্ডায় দাঁড়াইয়া আমার ঘরের তালা খুলিতেছি, এমন সময় বাড়ির ভিতর যাইবার যে দ্বার সর্বদা বন্ধ থাকে, পাল মহাশয়ের দিক হইতে সে দ্বারে কে ধাক্কা মারিল, আর তৎক্ষণাৎ কপাটের ফাঁক দিয়া আমার দিকে কে একখণ্ড কাগজ ফেলিয়া দিল। তাড়াতাড়ি আমি কাগজখানি কুড়াইয়া লইলাম। তাহার পর ঘরের ভিতর গিয়া, তক্তপোশের উপর বসিয়া, তাহা আমি পাঠ করিলাম। কাগজখানিতে এইরূপ লেখা ছিল,—

“মহাশয়! আমাদের বিষয়ে আপনি লোককে কোন কথা বলিয়াছেন। লোকের কাছে এরূপ গল্প করিলে আমাদের মন্দ হইবে। এরূপ গল্প আর করিবেন না। আমাদের এই উপকার করিবেন।”

কাগজখানিতে কাহারও নাম স্বাক্ষর ছিল না। কিন্তু হাতের লেখা নিতান্ত কাঁচা। তাহা দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, এ লেখা পাল মহাশয়ের কন্যার। তাহার পত্র পাইয়া আমি রাক্ষসের কথা সব ভুলিয়া যাইলাম। কাগজে লেখা আছে,—‘আমাদের এই উপকার করিবেন।’ ইহার অর্থ কি? পাল মহাশয়ের কন্যা দ্বারের ফাঁক দিয়া আমাকে দেখিয়া থাকিবে। আমার রূপ দেখিয়া সে মোহিত হইয়াছে, আমার উপর সে মন-প্রাণ সমর্পণ করিয়াছে। ঐ চারিটি কথার ইহা ভিন্ন অন্য অর্থ হইতে পারে না। উপকার! আমাকে ভালবাসে, আমাকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত সে লালায়িত হইয়াছে। সামান্য ঐ ‘উপকার’ কথাটির ভিতর যে এত অর্থ নিহিত আছে, অন্যে তাহা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু আমাদের দুইজনের মন-প্রাণ এক হইয়া গিয়াছে, সেজন্য তাহার মনের ভাব আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারিলাম।

পুলকে পুলকিত হইয়া কাগজখানি আমি একবার মাথায় রাখিলাম। তাহার অর্থ এই যে, ‘হে সুন্দরি! তোমার আজ্ঞা আমি শিরোধার্য করিলাম।’ তারপর তক্তপোশের উপর শয়ন করিয়া কাগজখানি আমি বুকের উপর রাখিলাম। তাহার অর্থ যে, ‘হে বরাননে! তোমার পত্রস্পর্শে আমার উত্তাপিত হৃৎপিণ্ড সুশীতল হইল।’

সাধে কি পিতা-মাতা আমার নাম মদন রাখিয়াছেন! মদন না হইলে এত ভাবুক আর কেহ হইতে পারে না। কিন্তু এমন সুখের সময় পোড়া রাক্ষসের কথা পুনরায় আমার মনে পড়িল। যাহার পায়ে আমি প্রাণ সঁপিয়াছি, কদাকার দুরন্ত রাক্ষসের সহিত তাহার যে ভাব, সেই চিন্তায় আমার হৃদয় জর-জর হইল। তাহার পর যক্ষ-রক্ষ প্রভৃতি দেব-যোনি-ভুক্ত জীবগণ অন্তর্যামী হইয়া থাকে। আমার মনের কথা যদি সেই রাক্ষস জানিতে পারে? কুপিত হইয়া রাত্রিকালে আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া যদি হারাণ সুরের ন্যায় কড়মড় করিয়া আমাকে ভক্ষণ করে? প্রাতঃকালে উঠিয়া সকলে যদি দেখে যে, মদনের আর চিহ্নমাত্র নাই, বিছানার উপর কেবল দুই-তিন কুচি হাড় পড়িয়া আছে?

ভয়ের কথা বটে। কিন্তু চিরকাল হইতে আমি সাহসী পুরুষ ; তাহাতে রাম-কবচ ধারণ করিয়াছি। নানারূপ প্রবোধ দিয়া মন হইতে রাক্ষসকে দূর করিলাম। আমি ভাবিলাম যে, পাল মহাশয়ের কন্যার ন্যায় শান্ত সুশীলা রূপবতী গুণবতী কামিনী রাক্ষসের সহিত প্রণয় করিতে পারে না। তাহা যদি করিত, তাহা হইলে আমাকে ঘোরতর ভালবাসিয়া আমার নিকট উপকারের প্রার্থনা করিত না। প্রকৃত আমি রাক্ষস দেখি নাই, আমি স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। আর যদিও প্রকৃত সে রাক্ষস হয়, তাহা হইলে পাল মহাশয়ের নিকট অন্য কোন কাজে সে আসিয়া থাকিবে। কলিকাতা শহরে জনাকীর্ণ পথে দিনের বেলা গাড়ি করিয়া অথবা পদব্রজে রাক্ষস আসিতে পারে না। সেজন্য রাত্রিকালে গোপনভাবে আসিয়াছিল। শুনিয়াছি যে, শহরের ভিতর উট কি হাতি আসিবার হুকুম নাই। রাক্ষস আসিবারও বোধ হয় হুকুম নাই।

এইরূপ নানাপ্রকার প্রবোধ দিয়া মন হইতে কুচিন্তা আমি দূর করিলাম। পালকন্যার কল্পিত মুখচন্দ্রের বিমল জ্যোতি দ্বারা আমার তাপিত হৃদয় আলোকিত ও স্নিগ্ধ করিতে লাগিলাম।

সপ্তম অধ্যায়

মদনের বদনে অম্বলের বড়ি

দুইদিন পরে অপরাহ্ণে আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমি বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, এমন সময় দ্বারের নিকট পাল মহাশয়ের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তিনি বাহিরে যাইতেছিলেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করিতেছিলাম। আমাকে দেখিয়া পাল মহাশয় দাঁড়াইলেন। তাহার পর, আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমার ঘরের পার্শ্বে তুমিই বাসা লইয়াছ?’

স্বয়ং পাল মহাশয় আমার সহিত কথা কহিলেন! হৃদয়-মন্দিরে যে দেবীকে স্থাপিত করিয়া অহরহ পূজা করি, সেই দেবীর পিতা আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন! শরীর আমার শিহরিয়া উঠিল, মন আমার পুলকিত হইল, বুক আমার ঢিপঢিপ করিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম, ‘মদন! প্রাতঃকালে আজ কাহার মুখ তুমি দেখিয়াছিলে?’

অতি বিনীতভাবে আমি উত্তর করিলাম, ‘আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়। আমিই আপনার ঘরের পার্শ্বে বাস করি।’

পাল মহাশয় পুনরায় বলিলেন, ‘তুমি অতি উত্তম মহাভারত পাঠ করিতে পার। তবে কি জান, দূর হইতে আমি বুঝিতে পারি না, কেবল শব্দ পাই, এইমাত্র। বৃথা শব্দ শুনিয়া কি হইবে, সেইজন্য ধীরে ধীরে পড়িতে বলিয়াছিলাম। সন্ধ্যার পর যদি তোমার অবকাশ থাকে, আর আমার ঘরে আসিয়া যদি তুমি পাঠ কর, তাহা হইলে আমি শ্রবণ করি।’

আগ্রহের সহিত আমি উত্তর করিলাম, ‘সন্ধ্যার পর আমার কোন কাজ নাই। আপনি ডাকিলেই আমি আপনার ঘরে গিয়া মহাভারত পাঠ করিতে পারি।’

পাল মহাশয় বলিলেন যে, ‘তবে আজ সন্ধ্যাবেলা আমি তোমাকে ডাকিব। এক ঘন্টাকাল তোমার নিকট আমি মহাভারত শ্রবণ করিব।’

সন্ধ্যার পর পাল মহাশয় সেই বারেণ্ডার দ্বারে ধাক্কা মারিয়া আমাকে ডাকিলেন। আমি তাঁহার ঘরে গিয়া, অনেকক্ষণ পর্যন্ত মহাভারত পাঠ করিলাম। আমার কণ্ঠস্বর অতি মধুর, তাহার উপর আমি সুর করিয়া পড়িতে পারি। নিজে পাঠ করিয়া আমি নিজেই মোহিত হই। কিন্তু পাল মহাশয়ের বোধ হয়, সঙ্গীত-বিদ্যায় অধিকার নাই। তিনি বলিলেন, ‘এ কাশীদাসী মহাভারত অথবা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নহে। সুর করিয়া পড়িতে হইবে না, সহজ ভাষায় পাঠ কর।’ যে আজ্ঞা, বলিয়া আমি তাহাই করিতে লাগিলাম।

এইরূপ প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমি তাঁহার নিকট মহাভারত পাঠ করিতে লাগিলাম। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। রবিবারে নিমন্ত্রণ করিয়া, অতি আদরে তিনি আমাকে ভোজন করাইলেন।

প্রথম দুই-চারি দিন আমি তাঁহার কন্যাকে দেখিতে পাই নাই। পাল মহাশয়ের গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত সতৃষ্ণনয়নে আমি চারিদিকে চাহিয়া থাকিতাম ; তাহার মলের শব্দ অথবা কণ্ঠস্বর শুনিবার নিমিত্ত সতৃষ্ণ কর্ণে সর্বদাই আমি সতর্ক থাকিতাম। যেদিন আমার নিমন্ত্রণ হইয়াছিল, সেই রবিবারে আমার বাসনা পূর্ণ হইল। একজন ঠিকা ঝি ব্যতীত পাল মহাশয়ের অন্য দাসদাসী ছিল না। প্রাতঃকালে দুই-এক ঘন্টা,—অপরাহ্ণে দুই-এক ঘন্টা, কাজ করিয়া সে ঝি আপনার গৃহে চলিয়া যাইত। আমি ও পাল মহাশয় যখন ভোজন করিতে বসিলাম, ঝি তখন উপস্থিত ছিল না। আহার করিতে বসিয়া আমাদের যাহা কিছু প্রয়োজন হইল, সে সমুদয় পাল মহাশয়ের কন্যা আনিয়া দিল। সেই দিন তাহাকে দর্শন করিয়া আমার নয়ন সার্থক হইল।

নিশ্চয় নয়ন সার্থক হইল। তাহাকে দেখিলে কাহার না নয়ন সার্থক হয়? কেমন মাজা-মাজা উজ্জ্বল রং! কেমন নরম-নরম গোল-গোল গায়ের গড়ন! চাঁদের মত মুখখানি বটে, কিন্তু চাঁদ যেরূপ চাকার ন্যায় গোল, সেরূপ গোল নহে। চাঁদের মুখে অলকা-তিলকা আছে, ইহার তাহা নাই। নাকটি শুক-চঞ্চুর ন্যায় বটে, কিন্তু সেইরূপ বঁড়শীর ন্যায় বক্র নহে। চক্ষু দুইটি মৃগ-নয়নের মত বটে, কিন্তু সেরূপ ড্যাব্‌ডেবে নহে। বাহু দুইটি মৃণালের মত বটে, কিন্তু ততটা সরু নহে। ঊরুদ্বয় রাম-রম্ভাকে পরাজয় করে বটে, কিন্তু তত মোটা নহে। ফলকথা, কালিদাস, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি কবিদিগের রূপ-বর্ণনা পাঠ করিয়া যেরূপ মুখশ্রী আমি মনে মনে কল্পনা করিয়াছিলাম, তাহার কিছুই নহে। তাহার মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিক মানুষের মত ; কবি-কল্পিত কোনরূপ অলৌকিক অদ্ভুত জীবের ন্যায় নহে। তাহাকে দেখিয়া আপনাদের দাসানুদাস মদনের মুণ্ড ঘুরিয়া গেল। প্রথমে শাকের ঘন্ট না খাইয়া, প্রথমে অম্বলের বড়ি মদন বদনে দিয়া বসিলেন!

অষ্টম অধ্যায়

মেদো চাঁড়াল ও পঞ্চুবাবু

পাল মহাশয়ের সহিত এইরূপে আমার পরিচয় হইল। দিন দিন তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তাঁহার কন্যার রূপে-গুণে আমার মন মোহিত হইয়া গেল। কি করিয়া তাহাকে পাইব, কেবল সেই চিন্তায় আমি দিনপাত করিতে লাগিলাম। রাক্ষসকে আর আমি দেখিতে পাই নাই। সে রাত্রির ঘটনা স্বপনের ন্যায় মিথ্যা বলিয়া ক্রমে আমার প্রতীতি হইল।

কিছুদিন গত হইলে, পাল মহাশয়ের কন্যার সহিত আমার বিবাহের কথা উত্থাপন করিবার নিমিত্ত ভট্টাচার্য মহাশয়কে আমি অনুরোধ করিলাম। তখন বৈশাখ মাস। ফল দিবার নিমিত্ত পাল মহাশয়ের গৃহিণী একদিন ভট্টাচার্য মহাশয়কে বাটীর ভিতর ডাকিলেন। ফল গ্রহণ করিয়া, কিছুক্ষণের নিমিত্ত তিনি পাল মহাশয়ের নিকট বসিলেন। সেই অবসরে তিনি আমার বিবাহের কথা উত্থাপন করিলেন। পাল মহাশয়ের সহিত এ সম্বন্ধে যেরূপ কথাবার্তা হইয়াছিল, সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে তাঁহার ঘরে ডাকিয়া, সে সমুদয় বিবরণ প্রদান করিলেন। পাল মহাশয়ের সহিত তাঁহার এইরূপ কথাবার্তা হইয়াছিল।

ভট্টাচার্য মহাশয় পাল মহাশয়কে বলিলেন, ‘নিয়োগী মহাশয়ের পুত্রের পীড়া ক্রমেই কঠিন হইয়া উঠিতেছে। এ যাত্রা সে আর রক্ষা পাইবে না।’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘হাঁ! পীড়া বড়ই কঠিন হইয়াছে।’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘আমি শুনিয়াছি যে, আপনার কন্যার সহিত তাহার বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে। এ যাত্রা সে রক্ষা পাইলেও, কাস রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে কন্যা-সম্প্রদান শাস্ত্রনিষিদ্ধ।

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘আমি তাহা জানি। কিন্তু কি করিব! আমার কন্যা যখন ছয় মাসের, তখন হইতে নিয়োগীর সহিত আমার কথা হইয়াছে। তাহার এই ঘোর বিপদের সময় কোন কথা আমি বলিতে পারি না। নিয়োগীর সহিত বিবাদ করিতেও আমি ইচ্ছা করি না। নিয়োগী-পুত্রের শরীর দিন দিন যেরূপ শীর্ণ হইয়া পড়িতেছে, তাহাতে অল্পদিনের মধ্যেই বোধ হয়, আমি আমার প্রতিজ্ঞা হইতে মুক্ত হইব। তবে সে কথা এখন আর বৃথা তুলিয়া প্রয়োজন কি?’

ভট্টাচার্য মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘অন্য কোন স্থানে পাত্র স্থির করিয়াছেন?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘না, এখনও কোন স্থানে স্থির করিতে পারি নাই ; তবে গোপনে অনুসন্ধান করিতেছি।’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘আপনার ঘরের নিকট মদনমোহন বলিয়া ঐ যে ছোকরা থাকে, তাহার সহিত দিলে হয় না? ছোকরা শান্ত, সচ্চরিত্র, লেখাপড়া জানে, দু’-পয়সা উপার্জনও করিতেছে।’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘কিছুতেই নয়! সে আমাদের স্বজাতি শুনিয়া, আমিও প্রথম সেইরূপ ইচ্ছা করিয়াছিলাম। কিন্তু গোপনে তাহার সমুদয় সন্ধান লইয়া এখন সে ইচ্ছা আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। আমরা লেখাপড়া-জানা চাক্‌রে ভদ্র সদগোপ। মদনের বাপ স্বহস্তে লাঙ্গল ধরিয়া চাষ করিত। অতিকষ্টে সে ছেলেটিকে লেখাপড়া শিক্ষা দিয়াছে। চাষ করা যে নিতান্ত গর্হিত কাজ, লেখাপড়া শিখিয়া মদন তাহা বুঝিয়াছে। সেজন্য বাপকে এখন সে একখানি মুদিখানার দোকান করিয়া দিয়াছে। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়! পূর্বের কলঙ্ক ঘুচিবার নহে। আমি চাক্‌রে সদ্‌গোপ হইয়া, চাষী সদগোপের সহিত কন্যার বিবাহ কি করিয়া দিব?’

ভট্টাচার্য মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘স্বহস্তে চাষ করা কি নিতান্ত অন্যায় কাজ?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘আপনি নিজেই কেন বুঝিয়া দেখুন না? চাষ করিলে মানুষ চাষা হয়, আর চাকরিতে মানুষ বাবু হয়। তাহার যত টাকা থাকুক না কেন, আপনার নিকট একজন চাষা আসিলে নাক সিট্‌কাইয়া আপনি তাহার সহিত কথা কহিবেন না। কিন্তু সেই জাতীয় কোন লোক যদি চাক্‌রে হয়, তাহা হইলে, “আসুন, আসুন, বাবু আসুন” বলিয়া আপনি তাহাকে মাথায় তুলিয়া লইবেন। কেবল আপনি নহেন, দেশের সকল লোকই এইরূপ করিয়া থাকে। আমাদের গ্রামে দুইজন চাঁড়াল আছে—একজনের নাম মাধব আর একজনের নাম পঞ্চু। দুইজনে একসঙ্গে পাঠশালায় লিখিয়াছিল। আলু, আম ও পাটের চাষ করিয়া মাধব বিলক্ষণ দু’-পয়সা সঙ্গতি করিয়াছে। কিন্তু সে নিজে হাতে কোদালি-কুঠারি ধরিয়া পরিশ্রম করে। সেজন্য সকলে তাহাকে মাধব না বলিয়া মেদো চাঁড়াল বলে। পঞ্চু একটু ইংরেজী শিখিয়া পনের টাকা বেতনে রেলে টিকিট টাকা কাজ পাইয়াছে ; সেজন্য সকলে তাহাকে পঞ্চুবাবু বলে। চাকরি না করিয়া সে যদি চাষের কাজ করিত, তাহা হইলে কেহ তাহাকে পঞ্চুবাবু বলিত না, সকলেই তাহাকে পেঁচো চাঁড়াল বলিত। এইজন্য হাড়ি বাগদী সকলেই আপন পুত্রদিগকে ইংরেজী শিক্ষা দিয়া, চাক্‌রে করিতে চেষ্টা করিতেছে। কাহার না ইচ্ছা যে, তাহার ছেলে জেন্টলম্যান হয়?’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘সত্য বটে। ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে যাঁহারা চিরকাল পুরুষ-পুরুষানুক্রমে অধ্যাপক পণ্ডিতের ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া আসিতেছিলেন, তাঁহারাও এক্ষণে পুত্রদিগকে ইংরেজী শিক্ষা দিয়া জেন্টুমান করিতেছেন।’

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘আমাদের মধ্যে যেরূপ ভদ্র সদ্‌গোপ ও চাষী সদ্‌গোপ আছে, আপনাদের মধ্যেও সেইরূপ ভদ্র ও চাষী ব্রাহ্মণ আছে। হলধারী ব্রাহ্মণদিগকে বাভন বলে ; বেহার অঞ্চলে তাহারা বাস করে। ভাল ব্রাহ্মণগণ যেরূপ তাহাদের সহিত আদান-প্রদান করিতে পারে না, আমরাও সেইরূপ চাষী সদ্‌গোপকে কন্যা-সম্প্রদান করিতে পারি না।’

ভট্টাচার্য মহাশয়ের ঘরে বসিয়া, তাঁহার মুখ হইতে আমি এই সমুদয় বিবরণ শ্রবণ করিতেছিলাম। পাল মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি একেবারে বসিয়া পড়িলাম। সত্য বটে, আমার পিতা স্বহস্তে চাষ করিতেন। আর একথাও সত্য যে, চাষ ছাড়াইয়া আমি তাঁহাকে মুদিখানার দোকান করিয়া দিয়াছি। আমি মনে করিয়াছিলাম যে, চাষের কলঙ্ক দূর হইয়াছে ; আমরা এক্ষণে বাবু হইয়াছি। কিন্তু পাল মহাশয় গোপনে গোপনে এত সন্ধান লইবেন, তাহা আমি কি করিয়া জানিব! যাহা হউক, তাঁহার কন্যাকে লাভ করা সম্বন্ধে আমি এক্ষণে হতাশ হইয়া পড়িলাম।

কিন্তু ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া বলিলেন, ‘তুমি হতাশ হইও না। শাস্ত্র হইতে বচন বাহির করিয়া পাল মহাশয়কে আমি বুঝইয়া দিব যে, সকল সদ্‌গোপ একজাতি।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শাস্ত্র হইতে এরূপ বচন বাহির করিতে পারিবেন?’

ঈষৎ হাসিয়া ভট্টাচার্য মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘আমাদের শাস্ত্র মহাসাগরস্বরূপ। এমন জিনিস নাই, যা ইহার ভিতর হইতে বাহির হয় না।’

ভট্টাচার্য মহাশয় বৃদ্ধাঙ্গুলি ও মধ্যমা নাড়িয়া ইঙ্গিত করিলেন। তাহার অর্থ এই যে, সব টাকার খেলা! টাকা দিলে শাস্ত্রের ভিতর হইতে যাহা ইচ্ছা তাহাই বাহির করিয়া দিতে পারা যায়।

এই সময় বাহিরে একটু কাসির শব্দ হইল। ভট্টাচার্য মহাশয় কিছু চমকিত হইয়া বলিলেন, ‘এঃ! গোঁপছাঁটা নিয়োগী আড়ালে দাঁড়াইয়া, আমাদের কথা শুনিতেছে।’

এই কথা বলিতে বলিতে নিয়োগী মহাশয় আসিয়া দ্বারের নিকট দাঁড়াইলেন। ভট্টাচার্য মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন, ‘কি ঠাকুর! সকল সদ্‌গোপ একজাতি? তাহাদের মধ্যে ইতর-ভদ্র নাই?

ভট্টাচার্য মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘হাঁ! আমার মত তাই। সকল সদ্‌গোপ একজাতি। চাষ ছাড়িয়া দিলেও সে সদ্‌গোপ থাকে, অন্য জাতি হয় না। তাহা ব্যতীত তোমরা সকলেই ব্রহ্মার পা হইতে বাহির হইয়াছ।’

নিয়োগী বলিলেন, ‘আমরা ব্রহ্মার পা হইতে বাহির হইয়াছি। আর তোমরা?

ভট্টাচার্য মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘আমরা ব্রহ্মার মুখ হইতে বাহির হইয়াছি।’

এই কথা শুনিয়া নিয়োগী মহাশয় রাগে জ্বলিয়া উঠিলেন। আমাকে লক্ষ্য করিয়া অন্যান্য জাতি বিষয়ে তিনি নানারূপ প্রশ্ন করিলেন। যথাসাধ্য আমি সেই সমুদয় তর্কের উত্তর দিলাম। অবশেষে যখন দেখিলাম যে, তাঁহার ক্রোধ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতেছে ও তিনি অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করিতেছেন, তখন সে স্থান হইতে আমি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলাম। যাইবার সময় নিয়োগী আমাকে বলিলেন, ‘পালের কন্যাকে তুমি বিবাহ করিবে! বামন হইয়া চাঁদে হাত! পাল অন্য স্থানে বর খুঁজিতেছে! বটে! তোমার পালকেও আমি দেখিয়া লইব। রাত্রিতে জানালা দিয়া ঘরে রাক্ষস আসে! বটে! পালকে বলিও যে, রাক্ষসের উপর খোক্কস আছে।’

নবম অধ্যায়

আবার সেই সবুজ রাক্ষস

এই কথা বলিয়া নিয়োগী সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও আমার ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িলাম। মনোদুঃখে সে রাত্রিতে আমি আর আহার করিলাম না। সে রাত্রি পাল মহাশয়ের নিকট মহাভারত পাঠ করিতেও যাইলাম না। ফলকথা, সেইদিন হইতে মহাভারত পাঠে আমার অরুচি জন্মিয়া গেল। পাল মহাশয়ের সহিত কথাবার্তা,—তাঁহার গৃহে যাতায়াতও সেইদিন হইতে আমার অনেক কমিয়া গেল।

এইরূপে কিছুদিন গত হইল। একদিন রাত্রিকালে আমি শয়ন করিয়া আছি। অঘোর নিদ্রায় আমি অভিভূত আছি। বাহির-বাটীতে আমার ঘর, আর ভিতর-বাটীতে পাল মহাশয়ের ঘর,—এই দুই ঘরের মাঝখানে যে দেয়াল, সেই দেয়ালের ঠিক গায়ে আমার বিছানা ছিল। সহসা পাল মহাশয়ের দিক্‌ হইতে সেই দেয়ালের গায়ে গুপ-গুপ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। সেই শব্দে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়া গেল। শুইয়া শুইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে শব্দ করে?’

তাঁহার ঘর হইতে পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘শীঘ্র উঠিয়া বাহিরে এস। বিশেষ প্রয়োজন আছে। গোল করিও না।’

আমি উঠিয়া প্রথমে ঘড়িতে দেখিলাম যে, রাত্রি তখন দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। তাহার পর, দ্বার খুলিয়া আমি বারেণ্ডায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। পাল মহাশয়ও সেই সময় আপনার ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইয়া, বারেণ্ডায় দ্বারের খিল খুলিলেন। আমার দিকে সেই দ্বার শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ ছিল। পাল মহাশয় আমাকে সেই শৃঙ্খল খুলিতে বলিলেন। আমি শৃঙ্খল খুলিলাম। ভিতর-বাটী এবং বাহির-বাটী এক হইয়া গেল। এই সময় আমি দেখিতে পাইলাম যে, লাঠি ধরিয়া কে একজন অতি ধীরে ধীরে পাল মহাশয়ের সিঁড়ি দিয়া নিচে নামিবার উপক্রম করিতেছে, আর প্রদীপ হাতে লইয়া পাল মহাশয়ের গৃহিণী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছেন। ভালরূপে দেখিয়া আমি তাহাকে চিনিতে পারিলাম। সে নিয়োগীর পীড়িত পুত্র। শয্যাশায়ী মরণাপন্ন রোগী এত রাত্রিতে কেন সে স্থানে আসিয়াছে, তাহা ভাবিয়া আমি ঘোরতর বিস্মিত হইলাম।

পাল মহাশয় চুপি চুপি আমাকে বলিলেন, ‘আস্তে আস্তে কথা কহিও। বিশেষ প্রয়োজন আছে। আমার ঘরের ভিতরে এস। তাহার পর সকল কথা তোমাকে বলিব।’

পাল মহাশয়ের আজ্ঞায় বারেণ্ডার দ্বারে খিল দিয়া, নিঃশব্দে আমি তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। পাঁচ-ছয় পা গিয়াই পাল মহাশয়ের ঘরের দ্বারের নিকট উপস্থিত হইলাম। পাল মহাশয় ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও প্রবেশ করিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময়,সর্বনাশ! চাহিয়া দেখি না তাঁহার ঘরের ভিতর সেই রাক্ষস! ঘরের মাঝখানে মাদুরের উপর আসন-পিঁড়ি হইয়া রাক্ষস মহাশয় গট্‌ হইয়া বসিয়া আছেন। আরও আশ্চর্য কথা! লজ্জা-সরমের মাথা খাইয়া, পাল মহাশয়ের কন্যা সেই মাদুরের একপার্শ্বে বসিয়া আছে!

ভয়ে আমার পা থর-থর কাঁপিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম যে, আর কিছু নয়, পাল মহাশয় এই রাক্ষসকে আপনার জামাতা করিয়াছেন। জলখাবারস্বরূপ আমার দেহটি তাহাকে প্রদান করিবার নিমিত্ত এই ঘোর রাত্রিতে তিনি আমাকে ডাকিয়া আনিয়াছেন। মহাভারত পাঠ করাইয়া, নিমন্ত্রণ করিয়া, অনেক দিন হইতে তিনি ইহার যোগাড় করিতেছেন। আমার প্রতি কেন যে তিনি এত কৃপা করিয়াছিলেন, তাহার অর্থ এখন আমি বুঝিতে পারিলাম। আমি আরও ভাবিলাম যে, নিয়োগীদিগেরও ইহাতে যোগ আছে। তা না হইলে, যে লোক বিছানা হইতে উঠিতে পারে না, সে কেন এই রাত্রি দুই প্রহরের সময় এ স্থানে আসিবে! যাহা হউক, আমি তাঁহার ঘরের ভিতর আর প্রবেশ করিলাম না। প্রাণ লইয়া তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে পলায়ন করিবার উপক্রম করিলাম। কিন্তু পাল মহাশয় খপ করিয়া আমার হাত ধরিয়া ফেলিলেন। আমার হাত ধরিয়া তিনি বলিলেন, ‘কোথা যাও!’

আমি তাঁহার পায়ে পড়িলাম। তাঁহার পা দুইটি জড়াইয়া আমি বলিলাম, ‘আমি মায়ের একেলা ছেলে! দোহাই আপনার!’

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘সে আবার কি?’

আমি বলিলাম, ‘দোহাই আপনার। আপনার উনি জামাতা, উনি বোধ হয় বিভীষণের প্রপৌত্র। উনি দেবতা। আমাকে খাইয়া উনি সুখ পাইবেন না। উনি বরং আসিয়া টিপিয়া দেখুন, আমার গায়ে মাংস নাই, আমার গায়ে সব হাড়।’

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘এ বলে কি!’

এই সময় গঙ্গাদত্তর কথা আমার মনে পড়িল। আমি বলিলাম, ‘আমাকে ছাড়িয়া দিন। রাক্ষস মহাশয়ের নিমিত্ত আমি ভাল মোটা তাজা মানুষ ডাকিয়া আনিতেছি। তাহার কোমল মাংস ভক্ষণ করিয়া, রাক্ষস মহাশয় পরম তৃপ্তিলাভ করিবেন। জামাতার আদর করিয়া, আপনিও সন্তোষলাভ করিবেন ; আমাকে খাইয়া তাঁহার সুখ হইবে না। এ চাষার মাংস। স্বহস্তে আমরা চাষ করি। আমাদের মাংস শুষ্ক ও কঠিন,—ঠিক দড়ির মত। দোহাই আপনার!’

এত বিনয়বচনে আমি প্রাণ-ভিক্ষা চাহিলাম, তথাপি পাল মহাশয়ের দয়া হইল না। তিনি আমাকে ছাড়িয়া দিলেন না। তখন নিরুপায় হইয়া যেমন একদিকে তাঁহার হাত ছাড়াইতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম, তেমনি অন্যদিকে লোক জড় করিবার নিমিত্ত চিৎকার করিতে উদ্যত হইলাম। ‘কর কি!’ এই কথা বলিয়া পাল মহাশয় আমার মুখ চাপিয়া ধরিলেন। আর সেই সময় রাক্ষস উঠিয়া আমাকে আসিয়া ধরিল। নিমিষের মধ্যে সে আমাকে ঘরের ভিতর টানিয়া লইল ; তাহার পর, সে ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। একবার, আমাদের গ্রামে, কাজি বুড়ীর ধামা-ঢাকা বীজ মোরগ রাত্রিকালে আমি চুরি করিয়া খাইয়াছিলাম। জবাই করিবার সময়, আমার হাতে সেই মোরগ যেরূপ ঝটপট করিয়াছিল, আজ রাক্ষসের হাতেও আমি সেইরূপ ঝট্‌পট্‌ করিতে লাগিলাম। কিন্তু সে হইল রাক্ষস, আর আমি হইলাম মানুষ। তাহার হাত হইতে আমি আপনাকে ছাড়াইতে পারিলাম না। তাহার স্পর্শে আমার হাত-পা অবশ হইয়া গেল। ক্রমে আমার সর্বাঙ্গ হিম হইয়া গেল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল, কম্পজ্বরের ন্যায় শরীর আমার কাঁপিতে লাগিল, দাঁতে দাঁত লাগিয়া ঠক্‌ঠক্‌ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। আমি অচেতনপ্রায় হইলাম, আমার কণ্ঠ হইতে কেবল গোঁ-গোঁ ধ্বনি বাহির হইতে লাগিল। কিন্তু তখন সম্পূর্ণ ভাবে আমি অজ্ঞান হই নাই, কারণ, তখনও আমি ভাবিতেছিলাম যে, ‘হায় রে! শেষে রাক্ষসের আহার হইব বলিয়া কি বাপ-মা আমাকে এতবড় করিয়াছিলেন?’

দশম অধ্যায়

আমার সাহস ও বিক্রম

কাজি বুড়ীর সেই বীজ মোরগের মত ঝট্‌পট্‌ করিতে করিতে, শরীর আমার অবশ হইয়া পড়িল। অবশেষে আমি একেবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম। অজ্ঞান অবস্থায় কতক্ষণ ছিলাম, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। বোধ হয়, অধিকক্ষণ নহে। পুনরায় আমার জ্ঞান হইলে, চক্ষু চাহিয়া আমি দেখিলাম যে, মাদুরের উপর আমি শয়ন করিয়া আছি। পাল মহাশয়ের গৃহিণী আঁচল দিয়া আমার কপাল মুছাইতেছেন। তাঁহার কন্যা আমাকে বাতাস করিতেছে। নিকটে উনিশ-কুড়ি বৎসর বয়স্ক এক সুশ্রী যুবক বসিয়া আছে। আর কিছু দূরে পাল মহাশয় নিজে বাক্সর ভিতর একটি শিশি তুলিয়া রাখিতেছেন। আমি তখন কোথায় আছি, প্রথম তাহা আমার স্মরণ হইল না। ক্রমে সকল কথা স্মরণ হইল। সভয়নয়নে চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম। কিন্তু রাক্ষসকে সে ঘরে আর দেখিতে পাইলাম না।

আমাকে চেতন করিবার নিমিত্ত পাল মহাশয় শিশি হইতে কি ঔষধ দিয়াছিলেন। সেই শিশি পুনরায় তিনি বাক্সর ভিতর তুলিয়া রাখিতেছিলেন। আমার জ্ঞান হইয়াছে দেখিয়া, তিনি আমার নিকট আসিলেন।

তাঁহার কন্যা ও স্ত্রী সেই সময় সে স্থান হইতে সরিয়া বসিলেন। আমি পাল মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘রা—রা—রা?’

সমুদয় প্রশ্নটি স্পষ্টরূপে আমার মুখ দিয়া বাহির হইল না। সে রাক্ষস মহাশয় এখন কোথায়, ইহাই আমার জিজ্ঞাস্য ছিল। আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘তোমাকে আর কি বলিব। তুমি মানুষ কি, কি, তাহাই আমি বুঝিতে পারিতেছি না। রাক্ষস আবার কোথায়? আমার এত বয়স হইয়াছে ; কিন্তু রাক্ষস আমি কখনও দেখি নাই। ইনি আমার পুত্র। বিপদে পড়িয়া আমার পুত্রকে ছদ্মবেশ ধারণ করিতে হইয়াছে। এই সে পরচুলের দাড়ি-গোঁপ, আর এই সে মুখোশ,—যাহা দেখিয়া তুমি এত ভয় পাইয়াছিলে।’

এই কথা বলিয়া, পাল মহাশয় প্রথম আমায় সেই সুশ্রী যুবককে দেখাইলেন, আর তাহার পর সেই পরচুল ও মুখোশ দেখাইলেন।

নিজের বড়াই করিতে নাই; কিন্তু স্বভাবত আমি যে একজন সাহসী পুরুষ, সে পরিচয় বোধ হয়, আর আপনাদিগকে দিতে হইবে না। প্রকৃত রাক্ষস না হউক, রাক্ষসের মত তো বটে! সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসের হাতে পড়িয়াও আমি ধৈর্য ধরিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহাই আমার সাহসের যথেষ্ট পরিচয়। আপনারা হইলে ভয়ে হয়তো কত কি করিয়া ফেলিতেন। তাহার পর বলিলে হয়তো আপনারা বিশ্বাস করিবেন না; কিন্তু সত্য বলিতেছি যে, কিছুমাত্র ভয় না করিয়া, রাক্ষসের মুখোশ আমি টিপিয়া দেখিলাম,—স্বচ্ছন্দে হাতে করিয়া টিপিয়া দেখিলাম। তাহাতে আমার কিছুমাত্র ভয় হইল না। এখন আপনারা বুঝিয়া দেখুন, আমার কত সাহস!

যখন আমি নিশ্চয় বুঝিলাম যে, সে বস্তুটা মুখোশ বটে ; রাক্ষসের মুণ্ড বা অন্য কোন ভয়াবহ পদার্থ নহে, তখন আমি উঠিয়া বসিলাম। বসিয়া আমি পাল মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি জন্য আপনার পুত্রকে এরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করিতে হইয়াছে? আর কেনই বা ইহাকে অশ্বত্থগাছ-পথে যাতায়াত করিতে হয়?

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘সে অনেক কথা। বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিবার সময় নাই। আপাতত আমরা ঘোর বিপদে পড়িয়াছি। শীঘ্র তাহার প্রতিকার না করিতে পারিলে, আমাদের সর্বনাশ হইবে।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এই রাত্রি দুই প্রহরের সময় বিপদ কোথা হইতে আসিবে?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘আমার পুত্রের নাম মিহির! মিহির এক খুনী মোকদ্দমায় পড়িয়াছে। দুই বৎসর পূর্বে সে ঘটনা ঘটিয়াছে। মিহির সে লোককে খুন করে নাই ; কিন্তু সমুদয় দোষটি তাহার ঘাড়ে পড়িয়াছে। সেজন্য এই দুই বৎসর নানারূপ ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া, সে পথে পথে ফিরিতেছে। দুঃখের কথা বলিতে আমার বুক ফাটিয়া যায়, বাবা আমার কতই না কষ্টভোগ করিতেছে। ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া রাত্রিকালে অতি গোপনে সে আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করে। আমাদের নিকট আসিতে তাহাকে আমি বারবার মানা করিয়াছি। কিন্তু আমাকে, তাহার গর্ভধারিণীকে ও তাহার ভগিনীকে না দেখিয়া সে থাকিতে পারে না। কিছুদিন পূর্বে রাত্রিকালে যখন সে অশ্বত্থগাছ দিয়া বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতেছিল, সেই সময় তুমি তাহাকে দেখিয়াছিলে। পাছে কেহ সন্দেহ করে, সেজন্য আমার আজ্ঞায় আমার কন্যা তোমাকে সেই চিঠি লিখিয়াছিল। মিহির যদি আজ ধরা পড়ে, তাহা হইলে নিশ্চয় তাহার ফাঁসি হইবে। কারণ, সে যে খুন করে নাই, সে যে সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধ, তাহা প্রমাণ করিবার উপায় নাই। এ বিষয়ে যদি তুমি কোনরূপ সহায়তা করিতে পার, সেইজন্য তোমাকে ডাকিয়াছি। আমি তোমাকে ডাকিতে ইচ্ছা করি নাই। আমার গৃহিণী, আমার পুত্র ও আমার কন্যা, সকলের অনুরোধে আমি তোমাকে ডাকিয়াছি। কিন্তু সামান্য একটি মুখোশ ও পরচুলের দাড়ি দেখিয়া তোমার যখন এত ভয়, তখন তোমার দ্বারা যে কোন উপকার হইবে, তাহা আমার বোধ হয় না। বরং আর একটু হইলেই, তুমি ভয়ে চিৎকার করিয়া সর্বনাশ করিতে! তোমার চিৎকারে পাড়ার লোক আমার বাড়িতে আসিয়া জমা হইত। মিহিরের পলায়ন করিবার তখন আর কোন উপায় থাকিত না। সেইজন্য তোমাকে ঘরের ভিতর আনিয়া তোমার মুখ চাপিয়া ধরিতে আমরা বাধ্য হইয়াছিলাম।’

পাল মহাশয়ের ভর্ৎসনায় আমি অতিশয় লজ্জিত হইলাম। কিন্তু তাঁহার কন্যা যে আমাকে ডাকিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়াছিল, সেজন্য আমার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হইল। আপনাদিগকে পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমি একজন বুদ্ধিমান লোক। এই প্রখর বুদ্ধিবলে ইঙ্গিতমাত্রে আমি সকল কথা বুঝিতে পারি। ইতিপূর্বে আমি বলিয়াছিলাম যে, পাল মহাশয়ের কন্যা আমার রূপে-গুণে মোহিত হইয়া, আমাকে বিবাহ করিতে লালায়িত হইয়াছে। কেমন! আমার কথা সত্য নয়? আমার বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়।

আর আমার সাহসেরও প্রশংসা করিতে হয়। পূর্বে সাহসের অনেক পরিচয় দিয়াছি। এখন আমি ভাবিলাম যে, আরও বীরত্ব প্রদর্শন করিয়া এই কন্যার মন-প্রাণ আমি একেবারে কাড়িয়া লইব। এইরূপ ভাবিয়া তাঁহার কন্যার মুখপানে চাহিয়া আমি পাল মহাশয়কে বলিলাম, ‘ঘরে তলোয়ার আছে? থাকে তো দিন, আমি লড়াই করিব।’

পাল মহাশয় বিরক্ত হইয়া উত্তর করিলেন, ‘তুমি পাগল না কি? কাহার সহিত তুমি লড়াই করিবে? পুলিশের সহিত লড়াই করিবে?’

আমার ভয় হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পুলিশ এ স্থানে কি করিয়া আসিবে? পুলিশ কি করিয়া জানিবে যে, আপনার পুত্র মিহির এ বাটীতে আসিয়াছে?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘তাহাই তো ভয়! সেই বিপদেই তো এখন আমি পড়িয়াছি ; আর সেইজন্যই তো তোমাকে আমি ডাকিয়াছি। কি করিব, কিছুই আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। পুলিশের লোক এখনি হয়তো আসিয়া উপস্থিত হইবে। নিয়োগী থানায় খবর দিতে গিয়াছে।’

বিস্মিত হইয়া আমি বলিলাম, ‘নিয়োগী?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘হাঁ, নিয়োগী। তাহার পুত্র বেচুর সহিত আমার কন্যার বিবাহ সম্বন্ধ হইয়াছিল। কিন্তু বেচুর এখন যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সে বিবাহ আমি কিছুতেই দিতে পারি না। সেই কথা শুনিয়া, আমার উপর নিয়োগীর অতিশয় রাগ হইয়াছে। যখন বাসার কোন কোন লোকের নিকট তুমি রাক্ষসের গল্প করিয়াছিলে, নিয়োগী তাহা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিয়াছিল যে, সে ভূতও নয়, রাক্ষসও নয়,—সে আমার পুত্র মিহির ব্যতীত অন্য কেহ নয়। ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া, সে আমার বাটীতে গমনাগমন করিতেছে। কারণ নিয়োগী সেই খুনের কথা সমুদয় অবগত আছে। তাহার পুত্র ও আমার পুত্র,—হুগলিতে এক বাসায় থাকিয়া লেখাপড়া করিত। সেই বাসাতেই এই খুন হয়। নিয়োগী-পুত্রের পরামর্শে ও সহায়তায় আমার পুত্র পলায়ন করে। তোমার মুখে রাক্ষসের কথা শুনিয়া পর্যন্ত নিয়োগী বোধ হয়, চৌকি দিতেছিল। তাহার পর আজ রাত্রিতে মিহিরকে আসিতে দেখিয়া সে থানায় সংবাদ দিতে গিয়াছে।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি কি করিয়া জানিলেন যে, সে থানায় খবর দিতে গিয়াছে?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘নিয়োগীর পুত্র বেচু আসিয়া আমাকে এইমাত্র বলিয়া গেল। বেচু এখন আর বিছানা হইতে উঠিতে পারে না। তথাপি লাঠি ধরিয়া অতিকষ্টে সে এইমাত্র আসিয়াছিল। তাহার পিতা যে ঘোর অন্যায় কাজ করিতেছে, তাহা বোধ হয়, সে বুঝিতে পারিয়াছে। সেজন্য আমাকে সে সকল কথা বলিয়া গেল।’

একাদশ অধ্যায়

রাধারাণীর বুদ্ধি

আমি বলিলাম, ‘মিহির এই বেলা অশ্বত্থগাছ দিয়া পলায়ন করুক না কেন?’

পাল মহাশয় উত্তর করিলেন, ‘তাহার যো নাই। বেচু বলিয়া গেল যে, সদর দরজায় একজন কনস্টেবল দাঁড়াইয়া আছে। সেদিক দিয়া পলায়ন করিবার উপায় নাই। পশ্চিমে গলির রাস্তায় এই জানালার পার্শ্বে যেদিকে অশ্বত্থগাছ রহিয়াছে, সে স্থানে নিয়োগীর বন্ধু সেই দালাল দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে। দুই পথে দুইজনকে পাহারা রাখিয়া নিয়োগী থানায় গিয়াছে।’

আমি জানালার নিকট গিয়া ঈষৎ উঁকি মারিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, সত্য বটে,—সে স্থানে সেই দালাল দাঁড়াইয়া আছেন, যিনি কেশবী আমলে একজন ধ্বজাধারী ব্রাহ্ম ছিলেন, যিনি এক্ষণে গোঁড়া হিন্দু হইয়াছেন, ও যিনি এক্ষণে মুরগী ভক্ষণ করেন না।

জানালার নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া, আমি বাটীর উত্তর ও পূর্বদিক পানে চাহিয়া দেখিলাম। সেই দুই দিক একেবারে ভগ্ন ; সে দুই দিক দিয়া পলায়ন করিবার কোন উপায় নাই। তাহার পর, আমি ছাদে উঠিবার সিঁড়ির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সিঁড়িও একেবারে ভগ্ন ; ছাদে উঠিবার উপায় নাই। পলায়ন করিবার কোন উপায় আমি দেখিতে পাইলাম না।

মিহির এতক্ষণ মাতার নিকট বসিয়াছিল। খাইবার নিমিত্ত মাতা তাহাকে কিছু মিষ্টান্ন দিয়াছিলেন। মিহির খাইতে অস্বীকার করিতেছিল। কাঁদিতে কাঁদিতে, আঁচলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে, খাইবার নিমিত্ত মাতা তাহাকে জেদ করিতেছিলেন। মাতার অনুরোধে মিহির সন্দেশ ভাঙ্গিয়া, একটু মুখে দিয়া জল পান করিল। তাহার পর সে মাতাকে বুঝাইতে লাগিল।

মিহির বলিল, ‘মা! তুমি জননী! আমার দেবতা। তোমার সাক্ষাতে আমি সত্য বলিতেছি যে, আমি সে ছোকরাকে খুন করি নাই। দুইজনে আমরা একঘরে থাকিতাম। চিরকাল তাহাতে আমাতে বড় ভাব ছিল। বাবার সহিত তাহার বাপের মোকদ্দমা আরম্ভ হইলেও তাহাতে আমাতে ভাব যায় নাই। তবে যে রাত্রিতে সে খুন হয়, সেইদিন সন্ধ্যাবেলা তাহাতে আমাতে একটু বচসা হইয়াছিল। কিন্তু সে অন্য কথা লইয়া, মোকদ্দমার কথায় নয়। যাহা হউক, সে ঝগড়া কোন কাজের নয়, কথার তর্ক-বিতর্ক মাত্র। তাহার পর আমরা একসঙ্গে কত কথা কহিলাম, একসঙ্গে আহার করিলাম, একঘরে শয়ন করিলাম। রাত্রি দুইটা কি তিনটার সময় আমাকে একবার বাহিরে যাইতে হইল। বাহির হইতে আসিয়া পুনরায় ঘরের ভিতর যেই প্রবেশ করিয়াছি, আর সেই সময় বেণীর বিছানার নিকট হইতে কিরূপ একটা ঘড়-ঘড় শব্দ আমি শুনিতে পাইলাম। যে ছোকরা খুন হইয়াছে, তাহার নাম বেণী ছিল। আমি ভাবিলাম, বেণী বুঝি কিরূপ কুভাবে শয়ন করিয়াছে, তাই সে এইরূপ শব্দ করিতেছে। তাহাকে ঠেলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইতে বলিব, এই জন্য আমি সেই অন্ধকার ঘরে তাহার বিছানার দিকে যাইতে লাগিলাম। সহসা আমার পায়ে মানুষের গা ঠেকিয়া গেল। তখনও আমি কোন বিপদের আশঙ্কা করি নাই। তখন আমি ভাবিলাম যে, বেণী ঘুমের ঘোরে তক্তপোশ হইতে পড়িয়া গিয়াছে। ‘বেণী’ ‘বেণী’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে আমি তাহাকে তুলিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু আমি দেখিলাম যে, তাহার সর্বশরীর অবশ হইয়া গিয়াছে, আর তাহার গলা দিয়া সেই ঘড়-ঘড় শব্দ হইতেছে ; আর সেই সময় আমার পায়ে জল অপেক্ষা ঘন কি সব লাগিয়া গেল। আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম। পাশের ঘরে নিয়োগী মহাশয়ের পুত্র বেচু ও আর আর ছোকরা ছিল। কিন্তু আমার চিৎকার শুনিয়া, কেবল বেচু একেলা দৌড়িয়া আসিল। সঙ্গে সে দিয়াশলাই আনিয়াছিল। সে দিয়াশলাই জ্বালিল। সেই আলোতে বেণীকে আমি তাহার তক্তপোশে শয়ন করাইলাম। আর সেই সময় দেখিলাম যে, তাহার বুকে কে ছুরি মারিয়াছে ; বুক হইতে ভলকে ভলকে রক্ত বাহির হইতেছে, তাহাতে আমার গা ও কাপড় রক্তে রক্ত হইয়া গিয়াছে। ঘরের মেজেতে যে স্থানে বেণী পড়িয়াছিল, সে স্থানেও অনেক রক্ত জমা হইয়াছিল। সেই রক্ত আমার পায়ে লাগিয়া গিয়াছিল। নিয়োগী মহাশয়ের পুত্র বেচু ঘরের ভিতর আসিয়া দিয়াশলাই জ্বালিয়া সমুদয় ব্যাপার দেখিল। বেচু মনে করিল যে, আমি বেণীকে খুন করিয়াছি। সেইজন্য বেচু আমাকে বলিল, “চুপ্‌ চুপ্‌! গোল করিও না। কিন্তু মিহির, এ কি তুমি করিয়াছ? বেণীকে তুমি খুন করিয়াছ? সন্ধ্যাবেলা তাহার সহিত তোমার ঝগড়া হইয়াছিল, সেইজন্য ইহাকে খুন করিয়াছ? না, ইহার বাপের কাছ হইতে যে একশত টাকার নোট আসিয়াছে, তাহার জন্য তুমি ইহাকে খুন করিয়াছ?” আমি বলিলাম, “ও কি কথা, বেচু! আমি ইহাকে খুন করিয়াছি! আমি যদি খুন করিব, তবে চিৎকার করিয়া লোক ডাকিতে যাইব কেন?”—বেচু বলিল, “দেখ, মিহির! তোমার সে কথা কেহ বিশ্বাস করিবে না! তোমরা দুইজনে একঘরে থাক। তোমার সহিত কাল তাহার ঝগড়া হইয়াছিল, তোমার গায়ে রক্ত,আর এ কি! এই বলিয়া ঘরের মেজে হইতে বড় একখানি ছুরি সে তুলিয়া লইল। ছুরিখানি রক্তমাখা ছিল। সে ছুরি আমার। ঘরের এক পার্শ্বে ছোট টেবিল ছিল। তাহার উপর কাগজ, কলম, পুস্তক প্রভৃতির সহিত আমার সেই ছুরিখানিও থাকিত। ছুরিখানি হাতে লইয়া বেচু বলিল, “আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিও না। শীঘ্র তুমি পলায়ন কর।” আমি হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। পলায়ন করিতে আমি উদ্যত হইলাম, তখন বেচু বলিল, “ও কি কর! ওরূপ রক্তমাখা কাপড়ে বাহিরে যাইও না। এখনি তোমাকে চৌকিদারে ধরিবে।” এই কথা বলিয়া সে দৌড়িয়া আপনার ঘরে গেল। আপনার একখানি কাপড় আনিয়া আমাকে দিল। সেই কাপড় পরিয়া আমি পলায়ন করিলাম। সে রাত্রিতে বেচু আমার অনেক উপকার করিয়াছে। আজও দেখ, সে আমাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু মা! এখন বোধ হইতেছে যে, পলায়ন করিয়া আমি ভাল কাজ করি নাই। যখন আমি অপরাধ করি নাই, তখন কি জন্য যে আমি পলায়ন করিলাম, তাহা বুঝিতে পারি না। এরূপ অবস্থায় আর কতদিন কাল কাটাইব! ইহা অপেক্ষা ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়া মরাই আমার পক্ষে ভাল। তোমাদিগকে না দেখিয়া আর পথে পথে ফিরিতে পারি না। আর কষ্টভোগ করিতে পারি না, মা!’

মাতা কাঁদিতে লাগিলেন। পাল মহাশয়ের কন্যা কাঁদিতে লাগিল। পাল মহাশয়ের চক্ষে জল আসিল, আমারও চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

মিহির পুনরায় বলিল, ‘আজ আর পলাইবার কোন উপায় নাই। কিন্তু তাহার জন্য আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নই। পথে পথে আর বেড়াইতে পারি না।’

এইরূপ বলিতে বলিতে মিহির দেখিল যে, তাহার পিতা, মাতা ও ভগিনী সকলেই অতিশয় কাঁদিতেছেন। সেজন্য তাঁহাদিগকে প্রবোধ দিয়া সে পুনরায় বলিল, ‘মা, কাঁদিও না! তুমি ভয় করিও না! ভগবান মাথার উপর আছেন। বিনাদোষে তিনি আমাকে ফাঁসি যাইতে দিবেন না।’

আমার নিজের সম্বন্ধে এই সময় একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিল। মিহিরের দুঃখের কাহিনী শুনিয়া আমার বুকের ভিতর গুর্‌গুর্‌ করিয়া উঠিল। কেন বলিতে পারি না, কিন্তু এই সময় হইতে আমার স্বভাব পরিবর্তিত হইতে আরম্ভ হইল।

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘প্রাণ থাকিতে তোমাকে আমি ধরা দিতে দিব না। পলাইবার কোন উপায় কি নাই?’

এই সময় বাটীর নিম্নে অন্দর মহলের দরজায় সবলে কে আঘাত করিতে লাগিল। দরজা যেন ভাঙ্গিয়া ফেলিতে লাগিল।

শশব্যস্ত হইয়া সকলে আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম। পাল মহাশয় বলিলেন, ‘ঐ পুলিশ আসিয়াছে।’

পাল মহাশয়ের কন্যা ও গৃহিণী কাঁদিয়া উঠিলেন। মিহির পুনরায় তাঁহাদিগকে বুঝাইতে লাগিল। মিহির বলিল, ‘ভয় নাই মা! কাঁদিও না। অন্তর্যামী ভগবান জানেন যে, আমি কোন দোষে দোষী নই। তিনি আমাকে রক্ষা করিবেন।’

দরজায় অতি সবলে আঘাত হইতে লাগিল। দরজা যেন ভাঙ্গিয়া ফেলিতে লাগিল।

পাল মহাশয় বারেণ্ডায় গিয়া উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে ও? দরজা ভাঙ্গে কে?’

বাহির দিকে নিচে হইতে কে উত্তর দিল, ‘আমরা পুলিশের লোক। দরজা খুলিয়া দাও।’

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘রাত্রি প্রায় একটা বাজে। এ ঘোর রাত্রিতে আমি দরজা খুলিয়া দিতে পারি না। যদি তোমাদের কোন প্রয়োজন থাকে, তাহা হইলে প্রাতঃকালে আসিও, তখন দ্বার খুলিয়া দিব। রাত্রিকালে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার আইন নাই।’

পুলিশের লোক উত্তর করিল, ‘দ্বার খুলিয়া দাও। যদি না খুলিয়া দাও, তাহা হইলে দ্বার আমরা ভাঙ্গিয়া ফেলিব। তোমার ঘরে খুনী আসামী আছে।’

পাল মহাশয় বলিলেন, ‘আমার ঘরে খুনী আসামী কোথা হইতে আসিবে? এ ঘোর রাত্রিতে আমি দ্বার খুলিয়া দিব না ;—তোমরা পুলিশের লোক হও আর যেই হও।’

তাহারা দ্বার যেন ভাঙ্গিয়া ফেলিবার উদ্যোগ করিল। পাল মহাশয় ঘরের ভিতর আসিয়া বলিলেন, ‘সর্বনাশ হইল! আর কোন উপায় নাই! মিহির এইবার ধরা পড়িল! সর্বনাশ হইল!’

মিহিরের এক হাত মা ধরিয়াছিলেন ও অপর হাত ভগিনী ধরিয়াছিল। মিহিরকে মাঝখানে রাখিয়া, দুইজনে পার্শ্বে বসিয়া ক্রমাগত কাঁদিতেছিলেন। পাল মহাশয়ের এই নিদারুণ বাক্য শুনিয়া, ভগিনী সহসা মিহিরের হাত ছাড়িয়া দিল। তাহার পর সে উঠিয়া দাঁড়াইল। আঁচলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে পিতাকে সে বলিল, ‘বাবা। নিচে গিয়া পুলিশের লোককে তুমি দরজা খুলিয়া দাও। আমি মনে মনে এক উপায় স্থির করিয়াছি। ভগবানের কৃপায় আমাদের বাসনা পূর্ণ হইবে।’

কন্যার কথা শুনিয়া আমরা সকলেই অবাক হইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিলাম।

কন্যা ধীর-গম্ভীর স্বরে ভ্রাতাকে বলিল, ‘দাদা, উঠ! মদনবাবুর ঘরে গিয়া তাঁহার বিছানায় তুমি শয়ন কর। বারেণ্ডার দ্বারে ওদিক হইতে তুমি শিকল দিয়া দাও, এদিক হইতে সেই দ্বারে আমি খিল দিতেছি।’

পাল মহাশয়ের কন্যা তাহার পর মাদুরের উপর হইতে সেই রাক্ষসের মুখোশ ও সেই পরচুল তুলিয়া লইল। স্বহস্তে সেই মুখোশ ও সেই পরচুলের দাড়ি-গোঁপ সে আমার মুখে পরাইয়া দিল।

সকলে তাহার অভিসন্ধি তখন বুঝিতে পারিল। পাল মহাশয় বলিলেন, ‘রাধারাণী! ধন্য তুমি! ধন্য তোমার বুদ্ধি! তোমার বুদ্ধিবলে ও ভগবানের কৃপায় মিহির বোধ হয়, এবার নিষ্কৃতি পাইবে। মিহির! উঠ বাবা! শীঘ্র মদনবাবুর ঘরে তুমি গমন কর!’

পাল মহাশয়ের কন্যার নাম রাধারাণী।

দ্বাদশ অধ্যায়

মদনের প্রতিজ্ঞা

বারেণ্ডায় দাঁড়াইয়া রাধারাণী মিহিরকে আমার ঘর দেখাইয়া দিল। ভিতর-বাটী হইতে বাহির-বাটীতে গমন করিয়া, মিহির প্রথম বারেণ্ডার দ্বারে শিকল দিল। তাহার পর, আমার ঘরে প্রবেশ করিয়া সে ঘরেরও দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। অবশেষে সে আমার বিছানায় শয়ন করিল।

দ্বার খুলিয়া দিবার নিমিত্ত পাল মহাশয় এখনও নিচে গমন করেন নাই। রাধারাণী সেজন্য পুনরায় তাঁহাকে বলিল, ‘বাবা! তুমি নিচে গিয়া পুলিশের লোককে দ্বার খুলিয়া দাও। দ্বার খুলিতে কিন্তু একটু নলপত করিও। উপরে কেবল তোমার ঘরের দ্বার খোলা থাকুক। প্রদীপ নিবাইয়া মা ও আমি অন্য ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া শয়ন করি।’

পাল মহাশয় প্রথম বারেণ্ডায় দাঁড়াইয়া উচ্চৈঃস্বরে পুলিশের লোককে বলিলেন, ‘আপনাদের আর কষ্ট করিতে হইবে না। এখনি নিচে গিয়া আমি দ্বার খুলিয়া দিতেছি।’

এই বলিয়া সিঁড়ি দিয়া আস্তে আস্তে তিনি নিচে নামিতে লাগিলেন।

পরচুল ও মুখোশ পরিয়া অবাক হইয়া এতক্ষণ আমি চুপ করিয়া বসিয়াছিলাম। রাধারাণী স্বহস্তে আমার এই সাজ করিয়া দিয়াছিল। তাহার কোমল হস্তস্পর্শে শরীর আমার রোমাঞ্চিত হইয়াছিল। সেই সুখে মুগ্ধ হইয়া, চিন্তা করিতে এতক্ষণ আমি সময় পাই নাই। কিন্তু এখন আমার বড় ভয় হইল। আমি ভাবিলাম, ‘এ মন্দ কথা নয়! রাক্ষসের হাত হইতে কত কষ্টে পরিত্রাণ পাইলাম। এখন দেখিতেছি, আমার ফাঁসির যোগাড় হইতেছে। নিয়োগী মহাশয় পুলিশকে নিশ্চয় বলিয়াছেন যে, রাক্ষসের সাজ সাজিয়া খুনী আসামী বাটীতে আগমন করে। সুতরাং পুলিশ আসিয়াই আমাকে ধরিয়া ফেলিবে। তাহার পর, আমাকে থানায় লইয়া যাইবে। তাহার পর, আমার নামে মোকদ্দমা করিবে। তাহার পর, আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলাইয়া দিবে। আমাকে দিয়া রাধারাণী ভ্রাতার প্রাণ বাঁচাইতে চেষ্টা করিতেছে। মেয়েটি সামান্য মেয়ে নয়!’

এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময় মিহিরের সেই দুঃখের কাহিনী আমার স্মরণ হইল। আপনাকে ধিক্কার দিয়া আমি মনে মনে বলিতে লাগিলাম, ‘ছি, মদন! তুমি না এইমাত্র প্রতিজ্ঞা করিয়াছ যে, আজ হইতে আর পাগলামি করিবে না? আর কখন কাপুরুষের ন্যায় ব্যবহার করিবে না? আজ হইতে তুমি তোমার স্বভাব পরিবর্তন করিবে? ছি, মদন! তোমার কি লজ্জা নাই?’

একদিনে সামান্য কথায় মানুষের চক্ষু ফুটিয়া যে চৈতন্য হয়, তাহা আপনারা অসম্ভব বিবেচনা করিবেন না। লালাবাবু তাহার দৃষ্টান্ত। কথিত আছে যে, একদিন লালাবাবু বিষয়কর্মে সাতিশয় ব্যস্ত ছিলেন। বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গেল, তথাপি স্নান-আহার করিতে তিনি যাইলেন না। বাটীর ভিতর হইতে কয়বার লোক তাঁহাকে ডাকিতে আসিল, তবুও তিনি উঠিলেন না। অবশেষে তাঁহার কন্যা আসিয়া বলিল, ‘বাবা! বেলা গেল যে!’ ‘বেলা গেল’, এই দুইটি কথায় লালাবাবুর হৃদয়-তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল। সেই মুহূর্ত হইতে সংসারের প্রতি তাঁহার বৈরাগ্য জন্মিল।

মিহিরের কাহিনী শুনিয়া আমারও আজ সেইরূপ হইল। আমার স্বভাবে যে সমুদয় দোষ আছে, এতদিন তাহা আমি দেখি নাই। সে সমুদয় দোষ এখন আমার প্রত্যক্ষ হইল। তাহার পর আমি ভাবিতে লাগিলাম,—’সংসার কি ভয়ানক স্থান! মিহির সম্পূর্ণ নিরপরাধ; নিশ্চয় খুন করে নাই। তথাপি তাহাকে কত না কষ্ট ভোগ করিতে হইতেছে! ধরা পড়িলে হয়তো তাহার ফাঁসিও হইবে। অন্তর্যামী ভগবান কেন এমন করিতেছেন? এ রহস্য আমি বুঝিতে পারি না। হে ঈশ্বর! তুমি জান; আমি কিছুই জানি না।’

এইরূপ ভাবিয়া আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, আজ হইতে যথাসাধ্য সকল বিষয়ে আমি চুপ করিয়া থাকিব। তাঁহার যাহা ইচ্ছা, তাহাই হউক।’

ভ্রাতাকে আমার ঘর দেখাইয়া দিয়া, বারেণ্ডার দ্বারে ভিতর হইতে খিল দিয়া রাধারাণী পুনরায় আমার নিকট আসিয়া বলিল, আপনি ভয় করিবেন না। আপনি যে দাদা নহেন, তাহা জানিতে পারিলেই পুলিশ আপনাকে ছাড়িয়া দিবে। কিন্তু অনুগ্রহ করিয়া আপনি শীঘ্র পরিচয় দিবেন না। যত বিলম্ব করিতে পারেন, ততই ভাল। কারণ, বিলম্ব হইলে দাদাকে সরাইতে আমরা সময় পাইব।’

রাধারাণীর মধুর বচনে আমার মন আশ্বাসিত হইল। আমিও তখন মনে মনে বুঝিয়া দেখিলাম যে, সত্য বটে; আমাকে কেন তাহারা ফাঁসি দিবে? আমি যে মিহির নই, জানিতে পারিলেই, তাহারা আমাকে ছাড়িয়া দিবে। আমার নাম-ধাম প্রকাশ করিতে আমি যত পারি, তত বিলম্ব করিব।

রাধারাণী পুনরায় বলিল, ‘আপনার এ ঘরে থাকা উচিত নহে। আপনাকে অন্য স্থানে যাইতে হইবে। আসুন।’

রাধারাণীর সহিত সে ঘর হইতে আমি বাহির হইলাম। চক্ষুর উপরে মুখোশে দুইটি গোল ছিদ্র ছিল। তাহার পূর্বে রাক্ষসের ভয়াবহ চক্ষু-কোটর বলিয়া আমার প্রতীতি হইয়াছিল। সেই ছিদ্র দিয়া আমি দেখিতে পাইতেছিলাম। তেতলায় উঠিবার নিমিত্ত পূর্বে যে স্থানে সিঁড়ি ছিল, তাহার পার্শ্বে সামান্য একটু নিভৃত অন্ধকারময় স্থান ছিল। সে স্থানে যে ভগ্ন প্রাচীর আছে, তাহার কোণে রাধারাণী আমাকে বসিতে বলিল। আমি সেই কোণে বসিলাম। ঘর হইতে রাধারাণী মাদুরটি তুলিয়া আনিয়াছিল। সেই মাদুর সে আড়াল করিয়া দিল। মাদুরের অন্তরালে চুপ করিয়া আমি বসিয়া রহিলাম। নানারূপ আশ্বাসবাক্যে আমাকে প্রবোধ দিয়া রাধারাণী সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল।

প্রাচীরের কোণে মাদুরের আড়ালে বসিয়া, শব্দ শুনিয়া, সমুদয় ঘটনা আমি বুঝিতে পারিলাম। পাল মহাশয় দ্বার খুলিয়া দিলেন; সে শব্দ আমি পাইলাম। অনেকগুলি লোক বাটীর ভিতর প্রবেশ করিল; সে শব্দ আমি পাইলাম। সাত-আট জন লোক, তড়-বড় করিয়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিল; সে শব্দ আমি পাইলাম। পাল মহাশয়ের তিনটি ঘর আতি-পাতি করিয়া তাহারা খুঁজিতে লাগিল; সে শব্দও আমি পাইলাম। তাহাদের অনুসন্ধান যে বৃথা হইল, তাহাদের কথাবার্তায় তাহাও বুঝিতে পারিলাম। অবশেষে দুইজন লোক আমার দিকে আসিতেছে, পদশব্দে তাহাও আমি বুঝিলাম।

যে স্থানে আমি লুক্কায়িত ছিলাম, সেই দুইজন লোক সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোল লণ্ঠনের প্রখর আলোক তাহারা মাদুরের উপর ধরিল। তাহার পর, একজন অগ্রসর হইয়া মাদুরটি সরাইয়া ফেলিল। তৎক্ষণাৎ সেই দুইজন লোক একসঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘আসামী পাইয়াছি! আসামী পাইয়াছি!’

সেই কথা শুনিয়া পুলিশের অন্যান্য লোক সেই স্থানে দৌড়িয়া আসিল। তাহাদের মধ্যে একজন তৎক্ষণাৎ আমার হাতে হাতকড়ি লাগাইয়া দিল। ঘরের ভিতর পাল মহাশয়ের কন্যা ও গৃহিণী কাঁদিয়া উঠিলেন। আমি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। একজন পুলিশের লোক আমার মুখ হইতে সেই রাক্ষসের মুখোশ খুলিতে উদ্যত হইল। কিন্তু তাহাদের মধ্যে যিনি কর্তা, তিনি তাহাকে নিষেধ করিয়া বলিলেন, ‘উঁ হুঁ! মুখোশ খুলিও না। এই অবস্থাতেই ইহাকে সাহেবের নিকট লইয়া যাইব।’

আমার ভয় হইয়াছিল, মুখোশ খুলিলে পাছে কেহ আমাকে চিনিতে পারে! রাধারাণীর সমুদয় আয়োজন তাহা হইলে বৃথা হইত। নিয়োগী তখন সে স্থানে উপস্থিত ছিলেন না বটে; কিন্তু পুলিশের লোক যখন আমাকে থানায় লইয়া যায়, সেই সময় বাহির-বাটীর যত বাসাড়ে তামাসা দেখিবার নিমিত্ত আপন আপন ঘর হইতে বাহির হইয়াছিল। নিচের বাসাড়েগণ নিচে ও দোতলার বাসাড়েগণ উপরের বারেণ্ডার রেল ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সকলের সম্মুখ দিয়া পুলিশের লোক আমাকে লইয়া গেল। মুখোশ খুলিলে তাহারা আমাকে চিনিতে পারিত। মুখোশের চক্ষু-কোটর দিয়া আমি সকলকে দেখিলাম। নিয়োগীকে কোন স্থানে দেখিতে পাইলাম না। নিয়োগী জানিতেন না যে, তাহার পুত্র পাল মহাশয়কে গোপনে সংবাদ দিয়া, তাঁহার পরিশ্রম বিফল করিয়াছে। যেন এ ব্যাপারের কিছু জানেন না, পরদিন পাল মহাশয়কে তাহাই বলিবার নিমিত্ত তিনি বোধ হয়, আপনার দ্বার বন্ধ করিয়া ঘরের ভিতর বসিয়াছিলেন। দালালকেও কোন স্থানে দেখিতে পাইলাম না।

আমি থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সাহেবের সম্মুখে আমার মুখোশ খোলা হইল। কিন্তু পরচুলের দাড়ি-গোঁফ যেমন তেমনি রহিল। থানার সাহেব আমাকে দুই-এক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু আমি কোন উত্তর করিলাম না। আমাকে গারদে কয়েদ করিয়া রাখা হইল।

গারদে আমি বসিয়া আছি, এমন সময়ে বাহিরে নিয়োগীর গলার শব্দ পাইলাম। নিয়োগীর সহিত পুলিশের যে কথাবার্তা হইল, তাহাতে আমি বুঝিলাম যে, মিহিরকে ধরিয়া দিবার নিমিত্ত পাঁচ শত টাকা পুরস্কার দিবার ঘোষণা ছিল। নিয়োগী সেই পুরস্কারের প্রার্থনা করিলেন। পুলিশের লোক বলিল যে, ‘রও! আগে ইহার মোকদ্দমা হউক, তাহার পর তুমি সে পুরস্কার পাইবে।’ সেই কথা শুনিয়া নিয়োগী মহাশয় প্রস্থান করিলেন।

পুলিশের লোক পরদিন আমাকে আর একজন সাহেবের নিকট লইয়া গেল। সে সাহেবও আমাকে দুই-চারি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি কিন্তু একটি কথাও মুখ দিয়া বাহির করিলাম না।

হুগলিতে সেই খুন হইয়াছিল। আমাকে হুগলিতে লইয়া গিয়া সে স্থানের পুলিশের হাতে সমৰ্পণ করিবার নিমিত্ত সাহেব আজ্ঞা করিলেন। দুইজন পুলিশের লোক আমাকে হুগলিতে লইয়া চলিল। আমরা তিনজনে রেলগাড়িতে গিয়া বসিলাম। আমার হাতে হাতকড়ি ছিল। কিন্তু পথে যাইতে যাইতে কৌশল করিয়া, আমি সেই পরচুলের দাড়ি-গোঁফ খুলিয়া চুপি-চুপি গাড়ির বাহিরে ফেলিয়া দিলাম। পরক্ষণেই পুলিশের লোক আমার দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইল। সে যে পরচুল, তা বোধ হয়, তাহারা জানিত না। তাহারা বলিল, ‘তুই একজন পাকা বদমায়েশ!’

যথাসময়ে আমরা হুগলির থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। কলিকাতা পুলিশের লোক হুগলি পুলিশের হাতে আমাকে সমর্পণ করিয়া চলিয়া গেল। হুগলি থানার একজন কর্মচারী মিহিরকে জানিত। সে তখন থানায় উপস্থিত ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সে আসিয়া আমাকে দেখিয়া বলিল, ‘মিহির পাল! এ কেন মিহির পাল হবে?’

এই কথা শুনিয়া থানার দারোগা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তবে তুমি কে?’

এইবার আমার মুখ দিয়া কথা ফুটিল। আমি বলিলাম, ‘আমি মদন ঘোষ।’

দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মদন ঘোষ আবার কে?’

নাম-ধাম প্রভৃতি বলিয়া, আমি আমার সমুদয় পরিচয় প্রদান করিলাম। তাহা শুনিয়া, উপস্থিত সকল লোকেই ঘোরতর বিস্মিত হইল।

দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তবে কলিকাতা পুলিশ তোমাকে ধরিয়া আনিল কেন? আর মিহির বলিয়া তোমাকে এ স্থানে দিয়া গেল কেন?’

আমি উত্তর করিলাম, ‘পাল মহাশয় ও আমি এক বাটীতে বাস করি। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব আছে। তামাসাচ্ছলে রাক্ষসের মত মুখোশ পরিয়া, পাল মহাশয়ের পরিবারবর্গকে আমি ভয় দেখাইতে গিয়াছিলাম। সেই অবস্থায় কলিকাতা পুলিশের লোক আমাকে মিহির মনে করিয়া ধৃত করিল।’

দারোগা জিজ্ঞাসা করিল, ‘কলিকাতার থানায় তুমি আপনার পরিচয় প্রদান কর নাই কেন?’

আমি বলিলাম, ‘ভয়ে আমি হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলাম।’

যাহা হউক, হুগলির পুলিশের লোক আমাকে তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিল না। সে স্থানের সাহেবের নিকট আমাকে লইয়া গেল। আরও দুই দিন ধরিয়া ভালরূপে তদন্ত করিল। হুগলির যে সমুদয় লোক মিহিরকে জানিত, তাহাদিগকে আনিয়া আমাকে দেখাইল। পাল মহাশয়ের গ্রামের কয়েকজন লোককে আনিয়া আমাকে দেখাইল। যখন সকলেই বলিল যে, আমি মিহির নই, তখন আমাকে তাহারা ছাড়িয়া দিল।

এয়োদশ অধ্যায়

নিয়োগী মহাশয়ের গান

তিন দিন পরে অপরাহ্নে আমি আমার কলিকাতার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে, নিয়োগী আপনার ঘরের দ্বারের নিকট একটি কেরোসিন তেলের পুরাতন ও ভাঙ্গা বাক্সর উপর বসিয়া খবরের কাগজ পাঠ করিতেছেন। সকলে যেভাবে সংবাদপত্র পাঠ করে, নিয়োগী সেভাবে পাঠ করিতেছিলেন না; গীত গাহিবার ন্যায় সুর করিয়া গদ্য লেখা তিনি পাঠ করিতেছিলেন। যথা,—

ম-অ-অ-অ-হে-এ-এ-এশ- পা-আ-আ-আ-লে-এ-এ-এর ইত্যাদি।

সংবাদপত্রের যে কথাগুলি লইয়া তিনি মনের আনন্দে গান করিতেছিলেন, তাহা এইরূপ ছিল—

‘মহেশ পালের পুত্র মিহির দুই বৎসর পূর্বে হুগলিতে খুনী মোকদ্দমায় অভিযুক্ত হইয়া ফেরার হইয়াছিল। মুখোশ পরিয়া ছদ্মবেশে মাঝে মাঝে সে পিতা-মাতার সহিত সাক্ষাৎ করিত। এই অবস্থায় সেদিন সে ধরা পড়িয়াছে।’ ইত্যাদি।

মিহির পাল ধরা পড়িয়াছে। আনন্দে নিয়োগী মহাশয়ের মন একেবারে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আনন্দের বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া, তিনি সেই গদ্য ভাষায় লিখিত সংবাদটি গীতের ন্যায় গাহিতেছিলেন। নিয়োগী তখনও জানিতে পারেন নাই যে, প্রকৃত মিহির সে রাত্রিতে ধরা পড়ে নাই, জাল মিহির ধরা পড়িয়াছিল।

আমাকে দেখিয়া ভট্টাচার্য মহাশয় ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হে মদন! এতদিন কোথায় ছিলে?’

আমি উত্তর করিলাম, ‘সেসব কথা আপনাকে পরে বলিব। পাল মহাশয় কেমন আছেন?’

ভট্টাচার্য মহাশয় বলিলেন, ‘পাল মহাশয় এখানে নাই। যে রাত্রিতে তাঁহার পুত্র ধরা পড়িল, সেই রাত্রিতেই সপরিবারে তিনি এ স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছেন। পুত্রের মোকদ্দমার তদ্বির করিবার নিমিত্ত তিনি বোধ হয়, হুগলি গিয়াছেন। ভাল কথা! তোমার ঘরের চাবি আমার কাছে আছে। তিনি আমাকে সেই চাবি দিয়া গিয়াছেন।’

ভট্টাচার্য মহাশয়ের নিকট হইতে চাবি লইয়া, আমি আমার ঘরে গমন করিলাম। পাল মহাশয় কোথায় গিয়াছেন, বিছানায় শুইয়া সেই কথা ভাবিতে লাগিলাম।

কয়দিন অনুপস্থিতির পর, আমি আফিস যাইলাম। আফিস হইতে আসিয়া বাসার সকলকে আমি পাল মহাশয়ের সন্ধান জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কেহই আমাকে বলিতে পারিল না। রবিবার দিন আমি পুনরায় হুগলিতে গিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিলাম। সে অনুসন্ধান নিস্ফল হইল। তাহার পর, আর একদিন রবিবার তাঁহার গ্রামে গিয়া তাঁহার অনুসন্ধান লইলাম। কিন্তু সে স্থানেও কেহ কিছু বলিতে পারিল না। এইরূপে বহুদিন ধরিয়া ক্রমাগত আমি তাঁহার অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু আমার সকল চেষ্টা বিফল হইল। অবশেষে হতাশ হইয়া আমি চুপ করিয়া রহিলাম।

নিয়োগী মহাশয় ক্রমে জানিতে পারিলেন যে, প্রকৃত মিহির ধরা পড়ে নাই; আমি যে মিহির সাজিয়া ধরা দিয়াছিলাম, সকল লোকেই ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিল। একদিকে প্রতিহিংসা ও পুরস্কার বিষয়ে নিয়োগী বিফলমনোরথ হইলেন; অপরদিকে তাঁহার পুত্র বেচুর ক্ৰমে আসন্নকাল উপস্থিত হইল।

একদিন বেলা নয়টার সময় আমি আফিস যাইতেছি, এমন সময় বেচু আমাকে তাহার নিকট ডাকিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম যে, সে আর অধিক দিন বাঁচিবে না।

বেচু আমাকে বলিল, ‘মদনবাবু! আপনাকে আমি একটি বড় গোপন কথা বলিব। সেই কথা বলিবার নিমিত্ত আজ কয়দিন ধরিয়া আমি সুযোগ খুঁজিতেছি; কিন্তু পিতার ভয়ে আমি বলিতে পারি নাই। আজ পিতা আমাদের গ্রামে গিয়াছেন। সেইজন্য আপনাকে ডাকিলাম।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি কথা?’

নিয়োগী-পুত্র উত্তর করিল, ‘আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি যে, তিন-চারি দিনের মধ্যেই আমার মৃত্যু হইবে। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, মৃত্যুর পর আমি ঈশ্বরের নিকট কি করিয়া দাঁড়াইব। ঘোর নরক! ঘোর নরক! ভাবিলে শরীর আমার শিহরিয়া উঠে।’

এই কথা বলিয়া, বেচু কাঁদিতে লাগিল। আমি তাহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম, ‘বেচুবাবু! ঈশ্বর দয়াময়। মানুষের শরীরে যে সামান্য দয়া আছে, সে কেবল সেই দয়া-সাগরের এক বিন্দুমাত্র। যদি আপনি কোন পাপ করিয়া থাকেন, তাহার নিমিত্ত আন্তরিক অনুতাপ করুন। তাহাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। দয়াময় আপনাকে ক্ষমা করিবেন।’

নিয়োগী-পুত্র পুনরায় বলিল, ‘দেখুন, মদনবাবু! এই আসন্নকালে সকল বিষয় আমি প্রত্যক্ষ দেখিতেছি। জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত আমি যাহা কিছু করিয়াছি, ব্যোমজগতে সে সমুদয় যেন ছাপ পড়িয়া গিয়াছে। আমার সমুদয় চিন্তা, কথা ও কাজের ফল আমার সঞ্চিত রহিয়াছে। সে সমুদয় আমাকে ভোগ করিতে হইবে। কাজ করিলেই যে তাহার ফল আছে, মানুষ অনুক্ষণ তাহা দেখিতেছে। হায় হায়! তবু মানুষ কেন কুকর্ম করে! মদনবাবু! মানুষ আর যাহা করুক, মানুষ সত্য হইতে যেন বিচলিত না হয়। অন্য পাপ মানুষের বিরুদ্ধে, কিন্তু অসত্য ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। মনুষ্য-জীবন ছেলেখেলা নহে,—ধর্মও খেলা করিবার বস্তু নহে যে, তাহা লইয়া যে যা মনে করিবে, সে তাহাই করিবে। আমি সত্য বলিতেছি যে, পরকাল আছে, নরক আছে। এই মৃত্যুকালে আমি একান্ত মনে মানুষকে এই উপদেশ প্রদান করি যে, মানুষ যেন সত্য হইতে বিচলিত না হয়।’

তাহার কথা শুনিয়া, আমার শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠিল। আমিও যেন নরক প্রত্যক্ষ দেখিতে লাগিলাম। পাপীদিগের পরিত্রাহি ডাক আমারও যেন কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতে লাগিল। শিহরিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সত্য-মিথ্যা কি, মোটামুটি তাহা আমি বুঝি। কিন্তু ধর্ম বিষয়ে সত্য কি?’

বেচু উত্তর করিল, ‘আপনি আমাকে বড় কঠিন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। ধর্ম-বিষয়ে প্রকৃত সত্য কি, সকলে তাহা অনুভব করিতে পারে না; অনুভব করিবার তাহাদের ক্ষমতা নাই।’

এইরূপ বলিয়া সে আমাকে তাহার নিজের বিশ্বাসের কথা বলিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমি মনোযোগের সহিত তাহা শ্রবণ করিলাম। আমার বোধ হইল যে, পীড়িত হইয়া পর্যন্ত নিয়োগী-পুত্র একান্ত মনে সর্বদা ঈশ্বরকে ডাকিয়াছে। কৃপা করিয়া তিনি তাহার চক্ষু উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। তা না হইলে, এরূপ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া, এত অল্পবয়সে এরূপ জ্ঞান হয় না। প্রথম প্রথম তাহার মুখ দেখিয়া ও তাহার কথাবার্তা শুনিয়া, তাহার প্রতি আমার বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝিলাম যে, ক্রমাগত ভগবানকে ডাকিয়া পিতৃদত্ত কলুষিত মনকে সে পবিত্র করিতে সমর্থ হইয়াছে। তাহার নিকট বসিয়া, তাহার কথা শুনিয়া, আমারও চক্ষু যেন উন্মুক্ত হইল। আমি রূপবান, আমি গুণবান, আমি বুদ্ধিমান, আমি সাহসী পুরুষ,—আমার মনে এই প্রকার যে অভিমান ছিল, মুহূর্তমধ্যে সে সমুদয় ভাব আমার চিত্ত হইতে তিরোহিত হইল। কীটস্য কীট,—সামান্য একটা অধম জীব বলিয়া, আমি আমাকে মনে করিতে লাগিলাম। বেচু ধর্ম-বিষয়ে যাহা আমাকে বলিল, সেসব কথা এ স্থানে বলিবার আবশ্যক নাই। কিন্তু শেষকালে সে আমাকে এই কয়টি কথা বলিল, ‘মদনবাবু! প্রকৃত সত্য কি, তাহা আমি আপনাকে বলিলাম। কিন্তু এ সত্য হৃদয়ঙ্গম করিবার ক্ষমতা সকলের নাই। সে নিমিত্ত সাধারণ মনুষ্যকে আমার উপদেশ এই যে, যাহার যেরূপ বিশ্বাস, সে যেন তদনুযায়ী কাজ করে। মনে একরূপ বিশ্বাস, বাহিরে অন্যরূপ কাজ, এ যেন কেহ করে না। সেরূপ অসত্য কপট জীবনের ক্ষমা নাই; সেরূপ লোককে নিশ্চয় নরকে ডুবিতে হইবে।’

আমি চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলাম। বেচু পুনরায় আমাকে বলিল, ‘যে কথা বলিবার নিমিত্ত আমি আপনাকে ডাকিয়াছি, তাহা এখনও আপনাকে বলি নাই। বড় বিষম কথা! কি করিয়া আপনাকে বলিব, তাই ভাবিতেছি। আপনি অনুতাপের কথা বলিতেছিলেন। আজ এক বৎসর ধরিয়া ক্রমাগত ঘোর অনুতাপিত হৃদয়ে আমি ঈশ্বরকে ডাকিতেছি। যখন সেদিন মিহিরের আগমন-সংবাদ পিতা পুলিশকে দিতে গেলেন, সেইজন্যই সেদিন মরিতে মরিতে অতিকষ্টে আমি পাল মহাশয়কে গিয়া সাবধান করিলাম। মিহিরের আমি সর্বনাশ করিয়াছি। আমি ভাবিলাম যে, নিরপরাধ মিহিরকে যে আমার সাক্ষাতে বাঁধিয়া লইয়া যাইবে, তাহা আমি দেখিতে পারিব না।’

বিস্ময়াম্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মিহিরের আপনি সর্বনাশ করিয়াছেন? মিহিরের আপনি কি করিয়াছেন?’

নিয়োগী-পুত্র বলিল, ‘যে খুনের জন্য মিহির পথে পথে ফিরিতেছে, যে খুনের জন্য তাহার ফাঁসি হইবার সম্ভাবনা, সে খুন সে করে নাই, সে খুন আমি করিয়াছি।’

আমি বলিলাম, ‘কি!!! সত্য?’

নিয়োগী-পুত্র উত্তর করিল, ‘সম্পূর্ণ সত্য। মিহির, আমি আর সেই ছোক্‌রা ,—তাহার নাম বেণী, —আরও তিন-চারি জন, হুগলিতে এক বাসায় থাকিয়া স্কুলে পড়িতাম। সকলেই আমরা এক জাতি। আমরা সকলে পরস্পরের কুটুম্ব ও পরিচিত। মিহির ও বেণী একঘরে থাকিত। পাল মহাশয়ের সহিত বেণীর পিতার ভূমি-সম্পত্তি লইয়া বিবাদ হয়। কিন্তু তাহাতে মিহির ও বেণীতে যে সদ্ভাব ছিল, তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। পরীক্ষার টাকা ও অন্যান্য খরচের নিমিত্ত বেণীর পিতা একশত টাকা প্রেরণ করিয়াছিলেন। আমার সাক্ষাতে বেণী সেই টাকাগুলি বিছানায় আপনার শিয়রদেশে বালিশের নিম্নে রাখিয়া দিল। আমার পিতা ধনবান ব্যক্তি নহেন। খরচের টানাটানি আমার সর্বদাই থাকিত। সেই টাকাগুলি দেখিয়া আমার লোভ হইল। দৈবের লিখন কেহ খাইতে পারে না। সেই দিন রাত্রি দুইটা কি তিনটার সময় সহসা আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। জাগ্রত হইয়া আমি বিছানায় শুইয়া আছি, এমন সময় মিহির ও বেণী যে-ঘরে থাকে, সেই ঘরের দ্বার খুলিবার শব্দ হইল। বিছানা হইতে উঠিয়া, আমিও আস্তে আস্তে আমার ঘরের দ্বার খুলিলাম। দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া দেখিলাম যে, গাড়ু হাতে লইয়া মিহির বাহিরে গেল। আমি ভাবিলাম, উত্তম সুবিধা হইয়াছে। দেখি, বেণীর বালিশের নিচে হইতে নোটগুলি লইতে পারি কি না। এই মনে করিয়া আমি আস্তে আস্তে তাহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘর অন্ধকারে পরিপূর্ণ। যাহা হউক, নিঃশব্দে বেণীর বিছানার নিকট গিয়া, আমি নোটগুলি লইতে পারিলাম। নোট লইয়া পলায়ন করিবার উপক্রম করিতেছি, আর বেণী সেই সময় জাগিয়া উঠিল। “চোর” এই কথা বলিয়া আমাকে সে তৎক্ষণাৎ ধরিয়া ফেলিল।’

এতদূর বলিয়া বেচু আর বলিতে পারিল না। তাহার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া অতি দ্রুতভাবে সম্পন্ন হইতে লাগিল। ‘জল!’ এই কথা বলিয়া সে আমাকে গেলাস দেখাইয়া দিল। তাড়াতাড়ি জলের গেলাস লইয়া আমি তাহার মুখে ধরিলাম।

চতুর্দশ অধ্যায়

বেচুর শেষ কথা

জলপান করিয়া বেচু কিছু সুস্থ হইল। অল্পক্ষণ বিশ্রাম করিয়া পুনরায় সে বলিতে আরম্ভ করিল—

‘আমাকে ধরিয়া চোর চোর বলিয়া বেণী পুনরায় চিৎকার করিতে উদ্যত হইল। আমি তাহার মুখ চাপিয়া ধরিলাম ও সেখান হইতে পলায়ন করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু বেণী আমাকে সহজে ছাড়িল না। সেই ঘরের দেয়ালের নিকট সামান্য একটি মেজে ছিল। তাহার উপর বেণী ও মিহিরের পুস্তক, কাগজ-কলম ইত্যাদি থাকিত। মিহিরের বড় একখানি ছুরি ছিল। ছুরিখানি সর্বদাই এই মেজের উপর পড়িয়া থাকিত। অন্ধকারে বেণীর সহিত জড়াজড়ি করিতে করিতে ক্রমে আমি সেই মেজের উপর গিয়া পড়িলাম। দৈবের ঘটনা। আমার দক্ষিণ হাতটি মেজেস্থিত ঠিক সেই ছুরির উপর পড়িল। তখনও বেণী আমাকে সবলে ধরিয়া ছিল। তাহাকে যে খুন করিব, সে ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না। কিন্তু কোনরূপে তাহার হাত হইতে নিষ্কৃতি না পাইয়া, আমি সেই ছুরি তাহার বুকে মারিয়া বসিলাম। “বাপ”! বলিয়া বেণী তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হইল। আমি পলায়ন করিয়া আপনার ঘরে প্রবেশ করিলাম। হায় হায়! এক মিনিট পূর্বে আমি একজন সাধু সচ্চরিত্রবান যুবক ছিলাম। এক মিনিটের মধ্যে আমি চোর, খুনে, নরপিশাচ হইয়া পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরে মিহির ঘরে প্রবেশ করিল। ঘরে প্রবেশ করিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার ঘরে গিয়া আলো জ্বালিয়া দেখিলাম যে, বেণী মৃতপ্রায় হইয়াছে, তাহাকে তুলিতে গিয়া মিহিরের শরীর ও কাপড় রক্তে আরক্ত হইয়া গিয়াছে ও সেই স্থানে মিহিরের ছুরি পড়িয়া আছে। ইহা ব্যতীত সেইদিন বৈকালবেলা বেণী ও মিহিরের কিছু বচসা হইয়াছিল। আমি মনে করিলাম,—ভাল হইয়াছে। এ দোষ সম্পূর্ণরূপে মিহিরের উপর আরোপিত হইতে পারিবে, আর তাহা হইলে আমাকে কেহ সন্দেহ করিবে না। এইরূপ ভাবিয়া, তৎক্ষণাৎ পলায়ন করিবার নিমিত্ত মিহিরকে আমি পরামর্শ দিলাম। মিহির সে সময় স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল। সে আমার কথামত কার্য করিল। আমার একখানা কাপড় পরিধান করিয়া সে পলায়ন করিল। তাহার পলায়ন, তাহার পরিত্যক্ত রক্তাক্ত কাপড়, তাহার রক্তাক্ত ছুরি, পূর্বদিন বেণীর সহিত তাহার বিবাদ, এই সকল দেখিয়া ও শুনিয়া পুলিশ তাহাকেই দোষী বলিয়া স্থির করিল, অন্য কাহাকেও সন্দেহ করিল না। সে খুনের প্রকৃত বিবরণ এই আমি আপনাকে বলিলাম।’

আমার আফিস-গমন ঘুরিয়া গেল। বেচুকে আমি বলিলাম, ‘এ রোগে আপনার মৃত্যু নিশ্চয়, তাহার অধিক বিলম্বও নাই। আজ হউক, কাল হউক, পরশ্ব হউক, শীঘ্রই আপনাকে ঈশ্বরের নিকট দাঁড়াইতে হইবে। নিজের এরূপ গুরুতর অপরাধ অন্যের ঘাড়ে দিয়া, কোন মুখে আপনি ঈশ্বরের নিকট দাঁড়াইবেন। অতএব যদি সময় থাকিতে যথার্থই আপনি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে এ সকল কথা কেবল আমাকে বলিলে হইবে না।’

বেচু জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমাকে আর কি করিতে বলেন?’

আমি উত্তর করিলাম, ‘এ সকল কথা আপনাকে পুলিশের নিকট বলিতে হইবে।’

বেচু বলিল, ‘তবে শীঘ্র পুলিশের লোককে আপনি ডাকিয়া আনুন। আমার পিতা প্রত্যাগমন করিতে না করিতে আপনি এ কাজ করুন। আমি যে বেণীকে খুন করিয়াছি, তাহা তিনি জানেন না; একথা শুনিলে তিনি আমাকে কিছুতেই বলিতে দিবেন না।’

আমি তৎক্ষণাৎ থানায় দৌড়িয়া যাইলাম। থানার লোক আসিয়া নিয়োগী-পুত্রের সমুদয় বিবরণ লিখিয়া লইল। তাহার পর, পুলিশের কর্মচারী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বেণীর নিকট হইতে যে নোট তুমি লইয়াছিলে, তাহা কি তুমি খরচ করিয়া ফেলিয়াছ?’

নিয়োগী-পুত্র উত্তর করিল, ‘একখানি পঞ্চাশ টাকার ও পাঁচখানি দশ টাকার নোট ভাঙ্গাইয়া আমি খরচ করিয়াছি; কিন্তু পঞ্চাশ টাকার নোটখানি নম্বরী বলিয়া তাহা ভাঙ্গাইতে আমি সাহস করি নাই। সে নোট এখনও আমার নিকট আছে।’

এই বলিয়া বেচু তাহার তোরঙ্গের চাবি আমাকে দিল ও যে কোণে নোটখানি ছিল, তাহা আমাকে বলিয়া দিল। নোটখানি বাহির করিয়া আমি পুলিশের হাতে দিলাম। ইহার কিছুদিন পরে নম্বর দেখিয়া প্রমাণ হইল যে, ইহা বেণীর পিতার প্রেরিত সেই নোট বটে।

পুলিশ বেচুকে থানায় লইয়া যাইতে ইচ্ছা করিল। আমি ও বেচু দুইজনেই আপত্তি করিলাম। কিন্তু পুলিশ সেকথা শুনিল না। পালকি করিয়া বেচুকে তাহারা লইয়া চলিল। দুধ, জল, ঔষধ প্রভৃতি লইয়া, আমিও সঙ্গে চলিলাম। থানা হইতে পুলিশ তাহাকে আদালতে লইয়া গেল। সাহেবের নিকট পুনরায় তাহাকে সমুদয় বৃত্তান্ত প্রদান করিতে হইল। সাহেব তাহাকে জেলখানার হাসপাতালে পাঠাইতে আদেশ করিলেন। নিজের খরচে আমি উকিল দিয়া জামিনের প্রার্থনা করিলাম; কিন্তু সে খুনী আসামী; জামিন হইল না।

এক স্থান হইতে অন্য স্থানে নাড়া-চাড়া, তাহার উপর ঘোরতর মনের আবেগ, এই সমুদয় কারণে আমি দেখিলাম যে, বেচুর অবস্থা ক্রমশই মন্দ হইয়া আসিতেছে। অপরাহ্নে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের বৈলক্ষণ্য ঘটিল। এ অবস্থায় জেলখানায় তাহাকে গাড়ি করিয়া লইয়া যাইতে পুলিশ সাহস করিল না। পাল্কিতে আস্তে আস্তে তাহাকে লইয়া চলিল। দুইজন পুলিশ-কর্ম্মচারী সঙ্গে চলিল। পাল্কির উপর হাত রাখিয়া, পার্শ্বে দাঁড়াইয়া, রোগীর মুখের দিকে সতত দৃষ্টি রাখিয়া, আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। গড়ের মাঠে গিয়া রোগীর চক্ষুর ভাব দেখিয়া আমার বড় ভয় হইল। এক নিভৃত বৃক্ষতলে আমি পাল্কি নামাইতে বলিলাম। তাহার পর ভাল করিয়া দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, বেচুর আসন্নকাল উপস্থিত হইয়াছে। আমি তাহার মুখে বিন্দু বিন্দু জল দিয়া ধীরে ধীরে ভগবানের নাম করিতে লাগিলাম।

এবার আমার পানে চাহিয়া অতি মৃদুস্বরে বেচু এই কয়টি কথা বলিল, ‘মদনবাবু! আমি চলিলাম। রাধারাণীকে আপনি বিবাহ করিবেন। আপনি সংসারী হইবেন। সেদিন ধর্মবিষয়ে অনেকগুলি কথা আপনাকে বলিয়াছি। আজ আর একটি কথা আপনাকে বলি। একখানি মহানির্বাণতন্ত্র ক্রয় করিবেন! বর্তমান-কালে মানবজাতির অবস্থা বুঝিয়া চরাচরের গুরু শ্রীশ্রীসদাশিব মনুষ্যজাতিকে এই মহারত্ন প্রদান করিয়াছেন। ব্রহ্মপরায়ণ ব্রাহ্মণের নিকট এই তন্ত্র অনুসারে উপদেশ গ্রহণ করিবেন। তাহার পর, এই তন্ত্র অবলম্বন করিয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করিবেন। তাহা করিলে আপনার ইহকালে সুখ ও পরকালে সদগতি হইবে। আর বিশেষ কথা এই যে, এই তন্ত্রের প্রভাবে অকালমৃত্যুজনিত মহা শোকে আপনার হৃদয় সন্তপ্ত হইবে না। সেই সদাশিব এক্ষণে আমার কণ্ঠে আসীন হইয়াছেন। তাঁহার আদেশে আপনাকে আমি এই কথাগুলি বলিলাম।’

আহা! এই কথাগুলি বলিবার নিমিত্ত বেচু যেন এতক্ষণ জীবিত ছিল। যাই এই কথাগুলি শেষ হইল, আর দেহ হইতে তাহার প্রাণবায়ু অন্তর্হিত হইল। আমি কাঁদিতে লাগিলাম।

বেহারাগণ তাহার মৃতদেহ জেলখানায় লইয়া গেল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে যাইলাম। আমি মনে করিলাম যে, মৃতদেহ দিবার অনুমতি হইলে, আমি লোক ডাকিয়া আনিব। এইরূপ মনে করিয়া বাহিরে আমি অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

কিছুদিন পরে নিয়োগী মহাশয় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাসায় পৌঁছিয়া তিনি সমুদয় ঘটনা শুনিয়াছিলেন। তাহার পর তিনি থানায়, ও থানা হইতে আদালতে গিয়াছিলেন। আদালত হইতে এইস্থানে উপস্থিত হইলেন।

মিহির মনে করিয়া, যেদিন পুলিশে আমাকে ধরিয়া লইয়া যায়, সেদিন হইতে আমার মনের ভাব পরিবর্তিত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। তাহার পর মুমূর্ষ বেচুর নিকট বসিয়া, তাহার কথাবার্তা শুনিয়া আমার চক্ষু উন্মুক্ত হইয়াছিল। মনুষ্য-জীবন কিরূপ অনিত্য, তাহা আমি বুঝিয়াছিলাম। আমি ভাবিলাম যে, নিয়োগী মহাশয় যেরূপ লোক হউন না কেন, আমি তাঁহার বিচার করিবার কে? মানুষ দোষে গুণে হইয়া থাকে। নিয়োগী মহাশয়েরও অনেক গুণ থাকিতে পারে,—যে গুণের পরিচয় আমি প্রাপ্ত হই নাই। দোষের ভাগ ত্যাগ করিয়া, মানুষের গুণের ভাগ গ্রহণ করাই যে ভাল, সকলকে আমি এই উপদেশ প্রদান করি। কাহারও প্রতি বিদ্বেষ ভাব মনে স্থান দিও না। কাহাকেও ঘৃণা করিও না। কাহারও প্রতি হিংসা করিও না। অনেক সময় কু-চিন্তা উদয় হইতে পারে। অন্যের ভাল হইয়াছে শুনিয়া, মনে হিংসার উদয় হইলে, তৎক্ষণাৎ তাহা দূর করিতে চেষ্টা করিবে। মনে কু-চিন্তা হইলে, ক্রমাগত ঈশ্বরকে ডাকিতে থাকিবে যে,-‘হে ঈশ্বর! আমার মন হইতে এরূপ চিন্তা দূর কর।’

এইরূপ ভাবিয়া আমি কাঁদিতে কাঁদিতে নিয়োগী মহাশয়কে তাঁহার পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ প্রদান করিলাম। এরূপ ঘোর দুঃখ-সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াও তাঁহার অন্তঃকরণ আর্দ্র হইল না; আমার প্রতি তাঁহার রাগ দূর হইল না। অন্তত তাঁহার কোপ-দৃষ্টি দেখিয়া আমি তাহাই বুঝিলাম। যাহা হউক, তাঁহার পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিমিত্ত লোক ডাকিয়া আনিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিলাম। সে অনুমতি তিনি আমাকে প্রদান করিলেন। গাড়ি করিয়া শীঘ্র আমি লোক ডাকিয়া আনিলাম। তাঁহার পুত্রের সৎকার আমরাই করিলাম। দুই দিন পরে নিয়োগী মহাশয় কলিকাতা হইতে প্রস্থান করিলেন। এ পর্যন্ত তাঁহার আর কোন সংবাদ আমি পাই নাই। পাইতে ইচ্ছাও বড় করি না।

পাল মহাশয়ের ও তাঁহার পুত্রের অনুসন্ধানে পুনরায় আমি প্রবৃত্ত হইলাম। তাঁহার সহিত যাহাদের আলাপ-পরিচয় ছিল, একে একে সকলকে তাঁহার তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলাম। তাঁহার গ্রামে গিয়া একে একে গ্রামবাসীদিগকে জিজ্ঞাস্য করিলাম। আরও কত স্থানে গিয়া অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কেহই তাঁহার সন্ধান আমাকে বলিয়া দিতে পারিল না। মিহির নিরপরাধ প্রমাণিত হইয়াছে, আর লুকায়িত থাকিবার আবশ্যক নাই, এই মর্মে দুইখানি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিলাম। তাহাতেও কোন ফল হইল না। কিন্তু তাঁহাদের সহিত পুনরায় যে আমার দেখা হইবে, সে বিষয়ে আমি হতাশ হইলাম না। কারণ, পাল মহাশয় সম্পত্তিশালী লোক। একদিন না একদিন তাঁহাকে দেশে আসিতেই হইবে। তাহা ব্যতীত, কলিকাতার বাসা তিনি একেবারে পরিত্যাগ করিয়া যান নাই। কলিকাতার সেই তিনটি ঘরে তাঁহার জিনিসপত্র আছে। তাহাতে চাবি দিয়া গিয়াছেন। একদিন না একদিন কেহ না কেহ সে দ্রব্যাদি লইতে আসিবে। এই প্রত্যাশায় আমি দিনাতিপাত করিতে লাগিলাম।

পঞ্চদশ অধ্যায়

আশু কষ্ট–পরে ইষ্ট

এইরূপে আরও তিন মাস কাটিয়া গেল। ভাদ্র মাস পড়িল। সে বৎসর দারুণ বর্ষা হইয়াছিল। পথঘাট জলে জলময় ও কাদায় কর্দময় হইয়াছিল। একদিন অপরাহ্ন চারিটার সময় আফিসে বসিয়া কাজ করিতেছি, এমন সময় একজন উৎকলবাসী আমাকে একখানি চিঠি আনিয়া দিল। সে পত্রে কেবল এই কয়টি কথা লেখা ছিল, ‘অনুগ্রহ করিয়া অতি গোপনে এই লোকের সহিত শীঘ্র আসিবেন। আসিলে সকল কথা জানিতে পারিবেন।’

পাল মহাশয় ও মিহিরের জন্য সর্বদাই আমার মন উদ্বিগ্ন ছিল। চিঠিখানি পাইবামাত্র আমার মনে হইল যে, এইবার বোধ হয়, তাঁহাদের সন্ধান পাইলাম। কালবিলম্ব না করিয়া, আমি সেই লোকের সহিত চলিলাম। কলিকাতার যে অংশে অতি ঘন বসতি, উড়িয়া আমাকে সেই স্থানে লইয়া গেল। সঙ্কীর্ণ গলির ভিতর সঙ্কীর্ণতর গলি, তাহার ভিতর একখানি খোলার বাড়িতে আমি প্রবেশ করিলাম। অতি কুৎসিত স্থান, দুর্গন্ধে নাড়ি উঠিয়া যায়। চারিদিক কাদায় ও ময়লায় পরিপূর্ণ। সেই বাটীতে অতি সামান্য ও ক্ষুদ্র একখানি ঘর উড়িয়া আমাকে দেখাইয়া দিল। ঘরের মেজে নিতান্ত আর্দ্র, যেন জল সপ-সপ করিতেছিল। আমি দেখিলাম যে, সেই ভিজা মেজেতে সামান্য একটি মাদুরের উপর গেরুয়া পরিচ্ছদ পরিহিত এক যুবক পড়িয়া আছে। ‘কে ও, মিহির’—এই কথা বলিয়া আমি তাহার নিকট গিয়া বসিলাম।

মিহির আমার দিকে চাহিয়া দেখিল। চিনিতে পারিলাম বটে; কিন্তু সে মিহির আর নাই। তাহার দেহ অস্থিচর্মসার হইয়া গিয়াছে; তাহার মুখ মলিন হইয়া গিয়াছে। তাহার গায়ে হাত দিয়া দেখিলাম যে, শরীর হইতে অগ্নির ন্যায় উত্তাপ বাহির হইতেছে। মাঝে মাঝে অতি কষ্টের সহিত সে কাসিতেছে। নিশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া সাধন করিতেও যেন তাহার বড় ক্লেশ হইতেছে। আমি পুনরায় বলিলাম, ‘মিহির!’

মিহির মৃদুস্বরে বলিল, ‘চুপ চুপ! আমার নাম ধরিয়া ডাকিও না, কেহ শুনিতে পাইলে এখনি আমাকে ধরিয়া লইয়া যাইবে।’

আমি বলিলাম, ‘তবে তুমি এখনও সে কথা জান না? মিহির! সে ভয় আর কিছুমাত্র নাই। তুমি যে নিরপরাধ, তাহা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। বেণীকে নিয়োগী-পুত্র খুন করিয়াছিল; পুলিশের কাছে ও আদালতে সাহেবের কাছে, সে তাহা স্বীকার করিয়াছে। তোমার আর কোন ভয় নাই।’

এই কথা শুনিয়া মিহির বলিল, ‘আমাকে তুলিয়া বসাও। আমি উঠিতে পারি না।’

আমি মিহিরকে তুলিয়া বসাইলাম। আমার স্কন্ধে মাথা ও বক্ষস্থলে আপনার শরীর রাখিয়া, সে বসিয়া রহিল। তাহার পর, বেচুর আদ্যোপান্ত বিবরণ বারবার সে আমার মুখ হইতে শুনিল। সেই বিবরণ শ্রবণ করিয়া তাহার রোগ ও যাতনার যেন অনেকটা উপশম হইল, আর তাহার শরীরে যেন একটু বল হইল।

তাহার পর, আমি তাহাকে বলিলাম, ‘মিহির! ভাই! তোমাকে আর ক্ষণকালের জন্য আমি এ স্থানে রাখিতে পারি না। এ স্থানে সহজ মানুষ মরিয়া যায়। তুমি ভয়ানক জ্বর ভোগ করিতেছ। বুকেও বোধ হয়, কিছু রোগ হইয়া থাকিবে। অতএব তোমাকে আমি আমার বাসায় লইয়া যাইব।’

মিহির উত্তর করিল, ‘কি করিয়া তাহা হইবে! আমার হাতে একটিও পয়সা নাই। এই সন্ন্যাসীবেশে বহুদেশে ভ্রমণ করিয়া, আজ দশ দিন কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াছি। কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াই, আমি শ্যামবাজারে গদাধর মোড়লের নিকট গমন করিয়াছিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। তাহার পর দিন হইতে এই বিষম জ্বর দ্বারা আমি আক্রান্ত হইয়াছি। সেই অবধি বিছানায় পড়িয়া আছি; —না ঔষধ, না পথ্য। গাড়িতে যাইতে পারিব না, পাল্‌কি করিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু গাড়ি কি পাল্‌কি ভাড়া কোথায় পাইব যে, তোমার সহিত তোমার বাসায় যাইব? তবে তুমি যদি গদাধর মোড়লের নিকট একবার যাইতে পার, তাহা হইলে হয়।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘গদাধর মোড়ল কে?’

মিহির উত্তর করিল, ‘তিনি বাবার বন্ধু, আমাদের স্বজাতি। কলিকাতায় তিনি ব্যবসায় করেন। শ্যামবাজারে তাঁহার বাসা, তোমার সহায়তায় যে রাত্রে আমি পুলিশের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাই, সেইদিন বাবার নিকট যাহা কিছু নগদ টাকা ছিল, তাহা তিনি আমাকে প্রদান করিয়া বলিলেন যে, এ টাকা ফুরাইয়া গেলে তুমি গদাধর মোড়লের নিকট যাইবে, যখন যাহা আবশ্যক হইবে, গদাধর তোমাকে দিবে। আমাকে কদাচ তুমি পত্র লিখিবে না। কারণ, সেই পত্রের অনুসরণে পুলিশে তোমার সন্ধান পাইতে পারে।’

একটু চুপ করিয়া মিহির পুনরায় বলিল, ‘তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্বেও আমি গদাধর মোড়লকে পত্র লিখিতাম, পিতাকে লিখিতাম না। গদাধর মোড়ল পিতাকে আমার সংবাদ দিতেন। ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া যেদিন বাটী যাইতে ইচ্ছা হইত, সে সংবাদও গদাধর মোড়লের দ্বারা পিতাকে জানাইতাম। পিতা, মাতা ও রাধারাণী সকলে আমার জন্য বসিয়া থাকিতেন। আমি উপস্থিত হইলে, জানালার গরাদে তুলিয়া, ঘরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত রাধারাণীর পথ করিয়া দিত।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে রাত্রি তুমি কিরূপে পলায়ন করিলে? আর তাহার পর এত দিন কোথায় ছিলে? তুমি যে নিরপরাধ, তাহা যখন প্রমাণ হইল, তখন আমি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়াছিলাম। সে সংবাদপত্র তোমার হাতে পড়ে নাই?’

মিহির উত্তর করিল, ‘না, সে বিজ্ঞাপন আমি দেখি নাই। মৃত্যুকালে বেচু আপনার দোষ স্বীকার করিয়া, আমাকে যে খুনের অভিযোগ হইতে অব্যাহতি দিয়াছে, সে কথা তোমার মুখ হইতে এইমাত্র শুনিলাম। সে রাত্রি পুলিশে তোমাকে লইয়া গেল। তাহার পর, বাসাড়েগণ যে যাহার ঘরে শয়ন করিল। আমি তোমার ঘর হইতে বাহির হইয়া, পুনরায় পিতা, মাতা ও ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহার পর বাটীর সদর দরজা দিয়া পলায়ন করিলাম, অশ্বত্থগাছ দিয়া নহে। দিন দুই কলিকাতার এক খোলার ঘরে লুক্কায়িত রহিলাম। তাহার পর, কাপড় ছোপাইয়া, গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে সে বাটী হইতে বাহির হইলাম। একদল সন্ন্যাসীর সহিত প্রথম জগন্নাথ যাইলাম। তাহার পর, নানা তীর্থস্থান ভ্রমণ করিয়া কলিকাতা প্রত্যাগমন করিলাম। পিতা যাহা কিছু টাকা দিয়াছিলেন, সে সমুদয় খরচ হইয়া গিয়াছে। টাকার জন্য গদাধর মোড়লের নিকট গমন করিলাম। তাঁহার দেখা পাইলাম না। তাহার পর আজ নয় দিন পীড়িত হইয়া বিছানায় পড়িয়া আছি। সে রাত্রি পিতা আমাকে তোমার পরিচয় দিয়াছিলেন; তুমি কোন্ আফিসে কাজ কর, তাহাও তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন। তাই আজ তোমাকে সংবাদ দিতে পারিলাম। তোমার বাসায়, কি গদাধর মোড়লের বাসায় লোক পাঠাইতে আমি সাহস করিতাম না। সে যাহা হউক, আমার হাতে এখন একটিও পয়সা নাই। গাড়ি কি পাল্‌কি ভাড়া কোথায় পাইব যে, তোমার বাসায় যাইব।’

আমি বলিলাম, ‘সেজন্য তোমার কোন ভাবনা নাই। গদাধর মোড়ল বোধ হয়, তোমার পিতার ঠিকানা জানেন?’

মিহির উত্তর করিল, ‘বোধ হয় কেন! পিতার ঠিকানা তিনি নিশ্চয় জানেন।’

মিহিরকে আমি বাসায় লইয়া যাইলাম। পরিষ্কৃত শুভ্র বসন পরাইয়া, তাহাকে পরিষ্কৃত বিছানায় শয়ন করাইলাম। তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনিয়া তাহাকে দেখাইলাম। ডাক্তার বলিলেন যে, মিহিরের পীড়া বড় কঠিন হইয়াছে। তাহার বক্ষস্থলের দুই দিকেই প্রদাহ হইয়াছে। যাহা হউক, তাহার ঔষধ ও পথ্যের আয়োজন করিয়া, ভট্টাচার্য মহাশয়কে তাহার নিকট বসাইয়া, আমি সেই রাত্রিতেই গদাধর মোড়লের অনুসন্ধানে গমন করিলাম। এ স্থানে বলিয়া রাখি যে, যখন যেরূপ ঘটনা ঘটিতেছিল, ভট্টাচার্য মহাশয়কে তাহার সমুদয় বিবরণ আমি প্রদান করিতেছিলাম। তাঁহার অনুগ্রহ আমি এ জীবনে ভুলিতে পারিব না।’

গদাধর মোড়লের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। পাল মহাশয়ের তিনি বন্ধু বটেন; কিন্তু মিহির যে নিরপরাধ প্রমাণিত হইয়াছে, সে সংবাদ এ পর্যন্ত তিনি শ্রবণ করেন নাই। আমার মুখে সেই সমুদয় বিবরণ শুনিয়া, তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। কিন্তু মিহিরের কঠিন পীড়া শুনিয়া তিনি দুঃখিত হইলেন। তাঁহার মুখে শুনিলাম যে, পাল মহাশয় কাশীতে আছেন। সেই ঠিকানায় তৎক্ষণাৎ আমি বিস্তারিতভাবে তারে খবর দিলাম। ডাক্তার খরচের নিমিত্ত অনেকগুলি টাকা সঙ্গে লইয়া, মোড়ল মহাশয় সেই রাত্রিতেই আমার সঙ্গে মিহিরকে দেখিতে আসিলেন। মিহিরকে দেখিয়া তিনিও পাল মহাশয়কে স্বতন্ত্রভাবে তারে খবর দিলেন।

একদিন পরে পাল মহাশয় সপরিবারে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য যে, মিহির যে নিরপরাধ প্রমাণিত হইয়াছে, সেকথা তিনিও পূর্বে শ্রবণ করেন নাই। আমার তারের সংবাদে সে সুসমাচার তিনি প্রথম প্রাপ্ত হইলেন। পুত্রের মুখ দেখিয়া তিনি আনন্দিত হইলেন, কিন্তু তাহার পীড়ার জন্য সকলকেই ঘোরতর উৎকণ্ঠিত হইতে হইল। মিহিরের পীড়া ক্রমে এমনি কঠিন হইয়া উঠিল যে, দিন কয়েক তাহার বাঁচিবার আশা একেবারেই ছিল না। পাল মহাশয়, তাঁহার গৃহিণী, রাধারাণী, ভট্টাচার্য মহাশয়, আর আমি—এই কয়জনে, আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া মিহিরের সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগিলাম। যাহা হউক, ভগবানের কৃপায় মিহির এ যাত্রা রক্ষা পাইল।

পীড়ার যখন একটু উপশম হইল, তখন মিহির একদিন আমার হাতটি ধরিয়া কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলিল, ‘ভাই! তুমি আমার ভাই।’

পাল মহাশয়, তাঁহার গৃহিণী ও রাধারাণী সকলেই মিহিরের বিছানার পার্শ্বে সেই সময় বসিয়াছিলেন। মিহিরের এই কথা শুনিয়া পাল মহাশয় বলিলেন, ‘হাঁ, মিহির! মদন তোমার ভাই। মদনকে প্রথম আমি বুদ্ধিশুদ্ধিহীন পাগল বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু ইহার স্বভাব দেখিতেছি, সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। ইহার ধীর-মধুর বাক্যে আমি বড়ই প্রীত হইয়াছি। তাহার পর, মদন আমার যে উপকার করিয়াছে, জীবনে তাহা আমি কখনই ভুলিতে পারিব না। সে রাত্রি তোমার পলায়ন, তাহার পর খুনী অভিযোগ হইতে তোমাকে অব্যাহতি দান, অবশেষে এই সঙ্কট পীড়ায় তোমার জীবন রক্ষা,—এ সমুদয় মদনের সহায়তায় হইয়াছে। সে নিমিত্ত আমি বলিতেছি যে, তুমি আমার যেমন পুত্র, মদনও সেইরূপ আমার পুত্র। রাধারাণী মা! তুমি কি বল?’

রাধারাণী বুঝিতে পারিল। লজ্জায় সে ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল। কোন উত্তর করিল না। তাহার পর, সে স্থান হইতে উঠিয়া সে পলায়ন করিল।

সেইদিন আমি মিহিরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মিহির! মুখোশ পরিয়া কলিকাতার জনাকীর্ণ পথ দিয়া তুমি কি করিয়া চলিতে? কেহ তোমাকে কিছু বলিত না?’

একটু হাসিয়া মিহির উদ্ভব করিল, ‘তুমি পাগল! পথ চলিবার সময় আমি মুখোশ পরিতাম না। কেবল অশ্বথগাছে উঠিবার সময় আমি মুখোশ পরিতাম। চোর মনে করিয়া কেহ আমার নিকট না আসে, লোকে ভূত মনে করিয়া ভয়ে পলায়ন করে, সেইজন্য গাছে উঠিবার সময় আমি মুখোশ পরিতাম। দুই-একবার ভূত মনে করিয়া লোকে পলায়ন করিয়াও ছিল।’

খুনী অভিযোগ হইতে মিহির সহজে নিষ্কৃতি পায় নাই। ভাল হইয়া হুগলির কাছারিতে তাহাকে হাজির হইতে হইয়াছিল। সে স্থানে সামান্য একটু মোকদ্দমাও হইয়াছিল। এই বিচারের সময় আর একটি নূতন কথা বাহির হইয়া পড়িল। বেচুর সহিত আর দুইটি ছাত্র একঘরে শয়ন করিত। খুনের সময় তাহাদের একজন জাগরিত ছিল। বেচুকে বেণীর ঘরে প্রবেশ করিতে ও কিছুক্ষণ পরে দ্রুতপদে ফিরিয়া আসিতে সে দেখিয়াছিল। এইরূপ আরও অনেক কথা সে অবগত ছিল। মিহিরের হইয়া সে সাক্ষ্য প্রদান করিল। যাহা হউক, অল্পদিনের মধ্যেই মিহির খালাস পাইল।

অধিক আর কিছুই বলিবার নাই। মিহির খালাস পাইলে, পাল মহাশয় তাহাকে লইয়া দেশে গমন করিলেন। মাঝে মাঝে তিনি ও মিহির কলিকাতায় আসিয়া, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। আমিও মাঝে মাঝে তাঁহাদের গ্রামে গমন করিতাম। রাধারাণীর সহিত আমার যে বিবাহ হইবে, সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কোন কথা হয় নাই। কিন্তু কি আমি, কি ভট্টাচার্য মহাশয়, কি আর আর লোক, সকলেই বুঝিল যে, সে তো হবেই, তবে আর কথার আবশ্যক কি! আমার পিতা যে স্বহস্তে চাষ করিতেন, সে কথার কোনরূপ আর উল্লেখ হইল না। তবে একদিন কথায় কথায় ভট্টাচার্য মহাশয়কে পাল মহাশয় বলিলেন যে, ‘লোকের মনে কি কুসংস্কার! যাহাদের পরিশ্রমে ভূমি হইতে মনুষ্যের আহার আচ্ছাদন উৎপাদিত হয়, তাহাদিগকে লোকে চাষা বলিয়া ঘৃণা করে। বড় মানুষের রাজভবন ও গাড়ি ঘোড়া হইতে সামান্য ভিখারীর একমুষ্টি অন্ন পর্যন্ত সমুদয় বস্তু কৃষকের পরিশ্রমেই উৎপন্ন হয়। ভারতের সমুদয় জাতির সম্বল—কৃষিকার্যের ফল। সুতরাং কৃষকেরা সাধারণের পূজ্য, তাহারা ঘৃণিত নহে। এ বিবেচনা যাহাদের নাই, তাহাদিগকে আমি আর কি বলিব!’

পাল মহাশয় পুনরায় বলিলেন, ‘বিপদে পতিত হইয়া আমি আর একটি জ্ঞানলাভ করিয়াছি। ঈশ্বর সর্বদাই আমাদের নিকট আছেন। জলে যেমন মৎস্য ডুবিয়া থাকে, ঐশ্বরিক শক্তির ভিতর সেইরূপ আমরা ডুবিয়া আছি। সেই অনন্ত জ্ঞানসাগরে আমরা যে ডুবিয়া আছি, তাহা যদি ভালরূপে আমরা বুঝিতে পারিতাম, তাহা হইলে মনুষ্য নানা জ্ঞান ও নানারূপ অলৌকিক শক্তি লাভ করিতে সমর্থ হইত। কিন্তু তিনি যে সর্বদাই আমাদের কাছে আছেন, তাহা আমরা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারি না। সেইজন্য সেই বিশ্বাত্মার সহিত নিজের আত্মা সংযোজিত করিয়া, মানুষ সেই অনন্ত জ্ঞান ও শক্তি-সাগর হইতে নিজের সামান্য জ্ঞান ও শক্তি পরিপুষ্ট করিতে পারে না। তথাপি তিনি সর্বদাই আমাদের মঙ্গল সাধন করিতেছেন। বিনা দোষে মিহিরকে যখন পথে পথে ফিরিতে হইয়াছিল, তখন ভগবানের অবিচারের উপর আমি কতই না দোষারোপ করিয়াছিলাম। কিন্তু মিহিরের উপর সেই মিথ্যা অভিযোগ যদি আরোপিত না হইত, তাহা হইলে তাহার একমাস পরেই বেচুর সহিত আমার কন্যার বিবাহ হইয়া যাইত। কারণ বিবাহের দিন স্থির পর্যন্ত হইয়া গিয়াছিল। সে বিবাহ হইলে আমার সর্বনাশ হইত! যে চুরি করিতে পারে, যে খুন করিতে পারে, আমার কন্যা সেইরূপ লোকের হাতে পড়িত। তাহার পর, রোগগ্রস্ত লোকের হাতে পড়িয়া অল্পদিনের মধ্যেই তাহাকে বিধবা হইতে হইত। অতএব মিহিরকে দুই বৎসরের নিমিত্ত ক্লেশ দিয়া, দয়াময় ভগবান চির জীবনের নিমিত্ত আমার কন্যাকে রক্ষা করিয়াছেন।’

পুনরায় যখন মাঘ মাস আসিল, পুনরায় যখন শ্রীপঞ্চমীর সময় আসিল, তখন পাল মহাশয় কলিকাতায় আসিয়া, ভট্টাচার্য মহাশয়কে বিবাহের দিন ধার্য করিতে বলিলেন। তাহার পর, সে শুভকার্য,—অন্য লোকের যেভাবে সম্পন্ন হয়, আমারও সেইভাবে হইল। পূর্বের ন্যায় যদি আমার প্রাণে রস থাকিত, তাহা হইলে কিরূপে বাসর-ঘর হইল, কিরূপে শালী-শালাজগণ আমার সহিত তামাসা করিল, সেসব পরিচয় বিস্তারিত ভাবে আমি আপনাদিগকে প্রদান করিতাম। কিন্তু নিয়োগী-পুত্রের চিতাগ্নিতে সে রস আমার শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। রস নাই বটে, তবে মন আমার আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়াছে। কারণ, আমার রাধারাণী, রূপে গুণে লক্ষ্মী সরস্বতী দেবীর বরে আমি একাধারে এই লক্ষ্মী সরস্বতী লাভ করিয়াছি। সেদিন দেবীকে পূজা করিতে গিয়াছিলাম, তাই ভট্টাচার্য মহাশয়কে পাইয়াছিলাম। তাহার পর, তাঁহার দ্বারা পাল মহাশয়কে পাইলাম। অবশেষে রাধারাণীকে লাভ করিলাম। সেদিন দেবীকে যদি অঞ্জলি দিতে না যাইতাম, তাহা হইলে এসব যোগাযোগ হইত না। সেইজন্য বলি যে, মা সরস্বতীর কৃপায় আমি রাধারাণীকে লাভ করিয়াছি। রাধারাণীকে লাভ করিয়া, আজ, হে পাঠক! আপনাদের দাসানুদাস এই মদন ঘোষের বদন হাসিতে পূর্ণ হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *