মথ
জেরিন আমাকে দেখেই বলল, আগের চেয়ে বেশ শুকনা হয়ে গিয়েছিস। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা ঝাঁকালাম। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কেমন যেন একটা অনিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া চারপাশে। বড় বড় দালান, দোকানপাট। মোটামুটি বড় রাস্তা বলে অটোরিকশা, টেম্পো আর ব্যক্তিগত গাড়িগুলো চলছে। সেই সাথে আছে অনবরত রিকশার টুং-টাং শব্দ। পাশেই একটা ছাপড়া হোটেলে ডালপুরি আর মোগলাই ভাজা হচ্ছে। ধোঁয়া উঠছে কড়াইয়ের গরম তেল থেকে। পটাপট কাগজের প্যাকেটে ঢুকে যাচ্ছে সদ্য ভাজা পুরি কিংবা মোগলাই। খাবার নেওয়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। আকাশে কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। কিছু সোনালি রেখা আর দূরবর্তী পাহাড়ের মতো বিচ্ছিন্ন কিছু মেঘ। একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। এক বুড়ো। তামাকের ঘ্রাণ আসছে তীব্র। এ রাস্তার পূর্বপাশে অনেক আগে নারিকেলগাছের সারি ছিল। বাতাসে সেই গাছের পাতা ঝুঁকে ঝুঁকে শুধু সালাম জানাত। একটা বকুলগাছ ছিল কাছেই কোথাও। ফুল হতো খুব। এসব কিছুই এখন আর নেই। স্মৃতির শহর বদলে গেছে অনেকটুকুই।
জেরিন একবারও বাসায় আসতে বলল না। লক্ষ করে দেখলাম ওর মাথার চুল খুব পাতলা হয়ে গিয়েছে। সাদা সাদা চামড়া দেখা যাচ্ছে পাতলা চুলের পাশ দিয়ে। অথচ এক কালে কেমন মোটা মোটা দুটা বেণি করে আসত ক্লাসে। কোচিংয়ের ছেলেরা ওকে দেখলে বিজ্ঞাপনের লাইন ছুঁড়ে দিত, তোমার ঘন কালো চুলে হারিয়ে যায় মন…
এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব? নাকি বাসায় গিয়ে বসব?
জানি না আসলে। বলেই ত্যাগ করে জেরিন। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। ঘাড় বাঁকা করে তাকাতেই দেখতে পাই, ওদের চুনকাম না করা বাড়িটার পেছনে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে চুপি চুপি।
চল হাঁটি। উত্তরের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ হাঁটা শুরু করে জেরিন।
সন্ধ্যার মৃদু বাতাসে অল্প দুলে ওঠে আমার মন। দেখি ওর ভারিক্কি চালে হেঁটে যাওয়া। তারপর ওকে অনুসরণ করি। অনেকেই আমাকে দেখছে কিছুটা বিচিত্র দৃষ্টিতে। এই সন্ধ্যায় সানগ্লাস পরে আছি বলে নাকি মেয়েমানুষ হয়েও জিনসের সাথে ঢোলা শার্ট পরে আছি বলে তা জানি না। সানগ্লাসটা খুলব খুলব ভেবেও খোলা হয় না। জেরিনের পিছু পিছু যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখি আমার পাশাপাশি চামড়া পুড়ে যাওয়া এক নেড়ি কুকুর রাস্তা পার হচ্ছে। অল্পক্ষণের মাঝেই রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকে পড়ি। গলির মোড়ে হোসেন চাচার দর্জি দোকানটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মোবাইলে টাকা ভরার একটা ছোট্ট দোকান বসেছে সেখানে। রেডিও শুনতে শুনতে কাজ করছে এক কিশোর ছেলে। গায়ে বাহারি শার্ট, মাথার চুল খুব কায়দা করে কাটা। জেরিন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে হাঁক দিয়ে বলল-জারিন আপা, মুবাইলে টেকা লাগব?
জেরিন মাথা নেড়ে না করে দেওয়ায় সে আবার মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যায়।
আমি হাঁটতে হাঁটতেই ব্যাকপ্যাক থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে নিই। আমার ভিনদেশি জীবনে আমি অনেক হাঁটি, তাও কখনো এত তৃষ্ণা পায় না। অথচ আজ বার বার তৃষ্ণা পাচ্ছে। সম্ভবত আর্দ্রতার জন্য। জেরিন কিছুদূর গিয়ে থেমে আমাকে হাতের ইশারায় ডাকে। আমি লম্বা পা ফেলে ওর কাছে এগিয়ে যাই।
মোকসেদ চাচার বাড়ি না সামনে? উনার মেয়েটা কেমন আছে এখন?
কে মুনিবা? অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এক পা প্রায় খোঁড়া ছিল বলে বিয়ে হচ্ছিল না। মোকসেদ চাচাঁদের হতাশা আর ওর কারণে ছোটবোনের বিয়েতে বাধা হতে পারে ভেবেই এমন করেছে। এই ঘটনার মাস ছয়েক পরেই বিয়ে হয়েছে ওর বোনের। বেশ আয়োজন করেই হয়েছে।
আমার মুনিবার বহু আগের মুখটা হালকা মনে পড়ে। লম্বাটে চেহারা আর ঢেউ খেলানো চুল ছিল ওর। খুব ক্লাসিক বই পড়ত। ভার্জিনিয়া উলফ ছিল ওর প্রিয় লেখক। ভার্জিনিয়া নিজের ওভারকোটের পকেটে পাথর ভরে আত্মহত্যা করেছিল ওউজ নদীতে ডুবে। মুনিবার আশপাশে নদী থাকলে সেও হয়তো একই কাজ করত। কিংবা হয়তো ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার সময় সে তার ঘরটাকেই নদী ভেবে নিয়ে ডুব দিয়েছিল। কে জানে?
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কাসেমবাগ পর্যন্ত চলে এলাম। পথ শুকনা খটখটে। ধুলোময়। বহু আগে এখানে ড্রেন ছিল। ড্রেনের পানি ছিল কালচে। যাতায়াতের জন্য ছিল কিছু সরু কালভার্ট, এখন আর ওগুলো নেই। রাস্তা আগের চেয়ে প্রশস্ত। আমরা দুজন চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম। জানি না জেরিন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। অনেক বেশি আগ্রহ কাজ করছে না জানার জন্য, আবার এমনও নয় যে না জানলেও চলবে। আবার গলা শুকিয়ে এসেছে। অযথাই কথা চালানোর জন্য বললাম, বাসার সবাই ভালো আছে?
জেরিন বিচিত্রভাবে একটু তাকাল আমার দিকে। তারপর বলল, পা চালিয়ে আগা। সামনের রাস্তাটা অন্ধকার।
অন্ধকার থেকে মনে পড়ে গেল স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে সন্ধ্যার পর লোডশেডিং হলেই আমরা ছাদে চলে যেতাম, ছাদের গাছগুলোকে পানি দিতে দিতে গান গাইতাম। ভাবতে গিয়ে ঝিম ধরা একটা ভাব কাজ করে মনে। সন্ধ্যার হালকা অন্ধকারে আমি অতীতের ছবি আঁকিবুকি করতে থাকি। আচ্ছা জেরিন কি আমাকে মন্ময় ভাইদের বাসায় নিয়ে যাচ্ছে? এদিকেই কোথাও ছিল উনাদের বাসা। কিন্তু, শুনেছিলাম উনি দেশের বাইরে চলে গেছেন। তা হলে কি আবার ফিরে এসেছেন কোনো কারণে?
বেশ বড় একটা বাঁক নিয়ে আমরা আরেকটা সুনসান গলিতে ঢুকে পড়লাম। দু-পাশে বেশ কিছু বন্ধ দোকানপাট। এই সন্ধ্যাবেলাতেই মনে হচ্ছে নিঝুম রাত নেমে এসেছে। ঝিঁঝি পোকা হালকা করে ডাকছে দূরে কোথাও। বাতাসে একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ। জেরিন হেঁটে হেঁটে একটা বড় দালানের সামনে চলে গেল। দালানটি প্রায় দশতলা। ঘন অন্ধকারে প্রায় ডুবেই আছে। আশপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেখেই বোঝা যায় সেখানে এখনও কাজ চলছে কিংবা চলছিল বহু আগে থেকে, যা হয়তো এখন থেমে আছে কোনো কারণে। জেরিন গায়ের সাদা ওড়নাটা ঠিক করতে করতে ভেতরে যেতে যেতে বলে উঠল, আয়।
এখানে কোথায়?
আরে আয় না। আয় আমার সাথে। আমি মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আলো দিচ্ছি।
এখানেই কেন?
কারণ সবখানে সবকিছু বলা যায় না। দেয়ালেরও কান থাকে। এখানে দেয়ালগুলো এখনও পুরোপুরি জেগে উঠেনি। তাই শান্তিমতো কথা বলা যাবে।
জেরিন কথা বলতে বলতেই ফ্ল্যাশের আলোতে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে। চারপাশে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। ফ্ল্যাশের হালকা আলোতে দেখা যাচ্ছে এখানে সেখানে ইট-সুরকির স্তূপ। সঁতসেঁতে ঘ্রাণ। আমি অপরিচিত এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে জেরিনের পিছু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকি। এক, দুইতলা করে করে আমরা প্রায় ছয়তলায় উঠে যাই। হুট করেই সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হতে থাকে আমার। যেন আমি আরব্য রজনীর গল্প শুনতে মন্ত্রমুগ্ধ এক শ্রোতার মতো কোনো জাদুকরের পিছু নিয়েছি। দালানের ভেতরে খোলামেলা বলে বাতাস আসলেও কেমন যেন ভ্যাপসা ভাব। অন্ধকারে দেয়াল আর স্তম্ভগুলো বিষাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলের অল্প আলোয় ছায়া ছায়া হয়ে যেন গাঢ় দুঃস্বপ্নের চিত্র এঁকে দিয়েছে। জেরিন সাততলা পেরিয়ে আটতলায় উঠে আসে। ওর জামার রং আর আলাদাভাবে বোঝা যায় না। শুধু আবছাভাবে সাদা ওড়নাটা অন্ধকারে ভেসে থাকে। আটতলার পর আর কোনো সিঁড়ি নেই। বাকি অংশে কাজ চলছিল, কিন্তু শেষ করেনি বলে আগায়নি। ছাদে উঠে বড় বড় দম নেয় জেরিন। আমি জিজ্ঞেস করি, পানি খাবি?
উঁহু।
বেশ গরম লাগতে থাকে আমার। আকাশটা অন্ধকার হয়েও আবছা আলো দিচ্ছে। জেরিন মোবাইলের আলো বন্ধ করে দেয়। অল্প সময়ে আরও সয়ে আসে চোখদুটো। অনলাইনের খবরে প্রায়ই পড়েছি, এসব পুরোনো দালানে প্রচুর মাদক ব্যবসায়ী আর নেশাখোররা আড্ডা জমায়। কে জানে এখানেও তেমনি করে কেউ আসে কিনা। ভয় নয় তবে যেন একটা শঙ্কা কাজ করে আমার। কী বলবে আজ জেরিন?।
আমরা কেউ কোনো কথা না বলেই কেন যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। আবছা আলোতে দেখতে পাই জেরিন মুখে আঁচল চেপে ধরেছে। ও কি কাঁদছে?
সাতাশবার।
মানে?
জানিস, গত এক বছরে মোট সাতাশবার আমি এখানে এসেছি আত্মহত্যা করার কথা ভেবে। কখনো পারিনি।
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত নদীর মতো কুলকুল বয়ে যায়। কী বলছে জেরিন এসব?
জানিস এক সন্ধ্যায় এই বাড়িটার নিচে এসেই মন্ময় ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন। ওটাই প্রথম, ওটাই শেষ। উনি বয়সে তিন বছরের বড় এক মেয়েকে বিয়ে করে গ্রিন কার্ড নিয়ে আমেরিকা গিয়েছেন। হয়তো ভালোই আছেন।
চল তো এখান থেকে। কোনো খাবারের দোকানে বসে বাকি কথা বলা যাবে। আমি কণ্ঠস্বর শান্ত রেখে বলার চেষ্টা করি। আকাশে ক্ষণিকের বিদ্যুৎ চমকে ওঠে হঠাৎ বৃষ্টি নামবে নাকি? আমি গলার স্বর নিচু করি, কিরে কাঁদছিস নাকি? অল্পবয়সি মেয়েদের মতো কোনো পুরুষের জন্য কাঁদলে এ বয়সে মানায় নাকি? বাদ দে এসব।
অন্ধকারে জেরিন গায়ের ওড়নাটা এবার কিছুটা চাদরের মতো পরে নেয়। তারপর এক পা এগিয়ে আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে, চাকরিতে অনেক বেতন বাকি পড়ে আছে। প্রায় আট মাস বেতন দেয় না। তবুও নিয়ম করে যাই। আর কোথাও কাজ পাচ্ছি না। আব্বার পেনশনের টাকাগুলো অর্ধেকের বেশি আটকে আছে।
আমি চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ, তারপর হালকা স্বরে বলি-টাকাপয়সার সমস্যা পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের। এটা নিয়ে এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
আঁধার-আলোয় যেন আপন স্তব্ধতা সৃষ্টি হয়। জেরিনের মুখ দেখা যায় না। বেশ অনেকখানি মেদবহুল শরীর নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে প্রায় না শোনা যাওয়া কণ্ঠে বলে, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি এক ছেলের সাথে আম্মা গত এক বছর ধরে রোজ ফোনে কথা বলে। মাঝে মাঝে সারারাত বলে। আমি প্রায়ই টের পাই প্রতি দু-ঘণ্টা পর পর লাইন কেটে গেলে আম্মা পানি খেতে ওঠেন, বাথরুমে যান। এরপর একবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান। দুপুর একটার আগ পর্যন্ত তাকে জাগানো যায় না। মাঝে মাঝে আমার সালোয়ার-কামিজ পরে বাজার করতে যান। মোবাইলে লক দিয়ে রাখেন যেন আমি দেখতে না পাই। গভীর রাতে আমি পাশের ঘর থেকে তার কথার আওয়াজ পাই, হাসি শুনতে পাই। কাউকে বলতে পারি না…
জেরিন কেমন যেন একটা অদ্ভুত শব্দ করে কথা থামিয়ে দেয়। বুঝতে পারি কান্না সামলে নিচ্ছে।
আমার আর বলা হয় না, এশিয়া মহাদেশের বিধবাদের নিয়ে খুব বড় একটা প্রজেক্টে কাজ করছি আমি। প্রাচীন আমলের সেই সতীদাহ প্রথা শেষ হয়ে গেলেও এখনও প্রচুর নারী স্বামী মারা যাওয়ার পর একাকী জীবন যাপন করেন। তাদের মানসিক বিকাশ ও জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার বিষয়ে সাহায্য করা নিয়েই আমার কাজ।
জেরিনের বাবার জায়গায় মা মারা গেলে কি আদৌ ওর বাবা বাকি জীবন একাকী থাকতেন? উত্তর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা হলে জেরিনের মা যদি নিজের চেয়েও অল্পবয়সি কাউকে খুঁজে পায় তাতে দোষ কোথায়? আমি হিসাব মেলাতে চেষ্টা করতে থাকি আর জেরিনকে কিছু বলার চেষ্টা করব নাকি ভাবতে থাকি। কেমন একটা অদৃশ্য আর নির্বিকার দার্শনিকতা চেপে বসে আমার দুই কাঁধের ওপরআর ক্ষণে ক্ষণে জেরিন রাতের অন্ধকারে নিজেকে আরও আড়াল করতে চায়। আমি একটু এগিয়ে যাই ওর দিকে। আর হঠাৎ করেই জেরিন আবছা আঁধারে গায়ের ওড়নার মাঝে নিজে আপাদমস্তক আরও পাচাতে শুরু করে।
আমি মনে মনে ওকে ডাকি, জেরিন জেরিন।
কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে, নিজেকে প্রায় মমির মতো পেঁচিয়ে জেরিন অল্প অল্প করে পেছাতে থাকে আমার সামনে থেকে। হঠাৎ করেই আমার মনে হয়, ও কি এখন আত্মহত্যা করতে চাইছে আমার সামনে? আটত্রিশ বছরের একাকী জীবন, পারিবারিক দায়িত্ব, অর্থ সংকট, মায়ের সাথে দূরত্ব ওকে দিন দিন কোকুনের মতো এতই গুটিয়ে ফেলছে যে জন্মদাত্রীর জীবনে আগত প্রেম ওর জন্য বেদনার পাশাপাশি ঈর্ষারও। তাই কি সে আত্মঘাতী হতে চাইছে? আমি বুঝতে পারি না, কোনো সমীকরণে ফেলতেও পারি না, শুধু অস্ফুট স্বরে কোনো রকমে বলি এই জেরিন।
জেরিন কোনো উত্তর দেয় না। শুধু অন্ধকারে দূরে যেতে থাকে আমার থেকে। আমার মাথার ভেতরে হতে থাকে কোলাহল। এই বিজন ছাদে ওকে নিয়ে এখন কী করব আমি? হাহাকার গোপন করে নিজেকে মুক্ত করতে চাওয়া মেয়েটিকে আমি কী বলব?
অল্প একটু এগিয়ে যাই ওর দিকে। এখন আর অন্ধকারে ওর চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ও কোনো কথাও বলছে না। শুধু বুঝতে পারছি পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা ওড়নায় প্যাঁচানো ওর স্থূল শরীরটা অল্প অল্প করে দুলছে। কেমন যেন ভয় লাগে আমার, জেরিনের মুখ কই? ও কথা বলছে না কেন? এমন কিছু আসলেই হচ্ছে? নাকি এসবই আমার কোনো কালেক্টিভ নস্টালজিয়া কিংবা ট্রমার অংশ? মনে মনে কয়েক কোটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি নিশ্চল।
এদিকে জেরিনের শরীর আরও জোরে দুলতে থাকে ঝড়ে পড়া গাছের মতো। যেন ও কোনো মস্তকহীন মমি। এক পলকের জন্য আমার চোখের মধ্যে ভেসে উঠে জেরিন একটা আর্তচিৎকার দিয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরের দিন অনলাইন পোর্টাল আর ফেসবুকের চলমান পেজগুলো উপচে পড়ছে ওর মৃতদেহের অজস্র ছবি দিয়ে। কেউ কেউ ওর সাথে ইনবক্সে চ্যাট করার স্ক্রিনশট দিয়ে লম্বা স্ট্যাটাস লিখে কামিয়ে নিচ্ছে কিছু তুচ্ছ লাইক, কমেন্ট। কেউ ওর সাথে পুরোনো ছবি-ভিডিও দিয়ে নিজের টাইমলাইনের ট্রাফিক বাড়াচ্ছে। আমি দেখতে পাই, ওর মা কাঁদছে সেই তরুণ প্রেমিকের বুকে। আমি দেখতে পাই, জেরিনের মৃত্যুর পরের কিছু দিন সারা শহরে বৃষ্টি, শান্তিনগর থেকে ধানমন্ডিতে শুধুই জলাবদ্ধতা। পানিতে আটকে পড়ে ছটফট করছে শহরের সমস্ত ভাসমান আবর্জনা। এসবের মধ্যে কোথাও জেরিন নেই, কিন্তু আবার যেন জেরিনই আছে সর্বত্র।
আমার মাথার সব চিন্তা পড়ে ফেলার মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে জেরিনের মস্তকহীন শরীরটা হঠাৎ থামিয়ে দেয় দুলুনি। আমি শিরদাঁড়া টানটান করে ফেলি। হ্যাঁ সম্ভবত এখনই ও ঝাঁপ দেবে ছাদ থেকে। এখনই। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে আমার। ভেতরে ভেতরে হাঁপাতে থাকি অনবরত। একইসাথে অবশ লাগতে থাকে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। যেন ক্রমশই আমরা থেকে আমরা সবাই আমি কিংবা তুমি হয়ে যাচ্ছি। বিচ্ছিন্ন কিন্তু অপূর্ণ। তবে আমাকে বিস্মিত করে জেরিন ছাদ থেকে লাফ দেয় না। আচমকা ওর দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটা লতানো গাছের ভারসাম্য হারানোর মতো লুটিয়ে পড়ে ছাদের মেঝেতে। আবছা অন্ধকারে দেখতে পাই নিজের শারীরিক কাঠামো বদলে এক অতিকায় মথের মতো কিছু একটায় পরিণত হয়েছে ও। হালকা শোঁ শোঁ শব্দ আসতে থাকে ওর কাছ থেকে। আর বিচিত্র ভঙ্গিতে মাটিতে নিজের শরীর টেনে টেনে আমার দিকে আগাতে থাকে জেরিন।
আমি পেছাতে থাকি। ডুবন্ত প্রাণীর বাঁচতে চাওয়ার মতো করে তাকাই চারপাশে। উভ্রান্তের মতো পালিয়ে যেতে চাই, আর্তনাদ করতে চাই, কিন্তু এক পা নড়তে পারি না নিজের অবস্থান থেকে। জেরিন ওর অতিকায় ও পিচ্ছিল শরীরটা টানতে টানতে বেশ দ্রুত আগাতে থাকে আমার দিকে।