মতিলালের মুশকিল – সুভদ্রকুমার সেন
রাত আন্দাজ ন’টা হবে।
পূর্ব কলকাতার প্যারাডাইস হোটেলের এক কেবিনে বসে বিরিয়ানি আর রেজালার অর্ডার দিয়ে রতনলাল তার সঙ্গী অতুল, নুটু আর ওসমানের সঙ্গে দলের নতুন রিক্রুট বহুরূপী মতিলালের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর খাওয়া-দাওয়ার পরে শেষবারের মতো কাকে কী করতে হবে নির্দেশ দিয়ে বললে, “আমি আর মতিলাল একসঙ্গে যাব। তোমরা আমাদের যাবার অন্তত দশ মিনিট আগে যাবে। তারপর যেমন যেমন বলে দিলুম প্রত্যেকে সেই মতো কাজ করবে। কি, ঠিক ঠিক মনে আছে তো সব?”
অতুল, নুটু আর ওসমান একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ।” তারপরই ওসমান খুকখুক করে হেসে উঠল।
“ওসমান, হাসছ কেন?” রতনলাল গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে।
“ইনি তোমার সঙ্গে ইয়ে সেজে যাবেন ভাবলেই আমার হাসি পাচ্ছে।”
রতনলাল চাপা অথচ দৃঢ় গলায় বললে, “এটা হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়।” তারপর একটু থেমে বললে, “আচ্ছা, তোমরা এখন এসো। ভাল কথা, এখান থেকে বেরিয়ে আলাদা আলাদা যাবে।”
অতুল বললে, “অপারেশনের পর কাল রাত্রে আমরা হাওড়া স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে মিট করছি তো?”
রতনলাল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
আমহার্স্ট স্ট্রিটের ওপর দত্ত কোম্পানির বিরাট গয়নার দোকান। এখন বিয়ের মরসুম চলছে। দোকানে খদ্দেরের যাতায়াতের বিরাম নেই। তবে ভিড়টা সকাল আর সন্ধের দিকেই হয় বেশি। দুপুর বেলা— দেড়টা থেকে আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত— ভিড় থাকে না। সেই সময়ে দোকানের ভার বিশ্বাসী কর্মচারী পরেশবাবু, তাঁর ভাইপো পরমেশ আর নেপালি দরোয়ান বাগ সিংয়ের উপর দিয়ে মালিকেরা বাড়ি যান স্নান-খাওয়া করতে। অন্যান্য কর্মচারীরা সেই সময়টা দোকানের পিছনের ঘরে হয় টিফিন খায় নয় গল্পগুজব করে। মালিকেরা বাড়ি থেকে ফিরে এলে পরেশবাবু আর পরমেশের টিফিনের ছুটি হয়।
বেলা তখন পৌনে দুটো হবে। দত্ত কোম্পানির দোকানের সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সি থেকে নামল সুবেশ তিনটি যুবক। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে তারা দোকানের দরজার সামনে আসতেই বাগ সিং বন্ধ কোলাপসিবল গেটটা একটু ফাঁক করলে। কোলাপসিবল গেটটা মোটা লোহার শেকল দিয়ে আটকানো। ঠেললে, যেটুকু ফাঁক হয় তাতে একজন লোক কোনওরকমে ঢুকতে বা বেরুতে পারে।
“বাব্বা, ডাকাতি ঠেকাবার জন্য এমন কায়দা করেছ যে, ভেতরে ঢুকতেই প্রাণান্ত।” একজন যুবক দরোয়ানের সঙ্গে রসিকতা করবার চেষ্টা করলে। কোনও উত্তর না দিয়ে বাগ সিং ভাবলেশহীন মুখে একবার তার দিকে চাইলে।
কাউন্টার থেকে পরেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের কী চাই?”
সেই যুবকটি তার আর-এক সঙ্গীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, “এর জন্যে—না সরি— এর ভাবী স্ত্রীর জন্যে একটা হার চাই।”
“কী রকম দামের মধ্যে?”
যুবকটি তার অপর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললে, “অ, অতুলদা, কত দামের মধ্যে?”
অতুলদা বললেন, “এই ছ’-সাতশো টাকার। মধ্যে, তবে জিনিসটা যেন ভাল হয়।”
পরেশবাবু পরমেশকে বললেন, “হারের বাক্সগুলো নিয়ে এসো।” তিনি আরশির মধ্যে দিয়ে যুবক তিনটিকে দেখে সন্তুষ্ট হলেন। বুঝলেন যে, অতুলদা নামক ব্যক্তিটি এদের বন্ধু এবং গার্জেন। যে যুবকটির বিয়ে হবে সে খুব নিরীহ, গোবেচারি প্রকৃতির। আর তৃতীয় যুবকটি যেমনি বাচাল আর তেমনি ছটফটে।
পরমেশ হারের বাক্স আনলে পরেশবাবু তাদের হার দেখাতে লাগলেন। বাচাল ও চঞ্চল যুবকটি তার নিরীহ ও শান্ত বন্ধুটিকে নানা অবাস্তব ও অসম্ভব কথা বলে বিব্রত করতে লাগল। আর অতুলদা খুব মনোযোগের সঙ্গে হারগুলো দেখতে দেখতে কোনটা বেশি টেকসই হবে আর কোনটাই বা বেশি ফ্যাশানেবল হবে সে- বিষয়ে পরেশবাবুর মতামত শুনতে লাগল।
ঠিক সেই সময়ে দোকানের সামনে একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল, বোধহয় সুবিধেমতো পার্কিং করতে। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার বেশবাস, হাঁটাচলার কায়দা দেখলেই বোঝা যায় যে, বেশ অভিজাত ধনীসম্প্রদায়ের লোক। তাদের দোকানের দিকে আসতে দেখেই বাগ সিং ঘটাং করে লোহার শেকলের তালা খুলে কোলাপসিবল গেটটা ফাঁক করলে যাতে ওঁদের ঢুকতে কোনও অসুবিধে না হয়।
ওঁদের ঢুকতে দেখেই পরেশবাবু অতুলকে লক্ষ করে বললেন, “তা হলে এগুলোর মধ্যে থেকে একটা আপনারা পছন্দ করুন। আমি এখুনি আসছি।” তারপর তিনি পরমেশকে ডেকে বললেন, “তুমি। একটু এঁদের দেখো।”
পরেশবাবু বিনয়ে গলে গিয়ে হাত জোড় করে সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, “বলুন স্যার, কী দেখাব।”
সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, “ভাল জড়োয়ার সেট দেখান। দামের জন্য আটকাবে না।”
“নিশ্চয়ই স্যার। আমাদের খুব ভাল ভাল জড়োয়ার সেট আছে। আপনাদের মতো রেসপেকটেবল কাস্টমারদের জন্যেই স্যার ওই সব সেট করা—” বলতে বলতে পরেশবাবু কোমর থেকে একটা চাবির রিং বের করে দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা আয়রন সেফের পাল্লা খুলে জড়োয়ার বাক্স বের করতে লাগলেন। আর ঠিক সেই মুহুর্তে সবচেয়ে নিরীহ- দর্শন যুবকটি পরেশবাবু আর পরমেশের অলক্ষ্যে তার দুই সঙ্গীকে চোখ টিপে ইশারা করলে। পরেশবাবু তখন বড়লোক খদ্দেরকে জড়োয়ার দামি দামি সেট দেখাতে ব্যস্ত।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক সঙ্গের ভদ্রমহিলাকে বললেন, “নাও, দেখেশুনে একটা ভাল জিনিস পছন্দ করো।”
ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে জড়োয়ার সেটগুলো নেড়েচেড়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। পরেশবাবু আড়চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, পরমেশ হারের বাক্সগুলো তুলে রাখছে। তিনি অতুলকে লক্ষ করে বললেন, “কী, পছন্দ হল?”
একটা বাক্স তুলে ধরে অতুল বললে, “হ্যাঁ, এইটে নিচ্ছি। তাড়াতাড়ি ক্যাশমেমো করুন।”
পরেশবাবু দেখলেন অতুল পকেট থেকে ‘পার্স’ বের করছে। বাচাল ছেলেটির দিকে নজর পড়তেই দেখলেন যে, আরশির সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। আর নিরীহ ভাবী বরটি বাইরে যাবার দরজার দিকে যাচ্ছে।
পরমেশের কাছ থেকে হারটা চেয়ে পরেশবাবু মাথা হেঁট করে ক্যাশমেমো লিখছেন এমন সময়ে তাঁর রগে কী একটা কঠিন ঠান্ডা জিনিসের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই ভয়ে তিনি ঠান্ডা হিম হয়ে গেলেন। তাঁর রগে একটা পিস্তল ঠেকানো। পিস্তলের নলটা পরেশবাবুর রগে আরও একটু চেপে ধরে কঠিন গলায় প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বললেন, “এটা খেলনার পিস্তল নয়। টুঁ শব্দ করলেই মাথার খুলি উড়ে যাবে।” পরমেশ কাকার সাহায্যে এগিয়ে আসবার চেষ্টা করতেই অতুল তাকে এক ঘুষি মারলে। সে কোঁক করে একটা শব্দ করেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। পরেশবাবু বাগ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই গোবেচারি যুবকটি মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বাগ সিংকে বাগিয়ে রেখেছে। তিনি অসহায়ভাবে দেখলেন যে, ভদ্রমহিলার হাতে এতক্ষণ যে বস্তুটাকে ‘ভ্যানিটি ব্যাগ’ বলে মনে হয়েছিল সেটা আসলে একটা ‘ফোল্ডিং ব্রিফকেস’। আর সেই ভদ্রমহিলা অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় তাঁর হাতের কাছে যত গয়না ছিল সবই ব্রিফকেসে পুরে ফেলছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভয়ে, লজ্জায় পরেশবাবু কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখের সামনে তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আর মালিকদের মুখগুলো পরপর ভেসে উঠল।
ঠিক সাড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেশ কয়েক লক্ষ টাকার গয়না ব্যাগে পুরে সেই অভিজাত ভদ্রমহিলা গটগট করে দত্ত কোম্পানির দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কথা আছে রতনলালেরা কয়েক মিনিট পরে বেরুবে যাতে করে মতিলাল গয়নাগুলো নিয়ে ঠিকমতো পালাতে পারে। দোকান থেকে বেরিয়েই মতিলাল কিন্তু খুব মুশকিলে পড়ল। রতনলাল বলেছিল যে, তাদের গাড়িটা দোকানের কাছাকাছিই থাকবে। দোকানের কাছাকাছি বেশ কয়েকটা কালো আর অন্যান্য রঙের অ্যামবাসাডার দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এগুলোর মধ্যে তাদের কালো গাড়িটা কই? কোন গাড়িটা তাদের? এই প্রথম মতিলাল বেশ ঘাবড়ে গেল। এদিকে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। যে-কোনও মুহুর্তে রতনলালরা দোকান থেকে বেরিয়ে আসবে। আর তখনই একটা হইচই আর গোলমাল শুরু হয়ে যাবে। আর সেই গোলমাল শুরু হবার আগেই মালপত্র নিয়ে মতিলালকে পালাতে হবে।
এতক্ষণ যা হয়নি মতিলালের এবার তাই হল। তার ভয় করতে লাগল। হাত-পা ঘামে ভিজে গেল। মরিয়া হয়ে সে সামনেই যে কালো রঙের অ্যামবাসাডারটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটার দরজার হাতল ধরে টান দিল। লক-করা দরজা খুলল না। পিছনের গাড়ির ড্রাইভার মজা পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে, “কী মাইজি, গাড়ি চিনতে পারছেন না?” উত্তেজনায় আশঙ্কায় নিজের পার্ট সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মতিলাল তার স্বাভাবিক পুরুষকণ্ঠে বললে, “হ্যাঁ।” মহিলার এমন মোটা পুরুষালি গলা শুনে সেই ড্রাইভার ভীষণ চমকে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে পরপর কতকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। রতনলালরা দোকান থেকে বেরিয়ে আসতেই পরেশবাবু আর বাগ সিং একযোগে “ডাকাত ডাকাত, ডাকু ভাগতা হ্যায়” বলে ভীষণ হল্লা জুড়ে দিলে। আর সেই চিৎকার শুনে আশেপাশের দোকান থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছে দেখে মতিলাল ছুটে পালাতে চেষ্টা করতেই সেই ড্রাইভারটা তাকে ছোট্ট একটা ল্যাং মেরে ছিটকে ফেলে দিল।
পরদিন সব দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে ড্রাইভার রামলগন সিংয়ের ছবি আর ‘ইন্টারভিউ’ ছাপা হল। সকলেই তার বুদ্ধি আর সাহসের খুব প্রশংসা করলে। দত্ত কোম্পানির মালিকপক্ষ তাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন। রতনলাল আর তার সঙ্গীদের ধরা পড়ার আসল কারণটা কিন্তু জানা গেল অনেক পরে। তারা এসেছিল একটা খয়েরি রঙের অ্যামবাসাডারে চেপে। মতিলাল আসলে কালার-ব্লাইন্ড, যাকে বলে রংকানা। খয়েরি রংকে সে কালো দেখে; তাই অন্য কালো রঙের গাড়ির সঙ্গে নিজেদের খয়েরি রঙের গাড়িটাকে গুলিয়ে ফেলেই সে সব বিভ্রাট ঘটায়।
২৬ জানুয়ারি ১৯৮৩
অলংকরণ: অনুপ রায়