মতিয়া বিবি

মতিয়া বিবি 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

এক দিবস অতি প্রত্যূষে আমি আমার থানার অফিসে বসিয়া নিয়মিত দৈনিক কাৰ্য্য সমাপন করিতেছি, এইরূপ সময় এক ব্যক্তি থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও আমাকে সম্মুখে দেখিতে পাইয়াই কহিলেন “মহাশয়, আমার একটি প্রজার ঘরে সিঁদ হইয়াছে। এই সংবাদ প্রদান করিবার মানসে আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।” 

আমি। সিঁদ হইয়াছে? কাহার ঘরে সিঁদ হইয়াছে? 

আগন্তুক। আমার বাড়ীর সন্নিকটে আমার একখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে। ওই বাড়ীতে তারামণি নাম্নী একটি স্ত্রীলোক বাস করে। ওই তারামণির ঘরেই সিঁদ হইয়াছে। 

আমি। এই সংবাদ প্রদান করিতে তারামণি আসে নাই কেন? 

আগন্তুক। যে ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তারামণি সেই ঘরে শয়ন করিত। তাহার ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ আছে; কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করিয়া তারামণির কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, আমিই আপনাকে সংবাদ দিতে আসিয়াছি। 

আমি। সিঁদটি আপনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন কি? ওই ঘরের কোন্ স্থানে ও কি প্রকার সিঁদ? সে ঘরে তারমণি শয়ন করেন, সেই ঘরের পশ্চাৎ দিকের দেওয়ালের মাটি কাটিয়া এক প্রকাণ্ড সিদ দিয়াছে। ওই সিঁদ আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি। 

সংবাদদাতার এই কথা শুনিয়া সেই সময় আমার মনে যে কিরূপ চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা পাঠকগণ কিছুমাত্র অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছেন কি? আমার মনে হইল, চোরে সিঁদ দিয়া কেবলমাত্র তারামণির মূল্যবান দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া যায় নাই, সেই সঙ্গে তারামণিকেও শমন-সদনে প্রেরণ করিয়া গিয়াছে। নতুবা যে ঘরে তারামণি শয়ন করিয়াছিল, যে ঘরের দরজা তারামণি ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল, সেই ঘরেই সিঁদ হইয়াছে, অথচ এখন পর্যন্ত তারামণির কোনরূপ সন্ধান নাই কেন? কিন্তু ঘরের দরজা তারামণি যেরূপ ভাবে ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া শয়ন করিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ ভাবেই ভিতর হইতে বদ্ধ আছে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেই দেখিতে পাইব, হয় তারামণি তাহার বিছানার উপর, না হয় ঘরের মেজের উপর মৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আর কালবিলম্ব করিলাম না। সেই সংবাদদাতার সঙ্গে তৎক্ষণাৎ থানা হইতে বহির্গত হইলাম। তারামণি যে বাড়ীতে বাস করিত, সেই বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, উহা একখানি খোলার ঘর, কিন্তু উহার পোঁতা বেশ উঁচু। ওই একখানি ঘর লইয়াই একখানি বাড়ী। ওই ঘরের সম্মুখে একটি বারান্দা আছে মাত্র। রন্ধনাদি ওই বারান্দার এক পার্শ্বেই হইয়া থাকে। ওই ঘরখানি প্রাচীর অথব অপর কোনরূপ আবরণের দ্বারা বেষ্টিত নহে, উহার চতুষ্পার্শ্বই খোলা। চতুষ্পার্শ্ব হইতেই ওই ঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হওয়া যায়। ওই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার কেবল একটিমাত্র দরজা, উহা এখন পর্যন্ত ভিতর হইতে বন্ধ আছে। ওই দরজায় একটু সামান্য ধাক্কা দিয়া দেখিলাম, কিন্তু উহা সহজে খুলিল না। ওই ঘরখানির চতুদিক উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, উহার পশ্চাদ্ভাগের পোঁতার গায়ে, বেড়ার নীচে একটি প্রকাণ্ড সিঁদ কাটা রহিয়াছে। সদাসর্বদা যেরূপ পরিমাণের সিঁদ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অপেক্ষা এই সিদেঁর পরিমাণ একটু বড়। উহার মধ্য দিয়া ছোট বড় সকল প্রকার মনুষ্যই ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ ও ঘর হইতে বহির্গত হইতে পারে। খুব বড় বড় সিন্দুক, বাক্স, পেঁটরা প্রভৃতি অনায়াসেই উহা দিয়া বাহির করিয়া লওয়া যায়। 

সিঁদের নিকট গমন করিয়া তাহার মধ্য দিয়া ঘরের ভিতরের অবস্থা যদি কিছু দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার চেষ্টা করিলাম; কিন্তু ঘরের মধ্যে অন্ধকার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া ওই ঘরের দরজা ভাঙ্গিয়া ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতে হইল। জানিতে পারিলাম, ওই পাড়ার মধ্যে একজন ছুতারের বাস; নিজে ওই ঘরের দরজা ভাঙ্গিবার চেষ্টা না করিয়া সেই ছুতারকে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। সে আসিয়া প্রথমে ওই দরজার অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া, তাহার বাড়ী হইতে একখানি ছোট ও পাতলা হাত-করাত আনিয়া ওই দরজা দুই পাটির মধ্য দিয়া কোনরূপে প্রবেশ করাইয়া দিল ও ভিতরে যে কাষ্ঠ-খিলের দ্বারা ওই দরজা আবদ্ধ ছিল, তাহা আস্তে আস্তে কাটিয়া ফেলিল। দরজা খুলিয়া গেল। নিতান্ত সোৎসুক অন্তঃকরণে আমি ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিবার সময় মনে করিয়াছিলাম যে, প্রবেশ করিবামাত্র তারামণির মৃতদেহ ওই ঘরের ভিতর দেখিতে পাইব, কিন্তু ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহা দেখিতে পাইলাম না। ঘরের ভিতর একপার্শ্বে একখানি তক্তাপোষ, তাহার উপর শয়ন করিবার একটি বিছানা বিছান রহিয়াছে। বিছানার অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয়, উহার উপর কেহ শয়ন করিয়াছিল, কিন্তু এখন তাহার উপর কেহই নাই। ওই তক্তাপোষের নীচে অনুসন্ধান করিয়াও কাহাকে দেখিতে পাইলাম না। ওই তক্তাপোষের সন্নিকটে একটি লোহার সিন্দুক আছে দেখিলাম। সিন্দুকটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে; দেখিয়া অনুমান হয়, উহার ওজন বোধ হয় পাঁচ মণের কম হইবে না। সিন্দুকটি নাড়িয়া দেখিলাম, দেখিলাম উহা বদ্ধ আছে। ওই ঘরের অপর পার্শ্বে কয়েকটি বাক্স, কতকগুলি পিত্তল কাঁসার তৈজস ও কয়েকটি হাঁড়ি প্রভৃতি আছে। বাক্স কয়েকটি বদ্ধ অবস্থায় পাইলাম। পিত্তল কাঁসার তৈজস ইত্যাদি দেখিয়া উহার একটিও স্থানান্তরিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল না। ঘরের সমস্ত দ্রব্য পূর্ব্ব হইতে যেরূপ ভাবে রক্ষিত ছিল, ঠিক যেন সেইরূপ ভাবেই রক্ষিত আছে বলিয়া অনুমান হইল। কিন্তু জীবিত অবস্থায় বা মৃত অবস্থায় তারামণিকে ওই ঘরের মধ্যে কোন স্থানেই পাইলাম না। 

চোরে তারামণির ঘরে সিঁদ কাটিয়াছে। ওই সিঁদের মধ্য দিয়া কোন মনুষ্য যে গমনাগমন করিয়াছে, তাহার প্রমাণ সেই স্থানের মৃত্তিকোপরিস্থিত মনুষ্যের পদচিহ্ন প্রদান করিতেছে। অথচ ঘরের ভিতরের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইতেছে না যে, ওই ঘর হইতে কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত বা অপহৃত হইয়াছে। আমার যে অনুমান হইতেছে, তাহা প্রকৃত কি না, তারামণি ব্যতীত আর কেহই এ কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ নহে; কিন্তু তারামণি উপস্থিত নাই। সেই স্থানের সমবেত প্রতিবেশীবর্গের মধ্যে কেহই বলিতে পারে না যে, তারামণি কোথায়। কিন্তু এ কথা সকলেই বলে যে, তারামণির কিছু অর্থ ও অলঙ্কার আছে; অলঙ্কার পত্র বন্ধক রাখিয়া, টাকাকড়ি ধার দিয়া সে বেশ দশ টাকা উপার্জ্জনও করিয়া থাকে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

ঘরে সিঁদ, ঘরের দরজা ভিতর হইতে বদ্ধ, অথচ ঘরের ভিতর তারামণি নেই। এইরূপ অবস্থায় তারামণি কোথায় গেল? চোরের ভয়ে তারামণি যদি ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে ওই চোর ঘরের ভিতর হইতে ওই দরজা কেন বন্ধ করিয়া দিবে? তবে কি তারামণি ওই সিঁদের মধ্য দিয়াই প্রস্থান করিয়াছে? তাহাই বা অনুমান করি কি প্রকারে? এরূপ কথা ত এ পৰ্য্যন্ত কখনও শুনি নাই। আর যদি তারামণি কোনরূপে তাহার ঘরের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া পলায়ন করিয়াই থাকে, তাহা হইলেই বা এতক্ষণ পর্যন্ত সে পলায়িত রহিবে কেন? পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম, তারামণিকে হত্যা করিয়া চোরে তাহার যথা-সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। আমার সে অনুমান যদি প্রকৃত হইত, তাহা হইলে তারামণির মৃতদেহ নিশ্চয়ই এই ঘরের কোন না কোন স্থানে প্রাপ্ত হইতাম। মনে মনে এইরূপ অনেক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না! 

প্রাণের ভয়ে কোন স্থানে তারামণি যদি লুক্কায়িত থাকে, ইহা ভাবিয়া সেই গ্রামের মধ্যে ও তাহার নিকটবর্তী গ্রাম সকলের মধ্যে তাহার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই তারামণির কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। এরূপ অবস্থায় তখন যে আর কি কর্ত্তব্য, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কারণ, তারামণির ঘরের দ্রব্যাদির অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইল যে, ওই ঘরের কোন দ্রব্য কোনরূপে স্থানান্তরিত হয় নাই, যেস্থানে যে দ্রব্য যেরূপ ভাবে রক্ষিত ছিল, সেই সকল দ্রব্য সেই স্থানেই সেইরূপ ভাবে রহিয়াছে। লোহার সিন্দুক ও অপরাপর সিন্দুক বাক্স সকল যেরূপ ভাবে যে স্থানে ছিল, সেই সকল দ্রব্য সেই স্থানেই বন্ধ অবস্থায় রহিয়াছে। ঘরের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া কোন স্থানে ওই সকল সিন্দুক ও বাক্সের চাবিও পাইলাম না। অনুসন্ধানে তারামণিকে না পাইয়া ও ওইরূপ নানা কারণে ইহাই আমাদিগকে স্থির করিয়া লইতে হইল যে, তারামণি কোন না কোন স্থানে লুক্কায়িত আছে, দুই চারিদিবস পরে তাহাকে পাওয়া যাইবে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তারামণির ঘরে সিঁদ হইয়াছে, কেবল তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। কোন দ্রব্য অপহৃত না হইয়া কেবলমাত্র সিঁদ হইলে আমরা যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া থাকি, ইহাও সেইরূপ অনুসন্ধানে পরিণত হইল। ক্রমে ২।৩ দিবস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু কাহার দ্বারা তারামণির ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলাম না। প্রথম দিবসেই তারামণির ঘরে সিঁদ বন্ধ করিয়া দিতে বলিয়া আসিয়াছিলাম; কিন্তু তারামণি না থাকায় সেই সিঁদ কেহই বন্ধ করে নাই, এখন পৰ্য্যন্ত উহা সেইরূপ ভাবেই আছে। 

প্রথম দিবস যে ব্যক্তি থানায় আসিয়া সিঁদের সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, চতুর্থ দিবসে তিনি পুনরায় থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কথায় কথায় তাঁহার নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, এ পর্যন্ত তারামণি আসিয়া উপস্থিত হয় নাই; সে যে কোথায় গেল, বা তাহার ভাগ্যে যে কি ঘটিল, তাহার কিছুই এ পর্যন্ত কেহই অবগত হইতে পারেন নাই। আজ তিনি তারামণির ঘরের মধ্যে পুনরায় গমন করিয়াছিলেন, ঘরের মধ্যে যেন অতি অল্প পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, কিন্তু কোথা হইতে যে সেই দুর্গন্ধ আসিতেছে, তাহার কিছুই তিনি অনুমান করিতে সমর্থ হন নাই। তাঁহার বিবেচনায় ঘরের মধ্যে বা নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে হয়ত মৃত মূষিক পড়িয়া আছে, ও তাহা হইতেই ওই অল্প পরিমিত দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। তাঁহার নিকট হইতে কথায় কথায় এই কয়েকটি কথা জানিতে পারিলাম সত্য, কিন্তু তিনি সেই দিবস কি নিমিত্ত যে আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিলে তিনি কহিলেন না। অন্যান্য বাজে কথার আন্দোলন করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইয়া গেলে, আমি তাঁহাকে সেই দিবস আমার নিকট আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম ও তাহার উত্তরে জানিতে পারিলাম যে, তারামণি যে বাড়ীতে বাস করিত, তাহা তাঁহার নিজের; ওই বাড়ীর সহিত তারামণির কেবলমাত্র ভাড়া দিয়া বাস করা ব্যতিরেকে আর কোনরূপ সংশ্রব ছিল না। ভাড়াও সে নিয়মিতরূপ প্রদান করিত না, এখন পর্যন্ত প্রায় এক বৎসরের ভাড়া তাহার নিকট বাকী আছে। এরূপ অবস্থায় তারামণির যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা তিনি গ্রহণ করিতে সমর্থ কি না; কারণ, তারামণি এখন পর্য্যন্ত ফিরিয়া আইসে নাই। আসিবে কি না, তাহারও এখন পর্য্যন্ত স্থিরতা নাই। বিশেষ যদি কোন কারণে তাহার মৃত্যুই হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে আর কোথা হইতে ফিরিয়া আসিবে? আর যদি ফিরিয়াই আইসে, তাহা হইলে সে তাহার দ্রব্যাদি তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই গ্রহণ করিতে পারিবে। ওই ঘর হইতে তারামণির দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত না করিলে অপর কোন ব্যক্তিকে ওই ঘর ভাড়া দেওয়া যাইতে পারে না। 

বাড়ীওয়ালার কথা শুনিয়া তাঁহার অভিসন্ধি যে কি, তাহা অনুমান করিতে উত্তমরূপে সমর্থ হইলাম। এতদিন পর্যন্ত তারামণি যখন প্রত্যাগমন করে নাই, তখন তারামণির প্রত্যাগমনের সম্ভাবনা নিতান্তই অল্প। তারামণি প্রত্যাগমন না করিলে ওই সকল দ্রব্য আর কেহই তাঁহার নিকট হইতে চাহিবে না; সুতরাং, আর কাহাকেও উহা প্রত্যর্পণ করিতে হইবে না, তারামণির সমস্ত বিষয় তাঁহার নিজেরই হইয়া যাইবে। 

বাড়ীওয়ালার কথা শুনিয়া আমি তাহাকে কহিলাম “তারামণি এখন পর্যন্ত প্রতাগমন করে নাই, প্রত্যাগমন করিবে কি না, তাহারও এখন কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। যদি আর সে প্রত্যাগমন না করে, তাহার পরিত্যক্ত দ্রব্যাদির সহিত আপনার কোনরূপ সংশ্রব আছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না। কারণ, ওই সকল দ্রব্যের অধিকারী হইবেন—গবর্ণমেন্ট। গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে আমি ওই সকল দ্রব্য লইয়া আসিব, তাহা হইলেই আপনার ঘর খালি হইয়া যাইবে, তখন আপনি অনায়াসেই ওই ঘর অপরকে ভাড়া দিতে পারিবেন। তারামণি প্রত্যাগমন না করিলে বা তাঁহার কোন ওয়ারিস্ আসিয়া ওই সকল দ্রব্য গ্রহণ গ্রহণ না করিলে, যখন উহারা বিক্রয় করিয়া উহার মূল্য গবর্ণমেন্ট গ্রহণ করিবেন, সেই সময় আপনার ঘর ভাড়ার নিমিত্ত যাহা কিছু পাওনা আছে, তাহা আপনি প্রাপ্ত হইবেন। তদ্ব্যতীত তারামণি যদি অপর আর কাহারও নিকট কোনরূপ ঋণগ্রস্তা থাকেন, তাহা হইলেও তাহার ঋণ পরিশোধ করিয়া দেওয়া যাইবে। 

আমার কথা শুনিয়া বাড়ীওয়ালা আর কোন কথা কহিতে সাহসী হইলেন না। আমি তাঁহাকে বলিয়া দিলাম, যদি সময় পাই, তাহা হইলে অদ্যই নতুবা কল্য প্রাতঃকালে আমি ওই স্থানে গমন করিয়া তাহার সিন্দুক, বাক্স প্রভৃতি সমস্ত খুলিয়া দেখিব, তাহার কি কি দ্রব্যাদি আছে। আর ওই সকল দ্রব্যের একটি তালিকা আপনাদিগের সকলের. সম্মুখে প্রস্তুত করিয়া, সমস্ত দ্রব্য আমি থানায় উঠাইয়া আনিব। তাহা হইলেই আপনার ঘর খালি হইয়া যাইবে। 

আমার কথা শুনিয়া বাড়ীওয়ালা আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি করিতে সাহসী না হইয়া, আস্তে আস্তে থানা হইতে প্রস্থান করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

যে দিবস বাড়ীওয়ালা আমার থানায় আসিয়াছিলেন, সে দিবস তারামণির গৃহে গমন করিবার সময় কোনরূপেই করিয়া উঠিতে পারিলাম না। পরদিবস প্রত্যূষেই গিয়া সেই স্থানে স্থানীয় দুই তিনজন ভদ্রলোককে ডাকাইয়া তারামণির ঘরের দরজা খুলিয়া সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। বাড়ীওয়ালা থানায় গিয়া পূৰ্ব্বদিবস যাহা বলিয়া আসিয়াছিল, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই জানিতে পারিলাম যে, তাহার কথা প্রকৃত; ওই ঘরের মধ্য হইতে কেমন একটি অল্প অল্প দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। কোথা হইতে ওই দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ওই ঘরের মধ্যে পুনরায় উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। ঘরের মধ্যস্থিত সিন্দুক বাক্সগুলি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিবার কালীন, লোহার সিন্দুকের গাত্রে দুই চারিটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা দেখিতে পাইলাম। আরও বোধ হইল, ওই দুর্গন্ধ যেন সেই লোহার সিন্দুকের নিকটেই অধিক পরিমাণে বোধ হইতেছে। 

লোহার সিন্দুকের এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে এক ভয়ানক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, ক্রমে ভয়েরও সঞ্চার হইতে লাগিল। কেন যে ভয় হইল, তাহা আমিই ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, পাঠকগণকে বুঝাইব কি প্রকারে? 

এখন স্থির হইল, সর্ব্বাগ্রে ওই লোহার সিন্দুক খুলিয়া দেখা। অনুসন্ধান করিয়া লোহার সিন্দুকের চাবি পাওয়া যায় নাই; সুতরাং অন্য উপায়ে ওই লোহার সিন্দুক খুলিবার বা উহা ভাঙ্গিবার চেষ্টা দেখিতে হইল। জানিতে পারিলাম, অনতিদূরে জনৈক লোহার সিন্দুক নির্ম্মাতার একটি কারখানা আছে। সুতরাং তাহাকে ডাকাইতে হইল। তিনি আসিয়া প্রথমতঃ ওই সিন্দুক খুলিবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেন কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য হইতে না পারিয়া, পরিশেষে কয়েকটি লোহার খিল বা ‘নেচি’ কাটিয়া ওই সিন্দুকের ডালা খুলিয়া দিল। 

তালাটি স্থানান্তরিত করিয়া দেখিলাম—সর্ব্বনাশ! ইতিপূর্ব্বে মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, দেখিলাম ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। ওই সিন্দুকের মধ্যে তারামণির মৃতদেহ রহিয়াছে। ওই মৃতদেহ ভয়ানক পচিয়া গিয়াছে, ও তাহা হইতে অতিশয় দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলি পিপীলিকা কেবল উহার স্থানে স্থানে কাটিয়া খাইয়া ফেলিয়াছে। নিতান্ত সঙ্কীর্ণ স্থানের মধ্যে ওই মৃতদেহ রক্ষিত আছে; কিন্তু উহার হস্ত পদ প্রভৃতির কোন স্থান কোনরূপে বন্ধন করিয়া রাখা হয় নাই। মৃতদেহ অতিশয় পচিয়া গিয়াছে এবং উহার মুখ দেখিয়াও বেশ চিনিতে পারা যাইতেছে না যে, উহা তারামণির মৃতদেহ কি না। 

যেরূপ অবস্থায় তারামণিকে পাওয়া গেল, তাহা দেখিয়া এখন সহজেই অনুমিত হইল যে, কোন দস্যু তারামণির ঘরের দেওয়ালে সিঁদ দিয়া ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তারামণিকে হত্যা করিয়া তাহার যথা-সর্ব্বস্ব অপহরণ পূর্ব্বক তারামণির মৃতদেহটিকে ওই লোহার সিন্দুকের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া এবং ওই সিন্দুকের চাবি লইয়া পুনরায় সেই সিঁদের মধ্য দিয়া বহির্গত হইয়া গিয়াছে। 

এখন যাহা অনুমিত হইল তাহা সত্য; কিন্তু এখন কৰ্ত্তব্য কি? 

পাঠকগণ বলিয়া বসিবেন, এখনকার কর্তব্য কি, তাহা একটি পঞ্চমবর্ষীয় বালকও অনায়াসে বুঝিতে পারে। এখন পুলিসের কর্তব্য, যে দস্যুর দ্বারা এই ভয়ানক কার্য্য্য সাধিত হইয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধৃত করা ও যাহাতে দোষীর উপযুক্ত দণ্ড হয়, তাহার উপায় করা। 

কথাটি যেরূপ সহজ, কার্য্যটি ততদূর সহজ নহে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আপনার শরীর আবৃত করিয়া যে দস্যু তারামণির গৃহে সিঁদ দিল, ও অপরের অলক্ষিতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই ঘরের একমাত্র অধিকারিণীকে হত্যা করিয়া নির্বিবাদে বাহির হইয়া চলিয়া গেল, এখন বলুন দেখি, তাহার অনুসন্ধান কিরূপে হইতে পারে? যাহাকে কেহ দেখিল না, যাহার কথা কেহ শুনিল না, অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা ও হত্যাপরাধে তাহাকে দণ্ডিত করা, কিরূপ দুরূহ কার্য্য; তাহা অনুমান করিয়াই স্থির করা যায় না। কার্য্যে পরিণত করা একেবারে অসম্ভব হইলেও, সেই অসম্ভবকে আমাদিগকে সম্ভবপর করিয়া লইতে হইবে। ইহা অপেক্ষা অসম্ভব বিষয় আর কি হইতে পারে? 

সম্ভব হউক আর অসম্ভব হউক, মনের ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিবার আশা থাকুক আর নাই থাকুক, এই অসম্ভব কার্য্য সম্ভবে পরিণত করিবার চেষ্টা আমাদিগকে দেখিতেই হইবে। যে কার্য্যের নিমিত্ত বেতন গ্রহণ করিয়া থাকি, পারি আর না পারি, সেই কার্য্য যাহাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, তাহার চেষ্টা আমাদিগকে করিতেই হইবে। সুতরাং এই মোকদ্দমার কিনারা হইবার কোনরূপ আশা না থাকিলেও, ওই অনুসন্ধানে বাধ্য হইয়া আমাদিগকে নিযুক্ত হইতে হইল। 

মৃতদেহ সেই লোহার সিন্দুক হইতে বাহির করিলাম। পচিয়া নিতান্ত বিকৃতভাব ধারণ করিলেও, পরীক্ষার নিমিত্ত উহা ডাক্তারখানায় প্রেরিত হইল। আমরা উপরি উপরি যতদূর দেখিলাম, তাহাতে ওই মৃতদেহের উপর কোনরূপ অস্ত্রাঘাতের বা অপর কোনরূপ চিহ্ন বা জখম দেখিতে পাইলাম না। পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, তারামণির কিছু অর্থাদি অলঙ্কার পত্র আছে, তদ্ব্যতীত কিছু কিছু বন্ধকী কারবারও করিয়া থাকে। কিন্তু লোহার সিন্দুকের ভিতর তাহার কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। এক তারামণির মৃতদেহ ও তাহার পরিহিত একখানি বস্ত্র ভিন্ন লোহার সিন্দুকের মধ্যে আর কিছুই ছিল না। 

যাহার ঘরে লোহার সিন্দুক আছে, তাহার মূল্যবান দ্রব্যাদি সে সেই লোহার সিন্দুকের ভিতরই রাখিয়া থাকে। আর মূল্যবান দ্রব্যাদি ঘরে না থাকিলেও যে লোহার সিন্দুকের ভিতর কিছুই থাকে না, তাহাও একেবারে অসম্ভব। সুতরাং তারামণির লোহার সিন্দুকের অবস্থা দেখিয়া স্বভাবতই আমাদিগের মনে করিতে হইল যে, উহার ভিতর যাহা ছিল, তাহার সমস্তই দস্যুগণ অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, না হয়, স্থানান্তরে রাখিয়া দিয়াছে; নতুবা লোহার সিন্দুকের ভিতর কোনরূপ দ্রব্যের চিহ্নমাত্রও নাই কেন? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ওই ঘরের ভিতর অপরাপর যে সকল সিন্দুক বাক্স ছিল, তাহাও খুলিয়া দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। অপর চাবির দ্বারা যে যে বাক্স প্রভৃতি খুলিতে পারিলাম, তাহা খুলিয়া ফেলিলাম; আর যাহা খুলিতে পারিলাম না, তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। ওই সকল বাক্সের আভ্যন্তরীণ অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ওই সকল বাক্স দস্যু কর্তৃক খোলা হইয়া ছিল, কিন্তু উহার মধ্যস্থিত বস্ত্র প্রভৃতি যে কিছু অপহৃত হইয়াছে, তাহা বোধ হইল না, কিন্তু কোনটির ভিতর অর্থ বা কোনরূপ অলঙ্কার দৃষ্টি গোচর হইল না। তারামণি ওই সকল বাক্স ও সিন্দুক প্রভৃতির ভিতর যদি কোনরূপ অলঙ্কার বা নগদ অর্থ রাখিয়া থাকে, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। 

পাড়ার অনেকেই কহিল, তারামণির অঙ্গে বালা, তাগা, হার প্রভৃতি কয়েকখানি সুবর্ণনির্ম্মিত অলঙ্কার প্রায়ই থাকিত। কিন্তু মৃতদেহের শরীরে অলঙ্কারের কোনরূপ চিহ্ন না দেখিয়া সহজেই অনুমান করিতে হইল যে, তারামণিকে হত্যা করিবার কারণ আর কিছুই নহে, কেবল তাহার যথা-সৰ্ব্বস্ব অপহরণ করা। আরও মনে করিলাম, হয়ত এই কার্য্য তারামণির কোন পরিচিত লোকের দ্বারা হইয়া থাকিবে। তারামণির দ্রব্যাদি কেবলমাত্র অপহরণ করিয়া চলিয়া গেলে, পশ্চাৎ তারামণি তাহাদিগের নাম বলিয়া দেয়, এই ভয়েই তাহারা তারামণিকে হত্যা করিয়া গিয়াছে। এবং যাহাতে সহজে এ কথা প্রকাশিত হইয়া না পড়ে, এই নিমিত্ত তাহারা তারামণির মৃতদেহ লোহার সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। তাহারা ভাবিয়াছিল, চাবি না পাইলে ওই সিন্দুক সহজে কেহ খুলিবে না, সুতরাং তারামণির অবস্থাও কেহ অবগত হইতে পারিবে না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

হত্যাকারী যাহা ভাবিয়া তারামণির মৃতদেহ লোহার সিন্দুকের ভিতর বন্ধ করিয়া তাহা চাবি সহিত প্রস্থান করিয়াছিল, তাহা হইল না; তারামণির মৃতদেহ পরিশেষে বাহির হইয়া পড়িল। আর আমরাও মনে মনে যাহা ভাবিয়া বা যেরূপ অনুমান করিয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতেছি, তাহাও যে কার্য্যে পরিণত হইবে, তাহাও অনুমান করা যাইতে পারে না। যাহা হউক, এখন হত্যা মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমাদিগকে লিপ্ত হইতে হইল। এরূপ মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইলে সৰ্ব্বপ্রথমে অপহৃত মালের তালিকা আমরা প্রস্তুত করিয়া থাকি। তাহার পর কি উপায় অবলম্বন করিলে ওই সকল অপহৃত দ্রব্য আমরা পুনরায় প্রাপ্ত হইতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখিয়া থাকি। কিন্তু বৰ্ত্তমান ক্ষেত্রে আমাদিগকে সে উপায় পরিত্যাগ করিতে হইল। কারণ, তারামণির ঘর হইতে কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার তালিকা আমরা সেই সময় প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইলাম না। কেবল এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, তারামণির অঙ্গে সময় সময় বালা, তাগা ও হার প্রভৃতি কয়েকখানি অলঙ্কার পরিহিত থাকিত এবং যে রাত্রিতে তাহার ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তাহার পূর্ব্বদিবস ওই কয়েকখানি অলঙ্কার তাহার অঙ্গে পরিহিত ছিল, তাহাও কেহ কেহ দেখিয়াছে। সুতরাং কেবলমাত্র ওই কয়খানি অলঙ্কারের উপর নির্ভর করিয়া আমাদিগকে এখন ওই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হইল। 

অপহৃত অলঙ্কার কয়েকখানির অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম সত্য; কিন্তু কোন স্থানে তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। অলঙ্কারের অনুসন্ধান ব্যতীত আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে সকল বিষয় আমাদিগের কর্ণ গোচর হইতে লাগিল, তাহারও আনুপূর্বিক অনুসন্ধান সঙ্গে সঙ্গে শেষ করিতে লাগিলাম,কিন্তু আসল মোকদ্দমা সম্বন্ধীয় কোন কথাই কোনরূপ প্রাপ্ত হইলাম না। এইরূপে ক্রমে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

যেস্থানে তারামণি বাস করিত, তাহার অনতিদূরে একটি বাগান আছে, ওই বাগানের ভিতর ঘাটবাঁধান একটি পুষ্করিণীও আছে। ওই পুষ্করিণীর জল অনেকটা ভাল বলিয়া নিকটবর্ত্তী দরিদ্র লোকজন ওই পুষ্করিণীর জলই প্রায় ব্যবহার করিয়া থাকে। একদিবস আমি ওই পুস্করিণীর বাঁধাঘাটের এক পার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছি, সন্ধ্যাকালীন তিমির আমাকে প্রায় আবৃত করিয়া সেই স্থানে লুক্কায়িতভাবে রাখিয়াছে, এইরূপ সময়ে দুইটি কলসী কক্ষে দুইটি স্ত্রীলোক জল লইবার মানসে আস্তে আস্তে ওই পুষ্করিণীতে অবতরণ করিল। উহাদিগের মধ্যে একটি স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকটিকে কহিল “ভাই! সে পয়সা কয়টা দিলি নে? “ 

২য় স্ত্রীলোক। না ভাই, এখন পর্যন্ত যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই। যেমন হাতে হইবে, অমনি দিব, চাইতে হইবে না। 

১ম স্ত্রীলোক। ইহার আগেও তো বলিয়াছিলে যে, দুই এক দিবসের মধ্যেই তুমি কোথায় পয়সা পাইবে, ও উহা পাইবামাত্রই আমার দেনা মিটাইয়া দিবে। 

২য় স্ত্রীলোক। বলিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু ভাই, সে পয়সা পাই নাই। আমাদিগের বাড়ীতে দুইজন ভদ্রলোক আসিয়া কয়েক দিবসের নিমিত্ত বাসা লইয়াছিল, তাহাদিগের নিকট হইতেই পয়সা পাওয়ার কথা ছিল, তাই তোমাকে বলিয়াছিলাম, ওই পয়সা পাইলেই তোমাকে দিব। 

১ম স্ত্রীলোক। তবে কি তাহাদিগের নিকট হইতে এখনও পয়সা পাও নাই? 

২য় স্ত্রীলোক। না ভাই পাই নাই, পাইবার আর আশাও নাই। 

১ম স্ত্রীলোক। কেন? পাইবার আশা নাই কেন, তাহারা কি দিবে না বলিয়াছেন? 

২য় স্ত্রীলোক। আমাদিগের ঘর ভাড়া প্রভৃতি একটি পয়সাও না দিয়া তাহারা হঠাৎ কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

১ম স্ত্রীলোক। যাইবার সময় বলিয়া যায় নাই? 

২য় স্ত্রীলোক। না ভাই, বলিয়াও যায় নাই বা একটি পয়সা দিয়াও যায় নাই। 

১ম স্ত্রীলোক। তাহা হইলে ত দেখিতেছি যে, তাহারা খুব ভদ্রলোক। 

২য় স্ত্রীলোক। কলিকাতার ভদ্র বা অভদ্রলোক হঠাৎ চিনিয়া লওয়া বড়ই শক্ত। তাহাদিগের পোষাক পরিচ্ছদে ও কথাবার্তায় আমরা তাহাদিগকে ভদ্রলোকই স্থির করিয়া লইয়াছিলাম। কিন্তু এখন দেখিতেছি, তাহারা ভদ্রলোক নহে। যে ঘরের ভাড়া না দিয়া চোরের মত রাত্রিকালে হঠাৎ চলিয়া যায়, তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিব কি প্রকারে? উভয় স্ত্রীলোকদ্বয় এইরূপে কথা কহিতে কহিতে আপনাপন কলসী জলে পূর্ণ করিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। উহাদিগের ওই কথা শুনিয়া আমিও মনে ভাবিলাম, এই স্ত্রীলোকদ্বয় যখন এই স্থানে জল লইতে আসিয়াছে, তখন তাহাদিগের বাসস্থান যে এই স্থান হইতে বহুদূরে, তাহা বোধ হয় না। আর দুইটি অপরিচিত লোক এই স্থানে আসিয়া বাসা লইয়াছিল, অথচ কাহাকেও কিছু না বলিয়া হঠাৎ তাহারা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, ইহাও নিতান্ত সন্দেহের বিষয়। বিশেষ এ কথা আমরা ইতিপূর্ব্বে কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি নাই। যাহা হউক, এখন দেখিতে হইবে যে, উহারা কোন্ বাড়ীতে আসিয়া কয়দিবস কাল অতিবাহিত করিয়াছিল, ও কোন্ দিবসই বা হঠাৎ এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমিও সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, ও দূর হইতে ওই স্ত্রীলোকদ্বয়ের অনুসরণ আরম্ভ করিলাম। কিছুদূর একত্রে গমন করিবার পর, দুইটি স্ত্রীলোক দুইটি স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিল। আমিও প্রথম স্ত্রীলোকটির পশ্চাদগমন না করিয়া দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম ও দেখিলাম, ওই স্ত্রীলোকটি কোন্ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে। এইরূপ উপায়ে ওই স্ত্রীলোকটির বাড়ী দেখিয়া লইয়া, সেই রাত্রিতে আমিও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কারণ মনে করিলাম, এই অনুসন্ধান রাত্রিকালে আরম্ভ করা কোন ক্রমেই কৰ্ত্তব্য নহে। 

পরদিবস প্রত্যূষে আমি ওই বাড়ীতে পুনরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। এই বাড়ীটি তারামণির বাড়ী হইতে বহুদূরবর্তী ছিল না, একটু দূর হইলেও সেই পাড়ার মধ্যে। সেই স্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, উহা কেশব কৈবত্ত নামক একজনের বাসগৃহ। কেশব তাহার পরিবার-সহিত ওই বাড়ীর একখানি ঘরে বাস করে, ও অপর একখানি বাইরের ঘর প্রায়ই খালি থাকে, সময় সময় কেহ ওই ঘর ভাড়া লইলে তাহাও সে দিয়া থাকে। আরও জানিতে পারিলাম, যে রাত্রিতে তারামণির ঘরে সিঁদ কাটিয়া তারামণিকে হত্যা পূর্ব্বক তাহার মূল্যবান দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, তাহার প্রায় ১০।১২ দিবস পূর্ব্ব হইতে কেশব কৈবর্ত্তের বাড়ী দুই ব্যক্তি ভাড়া লইয়াছিল, ও সেই স্থানেই বাস করিতেছিল। যে দিবস তারামণির গৃহে সিঁদ হইয়াছে জানিতে পারা গিয়াছে, সেই দিবস হইতে তাহাদিগকেও সেই স্থানে আর কেহ দেখিতে পায় নাই। তাহারা যে কোথায় গিয়াছে, তাহা কেশব কৈবর্ত বা অপর কেহ কিছুই বলিতে পারে না। ওই স্থান পরিত্যাগ করিবার সময় তাহারা কাহাকেও কোন কথা বলিয়া যায় নাই, বা ওই ঘরের ভাড়া প্রভৃতি কিছুই তাহারা কেশবকে দিয়া যায় নাই। তাহারা যে কে, কোথা হইতে আসিয়া ওই স্থানে বাস করিতেছিল, বা কি কাৰ্য্য করিয়া দিনযাপন করিত, তাহা কেহই কিছু বলিতে পারিল না। কেবল এইমাত্র জানিতে পারা গেল যে, তাহারা বলিত, বড়বাজারে তাহাদিগের কাপড়ের দোকান আছে; কিন্তু পীড়ার কারণে তাহারা বহুলোকের অধিকৃত বড়বাজার পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন স্থানে বাস করিতেছে। সময় সময় তাহারা দিনমানে বাহির হইয়াও যাইত। যাইবার সময় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহারা কহিত যে, তাহারা তাহাদিগের বড়বাজারের কাপড়ে দোকানে গমন করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে তাহারা যে কি করিত, তাহা সেই স্থানের কেহই অবগত ছিল না। অধিকাংশ দিবসের দিবাভাগেই তাহারা – প্রায়ই বাহিরে গমন করিত না, ঘরের মধ্যে থাকিয়াই সময় অতিবাহিত করিত। সময় সময় দুই একটি পশ্চিমদেশীয় লোক তাহাদিগের নিকট আগমন করিত। যাহারা আগমন করিত, তাহাদিগকে দেখিয়া অনুমান হইত, উহাদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। কিন্তু তাহাদিগের সংখ্যা খুব অধিক ছিল না; ওই দুই ব্যক্তি যতদিবস ওইস্থানে ছিল, তাহার মধ্যে বোধ হয়, চারিজনের অধিক লোককে কেহ সেই স্থানে দেখে নাই। 

কেশব ও তাহার পরিবারবর্গের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, আমাদিগের মনে মনে বেশ অনুমান হইল যে, তারামণির হত্যাকাণ্ডে ইহারা স্বতঃ বা পরতঃ যেরূপ ভাবেই হউক, লিপ্ত আছে। সুতরাং তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা এখন আমাদিগের নিতান্ত কর্তব্যকর্ম্মের মধ্যে পরিণত হইল; কিন্তু কি উপায় অবলম্বন করিলে ওই সকল ব্যক্তির অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

কেশব কৈবর্ত্তও তাহার পরিবারবর্গ ও পাড়ার অপরাপর ব্যক্তিগণ যাহারা তাহাদিগকে দেখিয়াছিল, তাহাদিগের নিকট হইতে ওই সকল ব্যক্তির হুলিয়া বা দৈহিক বিবরণ যতদূর সম্ভব সংগ্রহ পূৰ্ব্বক লিপিবদ্ধ করিয়া লইলাম। ওই সকল বিবরণ পাঠকগণের সুখপাঠ্য নহে বলিয়া এই স্থানে প্রদত্ত হইল না। 

পূর্ব্ববর্ণিত ছয়জন ব্যক্তির দৈহিক বিবরণ যতদূর সম্ভব অবগত হইয়া মনে করিলাম, বহুদর্শী কৰ্ম্মচারিগণের সহিত এখন একবার পরামর্শ করার প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমার সহিত যে সকল কর্ম্মচারী সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাহাদিগকে, ও আমার জানিত যে সকল অপরাপর কর্মচারী এই সহরের চোর বদমায়েসদিগের নিকট উত্তমরূপে পরিচিত, একস্থানে সমবেত করিয়া, ওই অজানিত ছয় ব্যক্তি সম্বন্ধে উত্তমরূপে আলোচনা করা হইল। কর্ম্মচারিগণের মধ্যে ওই প্রকার আকৃতি ও প্রকৃতির লোক ও যাহাদিগের দ্বারা ওইরূপ কার্য সম্পন্ন হইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা, তাহাদিগের একটি তালিকা প্রস্তুত করিলাম। বলা বাহুল্য, ওই তালিকার মধ্যে যে সকল ব্যক্তির নাম স্থান পাইল, তাহাদিগের প্রত্যেকের দ্বারাই এইরূপ কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে। 

এখন আমাদিগের প্রধান কাৰ্য্য হইল, অনুসন্ধান করিয়া আমাদিগের তালিকায় লিখিত ব্যক্তিগণকে বাহির করা ও কেশব কৈবর্ত্ত ও তাহার পরিবারবর্গকে দেখান যে, ওই বক্তিগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাহাদিগের বাড়ীতে কখন আসিয়ছিল কি না। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যে রাত্রিতে তারামণির ঘরে সিঁদ হয়, তাহার এক দিবস পরে আর একটি হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হয়। এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি ছিল না, তাহার উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা। ওই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত না থাকিলেও উহার অবস্থা জানিতে আমার কিছুমাত্র বাকি ছিল না। আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, যিনি হত হইয়াছিলেন, তাঁহার নাম মতিয়া বিবি। এবং ইহাও অনুমিত হইয়াছিল, মতিয়া বিবি কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের কন্যা ও তাঁহার পিতা জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমান যুবকের হস্তে উহাকে অর্পণ করিয়াছিলেন। মতিয়া বিবির ইহ-জীবন পরিত্যাগ করিবার কারণ ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারা যায় না। 

যে দিবস তাহার মৃত্যু হয়, সেই দিবস বা তাহার পরদিবস উহার মৃতদেহ সৎকারের নিমিত্ত গোরস্থানে লইয়া যাওয়া হয়। গোরস্থানে যিনি মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া গোরের ব্যবস্থা করিয়া থাকেন, তিনি মতিয়া বিবির মৃতদেহ দেখিয়া উহা কবরিত করিতে দেন না। মতিয়া বিবির মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহার অনুমান হয় যে, বিষপানই মতিয়া বিবির মৃত্যুর কারণ। কিন্তু তিনি স্ব-ইচ্ছায় বিষপান করিয়াছেন, কি বিষ প্রয়োগ করিয়া তাহার জীবন নষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তিনি বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবিকে সেই করবস্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে মহম্মদ মসলিম নামক এক ব্যক্তি ছিলেন। ওই মহম্মদ মস্‌লিমই মতিয়া বিবিকে তাঁহার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। মহম্মদ মল্লিমকে জিজ্ঞাসা করায় তিনিও মতিয়া বিবির মৃত্যুর কারণ যথাযথ বলিয়া উঠিতে পারেন না বা ইচ্ছা করিয়া বলেন না। সুতরাং বাধ্য হইয়া সেই কবরস্থানের কর্ম্মচারী এই সংবাদ নিকটবর্ত্তী থানায় প্রেরণ করেন। স্বাভাবিক মৃত্যুতে যে মরে নাই, তাহার মৃতদেহ কবরিত করিতে আদেশ দিবার ক্ষমতা সেই কৰ্ম্মচারীর নাই বলিয়াই, বাধ্য হইয়া এই সংবাদ তাঁহাকে থানায় প্রেরণ করিতে হয়। তিনি থানায় সংবাদ প্রদান করিলেন সত্য, কিন্তু যে পর্য্যন্ত পুলিস আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে না পারে, সেই পর্যন্ত ওই মৃতদেহের উপর কোনরূপ লক্ষ্য রাখিলেন না। কেবলমাত্র জনৈক ডোমের উপর এই আদেশ প্রদান করিলেন যে, “দেখিস্, এই মৃতদেহ কেহ যেন লইয়া না যায়।” ডোম আদেশ শ্রবণ করিল সত্য, কিন্তু তাহাদিগের যেরূপ স্বভাব, সেইরূপ ভাবে কার্য্য করিল। অর্থাৎ ওই মৃতদেহ কিরূপ ভাবে ও কোথায় রক্ষিত হইল, তাহার দিকে ক্ষণকালের নিমিত্তও দৃষ্টি রাখিল না। 

সংবাদ পাইবামাত্র জনৈক পুলিস কৰ্ম্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও সেই স্থানের কর্ম্মচারীর নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া তাহার সহিত ওই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। কিন্তু গোরস্থানে ওই মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন না, বা যে ব্যক্তিগণ ওই মৃতদেহ সেই স্থানে আনয়ন করিয়াছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের কাহাকেও সেই স্থানে পাইলেন না। যে ডোমের উপর ওই মৃতদেহ দেখিবার আদেশ ছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে প্রথমতঃ ওই মৃতদেহের একবার অনুসন্ধান করিয়া আসিল ও পরিশেষে কহিল, যাহারা ওই মৃতদেহ আনয়ন করিয়াছিল, তাহারাই ওই মৃতদেহ লইয়া চলিয়া গিয়াছে। যাইবার সময় আমি তাহাদিগকে নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহারা আমায় নিষেধ না শুনিয়া এই কথা বলিয়া চলিয়া যায় যে, “কবরাধ্যক্ষ মহাশয় আমাদিগকে ওই মৃতদেহ এই স্থান হইতে লইয়া যাইবার আদেশ প্রদান করিয়াছেন, তাহাই লইয়া যাইতেছি।” ডোমের কথা শুনিয়া বেশ বুঝতে পারিলাম যে, সে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা কথা বলিতেছে। কবরাধ্যক্ষ ওই মৃতদেহের উপর নজর রাখিবার জন্য তাহাকে যে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, সে সেই আদেশ কেবল শুনিয়াছিল মাত্র, কিন্তু কার্য্যের দিকে একবার লক্ষ্যও করে নাই। সুতরাং তাহারই অমনোযোগে যে ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

মৃতদেহ দেখিতে না পাইয়া কবরাধ্যক্ষ সেই পুলিস-কর্মচারীর সহিত উহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। প্রথমতঃ কবরস্থানের অন্তর্গত সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানে ওই মৃতদেহের চিহ্নমাত্রও দেখিতে না পাইয়া, পরিশেষে কবর স্থানের বহির্ভাগে অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ অনুসন্ধান করিবার পর দেখিতে পাইলেন, মহম্মদ মসলিম একটি দোকানের সম্মুখে উপবেশন করিয়া ধূমপান করিতেছে। বলা বাহুল্য, মসলিমকে দেখিবামাত্রই তাঁহারা উহাকে ধৃত করিলেন। ও উহাকে মৃতদেহের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, ওই মৃতদেহ তাহারা স্থানান্তরিত করে নাই। কবরস্থানের মধ্যে যেস্থানে উহারা প্রথমতঃ উহাকে রাখিয়াছিল, সেই স্থানে উহা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াছে ও একটু বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়া ধূমপান করিতেছে। যে ব্যক্তিগণ ওই মৃতদেহ বহন করিয়া জানিয়াছিল, তাহাদিগের কথা জিজ্ঞাসা করায় মলিম কহিল, যখন তাহারা জানিতে পারিল যে, পুলিসে সংবাদ প্রেরণ করা হইয়াছে, পুলিসের অনুসন্ধান শেষ না হইলে যখন ওই মৃতদেহ কবরিত হইতে পারিবে না, তখন তাহারা উহা ওই স্থানে নিক্ষেপ করিয়া আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিয়াছে। মসলিমের কথা শুনিয়া কিছুই অনুমান করিতে পারিলাম না যে, সে মিথ্যা কথা কহিতেছে, কি সত্য কথা বলিতেছে। যদি তাহার কথা প্রকৃত হইবে, তাহা হইলে ওই মৃতদেহ কোথায় গেল? আর যদি তাহার কথা অপ্রকৃতই হইবে, তাহা হইলে সে স্থির অন্তঃকরণে কবরস্থানের নিকটবর্ত্তী দোকানের সম্মুখে বসিয়া ধূমপানই বা করিবে কেন? সে সেই স্থানের কাহারও নিকট পরিচিত নহে কোন্ স্থানে তাহার বাসস্থান, তাহা কাহারও বিদিত নহে, সে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা নিতান্ত সহজ হইত না। সে যাহা হউক, তাহার কোন্ কথা প্রকৃত ও কোন্ কথাই বা অপ্রকৃত, তাহা জানিতে না পারিলে বিশেষ কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই সত্য, কিন্তু মৃতদেহের সন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক। 

মতিয়া বিবি বিষপানে আত্মহত্যা করিলেও পুলিশের কর্তব্য, তাহার যথাযথ অনুসন্ধান করা। আর যদি বিষ প্রয়োগ করাইয়া কেহ তাহাকে হত্যা করিয়া থাকে, তাহা হইলে ওই মৃতদেহের নিতান্ত আবশ্যক। মৃতদেহ প্রাপ্ত না হইলে কাহাকেও খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত করা যাইতে পারে না, অথচ যখন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে যে, মতিয়া বিবি হত হইয়াছে, তখন মৃতদেহ ব্যতীত ওই খুনি মোকদ্দমা কিরূপে প্রমাণিত হইতে পারিবে? 

পুলিস-কৰ্ম্মচারী এইরূপ অবস্থা দৃষ্টে নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া এইরূপ মনে করিলেন যে, মসলিম নিতান্ত মিথ্যা কথা কহিতেছে। তাহার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিগণ ওই মৃতদেহ লইয়া প্রস্থান করিয়াছে ও পুলিশের চক্ষে ধূলি প্রদান করিবার মানসে মসলিম সেই স্থানে উপস্থিত আছে। সুতরাং ওই সমস্ত ব্যক্তির বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে বাহির করাই এখন নিতান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। মল্লিমকে জিজ্ঞাসা করায় মলিম নিতান্ত সরলান্তঃকরণে ওই সকল ব্যক্তিগণের নাম ও ঠিকানা পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে বলিয়া দিল ও কহিল, যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে সে নিজে গিয়া উহাদিগকে দেখাইয়া দিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহে। 

কার্য্যেতে মসলিম করিলও তাহাই। ওই পুলিস-কর্ম্মচারী ও গোরস্থানের কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবির মৃতদেহ কবরস্থলে আনিয়াছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই দেখাইয়া দিল। পুলিস-কৰ্ম্মচারী তাহাদিগের প্রত্যেককেই পৃথক্ পৃথরূপে জিজ্ঞাসা করিলেন ও প্রত্যেকের নিকট হইতেই একই প্রকারের উত্তর পাইয়া আরও বিস্মিত হইলেন। সকলেই কহিল—তাহারা ওই মৃতদেহ কবরস্থানে রাখিয়া চলিয়া আসিয়াছে; তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহা তাহারা অবগত নহে। কবরস্থানের কর্ম্মচারী ও পুলিস-কর্ম্মচারী উভয়েই মৃতদেহের এইরূপ হঠাৎ অন্তৰ্দ্ধান দেখিয়া, বিশেষরূপ চিন্তিত ও আশ্চর্যান্বিত হইলেন। নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে এইরূপ যে একটি মনুষ্যের মৃতদেহ অন্তর্হিত হইয়া গেল, ইহা বড়ই আশ্চর্য্য। শৃগাল কুক্কুরে সহজে যে ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিতে পারিবে, তাহাও বোধ হয় না। মৃতদেহের এইরূপ অদ্ভুত অন্তর্ধানের কথা তিনি আর গোপন রাখিতে পারিলেন না। এই সংবাদ তখন তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট প্রেরণ করিতে হইল। উর্দ্ধতন কর্মচারীর আদেশ অনুযায়ী আরও কয়েকজন কৰ্ম্মচারী আসিয়া এই অনুসন্ধানে যোগদান করিলেন। কেহ মতিয়া বিবির মৃতদেহের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কেহ বা অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, ওই মতিয়া বিবি কে, কাহার স্ত্রী, বাসস্থান কোথায় ও তাহার মৃত্যুর কারণই বা কি? মলিম মতিয়া বিবিকে তাহার স্ত্রী পরিচয়ে কবরস্থানে লইয়া গিয়াছিল। এখনও সে তাহাকে আপন স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে লাগিল, কিন্তু তাহাদিগের প্রকৃত থাকিবার স্থান যে কোথায়, তাহা কিন্তু কাহাকেও কহিল না বা দেখাইল না। একস্থানের একটি খালি ঘর দেখাইয়া দিয়া কহিল, ওই স্থানে তাহারা বাস করিত; কিন্তু ওই ঘরের মধ্যে বাসোপযোগী কোন দ্রব্যই পরিলক্ষিত হইল না, বা নিকটবর্ত্তী কোন ব্যক্তিই বলিতে পারিল না যে, তাহারা ওই স্থানে বাস করিত। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

আমি যখন পূৰ্ব্ব-কথিত তারামণির হত্যাকারীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি ও কেশব কৈবর্ত্তকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাড়ী হইতে হঠাৎ অন্তর্হিত ব্যক্তিগণের অনুসন্ধান করিতেছি, সেই সময় মতিয়া বিবির মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত সেই পুলিস-কর্মচারীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। মসলিম ও তারামণির মৃতদেহ বহন করিয়া যে সকল ব্যক্তি কবরস্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের সকলকে সেই সময় ওই পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত দেখিতে পাইলাম। যে ব্যক্তি মহম্মদ মসলিম বলিয়া কবরস্থানের কর্ম্মচারী ও পুলিস-কর্মচারীর নিকট আত্মপরিচয় প্রদান করিয়াছিল, সে যে মুসলমান কি হিন্দু, তাহা এখন স্থির করা একরূপ কঠিন হইয়া পড়িল। উহার চোহারা দেখিয়া উহাকে হিন্দু বলিয়া অনুমান হয়, কিন্তু মসলিম হিন্দু বলিয়া আপনাকে স্বীকার করে না। সে কহে সে মুসলমান। সে হিন্দুই হউক, আর মুসলমানই হউক, কেশব কৈবর্ত্ত উহাকে দেখিবামাত্র কহিল যে, যে দুই ব্যক্তি আসিয়া তাহার ঘর ভাড়া লইয়া কয়েক দিবস ওই ঘরে বাস করিয়াছিল, তাহাদিগের এক ব্যক্তি এই। যে ব্যক্তিগণ মতিয়া বিবির মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যস্থিত দুই ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিয়া কহিল “ইহারা মসলিম ও তাহার বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত প্রায়ই তাহার বাড়ীতে গমন করিত।” ওই দুই ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করায় একজন কহিল, তাহার নাম মহম্মদ হানিফ ও অপর একব্যক্তি কহিল, তাহার নাম মহম্মদ কাছেম। মসলিমকে জিজ্ঞাসা করায় সে যে কখনও কেশব কৈবর্ত্তের বাটিতে বাস করিয়াছিল, তাহা স্বীকার করিল না। হানিফ ও কাছেম, কেশবের বাড়ীতে যাওয়া বা সেই স্থানে মসলিম বা তাহার বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করা, একবারে অস্বীকার করিল। কেশব কৈবর্ত যদি উহাদিগকে ঠিক চিনিতে পারিয়াই না থাকে, এই ভাবিয়া উহাদিগকে সঙ্গে লইয়া কেশব কৈবর্ত্তের বাড়ীতে গমন করিলাম। সেই স্থানে কেশবের স্ত্রী ও পাড়ার অপরাপর যে সকল লোক উহাদিগকে সেই স্থানে দেখিয়াছিল, তাহারা সকলেই একবাক্যে উহাদিগকে সনাক্ত করিল; এখন আর আমাদিগের মনে কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। এখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, মহম্মদ মসলিম তাহার জনৈক পারিষদের সহিত ওই স্থানে বাস করিয়াছিল ও হানিফ ও কাছেম উহাদিগের নিকট সেই স্থানে আগমন করিত। আরও বুঝিতে পারিলাম যে, তারামণি ইহাদিগের কর্তৃকই হত হইয়াছে ও ইহারাই তাহার যথা-সর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া, তাহার মৃতদেহ লোহার সিন্দুকে বন্ধ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে। 

মনে মনে আমরা এই অনুমান করিলাম সত্য, কিন্তু কিরূপে উহাদিগের উপর এই ঘটনা প্রমাণিত করিতে সমর্থ হইব, সেই চিন্তা আসিয়া তখন উপস্থিত হইল। যে সকল কৰ্ম্মচারী তারামণির হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, ও যে সকল কৰ্ম্মচারী মতিয়া বিবির মৃতদেহের অদ্ভুত অন্তর্দ্ধানের অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন, এখন তাহারা সকলে একত্রে মিলিত হইয়া উভয় অনুসন্ধান সম্পন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

একদিকে তারামণি হত; তাহার যথাসর্বস্ব অপহৃত ও তাহার মৃতদেহ লোহার সিন্দুকের ভিতর প্রাপ্ত। অপর দিকে মতিয়া বিবি হত ও তাহার মৃতদেহ অন্তর্হিত। ইহা বড়ই আশ্চর্য্য। ইহার ভিতর যে কি রহস্য আছে, তাহা বুঝিয়া উঠা মনুষ্যবুদ্ধির অসাধ্য। মতিয়া বিবি যদি মসলিমের স্ত্রী হয়, তাহা হইলে সে তাহাকে হত্যা করিবে কেন? আর যদি কোনরূপ প্রতিহিংসা প্রতিপালন করিবার মানসে সে তাহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াই থাকে, তাহা হইলে ওই মৃতদেহ কবরিত করিবার মানসে সে উহা গোরস্থানে আনিবে কেন? কারণ এ কথা বোধ হয়, কাহাকেই বলিয়া দিতে হইবে না যে, এইরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে তাহাকে কিরূপ বিপদে পতিত হইবার সম্ভাবনা। আর সেই বা ওই মৃতদেহের হঠাৎ অন্তর্দ্ধান করাইয়াই বা দিবে কেন? যদি প্রাণের ভয়ে মতিয়া বিবির মৃতদেহ সে স্থানান্তরিত করিয়াই থাকে, তাহা হইলে এত অল্প সময়ের মধ্যে সে উহাকে কোথায় রাখিবে? আর উহার অনুষঙ্গিগণ কেনই বা মিথ্যা কথা বলিয়া ভয়ানক ভাবি বিপদকে আপন আপন স্কন্ধে চাপাইয়া দিবে? 

এদিকে মতিয়া বিবি কে? তাহারও ত কোন সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। যে গৃহে মসলিম বাস করিত বলিয়া আমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছে, সে গৃহে সে এক মুহূর্তের জন্যও কখনও বাস করে নাই, ইহা অকাট্য সত্য। যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবির মৃতদেহ করস্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহারাই বা কে? তাহাদিগের বাসস্থানই বা কোথায়, কি কার্য্য করিয়া তাহারা দিনপাত করিয়া থাকে, তাহারও ত কিছুই জানিতে পারা যাইতেছে না। কেবলমাত্র এক মাস হইতে একখানি ঘর ভাড়া লইয়া উহারা একত্রে বাস করিতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া উহাদিগের নিকট হইতে এ পৰ্য্যন্ত কোন কথা পাওয়া যায় নাই ও ভবিষ্যতেও যে তাহারা কোন কথা প্রকাশ করিবে, তাহাও অনুমিত রইতেছে না। 

যাহা হউক, উহাদিগের লইয়া এখন উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতেই হইবে। মসলিম কে তাহা জানিতে হইবে; কোথায় তাহার বাসস্থান, কি করিয়া সে দিনপাত করিয়া থাকে, তাহা জানিতেনা পারিলে এই অনুসন্ধান কিছুতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারিবে না। তাহার আনুষঙ্গিক ব্যক্তিগণের পরিচয়ই বা কি এবং মতিয়া বিবিই বা কে, তাহা যে কোন উপায়ে হউক, জানিতেই হইবে। মনে মনে এইরূপে স্থির করিয়া উহাদিগকে লইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম সত্য, কিন্তু উহাদিগের নিকট হইতে কোন কথাই প্রাপ্ত হইলাম না। এমন কি উহারা কোন্ দেশীয় লোক, কোথা হইতে তাহারা এই স্থানে আগমন করিয়াছে, তাহা পর্যন্ত অপর কাহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম না। উহারাও সে সম্বন্ধে কোন কথা, আমরা বিশেষরূপে চেষ্টা করিলেও আমাদিগকে বলিল না। যে ঘর ভাড়া লইয়া উহারা বাস করিতেছিল, সেই ঘর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, এমন কি ঘরের মেঝে পর্য্যন্ত উত্তমরূপে খোদিয়া দেখিলাম কিন্তু সন্দেহসূচক কোন দ্রব্যই পাওয়া গেল না। অনেক অনুসন্ধান করিবার পর, পরিশেষে কেবল এই মাত্র জানিতে পারিলাম যে, মসলিম আখজি নামক একটি বেশ্যার গৃহে কখনও কখনও গমন করিত। কিন্তু আখজি কে কোথায় থাকে, কতদিন হইতে সেই স্থানে মসলিমের যাতায়াত আছে ও তাহার সহিত উহার সদ্ভাব আছে কি না, তাহাও কিন্তু কেহ বলিতে পারিল না। পরিশেষে বহু অনুসন্ধানের পর আখজির সন্ধান পাইলাম। মসলিম ও তাহার বন্ধুগণের মধ্যে দুই একজন কখনও কখনও যে তাহার ঘরে আসিত, তাহা সে স্বীকার করিল, ও মসলিম ও অপর দুই ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিল। কিন্তু তাহারা যে কে, কোথায় তাহাদিগের বাসস্থান, তাহার কিছুই সে বলিতে পারিল না। সে কহিল, উহারা তাহাদিগের পরিচয় কখনও তাহার নিকট প্রদান করে নাই। আখজিকে তাহাদিগের মধ্যে কেহ কখনও কোন অলঙ্কারাদি প্রদান করিয়াছে কি না, জিজ্ঞাসা করায় সে এক জোড়া সোনার অনন্ত বা তাগা বাহির করিয়া আনিল, ও উহা আমাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া কহিল, মসলিম তাহাকে কেবলমাত্র এই অলঙ্কারখানি প্রদান করিয়াছে। 

আখজির ভাবগতিক দেখিয়া ও তাহার কথা শুনিয়া আমাদিগের সম্পূর্ণরূপে অনুমান হইল যে, এই মহানগরী ও সহরতলীর মধ্যে যে সকল বারবনিতা বাস করিয়া থাকে, তাহাদিগের চরিত্র কার্য্যগতিকে উত্তমরূপে আলোচনা করিয়া যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে উহাদিগের মধ্যে যে কেহ সত্যবাদী বা সরল প্রকৃতির স্ত্রীলোক আছে, তাহা এ পর্য্যন্ত দেখিতে পাই নাই; কিন্তু আজ দেখিলাম, আখজি বেশ্যা হইলেও তাহার প্রকৃতি অপর বেশ্যা অপেক্ষা কিয়ৎ পরিমাণে অন্যতম। তাহার সহিত আমাদিগের যে দুই চারিটি কথা হইল তাহাতেই বুঝিতে পারিলাম, সে কতকটা সরল প্রকৃতির স্ত্রীলোক, ও সে যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃতই কহিতেছে। সে যে কোন কথা মিথ্যা বলিতেছে, তাহা আমাদিগের মনে হইল না। 

তারামণির অঙ্গে তাগা ও বালা ছিল, ইহা পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছেন। আর ওই তাগা বা বালা যে অপহৃত হইয়াছে, তাহাও আপনারা শুনিয়াছেন। এখন যে তাগা আখজির নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া গেল, তাহা তারমণির তাগা কি না? 

ইহা যদি তারামণির তাগা বলিয়া প্রমাণিত হয়, তাহা হইলে তারামণির হত্যাকাণ্ডের নায়কগণের একজন যে মসলিম, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। ওই তাগা তারামণির হউক না হউক, কিন্তু ওই তাগা সম্বন্ধে যে বিশেষরূপ অনুসন্ধান আবশ্যক, সে বিষয়ে আর কিছু সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, ওই তাগা লইয়া গিয়া তারামণির বাড়ীওয়ালাকে দেখাইলাম। তিনি দেখিবামাত্রই কহিলেন, ওই তাগা তারামণির। তারামণি বাড়ীওয়ালার বাড়ীর ভিতর সর্ব্বদা গমনাগমন করিত, বাড়ীওয়ালার পরিবারবর্গের সকলেই ওই তাগা দেখিয়া কহিল উহা তারামণির তাগা। তদ্ব্যতীত ওই পাড়ার স্ত্রীলোকগণ যাহার যাহার সহিত তারামণির জানাশুনা ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেকেই ওই তাগা দেখিয়া কহিল, উহা তারামণির তাগা ও ওই তাগা তারামণি সর্ব্বদা পরিয়া থাকিত। সমস্ত লোকেই যখন ওই তাগা তারামণির বলিয়া চিনিতে পারিল, তখন আমাদিগের মনেও আর কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। তদ্ব্যতীত পরিশেষে যে কর্ম্মকার তারামণির তাগা প্রস্তুত করিয়াছিল, অনুসন্ধানে তাহাকেও পাওয়া গেল। সে ওই তাগা দেখিবামাত্রই কহিল যে, ওই তাগা তাহার নিজ হস্তে প্রস্তুত। সে তারামণির জন্য ওই তাগা প্রস্তুত করিয়া ছিল ও তারামণির অঙ্গে সে উহা সর্বদাই দেখিয়াছে। 

এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই মহম্মদ মসলিম মহম্মদ হানিফ ও মহম্মদ কাছেমকে তারামণিকে হত্যা করা ও তাহার অলঙ্কার পত্র অপহরণ করা অপরাধে ধৃত করিলাম। উহাদিগকে কেবলমাত্র ধৃত করিয়াই যে আমরা স্থির থাকিলাম, তাহা নহে; এই অনুসন্ধানে যে সকল পুলিস-কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত ছিলেন, সকলে একত্র মিলিত হইয়া উহাদিগকে লইয়া কঠোর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। এই অনুসন্ধানের প্রথম উদ্দেশ্য উহারা কে, উহাদিগের বাসস্থান কোথায় ও উহাদিগের জীবন ধারণের উপায়ই বা কি? দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, যে কয়েকজন ব্যক্তিকে আমরা পাইয়াছি, তদ্ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি উহাদিগের দলভুক্ত আছে? ও এই দলের কার্য্যই বা কি? তৃতীয় উদ্দেশ্য, তারামণির গৃহ ও তাহার অঙ্গ হইতে যে সকল মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার উদ্ধারের চেষ্টা, ও ওই সকল দ্রব্য কিরূপে ও কোথায় বিক্রয় করা হইয়াছে বা লুকাইয়া রাখা আছে, অনুসন্ধান করিয়া তাহা বাহির করা। আর চতুর্থ উদ্দেশ্য এই যে, মতিয়া বিবি কে তাহার বাসস্থান কোথায়, তাহার হত্যাকারীই বা কে, ও যদি হত্যা হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই হত্যার উদ্দেশ্যই বা কি, ও এখন সেই মৃতদেহই বা কোথায় গেল? 

আমাদিগের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অনুসন্ধানের বিশেষরূপ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুই জানিতে পারিলাম না। কখনও বা উহাদিগকে ভয় প্রদর্শন ও উহাদিগের উপর নিতান্ত কঠোর ব্যবহার আরম্ভ করিলাম, কখনও বা উহাদিগের সহিত মিত্রতা করিয়া মিত্রভাব দেখাইতে লাগিলাম; কিন্তু আমাদিগের উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হইল না। যখন দেখিলাম, উহাদিগের নিকট হইতে আমরা কোন কথা বাহির করিতে সমর্থ হইলাম না, আমাদিগের চেষ্টা, যত্ন, কৌশল প্রভৃতি সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল, তখন অনন্যোপায় হইয়া আমরা পরিশষে ওই অপরাধের নিমিত্ত উহাদিগকে বিচারকের নিকট প্রেরণ করিলাম। কিন্তু বলা বাহুল্য, উহাদিগের উপর পূর্ব্ব-কথিত যে সকল প্রমাণ আদালতে প্রমাণিত হইল, তাহাতে কোন বিচারকই উহাদিগের সকলকে কোনরূপেই দণ্ড প্রদান করিতে পারেন না। তাহার উপর শবছেদকারী ডাক্তারের সাক্ষ্য। মৃতদেহ যেরূপ পচিয়া গিয়াছে, তাহাতে তিনি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করিতে সমর্থ হন না। তিনি উহার প্লীহা, যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতির কিয়দংশ কাটিয়া রাসায়নিক পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ করেন। রাসায়নিক পরীক্ষক পরীক্ষা করিয়া যে রিপোর্ট প্রদান করেন, তাহাতে জানিতে পারা যায়, বিষপানই উহার মৃত্যুর কারণ। ইহাতে আসামীগণের যে বিশেষ সুবিধাজনক বিষয়, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ, আমরা প্রমাণ ও যুক্তির দ্বারা – স্থির করিয়াছিলাম যে, উহারা তারামণিকে হত্যা করিয়া তাহার মৃতদেহ লোহার সিন্দুকে বন্ধ দিয়া, তাহার যথা-সৰ্ব্বস্ব চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছিল, কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষকের পরীক্ষা ফল পাইয়া সেই হত্যার যুক্তি অন্যরূপ ধারণ করিল। তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, বিষপ্রয়োগে তারামণিকে হত্যা করিল কিরূপে? যাঁহার নিকট প্রথমে এই মোকদ্দমার . বিচার হয়, তিনি মহম্মদ হানিফ ও মহম্মদ কাছেমকে অব্যাহতি দিয়া কেবল মহম্মদ মল্লিমকে বিচারার্থ উচ্চ আদালতে প্রেরণ করেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সময়মত উচ্চ আদালতে পাঁচ জন জুরির সাহায্যে এই মোকদ্দামার বিচার হয়। মহম্মদ মসলিম নিতান্ত সঙ্গিন অপরাধে অভিযুক্ত, সুতরাং বিচারকও জুরিগণের সাহায্যে বিশেষ বিচেনার সহিত তাহার বিচার করিতে আরম্ভ করেন। তাহার উপর যে সকল প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহাতে জজ ও জুরিগণের মনে বিশ্বাস হয় যে, মসলিম তারামণিকে হত্যা করিয়া তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। আর ইহাও সাব্যস্ত হয় যে, বিষপ্রয়োগই তারামণির মৃত্যুর কারণ। কারণ, রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট হইতে যে রিপোর্ট প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে জানিতে পারা যায় যে, তারামণির শবছেদকারী ডাক্তার তাঁহার নিকট যে সকল পদার্থ প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহার মধ্য হইতে বিষ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। মসলিম হত্যাপরাধে অভিযুক্ত, কিন্তু বিচারালয়ে তাহার পক্ষ সমর্থন করিতে ব্যবহারজীবিগণের মধ্যে কেহই উপস্থিত ছিলেন না। মসলিমও তাহার নিজের পক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত কোন কথা কহিল না। তাহার বিপক্ষে প্রমাণ প্রয়োগ সমস্ত শেষ হইয়া গেলে, এ বিষয়ে তাহার কি বক্তব্য আছে, তাহা বিচারক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে মসলিন কেবল এইমাত্র কহিল, সে যে তারামণিকে হত্যা করে নাই, তাহারই কেবল একটিমাত্র প্রমাণ সে বিচারালয়ে উপস্থিত করিতে চাহে। যে ব্যক্তি ওই প্রমাণ দিবে, তাহাকে দর্শন করিবামাত্রই বিচারক বুঝিতে পারিবেন যে, সে তারামণিকে হত্যা করিয়াছে, কি পুলিস-কর্ম্মচারিগণ তাহার উপর এই মিথ্যা মোকদ্দমা আনিয়া তাহাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। মসলিম আরও কহিল, সে যাহাকে এই স্থানে উপস্থিত করিতে বাসনা করিয়াছে, সে নিকটবর্তী একটি বাগানের ভিতর মহম্মদ কাছেম ও হানেফের নিকট আছে। পুলিস-কৰ্ম্মচারী ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তিকে সেই স্থানে পাঠাইয়া দিয়া তাহাকে আনা হউক, এই তাহার প্রার্থনা। 

এই বলিয়া বাগানের নাম ও ঠিকানা সে বিচারককে বলিয়া দিল। মসলিমের নিকট হইতে তাহার ছাপাই সাক্ষীর নাম পাইয়া, বিচারক তাহাকে কহিলেন “তুমি যখন অবগত আছ যে, কোন্ তারিখে তোমার মোকদ্দমার দিনে ছাপাই সাক্ষীগণকে হাজির করিবার বন্দোবস্ত তোমাকে পূর্ব্ব হইতেই করিতে হইবে, তখন তুমি সেরূপ বন্দোবস্ত পূর্ব্ব হইতে করিয়া রাখ নাই কেন? এরূপ অবস্থায় এখন তোমার প্রার্থনা কিরূপে মঞ্জুর করিতে পারি?” 

বিচারকের কথা শুনিয়া মসলিম কহিল, ‘ধর্ম্মাবতার! আমি ইহার সমস্তই অবগত আছি, কিন্তু পূৰ্ব্ব হইতে যদি আমি আমার সাক্ষীর নাম প্রকাশ করিতাম বা তাহাকে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইবার যদি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া রাখিতাম, তাহা হইলে পুলিসের অনুগ্রহে সেই সাক্ষী কখনই আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারিতাম না। এই জন্য আমার প্রার্থনা যে, আমার সাক্ষীকে এই স্থানে এখন আনাইয়া দেখুন, তাহা হইলে আমি জোর করিয়া বলিতে পারি যে, আপনি নিশ্চয়ই আমাকে অব্যাহতি প্রদান করিবেন। বিশেষ আমার ওই সাক্ষী অতি নিকটেই আছে। 

মলিমের কথা শুনিয়া বিচারক একটু চিন্তা করিলেন ও পরিশেষে তাঁহার বিচারালয়ের একজন কৰ্ম্মচারী ও এক জন চাপরাসিকে সেই স্থানে প্রেরণ করিলেন। মসলিম যে বাগানের নাম বলিয়া দিয়াছিল, উহা বিচারালয় হইতে বহুদূরে স্থাপিত ছিল না। সুতরাং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ওই বিচারালয়ের কর্মচারী হানিফ, কাছেম ও একটি স্ত্রীলোকের সহিত সেই স্থানে অসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

ওই স্ত্রীলোকটি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র চতুৰ্দ্দিকে একটি ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। কিসের গোলযোগ, তাহা প্রথমতঃ হঠাৎ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, কিন্তু যখন জানিতে পারিলাম, তখন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, কি ভয়ানক কাণ্ড আসিয়া উপস্থিত হইল! 

কি ভয়ানক কাণ্ড উপস্থিত হইল, তাহার কিছুমাত্র পাঠকগণ অনুমান করিতে সমর্থ হইয়াছেন কি? মহম্মদ মসলিমের প্রার্থনামত ওই স্ত্রীলোকটিকে সেই স্থানে আনীত হইলে মসলিম বিচারককে কহিল, ‘ধম্মাবতার! এই মোকদ্দমায় তারামণির বাড়ীওয়ালা ও তাহার প্রতিবেশিগণ যাহারা আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাহাদিগকে আপনি একবার ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করুন, এই স্ত্রীলোকটি কে? তাহা হইলেই জানিতে পারিবেন, এই মোকদ্দমায় আমি কতদূর দোষী।” 

মসলিমের কথা শুনিয়া বিচারক তারামণির বাড়ীওয়ালাকে ডাকাইলেন। তিনি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। আদেশমাত্র বাড়ীওয়ালা সেই স্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলে বিচারক মসলিমকে কহিলেন “তুমি ইহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহ, তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পার।” 

বিচারকের নিকট হইতে আদেশ প্রাপ্ত হইয়া মসলিম সেই বাড়ীওয়ালাকে কহিল, “দেখুন দেখি মহাশয়, আপনি এই স্ত্রীলোকটিকে চিনিতে পারিতেছেন কি না?” 

বাড়ীওয়ালা। হ্যাঁ, চিনিতে পারিতেছি। 

মসলিম। উহার নাম কি? 

বাড়ী। তারামণি। 

মসলিম। কোন্ তারামণি? যাহাকে হত্যা করা অপরাধে আমি অভিযুক্ত, তারামণি, কি অপর কোন তারামণি?

বাড়ী। যে তারামণি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা স্থির করিয়াছিলাম, এ সেই তারামণি। 

বাড়ীওয়ালার কথা শুনিয়া বিচারক ও জুরিগণের মুখ দিয়া কিয়ৎক্ষণ বানিষ্পত্তি হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে বিচারক মহাশয় কহিলেন “কি সর্বনাশ! যাহাকে হত্যাপরাধে দণ্ড দিতে আমরা প্রস্তুত হইতেছিলাম, এখন দেখিতেছি, সে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ! যে ব্যক্তি হত হইয়াছে বলিয়া আমরা স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া লইয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি; সে জীবিত! কি ভয়ানক!!” 

বিচারক সর্বসমক্ষে এইরূপ বলিয়া, অপরাপর ব্যক্তিগণ যাহারা তারামণিকে চিনিত, তাহাদিগের প্রত্যেককেই এক এক করিয়া ডাকাইলেন, ও প্রত্যেককেই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র রূপে জিজ্ঞাসা করিলেন। সকলেই একবাক্যে কহিল, “যে তারামণি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া এই মোকদ্দমার অবতারণা, সেই তারামণি এই, সে মরে নাই।” 

সকলকে জিজ্ঞাসা করার পর বিচারক আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া, মসলিমকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। মসলিম হাসিতে হাসিতে হানিফ ও কাছেমের সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। তারামণিও বাড়ীওয়ালার সহিত আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। 

ইহার পর পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ মহম্মদ মসলিম, মহম্মদ হানিফ, মহম্মদ কাছেম ও তাহাদিগের সহিত অপর যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবির মৃতদেহ কবরস্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই আর তাহাদিগকে প্রাপ্ত হওয়া গেল না। তাহারা যে কোথায় গমন করিল, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। 

তারামণিকে হত্যা করা অপরাধে বিচারক যে কেবলমাত্র মহম্মদ মসলিমকে অব্যাহতি দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছিলেন, তাহা নহে; পুলিস-কর্ম্মচারিগণের উপরও তিনি কঠোর সমালোচনা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করেন নাই। যে সকল পুলিস-কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহাদিগের বিপক্ষে পরিশেষে ভয়ানক অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। ওই অনুসন্ধান কোন আদালত হইতে হয় নাই, পুলিস-বিভাগের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারী এই অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। ওই অনুসন্ধানের মূল উদ্দেশ্য এই ছিল যে, পুলিস-কর্মচারিগণ ইচ্ছা করিয়া মহম্মদ মসলিমকে বিপদগ্রস্ত করিবার মানসে, এই মোকদ্দমায় অবতারণ করিয়াছে কি না, অথবা এই মিথ্যা মোকদ্দমা রুজু করিবার পুলিস-কর্মচারিগণের কোন উদ্দেশ্য বা কোনরূপ স্বার্থ আছে কি না? 

অনুসন্ধানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, তারামণির লোহার সিন্দুকের ভিতর যে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাই বা কাহার মৃতদেহ ও কিরূপেই বা উহা ওই বাক্সের ভিতর কাহার দ্বারা আনীত হইল? ওইরূপ মৃতদেহ ওইরূপে ওই স্থানে আনয়ন করিবার পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণের কোনরূপ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ আছে কি না? বলা বাহুল্য, ক্রমান্বয়ে ১৫ দিবসকাল পুলিসের প্রধান কর্মচারীর দ্বারা এই অনুসন্ধান চালিত হইল, কিন্তু তিনি পুলিস-কর্মচারিগণের বিপক্ষে এরূপ কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না যে, যাহাতে তিনি তাহাদিগকে দণ্ড প্রদান করিতে পারেন। সুতরাং আমরা সকলেই তাঁহার নিকট হইতে অব্যাহতি পাইলাম। কিন্তু তখনও আমাদিগের উপর আদেশ রহিল, “লোহার সিন্দুকের ভিতর যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সে কাহার মৃতদেহ, অনুসন্ধান করিয়া তাহার রহস্য উদ্ঘাটন কর।” 

সমাপ্ত 

[ বৈশাখ, ১৩১১ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *