মতিনউদ্দিনের প্রেম 

মতিনউদ্দিনের প্রেম 

মতিনউদ্দিন মেদমাংসশূন্য ক্ষীণ কাঠামোর ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষ। ক্ষিপ্রবেগে চলার অভ্যাস সত্ত্বেও পথেঘাটে সে সহজে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। বাচালতা দোষ নাই বলে অন্যদের মতো অজস্র কথায় সৃষ্ট একটি স্পর্শনীয় দৃশ্যমান চরিত্রও তার নয়। আপিসে দীর্ঘ বারান্দা-ঘরের সহযোগীদের মতো রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাপারে তার মতামত থাকলেও ক্বচিৎই তা সে প্রকাশ করে। কেবল চাল-ডালের দামের কথা উঠলে সে একটি বিশেষ মন্তব্য না করে যেন পারে না। একই ভঙ্গিতে একই স্বরে সে প্রতিবার বলে, শায়েস্তা খানের আমলে এক মন চাল পাওয়া যেত মাত্র দু-আনায়। উক্তিটা সত্য হলেও তা এখন সময়-কালবহির্গত এবং বাস্তব হতে এত দূরস্থিত শোনায় যে তার সে-ঐতিহাসিক মন্তব্যটি শূন্যে ঝুলে মিলিয়ে যায়। সে-মন্তব্যটিও তার সহযোগীদের মনে তার সম্বন্ধে স্বল্পভাষী নম্রলাজুক মানুষের ছবিটিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনে না। 

তবে বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র সে মানুষেরই চেহারা হাবভাবে একটি বিষম পরিবর্তন ঘটে। বাইরের মতিনউদ্দিন এবং ঘরের মতিনউদ্দিনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ইট-তর্জা-টিনযোগে কোনোমতে দাঁড় করিয়ে-রাখা তার ক্ষুদ্র বাসস্থানটি তার নতুন চরিত্রের স্পর্শে প্রাসাদে পরিণত হয়, এবং ঘরে তার স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো লোক না থাকলেও মনে হয় যেন তার হুকুম তামিল করবার জন্য মোসাহেব-গোমস্তা বাবুর্চিখানসামা পেয়াদা-হুঁকাবরদারের অন্ত নাই। তখন তার ত্রিশ-ইঞ্চি বুক থেকে অহরহ বাঘের মতো আওয়াজ বের হয়। তবে বন-জঙ্গলের শক্তিশালী পশুটির মতো তার সিনাটা গভীর নয় বলে মনে হয়, নিনাদপ্রচেষ্টায় যে-কোনো সময়ে তার রগ ফেটে যাবে। মতিনউদ্দিনের খড়মেও কম আওয়াজ হয় না। বরাবর দেখে-শুনে শক্ত মজবুত খড়ম কেনে সে। বস্তুত, তার ঘরের জাঁদরেল সত্তাটির একধারে তার গলা অন্যধারে খড়ম। 

তিন বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তার বউ খালেদা এখনো জানে না কখন তার স্বামী হুঙ্কার দিয়ে উঠবে, কখন হুড় ম করে লাফিয়ে যাবে উঠান থেকে কাককুত্তা তাড়াতে। সে-জন্যে সত্যিই পান থেকে চুন খসার প্রয়োজন নাই, উঠানে কাককুত্তার উপস্থিতিরও দরকার নাই। দিনের মধ্যে কতবার যে খালেদার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে, তার ঠিক নাই। 

খালেদাও ছোটখাটো মানুষ। গোপনে শরীরে একটু-যে মেদমাংস হয়েছে সে-খবরটা ঢাকতে চেষ্টা করে নিঃশব্দে আলগোছে হেঁটে, দেহটা কাপড়ে জড়িয়ে রেখে। অবশ্য এ-বিষয়ে তার লজ্জারও কোনো অর্থ নাই, সাবধানতাও নিষ্প্রয়োজন। মতিনউদ্দিন কখনো তার বউয়ের দিকে চোখ খুলে তাকায় না। তাকালেও বুঝবে না যে তার স্ত্রী কেমন একটু মোটাসোটা হয়ে উঠেছে। দোষভাবটা খালেদার মনেই। মোটা হওয়া মানে খেয়েদেয়ে সে আরামেই আছে। সে-কথা প্রকাশ করতে তার লজ্জা হয়। বিশেষ করে স্বামীটি যখন তেমন রোগাপটকাই থাকে। 

তারপর একদিন অকস্মাৎ মতিনউদ্দিনের মধ্যে একটি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটে। এমন আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটে বিনা খবরে, তার অব্যবহিত পূর্বে ক্ষীণতম ইঙ্গিত ছাড়া। পরিবর্তনটি শুরু হয় সকালেই, কিন্তু খালেদা তা লক্ষ্য করে সন্ধ্যাবেলায়। সেদিন আপিস থেকে ফিরে বেড়াঘেরা ক্ষুদ্র উঠানে বসে মতিনউদ্দিন কেমন নীরব হয়ে থাকে। বসার ভঙ্গিটা শিথিল, দৃষ্টি মাটির দিকে। নিত্যকার মতো চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে আসে খালেদা। মতিনউদ্দিন চা পান করে বটে কিন্তু অন্যদিনের মতো থেকে-থেকে তৃপ্তিসূচক উচ্চ আওয়াজ করে না। তারপর খালেদা হুঁকাটা নিয়ে এলে সে ধূমপানও করে, কিন্তু আজ ইঞ্জিনের ধুয়ার মতো রাশি-রাশি ধুয়া নির্গত হয় না, হুঁকার পানিতে দুর্দান্ত গড়গড় আওয়াজও হয় না। ধূমপান শেষ করেও মতিনউদ্দিন কেমন নিস্তেজভাবে বসে থাকে, বেড়ার ওপর বসে একটা কাক তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করলেও সে টু শব্দটা করে না। এদিকে সূর্য ডুবে যায়, আকাশে চাঁদ ওঠে, পাশের বাড়িতে ছেলেটি উচ্চকণ্ঠে ইতিহাস পাঠ খতম করে ঘুমোতে যায়। খালেদা চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু উঠান থেকে কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে না, খাবার তৈরি হয়েছে কি না। 

তিন দিন কাটলেও মতিনউদ্দিনের এ-অত্যাশ্চর্য ব্যবহার শুধু যে অব্যাখ্যাত থাকে তা নয়, তার সে-ব্যবহারে কোনো তারতম্যও হয় না। সেদিন রাতে খাবার সময়ে হারিকেনটা একটু তেজ করে রাখে খালেদা। স্বামীকে সে ভালো করে দেখতে চায়, যদি বুঝতে পারে তার পরিবর্তনের কারণ। সে দেখে, মতিনউদ্দিনের মুখে ব্যথা-বেদনার কোনো স্পর্শ নাই, থমথমে ভাবও নাই, কিন্তু গভীর ঘুম থেকে জেগে-ওঠার পর মানুষের মুখে যেমন একটা আবেশ দেখা যায়, তেমনি একটা আবেশে তার সারা মুখ আচ্ছন্ন। হাত-মুখ নড়ে, কিন্তু তার মনটা যেন ঘুমিয়ে। কিংবা দেহ-পরিত্যাগ করে তার মনটি কোথাও নিরিবিলি স্থানে গাছের ডগায় একাকী বসে আছে। 

খালেদার চোখ স্বামীর ওপরই থাকে বলে গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে যায়। মেঝেটা মাটির বলে সেটি না ভাঙলেও পানি ছড়িয়ে পড়ে। সভয়ে খালেদা স্বামীর দিকে তাকায়। কিন্তু স্বামীর চোখ বর্তন থেকে ওঠে না। তারপর খাদ্যের গন্ধ পেয়ে একটি লোমছাড়া কুকুর চোরের মতো অনিশ্চিতভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে তাকালে একটু অপেক্ষা করে খালেদাই আজ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেয়। 

এবার হঠাৎ খালেদার মনে হয়, মতিনউদ্দিনের ব্যবহার আর সহ্য করা যায় না। স্বামীর হুঙ্কারগর্জন লাফাঝাঁপি সহ্য হয়, কিন্তু তার এই পরিবর্তন সহ্য হয় না। কিন্তু সে কী করবে? স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করা যায় না। তিন বছরের পারিবারিক জীবনে তাদের মধ্যে এমন একটি আদত গড়ে উঠেছে যে, কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সহজ নয়। কাক-কুত্তা ত্যক্ত করলে তা নিয়ে কথা হতে পারে, কিন্তু স্বামী এক মাস কথা না বললেও তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না তার মৌনতার হেতু। অনেকে হাসি-ঠাট্টার মধ্যদিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে, গুরুতর কথারও উত্থাপন করে, মতিনউদ্দিনের ঘরে তা সম্ভব নয়। বিয়ের প্রথম মাসেই তার স্বামী পরিষ্কারভাবে তাকে বলে দিয়েছিল যে, হাসি-ঠাট্টার মানুষ সে নয়। একদিন রাতের বেলায় মতিনউদ্দিন যখন তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছিল, তখন মশকরা করে হালকাভাবে সে তার পিঠে একটু খোঁচা দেয়। তৎক্ষণাৎ মতিনউদ্দিন বিপুলবেগে লাফিয়ে উঠে রেগে লাল হয়ে তাকে প্রশ্ন করে, গুঁতা দেও কেন? সেদিন থেকে খালেদার মশকরায় কোনো সাধ নাই। অবশ্য তাতে খালেদার কোনো আফসোস নাই। তার মতে, স্বামীর আইনকানুন আচার-ব্যবস্থা স্ত্রীকে মানতেই হয়। 

কাজেই হারিকেন তেজ করে রাখলেও খালেদা শেষ পর্যন্ত স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করে না, তার পরিবর্তনের কারণও জানতে পারে না। তাতে অতি প্রত্যূষে উঠে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে স্বামীটি যখন আঙ্গিনায় বসে চুপচাপ হয়ে থাকে, তখন তার মনে একটা ভয়ের সঞ্চার হয়। তার স্বামীটির হল কী? 

জাগ্রতসময়ের প্রতি মুহূর্তে মানুষ কিছু-না-কিছু ভেবেই চলে। তবে প্রত্যেকের চিন্তাধারার স্বরূপটা নিজস্ব। খালেদার মনে চিন্তাধারাটি দুই বন্ধুর আলাপ-আলোচনার রূপ গ্রহণ করে। 

খালেদা তার মনের বন্ধুকে বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্ধু উত্তর দেয়, বোঝা মুশকিল। 

তারপর খালেদা এবং তার মনের বন্ধু দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকে।

নির্বাক হয়ে থাকলেও একটা কথা দুজনের মধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারে। কেবল সেটা তুলতে কারো সাহস হয় না। অবশেষে তার বন্ধুই বলে, আমার কী মনে হয় জান? 

কী? সে উত্তর দেয়। 

মনে হয় কোনো মেয়েলোকের ওপর তোমার স্বামীর দিল পড়েছে। 

সে টক করে উত্তর দেয় না। কথাটা সে যেন বোঝে না। দিল পড়ার অর্থ কী? কেনই-বা একটি পুরুষের দিল একটি মেয়ে মানুষের ওপর পড়ে? তাছাড়া, সে-ও কি মেয়েমানুষ নয়? 

তার মনের বন্ধু উত্তর দেয়, হয়তো মেয়েলোকটি সুন্দরী। 

খালেদা কিন্তু তার মনের বন্ধুর কথা মানতে চায় না। মাথায় একটু ঝামটা দিয়ে বলে, আমি জানি তার কী হয়েছে। 

কী হয়েছে? 

কোনো ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে। মনের বন্ধু হাসে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে না কচু হয়েছে। দেখ না কেমন যত্ন করে সিঁথি কাটে আজকাল, মুখে-চোখে কেমন আবেশ? 

খালেদা জবাব দেয় না। সে নিজেই বোঝে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়লে খোদা রসুলকেও মনে পড়ে। কিন্তু মতিনউদ্দিনের মধ্যে বিচিত্র পরিবর্তনটা আসার পর সে এক দিনও কলমা পর্যন্ত মুখে নেয় নাই। 

হয়তো তোমার কথাই ঠিক। সে মনের বন্ধুকে বলে। একটু থেমে আবার বলে, তবে চিন্তার কারণ নাই। ভেবেছিলাম, তার অসুখ-বিসুখ হয়েছে বুঝি। 

মনের বন্ধু মুখ টিপে হাসে। 

সুন্দরী মেয়েমানুষের ওপর তোমার স্বামীর মন পড়লে চিন্তার কারণ নাই? 

চিন্তার কী কারণ? গোয়ার্তুমির ভাব করে খালেদা উত্তর দেয়। 

যদি তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে বিয়ে করে? 

আবার কিছুক্ষণ খালেদা নীরবে ভাবে। তারপর আরেকবার মাথায় ঝামটা দিয়ে বলে, আমি চলে যাব। 

সে ভাবে, অন্য একটি বউ ঘরে নিয়ে এসে তাকে তাড়িয়ে দিলে সে বাপের বাড়িতে না-হয় ভাইয়ের বাড়িতে চলে যাবে। এখানে ভাত-কাপড়টা পায়, বাপ-ভাইয়ের বাড়িতেও ভাত-কাপড়টা পাবে। দেশের বাড়িতে ক্ষেতখামার আছে, কুমড়ো শাকসবজি আমকাঁঠাল আছে, গাই-ছাগল আছে, এখানে উঠান ছাড়া আছে কী? 

কিন্তু তুমি একটি মানুষের বউ। তাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না? 

আবার একটু ভেবে খালেদা জবাব দেয়, কষ্ট কিসের? যেতে হলে যাব। 

মতিনউদ্দিনের চিন্তাধারাটা ভিন্ন ধরনের। তার মনের প্রাসাদের থামের আড়ালে দেয়ালের আনাচে-কানাচে অসংখ্য শ্রোতা। তবে তারা নীরবেই তার কথা শোনে। কেবল তারই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি জাগে মনের সে-প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে। 

তবে তার মধ্যে ঘোর পরিবর্তনটি আসার পর তার চিন্তাধারার রূপটাও বদলেছে। আজ তার মনের প্রাসাদ নির্জন; সেখানে শ্রোতারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে নিঃসঙ্গ প্রাসাদের অসীম ভার সে একাই বহন করে বেড়ায়—আপিসে দীর্ঘ ঘরে হোক, মিষ্টিমধুর কলতানমুখর নদীতীরে হোক, আপন ঘরেই হোক। তার এই নিঃশব্দ জগতে একটি কাক পর্যন্ত নাই যে-একটু শব্দের লহরি তুলবে। 

আসলে একটা নিদারুণ ভয় পাথরের মতো ভারি হয়ে চেপে আছে তার মনে। সে–ভয়েই নিজের মনে কোনো কথা তুলতে সে সাহস পায় না। কী হয়েছে তার? 

সে বোঝে, ভয়ের তলে আসলে আছে একটি বিচিত্র স্নিগ্ধভাব—এমন-এক ভাব যার স্পর্শে এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে ফুটে ওঠে, ধানের ক্ষেতে মধুর হাওয়ার ঢেউ জাগে। সত্য কথা বলতে কী, সে প্রেমেই পড়েছে। কেবল কথাটা স্বীকার করার সাহস তার নাই। নাহলে পাথর ঠেলে যে-স্নিগ্ধ মনোরম ভাবটি বারেবারে তার মন ছেয়ে ফেলতে চায়, তাকে সে বাধা দিত না। 

সে যে তার পারিবারিক জীবনের বা খালেদার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আপন মনে এই সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তা নয়। বস্তুত, এ-পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও সে-সব কথা তার মনে পড়ে নাই। সে-যে দায়িত্বহীন তাও নয়। পারিবারিক শাসন-সংযমের খাতিরে কঠোর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তায় সে বিশ্বাসী বলে তার মনোভাবের বাহ্যিক কোনো পরিচয় সে দেয় না। কিন্তু খালেদার প্রতি তার স্নেহ-মমতা দায়িত্ববোধের অন্ত নেই। 

যে-কারণে পরিবারের কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনের আকাশে উদয় হয় না তা এই যে, তার হৃদয়ে যে-প্রেমের ভাবটি জেগেছে তা অতি বিচিত্র। আসলে তার কোনো বাস্তবরূপ নাই; সে-প্রেমের উৎপত্তি স্বপ্নের মধ্যেই। তবু আজ কদিন ধরে তা-তাকে গভীরভাবে আবিষ্ট করে রেখেছে। তার মানসিক সংগ্রামের এবং ভয়ের কারণ তাই। সে জন্যেই তার মনের প্রাসাদ কিচ্ছা-কাহিনীর অভিশপ্ত কোনো প্রাসাদের মতো নিস্তব্ধ, নির্জন! 

স্বপ্নের কথাটি সে ভাবতে চায় না। তবু বারবার তারই অজ্ঞাতে তার মনে তা ভেসে ওঠে এবং প্রতিবারই তাকে কেমন অবশ করে ফেলে। 

তার স্বপ্নটি এই। সে পুকুরে গোসল করতে যাচ্ছে, হাতে লাল গামছা! সেদিন কোনো কারণে তার বড় তাড়াতাড়ি। হয়তো আপিসে যাওয়ার সময় উতরে গেছে। ঘরে বউটিও রান্না করতে দেরি করেছে। গোসল করতে গিয়েও তার আবার দেরি হয়, কারণ সে দেখতে পায় পুকুরের ধারে মস্ত একটা বাজার বসেছে। মানুষের হৈ-হট্টগোল, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি, গরু-ছাগলের পায়ের ধুলায় স্থানটি ভরপুর। ভিড়ের মধ্যে অসংখ্য মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় দুর্ধর্ষগোছের একটি পুলিশ এসে তার হাত ধরে। তারপর মুহূর্তে কোথাও সব গোলমাল হয়ে যায় যেন। সে যেমন জানে তেমনি পুলিশও জানে, সে নির্দোষ। তবু সে দৌড়তে শুরু করে প্রাণপণে। শীঘ্র সে খোলা মাঠে এসে পৌঁছায়, উন্মুক্ত হাওয়ায় তার বুক ভরে ওঠে। পুলিশ তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবু তার ভয়টা সম্পূর্ণভাবে যায় না। ক্ষেতের আইল ধরে পূর্ণোদ্যমে আবার সে ছুটতে শুরু করেছে, এমন সময় সারা আকাশ খণ্ডবিখণ্ড করে একটি নারীর আর্তনাদ জেগে ওঠে। সে নারীর আর্তনাদে কী ছিল কে জানে, কিন্তু পুলিশের ভয় ভুলে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। শীঘ্র সে বুঝতে পারে, নারীকণ্ঠ আর্তনাদ করে তাকেই ডাকছে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে এদিক-ওদিক তাকায়, প্রথমে কোথাও কাউকে দেখতে পায় না। তারপর বিস্ময়ে সে দেখে, সামান্য দূরে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে একটি সুতন্বী নারী। তার পরনে উগ্র লালবর্ণের শাড়ি, মুখে কেমন বেদনাভরা নমনীয়তা। তাদের চোখাচোখি হতেই নারীটি তাকে হৃদয়বিদারক কণ্ঠে অনুরোধ করে, সে যেন তাকে ফেলে না যায়। পরক্ষণেই উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সে যেন বুঝতে পারে, মতিনউদ্দিন তাকে ফেলে চলে যাবেই। এ-সময় মতিনউদ্দিনের ঘুম ভেঙে যায়, স্বপ্নেরও অবসান ঘটে। 

স্বপ্নটি স্বপ্ন বলেই উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মতিনউদ্দিন। ক্রন্দনরতা যে-মেয়েকে সে জীবনে কখনো দেখে নাই, নিদ্রায় তার আবির্ভাব স্বপ্নের খামখেয়ালি এবং অর্থহীনতা ব্যতীত আর কী? বুদ্ধিমত্তার যুক্তি কিন্তু জয়ী হয় না। সব বুঝলেও সে অজানা মায়াময়ীর ডাক, তার অনুরোধ, তার কান্না ক্রমশ মতিনউদ্দিনের মনে একটা বিচিত্র মোহজাল বিস্তার করে। যে-কণ্ঠ সে শুনতে চায় না সে-কণ্ঠ বারবার তার মধ্যে অবিশ্বাস্য ঝংকারের সৃষ্টি করে, যার রেশ অবশেষে তার সমগ্র দেহে ছড়িয়ে তাকে গভীরভাবে অভিভূত করে। সে জানে স্বপ্নটির কোনো অর্থ নাই। তবু তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। বরঞ্চ তার মনে হয়, সে স্বপ্ন তার মধ্যে একটি নতুন সৌন্দর্যদীপ্ত আকাশ উন্মুক্ত করেছে, একটি সুপ্ত চেতনাকে জাদুমন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছে, একটি বিস্ময়কর ভাবাবেগের দ্বার খুলে দিয়েছে। ক্রমশ তার মনে হয়, নারীটি যেন অবাস্তব নয়, একটু চাইলেই সে সশরীরে উপস্থিত হবে। এ-কথায় সে ভয়ই পায়। 

তারপর আজ সন্ধ্যায় একাকী নদীতীরে বসে আরেকটি কথা উপলব্ধি করলে তার ভীতিটা আরো ঘনীভূত হয়। সে বুঝতে পারে স্বপ্নের সে নারীটি শুধু যে তার মনের সুখশান্তি ধ্বংস করেছে তা নয়, সংসার থেকেও তার মনকে যেন উঠিয়ে নিচ্ছে। খালেদা তার স্বপ্নের নারীর তুলনায় সোনার পাশে পেতলের মতো সস্তা, অলোভনীয় হয়ে পড়েছে। ভয়ে ক্ষণকালের জন্যে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে বোঝে, অবাস্তব যখন বাস্তবকে ধ্বংস করে তখন প্রত্যুত্তরে কিছু করবার থাকে না। বাস্তবের পক্ষে অবাস্তবের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো অস্ত্র নাই। 

স্বপ্নের মায়াময়ী নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করার অস্ত্র মতিনউদ্দিনের নাই। 

ক্ষুদ্র উঠানের কোণে খালেদাও একাকী বসে। অনেকক্ষণ ধরে একটি বাসনই সে বারেবারে মাজে-ঘষে। মনের বন্ধুর সঙ্গে কথালাপনে মগ্ন থাকে বলে তা সে লক্ষ্য করে করে না। 

মনের বন্ধু বলে, মেয়েলোকটি কেমন সুন্দরী তা তোমার জানতে ইচ্ছা করে না? 

খালেদা একটু ভাবে। সুন্দরী হওয়াটা কী? আসলে সে-কথাই তার সর্বপ্রথম জানতে ইচ্ছা করে। জীবনে সে বেশি মেয়েমানুষ দেখে নি। দেশের বাড়িতে কুলসুম আমেনাকে দেখেছে। এখানে পাশের ঝুনু বিবির সঙ্গে তার দেখা হয়। কিন্তু কখনো ভাবে নি কে কার চেয়ে বেশি সুন্দরী, কে-বা রূপবতী। কে কার বউ, বা মেয়ে, কার কী নাম, সে-সব কথাই মনে এসেছে। অবশ্য ছোটবেলায় পরীর কথা শুনেছে। কিন্তু তারা হাওয়াই বস্তু। মানুষের আটঘাটের বাইরে তাদের বিচরণ। 

কে জানে। হয়তো পরীর ওপর তার নজর পড়েছে। বলে সে হাসে। হাসিটা অবশ্য লোকদেখানো। তার বন্ধুর খাতিরেই সে হাসে। গম্ভীর হয়ে বলে, সুন্দরী হোক অসুন্দরী হোক, আমার তাতে মাথাব্যথা নাই। তবে আজকাল তার খাওয়াটা কমে গেছে। বাসনে হাত নাড়াচাড়া করেই উঠে যায়। কী করি? 

কী আর করবে? 

মনে হয় চোয়ালের নিচে গাল বসে গেছে। হয়তো অসুখই হয়েছে। 

জ্বর নাই, কাশি নাই, লোটা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি নাই—অসুখ আবার কিসের? 

তবে করি কী? 

কী আর করতে পার তুমি? 

একটু থেমে খালেদা আবার বলে, থেকে-থেকে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। মানুষটার হল কী? হাঁকাহাঁকি নাই, গলাবাজি নাই। হল কী তার? কবরের মতো নিঝুম ভাবটি আর সত্যিই সহ্য হয় না। একদিন আমিই এবার পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠব বলে দিলাম। 

কথাটি অবশ্য তার মনের বন্ধুরও বিশ্বাস হয় না। 

কিন্তু তা যে শূন্য ভয়প্রদর্শন নয়, খালেদা তার প্রমাণ দেয় সেদিন সন্ধ্যাবেলায়। আপিস থেকে ফিরে কাপড় বদলে উঠানে নিত্যকার মতো মতিনউদ্দিন চায়ের জন্যে অপেক্ষা করে। সে লক্ষ্য করে না যে চুলার তলে ঠাণ্ডা ধূসর ছাইয়ের স্তূপ, খালেদাও দরজার চৌকাঠ ধরে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে। চা না এলে সে একবার অস্পষ্টভাবে এদিক-ওদিক তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। খালেদা নড়ে না। সে একটি উল্লাসমিশ্রিত ভীতি বোধ করে। মনে হয় তার স্বামী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠে চা দাবি করবে। 

কিন্তু মতিনউদ্দিন কিছুই বলে না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে ঘুমঘোরের মতো উঠে ভেতরে যায়, শার্ট-জুতা পরে তারপর আবার উঠানে নাবে। খালেদাকে সে দেখেই না যেন। 

মতিনউদ্দিন যখন উঠানের মধ্যখানে পৌঁছয় তখন খালেদার দেহে কেমন অদম্য কাঁপন ধরেছে। সে নিজেই বুঝতে পারে না, তার কারণ রাগ না ভয়।

মতিনউদ্দিন ততক্ষণে উঠানটা অতিক্রম করেছে বটে কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যায় নাই। খালেদা দরজার চৌকাঠ শক্ত করে ধরে। তারপর তার দেহের সে-অদম্য কম্পন হঠাৎ একটি চিৎকারে কেন্দ্রীভূত হয়ে উচ্চ, তীক্ষ্ণ আওয়াজে ফেটে পড়ে। সে বলে, মানুষটি যাচ্ছে কোথায়? 

নিজের কানেই চিৎকারটি বিচিত্র শোনায়। 

বেড়ার পাশে মতিনউদ্দিন থমকে দাঁড়ায়; তার সারা মুখে গভীর বিস্ময়ের ছায়া। সে অবুঝের মতো এধার-ওধার তাকায়। তারপর তার দৃষ্টি ফিরে যায় খালেদার প্রতি। তার বিস্ময়টা আরো বেশি। নির্বোধের মতো তার নিচের ঠোটটি ঝুলে থাকে। সে যা দেখে তা তার যেন বিশ্বাস হয় না। 

সে-রাতে মতিনউদ্দিনের নিথর ভাবটি মাত্রাতিরিক্তই মনে হয়। রাতটাও কেমন গুমট ধরে আছে। কোথাও হাওয়া নাই। পাশে বান্ডিলের মতো নিস্তেজ হয়ে শুয়ে খালেদা কান খাড়া করে রাখে। তার স্বামীর চোখে যে ঘুম নাই সে কথা সে জানে। 

আজ মতিনউদ্দিনের নিদ্রাহীনতার কারণটি কিন্তু একদিনের মোহ নয়। বস্তুত, আজ সন্ধ্যায় বেড়ার নিকট হতে ফিরে আসার পর হঠাৎ সে বুঝতে পারে, স্বপ্নের সুতন্বী নারীটি তার হৃদয়বিদারক আবেদন ক্রন্দনসহ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন সজ্ঞানভাবে সে-নারীর কথা স্মরণ করলেও হৃদয়ে ভাবাবেগের ঢেউ ওঠে না, দেহে মধুর ঝংকার জাগে না। প্ৰথমে সে একটু ক্ষোভ বোধ করে, তারপর মনে স্বস্তিই পায়। এখন যে-কথা তার ঘুমের ব্যাঘাত করে তা হচ্ছে এই। স্বপ্নের মায়াময়ী নারীর হাত থেকে সে নিস্তার পেয়েছে বটে কিন্তু সে যেন এখনো ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করে নাই : সুতন্বী নারীটি তাকে নিরবলম্ব অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। যে-পাখায় ভর করে একদিন সে উড়ে বেড়িয়েছিল সে-পাখা আর নাই বটে কিন্তু সে তার পায়ের তলে শক্ত জমি এখনো ফিরে পায় নাই। তাছাড়া তার কণ্ঠেও এখনো ভাষা ফিরে আসে নাই। শুধু তাই নয়, হঠাৎ খালেদা সম্বন্ধে এমন একটি তীক্ষ্ণ সচেতনা সে বোধ করে যে একটু নড়বারও সাহস সে পায় না যেন। তবে তার সন্দেহ নাই, একবার সে ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারলে তার নিরবলম্বভাব, তার বাকশূন্যতা এবং খালেদার বিষয়ে তীক্ষ্ণ বেদনাদায়ক সচেতনাটি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু কী করে সে মৃত্তিকাময় স্থূল পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে, কী করেই-বা তার সাধারণ স্বাভাবিক জীবন পুনঃগ্রহণ করে? 

সাহায্য আসে অপ্রত্যাশিত অঞ্চল থেকে। 

বেহেশত-প্রেরিত একটি ফেরেশতা অতি দক্ষতার সঙ্গে তাদের মশারির মধ্যে অদৃশ্য একটি ছিদ্র আবিষ্কার করে। সে-ছিদ্র দিয়ে সে মশারিতে প্রবেশ করে কয়েক মুহূর্ত বিজয় উল্লাসে নৃত্য করে। অবশ্য তার আবির্ভাব অলক্ষিতই থাকে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছবার প্রশংসনীয় দক্ষতা সত্ত্বেও মনস্কামনা চরিতার্থ করার ব্যাপারে অশেষ ধৈর্য-অধ্যবসায় থাকা সত্ত্বেও ফেরেশতাটি একটি অতি ক্ষুদ্রকায় জীব, দিনের বেলায় তার ছায়া পড়ে না কোথাও, রাতের অন্ধকারে সে অদৃশ্যই থাকে। 

গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আনন্দোচ্ছ্বাসটি কাটলে বেহেশতপ্রেরিত ফেরেশতাটি এবার আপনকার্যে মনোনিবেশ করে। কাপড়ের বান্ডিলটি উপেক্ষা করে সরাসরি মতিনউদ্দিনের ঘর্মাক্ত ডান গালে সে অবতীর্ণ হয়। তার স্বীয় পাখা দুটিতে আলগোছে বার কয়েক ঝাপটা দিয়ে সে হঠাৎ নিশ্চল হয়ে পড়ে। 

একটু পরে অকস্মাৎ চাপড়ের মতো উচ্চ আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গে-সঙ্গে রাতের গভীর নীরবতা মতিনউদ্দিনের নিকট আর্তনাদে ভঙ্গুর কাচের মতোই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিজের গালে চাপড় দিয়ে এবং আর্তনাদ করেই মতিনউদ্দিন ক্ষান্ত হয় না। দুর্ধর্ষ গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলে, মশারিতে হাজারো মশা। কী করে মানুষ চোখ বোজে? 

তারপর মশারিতে যে মশার অন্ত নাই সে-কথাই প্রমাণ করার জন্যে সে ঠাঠাস্ করে নিজের দেহের নানা স্থানে চড়-চাপড় মারে। মশা মারতে সে কামান দাগে। 

অন্যদিন হলে খালেদা উঠে মশারিটা ঝেড়ে আবার সযত্নে গুঁজে দিত। আজ সে নড়ে না।

মতিনউদ্দিন অবশেষে শান্ত হয়। শত্রুবিজয়ী সেনাপতির মতো আত্মসচেতনভাবে কিছুক্ষণ নড়েচড়ে সে যখন ঘুমের আয়োজন করে, তখন তার পিঠটা খালেদার পিঠের সঙ্গে একটু লেগে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে সে সংস্পর্শ মধুর না হলেও মতিনউদ্দিন সরে না। 

খালেদার চোখে যখন নীরব অশ্রুর আবির্ভাব হয় তখন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে এমন রব তুলে মতিনউদ্দিন নাক ডাকাতে শুরু করেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *