মতবাদীর বিচারে রবীন্দ্রনাথ
০১.
ইংরেজ-শাসন ও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে অকালে, অতর্কিতে ও অভাবিতভাবে ঘটল আমাদের মধ্যযুগের অবসান। এ যেন অমাবস্যার নিশীথে হঠাৎ সূর্যোদয়, এ যেন কাঁচা ঘুমে জেগে উঠা। আধুনিক যুগের এই ঊষালগ্নে চকিত-চমকিত জনের মানস স্বাস্থ্যানুসারে কেউ বিমূঢ়, কেউ বিরক্ত আবার কেউ বা কৌতূহলী। নবযুগের সূচনায় যাকে সপ্রতিভ কৌতূহলী হিসেবে পাই তিনি রামমোহন। পশ্চিমী চেতনার বাতায়নিক বায়ু সেবনে তাঁর চিত্তলোক প্রসারিত–প্রতীচ্য জ্ঞানরশ্মিতে তার প্রজ্ঞালোক উদ্ভাসিত, তার উদ্যম উদ্দীপ্ত–তাই তিনি চঞ্চল, মুখর ও অক্লান্ত। তার মধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করি বুদ্ধির মুক্তি–পশ্চিমী জীবন-চেতনার প্রথম ফল।
পাশ্চাত্য হাওয়া অনেককাল কোলকাতার চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারেনি, কেননা, ইংরেজি শিক্ষা তখনো পরিব্যাপ্ত হয়নি মফস্বল অঞ্চলে। এখানেই আমরা বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত থেকে ইয়ং বেঙ্গল অবধি সবাইকে চেতনা-চঞ্চল দেখি। তখন পাশ্চাত্য নাস্তিক্য দর্শন, যন্ত্রবিজ্ঞান এবং ফরাসী বিপ্লবের মহিমাই ছিল মুক্তবুদ্ধি তরুণদের অনুধ্যেয়। অন্যেরা গ্রহণ-বর্জনের টানাপড়েনে দ্বিধান্বিত, কেউ কেউ বিপর্যস্ত। বস্তুত রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, রামকমল, কৃষ্ণকমল প্রভৃতি কয়েকজন ছাড়া তারুণ্যের অবসানে আর সবাই অর্থাৎ ইয়ং বেঙ্গলেরা হিন্দুয়ানীতেই স্বস্তি খুঁজেছেন ১৮৬০-এর আগে ও পরে। অবশ্য লালবিহারী, কৃষ্ণমোহন, মধুসূদন প্রমুখ খ্রীস্টানই রয়ে গেলেন। তখন ব্রাহ্ম হওয়া আর ব্রাহ্ম থাকাই ছিল চরম আধুনিকতা তথা প্রগতিশীলতা।
এভাবে নাস্তিক্য দর্শন তাঁদের জীবনে হল ব্যর্থ, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদ ছিল অনায়ত্ত আর ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব রইল অনাগত।
আগে ছিল ভূমি-নির্ভর কড়ির জীবন। এখন নগরে দেখা দিল বেনে সমাজের কাঁচা টাকার লেনদেন। নগুরে বাঙালি ব্রিটিশ বেনের বেনিয়া-ফরিয়া-কেরানী হয়েই সে-কাঁচা টাকার প্রসাদে ধনী ও মানী। বুর্জোয়া-জীবনের পরোক্ষ স্বাদ পেয়েই তারা ধন্য ও কৃতার্থ।
তারপর ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হল। প্রতীচ্য চেতনারশ্মি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সে-চেতনা ছিল গোড়া থেকেই বিকৃত, বিসদৃশ, অস্পষ্ট ও অজাতমূল। বৈশ্য বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যের মধ্যযুগীয় ভূমি-নির্ভর সামন্তিক সমাজে হঠাৎ করে চালু হল পশ্চিমের শিল্পায়ত সমাজের বুর্জোয়া অর্থনীতি। অকালে ও অস্থানে এই অতর্কিত ব্যবস্থা নিয়ে এল এদেশের নিস্তরঙ্গ আর্থিক জীবনে চরম বিপর্যয়। সাম্রাজিক শোষণ, ঔপনিবেশিকতা, যন্ত্ৰজাত পণ্যপ্রাধান্য, অটল সামন্তব্যবস্থা, জনগণের অশিক্ষা, বুর্জোয়া জীবনানুরাগ আর মনোজগতে শিক্ষালব্ধ মানবিক ও আত্মিক জীবন-চেতনার প্রসার প্রভৃতি এক অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম দিল, যার সমাধানবুদ্ধি ছিল না। বিমুগ্ধ, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত ও বিপর্যপ্ত জনগণের।
সামন্ততন্ত্রের বিলোপ, শিল্পবিপ্লব, বেনেবুদ্ধি, সাম্রাজ্যলি প্রভৃতি ছিল ইংরেজের জীবন চেতনাজাত ও সমাজ-প্রতিবেশ-পরিস্থিতি প্রসূত স্বাভাবিক জীবনচর্যার প্রসূন। সে-পরগাছা লালনের প্রস্তুতি ছিল না আমাদের দেশে। যে আবহাওয়ায় ও-সবের উন্মেষ ও বৃদ্ধি, সে-আবহাওয়া ছিল অনুপস্থিত ও অজ্ঞাত। তাই এদেশের মাটি ও-সবের কোনোটাই গ্রহণ করেনি বটে, কিন্তু সবগুলোর পীড়ন সইতে হয়েছে তাকে। অতএব, ইংরেজি শিক্ষার সূচনায় যে অকাল বসন্তের আভাস দেখা দিয়েছিল, রঙধনুর মতোই মিলিয়ে গেল সে-ক্ষণবসন্ত। বাসন্তী হাওয়া গায়ে লাগার আগেই যেন দেখা দিল হিমেল হাওয়ার দৌরাত্ম্য। কৃত্রিম আশ্বাস এভাবে বিদায় নিল অকৃত্রিম যন্ত্রণার জন্ম দিয়ে।
অজ্ঞ, মূক ও দৈব নির্ভর মানুষের দারিদ্র্য দুঃখ বেড়ে চলল বটে, কিন্তু এটি নিয়তির লীলা ও আল্লাহর মার বলেই জেনে আত্মপ্রবোধ পাওয়া কঠিন হল না। কাজেই কিসে কী হয়, সে তত্ত্ব রইল অজ্ঞাত।
যারা নগুরে তারা ইংরেজ বেনের উচ্ছিষ্ট পেয়েই ধনী ও ধন্য। ব্যবহারিক জীবনের ঐশ্বর্যে, চাকচিক্যে ও ভোগের নতুনতর রীতির আস্বাদনে তারা বিমুগ্ধ। যাদের বদৌলতে এ প্রাপ্তি, সেই ইংরেজ এখন তাদের প্রমূর্ত ভগবান। ছায়াকে কায়া বলে অনুভব করার বিড়ম্বনা তখনই টের– পাওয়ার কথাও নয়।
এঁদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ও মননশীল, তারা জীবনের অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতির ঈষৎ অনুভূত পীড়া ও বেদনা থেকে মুক্তি কামনায় য়ুরোপীয় জীবন প্রতিবেশের আর এক দান বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প চর্চায় আত্মনিমগ্ন থেকে চিত্তলোক প্রসারে আনন্দিত হতে চেয়েছেন।
য়ুরোপে যন্ত্র-শিল্পের প্রসার, মানসোৎকর্ষ ও বৈশ্য সভ্যতার বিকাশ তথা বুর্জোয়া সমাজের প্রাধান্য ছিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী অভিব্যক্তি এবং সে কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত। এর কোনোটাই অনুকূল ছিল না আমাদের দেশে। এজন্যে আমাদের জ্ঞানী-মনীষীরা য়ুরোপীয় জীবনের ও যুগের মর্মবাণী স্বরূপে উপলব্ধি করতে হয়েছেন অসমর্থ। তবু অবচেতন প্রেরণায় নতুন যুগ ও পরিবেশকে তারা গ্রহণে ছিলেন উনুখ, যদিও সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল সামান্যই। ব্যবহারিক জীবনে বুর্জোয়ার ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় ছিল না বলে তাদের সাধনা হয় অন্তর্মুখী। এভাবে আর্থিক জীবনে প্রতিহত হয়ে তারা মানবিক ও আত্মিক চেতনা প্রসারে হন প্রয়াসী। ব্যবসায় দ্বারকানাথের অসাফল্য দেশের স্বাদেশিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক চেতনা বৃদ্ধির নিমিত্ত হয়েছে, দেখতে পাই।
য়ুরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের ব্যবহারিক ও মানস ঐশ্বর্যে মুগ্ধ লুব্ধচিত্ত বাঙালির ঘরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এই ঘরে সামন্ত জীবনের দাপট ও বুর্জোয়া জীবনের ঐশ্বর্যের আশ্চর্য মিলন। হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবন বিকাশের পূর্ণতা লাভ করে। তার জন্মোত্তরকালে বুর্জোয়া সমাজের গ্লানি, ত্রুটি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। কিন্তু সে খবর উনিশ শতকেও এদেশে পৌঁছেনি। কাজেই বুর্জোয়া সমাজ; বেনে বুদ্ধি ও বৈশ্য সভ্যতাই ছিল শিক্ষিত বাঙালির অনুধ্যেয় জীবন স্বপ্ন। তাতে আবার ঠাকুর পরিবারের সন্তানেরা তখনো বুর্জোয়া জীবনের কোনো প্রসাদ থেকেই ছিলেন না বঞ্চিত। ধন-মান-যশ-প্রতিপত্তি যা-কিছু মানব কাম্য, যা-কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন তা ছিল জন্মসূত্রেই আয়ত্ত। এ জীবন দেশগত তথা প্রতিবেশ প্রসূত নয়-এ হচ্ছে দেখে শেখা ও পড়ে পাওয়া কৃত্রিম ও অনুকৃত জীবন– এ দেশে অজাতমূল। কাজেই গোটা দেশের প্রয়োজন ও সমস্যার সঙ্গে এ জীবনের যোগ ছিল না–তাই দায়িত্ব ও কর্তব্য চেতনাও ছিল অনুস্থিত। কিন্তু নেতৃত্বের সহজ অধিকার বশে তারা সভাপতিত্ব করতেন বটে, কিন্তু তাতে সেবার প্রেরণা ছিল না, ছিল সৌজন্যের আড়ম্বর।
এ হেন পরিবেশের সন্তান রবীন্দ্রনাথের অসামান্যতা এখানে যে তিনি মানুষ অবিশেষের প্রতি। প্রীতির অনুশীলনে সাফল্য লাভ করেছিলেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ মানুষের মানবিক গুণে ও আত্মিক উৎকর্ষে আস্থা রাখতেন, অনুকূল আবহাওয়ায় মানুষের সদ্বুদ্ধি ও সৌজন্যেই পীড়ন ও পাপমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে–এ ধারণা বশেই তিনি জাগতিক সব অন্যায়-অনাচারের ব্যাপারে মানুষের বিবেক ও বোধের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন। কোনো বাস্তব পন্থায় সমাধান প্রয়াস তার কাছে হয়তো মনে হয়েছে কৃত্রিম ও জবরদস্তিমূলক–যা স্বতঃস্ফূর্ত নয় বলেই টেকসই নয়।
দৈশিক পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক অমোঘতায় যে চেতনার জন্ম, সে-চেতনা সমস্যার প্রকৃতি ও সমাধানের উপায় নির্ধারণে সহজেই সমর্থ। কিন্তু যে-চেতনা পড়ে পাওয়া এবং পরিসুতি ও অনুশীলন প্রসূত তা তত্ত্বপ্রবণই করে–সক্রিয়তা দেয় না। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধও তাই। সংবেদশীলের মহাপ্রাণতাজাত সমস্যা-বিব্রত দেশকর্মীর নয়।
এজন্যেই তিনি চাষী-মজুরের হিতকামনা করেছেন, তাদের স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা দিতেও চেয়েছেন। সমবায় সমিতি গড়েছেন কিন্তু প্রজাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন নি। জমিদার যে পরোপজীবী ও পরস্বাপহারী তা উপলব্ধি করেও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদে সক্রিয় হন নি।
পীড়নমুক্ত মনুষ্য সমাজ দেখবার জন্যে তাঁর আবেগ ও আকুলতার অন্ত ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগও ছিল অশেষ। কিন্তু কৃত্রিম বুর্জোয়া পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন বলে সমাধানের বাস্তবপন্থা গ্রহণে ছিলেন অসমর্থ। এজন্যে রবীন্দ্রনাথ হিতকামী দার্শনিক–কর্মী পুরুষ নন।
কৌতূহল থাকলে তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ কার্লমার্কসকে (১৮১৮-৮৩) চাক্ষুষও করতে পারতেন। তাঁর প্রৌঢ় বয়সে রাশিয়ায় মার্কসের আদর্শ সমাজ মূর্তিলাভ করতেও দেখলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সে-প্রভাব অনুপস্থিত। এমনকি রাশিয়া স্বচক্ষে দেখেও তিনি দ্বিধামুক্ত হননি। মার্কসবাদের প্রয়োগক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল ভারতবর্ষ। কেননা বর্ণে বিন্যস্ত ও দারিদ্রক্লিষ্ট ভারতেই ছিল সাম্যবাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যেহেতু জনমনে ছিল মধ্যযুগের ঘোর, সামন্ত ও পেটি বুর্জোয়া জীবন ছিল প্রসারমুখী, এর জ্ঞানী-মনীষীরা ছিলেন বুর্জোয়া-জীবনের মানস-ঐশ্বর্যে বিমুগ্ধ এবং তার উপর ছিল পরাধীনের অসামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের অভাব; সেহেতু সাম্যবাদ এখানে শিকড় গাড়তে পারেনি। এ আবহাওয়ার সন্তান মানবতাবাদী মানবদরদী রবীন্দ্রনাথও তাই চিন্তানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। মার্কস পেলেন তার অবহেলা।
প্রসঙ্গত নজরুল ইসলামের নামও এ সূত্রে মনে পড়ে। স্বাধীনতা ও সাম্যকামী হয়েও তিনি মার্কসবাদ গ্রহণ করেননি। উভয়ের ক্ষেত্রেই কারণ সম্ভবত অভিন্ন। বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্ব বা তথ্য কিংবা উপায় বা আদর্শ আবেগগত না হলে তা জীবনে আচরণীয় হয়ে উঠে না। বিশেষ করে আস্তিক ও আত্মবাদীরা নাস্তিক্য ভিত্তিক ধনসাম্যবাদ মানতে চায় না। কেননা তাদের চেতনায় Man does not live by bread alone তত্ত্বের গুরুত্ব অশেষ। এ শ্রেণীর লোকই Animal Farm জাতীয় গ্রন্থে নিজেদের বোধ ও বিজ্ঞতার সমর্থন পেয়ে আশ্বস্ত ও আনন্দিত হয়। কিন্তু ধনসাম্য যে মানুষের দেহ-মন-আত্মার পার্থক্য মুছে দেয় না কিংবা সত্তার স্বাতন্ত্র ও স্বাধীন বিকাশ যে ব্যাহত করে না, ধনসাম্য যে শক্তিসাম্য ঘটায় না এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, প্রজ্ঞা, দর্শন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠা বুর্জোয়া কিংবা পুঁজিবাদী সমাজের মতোই যে সম্ভব, কেবল তা নয়; ব্যবহারিক, সামাজিক জীবনেও সামর্থ্যানুসারে প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি তা মান-যশ-প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে অক্ষুণ্ণ–বরং বাড়ে। কেননা ধনে লভ্য কৃত্রিম শক্তির প্রয়োগ এখানে অচল বলেই যোগ্যের প্রতিষ্ঠা লাভ যে সহজ–তা তারা বুঝতে চায় না।
ধন্যসাম্যবাদীরা খাদ্যবস্তুর অভাব, তার উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটিই মানুষের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা, পীড়ন-শোষণ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উৎস বলে বিশ্বাস করে। জীবিকা তথা খাদ্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন-আহরণ যারা করে তারা শ্রমজীবী শ্ৰেণী আর যারা কৃত্রিম উপায়ে পরোপজীবী তারা শোষক শ্ৰেণী। এদের সম্পর্ক হয়েছে উৎপাদক ও নিষ্ক্রিয় উপভোগীর, শোষক ও শোষিতের, পীড়ক ও পীড়িতের, বুর্জোয়া ও প্রলিতারিয়েতের, পুঁজিবাদী ও দরিদ্রের, সামন্ত ও ভূমিদাসের, মালিকের ও মজুরের, ধনী ও নির্ধনের, বেনের ও ক্রেতার, মহাজন ও খাতকের, মেহনতি জনতা ও পরশ্রমজীবী সবলের। কাজেই এদের মধ্যে সচেতন কিংবা অচেতন একটা দ্বন্দ্ব; বৈর কিংবা প্রতিপক্ষতা রয়েছে। এর নাম শ্রেণীসংগ্রাম। জীবন-চেতনার বিশেষ বিকাশের সঙ্গেই। এর শুরু। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি; জীবিকার দুর্লভতা, জীবনবোধের প্রসার ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এ সগ্রাম স্পষ্ট ও তীব্রতর হচ্ছে। অতএব মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে উৎপাদনে ও বণ্টনে সমতা বিধান করে প্রত্যেক মানুষের জীবিকার সুব্যবস্থা করার মধ্যেই। তাই মানবিক ভাব-চিন্তা কর্ম এই শ্রেণী- সংগ্রামের অবসান কল্পে উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যে নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক। এজন্যেই বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত প্রভৃতিরও এ সমস্যা সমাধানে হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে। এসবের আলাদা কোন উদ্দেশ্য বা সার্থকতা থাকতে পারে না– অন্তত থাকা উচিত নয়। এগুলো আগে পরশ্রমজীবী শোষকদের চিত্তবিনোদনে নিয়োজিত হয়েছে,এখন হবে শোষিতের মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক। কাজেই রাষ্ট্রসংস্থার নিয়ন্ত্রণে জনগণের কর্ম ও চিন্তাগত যৌথ প্রয়াসে মানবিক সমস্যার সমাধান ও জীবিকার সুব্যবস্থাই হচ্ছে দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।
রবীন্দ্রনাথ মার্কসবাদী ছিলেন না, তাঁর রচনা এই সংগ্রামী প্রেরণা প্রসূত নয়। তার মানবতাবোধ ও মানবপ্রীতি বুর্জোয়া উদারতার প্রসূন মাত্র। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য কালপ্রবাহে দেশের মৃত ঐতিহ্য মাত্র। এর মূল্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবেজীবনের উপকরণ রূপে নয়। অতএব বামপন্থীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্যের কোনো উপযোগ মূল্য নেই। এক্ষেত্রে মুসলিম তমদুনবাদীদের মতও স্মরণীয়। তাদের কাছেও রবীন্দ্রসাহিত্য তাদের সংস্কৃতিবিধ্বংসী। একদলের পক্ষে পরিত্যাজ্য বুর্জোয়া সাহিত্য বলে, অপর দলের কাছে অশ্রদ্ধেয় হিন্দুয়ানী বলে। তাদের ধারণায় রবীন্দ্রনাথ যুগের সৃষ্টি ও যুগধর–যুগোত্তর কিংবা যুগ প্রবর্তক নন।
.
০২.
অতএব রবীন্দ্রসাহিত্যের অপমৃত্যু আসন্ন! অবশ্য কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে। রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রাচীন কবি হবেন, তার অধিকাংশ রচনা মূল্য হারাবে–রবীন্দ্র-মহিমাও হবে ম্লান। ইতিমধ্যেই আধুনিক কবিতা ও গান রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। কিন্তু এত শিগগির যে রবীন্দ্রনাথ অশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠবেন, তা ছিল অভাবিত।
অবশ্য এর মধ্যে ভরসার কথা এই যে এ বিরূপতা বিচারের ফল নয়– আদর্শিক প্রতিপক্ষতার স্বাক্ষর মাত্র। আদর্শে অনুগত মানুষের বিচারশক্তি থাকে না–থাকে আচ্ছন্ন মনে advocacy-র প্রবণতা। আদর্শিক প্রয়াসের সিদ্ধিবাঞ্ছায় তারা চালিত হয় আবেগে–বিবেক-বুদ্ধি হয় অবহেলিত।
উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যেই-যে সমাজে ধনবৈষম্য ও তজ্জাত অন্যান্য সর্বপ্রকার উপসর্গের সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু সচেতন বা অচেতন শ্রেণীসংগ্রাম আধুনিক কালের চেতনাপ্রসূত–পুরাকালে এর উপস্থিতির সাক্ষ্য মেলে না। পৃথিবীর বিভিন্ন যুগের চিন্তানায়ক ও বিপ্লবীদের চেতনায় এর কোনো নজির পাইনে। মুসাতে দেখি পাপ-ভীতি, ঈসার মধ্যে পাই ধনভীতি ও প্রীতির কথা, হযরত মুহম্মদের বাণীতে দেখি দাস ও দরিদ্রের প্রতি দাক্ষিণ্যের কথা এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব কিন্তু ধন সাম্যের নয়। বুদ্ধে রয়েছে জন্ম-জরার ত্রাস আর করুণা ও মৈত্রীর কাক্ষা ও ধন-বিরাগ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পাই লোভের পরিণামভীতি ও ভোগে অনাসক্তির গুরুত্ব। চৈতন্য প্রচার করেছেন বৈরাগ্য ও ও প্রীতির মহিমা, কনফুসিয়াস কিংবা লাও সে (Lao tse) ধনসাম্যের কথা বলেননি। এঁদের সবারই আবেদন ছিল মানুষের আত্মার কাছে, সদ্বুদ্ধির প্রতি। এরা সবাই যুগানুগত ও মানবতাবাদী।
সুশৃঙ্খল সমাজ লক্ষ্যে সবাই চেয়েছেন নীতিনিষ্ঠা ও ন্যায়-সত্যের প্রতিষ্ঠা, উৎসাহ দিয়েছেন দয়া-দাক্ষিণ্যে–কিন্তু ধন বৈষম্যের অভিশাপের কথা কারো মুখে শোনা যায়নি। বস্তুত মার্কস-পূর্ব যুগে উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যই যে মানবিক যন্ত্রণার গোড়ার কথা এবং সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাস যে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিকথা, তা কখনো উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য এসব মনীষীর চিন্তা ও কর্মের মধ্যে যদি কেউ শ্রেণীসংগ্রাম এড়ানোরই অবচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করেন, তা হলে আমরা নাচার।
কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের চিন্তানায়ক রুশো-মন্টেগ-ভলট্যায়ার কিংবা মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন থেকে আজকের দিনের যে কোনো দেশের অধিকাংশ কম্যুনিস্ট নেতা, কর্মী কিংবা চিন্তাবিদ বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া এমনকি পুঁজিপতির সন্তান। Zeno থেকে Nicolite খ্রীস্টান বা জোসেফ প্রোচোন, বাকুনীন বা Hippie অবধি কোনো anarchist-ই গরিব ঘরের নন। কাজেই Suffering থেকেই সংগ্রামের শুরু অর্থাৎ শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম চিরন্তন–এই তত্ত্বে সত্য নেই। অতএব চিরকাল মানবিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা বা সংগ্রাম করেছেন মানবতাবাদীরাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শোষিত দরিদ্ররা এত প্রচারণার পরেও আত্মস্বার্থে ধনসাম্যতন্ত্রে তথা সমাজতন্ত্রে আজো উৎসাহবোধ করছে–না এটিই কি শ্ৰেণীচেতনা ও শ্রেণীসংগ্রামের অনুপস্থিতির বড় প্রমাণ নয়। এতে বোঝা যায় মানবতাবোধ, মানবপ্রীতি, সংবেদনশীল মন, সংগ্রামী প্রেরণা প্রভৃতি আবেগযুক্ত হলেই ব্যক্তিবিশেষ শোষণ-পীড়ন ও দারিদ্র্যমুক্ত মনুষ্য-সমাজ বাঞ্ছা করে কিংবা গঠনে উদ্যোগী হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন কালের মানবতাবাদী মানবদরদীরা সহানুভূতির আবেগেই সুশৃঙ্খল ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রত্যেকেই দেশকালের প্রেক্ষিতে জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের সামাজিক তথা আত্মিক কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। ক্রমে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে, জীবিকা হয়েছে অপ্রতুল, পৃথিবী হয়েছে সংহত, কাজেই সমস্যাও হয়েছে জটিল–সমাধানের উপায়ও হয়েছে বহু ও বিচিত্র। মার্কসোত্তর যুগে মার্কসপন্থীর সমাজতন্ত্র তাই মানব-সমস্যা সমাধানের নতুনতম পন্থা। গরিবদেশের সমস্যা সমাধানে সমাজতন্ত্র তথা ধনসাম্যবাদ প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী–তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটিও স্থায়ী সমাধান নয়, ঐতিহাসিক ধারার আধুনিক রূপ মাত্র।
অতএব হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই একই লক্ষ্যে কাজ করে এসেছেন, পার্থক্য কেবল পথ ও পদ্ধতির। সবাই মানবদরদী ও মানবতাবাদী। সবার জ্ঞান-বুদ্ধি অভিজ্ঞতা অভিন্ন ছিল না, কাজেই উপায়ও এক থাকেনি। মানুষের সমস্যাও পরিবেশগত। তাই সমাধান পদ্ধতিও হয়েছে স্থানিক ও কালিক। তাই কারো কল্যাণ প্রচেষ্টাই স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বকালিক ও সর্বমানবিক হয়নি।
রবীন্দ্রনাথও মানবতাবাদী। তিনি মুখ্যত কবি-মনীষী–কর্মী নন। তাঁর কর্তব্য ছিল মানুষকে আত্মিক চেতনায় প্রবুদ্ধ করা–বাস্তবে রূপায়ণ নয়। আবহমান কালের ধারায় তিনি যুগ-প্রতিনিধি। তার আবেদন মানুষের সদ্বুদ্ধি ও বিবেকের কাছে। ক্যুনিস্টদের আবেদনের লক্ষ্যও তাই। কম্যুনিস্ট বল প্রয়োগে বিশ্বাসী। মানবতাবাদী কবি স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণ-বুদ্ধির বিকাশে আস্থাবান। সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিকতাবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, অধ্যাত্মবাদী প্রভৃতি সংজ্ঞায় চিহ্নিত করে কোনো মানবতাবাদীকে বিচার করা অবিচারের নামান্তর। নিজের মত-পথকেই কেবল একমাত্র ও অভ্রান্ত ভাবা অসহিষ্ণুতা ও মানব-মনীষার প্রতি অশ্রদ্ধা তথা ব্যক্তিক সত্তার অবমাননার নামান্তর।
রবীন্দ্রনাথ নিজের সুদীর্ঘ জীবনে সমান্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তিনটেই স্বচক্ষে দেখেছেন– বুঝবার শক্তিও তার নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন আত্মিকবোধ না জন্মালে বাহুবলে আর্থিকসাম্য স্থাপন স্থায়ী হতে পারে না। বুদ্ধির সঙ্গে আবেগের যোগ না ঘটলে তা স্বভাবে পরিণতি পায় না। স্বেচ্ছা সম্মতি আর জবরদস্তির সায় এক বস্তু নয়।
কবি-মনীষী রবীন্দ্রনাথ মানুষের প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাবান করে তুলবার সাধনাই করেছেন, কল্যাণ ও সদ্বুদ্ধি প্রসূত স্বেচ্ছাসম্মতি দানে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছেন। মানবকল্যাণকামী স্বেচ্ছা-সৈনিক। তাঁর এই জীবন-দৃষ্টিকে বুর্জোয়া উদারতা ও দাক্ষিণ্য বলে উপহাস করা অসৌজন্য।
গল্পে-প্রবন্ধে-নাটকে-কাব্যে কত ভাবে তিনি দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, বিভেদ-বিরোধ, শোষণ-পীড়ন ও অপ্রেম-অশ্রদ্ধামুক্ত সমাজ-চিন্তা জাগানোর চেষ্টা করেছেন! ন্যায়যুদ্ধে কত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি!
তবু, তা কারো ism-সম্মত হল না বলে তাদের কাছে তা অকেজো ও অশ্রদ্ধেয়। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য আজ তাদের কাছে না ঘরকা না ঘাটকা! মানুষকে ভালবাসার এ এক অভিনব বিড়ম্বনা!