মণিপুরের সেনাপতি ৩

মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)

(অর্থাৎ টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের জন্ম হইতে ১৩ আগষ্ট ফাঁসী হওয়ার দিবস পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনার আশ্চর্য রহস্য! ) 

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

সন্ধির প্রস্তাব 

এই সময়ে মণিপুরিগণের আক্রমণ হইতে রেসিডেন্সি যে নিরাপদে ছিল, তাহাও নহে। দিবা ১০টার সময় কেল্লা হইতে গুলি সকল রেসিডেন্‌সি-অভিমুখে আসিতে লাগিল। ক্রমান্বয়ে গুলি আসিয়া রেসিডেন্‌সি আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। ওদিকে দিবা ১২টার সময় কতকগুলি মণিপুরী নাগা-সৈন্যের সহিত মিলিত হইয়া টিকেন্দ্রের কর্তৃত্বাধীনে রেসিডেন্সির অপর পার্শ্ব আক্রমণ করিল। সেই স্থানে যে অল্প পরিমাণ ব্রিটিশ সৈন্য ছিল, যুদ্ধ করিতে করিতে তাহাদিগের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতে লাগিল। দিবা দুই ঘটিকার সময় টিকেন্দ্রের নেতৃত্বে মণিপুরিগণ ২টি প্রকাণ্ড তোপ আনিয়া রেসিডেনসির সম্মুখে ও রাজবাটির তোরণের নিকট স্থাপিত করিল; এবং তাহা হইতে বজ্ৰনাদ গোলা-সকল বহির্গত হইয়া রেসিডেনসির উপর পড়িতে লাগিল। সেই স্থানে যে সকল সামান্য ইংরাজ-সৈন্য ছিল, তাহারা ক্রমে নির্বীৰ্য্য হইয়া পড়িল। তখন সেনাপতির বাড়ির ভিতর যে সকল সৈন্য ছিল এবং যে সকল সৈন্য ঐ বাড়ী বেষ্টন করিয়াছিল তাহারাও রেসিডেন্সিতে আসিয়া কর্ণেল স্কেনের সৈন্যের সহিত মিলিত হইয়া সম্মুখ-সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। উভয় পক্ষে তখন ঘোরতর সংগ্রাম চলিতে লাগিল। উভয় পক্ষ হইতেই অসংখ্য গুলিবর্ষণ হইতে লাগিল। যতই দিবা অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল, মণিপুরিগণের বিক্রম ততই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল কামানদ্বয় ততই প্রচণ্ড নাদে গোলা উদগীরণ করিতে লাগিল রেসিডেন্সির ঘর – সকল ক্রমে চূর্ণ বিচূর্ণ হইতে লাগিল। সেনাপতি যখন দেখিলেন, সমস্ত ইংরাজ – সৈন্য আসিয়া একত্রিত হইল তখন তিনি তাঁহার কেল্লার প্রাচীরের ভিতর হইতে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। এই প্রাচীরে যে সকল ছিদ্র প্রস্তুত ছিল ঐ ছিদ্র দিয়া অনবরত গুলি আসিয়া ইংরাজ সৈন্যের উপর পড়িতে লাগিল। ইংরাজ – সৈন্য মরিতে লাগিল; কিন্তু মণিপুরিগণ যে কোথা হইতে গুলি বর্ষণ করিতেছে, তাহা কেহই দেখিতে পাইল না। এইরূপে দিবা ৫টা পৰ্য্যন্ত ক্রমান্বয়ে উভয় পক্ষে গুলি বর্ষণ হইতে লাগিল। ইংরাজদিগের গুলি-বারুদ ক্রমেই কম পড়িতে লাগিল। 

এই সময়ে চিফ-কমিশনর দেখিলেন, বড়ই বিপদ। একবার ভাবিলেন, সমস্ত সৈন্য লইয়া রেসিডেন্সি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একটি ময়দানে গমন করি, ও সেই স্থানে মণিপুরিগণ আসিলে অদৃষ্টে যাহাই থাকুক, একবার সম্মুখ-সংগ্রাম করিয়া মরি। সে পরামর্শ কিন্তু হইল না। তখন, সন্ধ্যা ৭টার সময়, চিফ কমিশনর রাজাকে এক পত্র লিখিলেন; কি লিখিলেন, তাহা তিনিই জানেন। কিন্তু অনেকে বলিয়া থাকেন, এই পত্রের মর্ম্ম সন্ধির প্রস্তাব। সেই সময় ইংরাজগণ সন্ধি-স্থাপনের ‘বিউগিল’ বাজাইলেন; দেখিতে দেখিতে, মণিপুরী সৈন্যগণও গুলিবর্ষণে নিরস্ত হইল। ইহার অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে রাজার নিকট সেই পত্রের বাঙ্গালা ভাষায় উত্তর আসিল। তাহাতে অনেক কথা লেখা ছিল। মণিপুরিগণ ইংরাজকে যে কতবার সাহায্য করিয়াছে, তাহাতে ইহারও উল্লেখ ছিল। পরিশেষে মহারাজ লিখিয়াছিলেন, “যদি অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া দিবা,” তাহা হইলে মণিপুরিগণও নিরস্ত হইবে। 

ইতিমধ্যে একজন মণিপুরী দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে, সেনাপতি চিফ-কমিশনরের সহিত দেখা করিয়া এই সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিবার নিমিত্ত রাজবাটীর অর্দ্ধপথে দণ্ডায়মান আছেন। সেই স্থানে যদি চিফ-কমিশনর সাহেব বিনা অস্ত্রে গমন করেন, তাহা হইলে কথাবার্তা ও বন্দোবস্ত শেষ হইতে পারে। অনেক ইতস্ততঃ করিয়া ও পলিটিকেল এজেন্টের পরামর্শ-মতে, পরিশেষে চিফ-কমিশনর সাহেব সেই স্থানে গমন করিতে সম্মত হইলেন; স্কেন, গ্রিমউড, কলিনস্ ও সিসনকে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে বিনা অস্ত্রে ও বিনা-সৈন্যে গমন করিলেন। 

কেল্লার নিকট সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতের সহিত সাক্ষাৎ হইল। উভয়ের মধ্যে কি কথাবার্তা হইল। পরিশেষে সকলে কেল্লার ভেতর প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে সেনাপতি ইংরাজ-কর্ম্মচারি গণকে সমস্ত অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া সেই রাত্রেই মণিপুর হইতে প্রস্থান করিতে কহিলেন। কিন্তু চিফ কমিসনর সাহেব সেই প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলেন না। এ সম্বন্ধে নানারূপ আলোচনা প্রায় দুই ঘণ্টাকাল চলিতে লাগিল। সেই সময় পুনরায় মণিপুরী সৈন্যের কোলাহল উত্থিত হইল। তাহার ভিতর হইতে কেহ কেহ বলিল, — “ আমাদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রে আছে যে, মণিপুরে একটি ভয়ানক যুদ্ধ উপস্থিত হইবে, ও সেই যুদ্ধে ৫জন শত্রুপক্ষ কৰ্ম্মচারীকে দেবী-সম্মুখে বলিদান না দিলে সেই যুদ্ধে মণিপুরি গণ জয়লাভ করিতে সমর্থ হইবে না। এই ব্যবস্থা দেখিয়া সেনাপতি সৈন্যগণকে নিরস্ত হইতে কহিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহার কথা শুনিল না; বরং কহিল, “আমরা কেবল তোমার নিমিত্তই আমাদিগের প্রাণ অর্পণ করিতেছি, ও তুমিই এ যুদ্ধের মূল। যদি তুমি এখন আমাদিগের ইচ্ছার প্রতিবন্ধক হও, তাহা হইলে জানিও যে, তুমিও আমাদিগের হস্তে হত হইবে।” সৈন্যগণের এই কথা শুনিয়া সেনাপতি, কুইণ্টন প্রভৃতি ইংরাজ কর্মচারিগণকে সেই সময় বহির্গত হইতে নিষেধ করিলেন। কিন্তু তাঁহারা তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন।* 

[* “They all went to the road-side and had a talk with the Senapati, and after a few minutes entered into the palace where the Chief did not agree with the terms, viz, to leave Manipur by night, leaving arms behind, Arguments went on for two hours. In the meantime an infuriated mob assembled on all sides. The Senapati ordered his buglers “order order”, but this orders had no effect. The mob were labouring under an impression that, in their holy books it is said, that there will be a great war at Manipur which will not be won, till the blood of 5 of the enemies was given to certain Gods, and their heads buried in a certain ditch. When the Senapati orderd them to dispurse, some said,-”We are giving our lives only for you and you are the cause of this war: if you still obstruct, we will kill you too.” The Chief then wanted to return. The Senapati pointed to him the danger on the way and repeatedly told the party not to leave the palace.” 

Amrita Bazar Patrika, Dated 4th July, 1891.]

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

ইংরাজের পরাজয় ও হত্যা 

যেমন তাঁহারা বহির্গত হইলেন, অমনি গ্রিমউড সাহেবের উপর অস্ত্রাঘাত হইল; তিনি সেই স্থানে যেমন পতিত হইলেন, অমনি ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। চিফ কমিশনর প্রভৃতি অপর কয়েক ব্যক্তিও সৈন্যগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া প্রধান জল্লাদ সাগনসেনকা-দানা সিংহের হস্তে অর্পিত হইলেন। সেই সকল সৈন্যের মধ্যে থঙ্গেল জেনারেল ছিলেন। সৈন্যমাত্রই সেই বৃদ্ধের আজ্ঞাধীন, তাঁহার বিনা অনুমতিতে কেহই কিছু করিতে সমর্থ নহে; সুতরাং এই ইংরাজ কয়েকজনকে হত্যা করিবার অনুমতি তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিল। তিনি উহাদিগকে হত্যা করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। কেহ কেহ বলেন, টিকেন্দ্রজিৎও সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, এবং তিনিও ইহার অনুমোদন করিলেন। পরিশেষে তাঁহাদের অদৃষ্টেও যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সকলেই বুঝিতে পারিতেছেন। মহারাণীর পাঁচ জন প্রধান কৰ্ম্মচারী সেই প্রাসাদের ভিতরই মানবলীলা সম্বরণ করিলেন। সেই সময় হইতে পুনরায় গুলি চলিতে আরম্ভ হইল। আবার ইংরাজ সৈন্যগণও অস্ত্রধারণ করিল, আবার উভয় পক্ষে ঘোর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। রাত্রি ২টা পর্যন্ত এইরূপ যুদ্ধ চলিতে লাগিল; ইংরাজ-সৈন্যের গুলিবারুদ প্রভৃতি যাহা ছিল, সমস্তই নিঃশেষ হইয়া গেল। তখন অনন্যোপায় হইয়া অবশিষ্ট ইংরাজ-সৈন্য পলায়ন করিল। সকলেই রেসিডেনসির পশ্চাৎ দরজা দিয়া বহির্গত হইয়া প্রাণভয়ে কাছাড়ি-অভিমুখে দ্রুতপদে ছুটিতে লাগিল। গ্রিমউড সাহেবের স্ত্রীও অনন্যোপায় হইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলেন। তাঁহার পরিধানে একমাত্র কাপড় ও পদে একযোড়া সামান্য বিনামা ভিন্ন আর কিছুই ছিল না; এমন কি, তাঁহার টুপিটি পর্যন্ত লইতেও তিনি অসমর্থ হইয়াছিলেন। 

রেসিডেনসি হইতে যেমন সকলে বহির্গত হইল, মণিপুরিগণও অমনি তাহার ভিতর প্রবেশ করিল। তাহার ভিতর ধন-ভাণ্ডার ছিল, উহা লুট হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে রেসিডেন্সিতে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল, ও মুহূর্ত্ত মধ্যে উহা ভস্মে পরিণত হইল। 

যে সকল সৈন্য সেই স্থান হইতে পলায়ন করিয়াছিল, তাহারা সকলেই নিরাপদে গমন করিতে পারিল না; প্রায় অনেকেই মণিপুরী সৈন্য কর্তৃক ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হইল। পলায়ন করিতে গিয়া যাহারা কয়েদী অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল, তাহারা কিন্তু কেহই কয়েদীর যন্ত্রণা ভোগ করে নাই। পরে টিকেন্দ্রজিৎ সকলকেই অভয় প্রদান পূর্ব্বক মুক্তি-প্রদান করিয়াছিলেন। 

ইংরাজের এই ভয়ানক দুর্ঘটনার কথা ক্রমে প্রকাশ হইল। কিন্তু প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীগণ যে কাল-কবলে পতিত হইয়াছেন, তখন তাহা কেহই জানিতে পারিল না। সকলেই জানিল যে, তাঁহারা বন্দী হইয়াছেন; সকলেই শুনিল যে, ইংরাজ কৰ্ম্মচারী ও সৈনিকের দ্বারা মণিপুর কারাগার পরিপূর্ণ হইয়াছে। 

এই সংবাদ ক্রমে সুদূর সিমলা-শৈলে গিয়া উপস্থিত হইল; মহারাণীর প্রতিনিধির কর্ণে গিয়া পৌঁছিল। কোন উপায় অবলম্বন করা কর্তব্য, গবর্ণর জেনারেল সাহেব তখন তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। 

চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

মণিপুর-জয় 

প্রথম পরাজয়-সংবাদ পাইয়া গবর্ণর জেনারেল সাহেব ইংরাজ সৈন্যের দুর্গতির কথা একটু ভাবিলেন, ও কয়েদীদিগকে মুক্ত করিবার উপায় স্থির করিতে লাগিলেন। এমন সময় সেই লোমহর্ষণকর সংবাদ আসিয়া তাঁহার কর্ণে উপনীত হইল। তখন জানিতে পারিলেন যে, চিফ কমিসনর প্রভৃতি প্রধান প্রধান কৰ্ম্মচারিগণ, মণিপুরিগণ কর্তৃক অকালে কালকবলে প্রোথিত হইয়াছেন। এই সংবাদে তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন, ও তৎক্ষণাৎ মণিপুরিগণের এই নৃশংস কার্য্যের প্রতিবিধানের নিমিত্ত আয়োজন করিতে লাগিলেন। 

জেনারেল গ্রেহেম সাহেব তখন মণিপুর গমনের নিমিত্ত আদেশ প্রাপ্ত হইলেন। মেকেব সাহেব পলিটিকেল এজেন্টের পদ গ্রহণ করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন। * সপিট সাহেবও তাঁহাদের অনুগমন করিলেন। সিলচরে যে সৈন্য ছিল, মেকেব সাহেব তাহারই নেতা হইলেন। ভারতের চতুর্দিক হইতে কেবল সৈন্য সকল মণিপুর- অভিমুখে ছুটিতে লাগিল; গুলি-বারুদ লইয়া অসংখ্য শকট সকল রওনা হইল; নানাস্থানের নানাপ্রকারের, নানা শ্রেণীর সৈন্যগণকে বহন করিয়া অসংখ্য স্পেসাল ট্রেণ যাতায়াত করিতে লাগিল। ভলেন্টিয়ারগণও পরিশেষে বন্দুক হস্তে মণিপুর-যুদ্ধে যোগদান করিবার প্রত্যাশায় সেই স্থানে দলে দলে গমন করিতে লাগিলেন। ব্যাণ্ড সকল যেন রণবাদ্যে উন্মত্ত হইয়া, সৈন্যদলের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। 

[* See telegram No. 65-E, dated 6th April, 1891, and No. 708-E, dated 13th April, 1891, from foreign Secretary to Government of India to General Graham. ]

জেনারেল গ্রেহেম সাহেব চতুরঙ্গ সৈন্য সুশোভিত হইয়া মণিপুর-যাত্রা করিলেন। সেই স্থানে গমনপূর্ব্বক তিনি প্রথমেই ঘোষণা করিলেন যে, মণিপুর রাজবিদ্রোহী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহারাণীর বিপক্ষে মণিপুর যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে— মহারাণীর প্রধান প্রধান কৰ্ম্মচারিগণকে বিনা দোষে মণিপুর হত্যা করিয়াছে। সুতরাং তিনি আজ তাহার প্রতিবিধান করিতে আগমন করিয়াছেন। 

গ্রেহেম সাহেব যেরূপ দর্পের সহিত ও যেরূপ সৈন্যের সহিত মণিপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, তাহাতে তাঁহার গতিরোধ করিতে কে সমর্থ হইবে? তাঁহার সম্মুখীন হইতে কে সাহস করিবে? কিন্তু টিকেন্দ্রজিৎ একেবারে আত্মসমর্পণ করিলেন না। তিনি যতক্ষণ পারিলেন, সম্মুখ যুদ্ধে ততক্ষণ দণ্ডায়ামান রহিলেন। যুদ্ধও যে নিতান্ত কম হইল, তাহা নহে; উভয় পক্ষেরই ক্ষতি হইতে লাগিল। কিন্তু মণিপুর বিশেষ ক্ষতি সহ্য করিলেন। পরিশেষে ইংরাজ-সৈন্য মণিপুরের কেল্লা দখল করিয়া লইল। ভীষণ তোপের সম্মুখে রাজবাড়ি অভগ্ন অবস্থায় থাকিতে পারিল না। স্থান স্থান চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া স্তূপরাশিতে পরিণত হইল। গুলি, বারুদ, তোপ, কামান, বন্দুক, তরবারী, খাদ্য প্রভৃতি যাহা ছিল, সমস্তই ইংরাজের হস্তে পতিত হইল। উষ্ট্র, হস্তী প্রভৃতি যাহা ছিল, সমস্তই ইংরাজের হইল। সৈন্য সকল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া যে যেদিকে পাইল, পলায়ন করিল। অনেকে ধৃত হইয়া সেই স্থানে কারারুদ্ধও হইল। গ্রেহেম সাহেব তখন মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিয়া আপনার আয়ত্ত্বাধীন করিলেন, ও মণিপুর-পতাকার পরিবর্তে ব্রিটিশ-পতাকা সেই স্থানে উড্ডীয়মান হইল! 

যখন মণিপুর দখল হইল, তখন টিকেন্দ্রজিৎ ও কুলাচন্দ্র প্রভৃতি রাজবংশীগণ —- যাঁহারা ইংরাজের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া ব্রিটিশ—কর্ম্মচারিগণের এরূপ দুর্দ্দশা করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত সৈন্য-সকল রাজবাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল, কিন্তু কাহাকেও প্রাপ্ত হইল না। তাঁহারা যে কখন সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহা কেহই জানিতে পারিল না। তখন উহাদিগকেও ধরিবার নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল, চতুৰ্দ্দিকে সৈন্য-সামন্ত প্রেরিত হইতে লাগিল; কিন্তু কোন দিকেই তাঁহাদিগের কোনরূপ সংবাদ পাওয়া গেল না। 

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

টিকেন্দ্রের ধৃত হওন ও বিচার 

সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ ও কুলাচন্দ্র প্রভৃতি যাঁহারা রাজধানী পরিত্যাগ-পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত ইংরাজরাজ যে কত চেষ্টা করিলেন, তাহা বলা যায় না। পরিশেষে কিন্তু যখন কোন ফলই ফলিল না, তখন উপযুক্ত পারিতোষিকের প্রলোভন প্রদর্শিত হইল। ইহার কয়েক দিবস পরেই কুলাচন্দ্র ধৃত হইলেন; কিন্তু কেহই টিকেন্দ্রের কোন সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলেন না। পাঠকগণ শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, টিকেন্দ্রকে ধরিবার নিমিত্ত যখন এত আয়োজন ও এত চেষ্টা হইতেছে, ইহা জানিয়াও, টিকেন্দ্র তখন রাজস্থানীর দূরবর্তী স্থানে গমন করেন নাই। নিকটবর্ত্তী সামান্য পল্লীর ভিতর অবস্থিতি-পূর্ব্বক রাজধানীতে কি হইতেছে না হইতেছে, তাহার সংবাদ প্রত্যহই সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। 

টিকেন্দ্রজিৎ যে স্থানে লুক্কাইত ছিলেন, ২৪শে তারিখে তাহা সরমাভেলির সুবেদার কুলেন্দ্র সিংহ ও গারো-হিল- পুলিশের সিপাহী আনুসিংহ জানিতে পারিয়া, ইংরাজ-পলটনে সংবাদ প্রেরণ হইবার পূর্ব্বেই টিকেন্দ্র সিংহ জানিতে পারেন। এই সংবাদ টিকেন্দ্র সিংহ যেমন অবগত হইলেন, অমনি একাকী বিনা সহায়ে ও বিনা অস্ত্রে সেই স্থান পরিত্যাগ করিলেন। কুলেন্দ্র সিংহ ও আনু সিংহ সেই সময় সেই স্থানেই ছিলেন। তাঁহারা পলটনের সাহায্য পাইবার প্রত্যাশা না করিয়াই, আপনাদিগের সাহসের উপর নির্ভর-পূর্ব্বক টিকেন্দ্রকে ধরিবার নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন এবং হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে গমন-পূর্ব্বক তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলেন। টিকেন্দ্র পলাইবার নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা আর করিলেন না। তবে ধরিবার সময় ধৃতকারিদ্বয় ও টিকেন্দ্রের সহিত একটু সামান্য ধস্তাধস্তি মাত্র হইয়াছিল; এবং তিনজনেই জড়াজড়ি করিয়া সেই স্থানেই মৃত্তিকার উপর পতিত হইয়াছিলেন। ধরিবার সময় টিকেন্দ্র যদি আপনার প্রকৃত বল প্রকাশ করিতেন, তাহা হইলে তাঁহাকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ হইত না। কিন্তু কি জানি কি ভাবিয়া, টিকেন্দ্র বিশেষ বল প্রকাশ না করিয়া আত্মসমর্পণ করিলেন। 

টিকেন্দ্রজিৎ ২৫শে জুন তারিখে ধৃত হইলেন। তাঁহার ধৃত সংবাদ শ্রবণে সেই স্থানের ইংরাজ ও ইংরাজ- কর্ম্মচারিগণের মধ্যে মহা আনন্দ-স্রোত প্রবাহিত হইল। টিকেন্দ্র বন্দীভাবে কারাগারে প্রেরিত হইলেন; তাঁহার বিচারের দিন স্থির হইল। 

১লা জুন তারিখে টিকেন্দ্রের বিচার আরম্ভ হইল। লেপ্টেনান্ট কর্নেল জন ফারকোর্ট মিচেল, মেজর আর, কে, রিগওয়ে এবং নাগা-হিলের ডেপুটী কমিসনর এবং ডব্লিউ, ডেভিস এই তিনজন কর্মচারির হস্তে তাঁহার বিচারভার অর্পিত হইল। এক এক করিয়া অনেক সাক্ষ্যের সাক্ষ্য গৃহীত হইতে লাগিল, ও এইরূপ ক্রমান্বয়ে ১০ দিবস বিচারের পর মহারাণীর বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং ইংরাজ কৰ্ম্মচারিগণের হত্যায় সহায়তা করা প্রভৃতি অপরাধে তাঁহার দোষ সাব্যস্ত হইল। তিনি আইনের চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবার আজ্ঞা প্রাপ্ত হইলেন। * যে পর্য্যন্ত তাঁহার জীবনবায় বহির্গত না হয়, সেই পর্য্যন্ত তাঁহার গলায় রজ্জু বাঁধিয়া ঝুলাইয়া রাখিবার আজ্ঞা ১৩ই জুন তারিখে প্রদত্ত হইল, ও সেই দণ্ডাজ্ঞা স্থির রাখিবার জন্য সমস্ত কাগজপত্র মহামান্য গবর্ণর জেনারেল ল্যান্সডাউন সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। 

টিকেন্দ্রজিৎ প্রাণের আশা পরিত্যাগ-পূর্ব্বক একবার শেষ উপায় অবলম্বন করিলেন। প্রাণভিক্ষা চাহিয়া গবর্ণর জেনারেল সাহেবের নিকট এক আবেদন করিলেন, এবং তাঁহার পক্ষ হইতে তাঁহার দুঃখকাহিনী বলিবার নিমিত্ত কৌন্সলী শ্রীযুক্ত মনোমোহন ঘোষকে নিযুক্ত করিলেন। প্রথমে গবর্ণর জেনারেল সাহেব ১০ই জুলাই পর্যন্ত তাঁহার আবেদনের দিন স্থির করিয়া দেন, কিন্তু মনোমোহন বাবু বিশেষরূপে ওজর-আপত্তি প্রদর্শন করায়, পরিশেষে সেই দিন ৩১শে জুলাই স্থির হয়। কিন্তু গবর্ণর জেনারেল বাহাদুর নিজে বক্তৃতা শুনিতে অসম্মত হয়েন, এবং তাঁহার যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা লিখিয়া জানাইতে অনুমতি দেন। 

এই অনুমতি-প্রাপ্তে মনোমোহন ও লালমোহন দুই ভাই বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম পূর্ব্বক একখানি সুদীর্ঘ আবেদন- পত্র প্রস্তুত করেন, এবং এই সম্বন্ধীয় বিষয়ে তিনি যাহা কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই ইহার ভিতর সন্নিবেশিত করেন। ঐ আবেদন-পত্র ৩১শে জুলাই তারিখে শ্রীযুক্ত বড়লাট বাহাদুরের সমীপে প্রেরিত হয়। 

এদিকে মণিপুর-সম্বন্ধীয় বিষয় লইয়া, টীকেন্দ্রকে দরবার ধরিবার ষড়যন্ত্র করিবার উপায় করা প্রভৃতি নানা বিষয় লইয়া বিলাতে হুলস্থুল পড়িয়া যায়। কেহ বা টিকেন্দ্রের পক্ষ, কেহ তাঁহার বা বিপক্ষ-পক্ষ অবলম্বন-পূর্ব্বক পার্লিয়ামেন্টে নানারূপ সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেন। সেই সকল বিষয় আনুপূর্বিক বর্ণনা করিতে হইলে, এই পুস্তকের কলেবর নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়ে বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। 

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

টিকেন্দ্র-সম্বন্ধে দুই একটি কথা 

টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের বয়ঃক্রম এখন ৩৭ বৎসর মাত্র। এই সামান্য বয়সের মধ্যে তিনি না করিয়াছেন কি? যখন তাঁহার বয়ঃক্রম ২৫ বৎসর, সেই সময়ে তিনি প্রথম পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন, ও ক্রমে ক্রমে আটটি দার পরিগ্রহ করেন। তাঁহার একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। সেই পুত্রের নাম চৌবা। তাঁহার বয়স এখন ৯ বৎসর মাত্র। এখন টাকেন্দ্র এই নাবালক পুত্র ও বিধবা স্ত্রীগণকে পরিত্যাগ-পূর্ব্বক গমন করিতেছেন, ইহা কি কম কষ্টের ও দুঃখের কথা! 

টিকেন্দ্র! তুমি ইংরাজের জন্য না করিয়াছ কি? সেই ভীষণ নাগা-যুদ্ধে যদি তুমি, আপনার প্রাণের মায়া পরিত্যাগ না করিয়া, দেড় মাস কাল সেই ভীষণ সমরার্ণবে সম্ভরণ না করিতে, তাহা হইলে ইংরাজের কি দশা হইত? তুমি গ্রিমউডের একজন প্রাণের বন্ধু ছিলে; তাঁহার নিমিত্ত তুমি কোন কার্য্য করিতেই পরাম্মুখ হইতে না; মান-অপমানের দিকেও দৃষ্টি-নিক্ষেপ করিতে না। কেবল গ্রিমউডের কেন, তুমি যে সকলেরই প্রিয় ছিলে, তুমিই ইংরাজকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত আপনার জাতীর দিকে, আপনার ধর্ম্মের দিকে দৃকপাতও না করিয়া মণিপুরী স্ত্রীলোকদিগের ফটোগ্রাফ লওয়ায় সহায়তা করিয়াছিলে! 

তুমি মণিপুরকে যে কতবার বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছ, আপন জন্মভূমির দুরবস্থা যে তুমি কতবার মোচন করিয়াছ, তাহা বর্ণন করিতে কে পারে? তোমার পরাক্রমেই বড় চৌবার দুর্গতি হইয়াছে; তুমিই বল্কোরাপোর সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছ; তুমিই কুকিদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া কুকি সর্দ্দার তমহুকে বন্ধন করিয়াছ, ও এইরূপ কত ভয়ানক ভয়ানক কাৰ্য্য তোমা হইতে যে হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা কে করে! আজ তুমি সেই সকল অতীত কার্য্যের পুরস্কার পাইতেছ। 

আমরা হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, টীকেন্দ্র তোমার নিজের উপার্জ্জন মাসে তিন হাজার টাকার অধিক ছিল না, কিন্তু তাহার তিন পয়সা কি তুমি রাখিতে পারিতে? তোমার যে অসাধারণ দান ছিল, বৃন্দাবন যাত্রী মণিপুরীমাত্রেই যে তোমার দানের উপর নির্ভর করিয়া গমন করিত, অনাথা অসহায় স্ত্রীলোকগণের যে তুমিই একমাত্র সম্বল ছিলে, মাতৃ-পিতৃহীন বালকের পিতাই যে তুমি ছিলে! আজ তুমি ভয়ানক ঋণজালে আবদ্ধ হইয়া মণিপুর পরিত্যাগ করিতেছ! পরের উপকারের নিমিত্তই যে আজ তুমি ঋণজালে আবদ্ধ। পরকেই যে তুমি সর্ব্বস্ব খাওয়াইতে ভালবাসিতে! আজ তোমার স্ত্রী-পুত্রের কি উপায় করিলে? কে তাঁহাদিগকে ভরণ-পোষণ করিবে? টীকেন্দ্রের স্ত্রী ও পুত্র হইয়া এখন কি তাহারা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিবে? 

টিকেন্দ্র! আজ তোমার বিহনে মণিপুর হাহাকার করিতেছে, পশুপক্ষী প্রভৃতি সকলেই তোমার দুঃখে অশ্রুবারি বিসর্জ্জন করিতেছে। তুমি রাজা ছিলে না, তথাপি তোমার দুঃখে সকলে এরূপ দুঃখিত কেন? কেন, এ উত্তর কে দিবে? 

টিকেন্দ্র তুমি বলবান, তুমি ক্ষমতাশালী, তুমি সকলের প্রিয়, তুমি দাতা, তুমি পরোপকারী— এই নিমিত্তই আজ তোমার জন্য মণিপুর রোদন করিতেছে— সমস্ত বাঙ্গালা হাহাকার করিতেছে। সমস্ত ভারত তোমার পক্ষ সমর্থন করিয়া তোমাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে। রিপণ প্রভৃতি মহাত্মাগণ পার্লিয়ামেন্টে চীৎকার আরম্ভ করিয়াছেন, এবং সমস্ত পৃথিবী তোমার দুঃখে যোগদান করিয়া কেবল তোমার ইষ্টের চেষ্টায় মনঃসংযোগ করিতেছে। 

কিন্তু কি হইল? 

সকলের চেষ্টা ব্যর্থ হইল। সমগ্র পৃথিবী যাঁহার জীবন রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছিল, ইংরাজ-জাতি গৌরব স্থল মহামতি লর্ড-বংশধরগণ যাঁহার জীবন রক্ষার জন্য অবিরত চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজসভা পার্লিয়ামেন্টে প্রায় দুইমাস যাবৎ যাঁহার জীবন রক্ষার জন্য বাদ প্রতিবাদে বিবৃত ছিলেন, আজ সেই আন্দোলনের ফল কি হইল? বলিতে বুক বিদীর্ণ হয়! স্মরণে হৃদয় কাঁপিয়া উঠে!! আজ বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের বিচারে তোমার জীবনলীলা সম্বরণ করিতে হইল। টিকেন্দ্র! তুমি নির্দোষী বলিয়া যে এত করুণ আর্তনাদ করিয়াছ, ইংরেজ কৰ্ম্মচারীদিগের জীবন রক্ষা করিবার জন্য যে সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছ, পরিশেষে সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া যে রাজাধিরাজ ইংরাজের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাহিয়াছ, আজ রাজাধিরাজ ইংরেজরাজ-প্রতিনিধি লর্ড ল্যান্সডাউনের হৃদয় তাহাতে গলিল না। স্বজাতি- প্রাণঘাতক বলিয়া তোমার প্রতি তাঁহার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল না। তিনি সৰ্ব্বময় কর্তা হইয়াও তোমার জীবন- দান দিতে পারিলেন না। তোমার আশা-তরু শুকাইল, জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণ হইল, তুমি রাজাধিরাজ ইংরেজরাজের মঙ্গলার্থে যে কণ্ঠ নাগা, কুকী প্রভৃতি অসভ্য শত্রুর শাণিত তরবারির অধোভাগে স্থাপন করিতে কুণ্ঠিত ছিলে না, আজ সেই মহাপ্রতাপান্বিত ইংরেজের আদেশেই তোমার কণ্ঠ ফাঁসী-রজ্জুতে দোলায়মান হইল। টিকেন্দ্র তোমাকে আর কি বলিব? তোমার কর্ম্মদোষেই আজ তুমি, আপন রাজ্যে যে রাজ্যে শত শত নরঘাতক তোমার আদেশে জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছে, আজ তুমি সেই রাজ্যে সামান্য নরঘাতকের ন্যায় ফাঁসীকাষ্ঠে আপন জীবন বিসর্জ্জন দিলে! 

তুমিত এ জন্মের মত চলিলে, কিন্তু করিলে কি? তোমার অঙ্কলক্ষ্মী যে আটটি রমণীকে তুমি অঙ্কলক্ষ্মী বলিয়া হাস্যমুখে বাম পার্শ্বে বসাইয়াছিলে, আজ তাঁহাদের কি ব্যবস্থা করিলে? নবমবর্ষীয় অবোধ বালক চৌবা-ই তোমার একমাত্র পুত্র। ক্ষণমাত্র চক্ষের অন্তরাল হইলে, তুমি পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে; রাজপদ তোমার নিকট তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইত; যাহার পরিচর্য্যার ত্রুটী হইলে পরিচারকগণ তোমার কোপনেত্রে পতিত হইত, আজ সে চৌবাকে কাহার হস্তে সমর্পণ করিয়া চলিলে? যে কথায় অপমান বোধ করিয়া সর্ব্বাগ্রজ মহারাজ সুরাচন্দ্র বাহাদুরকে সিংহাসনচ্যুত করিলে, আজ তোমার সেই সাধের সিংহাসন, সাধের মণিপুররাজ্য, সাধের প্রজাবর্গ কাহার হস্তে সমর্পণ করিয়া চলিলে? বীরবর! তুমিত চলিলে, কিন্তু তোমার বীরত্ব তোমার সঙ্গে চলিল না। যতদিন চন্দ্রসূর্য্য থাকিবে, যতদিন দিবারাত্রি হইবে, যতদিনে প্রলয়ে সসাগরা পৃথিবী ধ্বংস না হইবে ততদিন তোমার বীরত্ব-কাহিনী, তোমার দয়া- দাক্ষিণ্য, তোমার সৌজন্যতা, তোমার ক্ষত্রিয়োচিত-ধৰ্ম্ম দিঙমণ্ডল ব্যাপিয়া ঘোষিত হইবে। এখন ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা, তুমি শান্তিময়ীর শান্তিময় ক্রোড়ে স্থান লাভ করিয়া পরলোকে শান্তি লাভ কর। 

আর আমাদের রাজাধিরাজ ইংরেজ রাজ-প্রতিনিধিকেও বলি,— তুমি সাক্ষাৎ সম্বন্ধে আমাদের দেবতা। প্রাণদান ও প্রাণদণ্ড তোমার কণ্ঠস্বরে সম্পন্ন হইতে পারে; সুতরাং তুমি একটি সর্ব্বশক্তিমান্ মহাপুরুষ! যাহার এতদূর ক্ষমতা, পঞ্চবিংশতি কোটী লোকের জীবন যাহার সামান্য প্রশ্বাসের উপর নির্ভর করে, সেই সর্ব্বশক্তিমান তোমার নিকট সামান্য কীটাণুকীট মণিপুর-যুবরাজ টিকেন্দ্রজিতের জীবন রক্ষা পাইল না। তুমি পালনকর্তা পিতা। পঞ্চবিংশতি কোটী লোকের পালনভার তোমার প্রতি ন্যস্ত আছে; এই পঞ্চবিংশতি কোটী লোকই তোমার সন্তান। সন্তান দুৰ্ব্বত্ত নৃশংস বা অত্যাচারী হইলেও পিতার নিকট ক্ষমা পাইবার যোগ্য। সকল সন্তান কিছু সমান সদ্ব্যবহারী হয় না। কিন্তু তা বলিয়া পিতা স্বহস্তে সন্তানের উচ্ছেদ সাধন করিতে পারে না। ঘোরতর মমতা-বন্ধন! আজ তুমি টিকেন্দ্রজিতের জন্য নির্মম হইলে! তোমার এক সন্তানের জীবনের জন্য অপর সন্তানের জীবন লইলে!! ভাবিয়া দেখ; তোমারই সন্তান তোমার হাতে উচ্ছন্ন হইল। 

উপসংহার 

গত ৩১শে জুলাই কলিকাতা হাইকোর্টের সুযোগ্য কৌন্সলি বাবু মনোমোহন ঘোষ টিকেন্দ্রজিৎ, কুলাচন্দ্র প্রভৃতির পক্ষ হইতে বড়লাটের নিকট লিখিত জবাব দাখিল করেন। ঘোষ মহাশয় জবাবে আইন কানুন সম্বন্ধে অনেক অনেক কথা বিশদরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। অধিকন্তু মণিপুররাজ্য যে স্বাধীন, সুতরাং সেই রাজ্যের উপর যে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন চলিতে পারে না, ধীরভাবে, বিশেষ বুদ্ধিমত্তার সহিত তাহা প্রতিপাদন করিয়াছিলেন; কিন্তু মহামতি বড়লাটের নিকট সে সকল আপত্তি যুক্তিযুক্ত বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই। টিকেন্দ্রজিৎ প্রভৃতি মণিপুরের রাজবংশধরগণ মহারাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া, বৃটিশ রাজকর্ম্মচারিদিগকে অন্যায়রূপে বধ করিয়াছেন, এই ধারণাই বড়লাটের মনে বদ্ধমূল হইয়াছিল। অতএব বড়লাট, মণিপুর কোর্টের রায় সম্পূর্ণ বাহাল না রাখিয়া, নিম্নলিখিতরূপে দণ্ডাজ্ঞা প্রচার করেন যে; 

মণিপুরের সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ এবং বৃদ্ধ মন্ত্রী টঙ্গল জেনারেল প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইবে, আর মহারাজ কুলাচন্দ্র সিংহ ও অঙ্গোসেনা যাবজ্জীবনের জন্য দ্বীপান্তর প্রেরিত হইবেন। 

গত ৯ই আগষ্ট বড়লাট বাহাদুরের এই আদেশ তারযোগে মণিপুরের বর্তমান বৃটিশ শাসনকর্তার নিকট প্রেরিত হয়। গত ১৩ই আগষ্ট, অপরাহু ৫ ঘটিকার সময় মণিপুরস্থ ইংরেজের “পলোখেলার” স্থানে টিকেন্দ্রজিৎ ও টঙ্গল জেনারেলের ফাঁসী হইয়া গিয়াছে। বীরবর টিকেন্দ্রজিতের দণ্ডাজ্ঞা বিরোচিত সাজসজ্জাতেই প্রতিপালিত হইয়াছিল। বধ্যভূমিতে মণিপুরসেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহকে ৫০০ সশস্ত্র গোরা সৈনিক বেষ্টন করিয়া লইয়া আসিয়াছিল। সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ বীরের ন্যায় নির্ভিক-চিত্তে ইংরাজ-রাজের দণ্ডাজ্ঞা পালন করিলেন। অসংখ্য মণিপুরবাসী নর-নারীর সমক্ষে ফাঁসীকাষ্ঠে প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়া ইহজগতের সমস্ত কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাইলেন। এখন আর টিকেন্দ্রের জন্য কাহাকেও ভীত হইতে হইবে না — টিকেন্দ্রের অত্যাচারে আর এখন কোন রাজপুরুষকে ব্যতিব্যস্ত হইতে হইবে না। মহারাজ সুরাচন্দ্রকেও আর টিকেন্দ্রজিতের ভয়ে ভীত হইতে হইবে না। এখন মহারাজ সুরাচন্দ্র নির্ভীক চিত্তে মণিপুররাজ্যে রাজত্ব করিতে পারিলেই সুখের বিষয় বটে। এই মহারাজ সুরাচন্দ্রের জন্যই ত মণিপুরের বিভ্রাট উপস্থিত। 

ইহার জন্যই আসামের চিহ্ন কমিসনর মিঃ কুইণ্টনের মণিপুরের অভিযান, এবং তাহা হইতে বৃটিশ কর্মচারীগণের হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটন। মহারাজা সুরাচন্দ্রের জন্যই ভারত-গভর্ণমেন্টকে এত কষ্ট সহ্য করিতে হইল। কিন্তু এখন যদি আমরা সুরাচন্দ্রকে পুনরায় মণিপুর রাজতত্তে উপবিষ্ট দেখিতে পাই, তবেই মনে করিব, বৃটিশ গভর্ণমেন্টের কষ্ট সফল হইল, সুরাচন্দ্রেরও কষ্টের অবসান হইল। তাহা না হইলে মনে করিব, এ বহ্নি অনর্থক প্রজ্বলিত হইয়াছিল, মণিপুর ছারখার করিয়া নির্ব্বাপিত হইল! 

বৃদ্ধ মন্ত্রী টঙ্গল জেনারেলের বয়স হইয়াছিল— পঞ্চাধিক অশীতি বর্ষ; চলচ্ছক্তি এক প্রকার রহিতই হইয়াছিল। শুনা যায় ফাঁসীর সময় যখন তাঁহাকে বধ্যভূমিতে আনয়ন করা হয় তখন তিনি চলিয়া আসিতে পারেন নাই, যানে আরোহণ করাইয়া, অন্য লোক দ্বারা বহন করাইয়া আনা হইয়াছিল এবং বধকার্য্যের সময়েও অন্য লোকের সাহায্যে তাঁহাকে বধ-মঞ্চে উত্তোলন করা হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে যদি সত্য সত্যই টঙ্গলের অবস্থা এরূপ হইয়াছিল, তাহা 

88b 

হইলে, তাঁহাকে আর এই ভীষণ দণ্ডে দণ্ডিত না করিলেই ভাল হইত। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের রাজপ্রতিনিধি লর্ড ল্যান্সডাউন ইহার বর্ত্তমান অবস্থা জ্ঞাত ছিলেন না; যদি তাহা জানিতেন, তবে কখনই এই অর্দ্ধমৃতের উপর এরূপ কঠোর দণ্ডবিধান করিতেন না। 

টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসী হইবার পরদিবস তাঁহার শ্রাদ্ধ হইবে কি না, এই মত গ্রহণ করিবার জন্য মহারাজ সুরাচন্দ্রের নিকট তারে সংবাদ আইসে। মহারাজ সুরাচন্দ্র শ্রাদ্ধের অনুমতি প্রদান করিয়াছেন। তদনুসারে গত ২০শে আগষ্ট টিকেন্দ্রজিতের শ্রাদ্ধকাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। 

[ ভাদ্র, ১৩১১] 

[*THE TRIAL OF THE SENAPATI 

THE JUDGMENT. 

FIRST COUNT OF THE CHARGE. 

The accused pleads not guilty to the first court of the charge against him, viz., waging war against the Queeen-Empress, and though he admits having fired upon the British troops sent to arrest him, he states that he did so more in self-defence than with any idea of waging war against the Queen. 

That it was the intention of the Manipuri Durbar to resist forcibly any order of the Government of India, which was not in accordance with their wishes. We have the evidence of Bamon Charan Mukerji, clerk to the Regent, who states that preparation for resistance and attack was made a fortnight before the arrival of the Chief Commissioner. 

The Manipuri Durbar had heard that the late Maharaja of Manipur, who had abdicated, was on the road from Kohima to Manipur, in company with the Chief Commissioner of Assam, and the acused does not deny that warlike preparations were made to resist. The accused was President of the Council, when it was decided to send 1,000 Manipuri solders to Mao Thana to oppose the advance. It was only on receipt of a telegraphic message, stating that the ex-Maharaja was not in company with the Chief Commissioner, that this most daring attempt to oppose the Government of India’s orders, was abandoned. 

We may take the events which occurred from the 21st March, when the Chief Commissioner arrived at Sengmai; up to the night of the 23rd March, as related by the witnesses, and the accused himself, as they agree, except on the points (1) of an interview with Mr. Grimwood; (2) the illness of the accused, and (3) his presence at the (Regent’s) Durbar. 

The plea of sudden illness, through which the accused was unable to attend any durbar on the 22nd and 23rd, cannot be accepted as valid. Everything tends to prove that it was a mere pretence to avoid a meeting with the Chief Commissioner. The accused was able to meet the Chief Commissoner some miles out of Manipur; he was able to attend the Durbar at noon on the same day on horse-back and it was only after he had been kept waiting outside the Residency-gate some little time that he returned to his house. 

His suspicious had been aroused that he was about to be arrested. We have it in evidence that a rumour had been current for some time Manipur that the accused’s arrest was contemplated by the Chief Commissioner, and there is further evidence to show that the accused was well enough to attend the Regent’s Durbar, an the afternoon of the 23rd, and to take an activepart in the attack of the 24th. Babu Baman Charan Mukerji, second withness, states that the accused was present at the Regent’s Durbar on the afternoon of the 23rd March, held in the palace, to discuss the orders of Government, The accused states, he was not there. The second witness, Babu Baman Charan, has given his evidence throughout in a most starightforward manner, and appears to have a good memory of the smallest details which happened, and his evidence on this point may be accepted. We come then to the morning of the 24th March. 

It is proved by all the witnesses for the prosecution, and admitted by the accused and the witnesses for the defence, that firing between the Manipuris and British soldiers commenced early on the morning of the 24th, and continued uninterrupteldly all day, until about eight o’clock in the evening. The accused pleads in extenuation that his troops were fired on first. 

Of his own witnesses, only one, the third asserts that the British fired first, and this witness was, by his own admission, not in a position to make any such assertion, as he states he was awakened by the sound of firing and immediately ran away; where as on the other hand, we have the evidence of Captail Butcher, Lieutenant Chatterton and Havildar Dhup Chand, that the British troops did not open fire first, and both officers testify to the strict orders given to officers commanding parties that our troops were not to fire unless fired on first. We are, therefore, justified in assuming that the first fire came from the Manipur side. The accused is proved by the evidence to have taken an active part in the attack on the Residency on the 24th. He was found at an early hour in the morning, superintending the men at the north west corner of the ramparts, from which the Manipuris were firing on his own house, then occupied by the British troops. He was found in the evening superintending the laying of a gun, and the construction of an embrasure at the west wall and he admits being in command and ordering the “ceasefire” on the evening of the 24th. It is impossible to doubt that he could, had he so wished, have stopped the fire of his troops on the British at any moment, and hoisted a flag of truce. Finally he demanded the surrender of the British troops on the night of the 24th. 

The court are unanimous in the opinion the first count of the charge has been proved against the accused. 

TRIAL OF THE GUARD 

This morning nine men who composed the guard placed over Mr. Quinton’s party by the Jubraj, and to whom he gave orders to take care of the Sahibs, were put on their trial before Maxwell, Chief Political Officer. 

ANGAO MINGTO’S STATEMENT 

The first witness for the prosecution was Angao Mingto, whose evidence was much the same as that given in the previous trials. He acknowledged receiving orders from the Jubraj to see the Sahibs safely out, and stated that he gave directions to the prisoners to watch over the officers and see that no harm befell them, After this, witness went away to eat his food, and did not hear of the muder of the Sahibs until his return. 

JUTTRA SING’S STATEMENT 

The next witness was Juttra Singh, who gave similar evidence, and acknowledged that Angao Mingto had handed over the captured European to his case. But notwithstanding this, witness stated that when the Jubraj and Tongal had a conversation in the Tope-guard regarding the killing of the officers, he, witness, seeing that something dreadful was to happen, went away to his quarters to sleep and did not hear of the murder of the officers until next morning. This witness also stated that he never saw Mr. Grimwood’s body near the steps, nor did he know how he was killed. 

USURBA’S DEFENCE 

The statement in defence of Usurba, the first prisoner, contained no new facts, except a confession that he knew that the Sahibs were to be killed at the time when he made them over to the executioners. He acknowledged doing this by order of the Tongal, although on a previous occasion he had refused to obey the order given by the Tongal to kill the sahibes, Witness gave as a reason for obeying this second order that he knew that the Tongal was closeted with the Jubraj, and hence that the order met with the Jubraj’s approval. 

SECOND COUNT 

It is admitted that the British officers met the accused at a Durbar inside the Fort on the night of the 24th March. The accused states that event expressions of regret on both sides as to the event which had occured during the day, he required the British troops to lay down their arms, and on this condition alone, would he give them a safe conduct to kohima, and he mentioned that the Manipuri troops were go infuriated as to be quite beyond his control. 

On the refusal of the Chief Commissioner to accede to the terms, the Durbar broke up; the accused left the Durbar and proceeded in the diretion of the Tope Guard, leaving the British officers to make their way out as best they could, in the opposed direction. This action, so contrary to the strict Oriental ideas of etiquette, and quite opposite to the usual custom in Manipur, was very expressive of anger against, and contempt for the British representative. 

The crowd, already excited, and encouraged no doubt by this attitude of their Prince, at once broke out into demonstrations of violence against the officers, stirking at them with spears, the butts of their rifles and swords, and shouting out “kill, kill.” One of the officers was wounded and it was only owing to the exertions of Angao Mingto that the officers were enabled to gain the shelter of the Durbar Hall steps. One of them, Mr. Grimwood was stabbed just as he entered the gate of the compound fell under the steps, and died there, The accused, hearing the uproar returned and drove off the crowd, apparently without any great difficulty. This affords strong proof of the great control he possessed over his men. He then ordered Angao Mingto to guard the officers safely, and went away, making no further efforts for their safety, although he had seen the dead body of Mr. Grimwood for whom he claims to have entertained strong personal friendship, lying under the steps, and must have known in what imminent danger the lives of the remiander were, 

He made no effort to see the Officers safe to their camp. He says, he did not do this owing to the heavy firing going on at the time; but we have conclusive evidence to prove that firing did not recommence until midnight and the Durbar has been proved to have been held at about nine O’clock. The accused himself, further on, states that when he was met on the wall by Jattra Sing and Usurba, there was no firing going on, and these witnesses sought him on the wall shortly after he left the Durbar-room. This excuse may, therefore, be dismissed as untrue. 

It is evident that the accused could not have been doubtful of his power to conduct the efficers outside the gates, had he wished to do so, for his own men had just given him an excellent proof of their obedience and of the influence he possesed over them. Even had the above excuses been valid, there was nothing to prevent his taking the officers either to the Tope Guard or to the citadel, where they would have been in perfect safety. 

He merely told Angao Mingto to guard them and went off to the ramparts to look after the troops, proving thereby that if he had not them desired to kill the officers, he intended to keep them prisoners, for some ends of his own. While the accused was on the ramparts, Juttra Singh .and Usurba reported to him that the Tongal General had given orders for the officers to be killed, but they wanted his, the accused’s orders. There is some discrepancy in the evidence of the witnesses. Jutra Singh says, the accused merely said; ‘Let us go and consult the old man, but Usurba states, the accused said, that the Tongal General’s orders were not to be obeyed, and that he would come and see about it. 

Juttra Singh was present in the Tope Guard when the accused taxed the Tongal General with having ordered the death of the officers, but he did not wait for the end of the conversation. Usurba, the companion of Juttra, went to the Durbar Hall, and to saw the accused pass on his way to have an interview with the Tongal in the Tope Guard, and about half an hour afterwards, Yenkoiba came, from there and said that the General (Tongal) and ordered the British officers to be made over to the public executioner. He then describes how the officers were taken out of the Durbar Hall and murdered to the dragon gate, but he did not see the execution. He then went to the Tope Guard. In his examination-in-chief, he says, the accused was not there then in cross-examination, he says he was there, Heda Chowbi, 11th witness, confirms the evidence of Usurba, but adds that when he returned to the Tope Guard, after making the officers over to the executioner, he found the accused there in conversation with the Tongal General, and according to this witness, the sirdar of executioners was present at the executions. 

The evidence of Yenkoiba, 14th witness, corrorates that of Usurba and Heda Chowbi, and gives some further important particulars. He says, for instance, that the Tongal General said to him. 

Jubraj before this told you to give the Sahibs over to the executioner, why have you not done it?” And further on, he states that when Tongal General said this, the accused was in the same room apparently asleep. He says, he did not see the accused in the Tope Guard, when he went back there, after having made the officers over the executioner. He denies having called the executioner. 

The executioner, tenth witness, gives details of the execution. He says, he was there by order of the Jubraj, and that Yenkoiba called him. The inference of his evidence is that the Sutwal, or chief executioner, was not present at the executions. 

The Sutwal, or chief executioner, twelfth witness, corroborates the above, and is certain that Yenkoiba called them. He also states that he was not present at the execution. The evidence of all the Manipuri witnesses bears the impress of truth up to certain point, that is, not one of them, save the executioner, will admit having seen the executions, and their evidence as to what happened immediately on the executions is most unreliable. 

The statement of Jattra Singh that he went away just as the accused and the Tongal General were arguing as to the murder of the officers, on whose behalf he had made such exertions, and in whose fate he had expressed so much interest, is altogether incredible, and such a statement can only be attributed to a disinclination to repeat the conversation be heard. The statement of the accused that when he came back to the Tope Guard, to confer with the Tongal General about the latter having ordered the officers to be killed, and that after the General had given his reasons for giving such an order, that he, the accused, lay down and went to sleep,  is almost beyond the bounds of credence. If he really did so, such an action would have implied nothing but consent to the murder of the officers, and that he had yielded to the arguments of the Tongal General. That the accused acquiesced in them, and that the second order for the executioners to be sent for, was the result of this acquiescence, the Court has no doubt; indeed, any other belief is impossible. The accused, according to his own account, returns to the Tope Guard wrathful with a Minister for having ordered British officers to be put to death; he argues the case with him, and rebukes him, yet although the Minister is, next to himself, the greatest power in the state, and had shown himself more than anxious to murder the officers, the accused, after a little argument, lay down. 

Such callousness. if he was really interested in the fate of the officers, is incomprehensible. He sent none of his followers to warn the sentries on no account to give the officers up to any one without his orders, nor did he have them removed to the citadel (only distant some 50 yards) when their safety would have been assured. 

If Usurba refused in the first instance to carry out the orders of the Tongal General, without the distinct orders of the accused, and heard hem express his disapproval and countermand the order; and when he knew that when the second order came, the accused was close at hand in the Tope Guard. Usurba must have been given to understand that the result of the conference to which he had seen the accused go, was a confirmation of the original order that the officers should put to death. 

Moreover, the fact that in the first instance the Tongal General merely ordered the sentries to kill officers, and that in the second instance an order was made for their delivery to the public executioner, which gave the deed a sort of legal aspect and made of it a public ceremonial order by the ruling power, would warrant the assumption that in the second instance a far higher power than the Tongal General had ordered the execution. The fact that neither the Tongal General, nor any of the parties directly concerned in the executions, were in any way punished by the accused, confirms this. 

The court is unanimous in its opinion that the second count of the charge has been clearly proved against the accused. With reference to the third count there is no evidence to prove that the accused was persent when the murders were committed; the Court finds the accused not guilty of his count. 

(SD.) ST. JOHN FARCOURT MICHELL, LT. COL., 

(SD.) R. K. RIDGWAY, MAJOR, 

PRESIDENT. 

COMMANDANT 44TH G. R. (SD.) A. W. DAVIS, DY, COMMR, NAGA HILLS. THE PLACE : MANIPUR, 10TH JUNE, 1891. 

FINDING AND SENTENCE 

The Court find that you, Tekendrajit Singh, are guilty of the 1st and 2nd counts of the charge that is to say, that you on or about the 24th March. 1891. at Manipur, waged war against the Queen Empress and abetted the murder of the Chief commissioner of Assam, Mr. Quinton; of Colonel skene, 42nd G. R.; of Lieutenant Simpson, 43rd G. R.; and of Mr. Cossins, Assistant Secretary to the Chief Commissioner of Assam. 

The Court finds that you are not guilty of the third count of the charge. 

The Court directs that you Tekendrajit Singh alias Jubraj, alias Senapati of Manipur, be 

hanged by the neck till you are dead. 

(Sd.) ST. J.F. MICHELL 

(Sd.) R. K. RIDGEWAY 

(SD.) A. W. DAVIS 

PRESIDENT. 

MEMBERS. 

Manipur, 11th June. 

The above sentence is subject to the confirmation of the Governor-General in Council, to whom the record of this trial will be forwarded. ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *