মণি

মণি

‘কাব্যের উপেক্ষিতা’য় ভারতের কবিগুরু রবীন্দ্ৰনাথ বিশ্বের কবিগুরু বাল্মীকির বিরুদ্ধে অনুযোগ করেছেন, তিনি তার কাব্যে ঊৰ্মিলার প্রতি অবিচার করেছেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, রসসৃষ্টিতে তাবৎ-নায়িকাকে সমান সম্মান, সমান অধিকার দেওয়া সম্ভবপর নয়।

তবু তো ঊৰ্মিলার উল্লেখ রামায়ণে আছে। কিন্তু রামচন্দ্ৰ আর সীতাদেবীর কি আরও বহু অনুচর সখা বান্ধবী পরিচারিকা ছিলেন না, যাদের উল্লেখ আদিকবি আদপেই করেন নি? তাঁদের জীবনে সুখ-দুঃখ উৎসব-ব্যাসন বিরহ-বেদনা মিলনানন্দ সবা-কিছুই ছিল। এতৎসত্ত্বেও আদিকবি তাদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। তিনি তো কিছু নিছক কাল্পনিক চরিত্রসৃষ্টি করেন নি, নির্ভেজাল রূপকথাতে যে-রকম হয়। তিনি তো লিখেছিলেন ইতিহাস, অবশ্য রসের গামলায় চুবিয়ে নিয়ে, বাটিক প্রক্রিয়ায় হলেই বা। তাই বলে কি শেষমেশ ওইসব অভাগাদের জ্যান্ত পোতা হল না?

জানি নে, আদিকবিকে এ-ফরিয়াদ জানালে তিনি কী উত্তর দিতেন। যে চন্দ্ৰবৈদ্য শ্ৰীীরামচন্দ্রের নখ-চুল কেটে দিত, যে শুক্লবৈদ্য মা-জননী জনকতনয়ার দুকুল-কঁচুলি কেচে দিত তারা যদি কবিসমীপে নিবেদন করত, তাদেরই বা তিনি ভুলে গেলেন কেন? ঊৰ্মিলার মত নিদেন তাদের নামোল্লেখ করলেই তো তারা অজরামর হয়ে যেত, তবে তিনি কী উত্তর দিতেন?

অত দূরে যাই কেন? কবিগুরু শ্ৰী রবীন্দ্রনাথকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, বিনয় এবং ললিতার মত দুটি অত্যুত্তর চরিত্রসৃষ্টি করার পর—হায়, বাংলার সচ্চরিত্র কী দুর্লভ-তিনি সে-দুজনকে পথমধ্যে গুম করলেন কেন, তা হলে তিনি কী উত্তর দিতেন?

আমি বাল্মীকি নই, রবীন্দ্রনাথও নই। এমন কি আমার আপনি গ্রামের প্রধান লেখক নই। আমার গ্রামের শুকুরুন্ন এবং পাগলা মাধ্যাই যে-সব ভাটিয়ালি রচে গিয়েছে, আমার রচনা তাদের সামনে লজ্জায় ঘোমটা টানে। মধাইয়ের একটি ভাটিয়ালির ভুলে-যাওয়া অন্তরা আমি তিরিশ বছর ধরে চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারি নি। মাধ্যই আমি একই পাঠশালাতে একই শ্রেণীতে পড়েছি। মাধ্যই ফি বাচ্ছর ফেল মারত, আমি ফাস্ট হাতুম।

তাই, বিশেষ করে তাই, আমি মোক্ষম মনঃস্থির করেছি, আমি আমার সৃজনে যাদের প্রতি অনিচ্ছায় অবজ্ঞা প্রকাশ করেছি, তাদের প্রত্যেককে জ্যান্তগোর থেকে খুঁড়ে তুলে প্রাণবন্ত করব। অর্থাৎ অর্ধমৃত করব। কারণ, আমি শক্তিমান লেখক নই। অদ্যাবধি বৰ্ণিত আমার তাবৎ চরিত্রই জীবন্মত। অতএব এঁরাও অমৃত না হয়ে আমৃত হবেন। কিন্তু আমি তো নিষ্কৃতি পাব আমার জন্মপাপ থেকে।

আমি কাবুলে ছিলাম, তখন সেখানকার ব্রিটিশ লিগেশনের সঙ্গে আমার কণামাত্র হৃদ্যতা হয় নি। ‘দেশে-বিদেশে’ যারা পড়েছেন তারা সে-কথা হয়তো স্মরণ করতে পারবেন। তবে লিগেশনের একজন প্রধান কর্মচারির সঙ্গে আমার অত্যন্ত হাদিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইনি পেশাওয়ারের খানদানী বাসিন্দা। অতিশয় খাস পাঠান। এঁর চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও আপন গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ে-শাদি করেন নি। পেশাওয়ারের পুলিশ ইনসপেক্টর আহম্মদ আলীর অগ্ৰজ। নাম শেখ মহবুব আলী। ব্রিটিশ লিগেশনে তিনি ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেক্রেটারি।

এর মত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ কূটনৈতিক আমি অষ্টকুলাচল সপ্তসমূদ্র পরিক্রম করেও দেখতে পাই নি। আমার বিশ্বাস পাঠান-প্রকৃতি ধরে। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু এইসব সরল পাঠানদের যাঁরা সর্দার হন, যেমন মনে করুন ইস্পাইয়ের ফকীর, ইংরেজিতে বলে ফকির অব ইপি (Ipi), তাঁদের মত ধুরন্ধর ইহসংসারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শেখ মহবুব আলীই বলতেন, ‘পাঠানরা হয়। গাড়ল, নয় ঘড়েল। মাঝখানে কিছু নেই। পিগমিজ অ্যান্ড জাইন্টস, নো নির্মেলস’ অধ্যাপক বাগদানফ এবং বেনওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রচুর হৃদ্যতা ছিল। বাগদানফ গত হয়েছেন। বেনওয়া আছেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁকে শতায় দিন, তাকে জিজ্ঞেস করলেই মহবুব আলীর বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সত্যাসত্য জানতে পারবেন।

মহবুব আলী বিলক্ষণ জানতেন, লিগেশনের ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে আমার অহিনকুল সম্পর্ক। ওদিকে তিনি যদিও ইংরেজের সেবা করতেন, তবু ভিতরে ভিতরে ওদের তিনি দিল-জান দিয়ে করতেন ঘেন্না, ঘৃণা’ নয়-ঘেন্না। এটা অবশ্য আমার নিছক অনুমান। মহবুব আলীর মত ঝাণ্ডু চাণক্য বাক্য বা আচরণে সেটা প্রকাশ করবেন, সে-চিন্তাও বরাহভক্ষণসম মহাপাপ! বোধ হয় প্রধানত এই কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত মেহ করতেন। তদুপরি আমি আহমদ আলীর বন্ধু। এবং সর্বশেষ সত্য, আমি বহু-দূরদেশাগত রোগা-পাটকা, নির্বান্ধব, দুনিয়াদারি-বাবদে-বেকুব বাঙালি। এমত অবস্থায় আপনি ভগৱানের শরণ না নিয়ে পাঠানের শরণ নিয়েই বিবেচকের কর্মকরবেন। তবে এ-কথাও বলব, আমি তাঁর শরণ নিই নি। তিনিই আমাকে অনুজরাপে তার হৃদয়ে গ্ৰহণ করেছিলেন।

সে-কথা থাক। আমি আজ তাঁর জীবনী লিখতে বসি নি। আমি লিখতে বসেছি তার স্ত্রীর পরিচারিকা সম্বন্ধে। উল্লসিত পাঠক বিরক্ত হয়ে আমার বাকী লেখাটুকু পড়বেন না, সে-কথা আমি জানি; কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষম জানি, আমি যে গুণীজনের মজলিসে দৈবে সৈবে মুখ খোলার অনুমতি পাই, তাদের পৌনে ষোল আনা সহৃদয় সদাশয় জন। তাদের অকৃপণ হৃদয় জন্মদাসী রাজরানী সবাইকে আসন দিতে জানে।

আমার সঙ্গে মহবুব আলীর হৃদ্যতা হওয়ার কয়েকদিন পর আমার ভৃত্য এবং সখা আবদুর রহমান আমাকে যা জানালে তার সারাংশ এই :

মহবুব আলীর পরিবার এবং অন্য এক পরিবারের দুশমনী-লড়াই ক্ষান্ত দেবার জন্য একদা স্থিরীকৃত হয়, দুই পরিবার যেন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মহবুব আলী এ পরিবারের বড় ছেলে। তাই তাঁকেই বিয়ে করতে হল অন্য পরিবারের বড় মেয়েকে। নবদম্পতি গোড়ার দিকে সুখেই ছিলেন। ইতিমধ্যে বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ মহবুব আলীর এক অতি দূর চাচাতো ভাই তাঁর শ্বশুর-পরিবারের ততোধিক দূর এক মামাতো ভাইকে খুন করে। ফলে মহবুব আলীর স্ত্রী পিতৃগণের আদেশানুযায়ী স্বামীগৃহ বৰ্জন করে পিত্ৰালয়ে চলে যান।

আবদুর রহমানের কাহিনী অনুযায়ী এ-ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক পূর্বে। বলতে গেলে এই অবধি মহবুব আলী অকৃতদার। অধুনা অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি শীঘ্রই হিন্দুস্থান থেকে বিয়ে করে অন্য বিবি নিয়ে আসছেন।

সুহৃদ সম্বন্ধে তার অপরোক্ষ আলোচনা করা অসঙ্গত, তা সে ভূত্যের সঙ্গেই হক আর পিতৃব্যের সঙ্গেই হক—এই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আবদুর রহমান যখন একবার কথা বলতে আরম্ভ করে তখন তাকে ঠেকানো অসাধ্য ব্যাপার।

শেষটায় আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলুম, ‘তোমারই বা এসব বলার কী দরকার? আমারই বা জেনে কী হবে? তিনি তো আমাকে এসব কিছু বলেন নি?’

আবদুর রহমান বললে, ‘তিনি কেন বলেন নি সে-কথা আমি কী করে জানব? (পরে মহবুব আলীর কাছে শুনেছিলাম, দুঃখের কথা নাকি বন্ধু বন্ধুকে বলে না।) তবে আপনার তো জানা উচিত।’ আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হয়।

‘শেখ মহবুব আলী খান বড় ভালো লোক।’

আবদুর রহমান সার্টিফিকেট দেবার সময় রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে না। একথা বলে রাখা ভাল।

***

শেখ মহবুব আলীর বাসাতে আমি সময় পেলেই যৌতুম। তাঁর বাসাটি লিগেশনের প্রত্যস্ত-প্রদেশে অবস্থিত ছিল বলে ইংরেজের ছায়া না মাড়িয়ে সেখানে পৌঁছানো যেত। তিনি দফতরে থাকলে তার ছেলেবেলাকার বন্ধু এবং চাকর গফুর খান তাঁকে খবর দিতে যেত। আমি ততক্ষণে ড্রইং-রুমে বসে আগুন পোয়াতুম। আর বাবুর্চিকে সবিস্তর বয়ান দিতুম কোন কোন বস্তু খাওয়া আমার বাসনা।

শেখ গফুর ফিরে এসেই আমার পায়ের কাছে বসে ভাঙা ভাঙা উর্দু ফার্সী। পাঞ্জাবী পশতুতে মিশিয়ে গল্প জুড়ে দিত। পাঠানদের ভিতর জাতিভেদ নেই। শেখ গফুর আর মহবুব আলী খান প্রভু-ভৃত্য হলেও তাদের সম্পর্ক ছিল সখ্যোর। তাই গফুর আমার সঙ্গে গল্প করাটা তার কর্তব্য বলে মনে করত; আমি ‘ভদ্রসন্তান’, তার সঙ্গে গল্প করে যে তাকে ‘আপ্যায়িতা করছি, সে-কথা তাকে বললে সে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হত। আবদুর রহমান এবং গফুরে যে সৌহার্দ্য ছিল, সে-কথা বলা বাহুল্য।

সচরাচর মহবুব আলীর ড্রয়িং-রুম খোলাই থাকত।

আবদুর রহমান রচিত মহবুব আলীর ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ শোনার কয়েকদিন পর তাঁর বাড়িতে গিয়ে ড্রইংরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখি, সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার হ্যান্ডেলের কাছে তখন দেখি বিজলির বোতাম, কলিং বেল। একটুখানি আশ্চর্য হয়ে ভাবানু, মহবুব আলী আবার কবে থেকে পর্দানশিন হলেন, তার গৃহে মাতা নেই, অপ্রিয়বাদীনী ভাৰ্যা পর্যন্ত নেই, তাঁর গৃহ তো অরণ্যসম। অরণ্যকে ছিটিকিনি দিয়ে বন্ধ করার কা কস্য প্রয়োজন? দিলুম বোতাম টিপে, সঙ্গে সঙ্গে ডাকলুম, ‘ভাই গফুর!’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। ভেবেছিলুম দেখব গাৰ্টাগোট্টা গালকম্বল গাড়ি সম্বলিত বেঁটে কেলে গফুর মহম্মদ খান। দেখি,—হকচাকিয়ে গেলুম,-দেখি, দীর্ঘ এবং তম্বঙ্গী একটি মেয়ে। পরনে লম্বা শিলওয়ার আর হাঁটু পর্যন্ত নেবে-আসা কুর্তা। ওড়না দিয়ে মাথার অর্ধেক অবধি ঘোমটা।

শ্যামা। এবং সে অতি মধুর শ্যামবর্ণ। পেশওয়ার কাবুলে মানুষের রঙ হয় ফরসা, কিংবা রোদো-পোড়া বাদামী। এ মেয়ের রঙ সেই শ্যাম, যেটি পর্দানশিন বাঙালি মেয়ের হয়। তার কী তুলনা আছে?

বলতে সময় লাগল। কিন্তু প্ৰথম দিন তাকে দেখেছিলুম এক লহমার তরে। আমি তাকে ভাল করে দেখবার পূর্বেই সে দিয়েছিল ভিতরপানে ছুট। তখন লক্ষ্য করছিলুম, সেও আধ লহমার তরে, গুরুগামিনী রমণীর যে যে স্থলে বিধাতা সৌন্দর্য পুঞ্জীভূত করে দেন, তম্বঙ্গীর ক্ষীণ দেহে তার কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নি; বরঞ্চ বলব, তিনি অজন্তার চিত্রকারের মত একটু যেন বাড়াবাড়ি করেছেন। অথচ বয়স পনের-ষোল হয় কি না-হয়। তবে কি বিধাতা মানুষের আঁকা ছবি দেখে তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্য বাড়ান?

তা সে যাক গে। তখন কি আর অত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলুম, না, ওই বিষয়ে চিন্তাই করেছিলুম!

আমি আগুনের কাছে গিয়ে বসলুম। খানিকক্ষণ পরে মহবুব আলী এলেন। পাশে বসে ডাক দিলেন, ‘ম-অ-অ-ণি-’

মণি দোরের আড়ালে দাঁড়ালে দুজনাতে পশতু ভাষায় কথাবার্তা হল। আমি তার এক বৰ্ণও বুঝতে পারলুম না। মহবুব আলী আমাকে বললেন, ‘মোটা রান্না এখনও বাবুর্চিই করে কিন্তু মণির হাতে তৈরি নাশতা না হলে আমার বিবির চলে না। মণি বললে, আপনি কী খেতে ভালবাসেন সে ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে এবং তৈরি করছে! ভালই হল। ও বড় তেজী মেয়ে। যাকে অপছন্দ করে তার রুটিতে হয়তো সেঁকো বিষ দেবে।’

দাবা খেলতে বসলুম এবং যথারীতি হারলুম। খেলার মাঝখানে মণি এসে অন্য টেবিলে নাশতা সাজালে। ‘

সময় নিয়েছে বটে কিন্তু রোধেছে ভাল। মমলেটের রঙটি সর্বাঙ্গে সোনালী হলদে। এখানে বাদামী, সেখানে হলদে, ওখানে সাদা নয়। তে-কোণা পরোটাও তৈরি করেছে যেন টিস্কয়ার সেটাস্কয়ার দিয়ে। ভিতরে ভাঁজে ভোজে কোন জায়গায় কাঁচাও নয়।

খাওয়া শেষ হলে আমি বললুম, ‘আধা ঘণ্টাটাক বসে যাই। সেঁকো বিষ দিয়েছে কি না তার ফলাফল দেখে যাই।’ মণি দাঁড়িয়ে ছিল। সে মহবুব আলীর মুখের দিকে তাকাল। তিনি পশতুতে অনুবাদ করলেন। মণি যাঃ’ কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা বলে চলে গেল।

ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে তখন ওই কাঁচা রসিকতটুকুও করতাম না।

ইতিমধ্যে মহবুব আলী আমার বাড়িতে একবার এসেছিলেন বলে আমি তার বাড়ি গেলুম দিন পনের পরে। এবারে বাইরের বোতামে চাপ দেওয়া মাত্রেই হুট করে দরজা খুলে গেল।

মণি আমাকে দেখে নিঃসঙ্কোচে পশতু ভাষায় কিচির-মিচির করে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। আমি একবার সামান্য সুযোগ পেয়ে বললুম, পশতু, তারপর বাঁ হাত উপরের দিকে তুলে ভরতনাট্যম কায়দায় পদ্মফুল ফোঁটাবার মুদ্রা দেখিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, ‘ড্ডনং’। অর্থাৎ আমি পশতু বুঝিনে। কিন্তু কে বা শোনে কার কথা! ভরতনাট্যমে আমি যদি হই খুচরো কারবারী, মণির বেসাতি দেখলুম পাইকিরি লাটের। ডান হাত দিয়ে এক অদৃশ্য বঁটা নিয়ে আকাশের বেশ খানিকটা বঁট দেবার মুদ্রা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে, ‘কুছ পরওয়া নহী।’ কিন্তু শুধু মুদ্রা দিয়ে তো আর বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালানো যায় না। তা হলে মানুষ ভাষার সৃষ্টি না করে শুধু নোচে কুদে ও মুদ্রা দেখিয়েই শঙ্করদর্শনের আলোচনা চালাত, একে অন্যকে এটম বাম বানাবার কৌশল শেখাত।

ইতিমধ্যে গফুর এসে আমার পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসে জানালে মহবুব আলী শহরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। তবে পইপই করে বলে গিয়েছেন, আমাকে যেন আটকে রাখা হয়। মণি ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে।

গফুর তার মনিবের সঙ্গে যে-রকম খোলা-দিলে গল্প জমায় আমার সামনে সেই ভাবেই উজির-নাজির কতল করতে আরম্ভ করল। আশকথা-পাশকথা বলে সে শুধালে, ‘মণিকে আপনার কী রকম লাগে?’

আল্লা জানেন, মৌলা আলীর দোহাই, আমি সব নই। দাসী পরিচারিকা সম্বন্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনা করতে আমার কণামাত্র আপত্তি নেই। আমার সেবক আবদুর রহমানের সঙ্গে আমার বে-ভাবের আদান-প্ৰদান রস-রসিকতা চলত, সে-রকম ধারা আমি বহু ‘শিক্ষিত’। ‘খানদান’ লোকের সঙ্গে করতে রাজী নই। কিন্তু এখানে তো ব্যাপারটা অতখানি সরল নয়। তাই একটু বিরক্তির সুরে বললুম, ‘আমার লাগা না-লাগার কী আছে?’

গফুর আমরা উত্তর শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে বললে, ‘এ আপনি কী বলছেন! আপনি শেখ মহবুব আলীর দোস্ত। তাঁর ইষ্টকুটুম, গোষ্ঠীপরিবারের পাঠান-পখাতুনের চেয়ে আপনাকে উনি ঢের ঢের বেশি ভালবাসেন। আর আপনি যেভাবে কথা বললেন, তাতে মনে হল ওঁর পরিবারের জন্য আপনার যেন কোন দরদ নেই। আজ যদি মণির বিয়ের সম্বন্ধ আসে। তবে কি মহবুব আলী আপনার সঙ্গে ওই বাবদে সলা পরামর্শ না নিয়ে থাকতে পারবেন?’

আমি শুধালুম, ‘এসেছে নাকি?’ সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বললুম, থুড়ি, ভুল করলুম, এতখানি ঔৎসুক্য দেখানো উচিত হয় নি। শান্দির পয়লা রাতে বেড়াল মারবে, এ যে দুসারা রাত খতম হবার উপক্রম!’

আমার ভাবান্তর লক্ষ্য না করেই গফুর সোৎসাহে বললে, ‘গণ্ডায় গণ্ডায়। সুবে পেশওয়ার-কোহট, বনু দেরা ইসমাইল খান, ইস্তেক জম্মু জলন্ধর অবধি। লিগেশনের সব কটা পাঠান চাপরাসী-দফতরি, কেরানী খাজাঞ্চী মণিকে শান্দি করতে চায়।’

আমি জানতুম, পাঠানদের আপনি গোষ্ঠীর ভিতর জাতবিচার নেই। কিন্তু সেটা ছিল থিয়োরেটিকল জানা, এখন দেখলুম। সেটা কীরকম মারাত্মক প্র্যাকটিকাল। লিগেশনের খাজাঞ্চী মেলের লোকও পরিচারিকা মণিকে বিয়ে করতে চায়!

ইতিমধ্যে মণি দু-তিনবার ঘরে এসে অগ্নিবাণ হেনে গফুরের দিকে তাকিয়েছে। ভাষা না জেনেই বুঝতে পেরেছে, ওর সম্বন্ধেই কথাবার্তা হয়েছে। আমি গতিক সুবিধের নয় দেখে বললুম ‘থাক্‌ থাক।’

মণি আমার জন্য এক অজানা পেশাওয়ারি কাবাব বানিয়েছে। ভারি মোলায়েম। দেখে মনে হয়। কাঁচা, কিন্তু হাত দিয়ে মুখের কাছে তুলতে না তুলতেই ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে। আমি আগের থেকেই হাঁ করে ছিলুম; মুখে কিছু পৌঁছল না দেখে মণি খিলখিল করে হেসে উঠল। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ভিতরের দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করল।

মহবুব আলী এলেন। দাবার ফাঁকে বললেন, মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’

আমি বললুম, ‘কিস্তি সামলান। ঘোড়া উঠে, নৌকা ঘোড়ার ডবল কিস্তি।’

মহবুব আলী বললেন, ‘মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’

আমি বললুম, হঁয়া, আমিও বিপদে পড়েছি। আবদুর রহমান বলছিল, এখন থেকে সবাইকে রাস্তায় দেরেশী পরে বেরুতে হবে। দর্জির দোকানে ভিড় লেগেছে। কী করি, বলুন তো?’

ততক্ষণে খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি যথারীতি হেরে গিয়েছি।

পূর্বেই বলেছি, মহবুব আলী চাণক্যস্য চাণক্য। তাই এটাও জানেন, কখন সাফসাফ খোলাখুলি কথা কইতে হয়। বললেন, মণিকে বিয়ে করার জন্য সব কটা পাঠান আমার দোরে। ধন্না দিচ্ছে। ওদিকে মণি বলে, সে কাউকে বিয়ে করতে চায় না। কেন? আমার বিবি বললেন, সে নাকি—’

আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘বাস, বাস।’

মহবুব আলী আমার উম্মার জন্য তৈরি ছিলেন। আমার দুখানা হাত ধরে বললেন, ‘দোস্ত, আমি জানি, এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আপনি সৈয়দ বংশের ছেলে। আপনারা পাঠানমোগলে বিয়ে শান্দি করেন না। যদিও কুরান হাদিসের রায়, যে-কোনও মুসলমান যে-কোনও মুসলমানীকে বিয়ে করতে পারে। হক কথা। কিন্তু লোকাচার দেশাচারও আছে। সেগুলো মানতে হয়। আজ যদি আপনি আমার বোন কিংবা শালীকে বিয়ে করে দেশে ফেরেন তবে আমি কোনও রকম দুশ্চিন্তা করব না। কিন্তু মণিকে বোঝাই কী করে, আপনার সঙ্গে তার বিয়ে সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে যে-কোনও ছেলের বিয়ে হয়। তা যে শুধু পাঠানদের ভিতরেই, সে কী করে জানবে বলুন? বাইরের সংসারে যে অন্য ব্যবস্থা, কী করে বুঝবে বলুন?’

আমি আরও বিরক্ত হয়ে বললুম, আঃ! কী এক স্টর্ম ইন এ টি-পট! তিলকে তাল! আপনার বাড়ির মেয়ে কাকে বিয়ে করতে চায়, না-করতে চায়, তাতে আমার কী?’

মহবুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হা, আপনার তাতে কী?’

আবদুর রহমানের উপদেশ স্মরণে এল। বললুম, না, না, আপনি আমাকে এতখানি হৃদয়হীন মনে করবেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাকে যেখানে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং যেস্থলে আমার হাতে কোনও সমাধা নেই, সেখানে আমি উপদেশই বা দিই। কী প্রকারে?’

***

কাবুলে এপিডেমিক সর্দিকাসি দেখা দিল। ঝাড়া দশ দিন ঘরে বন্ধ থাকতে হল। সেরে উঠে শুনি, মহবুব আলী আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার। ভেবেছিলুম। কিছুদিন ও-পাড়া মাড়াব না। তবু যেতে হল।

এবারে মণি দরজা খুলেই যা পশতুর তুবড়ি বাজি, বিডন বিশপ ফলস চালালে, তার সামনে আমি একদম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কুমারী পার্বতী কাম্য পতিনিন্দা শুনে ন যযৌ ন তস্থেী হয়েছিলেন, আমি উলটো অবস্থায়। ফল কিন্তু একই।

লক্ষ্য করলুম, মণিকে ভয়ঙ্কর রোগা দেখাচ্ছে। ফার্সীতে শুধালুম, সির্দি হয়েছে নাকি?’ মণি এক বর্ণ ফাঁসী বোঝে না। খলখল করে হেসে বাড়ির ভিতর চলে গেল।

মহবুব এলেন লাঠিতে ভর করে। ঠাণ্ডা দেশের সর্দি, যাবার বেলা মানুষকে অর্ধমৃত করে দিয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের চর্বি নিয়ে কারবার।

আমি জানতুম ওই কথাই উঠবে, যদিও আশা করেছিলুম, নাও উঠতে পারে। মণির বেশ উত্তেজনা থেকে অবশ্য আমেজ করেছিলুম, আরও কিছু একটা হয়েছে।

বললেন, ‘ওই যে আমাদের ছোকরা চাপরাসী মাহমুদ জান, রাসকেল না ইডিয়ট কী বলব! সেই ঘটিয়েছে কাণ্ডখানা। আপনি যখন দিন সাতেক এলেন না, তখন ওই মাহমুদ মণিকে একটা খাসা আরব্য উপন্যাস শোনালে। রাসকেলটা গল্প বানাতে আস্ত পাঠান। সে মণিকে বললে, ‘বাদশা আমানুল্লা খান সৈয়দ সায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এদেশে বিয়ে না করে দামড়ার মত ঘুরে বেড়ানো অত্যন্ত অনুচিত। লোকনিন্দা হয়, বিশেষ করে আপনি যখন শিক্ষক। তারপর সৈয়দ সায়েবের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলেন তার মেয়েইস্কুলে। সেখানে দু’শো মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হুকুম দিলেন, বেছে নাও। সৈয়দ সাহেব আর কি করেন! শাহানবাদশার হুকুম। না মানলে গর্দন। আর মেয়েগুলোই বা কি কম খাপসুরত! সৈয়দ সায়েব বিয়ে করে মশগুল। তাই এদিকে আসার ফুরসৎ তার আর কই?’

আমি জীবনে ওই একবারই গীতাবর্ণিত নিষ্কল্প প্রদীপ-শিখাবৎ!

মহবুব আলী বললেন, ‘মণি তো চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার পর শয্যা নিল, এই ড্রইং-রুমের দরজার গোড়ায়। একটানা রোজার উপবাস। রাত্রেও খায় না।–’

আমিও শুধালুম, ‘মণি বিশ্বাস করলে ওই গাঁজাখুরি?’

‘কেন করবে না? মণি মাঝে মাঝে মোটরে করে আমার বিবির সঙ্গে শহরে যায়। পথে পড়ে মেয়ে-ইস্কুল! দেখেছে, মেয়েগুলোর বরফের মত ফরসা রঙ, বেদানার মত ট্যাবট্যাবা লাল গাল, ধনুকের মত ভুরু—’

আমি বললুম, ‘থাক থাক। আপনাকে আর কবিত্ব করতে হবে না। কিন্তু আমি তো পছন্দ করি শ্যামবর্ণ—’।

এইবার মহবুব আলীর মুখে ফুটল মধুর হাসি। ন্যাকরা-গলা আবদেরে আবদেরে সুরে বললেন, ‘তা হলে মণিকে ডেকে সেই সুসমাচার শুনিয়ে দি এবং এটাও বলব কি যে, আপনি মণিকে কাবুলী মেয়েদের চেয়ে বেশি খাপসুরত বলে মনে করেন?’

আমি তো রেগে টঙ। চিৎকার করে বললুম, বিলুন, বলুন, বিশ্বসুদ্ধকে বলুন। আমার কী আপত্তি? মণি যখন বিশ্বাস করে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন তো আপনার সব সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে।’

মহবুব আলী হাসলেন, আরও মধুর হাসি। আমার গা জ্বলে গেল।

অমিয় ছানিয়া বললেন, ‘ওই তো আপনার ভুল। তাই যদি হত। তবে আপনাকে দেখামাত্রই মণি হাসির বন্যা জাগাল কেন? চিৎকার করে তখন কী বলেছে, শুনেছেন? না, আপনি পশতু বোঝেন না। বলেছে, ওঁর হাতে মেহদীর দাগ নেই, উনি বিয়ে করেন নি।’

আমি চুপ। শেষটায় কাতর কণ্ঠে শুধালুম, ‘মেহদীর দাগ ছাড়া কি কখনও বিয়ে হয় না?

মহবুব আলী বললেন, ‘বোঝান গিয়ে মণিকে। আপনাকে কতবার বলেছি, ও পাঠানমেয়ে, ও বোঝে পাঠানদের কায়দাকানুন। ও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় পাঠানজগতে। বিশ্বভুবনের খবর ও রাখে না। ’

আমি শুধালুম, আপনাকে গতবারে দেখেছিলুম, এ-ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিস্তাগ্রস্ত। সেটা হঠাৎ কেটে গেল কী প্রকারে? আমার তো মনে হচ্ছে জিনিসটে আরও বেশি প্যাঁচালো হয়ে যাচ্ছে।’

তিন বললেন, ‘পাঠান-মেয়েরা সচরাচর ব্যাপ-চাচার আদেশমত নাক কান বুজে বিয়ে করে। কিন্তু হঠাৎ কখনও যদি পাঠান মেয়ে কাউকে ভালবেসে ফেলে তখন সে আগুনে হাত না দেওয়াই ভাল। ব্যাপারটায় গুরুত্ব গোড়ার দিকে আমি বুঝতে পারি নি; তাই তার একটা সমাধান খুঁজেছিলুম। এখন নিরাশ হয়ে অভয় মেনে বসে আছি।’

আমি আর কী বলব! অত্যন্ত চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরলুম।

***

সমস্যার ফয়সালা করে দিল বাচ্চায়ে সকাও কাবুল আক্রমণ করে। আমি থাকি শহরের মাঝখানে, ব্রিটিশ লিগেশন শহরের বাইরে মাইল দেড়েক দূরে। বাচ্চা এসেছে সেদিক থেকেই এবং থানা গেড়েছে লিগেশন আর শহরের মাঝখানে। লিগেশন আর শহর একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সেখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

কয়েকদিন পরে বাচ্চা হটে গেল। তখন ব্রিটিশ প্লেন এসে বিদেশী মেয়েদের পেশাওয়ার নিয়ে যেতে লাগল। খবর পেয়েই ছুটে গেলুম আমার বন্ধু মৌলানা জিয়াউদ্দীনের স্ত্রীর জন্য একটা সীট যোগাড় করতে।

মহবুব আলীর কলিং-বেল টেপা মাত্রই এবারে দরজা খুলল না। তখন হ্যান্ডেল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল।

খানিকক্ষণ পর মহবুব আলী এলেন। মুখ বিষ। কোন ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘কাবুল নিরাপদ স্থান নয় বলে লিগেশনের সব মেয়েদের পেশাওয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী চলে গিয়েছেন। মণিও গেছে।’

আমি বলতে চাইলুম, ‘ভালই হল, কিন্তু বলতে পারলুম না।’

তারপর বললেন, ‘আপনাকে বলে কি হবে, তবু বলি। যে কদিন শহর লিগেশন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল সে কদিন এখানে অনেক রকম গুজব পোছত, কেউ বলত কাবুলে লুঠতরাজ আরম্ভ হয়ে গেছে, কেউ বলত বিদেশীদের সব খুন করে ফেলা হয়েছে। আর মণি ছুটোছুটি করেছে, এ-চাপরাসী থেকে ও-চাপরাসীর কাছে, এ-আরদালীর কাছ থেকে ও-আরদালীর কাছে। টাকা দিয়ে লোভ পর্যন্ত দেখিয়েছে, আপনার কুশল সংবাদ নিয়ে আসবার জন্যে।

আমি চুপ।

‘তারপর যখন সে জানতে পারলে তাকেও আমার স্ত্রীর সঙ্গে পেশাওয়ার চলে যেতে হবে তখন এক বিপর্যয় কাণ্ড করে তুললে। কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে বললে, সে কিছুতেই দেশে ফিরে যাবে না। এক রকম গায়ের জোরে তাকে প্লেনে তুলে দিতে হল।’

আমি কিছু বলি নি।

***

একদিন কাবুলে অনেক কষ্ট সওয়ার পর খবর পেলুম, অ্যারোপ্লেনে জিয়াউদ্দীন ও আমার জন্য জায়গা হয়েছে। আগের রাত্রে মহবুব আলী আমাকে গুডজার্নি বাঁভইয়াজ জানাতে এলেন। বিদায়ের সময় আমাকে একটা মোটা খাম দিয়ে বললেন, ‘আপনি পেশাওয়ারে পৌঁছে আমার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মণিকে খবর দেবেন। মণি এলে তার হাতে খামটা দিয়ে বলবেন—এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়ো।’

আমি বললুম, ‘আমি তো পশতু বলতে পারি নে।’

তিনি কথা কটি উর্দু হরফে লিখে বার তিনেক আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিলেন।

অ্যারোপ্লেনে বসে পরের দিন অনেক চিন্তা করেছিলুম। কী চিন্তা করেছিলুম, সে-কথা দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না।

পেশাওয়ার পৌঁছেই গেলুম মহবুব আলীর শ্বশুরবাড়ি। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, দুই বৃদ্ধ মুরুব্বী স্থানীয় লোক বসে আছেন। আমি মহবুব আলীর কুশল সংবাদ জানিয়ে তাদের অনুরোধ জানালুম, মণিকে একটু খবর দিতে। ভদ্রলোকেরা একটু চমকে উঠলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বললেন, ‘খবর দিচ্ছি। এঁরা চমকে উঠলেন কেন? তবে কি এ-বাড়ির মেয়েরা বৈঠকখানায় আসে না? তাহলে মহবুব আলীর সেটা বোঝা উচিত ছিল।

মণি এল। আমাকে দেখে অন্দরের দোরের গোড়ায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াল। মুখে কথা নেই। মুরুর্কীদের দিকে একবার তাকালে। র্তারা তখন অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে নিয়েছেন। মণি মৃদু কণ্ঠে একটি শব্দ শোধালে, ‘সলামত?’ কথাটা ফার্সী। হয়তো পশতুতেও চলে। অর্থ ‘কুশল?’

আমি ঘাড় নাড়িয়ে বললুম, হ্যাঁ।’

তারপর তার কাছে গিয়ে খামটা দিয়ে সেই শেখা বুলিতে পশতুতে বললুম, ‘এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়ো।’ মণির মুখ খুশিতে ভরে উঠল। যা বলল সে-ভাষা না জেনেও বুঝতে পারলুম, সে বলছে, পশতু তা হলে শিখেছেন?’

আমি দুঃখ দেখিয়ে ঘাড় নেড়ে না।’ জানালুম।

মণি ভিতরে চলে গেল।

আমি উঠি উঠি করছিলুম। এমন সময় চাকর এসে বললে কিছু খেয়ে যেতে। পাঠানের বাড়িতে না খেয়ে চলে যাওয়া বড় বেয়াদবি।

মণি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দোরের আড়ালে দাঁড়াল।

একটি কথা বলল না।

বাড়ি থেকে বেরবার সময় একবার পিছনের দিকে তাকালুম, মণিকে শেষ সেলাম জানাবার জন্য। কোথাও পেলুম না।

টাঙ্গাতে উঠে। উলটো দিকে মুখ করে বসতেই নজর গেল দোতলার বারান্দার দিকে। দেখি মণি দাঁড়িয়ে। মাথায় ওড়না নেই। আর দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে, লম্বা লম্বা ধারা বেয়ে।

টাঙ্গা মোড় নিল।

সে রাত্রে দেশের ট্রেন ধরলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *