মঞ্জরী
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি সেই কতক্ষণ ধরে। কখন বাস আসবে তার ঠিক নেই। এতক্ষণে মাত্র একটা বাস এসেছিল, তাতে এত ভিড় যে পা রাখাও অসম্ভব। আমি হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে পারি না। অথচ বাসে যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই এখন। মধ্য কলকাতার বিকেলবেলায় ট্যাক্সি পাওয়া একটা অলৌকিক ব্যাপার, ট্যাক্সি পাওয়ার চেয়ে একটা নতুন গাড়ি কিনে ফেলা অনেক সহজ।
বিরক্ত হয়ে ভাবছি শেষ পর্যন্ত হেঁটেই যাবো কিনা, হঠাৎ এই সময়ে রাস্তার ওপারের একটা বইয়ের দোকান থেকে মঞ্জরী বেরিয়ে এলো। সঙ্গে আর একটি মেয়ে। আশ্চর্য, মঞ্জরী এতক্ষণ আমার এত কাছাকাছি ছিল আর আমি শুধু শুধু বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছি! ওই দোকানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কয়েকবার, বেশ ভিড়, দু-একটি মেয়ের পিঠ দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু তেমন মনোযোগ দিইনি।
এক এক সময় মনে হয়, পৃথিবীতে কোনো ময়লা নেই, দুর্গন্ধ নেই, ঘাম নেই। কোথাও মানুষকে মানুষ মারছে না। মোলায়েম স্নিগ্ধ হাওয়ায় পৃথিবীটা ভরে গেছে। মঞ্জরীকে দেখলে আমার এই রকম হয়। একথাও স্বীকার করতে লজ্জা নেই মঞ্জরীকে দেখলে আমার বুক কাঁপে! কেন কাঁপে? পৃথিবীর কোনো বিশেষজ্ঞ এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন না।
মঞ্জরী আমাকে এখনও দেখতে পায়নি। ডাকবো? মঞ্জরীর সঙ্গে আর একটি মেয়ে রয়েছে, তাকে চিনি না। যাই হোক, আমার আর এখন বাসে ওঠবার তাড়া নেই, কোথায় যেন যাবার কথা ছিল তাও ভুলে গেছি।
মঞ্জরী তার সঙ্গের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলায় খুব মগ্ন হয়ে আছে। দোকান থেকে বেরিয়ে ওরা উলটোদিকের ফুটপাথ ধরেই হাঁটতে লাগলো। একটুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে।
রাস্তা না পেরিয়ে আমিও এ ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। এরকম করার যে কি মানে হয় কে জানে? আমি কি এক্ষুনি রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে মঞ্জরীর নাম ধরে ডাকতে পারি না? সেটাই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক। কিন্তু এই রাস্তাটা যেন একটা নদী, আমরা দুজনে দুদিকে রয়েছি, পার হবার উপায় নেই।
একটা ট্যাক্সি দারুণ শব্দে ব্রেক কষলো। একটি ছেলে প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছিল, একটুর জন্য বেঁচে গেছে। বেঁচে গেল ট্যাক্সিড্রাইভারটিও। সেই শব্দে রাস্তার সব লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে, তাকিয়েছে সেইদিকে, মঞ্জরীরাও। এবারও মঞ্জরী আমাকে দেখতে পেল না। আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, এই মঞ্জরী—
মনে মনে আমি দেখতে চাইছিলাম, মঞ্জরীই রাস্তা পেরিয়ে আসে কিনা, কিংবা আমাকে যেতে বলবে ওদিকে। যেন ওর ওপরেই অনেকখানি নির্ভর করছে। মঞ্জরী আমার ডাক শুনতে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাল, তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে হাসি ঝলমল করে তুলল মুখখানা। আমি তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে ডাকলো না, মঞ্জরীই সেই মেয়েটির সঙ্গে চলে এল রাস্তার এদিকে।
যাক, একটা ব্যাপার চুকে গেল।
মঞ্জরী এসে বলল, এই সুনীলদা, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
মঞ্জরীকে দেখার পর আমার আর কোথাও যাবার থাকে না, কোনো কাজের কথাই মনে থাকে না, কিন্তু মুখে সে কথা বলা যায় না। আমি একটু ব্যস্ত ভাব দেখিয়ে বললুম, এই এদিকে এসেছিলাম একটু বিশেষ কাজে। তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
বই কিনতে এসেছিলাম। একে চেনেন, এর নাম সর্বাণী। আপনাদের বাড়ির কাছেই থাকে।
মঞ্জরী দেখতে সুন্দর, বড্ড বেশি সুন্দর—এত সুন্দর যে একটু ভয় করে। কেননা, কোনো সুন্দর জিনিসই পৃথিবীতে বেশিদিন থাকে না। সর্বাণী মেয়েটি সাদামাটা, দেখতে খারাপ নয়, তবে কেউ সুন্দরীও বলবে না। অন্তত মঞ্জরীর পাশে দাঁড়ালে। সর্বাণী বোধহয় একটু বেশি লাজুক। আমাকে দেখে ছোট্ট একটু নমস্কার করলো।
আমি মঞ্জরীকে বললাম, বাড়ি ফিরবে কী করে? এখন তো বাসে-ট্রামে উঠতে পারবে না। একটা মিছিল বেরিয়েছে, তাই ট্রাফিক জ্যাম।
মঞ্জরী হাসতে হাসতে বলল, আমি বাড়ি ফিরবো না।
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবে?
কোথাও একটু গেলেই হয়। এখনও ঠিক করিনি।
এখন, এই মুহূর্তে সর্বাণীর উচিত বিদায় নেওয়া। আমাদের দুজনকে আলাদা থাকতে দেওয়া। এখন মঞ্জরী বাড়ি যাবে না, আমারও কোথাও যাবার নেই, আমরা পৃথিবীর শেষ সীমান্তে যেতে পারি।
মঞ্জরী অপ্রত্যাশিতভাবে বলল, সুনীলদা, আপনি একটু সর্বাণীকে পৌঁছে দিন না। ও তো আপনার বাড়ির দিকেই।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমি তো এখন বাড়ি ফিরবো না।
কেন ফিরবেন না? না হয় আমার কথা শুনেই একটু ফিরুন। সর্বাণী যদি বাসে উঠতে না পারে—আপনার উচিত নয় ওকে পৌঁছে দেওয়া?
সর্বাণী অপ্রস্তুত হয়ে বললো, না, না, আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আমি ঠিক যেতে পারবো।
মঞ্জরী রীতিমতন ধমক দিয়ে বলল, না, তুই দাঁড়া। সুনীলদা তোকে পৌঁছে দেবে।
আমি বললাম, তা না হয় পৌঁছে দেবো, কিন্তু তোমাকে রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে যাবো নাকি? তুমি কোথায় যাবে?
মঞ্জরী কি বুঝতে পারছে না, আমি শুধু ওর সঙ্গে যাবার জন্যই ব্যাকুল। কতদিন নিরালায় ওর সামনে মুখোমুখি বসে কথা বলিনি!
মঞ্জরী খুব দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে বলল, আপনি কি ভাবছেন আমি নিরুদ্দেশে যাচ্ছি নাকি?
তুমি যে বললে বাড়ি ফিরবে না? সন্ধের পর বেশিক্ষণ তো তোমায় বাইরে থাকতে দেখিনি!
বাড়িতে তো ফিরবোই না! এই তো কাছে, আমহার্স্ট স্ট্রিটে আমার মামার বাড়ি।
কদিন ধরে ওখানেই আছি।
বাঃ। তাহলে তো খুবই ভালো হল। চলো, কোথাও বসে একটু চা খাই। কিংবা, কফি হাউসে যাবে?
এখন? ইমপসিবল! আমাকে সাড়ে ছটার মধ্যে ফিরতেই হবে।
প্রথমবার যদি রাজি না হয়, তাহলে হাজার অনুরোধ করলেও মঞ্জরীকে আর রাজি করানো যাবে না, আমি জানি। আমিও গম্ভীরভাবে বললাম, ঠিক আছে, তাহলে চলি—
একি, আপনি যে বললেন সর্বাণীকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন?
আমি সত্যি এখন বাড়ি ফিরবো না, আমার অনেক দেরি আছে।
সর্বাণী রীতিমতন লজ্জা পেয়ে বলতে লাগল, সত্যি কোনো দরকার নেই, আমি নিজেই যেতে পারবো, রোজ যাই—
মঞ্জরী আমার চোখে চোখ রেখে বলল, সুনীলদা, প্লিজ আজ ওকে পৌঁছে দিন।
আমার একটা কথা রাখবেন না?
মঞ্জরী আমার কোনো কথা রাখবে না, কিন্তু ওর কথা আমাকে রাখতেই হবে।
এই ওর জোর। এই জোর ওকোথা থেকে পেল কে জানে। কিন্তু আমিও তো অগ্রাহ্য করতে পারি না।
সর্বাণীকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিলাম ঠিকই, কিন্তু সারা রাস্তা সে আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলল না। বলবেই বা কেন?
মঞ্জরীর সঙ্গে আবার একদিন দেখা হল রমেনের বাড়িতে। রমেনের বোনের বিয়ে ছিল সেদিন। একগাদা ভিড় ঠেলে এসে মঞ্জরী আমাকে বলল, সুনীলদা, আপনাকে আমি ভীষণ খুঁজছি। আপনার সঙ্গে আমার খুব দরকার।
লাল রঙের বেনারসিতে মঞ্জরী একেবারে রাজেন্দ্রাণীর মতন সেজেছে। তার মুখেও একটা লালচে আভা। আমি বললুম, উঃ কী দারুণ সেজেছো—আজ তোমারই বিয়ে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
প্রশংসায় লজ্জা পায় না মঞ্জরী। ছেলেমানুষের মতন খুশি হয়। বললো, আমি ঠিক জানতুম, আপনি প্রশংসা করবেন। আপনার কথা ভেবেই তো এরকম সাজলুম।
সত্যি!
সত্যি না তো কি মিথ্যে কথা বলছি!
আমার তো আজ এখানে আসবার কথাই ছিল না। আমার আজ জামসেদপুরে যাবার কথা—নেহাৎ ট্রেন বন্ধ—
আমি ঠিক জানতুম, আপনি আসবেন!
এসব প্রেমের কথা নয়। ইয়ার্কির কথা। মঞ্জরী এরকম বলতে ভালোবাসে। আমিও শুনতে ভালোবাসি। আশেপাশের লোকদের অগ্রাহ্য করে বললো, আপনাকে আমি কদিন ধরে যা খুঁজছি না! এত দরকার আপনার সঙ্গে।
কোথায় কোথায় খুঁজলে বলো তো?
সব জায়গায়! কোথাও আপনাকে পাওয়া যায় না! কোথায় থাকেন সারাদিন?
আমার বাড়িতে একবারও খোঁজ করেছিলে? একজন মানুষকে পাওয়ার সবচেয়ে সোজা উপায় তো তার বাড়িতে—
আপনি একবার আমার খোঁজ নিতে পারেন না?
তুমি তো সব সময়ই ব্যস্ত। কত তোমার অ্যাডমায়ারার! যাকগে আমার সঙ্গে কী দারুণ দরকারি কথা আছে বলছিলে?
আমার ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্ডটা হারিয়ে গেছে। কি করে রিনিউ করতে হয় আমি জানি না। আপনি একটু করে দেবেন?
আমি একটু দমে গেলাম। একটু কেন, বেশ খানিকটা। এই দরকার!
খানিকটা ক্ষুণ্ণ হয়ে বললাম, এইজন্য? একি আর কেউ করে দিতে পারত না?
এটা তো এমন কিছু শক্ত কাজ নয়?
আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।
এইজন্যই বুঝি আমাকে তোমার মনে পড়ে?
এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভুরু কুঁচকে অদ্ভুতভাবে হাসল মঞ্জরী। এ মেয়েকে ঠিক ছলনাময়ীও বলা যায় না। মঞ্জরী শুধু মঞ্জরীর মতন। ওকে একটু আঘাত দেবার জন্য আমি বললাম, আজকাল আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বেশি যাই না। ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। অন্য কারুকে বলো।
গাঢ় অবিশ্বাসের চোখে মঞ্জরী আমার দিকে তাকালো, একটু ম্লান হয়ে বলল, আপনি আমার জন্য একটু করে দেবেন না? কার্ডটা হারাবার পর থেকেই আপনার কথা ভেবে রেখেছি।
আচ্ছা, আচ্ছা, দেবোখন। আমাকে দেখলেই তোমার শুধু কাজের কথা মনে পড়ে। আমি যে তোমার জন্য অত দূরে যাবো—তার জন্য আমাকে তুমি কী দেবে?
মঞ্জরী আমার বাহুতে ওর হাত ছুঁইয়ে বলল, আপনি কী চান বলুন?
আমি কেন চাইব? তুমি নিজে থেকে বুঝি দিতে পারো না?
আপনি না চাইলে আমি বুঝব কী করে? বলুন, আপনি কী চান?
যা চাইব, তাই-ই দেবে।
চেষ্টা করব।
আমার বাহুতে মঞ্জরীর হাত, আমি চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঝর্নার জলের মতন ঝকঝকে মুখ, ওর দৃষ্টিতে কোনো মালিন্য নেই। আমি আর কী চাইব? দেবীমূর্তির সামনে বসে স্বামী বিবেকানন্দও কিছু চাইতে পারেননি। এই হচ্ছে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য, এর দিকে তাকিয়ে থাকলে বুক শিরশির করে, কিন্তু এই সৌন্দর্য কখনও সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। গাছ থেকে ছেঁড়ার পরের মুহূর্তেই ফুল আর সেই ফুল থাকে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, না, কিছু চাই না।
সেইজন্য তো আপনাকে এত ভালো লাগে। আপনি কিছু চান না।
আর সবাই বুঝি চায়?
আপনি বুঝি জানেন না? পৃথিবীতে সবাই তো সব সময় হাত বাড়িয়ে বলছে, দাও, দাও, আরও দাও—
আমি সে কথা বলিনি! তোমার কাছে অন্যরা অনেক কিছু চায়?
মঞ্জরী আমার হাতের ওপর ছোট্ট একটা চড় মেরে বলল, ধ্যাৎ!
মঞ্জরী এই পৃথিবীতে এসে অনেক কিছু পেয়েছে। জন্মেছে সচ্ছল পরিবারে, গা ভরা রূপ ও স্বাস্থ্য—সেই সঙ্গে ওর মালিন্যহীন প্রাণশক্তি। সুঠাম সুবেশ যুবকরা মঞ্জরীর চারপাশে তো ঘুরঘুর করবেই। মঞ্জরীর সঙ্গে দেখা করার বেশি সুযোগ আমার হয় না। কখনো-কখনো খুব ইচ্ছে হয়, কোথাও নিরালায় মঞ্জরীকে নিয়ে বসে থাকি—আর কোনো চোখ সেখানে উঁকি দেবে না—আমি মঞ্জরীকে একটু ছুঁয়ে দেখবো। ওই রূপ, ওই সৌন্দর্যের বিভা সব সময় মনের মধ্যে ছায়া ফেলে থাকে। অবশ্য মঞ্জরীর সঙ্গে সেরকমভাবে দেখা হয় খুব কমই। মঞ্জরী যখন আমাকে দেখে, কথা বলে খুবই অন্তরঙ্গভাবে—আবার যখন দেখা হয় না তখন ভুলে যায় আমাকে।
হঠাৎ কোনো কাজের দরকার হলে মনে পড়ে আমাকে। হঠাৎ বিকেলবেলা অফিসে টেলিফোন বেজে ওঠে, তুলেই শুনতে পাই মঞ্জরীর ব্যস্ত গলা, সুনীলদা কোথায় আপনি? বারবার টেলিফোন করেও পাওয়া যায় না!
আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করি, তুমি কতবার টেলিফোন করেছিলে?
অনেকবার! আপনি আমাকে একবার টেলিফোন করতে পারেন না?
অকারণে টেলিফোন করবো কেন?
অকারণে? আমার সঙ্গে বুঝি আপনার কথা বলতে ইচ্ছা করে না?
ইচ্ছে করলেই কি পৃথিবীতে সবকিছু হয়? আমার তো আরও অনেক কিছু ইচ্ছে করে। যাকগে, কীজন্য হঠাৎ তলব?
কিছুর জন্য না! এমনিই। শুনুন, আজ সন্ধেবেলা একবার আমাদের বাড়িতে আসবেন। আসতেই হবে কিন্তু!
আজই? অন্য একদিন গেলে হয় না?
না, না, আজই। কোনো কথা শুনতে চাই না, আসতে হবেই! আপনার সঙ্গে ভীষণ দরকার।
অন্য কেউ যদি পাশ থেকে শুনতো এই কথাবার্তা, তাহলে কি মনে করতো না যে আমাদের দুজনের মধ্যে গভীর টান? এমন জোর দিয়ে তো যে-কোনো মেয়ে ডাকতে পারে না। আমারও তো না গিয়ে উপায় নেই।
এবারও গিয়ে যথারীতি নিরাশ হলাম গোপনে। খুবই অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার।
মঞ্জরীর এক মামা থাকেন নিউগিনিতে। তিনি একখানা মস্তবড়ো খাতা-ভরতি ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, নিজের টাকাতেই ছাপাবেন। কিন্তু তার আগে, মঞ্জরী চায় আমি যেন সেটা আগাগোড়া পড়ে আমার মতামত জানাই। আমি তো লেখক, তাই আমার মতামতের মূল্য আছে। তা ছাড়া বানান ও ভাষাও ঠিক করে দিতে হবে আমাকে।
আমি বললাম, সেইজন্য টেলিফোনে এত জরুরি ডাক? এটা তো আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেও পারতে।
কেন আপনাকে আমি ডাকতে পারি না? আপনার সময় নষ্ট হল?
তা তো হলই! তা ছাড়া, এসব আজেবাজে লেখা আমার পড়তে ভালো লাগে না। এই রকম ঘুচিমুচি হাতের লেখা—
সুনীলদা, আমার জন্য আপনি এইটুকু কষ্ট করবেন না?
সেই অধিকারহীন দাবি জানায় মঞ্জরী। কি করে যেন জেনে গেছে, এক হিসেবে আমি ওর ক্রীতদাস। ও যদি বলে, সুনীলদা আমার জন্য আপনি সাপের মাথার মণি এনে দিন! আমার জন্য এটুকু কষ্ট করবেন না?—তাহলেও আমাকে সাপের মাথার মণির জন্যই যেতে হবে।
মঞ্জরীর বিয়েতে আমি যাইনি। মঞ্জরী যখন নেমন্তন্ন করতে এসেছিল, আমি বাড়িতে ছিলাম না, নিজের মুখে নেমন্তন্ন জানাবার সুযোগ পায়নি। আমিও একটা ছুতো করে সেই সময়টা কলকাতার বাইরে চলে গেলাম। আমার ঈর্ষা খুব প্রবল। আমার চোখের সামনে মঞ্জরীর হাতের ওপর অন্য কেউ হাত রাখবে—এটা সহ্য করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। যদিও জানতাম, মঞ্জরীর একদিন তো বিয়ে হবেই কিন্তু সেই দৃশ্য আমার নিজের চোখে দেখার দরকার নেই। পৃথিবীতে আমার চোখের আড়ালে তো কত রূপ ঝরে যায়, কত সৌন্দর্য অন্যের ভোগে লাগে, তা নিয়ে তো আর আমার মন খারাপ লাগে না।
বিয়ের পর মঞ্জরী চলে গেল বাঙ্গালোরে। ওর স্বামী ওখানে খুব একটা বড়ো কাজ করে। মঞ্জরী ওখানেই থাকবে। সুতরাং, আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হবে না। অফিস থেকে আমাকে সাউথ ইন্ডিয়া পাঠাতে চেয়েছিল বিশেষ কাজে, আমি কিছুতেই রাজি হলুম না যেতে। মাঝে মাঝে মঞ্জরীর খবর এর-ওর মুখে শুনতে পাই। মনে মনে ভাবি, মঞ্জরী যেন সুখে থাকে, ভালো থাকে।
এলিট সিনেমার সামনে মঞ্জরীকে দেখে সত্যি খুব চমকে গিয়েছিলাম। কবে যে কলকাতায় এসেছে, তা-ও শুনিনি। বিয়ে হয়েছে দু-বছর আগে, কিন্তু একটুও বদলায়নি চেহারা। কিংবা হয়তো বদলেছে, আমার চোখে ধরা পড়েনি। পাশে দাঁড়িয়ে ওর স্বামী, বেশ সুপুরুষ ও ভদ্র।
মঞ্জরীই আমাকে প্রথম দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, এই সুনীলদা, এই তো আজ ধরেছি। আমাদের বিয়েতে যাননি কেন?
প্রশ্নটা এড়িয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মঞ্জরী, তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি।
আরও কিছুক্ষণ কথা হল। কিন্তু সেসব কথা আমি মন দিয়ে শুনিনি। একটি কথাই আমার কানে বাজতে লাগল, ভালো আছি। ভালো তো থাকবেই, দুঃখ মানায় না মঞ্জরীকে, আমিও চাই মঞ্জরী ভালো থাকুক। কিন্তু আমাকে আর দরকার নেই মঞ্জরীর। এবার আর বলল না, একটা দারুণ দরকারে আপনাকে খুঁজছি।
আর বলবে না, আমার জন্য এইটুকু কষ্ট করবেন না?
যে-কথার উত্তরে আমি বলতে পারতাম, তার বদলে আমাকে কী দেবে তুমি?
আপনি কী চান বলুন?
আমি কিচ্ছু চাই না।
এসব কথা আর বলা হবে না। বুকের মধ্যে সরু সুতোর মতন একটা ব্যস্ততা ঘুরে বেড়ায়। বিদায় নেবার আগে মঞ্জরী বলল, সুনীলদা, আপনার খবর-টবর সব ভালো তো? ভালো আছেন তো?
আমি হেসে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ ভালো আছি। খুব ভালো আছি।