অধ্যায় নয় – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
রামু, চট্টগ্রাম
হঠাৎ তীব্র আঘাতে আনমনেই গালি বকে উঠল কিরান।
গোলার আঘাতে কারাগারের একটা অংশ তো ভেঙে পড়লই সেই সঙ্গে কয়েদিদের রাখার কয়েকটা খাঁচাও উলটেপালটে গেল।
বিস্ফোরণের ঠিক আগে কিরান একটু হলেও সাবধান হয়ে গেছিল, কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না। কারণ গোলার আঘাতে উড়ে আসা একটা খাঁচা সোজা বাড়ি খেল ওর খাঁচার সঙ্গে। আর তাতে ওর খাঁচাটা খুলে না গিয়ে বরং কাত হয়ে গেল একদিকে। আর যেদিক দিয়ে বের হওয়ার খোপ সেদিকটা বন্ধ হয়ে গেল অন্য খাঁচার বাড়ি লেগে। কিরান ছিটকে পড়ল খাঁচার একপাশে।
খাঁচার একদিকে ছিটকে পড়াতে প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিরান বুঝতেই পারল না চারপাশে কী হচ্ছে। মাথায় শক্ত বাড়ি খেয়ে কিছুক্ষণ ধুমার মতো বসে রইল ও। তারপর চট করে উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল ওর। মাথার একপাশে হাত দিয়ে দেখল চটচটে রক্ত লেগে আছে। জোরে ঝাড়া দিয়ে মাথাটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। চারপাশে তুমুল হট্টগোল চলছে, যে যেভাবে যেদিকে পারছে ছুটোছুটি করছে। দেয়াল আর খাঁচা ভেঙে পড়ায় কয়েদিদের একটা বড়ো অংশ চেষ্টা করছে পালানোর। এমন সুযোগ এ জীবনে আর পাওয়া যাবে না।
কিরান উঠে বসে প্রথমে শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে অন্য খাঁচাটাকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সুবিধে করে উঠতে পারল না। হাত দিয়ে কিছু করতে না পারলেও একটা ব্যাপার অনুধাবন করতে পারল খাঁচাটার মুখ আটকে রাখা কজাটা ভেঙে গেছে। তাই অন্য পথ ধরল ও। খাঁচার মধ্যে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু এতেও তেমন সুবিধে হলো না। খাঁচাগুলোর আকৃতি এমন যে, এগুলোকে না পুরোপুরি সোজা দাঁড়ানো যায়, না আবার পুরো শরীর মেলে দিয়ে শুয়েও পড়া যায়। ইচ্ছে করেই এগুলো এমনভাবে বানানো যাতে বন্দিরা আরামে শুতে কিংবা দাঁড়াতে না পারে। আর এ কারণেই এই খাঁচাগুলোতে খুব লম্বা সময় ধরে বন্দি থাকা মানুষেরা ধীরে ধীরে পঙ্গু হতে শুরু করে।
কিরান যতটা সম্ভব লম্বা হয়ে শুয়ে খাঁচার মুখটাতে লাথি মারতে শুরু করল। একবার, দুবার, তিনবার লাথি মেরে খানিকটা হাঁপাতে লাগল সে। ক্লান্তিও লাগছে আবার পায়ে ব্যথাও লাগছে। কিন্তু থামলে চলবে না, এই গণ্ডগোলের সুযোগে বেরুতে না পারলে এই জীবনে আর বেরুতে পারবে না। আবারও লাথি মারতে যাবে তার আগেই টের পেল ওর পাশের খাঁচাটা ধীরে ধীরে নড়ে উঠছে।
কিরানের খাঁচাটা যেমন একদিকে বাঁকা হয়ে গিয়েছিল ঠিক একইভাবে ওর খাঁচার ধাক্কায় পাশে গোমেজের খাঁচাটাও বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তবে ওরটার মুখ বন্ধ হলেও গোমেজেরটা তা হয়নি। কিরান সেদিকে ফিরে দেখল বাঁকা হয়ে যাওয়া খাঁচাটার একদিক দিয়ে একটা হাত বের করে কিরান খাঁচার কবজাটা ধরে ফেলল, তারপর অমানুষিক শক্তিতে মুচড়িয়ে স্রেফ ভেঙে ফেলল ওটাকে। কবজা ভেঙে যেতেই খাঁচার মুখটা আলগা হয়ে গেল, আর সেদিক দিয়ে শরীর মুচড়ে বেরিয়ে এলো সে।
‘গোমেজ, এই দিক দিয়ে,’ কিরান ওর খাঁচার সঙ্গে লেগে থাকা খাঁচাটাকে দেখিয়ে দিল। গোমেজ এগিয়ে এসে নিজের ঢেকির মতো মোটা একটা পা তুলে স্রেফ লাথি মারল খাঁচার মুখ বন্ধ করে রাখা খাঁচাটাকে। দুবার লাথি মারতেই কিরানের খাঁচা থেকে আলগা হয়ে একপাশে খানিকটা সরে গেল ওটা। কিন্তু খাঁচাটা সরলেও কিরানের খাঁচার মুখের কবজাটা বাঁকা হয়ে আটকে গেছে। যে কারণে গোমেজ কয়েকবার চেষ্টা করেও ওটাকে খুলতে পারল না। এদিকে মানুষজনের হট্টগোল বেড়েই চলেছে। কিরান একবার বাইরের দিকে দেখল।
‘জলদি কর গোমেজ,’ কী হয়েছে, কেন হয়েছে কিছুই জানে না কিরান, কিন্তু এটা জানে প্রাণে বাঁচতে হলে পালাতে হবে। সেটা যারা বন্দি করে রেখেছিল তাদের হাত থেকেই হোক, বাজিতে হেরে যাওয়া ওর পাওনাদারদের হাত থেকেই হোক, আর যারা আক্রমণ করতে এসেছে তাদের হাত থেকেই হোক।
গোমেজ কয়েকবার চেষ্টা করেও সুবিধে করতে না পেরে রেগে গেল। রীতিমতো হুংকার ছেড়ে সে ফিরে গেল নিজের খালি খাঁচাটার কাছে। কিরান অবাক হয়ে দেখল গোমেজ নিজের বিশাল দুই বাহু দিয়ে খাঁচাটাকে দুইপাশ থেকে ধরে ফেলল। তারপর অপরিসীম শক্তিতে টেনে শূন্যে তুলে ফেলতে লাগল ওটাকে। গোমেজ কী করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আপনাতেই চোখ বন্ধ করে নিজের দুই হাতে মাথা আর কাঁধ আড়াল করে ফেলল ও। ভূমিকম্পের মতো শব্দ হয়ে খাঁচাটা আছড়ে পড়ল ওর খাঁচার ওপরে। তীব্র আঘাতে কবজা আর খোপ তো বটেই খাঁচাটারই একপাশ আলগা হয়ে গেল। আঘাতের চোটে কেঁপে ওঠে পড়ে গেলেও কোনো আঘাত পায়নি কিরান। খাঁচাটা আলগা হতেই সেদিক দিয়ে বেরিয়ে এলো সে।
একহাতে সে গোমেজকে ধরে দরজা পর্যন্ত প্রায় এগিয়ে গেছে। এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকাল। নিজের খাঁচার ফাঁক দিয়ে হাত বের করে করুণ সুরে ওকে ডাকছে বৈঠা। ওর ঠিক পাশ দিয়েই আরেকটা ছোটো হাত বেরিয়ে রয়েছে, ওর ছেলের। মুহূর্তেও জন্য দ্বিধা করল কিরান। এখানে এখন এক মুহূর্ত থাকাটাও জীবনের ঝুঁকি। তার ওপরে বৈঠা তার কেউ হয় না। কিন্তু একসময় লোকটা তার অধীনে কাজ করেছে। চাইলেও সে লোকটাকে আর তার ছোটো ছেলেকে এভাবে ফেলে যেতে পারে না।
দরজার কাছেই হুঁশ হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে সেই প্রহরী। তার পাশেই পড়ে আছে লোকটার লম্বা বর্শাটা। এক লাথিতে মাটি থেকে ওটা তুলে হাতে নিয়ে নিল কিরান। গোমেজকে দরজা পাহারা দিতে বলে ছুটে গেল বৈঠাকে বন্দি করে রাখা খাঁচাটার কাছে। বর্শার মতো দেখতে ফালাটাকে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিল কব্জার ভেতরে। তারপর জোরে একটা মোচড় মারতেই খোপ থেকে ছুটে গেল কবজাটা। সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে ধরে নিজের ছেলেকে আগে খোপের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিল সে। ছেলেটাকে টেনে বার করতেই নিজেও বেরিয়ে এলো সে। বেরিয়ে এসেই পড়ে গেল মাটিতে।
কিরান ভেবেছিল দীর্ঘ সময় ছোটো খাঁচার ভেতরে থেকে সে জড়তার কারণে পড়ে গেছে মাটিতে। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সে অনুধাবন করল বৈঠা তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছে, কৃতজ্ঞতার কান্না। চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে সে মাটি থেকে টেনে তুলে শক্ত ধমক লাগাল, ‘বৈঠা সোজা হ, এখন পালাতে হবে,’ বলে সে বৈঠার ছেলেকে দেখাল গোমেজকে। গোমেজ ছেলেটাকে কোলে তুলে নিতেই বৈঠাকে একহাতে ধরে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে। ওরা দরজা দিয়ে বাইরে আসতেই দেখল দুজন দৌড়ে চলেছে বাইরের গলির দিকে।
‘হইছে কী?’ তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে কিরান জানতে চাইল।
‘হার্মাদ হার্মাদ,’ বলে লোক দুজন আরো জোরে দৌড়াতে লাগল।
লোক দুজনার মুখে হার্মাদ শব্দটা শোনামাত্রই মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে গেল কিরানের। পর্তুগিজ জলদস্যুদের স্থানীয়রা হার্মাদ বলে ডাকে। স্প্যানিশ নৌবহরের প্রকৃত শব্দ ‘আর্মাদা’ থেকে বিকৃত হয়ে এই হার্মাদ শব্দের উৎপত্তি। তবে উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেন হার্মাদ শব্দটা এখন দক্ষিণ বঙ্গের উপকূলে আতঙ্কের প্রতিনিধি। একবার হার্মাদদের হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। কারণ হার্মাদরা কাউকেই ছাড়ে না। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু সবাইকে ওরা এক কাতারে বিবেচনা করে। জিনিসপত্র তো লুট করেই সেই সঙ্গে বৃদ্ধ আর শিশুদেরকে হত্যা করে সমর্থদের দাস হিসেবে বন্দি করে বিক্রি করে দেয় আরাকান কিংবা হুগলির বাজারে। গ্রামকে গ্রাম আর শহরের পর শহর উজাড় করে দেয় এই হার্মাদরা। কিন্তু এর আগে এভাবে সরাসরি আরাকানি বন্দিশালায় তাদের হামলার কথা কখনো শোনেনি কিরান।
মুহূর্তের ভেতরে অনেক ভাবনা খেলে গেল কিরানের মনে। লোকদুটোর পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দিক পরিবর্তন করল কিরান। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আরেকটু হলেই টহলদার প্রহরীদের একটা দলের সামনে পড়ে যাচ্ছিল ওরা। সৈন্যদের দলটাকে আসতে দেখে বৈঠাকে নিয়ে একটা নিচু দেয়ালের আড়ালে বসে গেল। মুখে আঙুল দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে বলল সবাইকে।
মনে মনে তহশিলদারের এই বন্দিখানার নকশাটা মনে করার চেষ্টা করল সে। এখানে আগে বহুবার এসেছে। পুরো জায়গাটা একটা জলা ঝিলের পাড়ে অবস্থিত। চারকোনা কাঁটাতারের বাউন্ডারি আছে বাইরে। গোল একটা মাঠের মতো আঙিনাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পুরো বন্দিশালাটা। ওরা এখন যেখানে আছে সেটা ধরে সামনের দিকে এগোলে মাঠের মতো জায়গাটা পার হয়ে বন্দিশালাটার প্রবেশ পথের দিকে যেতে পারবে। কিন্তু কিরান মনে মনে হিসেব করে বের করে ফেলল। যদি হার্মাদরা আক্রমণ করে থাকে তবে অবশ্যই সেটা সামনের দিক দিয়ে হবে। তাই সৈন্য দলটাকে পার হতে দেখেই সবাইকে হাতের ইশারায় ওর পিছু নিতে বলল।
কোমর বাঁকা করে নিচু হয়ে দৌড়ে ওরা পেরিয়ে এলো মাঠটা। পুরো জায়গাটাতে আলো জ্বলে উঠেছে। মানুষজনের হাঁক-ডাক আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। এর মাঝেই বাকিদের নিয়ে মোটামুটি সহজেই ঘর দুটো পার হয়ে এলো কিরান। কারণ সবাই যার যার প্রাণ বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত। ওদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময়-সুযোগ কারো নেই। ঘর দুটো পার হয়ে আসতেই সামনে কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল। বেড়ার অন্য পাশেই পানির জলা।
জলাটা চোখে পড়তেই খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সে। এই দিকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিরান একবার ভেবেছিল হার্মাদরা হয়তো সামনে থেকে আক্রমণ না করে পেছন থেকে জলা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেটা করেনি দেখে একটু হলেও স্বস্তি বোধ করল ও। বেড়াটা দেখা যেতেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের গায়ের জামাটা খুলে ফেলল সে। ওটাকে একটানে ছিঁড়ে দুই হাতে পেঁচিয়ে নিল তারপর ওকে অনুসরণ করতে বলে নিজে লাফিয়ে ধরে ফেলল তারের একাংশ। ওটা বেয়ে লাফিয়ে নেমে এলো অন্যদিকে।
এপাশে এসেই গোমেজকে ইশারা করল সে। এই আধো অন্ধকারের ভেতরেও কিরান দেখতে পেল গোমেজের মুখে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি। সে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বৈঠার ছেলেকে শূন্যে ছুড়ে দিল। ওপাড় থেকে ছেলেটাকে ধরে ফেলল কিরান। কিন্তু ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেল মাটিতে। ও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বৈঠা আর গোমেজ দুজনেই এপাড়ে চলে এলো। কিরানকে পড়ে যেতে দেখে টিটকিরির ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক শব্দ করে উঠল গোমেজ।
‘ঠিক আছে,’ অনেকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে উঠল কিরান।
উঠে দাঁড়িয়েই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। কয়েক দফা হাত-পা নাড়তেই পার হয়ে এলো সরু জলাটা। বলতে গেলে এপাড়ে কেউ নেই। জলার এপাড়ের বালুমাটিতে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বন্দিশালার দিকে ফিরে তাকাল কিরান। ওর বুদ্ধি কাজে দিয়েছে। হার্মাদের আক্রমণের কথা শুনে সবাই সামনের দিকে গেছে বের হবার জন্য। পেছন দিয়ে যে পালানোর উপায় আছে সেটা কারো মাথাতেই আসেনি। ওরও হয়তো মাথাতে আসত না। কিন্তু এই জায়গাটা আগে থেকে চেনাতে সে বুদ্ধিটা বের করতে পেরেছে।
যদিও এখনো অনেকদূর যেতে হবে তবুও বহুদিন পরে আবারও পুরনো দিনের মতো উত্তেজনা বোধ করছে সে। মুখে আবারও সেই অস্ফুট হাসিটা ফুটে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই পেছনে একটা শব্দ শুনে চট করে পেছন ফিরল সে। শব্দটা শোনামাত্রই সতর্ক হয়ে উঠেছে ওর প্রতিটা ইন্দ্রিয়।
‘ওস্তাদ,’ বৈঠা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল কিরান।
‘আমি কিছু একটা শুনছি…’ কিরান সতর্ক দৃষ্টি বোলাচ্ছে অন্ধকারে।
‘খরগুশ বেজি অইবো…’
আবারও বৈঠাকে থামিয়ে দিল কিরান। গোমেজও সতর্ক হয়ে উঠেছে।
‘ওইরম কিছু না, এইডা বালু মাটিত লাঠির বাড়ির শব্দ। আমরা…’ কিরানের কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্ধকারের ভেতর থেকে ওদের সামনে উদয় হলো চার- পাঁচজন লাঠিয়াল। চট করে পেছাতে গিয়ে দুম করে উলটে পড়ল কিরান। আর সে বৈঠার হাত ধরে থাকায় সেও তার সঙ্গেই গড়িয়ে পড়ে গেল ও। দুই দফা উলটানি খেয়ে সে সোজা হয়েই ঝিলের দিকে লাফ দেওয়ার পরিকল্পনায় ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল সেদিকেও দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লাঠিয়াল। অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বৈঠাকে শান্ত থাকতে বলে সে ঘুরে দাঁড়াল।
কিরান অসহায় বোধ করলেও গোমেজ তো আর অসহায় বোধ করার মতো মানুষ নয়। সে বৈঠার ছেলেকে মাটিয়ে নামিয়েই সোজা ছুটে গেল লাঠিয়ালদের দিকে। ভীম বেগে ছুটে যাওয়া গোমেজের কাঁধের ধাক্কায় স্রেফ উড়ে গেল দুই লাঠিয়াল। দুজনকে ফেলে দিয়ে ওদের একজনের লাঠি তুলে নিয়ে শূন্যে দুবার পাক খাইয়ে সে বাকিদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে তার আগেই মাথার কাছে করাৎ শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিরান।
একেবারে খুলির পাশে একটা একনলা বন্দুক চেপে ধরে মুখ বাঁধা একজন আবছাভাবে বলে উঠল, ‘কিরান ওরে থামতে ক, নাইলে খুল্লি উড়ায়া দিবো।’
সঙ্গে সঙ্গে কিরান মুখ দিয়ে শিস বাজাতেই থেমে গেল গোমেজ। মুখ বাঁধা একজনকে কিরানের মাথায় বন্দুক চেপে ধরে রাখতে দেখে সে রাগের সঙ্গে লাঠিটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে। চরম হতাশার সঙ্গে এক দলা থুতু ফেলল মাটিতে। সেই সঙ্গে রাগতদৃষ্টিতে তাকাল কিরানের দিকে। নিজের দুই হাত তুলে কিরান অসহায় একটা ভাব দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে তিন দিক থেকে পাঁচজন লাঠিয়াল লাঠি দিয়ে একটা খোপের মতো বানিয়ে ফেলল গোমোজের মাথার চারপাশে দ্রুত বেগে খোপের বৃত্তটাকে ছোটো করে এনে চাপ দিতেই মাটিতে শুয়ে পড়ল গোমেজ।
কিরান চোখ ফিরিয়ে বন্দুকওয়ালার দিকে ফিরে দেখতে পেল বন্দুকের নলটা সরে গেছে ওর খুলির পাশ থেকে। তার বদলে ওটার বাঁটটাকে তীব্র বেগে এগিয়ে আসতে দেখল ওর দিকে, এরপর সব অন্ধকার।
***
জ্ঞান ফিরে আসতে প্রথমেই চোখ পড়ল আবছা হলদে একটা আবরণের ওপরে। মুহূর্তের জন্য কিরানের মনে হলো সে নিজের ভারসাম্য হারাবে। দম বন্ধ হওয়ার একটা অনুভূতির সঙ্গে মনে হলো সমস্ত পৃথিবীটা চেপে বসছে তার ওপরে। পুরো শরীরটাকে দুবার ঝাঁকি দিয়ে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু বাঁধা হাত পায়ের কারণে সেটা তো করতে পারলই না, উলটো নিজের মুখটা আবরণের সঙ্গে ঘসা খেতেই কেমন জানি বিদঘুটে একটা অনুভূতির সঙ্গে তার মনে হলো নাকের ভেতরে কিছু একটা ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পর পর দুইবার তীব্র হাঁচির সঙ্গে বাঁকা হয়ে গেল শরীরটা।
যদিও মুখের ওপরে সেই হলদে জিনিসটার আবরণ তবুও হাঁচি দিয়ে নিজেকে অনেকটা নির্ভার মনে হলো। শরীরটা একটু স্থির হতেই মাথাটাকে দুবার ঝাঁকি দিয়ে আবরণটা সরানোর চেষ্টা করল সে, সেই সঙ্গে খুব সাবধানে টেনে পরখ করেনিল হাত-পায়ের বাঁধন। নাহ, ছাড়াবার কোনো পথই নেই। বিপদে পড়ার অনুভূতি কিরানের জন্য নতুন নয়। বরং বলা চলে, এই জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় সে বিপদের মধ্যেই কাটিয়েছে। আর তাই সে জানে বৃথা টানাটানি করে কোনো লাভ নেই। বরং যে জিনিসটা মুক্ত আছে সেটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করল সে, নিজের মস্তিষ্ক। কিছু ব্যাপার চিন্তা করে হেসে উঠল। যেন নিজেকে শোনাচ্ছে অনেকটা ভাবে বলে উঠল, ‘এবার খুলে দিতে বলুন, পরীক্ষা তো হয়েই গেছে। নাকি ভুল বললাম, চাচা?’
খুব কাছেই কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে কিরানের মাথার ওপর থেকে হলুদ আবরণের মতো জিনিসটা সরে গেল। খুব যে আলোর বন্যায় ভেসে গেল তা নয়, কিন্তু আধো অন্ধকার জায়গাটাতে লণ্ঠনের আলোটাই অনেক বেশি চোখে লাগল।
‘বুজলা ক্যামনে আমি তোমারে ধইরা আনছি?’ চোখের দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হয়ে আসতেই কিরান দেখল সুবাদার আকরাম বেগ একটা কেদারার ওপরে হেলান দিয়ে বসে হাতের তালুতে তামাক পাতা গোল করতে ব্যস্ত। ‘তোমগো তো মনে করার কথা হার্মাদেরা ধরছে,’ তার পরনে এখনো সকালের পোশাক। মুখমণ্ডলে অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ কিন্তু চোখ দুটো ঝকঝকে পরিষ্কার।
তার কথা শুনে মৃদু হেসে উঠল কিরান। ‘বন্দিশালাতে থাকতেই হার্মাদদের আক্রমণটা ঠিক হজম হইতেছিল না আমার। তবে ঝুঁকি নেওয়াটা অনেক বেশি হইয়া যায়। তাই পেছন দিয়া পালানোর চেষ্টা করছিলাম। আর ওইখানে যখন আপনার লাঠিয়ালরা আমগো ধরতে আইলো, এরপরে বুঝতে না পারার তেমন কারণ ছিল না,’ বলতে বলতে কিরান কামরাটার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল গোমেজ, বৈঠা আর ওর ছেলেকেও ঠিক ওর মতোই বেঁধে রাখা হয়েছে এককোণে। ‘ওই লাঠিয়াল বাহিনী এই এলাকায় কার আছে সেটা বুঝতে না পারার মতোন বোকা আমি না।’
‘আমি যে এখানে আছি বুঝলে কীভাবে?’ সুবাদার আকরাম বেগের মুখে কৌতুক। গোল করে পাকানো তামাকের ডলাটা বসিয়ে দিয়ে সে গড়গড়ায় আগুন দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল।
‘ওই ওটা,’ বলে কিরানও মৃদু হেসে উঠল। ‘ওই সুগন্ধি তামাকের গন্ধ দুই মাইল দূর থাইকাও টের পাওয়া যায়। আর ওই জিনিস টানার ক্ষমতা এই এলাকাতে খুব বেশি লোকের নাই,’ কিরান মাথা উঁচু করে নিজের মুখ বাঁকা করে হাত-পায়ের বাঁধন দেখিয়ে তেজের সঙ্গে বলে উঠল, ‘এইরকম বাইন্ধা রাইখাই কথা বলবেন?’
‘তুমার বুদ্ধিশুদ্ধি এক্কেরে যে যায় নাই এইটা দেইখা ভালো লাগল,’ আকরাম বেগ ধোঁয়া টানতে টানতেই তার প্রধান লাঠিয়াল চাপদাড়ির দিকে ইশারা করল। লোকটা দম দেওয়া কলের পুতুলের মতো এসে কিরানের বাঁধন খুলে দিল ‘ওগোরও,’ বলে নিজের লোকদেরকে দেখাল। তারপর আকরাম বেগের দিকে ফিরে রাগের সঙ্গে বলে উঠল, কথা বলার দরকার লাগলে সোজা কইলেই হইতো। ডাকলে কি আমি আসতাম না। প্রথমে সকালের নাটক, তারপরে আইজ সন্ধ্যার নাটক, তারপরে এমনে বাইন্ধা রাখার দরকার আছিল?’
আকরাম বেগকে দেখে মনে হলো না সে কিরানের কথায় কোনো পাত্তা দিল। ‘কিরান, তুমার হইছে কি ঠিক কইরা কও দেহি। তুমি তো বুদ্ধিমান পোলা আছিলা। তুমি আমার বন্ধুর পোলা দেইখা কইতাছি না,’ বলে সে গড়গড়ার নলের মুখটা কিরানের দিকে তাক করে বলল, ‘তুমি আসলেই বুদ্ধিমান পোলা আছিলা। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, সাহসী আর শক্তিশালীও,’ শেষ শব্দটা সে অনেক জোর দিয়ে উচ্চারণ করল। তারপর গড়গড়ার নলের মুখটা ওর দিকে তাক করে ওকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘সেই পোলার আইজ এই পরিণতি!’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল সে। ‘যেই পোলারে নিয়া আমার বন্ধু স্বপ্ন দেখত একদিন এই ছেলে অনেক বড়ো হইবে। তার বিরাট সাম্রাজ্য তার চাইতেও বড়ো করব, সেই পোলার আইজ এই পরিণতি,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল সুবাদার আকরাম খান।
‘চাচা, আমি আপনারে সম্মান করি। তাই বলে যা খুশি তাই কইলে…’
‘কি করবা তুমি?’ আকরাম খানের গলায় কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। এইটুকু বলে সে নিজের একটা একগাদা আংটি পরা ডান হাতটা ওপরে তুলল। ‘গত চাইরটা বছর তুমি কোনো কাম ঠিকমতো করো নাই, ব্যবসায় তোমার কোনো মনোযোগ নাই। বেশিরভাগ সময় নেশা করো, উলটা-পালটা বাজি ধরো, উলটা- পালটা কাম করো,’ আকরাম খানের গলার উত্তপ ধীরে-ধীরে বাড়ছে। ভুল কইলে ঠিক কইরা দিবা। গেল বছর থেইকা খণ্ডালের মাঠের বাজিতে সবচেয়ে বেশি টাহা তুমি হারছো। বুড়িগঙ্গার কাপড়ের ব্যবসায়ীগর লগে ঝামেলা করছ। ইজারার পাহাড় জমা পড়ছে তুমার ওপরে। বাজারে তুমার এত বেশি দেনা যে আইজকা সকালের বাজি হারনের পর তুমি রাউজান কিংবা রামু কিংবা খণ্ডালের মাঠ যেকোনো এলাকাতে গেলেই তুমারে ধইরা খুনও কইরা ফালাইতে পারে ব্যবসায়ীরা,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘কও ভুল কইছি? কথা কও পোলা?’ শেষ কথাগুলো বলার সময়ে রাগের হলকায় মনে হলো পুরো কামরা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
কিরানের মাথা নিচু হয়ে গেছে। আকরাম বেগ তার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে খোঁজখবর করে তারপরেই ধরে এনেছে তাকে। কিন্তু এতে এই মানুষটার স্বার্থ কী-বেশি ভাবতে হলো না তাকে। এর পরের কথাতেই জবাব পেয়ে গেল সে।
তুমি হয়তো ভাবতাছ, কথা নাই-বার্তা নাই হঠাৎ তুমারে নিয়া আমার এত মাথা ব্যথা অইলো ক্যান?’ বলে সে তামাকের গড়াগড়ায় জোরে টান দিয়ে একটা পা তুলে বসল চেয়ারে। ‘কারণ আর কিছুই না। তুমার বাপ যে কিনা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও,’ আকরাম বেগ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিরানের দিকে। বাপের নাম শুনে তার ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা বোঝার জন্য।
কিরান সত্যি সত্যি তার বাপের কথা শুনে চোখ তুলে তাকাল আকরাম বেগের দিকে। ‘হঠাৎ…’
আকরাম বেগের গলায় উদাসীন্য। ‘তুমি তো দেশ-দুনিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়া ভালোই ওকাবিহাল আছ। আমগোর এই মাটি আর দক্ষিণের পানি যে চাপের মধ্যে আছ তুমি তো জানোই। ওই দিকে ত্রিপুরা-আসাম, দক্ষিণে আরাকান, উত্তর পুবের মোঘলরা সবাই এই ভূমির ফায়দা নিতে চায়। এইহানের মাটিতে ফসল, পানিতে মাছ, মানুষের হাতে মসলিনের জাদু। তাই এই মাটির দাম এহন সবচেয়ে বেশি। তার ওপরে যোগ হইছে সাদা কুত্তারা,’ ফিরিঙ্গিদের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ রাগে বিকৃত হয়ে উঠল। ‘ফিরিঙ্গি কুত্তারা আগে মানুষ মারত, লুটতরাজ চাইলাইতো, এহন হেরা আর আরাকানের শুয়োরের বাচ্চারা মিল্লা মানুষ লুট করা শুরু করছে। বুড়া বাচ্চা সব মাইরা গ্রামকে গ্রাম মানুষ ধইরা লয়া যাইতাছে। দক্ষিণের কূল খালি হইয়া যাইতাছে হারামীগর অত্যাচারে,’ বলে সে আবারও গড়াগড়ার ধোঁয়া টেনে নিল। ‘আর যতদিন শাহ সুজা সুবা বাংলার সুবাদার আছিল এরচেয়ে সুখী সময় এই বাংলায় আর আসে নাই।’
‘সে তো তার ভাই আওরঙ্গজেবের লগে হাইরা এহন আরাকানে…’
‘আরাকানরাজ তারে পরিবারসহ হত্যা করছে…’ আকরাম বেগের কথা শুনে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়লো, ‘এত বড়ো ধোঁকা! নিজের অতিথির বুকে ছুরি চালাইল ওরা, কিরান বুঝতে পারছে শাহ সুজার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যার পরিণতি সবাইকে ভুগতে হবে। ‘দিল্লি তো তাইলে…’
‘দিল্লি কী করব হেইডা এখন আমাগের জন্য বড়ো কিছু না,’ আকরাম বেগের গলায় সতর্কতা। ‘নিজেগো পাছা এহন আমগো নিজেগো বাঁচাইতে অইবো। আর হেই জন্য আমি তুমারে ডাইক্কা পাডাইছি,’ আকরাম বেগ তার গড়াগড়ার নলটা আবারো ওর দিকে তাক করল। ‘তুমি টেসকাইয়া গেলেও বুদ্ধিশুদ্ধি এহনো তুমার খারাপ নাই, এইডা আমি বুঝতে পারছি। তয় তুমার বুদ্ধি তো বটেই, তুমার শক্তিও আমার দরকার। কইতে পার আমাগো দরকার।’
মানে, চাচা? বুঝলাম না,’ কিরানের গলায় সতর্কতা। আকরাম বেগকে ধোঁয়া টানতে দেখে তার মদ আর ধোঁয়া দুটোরই পিপাসা পেয়ে বসেছে। আর শেষ কখন খেয়েছিল সেটা মনেও নেই। শরীর খারাপ লাগত কিন্তু সেটা হচ্ছে না কারণ আকরাম বেগের কথা শুনে ওর মাথা ঘুরে উঠেছে। ও এটা বুঝতে পারছে এই এলাকার ক্ষমতার খেলা চিরকালের মতোই বদলে যাচ্ছে, শুধু এই এলাকার নয় পুরো ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাঙাল মলুকের রাজনীতির পট বদলে যেতে বসেছে। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না, এতে ওর ভূমিকাটা কী।
‘শোনো, গুজব আছে আরাকান রাজের ওখানে শাহ সুজা পরিবারসহ নিহত হলেও মোঘলদের যে বিরাট সম্পদ সে আরাকানে নিয়ে গেছিল সেটার টিকিও ধরতে পারেনি আরাকানরাজের লোকেরা। শোনা যাচ্ছে, শাহ সুজার খুব কাছের কিছু মানুষ ওই সম্পদের প্রায় পুরাটাই লয়া পলাইছে ম্রোহং থেইকা।’
কিরান বেশ কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকরাম বেগের দিকে। আর আপনারা এই আজব গুজবে বিশ্বাস করছেন?’
তুমি পোলা কথা বেশি কও,’ আকরাম বেগ জোরে ধমক দিল কিরানকে। ‘আগে পুরাডা শোন,’ বলে সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলতে লাগল। ‘কে কার সম্পদ লয়া পলাইছে এইডা আমার কিংবা আমাগো মাথা ব্যথা না,’ গড়গড়ায় ধোঁয়া ছাড়ল আকরাম বেগ। আমি এবং আমার পিছে যারা আছে হেগো মাথা ব্যথা অন্য জায়গায়। ‘প্রথম কথা, শাহ সুজার ওইখান থেকে যারাই পলাইতে পারছে হেরা আমাগো কাছের মানুষ। হেগো নিরাপত্তা আমাগো লাইগা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় কথা, এই লোকগুলারে ধাওয়া করতে আরাকানরাজ পর্তুগিজ থেইক্কা শুরু কইরা নিজেগো লোকসহ বেশ বড়ো একটা বাহিনী বানাইছে। আর এই বাহিনীর ব্যাপারেই আমগো সব আগ্রহ।’
‘কারণ কী?’ কিরান এবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি তো জানোই গত কয়টা মাসের মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনে আমগো এই মুল্লকের দশা খাড়াইছে না ঘরকা না ঘাটকা। আমরা সুবাদার ব্যবসায়ী, যারা বৃহত্তর চাঁটগাওয়ে ব্যবসা করি হেগোর অবস্থা কাহিল হয়া গেছে নানা কারণে। যতদিন শাহ সুজা বাঙাল মুলুকের সুবাদার আছিল আমরা পরম শান্তিতে একরকম কইতে গেলে ঘুমাইতে ঘুমাইতে ব্যবসা করছি। হে যাওয়ার পর এহন মোঘল একরকম কইতে গেলে আমগো শত্রু। তার ওপরে স্থানীয় রাজারা বিদ্রোহ করতাছে। তার ওপরে আবার উপকূল আর নদীপথ যেইটা আমাগো ব্যবসার মূল মাধ্যম, হেইটাতে পর্তুগিজ আর হার্মাদগো যন্ত্রণায় ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, টানা কথা বলে আকরাম বেগ একটু থামল। ‘অবস্থা এহন খুবই কাহিল। এতদিন ওরা লুটতরাজ করত, এহন মানুষ সুদ্ধা ধইরা লইয়া যাইতাছে। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হইয়া যাইতাছে। এমন চলতে থাকলে আমরা চাঁটগায়ের ব্যবসায়ীরা তো বটেই এমনকি দক্ষিণ এলাকার মানুষেরাই নাই হয়া যাব। তার উপ্রে এহন যোগ অইছে আরাকানিরা
‘সম্রাটের মৃত্যুর লগে এর সম্পর্ক কী?’ কিরান এখনো ধরতে পারছে না ব্যাপারটা।
‘আছে। আমগো উপকূল এলাকায় যে অত্যাচার শুরু করছে দস্যুরা এর একটা প্রতিকার আমগোরই করতে অইবো। আর এর একটা সুযোগও দেহা দিসে। আমগো উপকূল এলাকায় যে কয়টা দস্যু দল উৎপাত চালাইতাছে এগোর মূলে আছে একজন মানুষ। আর এইবার হেরেই নিয়োগ দিছে আরাকানরাজ,’ বলে আকরাম বেগ একটু থামল।
কিরান আনমনেই একটা ঢোক গিলল বড়ো করে। ‘গঞ্জালেস ডি সিলভেরা, চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল কিরান।
আকরাম বেগ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিরানের দিকে। ‘একদম ঠিক। এই শালার অত্যাচারেই অতিষ্ট আমরা। আর হেরে দমন করার এই একটাই সুযোগ আমাগো হাতে আইসা পড়ছে। হেয় কহন কই থাকে এইটা ঠিকমতো জানা অসম্ভব একটা ব্যাপার। কিন্তু এইবার আমরা জানি হে কোনদিকে যাইতাছে। আর আমরা এও জানি কে তারে নিয়োগ দিছে, হেয় কার পিছে লাগছে। আর তার পিছেই আমরা আমাগো লোক লাগামু, যে ওরে আর ওর বাহিনীরে নিকেশ কইরা আমাগো মানুষটারে উদ্ধার কইরা আনতে পারব। আর এইখানেই দেখা দিছে তুমার ভূমিকা!’
কিরান প্রায় উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আকরাম বেগের দিকে। তার স্মৃতি চলে গেছিল অনেক দূরে। কিন্তু আকরাম বেগের কথা এই পর্যন্ত শুনে সে প্ৰথমে মৃদু হেসে উঠল। তারপর প্রায় জোরে জোরে হাসতে লাগল। নিজের কম্পনরত ডান হাতটা চোখের সামনে একবার তুলে ধরে সে বলে উঠল, ‘চাচা, আমি আপনেরে আমার বাপের পরে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ মনে করতাম আর সেই আপনে কিনা আমারে খুইজ্জা বাইর করছেন সিলভেরারে ধরার লাইগা,’ এইটুকু বলে সে আবারও জোরে হেসে উঠল। কিরানের হাসিটা শেষ হলো কাশি দিয়ে। হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করল সে, তারপর কাশতেই লাগল। কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে গেল। কাশির বেগ কমে এলে এক হাতে অপর হাত চেপে ধরল সে। তার কম্পনরত হাত দুটোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকরাম বেগ। কিরানও খেয়াল করল ব্যাপারটা। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। সিলভেরার নাম শুনলেই তার এরকম হয়। ব্যাপারটা নতুন নয়, এর আগেও ঘটেছে। কিরান ঘাড় বাঁকিয়ে একবার গোমেজে দিকে দেখে নিল। সিলভেরার নাম শুনে গোমেজও কান খাড়া করে ফেলেছে।
‘তুমি ঠিক আছ, ভাতিজা?’ আকরাম বেগ স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি নরম গলায় জানতে চাইল। ‘এই, ওরে পানি দে।’
আকরাম বেগের লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান চাপদাড়ি লোকটা একটা পাত্রে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল কিরানের দিকে। পানি খেয়ে নিয়ে খানিকটা স্বাভাবিক হলেও হাতের কম্পন পুরোপুরি থামল না। কিরান অনুভব করল তার পিঠের দিকে কোমরের নিচের অংশে অদ্ভুত একটা ব্যথা পাক খেয়ে উঠছে। কম্পনরত হাতটাকে সে চোখের সামনে তুলে ধরে আকরাম বেগের দিকে ইশারা করল। ‘দেখছেন চাচা, যেই লোকের নাম শুনলে আমার এই অবস্থা হয় সেই লোকের পেছনে আপনেরা আমারে লাগাইতে চান। যারে কিনা মোঘল বাহিনী পর্যন্ত কাইত করতে পারে নাই,’ বলে সে আপনাতেই একবার মাথা নাড়ল। ‘বোকা কি আপনে না আমি?’
আকরাম বেগের মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না। ‘কিরান তুমি বোকা না, আর তুমিও এইটা ভালাই জানো। আমি বা আমার পিছে যারা আছে হেরাও বোকা না,’ বলে সে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল গড়গড়া থেকে। ‘তোমারে একটা সত্যি কথা কই। শাহ সুজার মৃত্যুর লগে লগে যহন এইরকম এটা পরিকল্পনা হয় এবং এর পেছনে তুমারে লাগানোর কথা উঠে। আমিই ওই ব্যাপারটাতে ভেটো দিসিলাম সবার প্রথম। কিন্তু একজন অত্যন্ত শক্তিশালী মানুষ তোমার ওপরে ভরসা রাখতে চায়। তারপরেও আমি হ্যাঁ-না কিছুই কই নাই। কারণ আমি নিজে তোমারে পরখ কইরা দেখবার চাইছিলাম। আর এই কারণেই আইজ সকালের আয়োজনে তোমারে ষাঁড়ের লড়াইয়ে মাঠে নামাইছিলাম আমি। স্রেফ দেখবার লাইগ্গা তুমার ভেতরে আগের কিরান আছে কি নাই? বিশ্বাস করো, আমি মনে করি এহনো তোমার ভেতরে সেই কিরান বাঁইচা আছে,’ একটানা বলে সে থেমে গেল।
‘আরেকটা কথা, তুমি নিজের কথা কইলা। এইবার আমি আমাগো কথা কই। সিলভেরার জ্বালায় পুরা চাঁটগাওয়ের ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। আরাকান, হুগলি, বোম্বে, জাভা এই পুরা চলাচলের পথটারে জ্বালায়া খাইতাছে এই হারামজাদা। ওরে মারার লাইগ্গা আর আরাকানরে এট্টু সাইজ করনের লাইগ্গা বহু ক্ষমতাশালী লোক বহুকিছু বিসর্জন দিতে রাজি আছে,’ বলে সে নিজের একটা হাত তুলল। ‘তুমি যদি রাজি হও কাইলের ভেতরে তোমারে তিনটা জাহাজ আর দরকারি জিনিস দেওয়া অইবো, যত অস্ত্রপাতি লাগে, এমনকি তোমার যত ধারদেনা আছে সব ব্যবসায়ীগো পক্ষ থেইকা শোধ করা অইবো। তুমার ব্যবসায়ের অনুমতি ফিরায়া দেওয়া অইবো। আর যাতে তুমি নতুন ব্যবসা শুরু করতে পার সেই ব্যবস্থা আমি নিজে করব। আমি নিজে তোমারে পুঁজি দিব। এহন বলো তুমার যে অবস্থা তাতে নতুন কইরা জীবন শুরু করার লাইগা এর চাইতে …’
‘চাচা, আমি পারব না, কিরানের দৃষ্টি শূন্যের দিকে। তার মনের কোণে ভেসে উঠেছে দৈত্যের মতো একজন মানুষের অবয়ব। যার মাথার পেছন থেকে ইটের ভাটার মতো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সেই মানুষটা তার শক্তিশালী দুহাতে শূন্যে ধরে রেখেছে তাকে। রক্তবর্ণ চোখদুটোয় তার হত্যার উল্লাস। এর পরবর্তী দৃশ্যটার কথা মনে করে কিরানের মুখ আপনাতেই নিচের দিকে নেমে গেল। আবারও সে অনুভব করল জোড়া লাগা মেরুদণ্ডটা থেকে অদ্ভুত এক ব্যথা পাক খেয়ে উঠছে। ‘আমার দ্বারা হবে না, চাচা। একবার আমি বাঁইচা গেছি। আমার জাহাজ ধ্বংস হইছে। তাও এইগুলা আমি সহ্য করতে পারি। কিন্তু আমার মানুষেরা যারা আমার কারণে…’ গলা ধরে আসছে কিরানের। যাগো আমার কারণে, আমার বোকামির কারণে, আমার ব্যর্থতার কারণে মরতে হইছে তাগো মৃত্যুর দায়ভার আমি সহ্য করি কীভাবে, আপনার কোনো ধারণা আছে?’ কিরান তাকিয়ে আছে আকরাম বেগের দিকে। যদি নিজের সামর্থ্যের কথা আমি চিন্তা নাও করি, আপনার কি মনে হয় আমি একই ভুল আবারও করব। আবারও কিছু মানুষের জীবন আমি ঝুঁকিতে ফালাব আমার নিজের কারণে,’ জিভ টকটক শব্দ করল সে। ‘কখনই না, চাচা।’
‘ওইদিন ভারত সাগরে যা হইছিল তাতে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি কার হইছিল?’ আকরাম বেগের গলায় কোনো বেগ নেই। ‘তোমার বাহিনীর না তোমার? ওরা তো মইরা বাঁইচা গেছে। যারা বাঁইচা আছে, তারা যে সবাই তোমার মতো জীবন্ত লাশ হইছে সেইটা…’
মৃত্যুর চেয়ে বড়ো ক্ষতি আর কিছু হয় না, চাচা, উদাস গলায় বলে উঠল কিরান। ‘মইরা গেলেই সব শেষ।’
‘না, কিরান, মইরা গেলেই সব শেষ না,’ আকরাম বেগের গলায় সামান্য উত্তেজনা। ‘মৃত্যুর চেয়েও খারাপ হইলো মৃত হইয়া বাঁইচা থাকা। তুমি যেভাবে বাঁইচা আছ এভাবে বাঁচা…’ আকরাম বেগ একটা হাত তুলল। ‘ঠিক আছে, যদি মৃত্যুর কথাই কও তয় তুমি ভাবছ তোমার নিজের মানুষগো আবারও ঝুঁকির মধ্যে ফালাবা। কিন্তু তুমি এইটা ভুইলা যাইতাছ যে, তুমি যদি আইজ এগায়া না আসো তবে স্রেফ এই কারণে কতো কতো নিরীহ মানুষ মারা যাবে?’ প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে কিরানের দিকে তাকিয়ে রইল আকরাম বেগ।
‘আমি পারব না, চাচা,’ বলে সে মাফ চাইবার ভঙ্গিতে আকরাম বেগের দিকে দুই হাত জোর করল। তারপর গোমেজ আর বৈঠার দিকে ফিরে ইশারা করল দরজার দিকে এগোবার জন্য।
‘ঠিক আছে তোমার ইচ্ছা,’ বলে আকরাম বেগ একবার মাথা নাড়ল। ‘তোমার বাপের সঙ্গে শেষ কবে কথা হইছে তোমার?’
উঠে যেতে যেতে হঠাৎ সে ফিরে তাকাল আকরাম বেগের দিকে। লোকটা হঠাৎ এই কথা বলল কেন। ‘ইয়ে মানে,’ আমতা আমতা করতে করতে বলে উঠল কিরান। ‘বাপুর সঙ্গে, অনেকদিন মানে…’
‘তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে, কিরান।’
আকরাম বেগের উচ্চারিত শেষ বাক্যটা শুনে কিরানের বুকটা একবার লাফ দিয়ে উঠল। হঠাৎ ওর মনে হতে লাগল ওর হৃৎপিণ্ডটা ধরে কেউ আগুনে-আঁকশি দিয়ে চেপে ধরেছে। ‘মানে কী, বাপুর আবার কী হইলো?’
তুমি কিন্তু একবারও জানতে চাও নাই আরকানরাজের ওইখান থাইকা সম্রাট শাহ সুজার খুব কাছের যে মানুষটা পালাইতে পারছিল সে কে?’ আকরাম বেগ বসা থেকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল কিরানের দিকে। কোনো জবাব না দিয়ে কিরান তাকিয়ে রইল তার দিকে।
‘সেই মানুষটা আর কেউ না, তোমার বাবা—তালেব তৈমূর,’ বলে আকরাম বেগ একবার থামল। ‘এই ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে শাহ সুজার যারা মিত্র তাগো ভেতরে তোমার বাবাই ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। আর এটাও ঠিক যে, আরাকানরাজের পাঞ্জার ভেতর থাইকা কেউ যদি পালানোর ক্ষমতা রাখে সেইটাও তোমার বাবা। হইছেও তাই। তোমার বাবাই শাহ সুজার সব গচ্ছিত জিনিস নিয়া ম্রোহং থেইক্কা জাহাজে কইরা সরতে পারছে। আর তার পেছনেই লাগতে যাইতাছে আরাকানরাজের বাহিনী, মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যু সাগরের শকুন নামে পরিচিত সিলভেরা। এখন কও, তোমার বাবারে বাঁচানোর জন্য হইলেও তুমি কামডা করবা কিনা?’
কিরানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, চোখে পাথরের দৃষ্টি। সে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, আকরাম বেগের কথা শুনে আবার বসে পড়ল। ‘আমি রাজি আপনার প্রস্তাবে। বলেন কী করতে হবে আমার?’
আকরাম বেগ গড়গড়ায় জোরে শেষ একটা টান দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিল চাপ দাঁড়ির হাতে। ‘আমি আগেই বলেছি আমরা চাই, তুমি সিলভেরার পিছু নিয়ে তারে নিকেশ করবা, সম্ভব হলে আরাকানরাজের বাহিনীর আর মগ জলদস্যুগর একটা অংশও। আর এই জন্য যা যা রসদ আর খরচ লাগে আমরা দেব। তোমার কাজ হবে একটা দল বানানো এবং এইসব শকুনগোরে শেষ কইরা তোমার বাবারে ফিরায়ে আনা।’
কিছু না বলে আকরাম বেগের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তালেব কিরান। বাপুর বিপদের কথা শোনার পর ওর পক্ষে এখন আর পিছু ফেরা সম্ভব না। বাপুকে সাহায্য করার জন্যে দক্ষিণ সমুদ্র তো অনেক সহজ, লাগলে ও নরকে পর্যন্ত যাবে।