মগরাজ – ৭

অধ্যায় সাত – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

রামু, চট্টগ্রাম

হিসেবের ভেতরে গড়মিল হয়নি বরং পুরা হিসেবটাই কেঁচিয়ে গেছে কিরানের।

আরক রাখার চামড়ার থলিটা নিজের দুই ঠোঁটের ওপরে একেবারে উপুড় করে ধরল তালেব কিরান। মনের ভেতরে দুরাশা, যদি খানিকটা তরল রয়ে গিয়ে থাকে থলিটার একেবারে তলায়। ওর যে-অবস্থা তাতে কয়েক ফোঁটাও যদি মুখে পড়ে তবে সেটাও লাভ। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করে মনে হচ্ছে না কোনো লাভ হবে। থলিটাকে মুখের ওপরে ধরে তলা থেকে দু-আঙ্গুলে চাপ দিয়ে টান দিতেই তলির একেবারে তলায় লুকিয়ে থাকা কয়েক ফোঁটা বিশেষ তরল গড়িয়ে পড়ল কিরানের শুষ্ক জিহ্বার ওপরে।

শেষ ফোঁটা কটা জিহ্বায় পড়তেই ছ্যাঁত করে যেন আগুন ধরে গেল শুষ্ক জিহ্বায়। পিপাসার্ত মুখে আরকের ফোঁটা কটা যেন পিপাসা বাড়িয়ে দিল আরো বহুগুনে। জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে থলিটা হাতে মুড়িয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে লোহার শিক লাগানো গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল সে।

নিজের এই বিচিত্র জীবনে বহুকিছু করার অভিজ্ঞতা থাকলেও এর আগে কখনো জেল খাটা হয়নি ওর। এমনকি মোঘল সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময়ে একধিকবার প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ারও অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। কিন্তু এর আগে কখনো গরাদের ভেতরে বন্দি থাকেনি ও। তাই লোহার খাঁচার মতো গরাদের ভেতরে শুয়ে কারাগারের ভেতরে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন বোঝার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু অন্য সময়ের থেকে আলাদা কোনো অনুভূতি হলো না ওর। বরং মনের ভেতরে কেমন জানি একটা স্বস্তির অনুভূতি কাজ করছে।

কথাটা মনে আসতেই মৃদু হেসে উঠল কিরান। কারণ এই মুহূর্তে আরাকান রাজার বন্দি না হলে পাওনাদাররা ওকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত। কারাগারের ভেতরে থাকায় অন্তত পাওনাদারদের থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এটাই বা কম কী।

নাহ, এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে না। অন্তত গোমেজের খবর নেওয়া উচিত। কথাটা ভাবামাত্রই শুকনো খড়ের ওপর থেকে উঠে বসল কিরান। শরীরটাকে টান- টান করে বসা অবস্থাতেই আড়মোড়া ভাঙার চেষ্টা করল সে। তারপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঠুকে গেল অমসৃণ তারের জালের সঙ্গে।

মাথার তালু ডলতে ডলতে এগিয়ে গেল লোহার মোটা গারদের সামনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওর পাশের একই রকম আরেকটা গারদে গোমেজ কী অবস্থায় আছে।

খণ্ডালের মাঠে ওর সঙ্গেই আরাকানরাজের সৈন্যরা গ্রেপ্তার করেছিল গোমেজকেও। কিরানের দৃঢ় বিশ্বাস গোমেজ চাইলে খুব সহজেই খণ্ডলার মাঠ থেকে অন্যদের সঙ্গে পালাতে পারত। কারণ ছাউনির নিচে থাকা বাজিকরেরা কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। তার মানে ওদেরকে কেউ আগেই খবর দিয়ে দিয়েছিল, যাতে ওরা পালাতে পারে। অথবা এরকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে এটা বুঝতে পেরে, ওরা আগেই টের পেয়ে পালিয়ে গেছে। ধরা পড়েছে শুধু এলেবেলে কিছু লোকজন। কিছু ব্যাপারি আর মাঠে অবস্থানরত দস্তকদের ভেতরে রয়েছে একমাত্র ও আর গোমেজ। কিরান জানে গোমেজ আসলে চাইলেই পালাতে পারত কিন্তু সে কিরানকে ফেলে পালায়নি।

খণ্ডলার মাঠ থেকে ওদেরকে গ্রেপ্তার করে পায়ে হাঁটিয়ে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রামু দুর্গে। সেখানে তাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কারণ থেকে শুরু করে সব অপরাধ পড়ে শোনানো হয়। সেখানই দুপুর পর্যন্ত কাটানোর পর আরাকানরাজের বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে ওদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই বন্দিশালায়। এখানে আনার পর প্রথমে ওদেরকে যাচ্ছেতাইভাবে কতক্ষণ পেটানো হয়েছে, তারপর গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে আসা হয় বন্দিশালার একপাশে একটা লাগোয়া কারাগারে।

আসলে জায়গাটাকে কারাগার না বলে ছোটো ছোটো একগুচ্ছ গরাদের সারিও বলা যেতে পারে। গরাদগুলোকে আবার গরাদ না বলে খাঁচা বলাটাই শ্রেয়। কিরানের শরীরের এখানে-ওখানে নানা ধরনের ব্যথার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কারণ একে তো বহুদিন পর সুলতানের মতো ওরকম একটা দানবের মুখোমুখি হওয়া, তারপর আবার এতদূরের পথ হেঁটে আসাটা ওকে একেবারে কাহিল করে দিয়েছে। তার ওপরে উলটো-পালটা মারও পড়েছে আবার। তবে ও ভেবেছিল কারাগারে প্রবেশ করতেই কপালে লোহা পুড়িয়ে অপরাধীর ছাপ দিয়ে দেবে, সেটা এখনো দেয়নি দেখে অনেকটাই স্বস্তি পাচ্ছে ও।

স্বস্তি শব্দটা মনে আসতেই আবারও আনমনে হেসে উঠল কিরান।

আর স্বস্তি!

পরিবার ছেড়েছে বহু আগেই। তারপর হারিয়েছে নিজের জাহাজ থেকে শুরু করে সব। ছেড়েছে নৌবাহিনী, এরপর গেছে ব্যবসা। শেষ ভরসা হিসেবে নিজের যা কিছু ছিল সেটা নিয়েই বাজি ধরেছিল, সেটাও ডুবেছে। এখন শুধু প্রাণটাই বাকি আছে। আর হ্যাঁ, রয়ে গেছে নিজের একান্ত বিশ্বস্ত সাথি গোমেজ।

‘গোমেজ, গোমেজ,’ গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে গোমেজ যে গরাদের ভেতরে আছে সেটার লোহার আবরণের ওপরে মৃদু শব্দ করার চেষ্টা করল ও। গোমেজ ছিল পর্তুগিজ ব্যবসায়ী। কিরান যখন নৌবাহিনীতে কাজ করে তখন এক জলদস্যুর আক্রমণে পরিবারসহ সব হারিয়ে সে যখন পাগলপ্রায় তখন কিরানই তাকে পানি থেকে তুলে আশ্রয় দিয়েছিল নিজের জাহাজে। পরিবার থেকে শুরু করে নিজের সব হারিয়ে গোমেজ তখন পাগলপ্রায়। সেখান থেকেই কেন জানি সে রয়ে যায় কিরানের দলের সঙ্গেই। কখনো ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি নিজের জ্ঞাতি ভাইদের মাঝে। পর্তুগিজ আর বাঙালির মাঝে এরকম মেলবন্ধন চাটগাঁও এলাকা তো দূরে থাক পুরো দক্ষিণে কেউ দেখেনি।

ব্যাপার কী, ব্যাটা অবার অসুস্থ-টসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি! ‘এই গোমেজ?’ এবার আরেকটু জোরে ডাকার চেষ্টা করল সে। বেশি জোরে ডাকার সাহস পাচ্ছে না। একে তো আশপাশে নানা ধরনের বন্দি আছে, তার ওপরে কিছুক্ষণ পরপর বন্দিশালার পাহারাদার টহল দিয়ে যাচ্ছে।

কিরানের কাছে সবসময় মনে হয় আরাকান রাজের লোক মানেই একেককটা দানব। মানবিকতাবিহীন পশুর মতো এরা। আর তাই অন্যদের সঙ্গে আচরণটাও করে পশুর মতোই। কথায় কথায় চাবুক চালানো এদের স্বভাব। বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে এরা স্রেফ চাবুক মেরেই মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। আরাকানি পাহারাদারেরা যদি একবার টের পায় এখানে বন্দিদের মধ্যে কেউ একজন সমস্যা করছে, স্রেফ চাবকেই মেরে ফেলবে। আজকে বন্দিদের দলে সঙ্গে প্রবেশ করার সময়ে কিরানের বুকটা একবার কেঁপে উঠেছিল, কারণ কথিত আছে এখান থেকে মানুষ নাকি বের হয় মৃত অবস্থায় আর না হয় হাত-পা-চোখ-নাক কিছু একটা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে। ওদের কপালে কী আছে, কে জানে। ‘এই গোমেজ?’ গোমেজের জন্য কিরানের বেশি চিন্তা হচ্ছে, কারণ এলোপাতাড়ি চাবুক চালানোর সময়ে গোমেজ বেশ মার খেয়েছে। যে-প্রহরী চাবুক মারছিল বিশালাকায় গোমেজের ভাগ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মার বরাদ্দ করতে বিন্দুমাত্র কসুর করেনি সে।

খাঁচার ফাঁক দিয়ে মুখ বেঁকিয়ে গোমেজের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছিল কিরান, হঠাৎ সামনে থেকে মৃদু শিসের শব্দে চমকে উঠল ও। ওর সামনের আরেকটা গরাদের ভেতর থেকে কেউ একজন শিস দিয়ে উঠেছে। অন্ধকারের ভেতরে প্রথমে একটা আবছা ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। ভালোভাবে চোখ কুঁচকে তাকাতেই চুল-দাড়িওয়ালা একটা অবয়ব দেখা গেল। ব্যাপার কী, এই ব্যাটা শিস দিচ্ছে কেন।

‘আপনে হুজুর তালেব না?’ সামনের লোকটা প্রশ্ন শুনে হঠাৎ একটু চমকে উঠল কিরান। ব্যাপার কী? এই গজব পড়া কারাগারে কে ওর নাম ধরে ডাকে। ‘কে তুমি?’ প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু কৌতূহলের কাছে বাস্তবতা পরাজয় লাভ করতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে কথাটা।

‘হুজুর, আমি হেকমত বৈঠা,’ বলে লোকটা যেন মৃদু হেসে উঠল।

‘কে?’ প্রশ্নটা উচ্চারণ করতেই হঠাৎ লোকটার কথা মনে পড়ে গেল কিরানের। মনে পড়ার পেছনে প্রথম কারণ হলো লোকটার অদ্ভুত নাম। কর্ণফুলির তীরের নৌ- নির্মাণকারী গ্রামের ছেলে হেকমত বৈঠা হলো তাদের গ্রামের বৈঠা নির্মাণকারীদের ভেতরে সেরা কারিগর। এই লোকটা সম্ভবত একটা সময় তার বিশেষ বাহিনীর ভেতরেও সেরা কারিগর ছিল। অবশ্য কিরান যে-সময়ের কথা ভাবছে সেটা আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। এখন নিশ্চয়ই সে আর আগের সেই বৈঠা নেই। তা না হলে এখানে থাকত না সে।

বৈঠা, তুই এইখানে? ক্যামনে?’ কিরান এরকম বিধ্বস্ত অবস্থাতেও এই লোককে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে। কারণ ওর যতটুকু মনে পড়ে ওর বাহিনী ভেঙে যাওয়ার পর বৈঠা তার কারিগরদের দল নিয়ে অন্য বাহিনীতে চলে গেছিল।

‘আরে ওস্তাদ, তুমি এইখানে?’ বৈঠাকে দেখে মনে হচ্ছে, কিরানকে দেখে সে যারপরনাই খুশি। ‘তুমারে দেইখা কি যে ভাল্লাগতাছে, কি কমু, এই ওঠ,’ বলেই বৈঠা পা দিয়ে তার পাশেই খাঁচার ভেতরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা একজনকে লাথি মারল। ‘এই উঠ, দেখ আমার ওস্তাদ,’ বলেই সে কিরানের দিকে চোখ তুলে বলে উঠল, ‘ওস্তাদ, তুমি তো জানো না, তুমার কথা কত গপ্পো করছি ওগো লগে, বৈঠার পাশ থেকে ছোট্ট একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। কাঁচা ঘুমভাঙা চোখে জুলজুল করে কিরানকে দেখছে। ‘ওস্তাদ, এইডা আমার পোলা, আমরা একলগে বাজারে চুরি করি। হারামির পো, সেলাম দে,’ বলেই সে সদ্য ঘুম ভেঙে ওটা ছেলেটাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল। ছেলেটা কী বুঝল কে জানে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে রাখল সালামের ভঙ্গিতে।

এভাবে এই বন্দি কারাগারের খাঁচার ভেতরে পূর্ব জীবনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াতে কিরান একটু অস্বস্তি বোধ করছে। ‘ইয়ে, বৈঠা, তুই এইহানে ক্যামনে?’ ওর পাশের খাঁচাতে গোমেজের বাঘের মতো গর্জনের মতো নাক ডাকার শব্দ শুনে খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে কিরান।

‘আর কইয়ো না, ওস্তাদ, বৈঠা আধা দাঁড়ানো থেকে আবারও খাঁচার গায়ে হেলান দিয়ে বসল। এক হাতে মমতার সঙ্গে হাত বুলাতে শুরু করল তার ছেলেটার গায়ে। তুমি তো দল ভাইঙ্গা দিলা। এরপরে অন্য দলে গেলাম, টিকতে পারলাম না। সব হারাইয়া বাড়ি ফিরলাম। হেরা টেকা-পয়সা যা দিছিল সব শ্যাষ কইরা কিছু আছিল, হেইগুলা…’

‘নিশ্চিত গঞ্জের বাজারে জুয়ায় হারছিলি?’ কিরানের মনে পড়ে গেল বৈঠা মারাত্মক জুয়াড়ি ছিল।

এমন অবস্থাতেও খানিকটা লজ্জিত হাসি দিল বৈঠা। ‘ঠিকয় ধরছো ওস্তাদ। তুমরা অহনো মনে আছে আমার জুয়ার কতা… হায়রে তুমি যহন কাপ্তেন আছিলা জাহাজের পাটাতনের তলে কত জুয়া খেলছি তুমারে পলায়া। একবার তুমি যে- মাইরডা দিসিলা।’

কিরানও মৃদু হাসল সামরিক জাহাজে জুয়া খেলা নিষেধ। তবুও লুকিয়ে নাবিকরা মাঝেমাঝেই জুয়া খেলে। কাপ্তান হিসেবে কিরান বুঝতে পারলেও সে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ছাড় দিত। সব কাপ্তানই তাই করে। কিন্তু ধরা পড়লে ভিন্ন কথা।

‘তারপর কী করলি?’

‘ও,’ বৈঠা মনে হয় কিরানকে দেখে পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে গেছিল। ‘আসলে গঞ্জের বাজারো জুয়া খেলছিলাম শুধু নেশায় না। ওই ঘটনার পরে মাথাডা আউলায়া গেছিল। জুয়ায় সব হারায়া গেরামে ফিরা দেহি কিছুই নাই।’

‘কিছুই নাই মানে?’ কিরান অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘পুরা গেরাম, মানুষ, বাড়িঘর সবকিছু, সবকিছু ফিরিঙ্গিরা জ্বালায়া দিছে। আমগো জাহাজের লগে ওই ঘটনার পরে ওরা পুরা এলাকায় কুনো গেরাম ছাড়ে নাই। কুনো শহর ছাড়ে নাই। সব জ্বালায়া লুট কইরা সাফা কইরা দিছে। সমর্থ পুলা-মাইয়াগোরে সব ধইরা লইয়া গেছে আরাকানের হাটে বেচতে। আর বাচ্চা বুড়াগরে যাগো পাইছে মাইরালাইছে বাকিগরে ফালায়া গেছে মরবার লাইগা।’

‘এটা কে? তোর ছেলে?’ বৈঠার পাশে বাচ্চাটা আবার শুয়ে পড়েছে।

‘নাহ, আমার ভাইয়ের পুলা, ওহন নিজের পুলাই মনে করি,’ বৈঠা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘গেরামে যহন গেলাম তহন সব তো শ্যাষ। আমার বউ-বাচ্চা, সব শ্যাষ। আমার বাচ্চাডারে ফিরিঙ্গিরা পুরায়া মারছে বেগতের লগে। বউডারে ধইরা লইয়া গেছে গা। গেরামে বাইচ্চা থাহার মধ্যে একমাত্র এই ভাতিজাডারে পাইছি। তহন দুই বছর বয়স জঙ্গলের মধ্যে কান্তাছিল। হাসা কথা অইলো ওই ঘটনার পরে এর লাইগাই বাঁইচা রইছি। নাইলে মইরাই যাইতাম।’

‘এখানে, মানে এই জেলে আসলি কীভাবে?’

বৈঠার কাহিনি একটু বিরক্ত লাগছে কিরানের। পুরনো সব দুঃসহ স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে নিজের ভেতরে। বর্তমান জীবনের দায়ভারেই কিরানের অবস্থা কাহিল। তার ওপরে যদি পুরনো বাজে স্মৃতি এখন মাথার ভেতরে হামলা চালায় তবে মরতে হবে ওকে।

‘ওস্তাদ, ওইহান থেইকা আইসা কিছুদিন রাউজানের জাহাজে কাম করছি। বাল্লাগেনা। এরপরে একটা বাইদ্দা দলের লগে কিছু দিন ঘুরছি। হেগোর লগে এখন বাজিকরের খেলা দেহাই বাজারে বাজারে।’

‘বাজিকরের খেলা দেখানো তো আর কোনো অপরাধ নয়। এখানে এসেছিস কীভাবে?’

‘হে হে,’ বৈঠার মুখে লাজুক হাসি। ‘মানে খেলা দেহানির ফাঁকে ফাঁকে সইন্ধাবেলা সুবিধামতোন চুরিও করি, আবার সুযোগ পাইলে ডাহাতিও করি।’

‘সর্বনাশ কী বলিস?’ কিরানের যতটুকু মনে পড়ে বৈঠা একটা ভালো মানুষ ছিল। তার এই বাজে অধঃপতনে মনের ভেতরে একটু দুঃখই লাগল ওর। মানুষটার এই পতনের পেছনে কি ওরও খানিকটা ভূমিকা আছে? মনের ভেতরে প্রশ্নটা উদয় হতেই কেমন জানি চমকে উঠল কিরান। ‘ধরা পড়লি কীভাবে?’ কিরান যতটুকু জানে এসব বেদে ডাকাতরা খুব চতুর আর সতর্ক হয়ে থাকে।

‘আর কইয়ো না আইজ দুই বছর এইগুলা করি, জীবনেও কিছু অই নাই। এইবার কপাল খারাপ। কাইল সইন্ধার পরে একটা দলরে লুট কইরা মাত্র সারছি বান দেওয়াও শেষ অয়নাই, রাস্তার ওপরে আরাকানিগর বাহিনী কইত্তে আইলো খুদা জানে। ধরা পইড়া গেলাম,’ বৈঠার গলায় চরম আফসোস। ‘আমারে তো ফাঁসি দিবোই খারাপ লাগতাছে আমার বাইচ্চাডারেও মাইরালাবো।’

কিরানের খুবই খারাপ লাগল বৈঠার জন্য। ভালো হোক, মন্দ হোক বেচারা সব হারিয়ে একটা জীবন তো বেছে নিয়েছিল। ও নিজে তো সেটাও পারেনি। এখন অকালে সেই জীবনের অবসান হতে চলেছে বেচারার। ও যতটুক জানে এ-ধরনের চোরদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হয়। ‘দেখ, বৈঠা… কিরান তাকে মিথ্যে কোনো আশ্বাসবাণী শোনাতে যাচ্ছিল তার আগেই ওর পাশের খাঁচার ভেতরে গোমেজ হঠাৎ ধাম করে সোজা হয়ে বসল ঘুমের ভেতরেই।

একে তো ছোট্ট খাঁচা তার ওপরে একটার সঙ্গে আরেকটা খাঁচা লেগে আছে গায়ে গায়ে। বিশালাকায় গোমেজ সোজা হয়ে বসতেই ভীষণ জোরে তার মাথা ঠুকে গেল খাঁচার ওপরে। ‘হুফফ, হুফফফ, হুফফফ,’ মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে উঠল সে। একে তো খাঁচায় খাঁচায় ঠোকাঠুকি তার ওপরে আবার মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করাতে আশপাশের অনেক খাঁচাতেই কারো কারও ঘুম ভেঙে গেল। রাগত গলায় ধমকে উঠল কেউ কেউ।

‘গোমেজ কি হইছে?’ কিরান একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল।

‘হুমম হুমম,’ বলেই গোমেজ তার ডান হাতের তর্জনি চেপে ধরল ঠোঁটের ওপরে। ‘কী ব্যাপার?’

ঘটাং করে খুলে গেল কারাগারের লোহার দরজা। খাঁচার শব্দ আর ঠোকাঠুকিতে বিরক্ত প্রহরী চলে এসেছে। ‘এই বান্দির পুতেরা, মাইঝরাতে কি অইছে তগো?’

গোমেজ মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করেই চলেছে। ‘এই গোমেজ চুপ কর, মরতে চাস নাকি?’

ওদিকে প্রহরী হাতের আলো তাক করেছে গোমেজ আর কিরানের দিকে ‘এই, ওইটার কী হইছে?’ বলে সে হাতের লম্বা চুক্কির মতো লোহার চোখা জিনিসটা এগিয়ে আনতে লাগল গোমেজের দিকে। মনে মনে আঁতকে উঠল কিরান। গণ্ডগোল একটা লাগতে যাচ্ছে। ‘গোমজে, চুপচাপ শুয়ে পড়,’ মৃদু স্বরে বলে উঠল সে। কী করা যায় ভাবার চেষ্টা করছে সে দ্রুত। প্রহরীর চোখা জিনিসিটা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় গোমেজ আবারও ঠোঁটের ওপরে তর্জনী চেপে ধরে চুপ থাকবার ইশরা করল। কিরান একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে গোমেজের দিকে। ব্যাপার কী?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের মতো তীব্র শব্দে ভেঙে পড়ল কারাগারের একপাশের দেয়াল, শক্তিশালী আঘাতে কারাগারের কয়েকটা খাঁচাসহ দরজা আর দেয়ালের অনেকটা অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *