অধ্যায় ছয় – বর্তমান সময়
আফতাব নগর, রামপুরা
নিশ্বাসের সঙ্গে যেন ধোঁয়া উড়ছে ঠান্ডায়।
খোলা মাঠের তীব্র ঠান্ডার ভেতরে নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা গরম নিশ্বাস ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। উত্তপ্ত নিশ্বাস আর ঠান্ডা বাতাসের এই চিরন্তন খেলার দিকে তাকিয়ে কেন জানি প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে শারিয়ারের। বিরক্তিটা কি নিজের ওপর নাকি অন্য কারো ওপর ঠিক ধরতে পারছে না সে।
বাইকের একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। ওভাবে দাঁড়িয়েই কোমরের পাউচ থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে লাগাল। কষে দুটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজেকে খানিকটা উষ্ণ মনে হলো ওর। সিগারেট টানতে টানতেই ফিরে তাকাল সামনের বিরাট কর্মযজ্ঞের দিকে। ওখানে বাইক মাস্টার আর ওর ভেতরে রেসের আয়োজন চলছে। একটু আগে বাইক মাস্টার ওকে চ্যালেঞ্জ করার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই কর্মযজ্ঞ।
অবশ্য কর্মযজ্ঞটাকে ঠিক বিশাল বলা যায় কি না সেটা একটা ব্যাপার। তবে যা ঘটছে সেটাও কম নয়। রেস ট্র্যাকের মাঝখানের রাস্তাটাকে কেন্দ্র করে দাঁড়ানো ভিড়টাকে আরো বেশ খানিকটা দূরে সরানো হয়েছে। মাঝখানের ট্র্যাকটাকে ঠিক রেখে রাস্তাটাকে রাউন্ড করে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে গোল করে দাগ দেওয়া হয়েছে দুই রাউন্ড। সেই দাগের একটা প্রান্ত এসে শেষ হয়েছে রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে। যেখানে দাগটা শেষ হয়েছে সেখান থেকে রাস্তা বরাবর সোজা এগোতে হবে। সোজা বেশ অনেকটা এগিয়েই বসানো হয়েছে দুটো কাঠবোর্ডের মতো জিনিস। রেসিংয়ের ভাষায় ওগুলোকে বলে ‘জাম্পার’। জাম্প করার জন্য ব্যবহৃত হয় বলেই মনে হয় এই নাম। ছোটো পরিসরের রেসে এগুলো দিয়েই আসলে বাইক জাম্পের আয়োজন করা হয়। জাম্পার দুটো ক্রস করে রাস্তাটা আরো এগিয়ে গেছে আশি গজের মতো। ওটার শেষ মাথায় দুটো আগুনে ড্রাম বসানো হচ্ছে।
শারিয়ার আর বাইক মাস্টারের রেসের প্যাটার্নটা অনেকটা এমন হবে; ও আর বাইক মাস্টার রেস শুরু করবে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে। তারা দুজনে দুই বার পুরো রাস্তাটা চক্কর খাবে। তারপর রাস্তাটা রাউন্ড শেষ করে রাস্তার মাঝ বরাবর এগোবে। বাইকটাকে জাম্প করিয়ে খুবই ছোটো পরিসরের ভেতরে ড্রামের আগে থামিয়ে ফেলতে হবে একটা বিশেষ কায়দায়। কায়দাটা হলো; বাইকের সামনের চাকা মাটিতে থাকবে আর পেছনের চাকা শূন্যে উঠে পাক খেয়ে বাইক থেমে যাবে। বাইক থামানোর এই কায়দাকেই বলা হয় ‘স্টপি’। কিন্তু ওদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ ওটা নয়। বাইকটাকে থামানোরর আগে সামনের চাকার ওপরে ভর করে বাইকটাকে পুরো দু চক্কর ঘোরাতে হবে। বাইকাররা এটাকে বলে ‘রোলিং স্টপি’। এই রেসে চ্যালেঞ্জ তিনটে; প্রথমত, কে প্রথম হয়। দ্বিতীয়ত, জাম্পারে জাম্প করে স্বল্প দূরত্বে বাইকটাকে নিয়ন্ত্রণ করে থামানো। সেই সঙ্গে তৃতীয় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ হলো, বাইকটাকে থামানোর আগে সামনের চাকার ওপরে তিনটে চক্কর খাওয়ানো। যদি শেষটায় এতটুকু গড়বড় হয় তবে বাইক সোজা গিয়ে বাড়ি খাবে আগুনে ড্রামে। অ্যাক্সিডেন্ট-ইনজুরি তো হবেই এমনকি মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব নয়।
পুরো রেসটা মনের ভেতরে একবার ঝালিয়ে নিয়ে সামনের দিকে ফিরে তাকাল শারিয়ার। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে একটু দূরেই নিজের সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে কথা বলছে বাইক মাস্টার। পেছনেই তার বিরাট রেসিং বাইকটা। বাইকটা দেখেও ঠিক চিনতে পারল না শারিয়ার। পেশাগত কারণে গত ছয় মাস দেশের বাইরে থাকার কারণে এই জগৎ থেকে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে ও। হয়তো এরই মধ্যে রেসিং বাইকের কোনো নতুন রেভ্যুলুশন হয়েছে। যে- কারণে বাইকটা চিনতে পারছে না। তবে চিনতে না পারলেও এই ব্যাপারে ও নিশ্চিত যে ওটা একেবারেই আধুনিক আর লেটেস্ট মডেলের কিছু হবে।
রেসিং বা বাইকিং নিয়ে শারিয়ারের মনে কোনো দ্বিধা নেই। কারণ রেসিং ওর রক্তের ভেতরে আছে। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছে ও। প্রথমত ওর অস্ত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই একরকম বলতে গেলে ওদের হাতে ও এই মুহূর্তে জিম্মি। এভাবে অন্যের হাতের পুতুল হওয়া ওর পছন্দ নয়। তার ওপরে যে কাজে এসেছিল সেটা তো হয়নি, উলটো প্রমাণ হয়েছে ওর নিজের লোকের ভেতরেই ঘাপলা ছিল। এসব গ্যাঙবাজিতে এই এক সমস্যা; কে কখন কার সঙ্গে বেইমানি করবে কোনো ঠিক নেই। এখন মনে হচ্ছে এভাবে বোকার মতো পুরনো এই জগতে ফিরে না এলেই ভালো হতো। কারণ এখানে ওর কোনো স্বার্থ নেই। আর এই জগৎ ওর জন্য এখন অতীত। ও এখন ভিন্ন জগতের মানুষ। বরং এক অর্থে বলতে গেলে ওর বর্তমান জগৎ আর এই জগতের মধ্যে আকাশ আর পাতালের পার্থক্য।
‘ভাই, সব রেডি হয়া গেছে,’ নিজের ভাবনার জগতে এমনভাবে হারিয়ে গেছিল কখন মুম ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি শারিয়ার। মুম মাথা নিচু করে কথা বলছে ওর সঙ্গে, চোখে চোখ মেলানোর সাহস নেই। শারিয়ারের ইচ্ছে হলো সপাটে একটা চড় মারে হারামজাদার গালে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁতে কড়মড় করে মুমের দিকে একটা আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠল, ‘হারামজাদা তোর কারণে এইসব ঘটছে। তোরে আমি ধরব। রেসটা শেষ হোক আগে…’ শারিয়ার কথা শেষ করার আগেই অন্যপাশ থেকে উত্তেজিত জনতার গুঞ্জন শুনে ফিরে তাকাল সামনের দিকে। বাইক মাস্টার চড়ে বসেছে তার রেসিং বাইকে। আর সে বাইকে চড়ে বসতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠেছে খুশিতে। শারিয়ার নিজের হাত নামিয়ে বাইকে গিয়ে বসতেই পাশ থেকে শিস দিয়ে উঠল একজন। ফিরে দেখল একটা হেলমেট হাতে ওর থেকে খানিকটা তফাতে এসে দাঁড়িয়েছে মিল্টন। ‘বস,’ বলে মৃদু ডাক দিয়ে সে হেলমেটটা ছুড়ে দিল শারিয়ারের দিকে। একটু আগের অসহায় ভাব পুরোপরি উবে গেছে তার মুখ থেকে। তার বদলে কেমন জানি একটা তাচ্ছিল্যের ভাব তার চোখে মুখে। মনে মনে এর নামটাও টুকে রাখল শারিয়ার। সবার আগে এই ব্যাটাকে ধরতে হবে।
‘বেস্ট অব লাক, বস,’ বলে মিল্টন হাত তুলে নিজের বৃদ্ধাঙুলি দেখাল। পাত্তা না দিয়ে হেলমেটটা পরে নিয়ে বুম বুম করে নিজের বাইকটা স্টার্ট দিয়ে এক টানে চলে এলো ও বাইক মাস্টারের পাশে। শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নিচ্ছে বাইক থেকে শুরু করে সবকিছু। পরীক্ষা শেষ করে বাইক মাস্টারের দিকে তাকিয়ে দেখল হেলমেটের ওপাশ থেকে কুঁতকুঁতে চোখজোড়া দিয়ে ওকে দেখছে। ওকে দেখে নিয়েই সামনের দিকে ফিরে তাকাল লোকটা। শারিয়ারও বুমবুম করে বাইকটাকে রেসিং পজিশনে নিয়ে এলো।
মিল্টনের বৃদ্ধাঙুলি দেখানো আর বাইক মাস্টারের চাহনির মধ্যে কী একটা গড়মিল খুঁজে পাচ্ছে শারিয়ার। এর আগে বহুদিন রেসিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে ও জানে, এসব রেসে বহু ধরনের ধোঁকাবাজি হয়ে থাকে। তার ওপরে বাইক মাস্টারও রেস করতে যাচ্ছে, তারমানে অবশ্যই ভিড়ের ভেতরে উঁচু দরে বাজির খেলা চলবে আজ। শারিয়ার আবারও বাইক মাস্টারের দিকে ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল তার আগেই জিন্স আর টি-শার্ট পরা একটা মেয়েকে সামনের দিকে হেঁটে যেতে দেখল ও। মনে মনে হেসে উঠল শারিয়ার। ব্যাটারা হলিউডি সিনেমা গুলে খেয়ে ফেলেছে, যা দেখে নির্লজ্জভাবে তাই কপি করার চেষ্টা করে।
মেয়েটা ওদের দুজনকে ছাড়িয়ে আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল। তারপর হাতে একটা রুমাল তুলে ধরে ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘রেডি বয়েজ?’ দুজনেই মাথা নাড়তেই উত্তেজিত জনতা গুনতে শুরু করল। ‘এক’ ‘দুই’। দুই বাইকারই নিজেদের বাইক পূর্ণ ফোর্সে নিয়ে এসেছে। ‘তিন’ উচ্চারিত হতেই মেয়েটা হাতের রুমালটা ছেড়ে দিল। কিন্তু ওটা মাটিতে পড়ার আগেই দুই পাশ থেকে দুটো পূর্ণ বেগে লাফ দেওয়া বাইকের বাতাসের ধাক্কায় উড়ে গেল ওটা।
মানবজাতির ইতিহাসে কখনো কোনো মানুষের ডানা ছিল কি না শারিয়ারের জানা নেই। তবে এখন পর্যন্ত যতবার বাইক রেসে নেমেছে ও প্রতিবারই বাইক চলতে শুরু করার পর মনে হয়েছে যেন ওর পিঠে দুটো ডানা গজিয়েছে আর সেই ডানায় ভর করে যেন উড়তে শুরু করে ও। যদিও এবারের রেসটা অনেকটাই ব্যতিক্রম কিন্তু তবুও বাইক স্টার্ট করতেই যেন পুরনো সেই অনুভূতিটা আবারও ফিরে এলো। বাইকটা পূর্ণ বেগে চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার চোটে আপনাতেই চিৎকার বেরিয়ে এলো শারিয়ারের গলা দিয়ে।
বাইক মাস্টারে বাইকটা স্টার্ট হতেই একটানে শারিয়ারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছিল অনেকটা। কিন্তু প্রথম বাঁকের কাছে পৌঁছে ডানে মোড় ঘোরানোর সময়েই বাইক মাস্টারকে ধরে ফেলল শারিয়ার। মোড় ঘুরতে ঘুরতেই এক ধাপ এগিয়ে গেল ও। কিন্তু নিজের উন্নত বাইকের সুবিধে নিয়ে আবারও তাকে ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা এগিয়ে গেল বাইক মাস্টার। এক্সেলেটরে চাপ বাড়িয়ে দিল শারিয়ার। মরিয়া হয়ে উঠেছে ও। কিন্তু চালানোর দক্ষতা আর বাইকের শক্তি দুদিক থেকেই শারিয়ারের চেয়ে দক্ষ সে। বরং শারিয়ার দুবার তাকে ধরার চেষ্টা করলেও বরং উলটো ওকে ছাড়িয়ে আরো বেশ অনেকটা এগিয়ে গেল বাইক মাস্টার। প্রথম রাউন্ড এভাবেই শেষ হলো, বাইক মাস্টার সামনে আর তার থেকে কয়েক ধাপ পেছনে শারিয়ার।
যদিও গতির তীব্রতা আর রেসের উত্তেজনায় শারিয়ারের মাথায় আর কিছুই আসছে না তবুও হেলমেটের ভেতর থেকে পরিষ্কার শুনতে পেল ওদেরকে কেন্দ্র করে চারপাশে জনতা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। মুহূর্তের জন্য শারিয়ারের মনোযোগ হটেছিল তাতে আরো কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গেল বাইক মাস্টার। প্রথম রাউন্ড শেষ করে আবারো প্রথম বাঁকটা বাইক মাস্টার পেরিয়ে গেল। শারিয়ার প্রায় কয়েক ফিট পেছনে পড়ে গেছে। চোখের কোণে দেখল খোলা লম্বা জায়গার সুযোগে বাইক মাস্টার তার বাইক নিয়ে আরো বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। জাম্প করার আগে আর মাত্র দুটো বাঁক আছে। মুহূর্তের ভেতরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শারিয়ার।
আর মাত্র একটা বাঁক অবশিষ্ট। মনের চোখে শারিয়ার পরিষ্কার দেখতে পেল বাইক মাস্টারের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। আচমকা শারিয়ার তীব্র ব্রেক চেপে প্রায় দাঁড়িয়ে গেল। তীক্ষ্ণ কিচ-কিচ শব্দ করে বাইকটা প্রায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এমন সময় এক্সেলেটরের পূর্ণ চাপে মনে হলো ওর বাইকের ইঞ্জিনটা যেন বাঘের মতো গর্জন করে উঠল, সেই সঙ্গে এগজস্ট পাইপ এমনভাবে ধোঁয়া উগড়ে দিল যেন বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা প্রায় পূর্ণ বেগে লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। তীব্র বেগের আতিশয্যে ওটার সামনের চাকা শূন্যে উঠে গেছে। স্বাভাবিকের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ বেগে ওর বাইকটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের ভেতরে বাইক মাস্টারকে টপকে সামনে এগিয়ে গেল ওর বাইক।
যদিও নিজের বাইকের নিয়ন্ত্রণ আর গতি নিয়ে ব্যস্ত শারিয়ার তবুও বাইক মাস্টারের দিকে তাকালে পরিষ্কার দেখতে পেত ওর ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্টে হা হয়ে গেছে বাইক মাস্টারের মুখটা।
শারিয়ারের বাইকটা সামনের চাকা শূন্যে থাকতেই ওটাকে আর মাটিতে নামিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেল না ও। তার আগেই তীব্র বেগে ধেয়ে এলো সামনের জাম্পিং স্লাইড। এক চাকার ওপরে ভর করেই ওর বাইকটা জাম্পিং স্লাইড বেয়ে লাফিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল প্রায় ত্রিশ ফিটের মতো।
বাইক মাস্টারকে পেছনে ফেলতে পারলেও এখনো চ্যালেঞ্জ শেষ হয়নি। বরং সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জটা বাকি। বাইকটাকে নিরাপদে ল্যান্ড করিয়ে আগুনে ড্রামের আগে ট্রিপল রাউন্ড স্টপির মাধ্যমে শেষ করতে হবে রেস। তবেই বিজয় সম্ভব। শেষ মুহূর্তে অতিরিক্ত গতির কারণে বাইকটা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে অনেক বেশি শূন্যে উঠে গেছে ফলে ওটাকে ল্যান্ড করিয়ে যতটুকু জায়গাটায় শেষ স্ট্যান্টটা কীভাবে সম্পন্ন করবে সেটা ভেবে ঠিক করার আগেই শারিয়ারের আর সেভেন বাইকের সামনের চাকা মাটি স্পর্শ করল তীব্র ঝাঁকুনির সঙ্গে। একবারের জন্য শারিয়ারের মনে হলো বাইকের হ্যান্ডেল বুঝি ছুটেই গেল ওর হাত থেকে। কোনোমতে সামলে নিয়ে সামনের ব্রেক চেপে ধরল ও প্রাণপণে। কারণ আগুনের ড্রামটা প্রায় চলেই এসেছে।
সামনের ব্রেক চেপে ধরতেই ওর বাইকটা থামতে থামতে পেছনের চাকা শূন্যে উঠে পড়ল। ব্রেকের তীব্র চাপে বাইকের পেছনটা ঘুরতে শুরু করল শূন্যের ওপরে। ড্রামটায় বাড়ি লাগতে লাগতে আপনাতেই শারিয়ারের চোখ বুজে এলো, কিন্তু বাইকের শেষ প্রান্তটা ড্রামের সঙ্গে না লেগে দুবার চক্কর খেয়ে নেমে এলো মাটিতে।
বাইক মাটিতে নামতেই শক্ত ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে আর ধরে রাখতে পারল না ও বাইকের হ্যান্ডেল। একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা। কোনোমতো লাফিয়ে সরে এলেও শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারল না শারিয়ার। ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়ল ঘেসো মাটিতে।
ঘাসের ওপরে পড়লেও হেলমেট পরা মাথাটা জোরে বাড়ি খেল মাটিতে। কোনোমতে হেলমেটটা খুলে বড়ো বড়ো করে দম নিতে লাগল ও মাটিতে শুয়ে। ওপরে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। কানে আসছে উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকা জনতার উল্লাস। কিন্তু ওর মন ছেয়ে গেছে পরাজয়ের গ্লানিতে। জিততে পারেনি ও। স্টপিতে তিনবার রাউন্ড দেওয়ার কথা ছিল বাইকটাতে। দুই বার দিয়েই পড়ে গেছে ও মাটিতে।
ওর পাশে একটা বাইক এসে থেমে গেল। মাটি থেকে মাথা তুলে সোজা হলো শারিয়ার। গ্লাভ পরা একটা হাত দেখতে পেল চোখের সামনে। ওটা ধরতেই শক্ত হতে কেউ টেনে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে। হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল বাইকে উপবিষ্ট মানুষটা বাইক মাস্টার। ওকে সোজা হতে সময় দিয়ে নিজের হেলমেটটা খুলে হাতে নিয়ে নিল সে। নিজের ন্যাড়া মাথায় একবার গ্লাভস পরা আঙুল চালিয়ে দিয়ে। মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘আমি শুনেছিলাম ‘বাইকার ম্যাড কিং’ নাকি সত্যিকারের একটা পাগল বাইকার,’ বাইক গ্যাংয়ে শারিয়ারের ডাকনাম হলো ‘ম্যাড কিং’। ‘আজ নিজ চোখে দেখলাম তার পাগলামি,’ বলে সে মৃদু হেসে উঠল। শারিয়ার তার হাসিতে যোগ না দিয়ে মৃদু মাথা নাড়ল। আড়চোখে দেখল একটু দূরেই ভিড়ের ভেতরে টাকা চালাচালি হচ্ছে। নিশ্চয়ই বাজির হার-জিতের হিসেব হচ্ছে ওদের ভেতরে। আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল শারিয়ার। ‘কিন্তু আমি তো জিততে পারলাম না,’ ওর কণ্ঠে হতাশা।
শারিয়ারের কথা শুনে জোরে হেসে উঠল বাইক মাস্টার। ‘কে বলেছে? তোমাকে ওভাবে বাইকের চাকা শূন্যে তুলে লাফ দিতে দেখেই আমি থেমে গেছিলাম। মাই গড। এরকম কোনো ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, না দেখলে আমি,’ বাইক মাস্টার থেমে এগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘তুমি আসলে মানুষ তো? এরকম একেবারেই জীবনের পরোয়া না করে কোনো মানুষ রেস দিতে পারে, স্টান্ট করতে পারে না দেখলে আমি… আমি সেরা বাইকার হতে পারি। কিন্তু তুমি আসলেই ম্যাড কিং,’ বলে সে নিজের বৃদ্ধাঙুলি দেখাল। ‘পারফেক্ট নাম, এখন বলো…’ সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। কাছেই থাকা পুলিশের কোনো টহল জিপ মনে হয় অতিরিক্ত চিল্লাচিল্লিতে খবর পেয়ে গেছে।
পুলিশের সাইরেনের শব্দ শোনামাত্রই ভিড়ের ভেতরে উত্তেজনা দেখা দিল, যে যেদিকে পারল ছুটতে শুরু করেছে। মুহূর্তের ভেতরে নিজের কথা শেষ না করে বাইক মাস্টার দক্ষ হাতে নিজের বাইকটাকে ঘুরিয়ে ফেলল। একবার ওর উদ্দেশে হাত নেড়ে বাইক ছোটাল। যদিও তার কানেকশন অনেক, তবুও সবাই ঝামেলা এড়াতে চায়।
শারিয়ার কোনো তাড়াহুড়ো করল না। ও মাটিয়ে পড়ে থাকা নিজের হেলমেটটা তুলে পরে নিল। তারপর বাইকের কাছে হেঁটে এসে ওটাকে সোজা করে চড়ে বসল। আশপাশে তাকিয়ে মুম কিংবা অন্য কারো ছায়াও দেখতে পেল না। মুম আর অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে ওর হিসেবটা পরে পরিষ্কার করতে হবে। বাইক স্টার্ট দিয়ে মুহূর্তের জন্য পুলিশের সাইরেনটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করল ওটা কোনোদিক থেকে আসছে। হিসেব করে নিয়ে উলটো দিকে বাইকের মুখ ঘুরিয়ে উঠে এলো রোডে। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে থেমে গেল। আরেকটু হলেই রোডে দাঁড়ানো হেডলাইট অফ করা দুটো জিপের সঙ্গে বাড়ি খেতে যাচ্ছিল ওর বাইক।
যদিও জিপ দুটোর হেডলাইট অফ করা। কিন্তু ওর নিজের বাইকের আলোয় দেখল জিপের সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত চারজন পুলিশ। ‘হ্যান্ডস আপ।’ শারিয়ার কিছু না বলে ধীরে ধীরে বাইকের হ্যান্ডেল থেকে নিজের হাত সরিয়ে ওপরে তুলে ধরল।
‘হোন্ডা থেকে নেমে একপাশে সরে দাঁড়ান, নির্দেশ ভেসে এলো।
শারিয়ার এক পা দিয়ে বাইকটাকে স্ট্যান্ডের ওপরে দাঁড় করিয়ে সরে এসে বলে উঠল, ‘এক মিনিট এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমি-’ এটুকু বলতেই চড়চড় শব্দ তুলে কিছু একটা ছুটে এসে লাগল ওর বুকে। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র কারেন্টের ধাক্কায় মাটিতে শুয়ে পড়ল ও। শরীরে এখনো কারেন্ট বয়েই যাচ্ছে। ঝটকা দিয়ে থেমে গেল ইলেকট্রিসিটি।
‘টিজার, শালারা টিজার মেরেছে,’ আনমনেই শারিয়ারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বাংলাদেশ পুলিশ কবে থেকে টিজার ব্যবহার করতে শুরু করেছে! মাথাটাকে সামান্য তুলে দেখল পুলিশ না বরং সিভিল পোশাক পরা কেউ একজন এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
‘দেখুন, আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার শারহান…’ ও কথা শেষ করার আগেই লোকটা ওর দিকে ঝুঁকে এসে মুখের ওপরে সিগারেটের গন্ধওয়ালা নিশ্বাস ফেলে হেসে উঠল। ‘আমরা জানি তুমি কে। সেজন্যই তো এই ব্যবস্থা;’ বলেই লোকটা হেসে উঠে আবারও টিজারে চাপ দিল।
তীব্র কারেন্টের ধাক্কায় জ্ঞান হারানোর আগে শারিয়ারের মনে হলো বিরাট কোনো গড়মিল হয়ে গেছে ওর হিসেবে।