অধ্যায় চুয়াল্লিশ – অতীত
‘এই জায়গাটা আসলে কী বলতে পারবা?’ চামড়ার থলে থেকে আরেকটুখানি আরক গলায় ঢেলে দিয়ে পদ্মের দিকে ফিরে কিরান জানতে চাইল।
‘কেন, নিচের জায়গা বাদে তুমি তো বাকি সবই ঘুইরা দেখছো,’ কিরানের হাত থেকে আরকের থলিটা নিয়ে তাতে দু ঢোক দিয়ে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছল পদ্ম। তারপর কিরানের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আর জানোই তো, এইটা মগদোষীগো গ্রাম।’
‘না আমি সেইটা বলি নাই,’ কিরান খানিকটা বিব্রত বোধ করতে লাগল। নিজের জীবনে সে খুব বেশি মেয়েমানুষের সঙ্গে মিশেছে এমন নয়। কিন্তু যাদের সঙ্গেই মেশার সুযোগ হয়েছে তাদের সবার থেকে এই মেয়ে একেবারেই আলাদা। এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কিরানের মাঝে মাঝে অস্বস্তি হচ্ছে। আবার অন্যদিকে বেশ মজাও পাচ্ছে সে। ‘আমি বলতে চাইছি এই পাহাড়ের ওপরে দুর্গ আর আর এই উঠান নিশ্চয়ই তোমরা বানাও নাই। এর পিছের ইতিহাসটা কী?’
কিরানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল পদ্ম। ‘তুমি জাহাজি আমারে খুবই অবাক করতাছো। মাঝেমধ্যে তুমারে দেইখা খুব সাহসী মনে অয় আবার মাঝেমধ্যে এমন ভ্যাবলা লাগে। যাই হোক। এই জায়গাটা আমরা কেউই বানাই নাই। আমগো পক্ষে বানানী সম্ভবও আছিল না। আমি শুনছি এইখানে আসার বহুত আগে থেইক্কা মগদোষীরা এই জায়গায় বাস করা শুরু করছে। কারণ এইখানে কইতে গেলে তেমন কেউই আসে না। আর এইখানে সামনে আর পেছনে দুইদিকেই যাতায়াতাতের পথ থাকাতে এইখান থেইকা সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। বিশেষ কইরা এইখান থাইকা চাইলে সামনের দিক দিয়া চাঁটগা, সন্দ্বীপ, মহেশখালী এমনকি রোসাঙ্গেও যাওয়া যায়। আবার পেছন দিয়া কম সময় হুগলী কিংবা সপ্তগ্রামেও যাওয়া যায়।’
‘তাইলে এই জায়গা সবাই এড়ায়া চলে ক্যান?’ কিরান জানতে চাইল। হাত তুলে সে একবার পাহাড়ের ওপাশে দিগন্তের দিকে তাকাল। রাতের শেষ কালিমা মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে দিগন্তে ফুটে উঠছে আলোর রেখা। যেকোনো সময় সূর্যটা সমুদ্রের ওপাশ থেকে টুপ করে মাথা তুলবে ভেজা শরীর নিয়ে।
‘এই জায়গা সবাই এড়ায়া চলে, এর পিছে অনেকগুলা কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম একটা কারণ অইলো, এই জায়গারে সবাই ডাকে শয়তানের টিলা এইখানে নাকি মানুষ বাস করতে পারে না। শয়তান বাস করে। এইখানে নাকি একবার কেউ ঢুকলে আর বাইর অইতে পারে না,’ এইটুকু বলে ফিক করে হেসে উঠল পদ্ম। ‘এইটা অবশ্য সত্যি। এইখানে ঢুকলেই আমগো খপ্পরে পড়তে অয়। আর একবার আমগো খপ্পরে পড়লে আর রক্ষা নাই।’
‘তুমগো কারণেই কী এই জায়গারে শয়তানের টিলা বইলা ডাকে?’
‘নাহ, এই জায়গারে শয়তানের টিলা বলার পেছনে মূল কারণ অইলো এই জায়গার আবহাওয়া, পদ্ম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল। ‘প্রথমত যতই কম সময়ে যাতায়াত করা যাক, আর যাই হোক এইখানে আইতে অইলে ওই মোহনার বাঁক পার হইয়া আইতে অইবো। বেশিরভাগ মাল্লা, নৌকায় হোক আর জাহাজে হোক ওই পানির চক্র পারই অইতে পারব না। তার ওপরে এইখানে নোনা পানি আর পাহাড়ি টিলার এমন এক অবহাওয়া অইছে, যেকোনো সময় বৃষ্টি আসে, পানির ঘূর্ণি হয়, আবার জোয়ার-ভাটার হিসাবও এইখানে একেবারেই উলটা-পালটা। তার ওপরে গরম আর শীত নাই, যেকোনো সময়ে দেহা যায় কুয়াশা আইসা সব ঢাইক্কা ফালায়। যে কারণে এইখানে নৌকা কিংবা জাহাজ চালানি সবসময়ই ঝামেলার। তার ওপরে ডাকাইত, জলদস্যু এইগুলা তো আছেই। এইসব কারণেই এইদিকে তেমন কেউ আসে না।’
‘আর এই দুর্গ?’
‘এই দুর্গ আসলে কে বানাইছিল কবে বানাইছিল সেই ব্যাপারে সঠিক তথ্য কেউই বলতে পারে না। তবে এই দুর্গটা বানানি নিয়া একটা কথা প্রচলিত আছে; বহু বহুকাল আগে এক নাবিক নাকি সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়া এহানে আইসা উঠছিল। একে তো বিদেশ-বিভুঁই, তার ওপরে আবার এরকম ভয়ংকর জায়গায় নাবিক যখন খাওন আর আশ্রয়ের অভাবে মরতে বসছে তখন নাকি এই এলাকার প্রাণিরা সেই নাবিকরে বাঁচানোর জন্য আগায়া আসে। এর পেছনে নাকি কারণ ছিল সেই নাবিক প্রতিদিন এই পাহাড়ের চূড়া মানে আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেইখানে বইসা বাঁশি বাজাইত। আর তার বাঁশির সুর নাকি এতই করুণ ছিল যে, সব প্রাণির চইলা আসত। সেই নাবিক যখন ক্ষুধায় কাতর হয়া মরতে ধরে তখন এই এলকার পাখি, বাঘ, হরিণ থেকে শুরু করে এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত আগায়া আসে তারে সাহায্য করার জন্য। সেই প্রাণিদের দিয়েই নাকি এই নাবিক নিৰ্মাণ করেছিল এই দুর্গ। সেই নাবিকের নাকি প্রাণিদের নিয়ন্ত্রণ করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। আর একারণেই এই জায়গারে বলা হয় শয়তানের টিলা।’
‘হুমম যা প্রচলিত সেটাকে যদি বাস্তবতার নিরিখে বিচার করন যায় তয় এইটা বোঝা যায় যে, সম্ভবত অতীতের কোনো এক সময় জাহাজ ডুবি হয়া এইখানে এসেছিল অচেনা কোনো এলাকার এক নাবিক কিংবা একদল নাবিক। যেকোনো কারণে বা যেকোনোভাবেই হোক তারা এখানে বন্দি হয়ে পড়ে। সম্ভবত স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তারা এই দুর্গটা নির্মাণ করে। যেকোনো কারণেই হোক স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাদের একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সম্ভবত তারাই এই বন্দরটাও নির্মাণ করেছিল। এটাই প্রমাণ করে এই এলাকায় এক সময় আরো জমজমাট ছিল। তারপর যেমনেই হোক সেইটা আর টিকে নাই।’
‘হয়তো তাই, জাহাজি,’ সামান্য হেসে উঠল পদ্ম। ‘কে জানে আজ হয়তো আমরাও এহানেই শেষ হয়া যাব।’
‘তুমি কী নিশ্চিত যে ওরা আসবই?’ কিরান জানে প্রশ্নটা বোকার মতো। কিন্তু তবুও সে জানতে চাইল। এর পেছনে একটা কারণ আছে। ওরা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজঘাটা থেকে সিঁড়িগুলো উঠে এসে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে। এখান থেকে নিচের দিকে তাকালে পরিষ্কার চোখে পড়ে সামনের সমুদ্র।
কিরান রাতে আগের প্রহরে পদ্মদের দুর্গে আশ্রয় নেবার পর যখন বুঝতে পারে সামনেই আক্রমণ আসন্ন এখন সে তার পরিকল্পনা খুলে বলে। সেই পরিকল্পনা অনুসারেই নিজের অবশিষ্ট লোকজন আর পদ্মের বাহিনীর সমর্থ মেয়েদেরকে এক কাতার করে। সবাইকে যার যার দক্ষতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দিয়ে সবাইকে এক করে কিরান নিজের পরিকল্পনা খুলে বলে। আর সে-অনুযায়ী সবাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নিজের লোকবল আল আর অস্ত্রের মজুদ অনুযায়ী প্ৰস্তুতি শেষ করতে করতে মাঝরাত পার হয়ে যায়। এরপরে সামান্য খেয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে ভোরের আবহ তৈরি হতেই ওরা উঠে এসেছে যেখানে পাহারা বসানো হয়েছে।
‘জাহাজি তুমি যে প্রশ্ন করছো সে প্রশ্নের উত্তর আমার দেয়ার প্রয়োজন নাই। সামনের দিকে দেখো,’ বলে সে সামনের দিকে দেখাল। ভোরের নরম আলোয় ওরা দেখতে পেল শয়তানের টিলার সামনের পানি দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে কালো রঙের একটা জাহাজ।
‘ওরা আসতাছে, জাহাজি। মৃত্যু আর আতঙ্কের প্রতিনিধি হয়া ছুইটা আসতাছে,’ পদ্মের চোখে ভয়-ভীতি তো নেই বরং একরাশ অশান্ত আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ‘ওরা ধ্বংসের সমন নিয়া আসতাছে।’
কিরান একবার চারপাশে দেখে নিল। অবলোকন করে নিল সবকিছু সে যেভাবে ঠিক করেছিল সেভাবেই সাজানো আছে কি না। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল সে। তরপর পদ্মের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আসতে দেও ওগোরে,’ বাপুর দেওয়া লকেটটা এক হাতে চেপে ধরে বলে উঠল, ‘বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল। আসতে দাও ওগোরে।’
বর্তমান
‘খুব অদ্ভুত, তাই না?’ শারিয়ার বলে উঠল। সে তাকিয়ে আছে সূর্যের দিকে। ওরা যখন উঠে আসে টিলার ওপরে তখনো আবহাওয়া কুয়াশায় একেবারে অন্ধকার দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আজকের দিনে আবহাওয়া আর সূর্যের মুখ দেখবে না। কিন্তু আধা ঘণ্টা ভেতরে ঠিকমতো ভোর না হতেই সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে টিলাটার চারপাশে। আর সূর্যের আলোতে বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে পুরো টিলার উপরিভাগ। আর এর ওপরে থাকা দুর্গের অংশবিশেষ।
‘আমার মনে হয় এখানকার আবহাওয়া এখানকার পানির মতোই আনপ্রিডিক্টেবেল,’ ভুবন বলে উঠল।
‘তবে যাই হোক না কেন, রোদ ওঠাতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে, ‘ শশী ফোড়ন কেটে বলল, আমরা যা খুঁজে বের করতে চাইছি সেটা খুঁজে বের করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। কারণ এমনিতেই অচেনা জায়গা তার ওপরে আবার এরকম ঘোলাটে আবহাওয়া থাকলে কাজ করাটা অনেকটাই কঠিন হয়ে যেত।
‘জায়গাটা খুবই অদ্ভুত, তাই না?’ শারিয়ার চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলে উঠল, ‘এরকম রিমোট একটা জায়গায় এমন একটা দুর্গ কে বানালো? এখানে নিশ্চয়ই অনেক আগে যুদ্ধও হতো। দেখো,’ বলে শারিয়ার দুর্গের ভগ্নাবশেষের সঙ্গে ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন অংশ তো আছেই সেই সঙ্গে পুরনো আমলের মরচে পড়া একাধিক কামান দেখাল যেগুলো দুর্গের প্রাঙ্গণের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে।
‘বাহ, পুরনো কামান?’ অনেকক্ষণ পর সুমন কথা বলে উঠল। ‘এই মরা দেশে এরকম একটা জায়গায় এরকম পুরনো জিনিস পইড়া থাকল আর কেউই নিল না, এইটা কেমনে সম্ভব?’
সুমনের কথা শুনে সামান্য হেসে উঠল শারিয়ার। ‘হুমম, তোমার কথা ঠিক আছে সুমন। আলকাতরা ফ্রি পেলে লুঙ্গিতে নিয়ে নেয় যে জাতি তারা এরকম খোলা জায়গাতে এরকম কোনো জিনিস ফেলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো এরকম জায়গা থেকে এত ভারী জিনিস নামাবে কীভাবে আর নামালেই বা নেবে কীভাবে। আর তাছাড়া কামানগুলো সব আটকানো। কাজেই …
‘আমার প্রশ্ন হলো আমরা যা খুঁজতে এসেছি সেটা এখান থেকে খুঁজে বের করব কীভাবে?’ এত বড়ো দুর্গ তার ওপরে আবার এর বেশিরভাগ অংশই ভাঙা। এখানে তো ঠিকমতো কিছু খুঁজে বের করতে সেনাবাহিনী লাগবে মনে হচ্ছে।’
‘নাহ, অসম্ভব হবে না,’ শশী বলে উঠল সে হাতের ইশারায় টমিকে ডেকে প্রাঙ্গণের এক জায়গাতে ভাঙা পাথরের ওপরে বসে পড়ল সেই সঙ্গে টেনে নিল নিজের ব্যাক প্যাকটা। ‘প্রথমত, এই জায়গা যেমনই হোক, যত পুরনোই হোক না কেন আমাদেরকে মনে রাখতে হবে ডক্টর আবদেল এখানে এসেছিল খুব বেশি সময় হয়নি। এই দুর্গে কিছু একটা থাক বা না থাক কিংবা ডক্টর আবদেল যদি কিছু রেখে গিয়েও থাকে, সে একা মানুষ হয়ে করতে পারলে অবশ্যই আমরাও পারব। স্রেফ খুঁজে বের করতে হবে।’
‘এখানে আমার একটা কথা আছে,’ টমি বলে উঠল। ‘আপনাদের মনে আছে কিনা, ডক্টর অবদেলের যে দেয়ালচিত্রটা তৈরি করা ছিল মানে যেটা অ্যানালিসিস করে আমরা এখান পর্যন্ত এসেছি সেখানে আরো বেশ কিছু জ্যামিতিক প্যাটার্ন ছিল। আমার মনে হয়, স্রেফ আমার ধারণা আর কি।’
‘টমি কথা না পেঁচিয়ে বলে ফেলো কী বলতে চাচ্ছো?’ শারিয়ার মৃদু ধমকের সুরেই বলল। সে চোখ সরু করে সামনের সমুদ্রে চোখ বুলানোর চেষ্টা করছে।
‘মানে ওখানে যেসব জ্যামিতিক প্যাটার্নগুলো আছে সেগুলো দেখে কেন জানি আমার কাছে মনে হচ্ছে সেগুলো এই জায়গার হলে হতেও পারে। হয়তো সেখান থেকে আমরা কিছু না কিছু পেয়ে যেতে পারি।’
‘অবশ্যই,’ বলে তুড়ি বাজিয়ে উঠল শশী। ‘এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি। অবশ্যই আমাদের এই ব্যাপারটা চেক করে দেখা উচিত,’ বলে সে টান দিয়ে নিজের ব্যাকপ্যাকের ভেতর থেকে ট্যাবটা বের করে আনল। সেই সঙ্গে বলে উঠল, ‘টমি, তোমার সেই ড্রোনটাও কাজে লাগতে পারে আমাদের। ওটাও বের করে সেট করে ফেল।’
‘ওক্কে বস,’ এই প্রথম টমিকে দারুণ একটা আইডিয়া দেয়ার পরও কোনোরকম গাল না মেরে সরাসরি কাজে নামতে দেখে খানিকটা অবাকই হলো শারিয়ার। তবে সে এক হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল।
‘এক মিনিট, এক মিনিট। কাজে নামার আগে কথা আছে,’ সবাই তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে বলে উঠল। ‘অচেনা জায়গায় আছি আমরা। এখানে বিপদ আপদের কোনো শেষ নেই। আর তাছাড়া শত্রুপক্ষের লোকেরাও যে আমাদের অনুসরণ করে এখানে পৌঁছায়নি সেটাও বলা সম্ভব না। কাজেই উলটো-পালটা না করে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে আমাদের।’
‘এখানে কে আসবে…’
‘বলা যায় না,’ শারিয়ার একটা আঙুল তুলে বলে উঠল ‘কাজেই সাবধানের কোনো মার নেই। ‘সুমন, তুমি সিঁড়ির দিকে যাও। কোণে গিয়ে পাহারা দেবে। কোনো ঝামেলা হলে শিস দিয়ে আওয়াজ দেবে। ভুবন তুই প্রাঙ্গণের উলটোদিক থেকে সমুদ্রের ওপরে চোখ রাখ। শশী আর টমি কাজ শুরু করো। আমি যতটা পারি আশপাশটা আরেকটু অবলোকন করে নিচ্ছি। এতে করে তোমাদের হেল্প হতে পারে। সবাই লেগে পড়ো, সময় কম।’
অতীত
কালো রঙের জাহাজটাকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখা যেতেই পদ্ম একেবারে শান্তভাব বজায় রাখলেও কিরান দুই পা এগিয়ে গেল প্রাঙ্গণের কিনারার দিকে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখার কোনোই প্রয়োজন নেই। কারণ দুই টিলার মাঝখানের শান্তভাবে প্রবাহিত পানির ধারা ভেদ করে ধীর গতিতে ছুটে আসা জাহাজটা না দেখতে পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনাতেই নিজের একটা হাত চলে গেছে কোমরে রাখা পিস্তলের বাঁটে। অন্য হাতটা দিয়ে চেপে ধরেছে বুকের ওপরে থাকা লকেটটা।
বুকের বলই আসল বল, সে মনে মনে কথাটা বলেই পদ্মের দিকে ফিরে একবার মাথা ঝাঁকাল যদিও দরকার ছিল না। কারণ পদ্ম ইতোমধ্যেই নিজের কোমর থেকে চিকন দেখতে একটা শঙ্খের মতো বের করে মুখে লাগিয়ে ফুঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে হালকা কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল দুর্গের প্রাঙ্গণজুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দুর্গের ওপরে উপবিষ্ট মানুষটা সামান্য উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের পতাকাটা নাড়তে লাগল। যুদ্ধের ঘোষণা হয়ে গেছে।
কিরান দেখল সবাই যার যার জায়গায়,যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী নিজ নিজ জায়গায় কাজ শুরু করে দিয়েছে। সবাই যার যার জায়গায় মাথা নিচু করে আছে। এটাও কিরানেরই নির্দেশনা। প্রথমেই শত্রুর চোখে ধরা পড়তে চাচ্ছে না ওরা। যদিও শত্রুর না জানার কোনো কারণ নেই তবুও প্রথমেই এমন একটা ভাব দেখাতে চাচ্ছে যে ওদের যেন এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেই। যদিও কোনো সম্ভাবনা নেই তবুও শত্রুর চোখে পড়তে চাচ্ছে না কেউই।
কিরান দেখল বেদুকে নিয়ে গোমেজ আর তার সঙ্গীরা একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে দুর্গের প্রাঙ্গণ থেকে সামনের ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেল।
মনে মনে খুশি হয়ে উঠল কিরান। কারণ ওদেরকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া আছে, সেটা পালন করার জন্যই ওদিকে গেছে ওরা। এবার দুর্গের প্রাঙ্গণে সাজানো কামানের কামাঞ্চিদের দিকে ফিরে তাকাল সে। সবাই যার যায় জায়গায় উপবিষ্ট হয়ে কামানের নল ঘুরিয়ে জাহাজ বরাবর তাক করে রেখেছে। প্রত্যেকের কামানের পাশেই রাখা গরম কয়লার ঝামা। সেই সঙ্গে ছোটে ছোটো মশাল আর গোলা। ওদের উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে সে ফিরে তাকাল পদ্মের দিকে। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পদ্ম কথা বলে উঠল। বন্দুকবাজ আর তিরন্দাজ বাহিনী প্রস্তুত আছে।
‘সাব্বাস কিন্তু,’ কিরান কথা শেষ করার আগেই ওর দিকে এগিয়ে এলো পদ্মের বাহিনীর সবচেয়ে বিশালাকায় সেই মহিলা। তার সঙ্গে আরেকজন। এদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুর্গের পেছনের পানির দিকে নজর রাখতে।
‘মাতারানি, পেছনে পাহারায় থাকা শত্রুজাহাজ নড়া শুরু করেছে। প্রথমে ভাবছিলাম যে, জাহাজটা বোধহয় সইরে পড়তে শুরু করেছে বা সামনের দিকে আসবে। কিন্তু ওইটা স্থির হয়া পেছন দিকে যাওয়ার রাস্তার নালার দিকের পথ বন্ধ কইরা দাঁড়াইছে এহন।’
‘ওরা পেছনের রাস্তা বন্ধ কইরা দাঁড়াইছে যাতে এইখান থেইকা কেউ পলাইতে না পারে,’ বলেই কিরান জাহাজের দিকে নিজের দূরবীক্ষণ তাক করল। কিন্তু জাহাজের পাটাতনে কেউই নাই ক্যান?’
কিরানের কথা শুনে পদ্ম হেসে উঠল। ঠিক যেই কারণে আমরা মাথা নিচু কইরা রাখছি, যাতে শত্রু আমগোরে দেখতে না পারে ঠিক সেই কারণেই ওগো জাহাজের পাটাতনেও কেউই নাই। ওরাও আমগো মতো প্রথমেই শুক্রর চোখে পড়তে চাইতাছে না,’ পদ্মের গলা শান্ত পানির মতো স্থির। তাতে বিন্দুমাত্র কম্পন নেই। সেই বিশালাকায় মহিলার দিকে তাকিয়ে পদ্ম বলে উঠল, ‘তুমি এহনো পেছন দিকেই পাহারা রাখো। ওই জাহাজ থাইকা আক্রমণ অইলে সঙ্গে সঙ্গে জানান দিবা। আর তোমার লোকেগো প্রস্তুত রাখো। আমরা যতই বাধা দিই, একটা সময় শত্রু এইখানে উইঠা আসবই। সেই সময়ে আমগোরেই লড়তে অইবে। আর শোনো, আঘাত করবা মারার মতো। আর নিজের উপায় না থাকলে আগে জান দিবা পরে শরীর, মনে থাকব?’
মনে থাকব, মাতারানি। মাথ নিচু করেই পদ্মকে একবার কুর্নিশ করে চলে গেল,’ পদ্মবাহিনীর প্রধান।
‘জাহাজের পাটাতনের ওপরে একটা লোকও নাই, কিরান এখনো সিলভেরাকে এক পলকের জন্য দেখা যায় কিনা সেটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। হঠাৎ দূরবীক্ষণে দেখতে দেখতেই সচকিত হয়ে উঠল সে। ‘পাটাতনের ওপরে থাকা একজন সামলাইতাছে। সর্বনাশ,’ হঠাৎ কথাটা বলেই সে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘সবাইরে প্রস্তুত করো, যেকোনো সময় আক্রমণ হইবে। পাটাতনের ওপরে পুরা বাহিনী প্রস্তুত হয়া লাইনে আছে,’ বলেই সে নিজের খাটো বাঁকা তলোয়ারটা বের করে আনল। সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল কামাঞ্চিরা।
‘আমি আগেই জানতাম,’ বলেই পদ্ম সাবধান করে দিল সবাইকে। ‘কামাঞ্চিরা প্রস্তুত হও। জাহাজি ইশারা করতেই আক্রমণে যাবা। মনে রাখবা, ওরা নিচে আছে আর আমরা ওপরে। আমরা প্রথমে সুবিধা পাব, এই সুযোগেই ওগো দুর্বল করতে হইবে,’ বলে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘এইটা অবশ্য সিলভেরাও জানে।
দূরবীক্ষণে চোখ কিরানের মনে মনে দূরত্বের হিসাব করল। জাহাজটা কামানের আয়ত্তের ভেতরে আসতে এখনো কিছুটা বাকি। আরেকটু সময় লাগবে। মনে মনে সে গুণতে শুরু করল, ‘এক দুই তিন…’ সঙ্গে সঙ্গে তার তলোয়ার ধরা হাতটা উঠে যেতে লাগল ওপরের দিকে। তার হাতের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত যেতে লাগল কামাঞ্চি বাহিনী।
‘…আট নয় দশ.. এগারো বারো,’ বলতেই যেই মুহূর্তে তার মধ্যে হলো জাহাজ সীমার মধ্যে চলে এসেছে চট করে তলোয়ার ধরা হাতটা নামিয়ে আনল সে। সঙ্গে সঙ্গে বুম বুম শব্দে পাহাড়ি এলাকা কাঁপিয়ে উঠে এক ঝাঁক আগুনের গোলা ছুটে গেল জাহাজটার দিকে।
বর্তমান
‘নাহ, যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না,’ টমি আর শশীর হতাশ চেহারার দিকে তাকিয়ে শারিয়ার খানিকটা অবাক হয়ে গেল। সে ভেবেছিল ওরা দুজনে মিলে আগের মতোই কিছু একটা বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু গত আধা ঘণ্টা ধরে সেই ম্যাপটা থেকেও তারা কিছুই বের করতে পারেনি। শারিয়ার আশপাশটা চক্কর দিয়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। বরং ওর কাছে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। পুরনো দিনে শত্রুরা চারপাশ থেকে যুদ্ধের ময়দান ঘিরে ফেললে যেরকম অনুভূতি হতো ওর কাছে অনেকটা মনে হচ্ছে। যেন ওদেরকেও চারপাশ থেকে কেউ না কেউ ঘিরে ফেরেছে। যদিও কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আর এই পাহাড়ি এলাকায় চট করে তেমন কারো আসারও কথা নয়। তবুও ইনটুইশন ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে সে।
টমি আর শশী ট্যাবের দিকে চোখ রেখে মনোযোগের সঙ্গে আলোচনা করছে। শারিয়ার প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তের দিকে এসে আশেপাশে চোখ বুলাল। মনে মনে সেটার অবস্থানগত বিষয়টার প্রশংসা না করে পারল না। এমনভাবে বসানো হয়েছে দুর্গটা যেকোনো দিক থেকেই আক্রমণ হলেই এটা থেকে বেশ ভালোভাবেই প্রতিহত করা সম্ভব হবে। শারিয়ার দুর্গের একটা কামানের ওপরে পা তুলে দিয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেট টানতে টানতে কামানটা ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করল। দেখেই বোঝা যায় অন্তত কয়েকশ বছর বয়স হবে এগুলোর। তবে ভেতরের জিনিস ভালো হওয়ার কারণে এখনো টিকে আছে কোনোমতে। কামানগুলোর অবস্থানগত বিষয়টা ভালোভাবে লক্ষ্য করতে গিয়ে একটা ব্যাপার খানিকটা অবাক করল শারিয়ারকে। দুর্গের প্রাঙ্গণে কামান বসানোর জন্য আলাদা আলাদা খোপ আছে। কিন্তু একটা কামানও সেই অনুযায়ী বসানো নেই। বরং প্রতিটি কামানের মুখ ফিরিয়ে দুর্গের দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে।
ব্যাপারটা খানিকটা অবাক করল তাকে। ঘটনাটা কী বোঝার জন্য সে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে পরখ করতে লাগল কিন্তু বাঁকা হয়ে দেখল কামানটাকে সেট করা হয়েছে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে। অবাক হওয়ার মাত্রা খানিকটা বাড়ল তার। যে কামানটতে পা রেখে দাঁড়িয়েছিল সেটা থেকে সরে এসে সে অন্য কামানটাতে ভালোভাবে চোখ বুলাল। এটাকেও বিচিত্র ভঙ্গিতে ভেতরের দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে। প্রাঙ্গণের পাথুরে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে সে নিচে চোখ বুলাতেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল। প্রতিটা কামানকে একটা মাটিতে পুঁতে রাখা লোহার ডাণ্ডার সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে সেটাতে সিমেন্ট লাগানো হয়েছে। লোহার ডাণ্ডা- শিকল আর সিমেন্ট তিনটে জিনিসেই কামানের বাকি অংশের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। কারণ কামানটা ঠিক যত পুরনো, এই জিনিসগুলো ঠিক ততটাই নতুন। সেই সঙ্গে কোনোভাবেই এগুলোকে পুরনো বলার উপায় নেই।
‘এই তোমরা একটু দেখে যাবে এদিকে,’ শারিয়ার টমি আর শশীকে ইশারায় সে যেখানে আছে সেখানে আসতে বলল।
‘কী ব্যাপার?’ শশীর গলা শুনে মনে হলো শারিয়ার এভাবে ডাকাতে সে খানিকটা বিরক্তই হয়েছে। ‘জরুরি কিছু না হলে…’
‘জরুরি বলতে ভীষণ জরুরি। জলদি আসো,’ শারিয়ার এখনো পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি। শশী অর টমি কাছে আসতেই সে বলে উঠল, ‘দেখো কামানের নিচের অংশগুলো এভাবে আলাদা করে লাগানো কেন?
হাতের ট্যাবটা টমির হাতে ধরিয়ে দিয়ে শশী রীতিমতো ঝামটে উঠে বসে পড়ল পাথুরে মেঝেতে। ‘এগুলোতে দেখার কী আছে?’ বলে সে নিচু হয়ে দেখেই শিস দিয়ে উঠল। ‘ওমা, এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক পরে এগুলোকে লাগানো হয়েছে।
‘একদম ঠিক, শারিয়ার দুই হাত জড়ো করে বলে উঠল। ‘আর এখানে সাম্প্রতিক সময়ে একজনই মানুষই এসেছিল যার এমন কিছু করার পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে।’
‘ডক্টর আবদেল,’ অস্ফুটে বলে উঠল টমি।
‘তারমানে এই কামানগুলোকে এমনভাবে সেট করার পেছনে কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই আছে,’ শশী মনোযোগের সঙ্গে পরখ করার চেষ্টা করছে। দুর্গের প্রাঙ্গণে মোট পাঁচটা কামান বসানো আছে। প্রতিটি কামান কোনো না কোনো নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে আছে। এক মিনিট এক মিনিট। হিসেব অনুযায়ী কামানগুলোর মুখ থাকার কথা বাইরের দিকে। কিন্তু এগুলোকে সেট করা হয়েছে ভেতরের দিকে। মানে এই কামানগুলোর মুখ নির্দিষ্ট দিকে সেট করে কিছু একটা ইঙ্গিত করা হয়েছে।’
‘একদম ঠিক, ওদের পেছন থেকে ভুবন বলে উঠল। ওরা কী করছে দেখার জন্য ও এগিয়ে চলে এসেছে। ‘খেয়াল করে দেখো কামানগুলোকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে আলাদা আলাদাভাবে অ্যাঙ্গেল করা কিন্তু আমার মনে হয় এগুলো নির্দিষ্ট কোনো দিকে নির্দেশ করছে।’
‘দাঁড়াও, আমি এক কামানের সামনে দাঁড়াচ্ছি। টমি, ভুবন আর শারিয়ার তোমরা তিনজন তিনটে কামানের সামনে দাঁড়াও,’ শশী বলে উঠল। যদিও আরেকটা বাকি থাকে।’
‘সুমন ভাইকে ডাকব নাকি?’ টমি জানতে চাইল।
‘কোনো দরকার নেই,’ শারিয়ার বলে উঠল। ‘এই চারটে দেখলেই হবে। কী করতে হবে বলো?’ শেষ কথাটা সে শশীর দিকে ফিরে বলেছে।
‘সবাই একসঙ্গে আমাদের পেছনে কামানটাকে একটা সরল রেখার মতো ধরে সামনে এগোতে থাকব দেখো কোনো পয়েন্টে মিলে একসঙ্গে। চলো শুরু করি। এক দুই তিন…’ বলেই সে হাঁটতে শুরু করল। সেই সঙ্গে বাকিরাও। হাঁটতে হাঁটতে দুর্গের দেয়ালের প্রায় কাছাকাছি একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে এসে থেমে গেল চারজনই।
‘ওমা, এখানে তো কিছুই নেই?’ শারিয়ার অবাক হয়ে বলে উঠল। কামানের কুটা প্রথমে তারই নজরে পড়েছিল, এতে কিছু না পেয়ে সে বেশ হতাশ এবং বিরক্ত বোধ করতে লাগল।
অতীত
কামানগুলো থেকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে বোমা বর্ষণ হতেই শব্দের চোটে কানে প্রায় তালা লেগে গেল প্রাঙ্গণে উপস্থিত সবার। এমনিতেও জায়গাটা খোলা হওয়ার কারণে শব্দ আটকে পড়ার কথা না। কিন্তু দুর্গের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে শব্দ ফিরে আসাতে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় হলো কিরানদের।
কামানের গোলাগুলো প্রায় কাছাকাছি সময়ে ছুটে গেল জাহাজটার দিকে। কিরান উদগ্রীব হয়ে লক্ষ করতে করতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। আর নিজেদের লুকিয়ে লাভ নেই। প্রাঙ্গণের কিনারায় দাঁড়িয়ে আফসোসের সঙ্গে কিরান খেয়াল করল প্রথম গোলাটা জাহাজ টপকে চলে গেল অন্যদিকে। তৃতীয় আর চতুর্থ গোলাটাও জাহাজের ওপর দিয়ে পেছনের পানিতে গিয়ে পড়ল। শেষ গোলাটা গিয়ে আঘাত করল জাহাজের একেবারে পেছন দিকে। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসধ্বনি করে উঠল প্রাঙ্গণে উপস্থিত সবাই।
‘আবার… আবার গোলা ভরো,’ কিরান চিৎকার করে নির্দেশ দিল। সবাইকে। ‘এইটাই সুযোগ এই সময়েই আঘাত করতে হবে,’ বলেই সে নিচ থেকে ভেসে আসা চিৎকার শুনে ফিরে তাকাল জাহাজের দিকে। প্রথম দফা গোলাবর্ষণ শুরু হতেই দুই পক্ষেরই সব আড়াল ভেঙে পড়েছে। জাহাজের পাটাতনের ওপরে বেরিয়ে এসেছে সশস্ত্র যোদ্ধাদের দলটা। অনেকের হাতেই বন্দুক দেখা গেল। ক্রমাগত গুলি করছে। কিন্তু আয়ত্তের অনেক বাইরে হওয়াতে গুলি পৌঁছালো না। জাহাজের পাটাতন থেকে দস্যুদের এদিকে ফিরে গুলি করতে দেখেই কিরান চিৎকার করে পদ্মকে সাবধান করে দিল।
‘আমাদের বন্দুকবাজদের প্রস্তুত হতে বলো,’ বলেই সে সামান্য কেঁপে উঠল ফিরে তাকিয়ে দেখল জাহাজের সামনের অংশ থেকে দুটো কামানে একসঙ্গে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু দূরত্ব অনেক বেশি হওয়াতে সেগুলো ঘাটের কাছের পানিতে পড়ছে।
‘আবার আবার গোলা চালাও,’ বলেই কিরান নিজের হাতে ধরা তলোয়ারটা উঁচু করেই আবারও নিচু করে আনল। আবারও একের পর এক গোলা ছুটে গেল জাহাজটার দিকে। পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠল একেকটা কামান। একসঙ্গে একের পর এক প্রায় আধডজন গোলা ছুটে গেল জাহাজটার দিকে। এবার প্রথম গোলাটাই জাহাজে গিয়ে সরাসরি আঘাত করল। দুই-তিনজন দস্যুকে উড়িয়ে দিয়ে পাটাতনে মস্ত এক ফুটো করে নিচে গেমে গেল গোলাটা। দ্বিতীয় গোলাটা জাহাজের উঁচু অংশের কামরার এক কোনা উড়িয়ে দিল। তৃতীয় আর চতুর্থটা জাহাজ ছুঁতে ছুঁতেও বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করল তৃতীয় গোলাটা। জাহাজের একপাশের বেশ খানিকটা অংশ উড়িয়ে জাহাজটাকে একপাশে কাত করে ফেলল ওটা। আনন্দ ধ্বনি করে উঠল প্রাঙ্গণে থাকা যোদ্ধারা। কিন্তু কিরান চিৎকার করে আবারও গোলা ভরার নির্দেশ দিল।
কারণ ও জানে এগুলোর কোনোটাই কাজে দেবে না। যদি না ওরা ঘাটে ভেড়ার আগেই জাহাজটাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। একবার দস্যুসমেত জাহাজটা ঘাটে ভেড়াতে পারলে আর দেখতে হবে না। দস্যুরা স্রেফ হাতে পিষেই মেরে ফেলতে পারবে ওদের।
বর্তমান
খানিকটা হতাশ হয়েই বদ্ধ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে শারিয়ারসহ বাকিরা। শশী খানিকটা পিছিয়ে এসে দুইপাশে দেখে বলে উঠল, আচ্ছা আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। খালি চোখে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে, দুর্গের ভেতরের দিকে প্রবেশ করতে হলে দুদিকে দুটো প্রবেশপথ আছে আর প্রবেশপথ দুটো ওই দুদিকে।’
বাকিরাও শশীর দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী পাশাপাশি এসে ফিরে তাকাল দুর্গের দুপাশের দুই প্রবেশপথের দিকে। এর মধ্যে একদিকের পাথুরে দেয়াল ভেঙে পড়ে একেবারেই বন্ধ হয়ে গছে। অন্যপাশের আরেকটা প্রবেশপথের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
‘আমার কাছে কী মনে হয় জানো, যদি সত্যি সত্যি ডক্টর আবদেল এই কামানগুলাকে এদিকে সেট করে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করে থাকে তবে সেটা শুধু প্রবেশপথ না। এর সঙ্গে আরো বেশি কিছু বোঝাবার চেষ্টা করেছে সে।’
‘আমারও তাই মনে হয়. শারিয়ারের কথার সঙ্গে সঙ্গে ভুবন বলে উঠল। কারণ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ কি, এই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দুর্গের যতটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে সেটা কিন্তু খুবই কম। এই দুর্গ যারাই বানিয়েছে, এত ছোটো একটা দুর্গ এখানে বানানোর কথা নয়। কারণ খালি চোখে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি সেটাতে বিশজন মানুষও ঠিক মতো থাকতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আর গুদাম থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি তো বাদ গেল।’
‘তারমানে এই দুর্গের যতটুকু দেখা যাচ্ছে দুর্গটা এর চেয়েও অনেক বড়ো। সেটা হতে পারে পাহাড় মানে টিলার পেছন দিকে এর একটা বিস্তৃত অংশ রয়েছে অথবা…’
‘পাহাড়ের ভেতরে এর অনেকটা অংশ রয়েছে। আর পাহাড়ের ভেতরেই সম্ভবত দুর্গের মূল অংশটা রয়ে গেছে। যে কারণে,’ বলে শশী তার হাতটা নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে কমানগুলোর দিকে নির্দেশ করে বলে উঠল, ‘ডক্টর আবদেলের এই নির্দেশনা সম্ভবত দুর্গের ওপরের অংশ নয় বরং দুর্গের ভেতরের দিকে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।’
‘কিন্তু এটা দিয়ে বোঝাচ্ছে কী সেটা কীভাবে বের করব আমরা?’
যখন খালি চোখে কোনো কিছু দেখা না যায় তখন সেটার জন্য চশমা লাগাতে হয়,’ বলে টমির দিকে তাকিয়ে শশী হেসে উঠল। ‘আর নিজের চোখে দেখতে না পেলে পাখির চোখ ধার নেব।’
‘ড্রোন ক্যামেরা,’ বলে টমি তালি দিয়ে উঠে নিজের ব্যাকপ্যাক খুলে বসে পড়লপ্রাঙ্গণের ওপরে। শশী আর টমি মিলে কয়েক মিনিটের ভেতরেই ড্রোনটাকে সেট করে উড়িয়ে দিল ওপরের দিকে। টমি রিমোটেরে সাহায্যে ড্রোনটাকে কন্ট্রোল করে উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে। আর শশী চোখ রাখতে শুরু করল ল্যাপটপে। ওর পেছন থেকে শারিয়ার আর ভুবনও চোখ রাখছে ল্যাপটপে। ধীরে ধীরে ড্রোনটা উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। শতিনেক গজ ওপরে উঠতেই মোটামুটি পাহাড়ের ওপরে দুর্গটাকে পরিষ্কার দেখা গেল। পুরো টিলা আর আশেপাশের এলাকা চোখে পড়ছে এখন।
টমি ড্রোনটাকে আরেকটু সরিয়ে দুর্গটা সরাসরি ওপরে নিয়ে আসো,’’ শশী নির্দেশনা দিল। ড্রোনটাকে সরিয়ে দুর্গের ওপরের অংশে স্থির করল টমি। বাকিরা চোখ বোলাতে শুরু করল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। প্রথমে তেমন কিছুই দেখা গেল না। তারপর দুর্গের ওপরের অংশে ভাঙাচোরা জায়গাটায় ধীরে ধীরে চোখ বুলাতে শুরুকরল ওরা। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’
‘এক মিনিট,’ শারিয়ার বলে উঠল। ‘আমরা ভুলভাবে দেখছি ব্যাপারটা। টমি ড্রোনটা আরেকটু ওপরে ওঠাও,’ বলে সে পুরো প্রাঙ্গণটা কভার করতে করতে বলল, ‘এবার দেখো। বলে সে স্ক্রিনের ওপরে হাত রাখল। এই দেখো কামানগুলো থেকে যদি একটা করে সরল রেখা টানি তবে দেয়ালের এই জায়গাতে নির্দেশ করে। এবার এই জায়গা বরাবর ওপরের অংশে সার্চ করো,’ বলেই সে আবারও নির্দেশ দিল টমিকে। ‘আরেকটু নিচে নামিয়ে আনো, টমি।’
‘এই যে এখানে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে,’ শশী খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠল। দুর্গের ওপরের অংশের সরলরেখা বরাবর পরীক্ষা করতেই পরিষ্কার দেখা গেল, দুর্গের ওপর দিকে ওই সরলরেখা বরাবর রেলিংয়ের দিকে একটা ছোটো ফোকরের মতো আছে। নিশ্চিত ওটা দুর্গের ভেতরের দিকে প্রবেশ করার কোনো পথ হবে।’
‘এক মিনিট, এটা কী?’ দুর্গের দিকে চোখ রাখাতে আগে কেউই খেয়াল করেনি। এখন খানিকটা অন্যদিকে তাকাতেই ড্রোনের ভিউতে পরিষ্কার দেখতে পেল দুর্গের নিচের অংশে একটা স্পিডবোট। সর্বনাশ! এটা এলো কোথা থেকে। সুমনকে সাবধান করে দিতে হবে,’ বলেই শারিয়ার বসা থেকে সোজা দাঁড়াল। হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। ভুবনও নিজের অস্ত্র বের করে এনেছে। টমি আর শশী ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বনে গেছে। ‘হচ্ছেটা কী? এখানে লোক আসবে কোথা থেকে?’
শারিয়ার আর ভুবন সোজা হয়েও সরতে পারল না, তার আগেই প্রাঙ্গণের সিঁড়ির কাছ থেকে আধ ভাঙা বাংলায় কথা বলে উঠল একজন মানুষ।
সুমনকে আপনাদের সাবধান করার কোনো প্রয়োজন নেই,’ বলে সে হাসি মুখে নিজের অস্ত্র নেড়ে কথা বলে উঠল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে আসতে। শারিয়ার আর ভুবন দুজনেই নিজেদের অস্ত্র তাক করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এমনভাবে দাঁড়াল দুজনে যাতে করে টমি আর শশীকেও কভার করা হয়ে যায়। ‘সাবধান, এক পাও এগোবে না,’ শারিয়ার ধমকে উঠল।
‘ব্যাপারটা আসলে উলটো,’ বলে চায়নিজ চেহারার মানুষটা হেসে উঠল। ‘তোমরা বরং কিছুই না করে নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে নেবে। কারণ সুমন আমাদের হাতে বন্দি,’ বলে সে পেছন ফিরে ইশারা করতেই দুই দিক থেকে দুজনে ধরে সুমনকে নিয়ে এলো প্রাঙ্গণের ওপরে। একজন তার মাথার পাশে চেপে ধরে রেখেছে নিজের অস্ত্র।
শারিয়ারের অস্ত্র ধরা হাত আপনাতেই নেমে গেল নিচের দিকে।
অতীত
বাতাসে ভাসতে থাকা বারুদের গন্ধ, উড়তে থাকা ধুলো আর ধোঁয়া, তীব্র চিৎকার, আর্তনাদ আর উত্তেজনা সব মিলিয়ে যেন নরক নেমে এসেছে দুর্গের প্রাঙ্গণের ওপরে।
তবে কিরান জানে প্রকৃত নরক এখনো নেমে আসেনি। নরক নেমে আসবে একবার সিলভেরার জাহাজ ঘাটে ভিড়তে পারলে। সে আরেকবার চিৎকার করে কামান চালাতে নির্দেশ দিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ছোটো ছোটো মশালে করে কামানে আগুন দিল কামাঞ্চিদের দল। পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠে অগ্নিবর্ষণ করতে লাগল কামানগুলো।
এর আগের আক্রমণে শেষ গোলার আঘাতে জাহাজের একদিকে হেলে গেছিল তাতে জাহাজের গতি সামান্য কমে এলেও দক্ষ জাহাজি পর্তুগিজরা আবারও জাহাজটাকে সোজা করে ফেলেছে। ফলে আবারও তরতরিয়ে এগোতে শুরু করেছে জাহাজ। বরং জাহাজের পাটাতনের ওপর থেকে আবার ওদের দিকে কামান অগ্নিবর্ষণ করল। গোলাগুলো ছুটে আসতে দেখে সবাইকে মাথা নিচু করে সাবধান থাকার নিদের্শ দিল কিরান। যদিও গোলাগুলোর একটাও প্রাঙ্গণ পর্যন্ত উঠে এলো না, তবে ওগুলোর আঘাতে কেঁপে উঠল চারপাশ। গোলাগুলো আগেরবারের চেয়ে খানিকটা ওপরে আঘাত করেছে। কিরান অনুমান করল এরপরের গোলাগুলো হয়তো প্রাঙ্গণে চলে আসতেও পারে। কারণ এগিয়ে আসছে জাহাজ।
নিজের মাথা নিচু করেই আবারও সোজা হয়ে গেল কিরান। দেখতে পেল এবার ছোড়া গোলাগুলের ভেতরে তিনটেই জাহাজে লাগল। পাটাতনে বিশাল এক ফোকর দেখা দিল, এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ল কাঠের টুকরো। একটা কামান সহ উড়িয়ে দিয়েছে জাহাজের একাংশ। অন্যটা জাহাজের দুটো মাস্তুলের একটাকে আহত করেছে খানিকটা।কিন্তু জাহাজ এখনো তরতরিয়ে এগিয়েই আসছে।
উত্তেজনার চোটে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিরান। জাহাজ যেভাবে এগিয়ে আসছে আর দুবার বড়োজোর কামানের গোলা বর্ষণ করার সুযোগ পাবে ওরা। এরপরে জাহাজ চলে আসবে ঘাটের ভেতরেই।
কিরান চিৎকার করে কামানে গোলা ভরতে নির্দেশ দিল। সে দুর্গের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো পদ্মের দিকে ইশারা করতেই পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে এলো ছয় সাতজনের মতো অস্ত্রধারী। সারি দিয়ে প্রাঙ্গণের কিনারায় দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করল জাহাজের দিকে।
‘গুলি করো,’ বলে চিৎকার করে উঠতেই প্রায় কাছাকাছি সময়ে গুলি করল সবাই। ধোঁয়া কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরান তাকিয়ে দেখল জাহাজের অগ্রভাগে সাজানো কামানগুলোর কাছে দুয়েকজন পড়ে গেছে। এছাড়া আর গুলিগুলো তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কিরান বুঝল গুলির জন্য আরো কাছাকাছি আসতে হবে জাহাজগুলোকে। তবে কামানের গোলা লাগানোর এখনই সুযোগ।
কিরান লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে আবার পেছনে সরে বন্দুকে গুলি ভরার নির্দেশ দিয়ে নিজে চলে এলো সারি দিয়ে সাজানো কামানগুলোর কাছে। আগের বারের গোলাবর্ষণের পর আবারও গোলা ভরা হচ্ছে কামানে। গোলা ভরার পর বারুদ সাজিয়ে সলতে বসানোর পর কামানের পাশেই রাখা কয়লার বাক্স থেকে মশালে আগুন দিয়ে সেটা লাগানো হয়। কিরান একটা কামানের পাশে গিয়ে কামাঞ্চির হাত থকে গোলা নিয়ে ঢুকিয়ে দিল কামানের নির্দিষ্ট স্থানে। তারপর কামানের মুখটাকে ঘুরে স্থির করে ফেলল জাহাজের দিকে। জাহাজ বেশ ভালো গতিতে এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। জাহাজের পাটাতনে দস্যুরা ছোটাছুটি করছে। সেই সঙ্গে ওরাও কামান দাগতে শুরু করেছে। কিরান কামানের মুখটা নামাতে নামাতে একেবারে প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে ঠেকিয়ে দিল। তারপর পাশে হাত বাড়াতেই তার হাতে জ্বলন্ত মশাল ধরিয়ে দিল কেউ একজন।
অস্ফুটে কিরান বলে উঠল, ‘গোলন্দাজের জন্য,’ বলেই সে মশালটা ঠেকিয়ে দিল সলতের সঙ্গে। সামান্য লাফিয়ে উঠে কামানটা পিছিয়ে এলো। আর গোলাটা ছুটে গেল জাহাজের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আরো পাঁচটা কামান থেকে গোলা বেরিয়ে গেল জাহাজগুলোর দিকে। ধোঁয়া কাটতে কিরান দেখল জাহাজের মূল মাস্তুলটা হেলে পড়েছে একদিকে। পাটাতনে সদ্য তৈরি হওয়া নতুন বিরাট গর্তটা দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কিন্তু হাল চালানোর লোকটা এখনো ধরে আছে হালটা। জাহাজের গতি কিছুটা কমলেও সেটা এখনো এগিয়েই আসছে।
কামানে আবার গোলা ভরতে নির্দেশ দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে, ‘বন্দুক বাহিনী সামনে এগোও,’ বলতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বন্দুক বাহিনী। ‘জাহাজের হালের দিকে গুলি করবে সবাই,’ বলতেই একরাশ গুলি ছুটে গেল জাহাজের দিকে। কিরান দেখতে পেল হালের কাছের লোকটা পাটাতনের ওপরে পড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বন বন করে ঘুরতে শুরু করছে চাকাটা।
এটাই সুযোগ, মনে মনে বলে উঠল সে। উঠে দাঁড়িয়ে গলা চিড়ে চিৎকার করে উঠল গোমেজ আর বেদুর উদ্দেশ্যে। সেই সঙ্গে পাশের একজনের হাত থেকে গুলি ভরা একটা বন্দুক টেনে নিল নিজের হাতে। তারপর যাদের গুলি ভরা হয়ে গেছে তাদের নির্দেশ দিল নিশানা করতে।
সবাই মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছে, কিসের দিকে নিশানা করবে। এমন সময় প্রাঙ্গণের নিচের দিকেও টিলার প্রান্তে ঝোপঝাড় কেঁপে উঠতে শুরু করল। কিছু একটা গড়িয়ে চলেছে ঘাটের দিকে। কিরান হাঁটু গেড়ে বসে নিশানা করল ঘাটের দিকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে উড়াল দিল একটা পিপে। সেটাকে অনুসরণ করল ছোটো-বড়ো আরো অনেকগুলো পিপে। ‘এইবার,’ বলেই শূন্যে থেকে নিচের দিকে ধেয়ে চলেছে এরকম একটা পিপেতে গুলি করল কিরান। বারুদ ভরা পিপেটা বিস্ফোরিত হলো ঠিক জাহাজটার ওপর গিয়ে। সেই সঙ্গে বাকিগুলো অনুসরণ করলো ওটাকে। গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল পুরো পাহাড়ি টিলা।
বর্তমান
সুমনকে চায়নিজ হুয়ান জিঙের হাতে বন্দি দেখে নিজের পিস্তলটা সাবধানে নামিয়ে নিল শারিয়ার। সেই সঙ্গে হাত দিয়ে ভুবনকে ইশারা করল তার পিস্তলটা নামিয়ে নেয়ার জন্য।
‘সুমনকে ওইদিকে পাহারায় পাঠানোই উচিত হয়নি,’ বিড়বিড় করে বলে উঠল ভুবন। আর আমারও এভাবে পাহারা ছেড়ে উঠে আসাটা একেবারেই ঠিক হয়নি।’
যা হওয়ার হয়েছে,’ শারিয়ার আস্তে করে বলে উঠল। তারপর হুয়ান জিঙের কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি আমাদের এখানে খুঁজে বের করলে কীভাবে?’
‘তুমি ভুল প্রশ্ন করলে, অফিসার,’ হুয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে মনে মনে বেশ খুশি সে। তার সঙ্গে ছয়-সাতজন লোক। তাদের ভেতরে কয়েকজন এগিয়ে এসে শারিয়ার আর ভুবনের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিল। তারপর দুজনকেই পরীক্ষা করে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করাল। টমিকেও ওই একই কাজ করা হলো। ওদের ভেতরে একজন শশীর গায়ে হাত দিয়ে যাচ্ছিল চেক করার জন্য ঠাস করে তাকে চড় মারল শশী। সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে অস্ত্র তুলল হুয়ানের লোকেরা।
‘কুল কুল,’ বলে তার দিকে খানিকটা হুয়ান। ম্যাডামকে আমাদের দরকার, বলে সে আশপাশটা দেখাল। ‘উনি না থাকলে তো কোনোকিছুই হতো না,’ বলে সে শশীর একেবারে মুখের কাছে চলে এলো। ‘কি ম্যাডাম, ঠিক বলেছি না?’ বলে সে নিজের হাতের পিস্তলটা চেপে ধরল শশীর থুতনির নিচে। ‘কি ম্যাডাম, ঠিক বলেছি?’ বলে সে ছেড়ে দিল শশীকে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল শশী।
‘এই সাবধানে,’ বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল ভুবন। ‘শালা হারামি মেয়েদের গায়ে হাত তুলিস!’
শারিয়ার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হুয়ানের দিকে। তারপর ফিরে তাকাল শশীর দিকে। ‘মাদারটোস্ট…’ শারিয়ার চিবিয়ে চিবিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল তার আগেই হুয়ান তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
‘আচ্ছা, বহুত হয়েছে আবার কাজে নামো,’ বলে সে শশী আর টমির দিকে ফিরে ইশারা করল। ‘তোমরা যা বের করেছ, আমি সবই শুনেছি। কাজেই কোনো উলটা-পালটা চলবে না। এখান থেকে আমরা ওপরে উঠে দুর্গের ভেতরে নামার রাস্তাটা বের করব।’
‘সে তো যাব, কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্ন আছে, শারিয়ার বলে উঠল।
‘কোনো কথা নাই, আগে কাজে নামো,’ হুয়ান ধমকে উঠল। কিন্তু শারিয়ারের ভেতরে কোনো বিকার দেখা গেল না। সে বলেই চলেছে। ‘তুমি আমাদের এখানে অনুসরণ করলে কীভাবে?’ শারিয়ার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হুয়ানের দিকে I ‘লোকাল পুলিশে তোমার ইনফরমার আছে, সেটা আমি জানতাম। আর তাই এমনকি আমরা পুলিশ থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম, যাতে কেউই আমাদেরকে অনুসরণ করতে না পারে। কিন্তু তুমি ঠিকই আমাদের অনুসরণ করে একেবারে জায়গামতো চলে এলে। কীভাবে সম্ভব?’
‘বলছি না, কথা কম,’ বলে হুয়ান এগিয়ে এসে তার পিস্তল চেপে ধরল শারিয়ারের কপালের ওপরে। সে পিস্তল ঠেকাতেই শারিয়ার হেসে উঠল। তারপর সে ফিরে তাকাল সুমনের দিকে। ‘নাকি এই প্রশ্নটা আমার করা উচিত সুমনকে? শারিয়ারের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই অবাক হয়ে ফিরে তাকাল সুমনের দিকে। সুমন একেবারে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘উত্তর দাও, সুমন?’ শারিয়ার ধমকে উঠল।
‘বস, প্লিজ,’ বলে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ‘এরা যা বলে শুনেন প্লিজ না হলে…’
‘এই! কী সব নাটক শুরু হলো!’
‘আমি বলছি দেখো মেলে কি না,’ শারিয়ার মৃদু হেসে বলে উঠল। ‘ওইদিন রাতে সেই রোডের ওখানে আমাদেরকে হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকটিভ হয়ে ওঠে হুয়ান। যেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে আমাদেরকে ধরতে পারছে না সেই মুহূর্তে তুমি সুমনের বাড়ি চলে যাও। সুমন যখন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর বাড়িতে যায় ওর ওয়াইফকে ঢাকার গাড়িতে তুলে দেয়ার জন্য, সে বাড়িতে পৌঁছে দেখে তোমরা ইতিমধ্যেই ওখানে পৌঁছে গেছ। সম্ভবত সুমনের ওয়াইফকে জিম্মি করেই তুমি ওকে…’
‘বস, প্লিজ,’ সুমন হাত জোর করে অনুনয় করছে।
‘এই সবাই ওপরে ওঠো…’
‘হুয়ান তুমি অনেক চালাক। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুলে গেছিলা যে শত্রুরও শত্রু থাকে বন্ধুরও শত্রু থাকে। তুমি ভুলে গেছিলে যে, কেউ একজন ডক্টর শশীকে অপহরণ করেছিল। আর সেটা তুমি নও, কাজেই …
শারিয়ারের কথা শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে আসছিল হুয়ান। হঠাৎ থেমে গেল সে। ‘মানে, তুমি কী বলতে চাচ্ছো?’
হুয়ান আর শারিয়ার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। শারিয়ারের মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। সঙ্গে সঙ্গে গুলি খেয়ে পড়ে গেল হুয়ান।
অতীত
কিরানের পরিকল্পনা অনুযায়ী গোমেজ আর বেদু মিলে অনেক বারুদের পিপে পাহাড়ি টিলার প্রাঙ্গণের অন্যপাশে স্তূপ করে রেখেছিল। সিলভেরার জাহাজের হাল ধরে থাকা লোকটা গুলি খেয়ে পড়ে যেতেই জাহাজের মাথাটা ধীরে ধীরে একদিকে ঘুরতে শুরু করে। আর সঙ্গে সঙ্গে কিরান চিৎকার করে নির্দেশ দিতেই দুজনে মিলে পিপাগুলোকে গড়িয়ে দেয় পাহাড়ের ওপর থেকে। পিপাগুলো ওপর থেকে পড়তে পড়তে যখন জাহাজের ওপরে শূন্যে এমন সময় কিরানসহ বাকিদের গুলিতে একটা পিপা বিধ্বস্ত হতেই বাকিগুলোও একসঙ্গে বিধ্বস্ত হতে শুরু করে। একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পাহাড়ি টিলা। ধোঁয়া সরতে প্রাঙ্গণে থাকা সবাই দেখতে পেল জাহাজের পাটাতনের একাংশ আর জাহাজের একটা পাশ ভেঙে বসে গেছে। আর সেটার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে আগুন আর ধোঁয়া। জাহাজটাও আরো কাত হয়ে গেছে একপাশে। একসঙ্গে উল্লাস করে ওঠে সবাই মিলে।
কিন্তু কিরানদের মুখের হাসি মলিন করে দিয়ে জাহাজটার পাটাতনের অন্যপাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল দস্যুদের দল। সবার অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সিলভেরা। দস্যুরা বেরিয়ে এসেই তাদের সামনের সারি থেকে একদল দস্যু বন্দুক হাতে হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুক তাক করল ওদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে একপাশে লাফিয়ে পড়ে আড়াল তো নিলোই চিৎকার করে বাকিদেরকে সাবধান করে দিল কিরান। এক ঝাঁক গুলি ছুটে এলো ওদরে দিকে। এক গড়ান দিয়ে উঠে এসেই কিরান দেখতে পেল ওদের ভেতরে কয়েকজন গুলি খেয়ে পড়ে গেছে এদিকে-সেদিকে।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল জাহাজটার মাঝামাঝি পাটাতনের একটা অংশ ভেঙে পড়লেও তাতে ভেতরে অবস্থানরত দস্যুদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে জাহাজটা প্রায় ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে গেলেও ওটা প্রায় চলে এসেছে ঘাটের কাছাকাছি। বেঁচে থাকা দস্যুরা এখন পিলপিল করে বেরিয়ে এসে গুলি চালাতে শুরু করেছে।
‘সবাই যার যার অস্ত্র তুলে নাও, এবার শুরু হবে আসল লড়াই,’ বলেই কিরান এক হাতে টান দিয়ে বের করে আনল নিজের তরবারি, অন্যদিকে মাটিতে পড়ে থাকা একটা বন্দুক তুলে নিল।
‘কামাঞ্চিরা গোলা ভরে আবার চালাও। পদ্ম বন্দুকবাজদের সারি দিয়ে গুলি করতে বলো,’ বলেই কিরান হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুক তাক করল নিচের ঘাটের দিকে। দুপাশে সারি দিয়ে বসে গেছে আরো একাধিক সৈন্যরা।
নিচে সিলভেরাদের জাহাজ প্রায় ডুবতে বসেছে। ডুবতে ডুবতে জাহাজটা এসে বাড়ি মারল ঘাটে ভেড়ানো একটা নৌকাতে। সেটাকে চ্যাপ্টা করে দিয়ে ঘাটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে যেতে শুরু করল ওটা। জাহাজ ভাঙার মরমর ধ্বনিতে ভরে উঠল জায়গাটা। ঘাটের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে একদিকে কাত হয়ে মাটির সঙ্গে বাড়ি খেতে খেতে থেমে গেল বিরাট জাহাজটা। সেটা থেকে পিলপিল করে লাফিয়ে নামতে শুরু করল দস্যুরা। সংখ্যায় একেবারে কম বলা যাবে না।
ঘাটের সিঁড়িতে পা রাখা প্রথম দস্যুটা কিরানের গুলি খেয়ে পড়ে গেল। সেই সঙ্গে আরো কয়েকজন পড়ে গেল গুলি খেয়ে। কিন্তু বন্দুকবাজদের গুলি শেষ হতেই আবারও স্রোতের মতো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল দস্যুরা। সবার অগ্রভাগে কিরান দেখতে পাচ্ছে সিলভেরাকে। মুখে গালির তুবড়ি ছুটিয়ে উঠে আসছে সে।
প্রথম দফা গুলি করেই বন্দুকবাজদের নিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল কিরান। এক রাউন্ড গুলি করেই বন্দুকে গুলি ভরতে শুরু করেছে সবাই। বন্দুকে গুলি ভরতে ভরতেই আরো বেশ খানিকটা উঠে আসতে শুরু করেছে দস্যুরা। কিরানরা বন্দুকে গুলি ভরতে ভরতে আরেক দফা কামানে গুলি চালাল কামাঞ্চিরা। কিন্তু প্রায় সব গোলাই দস্যুদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে পানিতে গিয়ে পড়ল। কামানে আর কোনো কাজ হবে না। নাহ, শেষবারের মতো কাজে লাগানোর মতো একটা উপায় আছে। হাতের বন্দুক আরেকজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গুলি ভরতে বলল কিরান।
তারপর দৌড় দিল প্রথম কামানটা যেখানে আছে সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখতে পেল কালিঝুলি মাখা কামাঞ্চি ওটাতে গোলা ভরে ফেলেছে। গোলা ভরা শেষ হতেই কিরান তাকে নিয়ে কামানের মুখটা ঘুরিয়ে দিল। দুর্গের একপাশের দেয়ালের দিকে, যেখানটা সিঁড়ির সবচেয়ে কাছে। কামাঞ্চি বোঝার চেষ্টা করছে কিরান আসলে কী করছে। কামানের মুখটা ঘুরিয়ে দিতেই বুঝে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিরান চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দিল, ‘সরে যাও,’ বলেই সে বাড়িয়ে দেওয়া মাশলটা হাতে নিয়ে সেটাতে ঠেকিয়ে দিল সলতের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠে কামানের গোলাটা ছুটে গেল দুর্গের একপাশের দেয়ালের ওপরে।
আগুনের হলকার মতো গোলাটা সবার মাঝখান দিয়ে ছুটে গিয়ে আঘাত করল পাথুরে দেয়ালে। ভারী পাথুরে দেয়ালটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল সিঁড়ির ওপরে। দেয়ালটা ধসে পড়ার একটু পরেই নিচ থেকে ভেসে এলো একাধিক মানুষের আর্তনাদ। নিশ্চিত ভাঙা দেয়ালের টুকরোয় চাপ পড়ে মরছে দস্যুরা। কিরানের পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে।
কিন্তু কিরান তাতেও খুশি হলো না। ওদের হাত থেকে বাঁচতে হলে আরো ক্ষতি করতে হবে। কোমর থেকে একটানে সে বের করে আনল পিস্তলটা। ওটা দিয়ে গুলি করল কামান আটকে রাখা শিকলটাতে। গুলির আঘাতে সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ছুটে যেতেই কামানটাকে ঠেলতে শুরু করল কিরান। তার সঙ্গে হাত লাগাল আরো দুজনে।
‘সরে যাও, সরে যাও,’ কামানটাকে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে সিঁড়ির গোড়ার কাছে নিয়ে এলো কিরানরা, তারপর ওটাকে ঠেলে ফেলে দিল নিচে
তিন মণি ভারী লোহার তালটা মুহূর্তের জন্য যেন বাতাসে ঝুলে রইল শূন্যের ওপরে তারপর কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো শব্দ করে সেটা গড়িয়ে পড়তে শুরু করল নিচের দিকে। পাথর আর লোহার সংঘর্ষে একদিকে আগুনের ফুলকি ছুটল, সেই সঙ্গে হাড়-মাংস থেঁতলানোর আওয়াজের সঙ্গে তীব্র আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠল জায়গাটার বাতাস।
কিরান উঁকি দিল সিঁড়ির দিকে। পাথুরে সিঁড়ি নরকে পরিণত হয়েছে। একদিকে গোলা, তারপর পাথুরে দেয়াল আর সবশেষে ভারী কামানের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সিলভেরার বাহিনীর একাংশ। টুকরো টুকরো মানবদেহ আর রক্তের ধারায় ভেসে যাচ্ছে সিঁড়ি। কিন্তু সিলভেরা আর তার দলের লোকেরা যেন অদম্য-অপ্রতিরোধ্য। এত মৃত্যু আর ক্ষয়ক্ষতির পরও সিলভেরা ঠিকই একদল লোক নিয়ে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মতো উঠে আসছে ওপরের দিকে।
কোমরে রেখে দেওয়া তলোয়ারটাকে আবারও বের করে এনে অন্যহাতে পিস্তলটা ধরে নিজের লোকদেরকে সারি দিয়ে প্রস্তুত করে ফেলল কিরান। নিজে সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে অস্ত্রহাতে প্রস্তুত দলটাকে সামনে এগোনোর নির্দেশ দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল কিরান। এবার হবে জীবনমরণের আসল লড়াই।
‘সবাই প্রস্তুত…’ কথা শেষ করার আগেই ধুলো আর ধোঁয়ার ভেতরে আচমকাই সিঁড়ির প্রথম ধাপে উদয় হলো দানব সিলভেরা।
কিরান সারি দিয়ে দাঁড়ানো নিজের লোকদেরকে একবার দেখে নিয়েই চিৎকার করে উঠল, ‘শেষ লড়াই,’ বলতেই দুই বাহিনী একে অপরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বর্তমান
হুয়ান গুলি খেয়ে পড়ে যেতেই মুহূর্তেও জন্য সময় যেন থমকে দাঁড়াল। কিন্তু সবার আগে সচকিত হয়ে উঠল শারিয়ার। কারণ সে জানত এরকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
হুয়ান পড়ে যেতেই সে ছোটো একটা লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। হুয়ানকে পড়ে যেতে দেখে তার সঙ্গীরা প্রায় সবাই চমকে উঠেছে। তাদের দেখে শারিয়ারের কাছে মনে হলো হুয়ান দলের ওপরে এমনভাবে কর্তৃত্ব করে যে এরা নির্দেশ নিতে নিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন চাইলেও নিজে থেকে চট করে কিছু করতে পারে না। আর হুয়ান পড়ে যেতেই সেটাই প্রমাণিত হলো।
হুয়ানের সঙ্গীরা এমনভাবে হতচকিত হয়ে গেছে যে, তারা সিদ্ধান্ত নেবার আগেই ঘটে গেল যা ঘটার। শারিয়ার ছোটো একলাফে সামান্য এগিয়ে হুয়ানের এক সঙ্গীর পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল। হুয়ানকে পড়ে যেতে দেখে লোকটা তার দিকে তাকিয়েছিল। শারিয়ার তার পিস্তলটা ধরে ফেলতেই সে দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লোকটার পিস্তল ধরা হাতটা ধরেই মোচড় দিতেই ক্যাক করে একটা শব্দ হয়ে পিস্তলটা খসে গেল তার হাত থেকে। পড়ন্ত পিস্তলটা লুফে নিয়ে শারিয়ার সেটা ছুড়ে দিল ভুবনের দিকে। ‘ভুবন,’ বলেই সে পিস্তলটা ছুড়ে দিয়েই ফিরে তাকাল। হাতে ব্যথা পেলেও দক্ষ লোক সে। মোচড় খাওয়া কবজিটা অন্যহাতে ধরে শারিয়ারকে লাথি মারতে যাচ্ছিল সে। তার আগেই শারিয়ার পা-টা ধরে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিতেই লোকটা ছিটকে গিয়ে বাড়ি খেল তার অপর সঙ্গীর সঙ্গে।
লোকটার অপর সঙ্গী ধরে ছিল টমিকে। বাড়ি খেয়ে সে টমিকে ছেড়ে ফিরে তাকাল শারিয়ারের দিকে। হাতের অস্ত্র শারিয়ারের দিকে তাক করতে যাচ্ছিল তার আগেই শারিয়ারের লাথি খেয়ে অস্ত্র হারাল সে। সেই সঙ্গে সোলার প্লেক্সাসে জোরদার লাথি খেয়ে সরে গেল একপাশে। শারিয়ার মাটিতে লাফ দিল। মাটিতে এক গড়ান দিয়েই লোকটার পড়ে যাওয়া পিস্তলটা তুলে নিয়ে উলটো অবস্থাতেই গুলি করল একজনের পায়ে। অপরজন দুহাত তুলে অত্মসমর্পণ করার জন্য হাত তুলতেই শারিয়ার নিজের অস্ত্র নামিয়ে নিতে শুরু করল কিন্তু এই লোকটাও পড়ে গেল গুলি খেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল হাতে ঘুরে দাঁড়িয়ে শারিয়ার দেখল দুজনে মাটিতে পড়ে আছে। আর বাকি দুজনের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে ভুবন। কিন্তু শারিয়ারের দৃষ্টি সেদিকে নয়। সে তাকিয়ে আছে মাথার ওপরে বন বন করে ঘুরতে থাকা একজোড়া রোটরের দিকে। শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই পাচ্ছিলো সে। কিন্তু এখন হেলিকপ্টারটা মাথার একেবারে ওপরে এসে থেমেছে। শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে একবার ইশারা করল। কিন্তু দুজনের কেউই নড়ে ওঠার আগেই বনবন করে ঘুরতে থাকা চপারটা থেকে নেমে এলো তিন চারজন অস্ত্রধারী। তিনজনই কমান্ডোদের সাজে সজ্জিত। একজনের হাতে দূর পাল্লার রাইফেল।
তিনজনেই নেমে এসে শারিয়ার আর ভুবনকে নিরস্ত্র করে ফেলল। সেই সঙ্গে অজ্ঞান চারজন লোককে টেনে সরিয়ে ফেলল একপাশে। সেই সঙ্গে হাত কড়া পরিয়ে দিল হুয়ান বাকি দুজন মানুষকে।
‘ব্যাপার কী, বস? ঘটছেটা কী?’ ভুবন খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল। কিন্তু শারিয়ার জবাব দেয়ার আগেই ধমকে উঠল কমান্ডোর মতো পোশাক পরা তিনজনের একজন।
‘শান্ত, থাকো, অপেক্ষা করো,’ কথাটা শুধু ভুবন নয় বাকিদেরকেও উদ্দেশ্য করে বলে উঠল শারিয়ার। কথাটা শেষ করতেই সে ভুবনের দিকে ফিরে বিশেষ একটা ইশারা করল। জবাবে ভুবনও মাথা নেড়ে সায় জানাল।
‘এই চুপ থাকতে বললাম না,’ আধাভাঙা বাংলায় কমান্ডোদের একজন ধমকে উঠল। হুয়াঙের দলের অজ্ঞান লোকগুলোকে সরিয়ে বাকিদের হাতকড়া পরিয়ে ওরা শারিয়ারদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর চারপাশটার দিকে ফিরে হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ওকে সাইন দেখাতেই চপারটা নেমে এলো প্রাঙ্গণের একপাশে। সেটা থেকে নেমে এলো হালকা পাতলা একজন মানুষ। তার পেছনে আরেকজন কমান্ডোর মতো পোশাক পরা অস্ত্রধারী।
লোকটা কাছে আসতেই শারিয়ার দেখল হালকা-পাতলা মানুষটা চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ওদের একেবারে সামনে চলে এলো। শারিয়ারের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল সে। তারপর চট্টগ্রামের স্থানীয় টানের বাংলায় বলে উঠল, ‘মিস্টার শারিয়ার, আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। অবশেষে হয়েই গেল,’ বলে সে হেসে উঠল।
শারিয়ার এখনো মানুষটার দিকে হাত বাড়ায়নি। সে মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে। মানুষটা বাঙালি কোনো সন্দেহ নেই, সম্ভবত বৃহত্তর চট্টগ্রামেরই কোথাও তার আদিনিবাস। কিন্তু তার গায়ের রং দেখলে চট করে মনে হয় মানুষটা বিদেশি। শারিয়ার একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। সেটাকে সামান্য নাড়া দিয়ে মানুষটা হেসে উঠল, ‘আমি জানতাম আপনি ম্যান অব ম্যানারস,’ লোকটার বাংলার চেয়ে ইংরেজি অনেক বেশি পরিশীলিত। বলে সে শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘এর আগেরবার আপনার সঙ্গে দেখা হতে হতে হয়নি ডক্টর। অবশ্য তাতে ভালোই হয়েছে,’ বলে সে চারপাশটা দেখাল। ‘আপনি যা করলেন সেটার তো কোনো তুলনা নেই। এই জায়গাটা অনেক কম সময়ে খুঁজে বের করাটা একটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছেন আপনি। অবশ্য এতে আপনাদের পুরো টিমকে ক্রেডিট দিতে চাই আমি।’
‘আপনি কে, বলেন তো?’ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল শশী।
‘আর এভাবে আমাদেরকে বন্দি করে রাখার মানে কী?’ নিজের সামনে দাঁড়ানো কমান্ডোর হাতে ধরা অস্ত্রটাতে ঝাপটা মারল ভুবন।
‘আস্তে আস্তে, মিস্টার ভুবন, আপনার জায়গায় আমি হলে আরেকটু সাবধানে বিহেইভ করতাম। কারণ যদিও এরা ভাড়াটে লোক,’ বলে সে নিজের পাশের কমান্ডোদেরকে দেখাল। কিন্তু এরা সবাই প্রফেশনাল মার্সেনারি। কাজেই একটু সাবধান,’ বলে সে জোরে হেসে উঠল। ‘ওহ মাই গড! আমি কাকে কী বলছি আপনি তো ওদেরই একজন। তাই না?’ বলে সে হাসতে হাসতেই ফিরে তাকাল শশীর দিকে। ‘মাই ডিয়ার লেডি, আমার পরিচয় তাই না?’
‘আমি বলছি,’ হঠাৎ শারিয়ার কথা বলে উঠল। ‘আমি হয়তো উনার নাম জানি না, তবে পরিচয়টা অনুমান করতে পারি। যখন থেকে এই কেসে ইনভলভড হলাম তখন থেকেই অনুধাবন করতে পারছিলাম সাদা চোখে যা দেখছি, আসলে ঘটনা যা ঘটছে পুরোপুরি তা নয় বরং ঘটনার ভেতরে আরো অনেক ঘটনা আছে। বাপের ওপরেও আরো অনেক বাপ আছে,’ বলে শারিয়ার হেসে উঠে মাটিতে পড়ে থাকা হুয়ানকে দেখাল। ‘ও যদি বাপ হয় তবে ইনি হলেন দাদা। ডক্টর আবদেলের পেছনে দুনিয়ার বড়ো বড়ো যেসব প্রতিষ্ঠান লেগেছিল, ইনি তাদেরই একজন। ঠিক কি না?’
‘একদম ঠিক, মিস্টার শারিয়ার। আমি এমন এক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছি যার নাম মুখে নিতে এমনকি আমি নিজেও ভয় পাই। তবে আমাকে সবাই আলট্রা মাস্টার বা ইউ নামে জানে। এই জন্যই আমি বুদ্ধিমান মানুষদেরকে শ্রদ্ধা করি,’ বলেই সে হঠাৎ দ্রুত দুই পা পিছিয়ে গেল। ‘অনেক কথা হয়েছে। এবার কাজে নামতে হবে,’ বলে সে হুয়ানকে দেখাল। ‘যেহেতু বাইরের আবর্জনা পরিষ্কার হয়েছে কাজেই এবার আমরা ভেতরে যাবো,’ বলে সে শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘ডক্টর, আপনি পথ দেখান আমাদের,’ বলে সে দুজন সৈনিককে সামনে পাঠল। তার পেছনে বাকিরা সবাই আর সবার পেছনে আরো একজন। আর বাইরে পাহারায় রইলআরও একজন। সবাই সারি দিয়ে উঠে এলো দুর্গের চাতালের মতো অংশটার ওপরে।
টমিকে নিয়ে শশী চলে এলো সেই নিচে নামার পথটার কাছে। এখান থেকে দুর্গের পেছনের টিলা জঙ্গল আর পেছনের সমুদ্র পরিষ্কার দেখা যায়। ‘এই পথটা আসলে দুর্গের পেছনের দিকে নেমে ভেতরে দিকে প্রবেশ করেছে,’ অস্ফুটে বলে উঠল শশী। যতই ভাবছে সে দুর্গের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করছে তাকে।
‘আফটার ইউ, ডক্টর,’ বলে আলট্রা মাস্টার মানে ইউ শশীকে ইশারা করল নিচে নামার জন্য।
অতীত
চারপাশে তলোয়ারের ঝলকানি আর ছুটন্ত সিসার উদগীরণ করা বারুদের গন্ধ। প্রথম আক্রমণটা হিসেবের মধ্যে থাকলেও একবার দুই পক্ষ মুখোমুখি হতেই পুরো মোকাবেলাটা উন্মত্ত যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। পাগলের মতো চারপাশে নিজের অস্ত্র চালাচ্ছে কিরান। কিন্তু তার দৃষ্টি পড়ে আছে সিলভেরার দিকে। সিলভেরার অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনী আর পদ্মের বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতেই চারপাশ থেকে একে অপরের ওপর স্রেফ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা।
কিরানদের প্রাথমিক আক্রমণে সিলভেরার বাহিনীর দস্যু কমে যাওয়ার পরেও সংখ্যায় তারা অনেক। অন্যদিকে পদ্মের বাহিনীর জন্য এটা স্রেফ হারজিতের লড়াই নয়, বরং জীবনমরণের লড়াই। তাই জান দিয়ে লড়ছে ওরা। যে যেভাবে পারছে প্রাণপণ চেষ্টা করছে লড়াই করার। কিরান পাগলের মতো লড়াই করে চালালেও তার দৃষ্টি আসলে সিলভেরার দিকে। কারণ সিলভেরার বাহিনীর বিরুদ্ধে মূল লড়াইটা পরিচালনা করছে পদ্ম আর তার সহযোগীরা।
কিরানের নজর সিলভেরার দিকে। কারণ সে এটা পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারছে, যে যতই চেষ্টা করুক লড়াইতে ওরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। এই লড়াই আর কিছুক্ষণ চললেই ওদেরকে কোণঠাসা করে ফেলবে সিলভেরার বাহিনী। সাপের দেহ থামাতে হলে এর মাথা কাটতে হবে। খতম করতে হবে সিলভেরাকে।
সামনে আসা এক দস্যুর বুকে তলোয়ার চালিয়ে দিয়ে সেটাকে একটানে বের করে নিল কিরান। তারপর অপর হাতে নিজের কোমর থেকে বের আনল ওর বাবার দেওয়া পিস্তলটা। ‘পদ্ম,’ ওর থেকে বেশ খানিকটা তফাতে লড়তে থাকা পদ্মকে চিৎকার করে ডেকেই সামনের দিকে ইশারা করল কিরান। লড়াইরত সৈন্যদলের ভেতরে সবার মাথা ছাড়িয়ে এক হাত উঁচু হয়ে থাকা সিলভেরার মাথাটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
পদ্মকে ইশারা করেই সেদিকে পা বাড়াল কিরান। কয়েক পা এগোনোর আগেই লোকটার টের পাওয়ার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেল কিরান। কোনো কারণ ছাড়াই সে বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। চট করে এদিকে ফিরে তাকাল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি পড়ে গেল কিরানের ওপরে। কিরান তার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটার দুই চোখে খুশির ঝিলিক। সিলভেরার সামনে চলে আসা এক দস্যুকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল সে। তারপর এগোতে শুরু করল কিরানের দিকে। রাগের হলকা বয়ে গেল কিরানের শরীরে। পা বাড়াতে গিয়েও হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই থেমে গেল সে। আকরাম বেগ একবার তাকে বলেছিল তুমি কী তোমার ‘শত্রুকে বুঝতে পেরেছো? ধরতে পেরেছে তার দুর্বলতা আর তার শক্তি? তুমি কি বুঝতে পেরেছো তাকে?’ কথাটা হঠাৎই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মাথায় আসতেই কিরান থেমে গেল।
এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সে সিলভেরার মুখোমুখি হতে চলেছে। এর আগের দুইবারই সে হেরেছে এই লোকটর কাছে, কারণ কী?
সিলভেরা এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিরানের মনে হলো কোনো মানুষ নয় বরং যেন উন্মত্ত এক ঝড় এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিরান পেছাতে শুরু করল পেছন দিকে। সিলভেরা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কিরান পিছিয়ে যাচ্ছে। লোকটা এবার দৌড়াতে শুরু করল ওর দিকে। সামনে যাকে পাচ্ছে ভেঙেচুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে এগোতে শুরু করেছে।
পেছাতে পেছাতে চট করে থেমে গেল কিরান। ছুটে আসা উন্মত্ত ঝড়টাকে এড়ানোর জন্য লাফিয়ে পড়ল একপাশে। সিলভেরা ভেবেছিল সে ধরে ফেলেছে কিরানকে। কিন্তু হঠাৎ পিছিয়ে সরে পড়াতে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল সে। কিরান থেমে গিয়ে এক গড়ান দিয়েই লোকটার দিকে পিস্তল তুলল। এবার ওর মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। কিন্তু গুলি ছোড়ার জন্য ঘোড়ায় চাপ দিয়েই গলা শুকিয়ে এলো ওর। গুলি বেরুল না। আর্তনাদ করে উঠল কিরান। ওর মনে পড়ে গেল এর আগে একবার গুলি করেছিল সে এটা দিয়ে। এরপরে আর গুলি ভরার সময় পায়নি।
কিরানকে গুলি করতে দেখে মুহূর্তের জন্য থেমে গেছিল সিলভেরা। কিন্তু গুলি বেরুতে না দেখে এক লাফে এগিয়ে এলো। কিরান পেছাতে পেছাতে চলে এসেছে একেবারে কিনারায়। সিলভেরা তলোয়ার তুলতেই কিরানের পেছন থেকে ভেসে এলো আরেক চিৎকার। পেছন থেকে ছুটে আসছে আরেক উন্মত্ত ষাঁড়, গোমেজ।
গোমেজ আর বেদু বারুদের পিপেগুেলোকে ঠেলে ফেলে দিয়েই টিলার নিচ থেকে উঠে আসছিল। প্রাঙ্গণের কাছাকাছি আসতেই কিরানকে সিলভেরার মুখোমুখি দেখে গোমেজ দৌড়ে সোজা গিয়ে পড়ল তার গায়ের ওপরে। সিলভেরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, প্রায় তার সমান সাইজের এত বড়ো একজন মানুষের ধাক্কা সামলাতে পারল না সে। পড়ে গেল সে।
সঙ্গে সঙ্গে নিজের তলোয়ার তুলে নিয়ে সামনে এগুল কিরান। প্রথম আঘাত করল সিলভেরার পায়ে। তীব্র আঘাতে তার শরীরটা বাঁকা হয়ে যেতেই লোকটার গলাটা কেটে দিত পরবর্তী আঘাতে। কিন্তু ওর তলোয়ারটা খালি হাতেই ধরে ফেলল সিলভেরা। পেছন থেকে সিলভেরার ঘাড় চেপে ধরল গোমেজ। আর এক পাশ থেকে তার এক হাত মাটির সঙ্গে ঠেসে ধরল বেদু। নিজের তলোয়ারটাকে সিলভেরার হাত থেকে টেনে বের করে নিল কিরান।
মুহূর্তের জন্য সিলভেরার রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আবারও অবাক হয়ে অনুভব করল লোকটার চোখে না আছে মৃত্যুভয়, না আছে ব্যথা বা অন্য কোনো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। নিজের তলোয়াটাকে সর্বশক্তি দিয়ে সে বসিয়ে দিল সিলভেরার বুকে। কিন্তু সিলভেরার বুকের সঙ্গে আটকানো বর্মের লেগে একপাশে পিছলে গেল ওর তলোয়ার। আবারও আরেক টানে বের করে এনে ওটাকে সিলভেরার গলায় ঢুকিয়ে দিতে যাবে পেছন থেকে মেয়েলি গলায় আর্তনাদ শুনে ফিরে তাকাল কিরান। সঙ্গে সঙ্গে জমে গেল সে।
পদ্মের দলটাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে সিলভেরার বাহিনী। বিশালদেহী এক দস্যু পদ্মকে একহাতে ধরে রেখেছে পুতুলের মতো। অন্যহাতে বিরাট একটা ড্যাগার। চিৎকার করে সিলভেরাকে ছেড়ে দিতে বলল লোকটা, না হলে পদ্মকে মেরে ফেলবে এটাও জানাল। কিরানের তলোয়ার সিলভেরার গলার চামড়ার সঙ্গে প্রায় সেঁটে গেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু হয়ে এলো কিরানের। জিততে জিততে হেরে গেছে ও। হাত থেকে তলোয়ারটাকে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
বেদু আর গোমেজের হাত থেকে ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সিলভেরা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই কিরানের চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো পদ্মের পাশে। তাকে দেয়ালে দিকে ঠেলে ফেলে দিয়েই পদ্মকে ধরে রাখা সেই লোকটার কানে কানে কিছু একটা বলল সিলভেরা।
‘তালেব তৈমুরের রেখে যাওয়া জিনিসগুলোর কাছে নিয়া চলো আমাদের। না হলে এখানে সবাই মরবা,’ নিরুত্তাপ গলায় বলে উঠল লোকটা। সামনে তাকিয়ে কিরান দেখল ওর নিজের লোক থেকে শুরু করে পদ্মের বাহিনীর বেশির ভাগ যোদ্ধাই হয় মৃত নয় আহত কিংবা সিলভেরার লোকদের হাতে বন্দি।
আহত রক্তাক্ত পদ্ম মাটিতে পড়ে যেতেই হাতের ইশারার দেখাল কোন দিকে যেতে হবে ওদেরকে। সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করল সিলভেরার লোকেরা। সবার আগে আগে চলল পদ্ম, আর সবার পেছনে আসছে সিলভেরা। ওরা দুর্গের ওপর দিকে উঠে এসে পেছনের পথ দিয়ে নামতে শুরু করল।
বর্তমান
দুর্গের পেছনের দিকের সেই বিশেষ জায়গার প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে নামছে শশী, ওর ঠিক পেছনেই টমি, তার পেছনে বাকিরা। নামতে নামতে দুর্গের গঠনশৈলীটা অনুভব করে আরেকবার অবাক হলো শশী। ওরা যেখানে আছে সেদিকটা দুর্গের ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে। কিন্তু সেই হিসেবে জায়গাটা একেবারেই আঠালো আর স্যাঁতসেঁতে নয় বরং বলা চলে বেশ পরিষ্কার আর কোনো ধরনের ভ্যাপসা ভাবও নেই।
‘এখানে কেউ একজন এসেছিল,’ ওরা নামতে নামতে পেছন থেকে সেই লোকটা বলে উঠল যে একটু আগে নিজেকে মিস্টার ইউ নামে পরিচয় দিয়েছে। ‘আর যে মানুষটা নেমেছে এখানে সেটা ডক্টর আবদেল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমি এখনো অবাক হই এই লোকটা আসলে কী দিয়ে তৈরি ছিল। আমাদের মতো ঘাগু লোকদের সে যেভাবে ঘোল খাইয়ে দিয়েছে সেটা অদ্ভুতই বটে। আর সে যা আবিষ্কার করেছে সেটার কথা আর নাই বা বলি,’ বলে সে হাসতে লাগল।
ওরা প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একেবারে খোলা ময়দানের মতো একটা জায়গায় চলে এলো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জায়গাটার দিকে। এটা সম্ভবত পাহাড়ের ওপরে দুর্গের মূল অংশের একেবারে নিচে। কিন্তু সেটা বিষয় নয়, বিষয় যেটা-সেটা হলো জায়গাটা বিশাল এবং একপাশে একেবারেই খোলা জানালার মতো ফোকর দিয়ে আরো আসছে। সেদিক দিয়ে এমনকি সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
‘বাহ, অদ্ভুত সুন্দর তো জায়গাটা,’ মিস্টার ইউ কথাটা একেবারে ভুল নয়। জায়গাটা বিস্ময়করই বটে। একদিকে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অসাধারণ নিদর্শন তার ওপরে আবার গোল কামরাটাকে ঘিরে আছে নানা ধরনের প্রাচীন মূর্তি। লাল পাথর দিয়ে তৈরি মেঝে থেকে শুরু করে একেবারে ছাদ পর্যন্ত জায়গাটাতে বাইরে থেকে আলো আসছে। সেই আলোর প্রভাবে চারপাশ তো বটেই, এমনকি ভেতরেও অনেকটা জায়গাতেই সুন্দর আলোকিত হয়ে উঠেছে। ‘অদ্ভুত,’ লোকটা কথা বললেও সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চারপাশের অতিপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে।
সবাই যখন হাঁ করে চারপাশে তাকিয়ে আছে, ভুবন এগিয়ে এসে চট করে শারিয়ারের হাতে কিছু একটা গুঁজে দিতেই শারিয়ার সেটা রেখে দিল পকেটে। প্রায় চোখে পড়ে না এমনভাবে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।
‘অদ্ভুত সুন্দরই বটে,’ এবার বলে উঠল শশী। সেও বাকিদের মতোই মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ‘এমন জায়গায় এরকম কিছু থাকতে পারে ভাবাই যায় না। আমার কাছে এখন মনে হচ্ছে ওপরের দুর্গটাতে যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটার বেশিরভাগই পুরনো কোনো যুদ্ধের ফলে। ভেতরটা আরো অনেক বেশ সুরক্ষিত রয়ে গেছে।
‘ইয়েস ডক্টর, আমরা যা খুঁজতে এসেছি সেটা খুঁজে বের করুন এখন। আপনার ম্যাপ বা অন্য কিছু, কী বলে?’ মিস্টার ইউ ভ্রু নাচিয়ে জানতে চেয়ে আবারও বলে উঠল
‘এবার আর ম্যাপে খুঁজতে হবে না, শশী কিছু বলার আগেই পেছন থেকে শারিয়ার বলে উঠল। ওই যে ওদিকে মনে হয় কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি আমরা, বলে সে গোলমতো গুহার বিরাট কামরাটার একদিকে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ফিরে তাকাল সেদিকে।
সবাই অবাক হয়ে এবার খেয়াল করল ওরা এতক্ষণ যা দেখেছে সেটার তুলনায় শারিয়ার যেদিকে দেখিয়েছে সেদিকে যা দেখা যাচ্ছে সেটার কোনো তুলনা নেই।
বিরাট একট নারী মূর্তি। আসলে মূর্তি না বলে বলা উচিত বিরাট একটা দেবি মূর্তি। বক্রদেহের নারী মূর্তিটা সর্পিল আকৃতি নিয়ে মেঝে থেকে উঠে গেছে ওপরের দিকে। নারী মূর্তিটার দেহের প্রতিটি বাঁক নির্মাণ করা হয়েছে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে। জিনিসটা কবে বানানো হয়েছে সেটার কোনো ঠিক নেই। খালি চোখে দেখে দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত চার-পাঁচশ বছর আগে যে বানানো হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো ওটার সৌন্দর্য অপরিসীম।
‘এটা কোনো ধর্মের দেবী?’ কেউ একজন ফিসফিস করে বলে উঠল
‘এটা কোনো ধর্মের দেবী নয়,’ শশী অনেকটা আনমনেই বলে উঠল। ‘এটা লিলিথের মূর্তি। লিলিথ হলো সৃষ্টির আদি থেকে চলে আসা সবচেয়ে শক্তিশালী অপদেবীদের একজন। খুব সম্ভবত এই দুর্গ যারা নির্মাণ করেছিল তারা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের নয় বরং এই অপদেবীর পুজো করত। আর তাতেই—’
‘আমি কাজের কথা বলতে চাই ডক্টর আবদেলের আবিষ্কার কোথায়?’ মিস্টার ইউকে প্রশ্নটা করার সময়ে খানিকটা অসহিষ্ণু মনে হলো।
‘ডক্টর আবদেল যদি কিছু এখান রেখে থাকে বা আবিষ্কার করে থাকে, শশী পায়ের কাছে থাকা বিরাট আকারের পাথরের বেদির দিকে নির্দেশ করল সঙ্গে সঙ্গে লোকটা এগিয়ে গেল ওটার দিকে। ‘এটা একটা পাথরের সিন্দুক,’ একজন মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল। কিন্তু এটা কী?’ লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেদিকে দৌড়ে গেল শশী। পাথরের বেদি আকৃতির সিন্দুকটার ওপরের অংশটা দেখলেই বোঝা যায় এটা একটা সিন্দুকের উপরিভাগ। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল সিন্দুকটার দুটো ডালাতে লোহার রিং বসানো হয়েছে, সেই সঙ্গে ওটাতে লাগানো হয়েছে স্টিলের আধুনিক তালা। ‘ডক্টর আবদেল,’ ফিসফিস করে বলে উঠল শশী। ‘অবশেষে তার আবিষ্কার খুঁজে পেয়েছি আমরা।’
অতীত
সিলভেরার লোকের অত্যন্ত নির্মমভাবে টানতে টানতে প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে নামাল। বিশেষ করে পদ্মকে টানতে টানতে নামানো হলেও কিরানকে রীতিমতো লাথি মারতে মারতে স্রেফ নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া হলো।
সিঁড়ি বেয়ে কোনোমতে নেমে এসে কিরান পাথুরে মেঝেতে শুয়ে হাঁপাতে লাগল। কিন্তু সে চোখ তুলে অবাক হয়ে দেখল ওরা একটা বিরাট আকারের পাথুরে গুহার মতো জায়গায় চলে এসেছে। এটা নিশ্চয়ই দুর্গের একেবারে ভেতরের দিকের নিচের অংশে হবে। দুর্গের বাইরের অংশের সঙ্গে এখানকার কোনো মিলই নেই।
এখানকার ভেতরটা একেবারে অন্যরকম। কিরান ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেল না। কিছু করার আগেই তাকে টেনে আবার দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। কিরান পেছন ফিরে দেখল, ওর পেছন পেছন গোমেজ আর বেদুকেও নামানো হয়েছে একইভাবে। কিরান সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ওকে ঠেলা দেওয়া হলো সামনের দিকে এগুনোর জন্য। কিরান আবছাভাবে দেখল দুর্গের দেয়ালের সঙ্গে বসানো সারি সারি মূর্তির ভেতর দিয়ে ঠেলে নেওয়া হলো ওদেরকে সামনের দিকে।
ওরা বিরাট গোলাকার কামরাটার একপ্রান্তের দিকে এগিয়ে যেতেই কিরান দেখতে পেল কামরাটার একদিকে বিরাট একটা মূর্তি। সেই মূর্তির পায়ের কাছে একটা বিরাট বেদির মতো। সেটার সামনে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেওয়া হলো ওদের দুজনকে। কিরান দেখল ওদের দুজনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সিলভেরা। এক হাতে মদের বোতল আর অন্যহাতে একটা ধূম্রশলাকা।
ইশারায় সামনের বেদির কাছে বিরাট সিন্দুকের মতো পাথরের পায়াটা দেখিয়ে দিতেই সিলভেরার লোকেদের ভেতরে দুজনে মিলে ওটার ওপরের অংশ সরিয়ে ফেলল। কিরান আবছাভাবে দেখতে পেল ওটার ভেতরে সারি দিয়ে রাখা বেশ কিছু পিপে। একে একে পিপেগুলো বাইরে বের করে আনা হলো। কিরান অনুমান করল ওগুলোর ভেতরেই ওর বাপুর নিয়ে আসা শাহ সুজার সব সম্পদ গচ্ছিত আছে। পিপেগুলো একে একে বের করে আনা হচ্ছে কিরান দেখল ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পদ্ম। বেঁধে রাখা একটা হাত সে আলগা করে ফেলেছে লোকগুলোর ব্যস্ততার সুযোগে। কিরান ওর দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় সে সামনের দিকে দেখাল। সেই সঙ্গে ছোটো ছুরির মতো কিছু একটা ছুঁড়ে দিল ওর পায়ের কাছে। জিনিসটা তুলে নিয়েই পেছনে লুকিয়ে ফেলল কিরান।
সে ইশারায় বেদু আর গোমেজকেও বুঝিয়ে দিল কিছু একটা করতে যাচ্ছে সে। ছোটো ছুরিটা দিয়ে হাতের বাঁধন কেটে ফেলে বেদুর দিকে ছুঁড়ে মারল ওটা। সিলভেরার লোকেরা পিপেগুলো নামানো শুরু করতেই কিরান দেখল হাতের বোতলটা একপাশে ছুড়ে ফেলে সিলভেরা এগিয়ে গেল পিপেটার দিকে।
আহত ঘোলাটে চোখ আর রক্তাক্ত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে পদ্ম। কিরান বুঝে গেল সময় উপস্থিত। সে একবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো ইশারা করে পেছন ফিরবে তার আগেই সামনে থেকে সিলভেরার চিৎকার শুনে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল সামনের দিকে।
সিলভেরার সামনে থাকা পিপেটা ভেঙে পড়েছে। সেটার ভেতরে মাটি আর পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। সিলভেরা কুঠার হাতে উন্মাদের মতো একের পর এক পিপেতে কোপ মারতে লাগল আর একটার পর এটা পিপে ভেঙে পড়তে লাগল। সবগুলোতেই পাথর আর মাটি ছাড়া কিছুই নেই।
পদ্ম পাথর আর মাটিতে ভরা পিপেগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে সে ফিরে তাকাল কিরানের দিকে। ‘এক্ষণ জাহাজি,’ শান্ত সুরে বলে উঠল সে।
কথাটা বলতেই কিরান খোলা হাত দুটো দিয়ে সামনে থাকা লোকটার হাতের অস্ত্রটার একপ্রান্ত ধরে ফেলে টান দিয়ে সেটাকে ছুটিয়ে নিয়ে বসা অবস্থাতেই ঢুকিয়ে দিল লোকটার পেটের ভেতরে। লোকটা জানপ্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই টান দিয়ে বের করে এনেই আরেকজনের দিকে তাক করল কিরান। কিন্তু তাকে আঘাত করার আগেই পাশ থেকে অপর দস্যুর আঘাতে সে বসে পড়ল মাটিতে। লোকটা আবারও ওকে আঘাত করার আগেই সে তীব্র আঘাতে পড়ে গেল মাটিতে। কিছু একটা ছুটে এসে বিঁধেছে লোকটার বুকে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল লোকটা। আর ফিরে তাকাল কিরান। বেদু, গোমেজ আর পদ্ম তিনজনই উঠে দাঁড়িয়ে যার যার পাশের জনকে আঘাত করেছে।
কিরান টান দিয়ে একটা বর্শা তুলে নিল মাটি থেকে। পিপেগুলোতে কিছু না পেয়ে পাগলের মতো একটার পর একটা পিপে ভেঙে চলেছে সিলভেরা। সেদিকে ফিরে কিরান বশাটা সিলভেরার বুকে তাক করে ছুঁড়ে মারবে এমন সময় সিঁড়ির দিকে থেকে ভেসে আসা হই-হট্টগোলে ফিরে তাকাল সবাই। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সেদিক থেকে হট্টগোল ভেসে আসছিল কিন্তু কিরান ফিরে তাকাবার সময় পায়নি। এবার ফিরে তাকিয়ে দেখল একদল লোক ছুটে আসছে সেদিক থেকে। ওদিকটা পরে সামলানো যাবে আগে সিলভেরাকে শেষ করতে হবে।
বর্শাটাকে হাতে নিয়ে আবারও ফিরে তাকাবে, কিন্তু তার আগেই তীব্র আঘাতের চোটে বেশ অনেকটা পিছিয়ে গেল কিরান। দেখল সিলভেরার লাথি খেয়ে বেদু ছিটকে এসে পড়েছে ওর ওপরে। বর্শাটা হাতে নিয়ে সোজা হলো কিরান। এবার আর পেছানোর উপায় নেই। উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে সিলভেরা ছুটে আসছে ওর দিকে। বর্শাটাকে ঠিকমতো তাক করে সেটাকে ছুটন্ত সিলভেরার দিকে ছুড়ে মারল কিরান। কিন্তু লোকটার ক্ষিপ্রতা অপরিসীম। দৌড়াতে দৌড়াতেই স্রেফ একপাশে সরে গিয়ে ওটাকে পাশ কাটাল সে। সিলভেরার পেছনে তার একজনের গায়ে লাগল সেটা। কিরান লাফিয়ে পিছিয়ে এলো খানিকটা। সিলভেরা প্রায় চলে এসেছে। আগে বাগিয়ে ধরে রেখেছে নিজের বিরাট তরবারিটা। সেটা দিয়ে আঘাত করা মাত্রই নিজের দেহটা একপাশে ছেড়ে দিল কিরান। তরবারিটা মাথার ওপরে সাঁই সাই করে পার হয়ে গেল।
মাটিতে পড়েই গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিরান। হাতে তুলে এনেছে একটা পিস্তল। আবারও সিলভেরার দিকে তাক করে গুলি করে দিল। কিন্তু চিতার ক্ষিপ্রতায় লোকটা সরে গেল একপাশে আরেক দস্যু আহত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পিস্তলটাকে সিলভেরার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খালি হাতেই উঠে দাঁড়াল কিরান। সিলভেরা সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করল তরবারি দিয়ে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে লোকটার গাছের গুঁড়ির মতো মোটা কবজিটা ধরে ফেলল কিরান। সঙ্গে সঙ্গে চওড়া কপাল দিয়ে কিরানের নাকের ওপরে আঘাত করল সে। কোনোমতে মুখটাকে পাশ কাটালেও আঘাতটা এড়াতে পারল না কিরান। পড়ে গেল মাটিতে।
মাটিতে পড়েই সে পেছাতে শুরু করল। একহাতে নিজের বিরাট তরবারিটা আর অন্যহাতে একটা বর্শা নিয়ে এগোতে লাগল সে মাটিতে পড়ে থাকা কিরানের দিকে। কিরানের মনে হলো শেষ সময় সম্ভবত উপস্থিত। কিন্তু বিনা যুদ্ধে সে প্রাণ দেবে না। আড়চোখে একবার সে ফিরে তাকাল সিলভেরার লোকদের সঙ্গে লড়তে থাকা বেদু, গোমেজ আর পদ্মের দিকে।
আনমনেই দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নেমে এলো ওর চোখ থেকে। সব শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। খুব বেশি হলে আর অল্প কিছুক্ষণ টিকতে পারবে ওরা। দৃষ্টি ফিরিয়ে সিলভেরার দিকে ফিরে তাকাল সে। পানির ভেতরে হাত পা নাড়লে যেমন গতি ধীর হয়ে যায় অনেকটা সেরকম গতিতে যেন সিলভেরার তলোয়ার আর বর্ষা ধরা হাতটা নেমে আসবে ওর দিকে। মাটি থেকে দু-মুঠো ধুলো তুলে নিল সে।
নিজের প্রতিরোধ দেখে নিজেই হেসে ফেলত কিরান। সিলভেরার ভয়ংকর আঘাত ফেরোনোর জন্য হাত উঠিয়ে দুমুঠো ধুলো তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। বাজ পড়ার মতো শব্দের সঙ্গে সে অনুভব করল সম্ভবত সে মারা গেছে। কিন্তু ধুলো কাটতেই চোখ খুলে সে অবাক হয়ে গেল।
সিলভেরার বর্ম লাগানো বুকের কাছের পোশাক পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গেছে। অত্যন্ত অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিরান শোয়া অবস্থাতেই পেছাতে শুরু করল। পিছিয়ে একজন মানুষের পায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখল আপাদমস্তক কালো পোশাক পরা ওর নিজের জাহাজের সেই পতিত লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে বিরাট একটা পিস্তল, সেটা থেকে ধোঁয়া বেরুেচ্ছে। সিলভেরাকে এই লোকটাই গুলি করেছে। মুহূর্তের জন্য বাস্তব আর কল্পনাকে সে আলাদা করতে পারল না। তার মনে হলো বাস্তবে নয় বরং লোকটাকে কল্পনাতে দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু লোকটার পেছনে পট্টবর্ধনসহ পরিচিত আরো অনেককেই দেখতে পেল। এরা ওর পালিয়ে যাওয়া সেই দ্বিতীয় জাহাজের লোকজন। সঙ্গে পদ্মের দলেরও অনেকেই আছে, যারা একটু আগে দুর্গের ওপরের দিকে সিলভেরার লোকদের হাতে বন্দি ছিল।
কিরান যে মুহূর্তে বুঝতে পারল এরা তার কল্পনা নয় বরং সত্য। সঙ্গে সঙ্গে সে দৃষ্টি সরিয়ে পতিত লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা গুলি করেই নিজের শক্তিশালী দুই হাতে ধরে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। কিরান এই প্রথমবারে মতো লোকটার চোখের দিকে তাকাল। অত্যন্ত পরিচিত চোখজোড়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। কিরানকে সোজা করে তুলে ধরেই মানুষটা মুখের ওপর থেকে আবরণ সরিয়ে ফেলল। মানুষটার চেহারার দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল সে।
‘বাপু,’ কথাটা সে বলল নাকি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারল না কিরান। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল তালেব তৈমূর।
বর্তমান
পাথরের ডালার ওপরে আংটায় বসানো স্টিলের তালাটা দেখে সামান্য হেসে উঠল মিস্টার ইউ নামের লোকটা। নিজের একজন কমান্ডোর দিকে তাকিয়ে সে ইশারা করল তালাটাকে গুলি করে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে সাবধান করে দিল যেন ভেতরের জিনিসের কোনো ক্ষতি না হয়।
কমান্ডো লোকটা তালাটার দিকে নিজের সাবমেশিনগান তুলতেই শারিয়ার তাকে থামতে বলল। ‘এক মিনিট আমার একটা কথা আছে,’ শারিয়ার এক হাত তুলে বলে উঠল। ‘প্লিজ।’
‘বলুন মিস্টার শারিয়ার,’ ইউ নামের লোকটা শারিয়ারের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘কী এমন জরুরি বিষয় আপনার বলার আছে?’
সবাই তাকিয়ে আছে শারিয়ারের দিকে। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শারিয়ার মৃদু হেসে উঠল। ‘ইয়ে, মানে একটা ব্যাপার জানার ছিল আমার। আপনি আমাদেরকে এখানে খুঁজে বের করলেন কীভাবে?’
‘এই মুহূর্তে এটা জানাটা এতটা জরুরি হয়ে পড়ল কেন?’ লোকটা বেশ অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়েছে শারিয়ারের দিকে। ‘দেখুন মিস্টার শারিয়ার, আপনি উলটো- পালটা প্রশ্ন করে আমাদের নজর অন্যদিকে সরানোর…’
‘ব্যাপারটা মেটেই তা না। বরং আমি এখানে যা ঘটছে সেদিকেই নজর দিতে বলছি,’ শারিয়ার হাঁটু গেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘আমরা এখানে এসেছি একেবারে ক্লিন অবস্থায়। তারপরও হুয়ান আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে কারণ সে সুমনের স্ত্রীকে জিম্মি করেছিল, শারিয়ার পলকের জন্য সুমনের দিকে দেখিয়ে আবার ফিরে তাকাল। সুমনকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে আবারও। ‘হুয়ান আপনার কাছে ধরা খেয়ে গেছে সেটা তার বোকামি ছিল কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম হুয়ান ছাড়া কেউ একজন আমাদের ট্র্যাক করছে, যদিও টেরটা পেয়েছি এমন সময় যখন আর কিছু করার ছিল না আমার। যাই হোক। তার মানে আমাদের ধরার জন্য হুয়ানের যেমন ডেফিনিট সোর্স ছিল আপনাদেরও ছিল। কী সেটা?’ শারিয়ার এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। একেবারে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে সে।
‘তাতে কী হয়েছে?’ লোকটা নিজের কোমর থেকে ছোটো একটা পিস্তল বের করে শারিয়ারের কপালে চেপে ধরল। ‘আমরা যেভাবেই আসি বর্তমানে সব আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আপনারা আমার বন্দি। আর কিছুক্ষণের ভেতরেই ডক্টর আবদেলের পাওয়া জিনিস উদ্ধার করে সরে পড়ব আমরা। কীভাবে কী হয়েছে সেটা জেনে লাভটা কী হবে?’
‘যে ডেফিনিট সোর্সের কথা বলছি সেটা সম্ভবত ডক্টর শশী নিজে তাই না?’ বলে সে ফিরে তাকাল শশীর দিকে। খুবই অবাক হয়ে শশী তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
‘মানে কী বলছো তুমি?’ অবাক হয়েই সে প্রশ্ন করল।
মনেটা হলো তুমি বন্দি ছিলে এদের হাতে আর এরা সম্ভবত তোমার শরীরে কোনো এক ধরনের ন্যানো ট্র্যাকার পুশ করেছিল। আর তাতে তোমার পুরো শরীরটাই একটা জীবন্ত ট্র্যাকারে পরিণত হয়েছে। মানে সেই ডক ইয়ার্ড থেকে তোমাকে আসলে আমরা উদ্ধার করিনি। তুমি ওদের আয়ত্তের ভেতরেই ছিলে।’
সবাই তাকিয়ে আছে শশীর দিকে।
‘আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, মিস্টার শারিয়ার,’ বলে লোকটা হেসে উঠল।
‘আপনি যতটা ভাবছেন আমি তার চেয়ে সম্ভবত একটু বেশিই বুদ্ধিমান,’ বলে শারিয়ার হেসে উঠল। নিজের একটা হাত তুলে সে হুডির হাতাটা টেনে নামিয়ে ফেলল নিচের দিকে। ‘হাতের যে জায়গাটাতে একটা ছোট্ট দাগ দেখিয়ে বলে উঠল। ‘এটা কী জানেন?’ সে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। ‘মিশনে নামার আগেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন টেকনো এক্সপার্ট ঠিক ওরকমই ন্যানো ট্র্যাকার সেট করেছিল আমার শরীরেও। মানে মিশনে থাকা অবস্থায় আমি কোথায় যাচ্ছি কী করছি চাইলেই সব জানতে পারবে আমার অফিস,’ বলে সে থেমে গেছে। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘সেক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে। যদি আমার শরীরে ট্যাকারই বসানো থেকে থাকে তবে আমি অফিসের সঙ্গে যে বেইমানি করলাম সেটার মানে কী। কারণ তারা তো চাইলে দু মিনিটেই বের করে ফেলতে পারত আমি কোথায়। তবে আমি এমনটা করলাম কেন?’ বলে সে হেসে উঠল।
মিস্টার ইউ তো বটেই শারিয়ারের নিজের লোকেরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শারিয়ারের দিকে। তার দৃষ্টি এসে স্থির হলো ভুবনের ওপরে। ‘কী ভুবন, কেন করলাম?’
শারিয়ারে কথা শুনে মৃদু হেসে উঠল ভুবন, ‘কারণ সবাই যতটুকু ভাবে তুমি তার চেয়ে বুদ্ধিমান,’ কথাটা বলেই সে বসা থেকেই চট করে পাথুরে মেঝেতে দুটো স্মোক বল ছুড়ে মারল।
একই সময়ে একই কাজ করল শারিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। উপস্থিত প্রায় সবাই একসঙ্গে কাশতে শুরু করল।
অতীত
কালো পোশাক পরা মানুষটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল তাকে। তারপর দুজনে মিলে ঘুরে তাকাল সিলভেরার দিকে। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ওদের পেছনে থাকা বাহিনীর দিকে।
কিরান ব্যাপার দেখে সে ঠিকই চিনতে পারল। মুখ দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, ‘তালেব তৈমূর,’ বলে সে হা হা করে হেসে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে পর্তুগিজ ভাষায় কিছু বলে উঠে সে একাই এগিয়ে এলো ওদের দুজনার দিকে।
নিজের লোকদেরকে সিলভেলার বাকি দস্যুদের প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়েই কিরানকে একপাশে সরিয়ে ওর বাবা এগিয়ে গেল সিলভেরার দিকে। হাতের খালি হওয়া পিস্তলটা ছুড়ে মারল তার বুকে। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও পরমুহূর্তে আবারও পূর্ণ বেগে এগিয়ে এলো সিলভেরা। খানিকটা এগিয়েই হাতের তলোয়ারটা চালাল তালেব তৈমূরের দিকে। কিরানকে সরিয়ে একহাতে নিজের তলোয়ারটা বের করেই সে আঘাতটা ঠেকিয়ে পালটা আঘাত হানল তৈমূর।
কিরান পাশে সরে এলেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছুটন্ত এক যোদ্ধার হাত থেকে নিয়ে নিল একটা লাঠি। সেটাকে দুপাক ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ওর বাপুর পাশে। ওদের পেছনে সিলভেরার লোকেরা আর তার দলের বাকিদের ভেতরে সংষর্ষ শুরু হয়ে গেছে। আর এদিকে কিরান আর তৈমূর দুজনে মিলে আক্রমণ চালাল সিলভেরাকে।
দুজনে মিলে আক্রমণ চালাতেই যেকোনো দক্ষ যোদ্ধার মতোই সিলভেরা একপাশে সরে গেল। তারপর একদিক থেকে আক্রমণ চালাল। তৈমূরের আঘাতটা ঠেকিয়েই সে তলোয়ারের কিনারা দিয়ে বাড়ি মারল কিরানকে। কিরান সেই আঘাতটা ঠেকিয়ে দিয়েই লাঠি চালাল সিলভেরার মাথা লক্ষ্য করে। সিলভেরা আঘাত ঠেকানোর জন্য একপাশে জানালাগুলোর দিকে সরে গেল।
কিরান আর তৈমূর দুজনে এবার একসঙ্গে দুদিক থেকে আবারও আক্রমণ চালাল। দুজনেই এবার একসঙ্গে একদিকে। কিরান লাঠি দিয়ে বাড়ি মারল লোকটাকে। সেই সঙ্গে তার বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করল তৈমূর। শক্ত আঘাতে তার বুকের বর্মটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গেল, ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সিলভেরা।
‘কিরান,’ বলে সে নিজের দুই হাত নিচু করে পেতে ধরল। কিরান নিজের হাতের ভাঙা লাঠিটা বর্শার মতো তাক করে লাফিয়ে বাপুর হাতে উঠে এলো। তারপর কোনাকুনি আঘাতে লাঠিটা নামিয়ে আনল সিলভেরার কাঁধের ওপরে। শক্ত লাঠির চোখা অংশটা বসে গেল সিলভেরার কাঁধের একপাশে। গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল দস্যু সর্দার। তার শরীর একপাশে হেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের একদিকে নিজে হাতের তলোয়ারটাকে ঢুকিয়ে দিল তালেব তৈমূর। এত আঘাতেও পড়ে গেল না লোকটা।
খোলা জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে উন্মাদের মতো হাসতে লাগল। তার দিকে এগিয়ে কিরান লাথি মারল। কিন্তু কিরানের পা ধরে ফেলল লোকটা। তারপর কিরানকে টেনে ধরল নিজের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কিরানকে নিজের সামনে নিয়ে এলো এক হাতে ধরেই। এক হাতে কিরানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের একপাশ থেকে টেনে বের করে আনল বিঁধে থাকা তলোয়ারটা। সেটা কিরানের বুকে বসিয়ে দিতে যাবে ওদের দিকে ঝড়ের মতো ছুটে এলো তালেব তৈমূর। কিরানকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে সিলভেরাকে জড়িয়ে ধরল সে। সিলভেরার হাতে ধরা তলোয়ারটা আবারও তার বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে ঠেলে দিল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। কিন্তু সিলভেরাকে ঠেলে দেয়ার আগেই সে একহাতে ধরে ফেলল তালেব তৈমূরকে। তাকে জড়িয়ে ধরে দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেল খোলা জানালার অন্যপাশে।
‘বাপু,’ বলে চিৎকর করে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল কিরান। ততক্ষণে নিচে হারিয়ে গেছে সিলভেরা আর তালেব তৈমূর দুজনেই।
বর্তমান
ভুবন আর শারিয়ার ঝাঁঝাল বলগুলা এমনভাবে ছুড়ে দিয়েছে যে ওগুলো পাথুরে মাটিতে পড়ে ফাটার সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করল উপস্থিত সবাই। রীতিমতো কমান্ডোর পোশাকে সজ্জিত লোকগুলো থেকে শুরু করে ভুবন আর শারিয়ার, যারা ওগুলো ছুড়েছে তারা পর্যন্ত কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তবে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখাতে খানিকটা হলেও নিরাপদ থাকতে পারল শারিয়ার আর ভুবন।
দুজনের ভেতরে শারিয়ারই আগে সচেতন হয়ে উঠল। সে ঠিক তার পাশেই কাশতে থাকা লোকটার হাতের উজিটা চেপে ধরেই লোকটার হাঁটুর পাশে লাথি মারল। এমনিতেই কাশতে কাশতে তার অবস্থা কাহিল হয়ে ছিল। হাঁটুর পাশে বাড়ি খেয়ে লোকটা উলটে পড়ে গেল মেঝেতে। লোকটার কবজিটা চলে এলো শরিয়ারের হাতে। জিনিসটা হাতে নিয়েই মিস্টার ইউ-এর দিকে তাক করবে তার আগেই শক্ত একটা বাড়ি খেয়ে তার হাত থেকে ছুটে গেল জিনিসটা। সোজা হওয়ার আগেই দেখল মিস্টার ইউয়ের অপর লোকটা তার দিকে নিজর হাতের অস্ত্র তাক করছে। শারিয়ার মুহূর্তের ভেতরে নিজেকে বাঁচাতে সে লাফ দিল। যে অস্ত্র ধরে আছে তার দিকে নয় বরং সে সোজা লাফ দিল মিস্টার ইউয়ের দিকে।
কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে আসা লোকটাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সে। ফলে ভাড়াটে কমান্ডোরাও গুলি করতে গিয়ে থেমে গেল। লোকটাকে জাপটে ধরে তার কোমরে হাত দিয়ে পিস্তলটা বের করে ইউকে নিজের সামনে চেপে ধরে সোজা হলো। লোকটার মাথার পাশে চেপে ধরে রেখেছে মিস্টার ইউয়ের পিস্তলটা। সবাই যার যার অস্ত্র ফেলে দাও।’
যার যার বলতে আর তেমন কেউই নেই। একজনকে শারিয়ার সামলেছে। অন্যজনকে ভুবন, বাকি লোকটা গুলি করেই সে টেনে ধরেছে টমিকে। ফলে শারিয়ার যখন সোজা হলো মিস্টার ইউয়ের মাথার পাশে পিস্তল ঠেকিয়ে ও লোকটাও সোজা হলো টমির মাথার পাশে পিস্তল চেপে ধরে।
‘একদম শান্ত, কোনো কারণ নেই কারো ক্ষতি করার.,’ বলে শারিয়ার মিস্টার ইউয়ের মাথার পাশে পিস্তল চেপে ধরেই বলে উঠল, ‘আপনার লোককে নির্দেশ দিন ওকে ছেড়ে দিতে, না হলে…’
শারিয়ারকে অবাক করে দিয়ে মিস্টার ইউ হা-হা করে হেসে উঠল। ‘না হলে কী, মিস্টার শারিয়ার? বলে সে জোরে হেসে উঠল। ‘না আপনি আমাকে গুলি করতে পারবেন। না আমার লোকেরা আপনার মানুষটাকে ছেড়ে দেবে।
শারিয়ার দ্বিধা করছে। ভুবনকেও মনে হচ্ছে দ্বিধাগ্রস্ত। শারিয়ার কিছু বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু তার আগেই টমিকে ধরে থাকা লোকটা গুলি খেয়ে পড়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে ফিরে তাকাতেই পেছনে সিঁড়ির কাছে দেখা গেল একদল লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। গুলিটা সেই করেছে। মিস্টার ইউকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সেদিকে দুই পা এগিয়ে গেল শারিয়ার।
নিজের পুরো বাহিনী নিয়ে চলে এসেছে রুম্পা তালুকদার। ওদের দিকে এগিয়ে এসে সে জানতে চাইল, ‘তোমরা সবাই ঠিক আছ?’
শারিয়ার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ‘আগের সবকিছুর জন্য আমি সরি,’ বলে সে রুম্পার দিকে তকিয়ে বাকিদের দিকে ইশারা করে বলে উঠল, ‘আর বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ।’
‘তুমি যা করেছ সেই শাস্তি তোমার পরে হবে, ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল রুম্পা। ‘আসলে তোমার ধন্যবাদ জানানো উচিত তোমার বস মিস্টার হাবিব আনোয়ার পাশা স্যারকে, সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তোমার বন্ধু তানভীরের ওপরে। আপনার অবস্থা অনেক অনেক বেশি কাহিল হতো এখন, যদি মিস্টার তানভীর তোমার বস হাবিব আনোয়ার পাশাকে পুরো ব্যাপারটা না বোঝাত। আর হাবিব স্যার আমাদেরকে। যাকগে,’ হাতের পিস্তলটা কোমরে রেখে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল সে। ‘তা এত কিছু করে কী পেলাম আমরা?’
মিস্টার আলট্রা ওরফে মিস্টার ইউ,’ বলে শারিয়ার মাটিতে আধবসা অবস্থায় থাকা মিস্টার ইউকে পেয়েছি আমরা। যাকে ইন্টারপোল গত দশ বছর ধরে খুঁজছে। আমার বিশ্বাস নেক্রপলিস নামে যে সংগঠন বাংলাদেশে গোপনে ফাংশন করার চেষ্টা করছে তার সাউথ এশিয়ান জোনের প্রধান এই লোক। আর,’’ বলে সে শশীকে দেখিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই দৌড়ে গিয়ে সেই লিলিথের মূর্তির পায়ের কাছে পাথরের সিন্দুকটার কাছে বসে পড়েছে শশী।
‘শারিয়ার এটা খোলার ব্যবস্থা করো প্লিজ, শশীর গলায় আবেদন। তার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে আর সহ্য করতে পারছে না সে। শারিয়ার ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওটার দিকে। ওর সঙ্গে ভুবন। দুজনে মিলে বহু কষ্টে ঠেলে-ঠুলে সিন্দুকের ওপর থেকে ভারী পাথরের ডালাটা সরিয়ে একপাশে নামিয়ে রাখল।
ডালাটা সরে যেতেই প্রায় লাফিয়ে ওটার ভেতরে উঁকি দিল শশী। বাকিরাও সবাই এগিয়ে এলো এদিকে। ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। কিন্তু রাশি রাশি সোনা-দানা আর ধন সম্পদের পরিবর্তে শশী অনেকটা ভূতে ধরার মতো ভঙ্গিতে বিরাট সিন্দুকটার ভেতর ভেতরে টেনে বের করে আরো পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া একতাড়া কাগজ।
‘বই ভেতরে স্রেফ একটা বই,’ রুম্পা বলে উঠল। শারিয়ার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে আর কিছুই নেই।
শশী পাগলের মতো পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছে। বইটাতেও কিছুই লেখা নেই। একেবারেই শূন্য পাতা ওটার। শারিয়ার শশীর কাছে এসে টান দিয়ে বইটা কেড়ে নিল। বইটার মলাটটাই অনেক পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া। আর ভেতরে একটা পৃষ্ঠা পুরনো। এছাড়া বাকি সব পাতা একেবারেই নতুন, আনকোড়া আধুনিক কাগজ। পুরনো পৃষ্ঠাটাতে একটাই শব্দ লেখা। শারিয়ার আনমনেই পড়ে উঠল শব্দটা, ‘রাজদ্রোহী।’
‘কিন্তু এর মানে কী?’ প্রায় আর্তনাদ করার মতো করে বলে উঠল শশী। ‘দিনের পর দিন এতকিছু করে এতকিছু করে পেঁচিয়ে এভাবে সবাইকে ধোঁকা দিল আবদেল?’ সবাই হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে খালি সিন্দুক আর শারিয়ারের হাতে ধরা কাগজগুলোর দিকে। কিন্তু শশীকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে। কোনোমতে নিজেকে স্থির রেখেছে সে।
কিন্তু তার দিকে তাকানো শারিয়ারের মুখে হাসি। ‘ধোঁকা ডক্টর আবদেল দিয়েছেন নাকি তুমি আমাদের দিয়েছো শশী?’ ভারী গলায় বলে উঠল শারিয়ার। ‘নাকি তোমাকে তোমার প্রকৃত নামে ডাকব?’
‘মানে?’ নিচু করে রাখা মাথাটা চট করে সোজা করল শশী।
তুমি হয়তো জানো না। আমি অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি তুমি ডক্টর শশী নও,’ বলে সে নিজের হাতের অস্ত্রটা আলগোছে তুলে ধরল শশীর দিকে। ‘ডক্টর আবদেলের মেয়ে তো ডেফিনিটলি নও। অনেক নাটক করেছ। এবার ঠিক করে বল তুমি আসলে কে?’
যাকে সবাই শশী নামে চেনে তার অবাক হয়ে থাকা মুখের দিকে ততোধিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই।
অতীত
সিলভেরা আর তালেব তৈমূরকে শূন্যের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল কিরান। কিন্তু কিছু করার আগেই শেষ হয়ে গেল সব। প্রথমে দৌড়ে চলে গেল খোলা জানালার কাছে দুজনকেই নিচের অতলে হারিয়ে যেতে দেখে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সে। এত চেষ্টা করেও সে বাঁচাতে পারেনি নিজের বাপকে। বরং ওকে বাঁচাতে গিয়ে হারাতে হলো মানুষটাকে। কিরানের কাঁধে হাত রাখল কেউ একজন। কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল পট্টবর্ধন ওর কাঁধে হাত রেখেছে। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ওর আর পদ্মের দলের বাকি যারা বেঁচে আছে তারা সবাই। প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত-রক্তাক্ত। কিন্তু মুখে ফুটে আছে বিজয়ের হাসি। সিলভেরার সঙ্গে যুদ্ধে জয় হয়েছে ওদের। সিলভেরার দলের যারা বেঁচে আছে তাদের বন্দি করা হয়েছে।
কিরান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত ফিরে গেল সেই পিপেগুলোর কাছে। এক লাথি দিয়ে ফেলে দিল একটা। ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটি আর পাথর। তারপর আরেকটা…আরেকটা। প্রত্যেকটার ভেতরে একই জিনিসে ভরা। কিরানকে পাগলের মতো এটার পর একটা পিপে ফেলে দিতে দেখে সবাই এসে দাঁড়াল ওর কাছে।
পিপেগুলো দেখা শেষ করে খানিক চিন্তা করে মাটি থেকে একটা পড়ে থাকা তলোয়ার তুলে নিল সে। তারপর সেটাকে তাক করল পদ্মের দিকে। ‘শুরু থেকেই তুমি সবই জানতে তাই না? বাপু আমার সঙ্গেই ছিল,’ বলেই সে তলোয়ারটা উদভ্রান্তের মতো তাক করল পট্টবর্ধনের দিকে। ‘তুমিও জানতে। তাহলে কেন এত নাটক? কীসের জন্য? যদি এখানে কিছু না থেকেই থাকে?’ উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল সে।
‘কিরান শান্ত হও,’ পট্টবর্ধন তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
‘আমি আগে উত্তর চাই,’ কিরানও শান্ত হওয়ার অবস্থায় নেই।
পট্টবর্ধন তাকে শান্ত করার জন্য একটা হাত তুললেও কিরানের কথাকে কোনো পাত্তাই দিল না পদ্ম। সে একহাতে কিরানের তলোয়ারের ডগাটা ধরে সেটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল নিজের সামনে থেকে।
‘জাহাজি, আমি কিছুই জানতাম না। আবার সবই জানতাম। কিন্তু আমি কিছুই বলব না। কিন্তু তুমি যা ভাবতাছো ব্যাপারটা মোটেও তেমন কিছু না। এখন পর্যন্ত যা যা ঘটছে সবই ছিল পুরোপুরি সাজানো নাটক। আর এই নাটকে আমি ছিলাম স্রেফ একটা চরিত্র, ঠিক যেমন তুমিও ছিলা একটা চরিত্র,’ বলে সে হাত তুলে পট্টবর্ধনসহ বাকিদের দেখাল। ‘এখানকার সবাই ছিল তুমার বাপুর নাটকের এক একটা চরিত্র। তোমার বাপ আরাকান থেইকা পলানোর পরে একটা নাটক সাজাইছিল, আমরা সবাই সেইটাতে একে একে অভিনয় কইরা গেছি। আমারে সে যতটা বলছে আমি ঠিক ততোটাই জিজ্ঞেস করছি, ততটাই জানছি আর তাতেই অভিনয় করছি। তোমার বাপুর কাছে এই মগদোষীদের গ্রামের প্রতিটি মানুষ রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল আর তার বিপদে রক্ত দিয়াই সেই ঋণ শোধ করছে তারা, পদ্মের চোখে পানি। যুদ্ধে জয় হইছে আমাগো। কিন্তু আমরা মানুষটারে বাঁচাইতে পারি নাই। তুমি যেমন তোমার বাপুরে হারাইছো, ঠিক তেমনি আমিও হারাইছি আমার বাপুরে, আমার গ্রাম আমার মাইয়াগোরে। আর তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারব স্রেফ একজনই। এই নাটকের পরিচালক আর মূল পরিকল্পনাকারী; আকরাম বেগ। তালেব তৈমূর যদি এই নাটকের রচনাকারী হইয়া থাকে তবে আকরাম বেগ হইলো এই নাটকের বাস্তবায়নকারী। কাজেই সব জানতে হইলে তোমার তারে জিগাইতে হবে,’ বলে সে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবার মাঝখান দিয়ে এগোতে লাগল দুর্গের ওপরের দিকে। তার গমন পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিরান।
বর্তমান
‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শারিয়ার,’ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল শশী। শারিয়ারের হাত থেকে নিয়ে সে এমনভাবে বুকের সঙ্গে বইটা চেপে ধরে রেখেছে যেন এটা তার জীবনমরণ।
‘কিন্তু ব্যাপারটা তো এ রকম হওয়ার কথা, তাই না?’ শারিয়ারও একইরকম সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলে উঠল। এখনো সে অস্ত্রটা তাক করে আছে শশীর দিকে। শশী একবার সেটা দেখল আরেকবার রুম্পাসহ বাকিদের দেখে সে আবার ফিরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শারিয়ারের পাথরের মতো চেহারা দেখে থেমে গেল সে। শারিয়ারই কথা বলে উঠল আগে।
‘আমি তো আগেই বলেছি, আমার নিজের শরীরে ন্যানো ট্র্যাকার ছিল। তাহলে আমাকে বলো তো, আমি কেন আমার ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে নিজের লোকদের ঝুঁকিতে ফেলে বোকার মতো অথরিটির সঙ্গে ধোঁকাবাজি করলাম। যে কাজটা অথরিটির সাহায্য নিয়ে, তাদের সাপোর্ট নিয়ে তুলনামূলক সহজভাবে করতে পারতাম সেটা কেন এত কষ্ট করে করলাম। ভেবে দেখো,’ বলে শারিয়ার দুই পা এগিয়ে গেল শশীর দিকে। ‘কারণটা খুবই পরিষ্কার। আমি বুঝতে পারছিলাম যে খেলা ওপরে চলছে সেটা ভেতরে অনেক অন্যরকম। তাই হুয়ান, মিস্টার ইউ বা নেক্রপলিস তো বটেই অদৃশ্য সকল শত্রু এমনকি নিজের ডিপার্টমেন্টের ভেতরেও ওদের চরদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই এমনটা করেছিলাম। এটা তো এখন সবাই জানে,’ বলে শারিয়ার সবাইকে দেখে ফিরে তাকাল হাতকড়া পরানো মিস্টার ইউয়ের দিকে। ‘মিস্টার ইউকের এটাই বলেছি আমি। কিন্তু যেটা বলিনি সেটা হলো আসলে তোমার কাছ থেকেও নিরাপদে থাকার জন্যও এই পলায়ন।’
‘মানে?’ শশীর মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
‘মানে হলো তোমাকে উদ্ধার করার দিন সকালেই আমরা জানতে পারি তুমি শশী নও। তোমার আইডি কার্ড যেটা নৌকায় পাওয়া যায় সেই মানুষটা তুমি নও। এমনকি তোমাকে উদ্ধার করার আগেই তোমার পরিচয় নিয়ে খানিকটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল আমাদের ভেতরে, এখানে খানিকটা ক্রেডিট টমিকেও দিতে হবে,’ বলে সে টমির দিকে ফিরে হাত নাড়ল। ‘এর পেছনে কারণও ছিল। তোমার যে পাসপোর্ট হোটেলে পেয়েছিলাম, সব পোর্ট অব এন্ট্রিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই নামে গত কয়েকদিনে কেউ ট্রাভেল করেনি। মানে তুমি মিশর থেকে এসেছিলে নিজের নামেই। কিন্তু বাংলাদেশে নামার পর থেকে নিজেকে শশী নামে পরিচয় দিতে শুরু করো। এই নামে যে ফেসবুক আইডি, ইনসটাগ্রাম আইডি চালু আছে, যেগুলো দেখে আমরা ভেবেছিলাম তুমি দেশে এসেছো, সেগুলোও বেশ নতুন। খুব পুরনো না। এগুলো থেকে সন্দেহ তো ছিলই কিন্তু মূল ধরাটা খাও তুমি যখন আসল ডক্টর শশী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’
‘আসল ডক্টর শশী!
‘হ্যাঁ, আসল ডক্টর শশী। সে তার এক্সকেভেশন সাইট থেকে ফিরে এসেছে। তোমার হিসেবে যেটা আরো কয়েকমাস পর হবার কথা ছিল, কিন্তু একটা বিশেষ কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই ফিরে এসেছে সে। আসল শশী নিজের কাজে এক্সকেভেশন সাইটে চলে যাওয়াতেই তুমি তার পরিচয়ের ভুয়া নাটক সাজিয়েছিলে। তাও সেটা পারতে না যদি না যে ইউনিভার্সিটিতে তোমরা কাজ করো, ওদের ওয়েবসাইটে ডক্টর শশীর কোনো ছবি ছিল না, যে কারণে তুমি তার ভুয়া পরিচয়টা ক্যারি করতে পেরেছিলে। আসল ডক্টর শশী এমনকি ফেসবুক ইন্সটা এসবও ব্যবহার করে না, আর সেই সুযোগটাও তুমি নিয়েছো, ‘ বলে সে নকল শশীর দিকে এগিয়ে গেল দু-পা।
‘আসলে তুমি ডক্টর আবদেলের মেয়ে নও, তার অসম বয়সের প্রেমিকা। প্রকৃত ডক্টর শশীর কাছ থেকেই সেটা জানতে পেরেছি আমরা। তোমাকে উদ্ধারের আগেই খানিকটা সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু তোমাকে যেদিন আমরা উদ্ধার করতে ওই ডকইয়ার্ডে অভিযান চালাই, সেদিন রাতেই ডক্টর শশীর সঙ্গে আমার বস পাশা স্যারের কথা হয়। তাই সেদিন তোমাকে উদ্ধার করার পর পরদিন সকাল পাশা স্যারের সঙ্গে আমার যখন যোগাযোগ হয়, আমি তখনই সব জানতাম। আমি প্রথমে রুম্পাদের কাছ থেকে দূরে সরে পলাতক সেজে অভিযান চালাতে চাইছিলাম কারণ আমি ভেবেছিলাম রেলিক বা নেক্রপলিসের নিজেদের লোক আছে দপ্তরে, ওদের থেকে বেঁচে চলার জন্যে, তোমাকেও নিরাপদ রাখার জন্যে। কিন্তু তোমাকে উদ্ধার করার পর যখন পাশা স্যারের সঙ্গে কথা হলো তখন তো দেখি, ওমা যাকে বাঁচাতে চাইছি…’ বলে শারিয়ার কাঁধ ঝাঁকালো।
তার চুল থেকে টপ করে এক ফোঁট রক্ত গড়িয়ে পড়ল গালের ওপরে। সেটা মুছে নিয়ে বাকিদের দেখে নিয়ে সে বলে উঠল, ‘ওইদিন সকালে হোটেলে বসে যখন তুমি বললে যে, তুমি ডক্টর আবদেলের মেয়ে, প্রথমে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এই নাটক জারি রাখতে হবে। আমি একদিকে অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম আর ওপরে ওপরে তোমার সঙ্গে নাটকটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ আমি জানতাম তুমি হলে একটা টোপ। যে টোপ দিয়ে ডক্টর আবদেলের গবেষণার সমাধান সম্ভব, সেই সঙ্গে সম্ভব হুয়ানকে খেলানো। শুধু হুয়ান নয়, নেক্রপলিস থেকে শুরু করে বাকি যারা আছে সবাইকে খেলিয়ে জল থেকে তুলে আনা, যাবে,’ বলে সে দুই হাত প্রসারিত করে দেখাল। ‘আসলেও তাই হয়েছে। যখন তোমাকে নিয়ে পালাচ্ছিলাম তখনই আমি প্ল্যান করে ফেলি। আর তাই রুম্পাদের নিয়ে ওই নাটকটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ওখান থেকে পালানো, তোমাদের নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া সবই আসলে আমি অথরিটির কাছ থেকে পালিয়ে নয় বরং মিলেই করছিলাম। ডক্টর আবদেলের সম্পদ খুঁজে না পেলেও তার মৃত্যুরহস্য থেকে শুরু করে বাকি সব কর্মকাণ্ডের সমাধান করা গেছে,’ বলে সে আবারও এগিয়ে গেল নকল শশীর দিকে। ‘আরেকটা ব্যাপার, ডক্টর আবদেল আসলে সরকার, নেক্রপলিস বা রেলিকের কাছ থেকে ঠিক যেভাবে পালাচ্ছিল, তার আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার পেছনে আরেকটা বড়ো কারণ ছিলে তুমি। ডক্টর আবদেল তোমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল ঠিকই। কিন্তু একটা সময় সে তোমাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। আর তোমার কাজের চেয়ে বেশি লোভ দেখে সে ভয় পাচ্ছিল তাই সে লুকিয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় সে লুকিয়ে থাকতে পারলেও একটা সময় ঠিকই তুমি তাকে খুঁজে বের করে ফেল চট্টগ্রামে এসে। সম্ভবত তার মেয়েকে পাঠানো চিঠি আর লকেটটা কোনোভাবে পেয়ে যাও তুমি। কিন্তু তোমাকে অনুসরণ করে চলে আসে বাকিরাও। এই কেসটা যখন শুরু হয় একটা বড়ো প্রশ্ন ছিল ওইদিন রাতে ডক্টর আবদেল ওই রাস্তায় শীতের রাতে বৃষ্টির ভেতরে কী করছিল?
শারিয়ার রুম্পাসহ বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আসলে ডক্টর আবদেলের ওখানে এই মেয়েটা চুরি করে ঢুকে পড়ে। ডক্টর আবদেলের কিছু একটা চুরি করে পালাতে শুরু করে, সম্ভবত সেই জিনিসটা উদ্ধার করার জন্যই ডক্টর আবদেল তার পিছু নেয় এবং গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মারা পড়ে। জিনিসটা কী ছিল?’ বলে শারিয়ার এগিয়ে এলো শশীর দিকে। ‘এটা?’ বলে সে টান দিয়ে তার গলা থেকে লকেটটা নিয়ে ছুড়ে দিল রুম্পার দিকে। ‘নিয়ে যাও একে,’ বলে সে নিজের লোকদের দিকে ফিরে একটা চওড়া হাসি দিল।