অধ্যায় তেতাল্লিশ – বর্তমান সময়
দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর
তীব্র শীতের ভেতরে আধভেজা শরীরে যখন ভোরের নোনা বাতাস ঝাপটা মারে তখন পৃথিবীর সব রোমান্টিসিজম ভুয়া মনে হয়। উপন্যাস আর কবিতার বর্ণনা পড়া কুয়াশার বিবরণ মনে পড়লে লেখক কিংবা কবিদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ইচ্ছে হয়। এরকম বাতাসের ভেতর দিয়ে তীব্র গতিতে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলছে ছোট্ট একটা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার কাম স্পিডবোট আর সেটায় উপবিষ্ট সাতটি প্রাণ।
ফেলে আসা তীব্র স্রোতের দিকে একবার ফিরে তাকাল শারিয়ার। যদিও ওরা নিজেরা প্রায় সবাই আধা নৌকা আর আধা স্পিডবোটটার ছইয়ের ভেতরেই অবস্থান করছিল তবুও মাঝি আর তার অ্যাসিসট্যান্টের স্রোত কাটানোর তীব্র কসরত ঠিকই বুঝতে পারছিল ওরা। গতকাল সেই কলেজের প্রাঙ্গণে প্রফেসর আবদেলের রেখে যাওয়া ব্লু অনুসরণ করে বিশেষ জায়গাটার লোকেশন বের করার পর কেটে গেছে বেশ অনেকটা সময়।
ওরা সেই কলেজ থেকে শারিয়ারের পরামর্শ মতোই আর সেই বাড়িটায় ফিরে যায়নি। কলেজ থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে গেছে টেকনাফ। সেখানে গিয়ে একটা সাধারণ মানের হোটেলে তিনটে রুম বুক করে রাতে সেখানেই থেকেছে। ভুবনের মাধ্যমে সন্দ্বীপ হয়ে জংলাটিলা নামক সেই লোকেশনে যাওয়ার জন্য বহু কষ্টে একটা নৌকা ভাড়া করা হয়েছে। আসলে এগুলোকে নৌকা না বলে বলা উচিত আধানৌকা আর আধা স্পিডবোট। শারিয়ার চেয়েছিল ভালো একটা স্পিডবোট নিতে। কিন্তু ওরা খবর নিয়ে জানতে পারে যেখানে যেতে চাইছে সেখানে যেতে হলে শুধু স্পিডবোট অত্যন্ত রিস্কি হয়ে যায়। কারণ ওখানে যাওয়ার পথে এক জায়গায় নদী আর সমুদ্রের মোহনা আছে। যে কারণে ওখানে যেতে হবে বহু কষ্টে আর বহু ঝামেলার পথ পাড়ি দিয়ে। আর এই ঝামেলার পথের কারণে ওখানে কেউ যেতে চায় না। ওরা বহু কষ্টে ইঞ্জিনচালিত বেশ শক্তিশালী একটা নৌকা ভাড়া করে। একজন মাঝি আর তার অ্যাসিসট্যান্ট যাবে ওদের সঙ্গে।
টেকনাফের ঘাট থেকে ওরা রওনা দেয় খুব ভোরে। আসলে ভোর না বলে বলা উচিত মাঝরাতে। এই ব্যাপারটা ওরা করে দুটো কারণে, একদিকে নিরাপত্তার কারণে। অন্যদিকে মাঝি বলেই দিয়েছিল ওই নির্দিষ্ট সময়ে রওনা না দিলে ওরা মোহনার জটিল অংশটা পার হতে পারবে না। যে কারণে তীব্র শীত আর কুয়াশার ভেতরে ওরা রওনা দেয় সেই ভোররাতের দিকে।
টেকনাফ থেকে বেশ লম্বা সময় পার হওয়ার পরে কুয়াশার কারণে চারপাশে কিছু দেখতে না পেলেও ওরা নিচের পানিতে আন্দোলন অনুভব করেই বুঝতে পারে ভয়ংকর স্রোতময় কোনো একটা জায়গা পার হচ্ছে ওরা। আর সে-কারণেই সবাই মিলে নৌকায় ছইয়ের ভেতরে প্রবেশ করলেও পানির ঝাপটায় প্রায় আধভেজা হয়ে যায় ওরা অনেক আগেই।
শারিয়ার ছইয়ের ভেতরে বসে নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে সেটা থেকে গরম কফি বের করে সবাইকে প্লাস্টিকের কাপে ঢেলে দিল। তারপর নিজে ফ্লাস্কের মুখের ভেতরে কফি নিয়ে চলে এলো ছইয়ের বাইরে। নৌকার পেছন দিকের কোনায় বসে আছে মাঝি আর তার হেল্পার। অন্যদিকে নৌকার একেবারে সামনের দিকে বসে আসে শশী মেয়েটা। শারিয়ার সেদিকে এগিয়ে সাবধানে পা ফেলে তার পাশে বসে পড়ল। তারপর মৃদু কাশি দিয়ে বলে উঠল, ‘কফি চলবে, ম্যাডাম?’
‘অবশ্যই,’ শশী মৃদু হেসে উঠল ওকে দেখে। ‘চলবে মানে! দৌড়াবে।’
শারিয়ার তার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল, ‘আমি এই পেশা পছন্দ করি কেন জানো? এই যে প্রায় ভোর রাতে প্রায় অচেনা একদল মানুষের সঙ্গে অচেনা জায়গায় অনিশ্চিত এক যাত্রায় চলেছি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এটাই হলো এই পেশার মজা। এটা প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, জীবনটা আসলে কতটা মূল্যবান,’ শারিয়ার একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে ধরাতে ধরাতে বলে উঠল।
শশী কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। কিন্তু সে প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো জবাব দিল না। তারপর শারিয়ারের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘শারিয়ার, তোমার জীবনের সবচয়ে বড়ো ভয় কী?
শারিয়ার একদৃষ্টিতে আধো অন্ধকারের ভেতরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার বড়ো বড়ো বাদামি চোখের দিকে। সামান্য মাথা নেড়ে সে বলে উঠল। ‘তুমি কী জন স্টেইনবেকের ‘অফ মাইস অ্যান্ড মেন’ উপন্যাসটা পড়েছো?’ শশী সামান্য মাথা নেড়ে জানাল সে পড়েছে। ‘ওখানে একটা দৃশ্য আছে; লেনি মানে, উপন্যাসের মূল চরিত্র মানে তার একমাত্র কাছের মানুষ জনিকে মেরে ফেলে,’ বলে সে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। ‘আমার বাবাকে আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছি সে অচল অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। বাবাকে আমি মাঝে মাঝে বই পড়ে শোনাই। বাবা কেন জানি বারবার ওই উপন্যাসের ওই দৃশ্যটা শুনতে চায়। কেন বলতে পারো?’ শারিয়ার তাকিয়ে আছে শশীর দিকে। শশী অনুভব করার চেষ্টা করছে শারিয়ারের মুখ দিয়ে উচ্চারিত প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সে কী আসলে তার কাছে কিছু জানতে চাইছে। দুজনেই দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ শারিয়ারই সামান্য হেসে উঠল।
‘সরি, তুমি বলো। তোমার সবচেয়ে বড়ো ভয়টা কী?’
শশী এখনো তাকিয়ে আছে শারিয়ারের দিকে। শারিয়ারের কাছে মনে হলো মেয়েটা ওকে দেখছে না। শুধুই তাকিয়ে আছে। তারপর মৃদু হেসে অনেকটা ফিসফিসে স্বরে কথা বলতে শুরু করল। ‘আমার সবচেয়ে বড়ো ভয়টা আমি এই মুহূর্তে পার করছি। আমার সারা জীবনের ভয়-বিশ্বাস সব ভেঙে পড়েছে। আমার পরিবারের শেষ অংশটাও চিরতরে হারিয়ে গেছে। সে যার জন্য সারাটা জীবন লড়াই করেছে সেটাও হয়ে গেছে অনিশ্চিত। আমি আমি,’ শশী কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল। শারিয়ার তাকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু নৌকার পেছনের দিক থেকে মাঝি চেঁচিয়ে উঠে জানাল ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে।
মাঝির কথা শুনে শারিয়ার আর শশী দুজনেই ফিরে তাকাল সামনের দিকে। ভোরের আবছা ঘন কুয়াশার দঙ্গল ভেদ করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে আলো। আর সেই আলোতে সামনে বেশ কিছু পাহাড়ি আকৃতি দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে।
দেখতে দেখতেই ওরা পাহাড়ি টিলাগুলোর কাছাকাছি চলে এলো। মাঝি নৌকার গতি অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। সব পরিষ্কার দেখতে না পেলেও ওরা দেখতে পেল অদ্ভুত এক পাহাড়ের সারির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দেখতে দেখতেই সেই পাহাড়ি টিলার ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল ওদের নৌকা। দুইপাশের জঙ্গুলে টিলার ভেতরে চওড়া নদীর মতো সরু জলপথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এগোতে লাগল ওরা।
‘সর্বনাশ,’ পেছন থেকে টমির গলা শোনা গেল। সুমন, টমি আর ভুবনও নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ‘বাংলাদেশে এরকম জায়গা আছে আমি জানতামই না।’
‘আমার কাছে অনেকটা হা লং বের মতো লাগছে দেখতে,’ ভুবন মন্তব্য করল।
টমি, ট্যাবটা বের করে দাও তো,’ শশীর কথা শুনে টমি অভ্যস্ত হাতে ব্যাকপ্যাক খুলে ট্যাবটা ধরিয়ে দিল শশীর হাতে। সবাই দু-পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছে। যদিও ভোরের কুয়াশার কারণে কিছুই পরিষ্কার নয়। তবুও ওরা বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে একটা বাঁক পেরুতেই দেখতে পেল একপাশে একটা মনুষ্য নির্মিত আকৃতির দেখা যাচ্ছে। কালের আবরণে ভেঙেচুড়ে সেটাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরনো কোনো ভুতুড়ে খনি মুখের মতো দেখাচ্ছে ওটাকে। ‘কী এটা?’ ভুবনের মতো সাহসী ছেলেও কেমন জানি ফিস ফিস করে কথা বলছে। যেন জোরে কথা বললে কেউ শুনে ফেলবে।
মনে হচ্ছে পুরনো কোনো বন্দর,’ শারিয়ার বলে উঠল। কোনো কারণ ছাড়াই গা শিরশির করে উঠল ওর। শশীর দিকে তাকিয়ে সে জানতে চাইল। ‘এটাই কী সেই জায়গা?’ ইশারায় পুরনো ভাঙা বন্দর কাম ঘাটটা দেখাল।
শশী মনোযোগের সঙ্গে ট্যাবে লোকেশন সেট করতে ব্যস্ত… তাকে সাহায্য করছে টমি। ‘না এটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের আরেকটু এগিয়ে সামনে বাম দিকে যেতে হবে। নৌকার মাঝিকে নির্দেশনা দিতেই আবারও খানিকটা গতি বাড়িয়ে নৌকাটাকে সামনে এগিয়ে বামে মোড় নিল। তারপর শশীর দেখানো নির্দেশনা অনুসারে একটা বেশ বড়ো টিলার সামনে চলে এলো।
‘এখানেই, এখানেই,’ শশী প্রায় চিৎকার করে উঠল।
‘এই নৌকা ভেড়াও এখানে,’ শারিয়ার টিলার একপাশে ঘাটের পাথুরে ভাঙা ঘাটের মতো কিছু একটা দেখে সেখানে নৌকা ভেড়াতে বলল। মাঝি নৌকা ভেড়াতেই একে একে নেমে এলো সবাই ক্ষয় হয়ে যাওয়া পুরনো পাথুরে ঘাটে। মাঝিকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে সবার শেষে নামল শারিয়ার।
‘অদ্ভুত তো জায়গাটা, কিন্তু এখানে কোথায় কী আছে?’ বলে সে তাকিয়ে রইল শশীর দিকে। চারপাশে পাথরের টুকরো-টাকরা ছড়ানো। আর জঙ্গুলে টিলা ছাড়া কিছুই নেই। তার ভেতরেও সব কুয়াশায় ঘোলাটে দেখাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোনো হরর সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছে ওরা ভুল করে।
‘কোন দিকে যাবো এখন?’ প্রশ্নটা শারিয়ার শশীর কাছে জানতে চাইল না নিজের কাছে ঠিক বোঝা গেল না।
‘ওই যে দেখো,’ শশী সামনের দিকে দেখছিল হঠাৎ সে বেশ জোরেই বলে উঠল। তার নির্দেশিত দিকে সবাই এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল এতক্ষণ যেগুলোকে মাটিতে পড়ে থাকা উলটো-পালটা পাথর মনে হচ্ছিল সেগুলোকে এখন পাহাড়ের পাথুরে ধাপের মতো মনে হচ্ছে। সবাইকে ওপরে ওঠার জন্য সেদিকে এগোনোর জন্য ইশারা করল শারিয়ার। ‘আমি সবার সামনে থাকছি। শশী আর টমি আমার পেছনেই থাকবে, কোনো নির্দেশনা থাকলে বলবে। সুমন আর ভুবন পেছন দিকটা লক্ষ রাখবে। সবাই সাবধানে উঠবে। কতদূর উঠতে হবে আমরা জানি না। সামনে কী আছে সেটাও জানি না। কাজেই সবাই সাবধান,’ বলে সে সামনে উঠতে ইশারা করল। সবার পেছন পেছনে উঠতে লাগল ভুবন। প্রায় দেড়শ ধাপের মতো পার হয়ে উঠে আসার পর ওরা দেখতে পেল পাহাড়ের ওপরে একটা পাথুরে উঠানোর মতো জায়গায় উপস্থিত হয়েছে।
‘বাহ দারুণ তো, ভুবন বলে উঠল। ‘কিন্তু জায়গাটা আসলে কী, এখনো সেটাই তো বুঝতে পারলাম না।’
‘জায়গাটা কী সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ ভুবনের পাশ থেকে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে শারিয়ার বলে উঠল। ‘ডক্টর আবদেল আর অতীতের ইতিহাসকে ঘিরে রচিত হওয়া সুবিশাল উপন্যাসের সমস্ত জবাব আছে এই জায়গাতে। অতীত খুঁড়ে সেইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে আমাদের এখান থেকে, নাক- মুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া আবছা কুয়াশার ভেতরে উড়িয়ে দিয়ে সে যোগ করল। ‘এই জংলাটিলাতে।’