অধ্যায় বিয়াল্লিশ – বর্তমান সময়
কোর্ট হাউস, পরীর পাহাড়, চট্টগ্রাম
‘আল্লাই জানে কোনো বিপদে যে পড়ব এইখানে ঢুকলে,’ আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল সুমন। সুমন যখন নিচু হয়ে কথাটা বলল নিজের পায়ের খাপের ভেতরে ছুরিটাকে ভালোভাবে আটকে নিচ্ছিল শারিয়ার। কথাটা কানে যেতেই ফিতে বাঁধা শেষ করে রাগের সঙ্গে ঝটকা দিয়ে সোজা হলো সে। ইচ্ছে সুমনকে কড়া ভাষায় কিছু একটা শুনিয়ে দেবে।কিন্তু উঠে বসে সুমনের দিকে তাকিয়ে তার চেহারার করুণ অবস্থা দেখে হেসে ফেলল সে।
নিজেকে উত্তেজিত হতে না দিয়ে শান্ত ভাষায় বলে উঠল, ‘সুমন, এত চিন্তা করার দরকার নেই। আমরা তোমাকে নিয়ে ভেতরে যাব না,’ বলে শারিয়ার আদালত প্রাঙ্গনের দিকে। ফিরে তাকাল তারপর নিজের হাতের ঘড়ি দেখল। দশটা বেজে সামান্য বেশি। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে ওদেরকে। আদালত প্রাঙ্গণটা আরেকটু জমজমাট হলে মানুষজনের ভিড় আরেকটু বাড়লে যেতে হবে ভেতরে। না হলে লোকজনের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আসলে লোকজন না বলে বলা উচিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের চোখে। কাজেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। রাতের আলোচনা শেষ হওয়ার পর সকালে উঠে ওরা সবাই বেশ দ্রুত গোসল সেরে নাশতা করে নেয়। তারপর শারিয়ারের বাড়িতে থাকা সাদা এসইউভিটা নিয়ে বেরিয়ে আসে আদালত প্রাঙ্গণের উদ্দেশ্যে। গাড়ি নিয়ে ওরা পৌছে যায় বেশ সকাল সকালই। কিন্তু পৌছে গিয়ে দেখে লোকজনের ভিড় তেমন নেই বলতে গেলে। সেজন্যই শারিয়ারের নির্দেশে ওরা অপেক্ষা করছে ভিড় আরেকটু বাড়ার জন্য। কারণ সুমনের তথ্য মতে এগারোটার ভেতরেই আদালত প্রাঙ্গণে মানুষের জ্বালায় পা ফেলার জায়গা থাকবে না।
শারিয়ার আজ বসেছে সামনের সিটে। একেবারে পেছনে বসেছে ভুবন। আর মাঝখানের সিটে বসে টমি আর শশী কাজ করছে। টমির হাতে তার সেই ল্যাপটপ। আর শশী সেই অ্যাপলের ট্যাবটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে ওটার ভেতরে। ‘নতুন কিছু পেলে?’ জানতে চাইল শারিয়ার।
‘চেষ্টা করছি,’ শশী জবাব দিল। ‘ভবনটার একটা নকশা পেয়েছি, টমি ওটাকে অটোক্যাডে দিয়ে অনেকটা থ্রিডি মডেলের মতো একটা মডেল বানানোর চেষ্টা করেছে। সেটা নিয়েই কাজ করছি,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘ভবনটা বানানো হয়েছে আঠারো শতকের একেবারে শেষ দিকে। এই কারণেই এটাতে ব্রিটিশ আর মোঘল স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষ করে এটা অনেকটাই মোঘলদের নির্মাণের মতো। ভবনটার আকৃতি পাহাড়ের সঙ্গে সাজুয্যতা রেখে এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন দ্বিতল ভবনটা পাহাড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিন তলা ভবনের মতো দেখায়। আর সেটার ওপরে যোগ করা হয়েছে ওপরের দুটো মিনার আর মিনারের ওপরে গম্বুজ। প্রশ্ন হলো, এরকম একটা জায়গার, মানে এত বিরাট একটা ভবনের কোনো জায়গাতে সম্ভাব্য থাকতে পারে সেই ব্লু যেটা আমাদেরকে ভিন্ন কিছুর লোকেশন বর্ণনা করবে।
‘এইখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে,’ একেবারে পেছনের সিট থেকে ভুবন বলে উঠল, ‘যে সম্ভাব্য ক্লু আপনি খুঁজছেন, সেটা কী সেই পুরনো আমলের কিছু? নাকি পরে প্লান্ট করা হয়ে থাকতে পারে?’
দুটোই হতে পারে, তবে প্রথমটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ যে সময়ের ঘটনা আমরা অ্যানালিসিস করছি এই ভবনটা বানানো হয়েছে তার অনেক পরে। কাজেই সম্ভবত এমন কিছু একটা খুঁজছি আমরা যেটাকে হয়তো পরে প্লান্ট করা হয়েছে।
‘সেই ক্ষেত্রে আমার ধারণা ভবনটার সঙ্গে পুরো একটা নতুন অংশ লাগানো হয়েছে সেখানেই কিছু একটা থাকতে পারে। কিন্তু,’ ভুবন আগ্রহের সঙ্গে নিজে মাথা দুই সিটের মাঝখান দিয়ে শশী আর টমির মাঝখানে এসে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘সেই ক্ষেত্রে আরেকটা পয়েন্ট হলো এই জিনিসটা কী আপনার বাবা প্লান্ট করেছে নাকি অন্য কেউ?’
‘খুব জোর সম্ভাবনা বাবাই করেছে,’ ভুবন কী বলতে চাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছে শশী। ‘কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কোথায় খুঁজব, কোথা থেকে শুরু করব, এত বড়ো বাড়িটাতে। এরকম একটা বাড়ি বিস্তারিত তল্লাসি চালাতে গেলে একদল লোকের একমাসের ওপরে লেগে যাবে,’ শশীকে বেশ খানিকটা হতাশ দেখাচ্ছে।
‘সেক্ষেত্রে আমার একটা অ্যানালিসিস আছে,’ ভুবন বেশ আগ্রহে মুখ সামনে নিয়ে এলো। ‘স্রেফ আমার একটা অ্যানালিসিস, আমি কাল রাত্রে এমনিতেই ভাবছিলাম বিষয়টা নিয়ে। ধরুন এই যে বিরাট কোর্ট হাউসটা,’ বলে সে ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত কোর্ট হাউসটা দেখাল হাতের ইশারায়। ‘এরকম বিরাট একটা বাড়িতে যেখানে সর্বক্ষণ লোকজন আসা-যাওয়া করছে, মানুষজনে গমগম করে এরকম একটা বাড়িতে আপনি যদি কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে চান ভবিষ্যতে কেউ যাতে খুঁজে পায় সে-উদ্দেশ্যে তবে আপনি কোথায় লুকাবেন সেটা?’
‘এমন একটা জায়গাতে যেখানে লোক সমাগম কম,’ সামনের সিট থেকে মাথা ঘুরিয়ে বলে উঠল শারিয়ার।
‘ভেরি গুড, বস। আই লাভ ইউ,’ বলে সে হেসে উঠে আবারও বলতে শুরু করল ভুবন। ‘অমন জায়গা এরকম একটা কোর্ট হাউসে কোথায় পাওয়া যেতে পারে?’ বলে সে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ‘হয় কোনো তালাবন্ধ রুমে, অথবা কোনোবড়ো কর্মকর্তার কামরায় বা এরকম কোথাও। ঠিক?’
কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিল না দেখে সে নিজেই বলতে শুরু করল। কিন্তু এমন কোথাও জিনিসটা লুকানোও তো রিস্ক। আবার ওটাকে কেউ না কেউ কোনোনা কোনো সময়ে খুঁজে পেয়ে যেতে পারে। আমাদের প্রফেসর সাহেব নিশ্চয়ই এরকম কোনো জায়গাতে কিছু রাখবে না, যেখানে এরকম কিছু ঘটতে পারে। কাজেই সে চেষ্টা করবে এমন কোথাও জিনিসটা রাখতে যেখানে লোক সমাগম নেই, আবার ওখানে কেউ ওটাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই,’ বলে সে একটা আঙুল তুলল নিজের। আবার জায়গাটার একটা ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। এমন জায়গা কোর্ট হাউজের ভেতরে কোথায় থাকতে পারে?’
‘ছাদে,’ শশী আনমনেই বলে উঠল
‘আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ভুবন হেসে উঠে বলে উঠল। ‘কোর্ট হাউসের ওই মিনার দুটোতে কিংবা ওই দুটোর একটাতে। ট্রাস্ট মি, আমি আগেও এই অফিসে এসেছি। ওই মিনার দুটোতে ওঠার জন্য ভেতরে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। তবে ছাদে ওঠার দরজায় তালা লাগানো থাকে।’
‘দারুণ, দারুণ অ্যানালিসিস,’ শশী প্রায় হাততালি দেওয়ার মতো খুশি হয়ে বলে উঠল। ‘সুমন আর ভুবন, আপনারা যেহেতু এখানে আগে এসেছেন কাজেই আপনাদের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।’
শশী ওদেরকে প্রশ্ন করতে লাগল, শারিয়ার বেরিয়ে এলো গাড়িটার ভেতর থেকে। ভেতরে ওর দম বন্ধ লাগছিল, সেই সঙ্গে ওর জরুরি কিছু ফোন কল করতে হবে। একটু আগে কেনা বেনসনের প্যাকেট খুলে ওটা থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল সেই সঙ্গে নম্বর ডায়াল করতে লাগল সে।
শারিয়ারের মোবাইলে কল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় দেখল গাড়ি থেকে নেমে আসছে শশী টমি আর ভুবন। শারিয়ার কল কেটে ফোন রেখে দিল পকেটে। শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে শশী বলে উঠল, ‘আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি। এখন ওই মিনার দুটোতে উঠতে হবে। ওখানে কিছু একটা যদি পেয়ে যাই তবে ঝামেলা অনেক কমে যাবে।
‘সুমন কই?’ শারিয়ার সিগারেটাকে পিষে দিয়ে জানতে চাইল।
সুমন ভাই গাড়িতেই থাকবে,’ টমি বলে উঠল। ‘তার জন্য ওখানে যাওয়াটা অনেক বেশি রিস্কি হয়ে যাবে।’
গাড়িতে বসা সুমনের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে একবার হাত নেড়ে ইশারায় তাকে সাবধান থাকতে বলে বাকিদের নিয়ে সামনের দিকে এগোল ওরা।
‘আমার সঙ্গে এসো,’ ভুবন কথাটা বলে নিজের হুডিটা তুলে দিল ওপরের দিকে। বাকিরা তাকে অনুসরণ করে বিরাট কোর্ট হাউসটার সামনের দিকে চলে এলো। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বরাবর বাম দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে ওপরে লেখা কমিশনারের কার্যালয়। আর ভবনরটার একেবারে সামনের অংশে লেখা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় লেখা অংশটার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা।
‘কী দারুণ একটা স্থাপত্য, লোকজনের ভিড় ঠেলে ভেতরে যেতে যেতে শশী মুগ্ধতার সুরে বলে উঠল। ‘আমি বিশ্বের সেরা সেরা সব স্থাপনা দেখেছি। দিল্লির লাল কেল্লা আমার অন্যতম প্রিয় স্থাপনা, এই ভবনটা দেখে সেই স্থাপনাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এরকম একটা স্থাপনা অন্য কোনো দেশে থাকলে…’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল সে।
‘শোন, জীবনের মূল্য যে জাতির কাছে অর্থের মূল্যের চেয়ে কম সেদেশে তুমি আশা করতে পারো না যে প্রাচীন স্থাপত্যকে মূল্যায়ন করা হবে।’
‘এইটাই হয়। যার কাছে যেটা অনেক বেশি আছে সেটা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে মানুষ বেশি তো তাই মানুষের কোনো দাম নেই।’
ভুবন বাকিদের নিয়ে ভেতরে ঢুকে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে চলে এলো দুই তলা ওপরে। তারপর ভিড় ঠেলে একপাশে সরে গিয়ে ওদেরকে ইশারা করল ওদিকে যাওয়ার জন্য। ওরা মূল করিডরের সঙ্গেই লাগোয়া একটা দরজা দেখতে পেল। কিন্তু ওটার সামনে গিয়ে অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে শারিয়ারের দিকে ইশারা করল ভুবন। দরজাটায় পুরনো আমলের বিরাট একটা তালা ঝুলছে। শারিয়ার একবার আশেপাশে দেখে নিল। চারপাশে এত মানুষ, এর ভেতরে কোনোভাবে তালা ভাঙার চেষ্টা করাটা অসম্ভব মনে হচ্ছে। হাতাশার সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকাল শারিয়ার।
‘অন্য কোনোদিক দিয়ে ঢোকার উপায় নেই?’ শশী জানতে চাইল বিরক্ত মুখে। খানিকটা অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
‘আছে মনে হয়। কিন্তু আমি আসলে ভুলে গেছি,’ বলে সে হুডি নামিয়ে মাথা চুলকাল। ‘চলো দেখি নতুন ভবনের সঙ্গে এই পুরনো ভবনটার সংযোগ আছে বেশ কয়েকদিক থেকে। আমার মনে হয় পেছনের নতুন ভবনটা দিয়ে চাইলে এটার ছাদে পৌঁছানো সম্ভব হবে। চলো ট্রাই করে দেখি।’
ভুবন আগে চলতে লাগল, বাকিদের নিয়ে ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল ওরা। পুরনো ভবন থেকে হেঁটে ওরা চলে এলো নতুন ভবনে। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা উঠে তিনতলার একটা ফুট ব্রিজের সাহায্যে ভুবন আবার ওদের নিয়ে এলো অন্য একটা ভবনে। সেখান থেকে বেয়ে বেয়ে ওরা চলে এলো পেছনের ভবনে। পেছনের ভবনে এসে ভুবন খানিকটা তাল হারিয়ে ফেলল। ‘টমি, আমাকে ভবনের নকশাটা দেখাতে পরবে?’
টমি ইশারা করল শশীর দিকে। শশীর নিজের ব্যাগ থেকে ট্যাবটা বের করে ভুবনের হাতে ধরিয়ে দিল। ভবনের নকশাটা একবার দেখ নিয়ে সে আনমনে মাথা নাড়াল; তারপর আবার হাঁটতে লাগল আরো দুটো পুল পার হয়ে ওরা চলে এলো সিঁড়িকোঠার মতো একটা জায়গাতে।
‘হ্যাঁ, এটাই,’ বলে সে সিঁড়িকোঠার দরজাটা দেখাল। ‘এটা খুলতে হবে। এখান থেকে লাফিয়ে পুরনো ভবনের ছাদে নামা যাবে।’
শারিয়ার দেখল মোটা টিনের দরজাটায় সেই একই ধাঁচের পুরনো একটা তালা লাগানো। একবার চারপাশে দেখে নিল কেউ আছে কিনা। নিজের পিস্তল বের করে সাইলেন্সার লাগাল ওটাতে। তারপর তালার দিকে তাক করে গুলি করে দিল। ফচ করে একটা শব্দের সঙ্গে চৌচির হয়ে গেল পুরনো তালা। টিনের দরজাটায় একটা লাথি মারতেই কড়া সূর্যালোক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপরে। দরজার ওপাশে একটা সাদা রং করা ছাদ আর সেই লাল মিনার দুটো দেখা যাচ্ছে। ‘বলেছিলাম না!’ মিনার দুটো দেখা যাওয়াতে খানিকটা স্বস্তি মনে হলো ভুবনের গলায়। সবাই একে একে সামনের দরজা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল ওপাশের ছাদে। ওর পেছনে একে একে নেমে এলো বাকিরা সবাই।
ছাদে নেমেই ভুবন দেখল শশী সেই মিনার দুটোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সে একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর নিজে ত্রস্ত পায়ে এগোল ওদিকে।
‘আপনি আসলে খুঁজছেনটা কী একটু ভালোভাবে বলবেন?’ শশীর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভুবন জানতে চাইল।
‘আসলে আমি যে কী খুঁজছি নিজেও ঠিক জানি না। তবে আমি বাবার স্বভাব কিছুটা হলেও জানতাম, কাজেই এমন কিছু একটা খুঁজছি, দাঁড়ান এক মিনিট, ‘ বলে সে তালি দিয়ে সবাইকে কাছে ডাকল। ‘সবাই একটু শুনবেন প্লিজ,’ সবাই মোটামুটি কাছাকাছি আসতেই শশী বলতে শুরু করল। সবাই একটু ভালোভাবে চারপাশে নজর বোলাবেন। যেকোনো জিনিস যেটা একটু অন্যরকম মনে হবে, হয়তো একুট ব্যতিক্রম মনে হবে বা যদি খানিকটা চোখেও লাগে বা নজরে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ডাকবেন আমাকে। যেকোনো কিছু। কারণ আমরা সঠিকভাবে জানি না আসলে কী খুঁজছি,’ বলে সে নিজেও দেখতে শুরু করল তার আগেই শারিয়ার কথা বলে উঠল
‘জলদি করতে হবে আমাদের। যতটা দ্রুত সম্ভব,’ সবাই খোঁজার জন্য ফিরে তাকিয়েছিল কিন্তু শারিয়ারের কথা শুনে ফিরে তাকাতেই সে নতুন ভবনের জানালাগুলো দেখল, যেদিক দিয়ে ওরা ঢুকছে সেদিককার সবগুলো বড়ো বড়ো জানালা এই ছাদের দিকেই মুখ করে আছে। ‘আমি নিশ্চিত লোকজন দেখছে আমাদের। কেউ না কেউ সন্দেহ করলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। কাজেই জলদি।’
সবাই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে শুরু করল। শারিয়ার নিজে ব্যস্ত হয় পড়ল মোবাইল নিয়ে।
শশী এগিয়ে চলে এলো মিনারগুলোর কাছে। তার থেকে খানিকটা তফাতে ভুবন। যদি কিছু থাকে তবে এখানেই আছে।’
‘হতে পারে,’ শশী মিনারগুলোর দেয়ালে বসানো ছোটো ছোটো গোল ঘুলঘুলি দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। পুরোপুরি পরিষ্কারভাবে দেখা না গেলেও একদিকে দেখতে পেল প্যাঁচানো সিঁড়ি নেমে গেছে ভেতরের দিকে। ‘বাবাকে তো আমি চিনতাম, সে এমন কিছু করবে না যাতে এরকম প্রাচীন স্থাপত্যের কোনো ক্ষতি হয়। আবার এমনভাবেও কোনো ক্লু ছেড়ে যাবে না যাতে জিনিসটা খুব সহজে নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায় বা কেউ সরিয়ে ফেলতে পারে। তারমানে আমরা এমন কিছু খুঁজছি যেটা…’ কথা বলতে বলতে ভুবন আর শশী প্রথম মিনারটা পরখ করা শেষ করে দ্বিতীয় মিনারটার কাছে চলে এলো। দুটো মিনার দেখতে প্রায় একইরকম। অনেকটা মিরর ইমেজের মতো বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় মিনারটার ঘুলঘুলির কয়টা কাচ ভাঙা। ওটা দিয়ে একবার ভালোভাবে ভেতরে দেখল শশী। ভেতরে দেখা শেষ করে মিনারের ইটের দেয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে সে ভুবনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘যদি আমরা এখানে কিছু একটা না পাই তবে আমাদের মিনারের ভেতরে দেখতে হবে।’
‘ব্যাপারটা কঠিন হবে,’ বলে ভুবন আনমনে মাথা নাড়ল।
‘দেয়ালের এই রঙটা অবশ্যই অনেক পরে করা হয়েছে,’ দেয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে শশী মন্তব্য করে উঠল। সে বুলানো হাতটা চোখের সামনে তুলে দেখল তাতে লাল লাল গুঁড়ো লেগে আছে। দেয়ালের অন্যপাশটাতে দেখতে যাবে হঠাৎই দেয়ালের এটা জায়গাতে হাত বুলাতে গিয়ে খানিকটা মসৃণ মনে হলো তার কাছে। চোখ ফিরিয়ে দেখল লাল দেয়ালের গায়ে এক জায়গাতে একটা পিতলের প্লেট বসানো। ভালোভাবে দেখার জন্য হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল সে। জিনিসটা এমনভাবে এমন জায়গায় লাগানো যে চট করে চোখে না পড়ে। শশী দেয়ালে হাত বুলাতে না থাকলে হয়তো খেয়ালই করত না। কিন্তু এখানে এই পিতলের প্লেট বসানোর কারণ কী। এরকম প্লেট সাধারণত বসানো হয় নাম বা নির্দেশনা লিখে দেয়ালে লাগানোর জন্য। কিন্তু এটাতে সেরকমও কিছু নেই। প্লেটটা দেখে নিয়েই দৌড়ে অন্যপাশের মিনারটাতে চলে এলো সে। ওটার চারিপাশে দেখে নিয়ে সে এরকম কোনো প্লেট দেখতে পেল না।
‘সবাই একটু শুনবেন প্লিজ,’ সবাই তাকিয়ে আছে শশীর দিকে, কিছু একটা সে পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মিনারটার কাছে এসে সে ইশারায় দেখাল প্লেটটা। ‘এখানে এই প্লেটটা দেখেন, এটা এখানে লাগানোর মানে কী?’
পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো সবাই। শারিয়ার প্লেটটার কাছে এসে বসে পড়ল। ‘এ রকম প্লেট তো নাম বা ঠিকানা লেখার জন্য লাগায়।’
‘কিন্তু এটা তো খালি।’
‘হতে পারে এরকম প্লেট অনেক সময় দেয়ালের কোনো কিছু আড়াল করার জন্যও লাগানো হয়। এই যেমন ধরেন ইলেকট্রিক ওয়্যার বা অনেক সময় দেয়ালে গর্ত-টর্ত থাকলেও লাগানো হয়।’
‘আমার মনে হয় এরকম কিছু একটা অবশ্যই আছে এখানে,’ শশী বলে উঠে যোগ করল। ‘এটা মোটেই স্বভাবিক মনে হচ্ছে না আমার কাছে।’
‘খুলে দেখি,’ বলে শারিয়ার গোড়ালি থেকে নিজের কার্বন মেটালের ছুরিটা বের করে এনে ওটার মাথা দিয়ে প্লেটের কোনায় লাগানো বল্টুগুলো খুলতে শুরু করল। একে একে চারটা বল্টু খুলে সে প্লেটটা ধরিয়ে দিল পেছনে দাঁড়ানো শশীর হাতে। কিন্তু প্লেটটার ওপাশের দেয়ালে হাত দিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। কিছুই নেই সেখানে। একেবারে পরিষ্কার নিরেট দেয়াল। ধরে, টোকা দিয়ে, ঘুসি দিয়ে পরখ করল। এমনকি মাথা নামিয়ে কান পেতেও শোনার চেষ্টা করল। কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সবভাবে পরীক্ষা করে সে সোজা হয়ে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শশীর দিকে ফিরে তাকাল। ‘কিছুই তো নেই ওটার পেছনে।’
কিন্তু শশী তার দিকে তাকিয়ে সে তার হাতে ধরো প্লেটটা দেখছে। ওটাকে ভালোভাবে দেখে নিয়ে বাকিদের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর বেশ খানিকটা রাগত ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘ওটার ওপাশে কিছু পাবেও না কারণ যা থাকার এটাতেই আছে,’ বলে সে হাতের প্লেটটা নেড়ে চেড়ে দেখাল।
উত্তেজনার সঙ্গে শশীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বেশ হতাশার সঙ্গে বোর্ডটা দেখে নিয়ে বলে উঠল। ‘এটাতে তো লেখা…’
‘বোকার দল’,’ শারিয়ারের অসমাপ্ত কথাটা ভুবন সমাপ্ত করল। পিতলের প্লেটটার অন্যপাশে ইংরেজিতে যা লেখা সেটার বাংলা করলে এটাই দাঁড়ায়। ‘এ কেমন কথা, এতে কষ্ট করে শেষে… এটা কী ডক্টর আবদেল-’
‘পুরোটাই ছিল একটা ধোঁকা,’ বলে শশী মাথা নাড়ল। ‘আমি বলেছিলাম বাবা এত সহজে—’
‘এই এইখানে কী?’ পেছন থেকে হঠাৎ ধমক শুনে সবাই চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল। নিজেদের কাজে ওরা এতটাই মগ্ন হয়ে গেছিল যে, পেছনে ছাদে কেউ যে এসেছে খেয়ালই করেনি। ধমক শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখল দুজন পুলিশ উঠে এসেছে ছাদে।
‘এই, কথা শোনা যায় না? জিগাইলাম না এইখানে কী করস?’ দুই পুলিশের কড়া সন্দেহের দৃষ্টি ওদের ওপরে। দুজনারই একটা করে হাত পিঠে ঝোলানো শটগানের ওপরে।
পুলিশ দুজনকে দেখামাত্রই সবার প্রথমে সচেতন হয়ে উঠল ভুবন। শশীর একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। চট করে শশীর হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিজের শরীরের পেছনে নিয়ে গেল সে। আলতো করে সোয়েটারের পেছনে ঢুকিয়ে কোমরের কাছে গুঁজে রাখল ওটা। শারিয়ার নিজের একটা হাত নিয়ে গিয়েছিল পিস্তলের বাঁটের ওপরে ভুবন হাতের ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলল তারপর পুলিশ দুজনার দিকে হাত নেড়ে কথা বলে উঠল।
‘কোনো সমস্যা নেই,’ বলে সে এগিয়ে গেল দুই ধাপ সামনের দিকে। আপনারা এখানে মানে…?’
সে প্রশ্ন শেষ করার আগেই খেঁকিয়ে উঠল দুই পুলিশের একজন। ‘আমরা মানে? তোমরা কারা?’ তার গলায় সন্দেহের পারদ আরো এক ডিগ্রি ওপরে চড়ে গেছে।
‘এই সাবধানে কথা বলো,’ ভুবনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে তার পেছন থেকে শারিয়ার এগিয়ে এলো সামনের দিকে। ‘কথা সাবধানে বলবে, আর গলা নিচে নামাও। তোমাদের কারণেই আমাদের এখানে আসতে হয়েছে আবার উঁচু গলায় কথা বলো,’ শারিয়ারের গলার পারদ উঁচু থেকে উচ্চতর হচ্ছে ধীরে ধীরে। ভুবন দেখল বাম হাত কোমরের কাছে। অন্য হাতটায় কিছু একটা ধরে আছে সে। কিন্তু সেটা দেখানোর আগেই একজন পুলিশ কথা বলে উঠল।
‘আমাদের জন্য মানে?’ শারিয়ারের ধমক মারার ধরন দেখে থমকে গেছে সে একটু। গলা খানিকটা নরম করে বলে উঠল। ‘আপনারা কারা?’
শারিয়ার নিজের আইডি কার্ডটা সামনে এগিয়ে দিল। ‘স্পেশাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন,’ লোকটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে শারিয়ারের কার্ড। সেটা শারিয়ার তার সামনে থেকে সরিয়ে নিল। ‘আপনাদের কারণে এখানে আসতে হয়েছে। কারণ আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে আদালত প্রাঙ্গণের ছাদে ছেলেপেলেরা নেশা করে,’ বলে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পুলিশটার দিকে।
পুলিশ লোকটাকে খানিকটা বোকা বোকা দেখাল। সে একবার তার সঙ্গীর দিকে ফিরে তাকিয়ে তাকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল। ‘তাই নাকি? কই এরকম কিছু তো…?’
‘আপনারা শোনেন নাই দেখেই তো আমাদের আসতে হলো। আমাদের কাছে ডিটেইল রিপোর্ট আছে এই আদালত প্রাঙ্গণের কিছু বখাটে ছেলেপেলে সন্ধ্যার পর তো বটেই এমনকি দিনের বেলাতেও এখানে ইয়াবা খায়। ওই যে,’ বলে সে ওরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছিল সেদিককার দরজাটা দেখাল। ‘আমরা সরেজমিনের এসে ওই দরজার তালা ভাঙা পেলাম। তারমানে কী, হ্যাঁ, বলে সে দুই পা এগিয়ে গেল পুলিশ দুজনার দিকে?
‘আপনারা করেনটা কী? আমাদের কাছে আরো রিপোর্ট আছে। এই ছেলেপেলেরাই সন্ধের পর নানা রাস্তায় অন্ধকারের ভেতরে ছিনতাই করে। গত পরশু দিনই তো সন্ধে সাতটার দিকে এক উকিলের টাকা-পয়সা মোবাইল সব নিয়ে গেল। সন্ধে সাতটার সময়! ভাবতে পারো?’ শেষ কথাটা বলে সে তাকিয়ে আছে ভুবনের দিকে।
‘সেইটাই! ভাবাই যায় না,’ ভুবন তার চেয়ে বেশি সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।
দুই পুলিশের দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে অবস্থা দেখে। ‘স্যার, আমরা তো এতকিছু জানি না। আমরা আসছিলাম ওই পাশের বিল্ডিং থেকে রিপোর্ট পেয়ে। ছাদে নাকি কারা ঘুর ঘুর করছে। তাই দেখতে এলাম এইগুলা তো আমরা বলতে পারি না,’ দ্বিতীয় পুলিশ বলে উঠল। ‘আমরা তো ডিউটি করি বিভিন্নজনে,’ সেও সমর্থনের আশায় তার সঙ্গীর দিকে দেখল। সে তাকাতেই লোকটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে সমৰ্থন জানাল।
‘সেইজন্যই এই অবস্থা,’ বলে শারিয়ার ফিরে তাকাল তার সঙ্গীদের দিকে। পুলিশ দুজনেকেই আড়াল করে হাতের ইশারায় এগোতে বলল। ‘এই এলাকায় একটা ক্রাইম হচ্ছে দিনে দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণের মতো এমন জায়গাতে আর এইখানকার ডিউটি পুলিশদের কোনো খবরই নেই। এই হলো অবস্থা,’ বলে সে পুলিশদের দিকে একটা আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আমি এটা আজই রিপোর্ট করব,’ বলে সে বাকিদের সঙ্গে পা বাড়াল বাইরের দিকে। সেই সিঁড়ি ঘরটাতে এসেই তাড়া লাগাল সবাইকে, ‘চলো চলো, জলদি চলো। একবার ধরে ফেলতে পারলে খবরই আছে,’ বলে সবাই প্রায় দৌড়ানোর ভঙ্গিতে পা চালাল বাইরের দিকে।
একেবারে গাড়ির কাছে এসে দরজা খুলে সবাইকে ভেতরে ঢুকতে বলে শারিয়ার আশেপাশে দেখে নিয়ে গাড়ি ছাড়ল। ‘হুফফ, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি। সুমন গাড়ি ছাড়ো।’
‘কিছু পাওয়া গেল, বস?’ সুমন উদগ্রীব সুরে জানতে চাইল।
‘আরে আগে গাড়ি ছাড়ো,’ সুমন গাড়িটা ঘোরাতে শুরু করেছে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কোনো তৎপড়তা চোখে পড়ে কিনা দেখার জন্য শারিয়ার জানালার কাচের ভেতর থেকে আশেপাশে নজর বোলাচ্ছে হঠাৎ সে একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠল। সুমন ততক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে পাহাড়ের নিচে নামতে শুরু করেছে।
আমার মনে হলো সেই চায়নিজ হুয়ানকে দেখলাম,’ শারিয়ার এখনো মাথা বাড়িয়ে পেছনে ফিরে বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক দেখল কিনা লোকটাকে।
‘কী বলছো, এই ব্যাটা পিছু নিল কীভাবে আমাদের?’ ভুবনও ওর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত দেখার চেষ্টা করছে পেছনে। ‘এত দ্রুত খুঁজে পেল কিভাবে আমাদের?’
‘বস, চায়নিজ দেখতে একটা লোক, নীল শার্ট পরা তাই না?’ সামনে থেকে সুমন জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ শারিয়ার বলে উঠল। ‘নীল শার্টই তো মনে হলো। একটা গাড়ির জানালা দিয়ে লোকটাকে দেখলাম মনে হলো।’
শারিয়ারের উদগ্রীব গলায় শুনে সুমন হেসে উঠল, ‘বস, ওইটা হুয়ান না। আমিও ওরে প্রথমে দেখে খুব চমকে গেছিলাম। পরে ভালোভাবে দেখে বুঝলাম এইটা ওই ব্যাটা না।’
‘আচ্ছা,’ স্বস্তির নিশ্বাস শারিয়ারের গলায়। চোখ বন্ধ করে হেলান দিল সে এসইউভির সিটে। ‘এখন কী?’
‘এখন আর কী,’ হতাশ গলায় বলে উঠল শশী। ‘কী করব কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এভাবে বোকা বনে গেলাম। সে হাতে ধরে রাখা পিতলের প্লেটটা দেখছে।
‘ডক্টর শশী, আমার একটা কথা আছে,’ হঠাৎ ভুবন বলে উঠল। যদিও জানি না, কথাটা কতটা যৌক্তিক। বিশেষ করে আমি যখন একেবারেই আপনাদের লাইনের লোক নই। তবুও যেহেতু চট্টগ্রাম শহরটাকে আমি ভালোভাবে জানি, যেটা আপনি বা শারিয়ার স্যার জানেন না সেই হিসেবে একটা ব্যাপার আমার মাথায় খচখচ করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আমি সেটাই পরখ করে দেখছিলাম। সেই ধারণা থেকেই একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’
‘এত ভদ্রতা করে কথা না পেঁচিয়ে বলে ফেলো সোনা,’ শারিয়ার বলে উঠল। সবাই আগ্রহ নিয়ে ভুবনের দিকে তাকিয়ে আছে।
খানিকটা ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল ভুবন। ‘আমি নিজে যেহেতু ডক্টর আবদেলকে চিনতাম না কাজেই তার ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই। তবে গত দুয়েকদিন ধরে তার ব্যাকগ্রাউন্ড শোনার পর থেকে এবং তার কাজ দেখার পর থেকে একটা ব্যাপার আমি বেশ বুঝতে পারছি, অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন তিনি। এই কারণেই উনি যে মডেলটা তৈরি করেছেন উনি খুব ভালোভাবেই জানতেন যে, উনি যতই লুকিয়ে কাজ করুন না কেন, একটা না একটা সময় জিনিসটা কারো না কারো হাতে পড়বেই। তাই পুরো ব্যাপারটাতেই উনি সাজিয়ে রেখেছেন একের পর এক ধোঁকার প্রলেপ।’
‘একদম ঠিক,’ শশী মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
ডক্টর আবদেল পুরো জিনিসটাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যে কেউ চাইলেই এর সমাধান করতে পারবে না। আমরা যখন প্রথম অ্যানালিসিস করছিলাম সেখানে আদালত ভবনের গম্বুজ দুটোর ছবির সঙ্গে লেখা ছিল চট্টগ্রামের প্রথম আদালত। আমরা গুগলে সার্চ দিয়ে চট্টগ্রামের পুরনো ঐতিহ্যবাহী আদালত ভবন দেখে আর ওটার ছবির সঙ্গে ছবি মিলিয়ে লাফিয়ে পড়েছি। কিন্তু তখন ব্যাপারটা মাথায় ঘুরলেও একটা ব্যাপার খচ খচ করছিল মাথার ভেতরে,’ বলে সে সবাইকে দেখে নিয়ে দৃষ্টি স্থির করল শশীর ওপরে। ‘জিনিসটা সমাধান করার উত্তেজনায় এখানে খুব সূক্ষ্ম একটা ব্যাপার আমাদের সবার নজর এড়িয়ে গেছে।
‘ব্যাপারটা কী?’ শশী চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চাইল।
‘আমি বলি?’ ভুবন জবাব দেয়ার আগেই শারিয়ার বলে উঠল, ‘প্রথম আর প্রধান। ঠিক?’ শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘ব্যাপারটা আমার কাছেও মনে হয়েছিল। এখানে লেখা ছিল চট্টগ্রামের প্রথম আদালত। আর আমরা খুঁজছিলাম প্রধান আদালত।’
‘একদম ঠিক বলেছো বস। একটু আগে শশী যখন বলছিল ডক্টর অবদেল ভাষার ধোঁয়াশা তৈরি করতে পছন্দ করত তখন ভালোভাবে জেঁকে বসল বিষয়টা মাথায়, তুমি ঠিক বলেছো, প্রথম আর প্রধান,’ ভুবন মৃদু হেসে বলে উঠল। ‘ডক্টর আবদেলের সাজানো ব্যাপারটা দেখলে যে কেউ তাই ভাববে। আর ওটাই ছিল ফাঁদ। আর তাই আমি একটুখানি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখছিলাম এবং একটা কুও পেয়েছি। জানি না কতটা কাজে লাগবে। টমি ট্যাবটা আবার বের করো।’
‘হ্যাঁ বস, বলো,’ ট্যাব বের করে প্রস্তুতি নিয়ে বলে উঠল টমি।
চট্টগ্রামের পর্তুগিজ স্থাপনা লিখে সার্চ দাও,’ ভুবন বলতে লাগল। ‘প্রথমদিকে যেগুলো আসবে সব বাদ দেবে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখবে অনেক সোর্সের পরে একটা সোর্স আছে যেটার কথা প্রায় সবাই ভুলতে বসেছে। কাগজপত্র তো বটেই এমনকি বাস্তবেও জায়গাটা প্রায় ধ্বংস হওয়ার যোগার। কিন্তু ওইটাই চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন।
টমি ট্যাব ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা লিংক ওপেন করে দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘এটা? তুমি এটার কথা বলছো?’ সে ছবিতে পুরনো একটা ভাঙা স্থাপনা দেখিয়ে বলে উঠল।
‘এটাই,’ ভুবন ছবিটা দেখে নিয়ে জবাব দিল। ‘আমার বিশ্বাস ডক্টর আবদেল এটার কথাই বলেছেন তার পাজলে। আর পরীর পাহাড়ের আদালত ভবনের ছবিটা ছিল একটা হোক্স, মানে ধোঁকা। কিন্তু উনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন এটাই। আমি এটার কথা জানতাম, কারণ আমি ওই কলেজেই পড়াশুনা করেছি। তা না হলে আমার পক্ষেও জানা সম্ভব হতো না।’
‘দেখি দেখি,’ শশী ট্যাবটা প্রায় ছিনিয়ে নিল টমির হাত থেকে। ‘দারুল আদালত নামে পরিচিত জায়গাটা, এটার স্থাপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধরে নেওয়া যায় চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের নির্মাণ করা প্রথম দুর্গ এটা। এমনকি এটার স্থানীয় নামও পর্তুগিজ ভবন,’ বলে সে মুখ ভুলে বাকিদের দিকে দেখল তারপর কী যেন ভেবে একটা চাটি মারল। ‘এটাই, যা বুঝতে পারছি এটা হওয়ার সম্ভবনা অনেক অনেক বেশি। একদিকে পর্তুগিজদের স্থাপনা। আর আমরাও পর্তুগিজদের নিয়েই কাজ করছি। অন্তত একবার হলেও জায়গাটাতে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত। চলো চলো, সবাই চলো।’
‘আরে আস্তে, আগে লাঞ্চ করতে হবে। তারপর আমরা ওখানে যাব,’ শশী যাবার জন্যে অস্থির হলেও শারিয়ার তাকে শান্ত করল। ‘ভুবন আমাদেরকে এমন কোথাও নিয়ে চল যেখানে নিভৃতে খাওয়াও যাবে, কথাও বলা যাবে। খেয়ে পরিস্থিতি বুঝে তারপর আমরা ওখানে যাব।’
‘আমি সেরকম জায়গা চিনি, চলো পাহাড়ি খাবার খাওয়াব তোমাদের।’
***
লাঞ্চ সেরে গাড়িতে উঠে কোথায় যেতে হবে সেটা সুমনকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিল ভুবন। প্রায় ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে ওরা যখন মহসিন কলেজের গেটের কাছে পৌছাল তখন কলেজের গেট দিয়ে দলে দলে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে স্টুডেন্টরা। মনে হয় কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্র,’ ভুবন মন্তব্য করার মতো বলে উঠল। ‘অপেক্ষা করি কিছুক্ষণ।’
‘কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না, শারিয়ার ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে উঠল। ‘ছেলেপেলেদের ভিড়টা একটু হালকা হলেই ফাঁকতালে আমরা ঢুকে পড়ব। কারণ বেশি পাতলা হয়ে গেলে আবার কলেজের গার্ড বা অন্যদের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
ঠিক আছে বস, তাহলে আর দেরি না করে এগোতে থাকি একটু পরেই।’
ভুবনই আগে গাড়ি থেকে নামল। বাকিরা অনুসরণ করল তাকে। গেটের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ওরা। তারপর এক ফাঁকে ভিড় খানিকটা পাতলা হতেই একে একে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সবাই আমার সঙ্গে সঙ্গে আসেন। যদিও এই ঠান্ডার সময়ে সাপখোপ থাকবে না। কিন্তু যেখানটায় যাচ্ছি জায়গাটা খুব একটা ভালো না। কাজেই সাবধান। কলেজের মূল ভবনটা পার হয়ে ওরা চলে এলো নির্দিষ্ট দিকে। তারপর একদিকে বাঁক নিয়ে পুরনো আমলের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠতেই দেখতে পেলে ঘাস, জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে ছাওয়া পুরনো দুর্গের মতো একটা আকৃতি।
‘সর্বনাশ,’ শশী আনমনেই বলে উঠল। ‘এ তো রীতিমতো ভয়াবহ অবস্থা, ‘ কাছে এগোতে এগোতে সে পুরনো আকৃতিটা দেখে বলে উঠল। ‘এত সুন্দর একটা পুরাকীর্তির এই হাল।’
‘আমরা যখন কলেজে ছিলাম তখন থেকেই শুনে আসছি এটা সংস্কার করার জন্য কথা চলছে কলেজ কর্তৃপক্ষের,’ ভুবন আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আজো সেই কথা মনে হয় চলতেই আছে,’ বলে মৃদু হেসে উঠল সে।
বাকিরাও হেসে উঠল তার সঙ্গে সঙ্গে।
‘আরে এতটা নেগেটিভ ভাবেও বলো না প্লিজ,’ বলে শারিয়ার মৃদু হেসে সামনের দিকে দেখাল। ‘দেখো নিচের এই টাইলসগুলো অন্যগুলোর তুলনায় খানিকটা হলেও ভিন্ন আর পরিষ্কার দেখাচ্ছে।’
সেগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে হাতে তালি দিল শশী। ‘সবাই আগের মতো ছড়িয়ে পড়ো। যেকোনো ব্যতিক্রম বা অদ্ভুত কিছু চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ডাক দেবে বাকিদেরকে। আর ভুবন, আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। কারণ এই জায়গাটা আপনিই বাকিদের চেয়ে ভালোভাবে চেনেন।’
‘উই বেটার হারি,’ ঘড়ি দেখতে দেখতে শারিয়ার বলে উঠল। সে আশেপাশের জায়গাটা জরিপ করছিল। সবাইকে সাবধান করে দিয়ে সে নিচের দিকে দেখাল। কম্পাউন্ডে খেলতে থাকা বেশ কিছু ছোটো ছেলেপেলে এসে দাঁড়িয়েছে ওদেরকে দেখতে। ‘এখন এরা এসেছে আরেকটু পরে অথরিটির কেউ চলে এলে কিন্তু আমাদের কাছে কোনো জবাব নেই। কাজেই জলদি করো।’
‘জলদি করতে হবে আরেকটা কারণে, শারিয়ারের কথার সঙ্গে ভুবন যোগ করল। ‘আরেকটু পরেই আজান দেবে, আর মসজিদে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটা এদিক দিয়েই যায়। কাজেই তখন লোকজন আসবেই, দেখবেই। সবাই জলদি জলদি,’ বলে সে সবাইকে তাড়া লাগাতেই একে একে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সবাই।
কিন্তু জলদি বললেই তো আর হয় না। প্রায় দেড় একর জায়গায় পাহাড়ের ওপরে বিরাট দুর্গের মতো বাড়িটা। তবে ওরা পুরো দেড় একর না খুঁজে মূলত বাড়িটার ওপরেই ফোকাস রাখল। প্রাচীন পর্তুগিজ স্থাপনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভবনটা অনেকটা গোলাকৃতির। চারিপাশেই ঝোপঝাড় আর লতানো গুল্মতে ছাওয়া। তবে শীতের সময় বলে ওরা ভেতরে প্রবেশ করল অনেকটা নিশ্চিন্তেই। শারিয়ার শুধু সবাইকে সাবধান করে দিল, যাতে ভাঙা কোনোকিছুতে পা দিয়ে হোঁচট খেয়ে না পড়ে।
ওরা সাবধানেই ভবনের ভেতরে প্রবেশ করল প্রায় বিশ কামরার বিরাট ভবনের নিচের অংশটা যা-ও অনেকটা বাড়ির মতো কিন্তু দোতলাটা আক্ষরিক অর্থেই দুর্গের মতো। এমনকি এক জায়গাতে ওরা কামান বসানোর খোপও দেখতে পেল। সেটা যেদিকে মুখ করে বসানো সেদিকে এখন স্থলভাগ থাকলেও কেন জানি ওদের কাছে মনে হলো ওদিকে একসময় হয়তো কর্ণফুলির সঙ্গে সংযুক্ত কোনো শাখা নদী বা খাল ছিল। এমনকি ওদিকে একটা ঘাটের মতো পুরনো চিহ্নও দেখতে পেল ওরা। পুরো ভবনটার দুপাশে দুটো বিরাট স্তম্ভের মতো আছে। আর ভেতরে প্যাচানো সিঁড়ি আছে তিনটে। ওরা একে একে দুটো স্তম্ভ আর প্যাঁচানো সিঁড়িগুলো পরীক্ষা করে ছাদসহ যেসব কামরায় প্রবেশ করার মতো অবস্থা আছে, সেগুলোও পরীক্ষা করে দেখল কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছুই পেল না। পুরো ভবনটা পরীক্ষা করা শেষ করে ওরা আবারও ওটার বাইরের চত্বরে এসে দাঁড়াল।
যদিও শীতের সময় তবুও সবাই পুরনো ভবনটা ঘুরে দেখতে দেখতে ঘেমে উঠেছে। ‘কিছুই তো পেলাম না, টমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল।
‘তোমার ভুঁড়িটা একটু কমল, সেটাই-বা কম কী, শারিয়ার হেসে বলে উঠল।
‘নাহ, এখানে কিছু পাওয়া তো অসম্ভব মনে হচ্ছে,’ এমনকি পাহাড়ি ছাগলের মতো স্ট্যামিনাওয়ালা ভুবনও মৃদু হাঁপাচ্ছে। কথাটা বলে সে চত্বরের পুরনো একটা পাথরে বসে পড়ল। তার দেখাদেখি বাকিরাও জায়গা করে নিল একাধিক পাথরে।
‘এখন করণীয় কী?’ শারিয়ার প্রশ্নটা করেছে শশীকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু শশীকে দেখে মনে হলো না, সে জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আছে। একদিকে তাকে দেখাচ্ছে ক্লান্ত অন্যদিকে আবার কিছু না পাওয়ার হতাশাও জেঁকে বসতে শুরু করেছে তার চেহারায়। টমির দিকে হাত বাড়িয়ে সে বোতলটা নিয়ে নিল। ‘বুঝতে পারছি না। বিকেল হয়ে আসছে, আবার আসরের আজানও দিয়ে দেবে যেকোনো সময়,’ বলে সে বোতল থেকে পানি ঢেলে দিল গলায়। দুই ঢোক পানি খেয়ে বলতে শুরু করল। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু পেলাম না। এখন এই ভবনের পুরোটা তো দেখা সম্ভবই না। অবার অনেক কামরা আছে যেগুলোতে ঢোকাই সম্ভব নয়। আবার নেটে পড়লাম এখানে নাকি একটা সুড়ঙ্গও আছে। সেটা তো খুঁজে পাবার কোনো সম্ভাবনাই আছে বলে মনে হয় না, বলে সে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল।
‘এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আজ যদি বাই এনি চান্স আমরা কিছু বের করতে না পারি, প্রয়োজনে কাল আসব। প্রয়োজনে অফিসিয়াল কারো কাছ থেকে কথা বলে নথিপত্র বের করে দেখতে হবে। তবে আমার একটা বক্তব্য আছে এখানে,’ বলে শারিয়ার একটা হাত তুলল। ‘তুমি যে ভেতরের কামরা কিংবা সুড়ঙ্গের কথা বললে সেগুলো কিন্তু অনেক পুরনো,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘অনেক বেশি পুরনো। এমন কিছু আমরা খুঁজছি যেটা তুলনামূলক নতুন। কারণ ডক্টর আবদেল যাই করুক বা যেভাবেই ব্লু সেট করে রাখুক সেটা খুব বেশি পুরনো হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু এখানে তো খুব নতুন কিছু দেখলাম না,’ শশী চিন্তিত ভঙ্গিতে মন্তব্য করে উঠল। শশী আরেক ঢোক পানি গলায় ঢেলে কুলকুচি করে পানিটা ফেলে দিল সামনে। যেখানে পানিটা ফেলল সেদিকে কিছুক্ষণ স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, যদি নতুন কিছুর কথা বলো তবে এখানে আসার পর একটাই তুলনামূলক নতুন জিনিস চোখে পড়েছে আমার,’ বলে সে ওদের সামনে এলোমেলো লাগানো টাইলসগুলো দেখাল।
সবাই অবাক হয়ে মাটির দিকে তাকাল। শশী টাইলস বললেও সেগুলো আসলে টাইলস নয়। অনেকটা ভাঙা মাটিতে পোড়ানো টালির মতো। এরকম টালি রঙের টাইলস সাধারণত গ্যারাজে লাগানো হয়ে থাকে। শশী সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল মাটিতে। টাইলসগুলো বসানো হলেও সেগুলোর ভেতর কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। ‘সবাই ছড়িয়ে পড়ে জিনিসগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করো তো।’
‘এক মিনিট,’ টমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলে উঠল। ‘আমি ছাদেও এরকম একটা টাইলস দেখেছি।’
‘আমি একটা নতুন টাইলস দেখেছি দুটা বড়ো স্তম্ভের একটার রেলিংয়ে লাগানো,’ সুমন বলে উঠল।
‘তাহলে অবশ্যই এগুলোর কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা যেটা ভেবেছিলাম এগুলো রেনোভেশনের কাজের জন্য লাগানো হয়েছে আসলে তা-না। এগুলো লাগানো হয়েছে অন্য উদ্দেশ্যে এবং এগুলো লাগিয়েছে ডক্টর আবদেল।’
কিন্তু এগুলোর ভেতরে তো কোনো সামঞ্জস্যতা নেই,’ শারিয়ার পাথুরে মাটির সঙ্গে আটকোনো টুকরো টুকরো টাইলস দেখতে দেখতে বলে উঠল।
‘আছে, অবশ্যই আছে। আমাদের সঠিকভাবে দেখতে হবে,’ শশী ছোটো বাচ্চা মেয়েদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে টাইলগুলো দেখছে। ‘আমাদের স্রেফ সঠিকভাবে দেখতে হবে।
‘এবং আমরা সবাই ভুলভাবে দেখছি জিনিসগুলো,’ ভুবন এতক্ষণ বাকিদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। সে কথা বলে উঠতেই সবাই সেদিকে ফিরে দেখতে পেল সে একটা কাটা নারকেল গাছের গুঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ডক্টর অবদেল লোকটার বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে আমি যতই চিন্তা করছি লোকটার ওপরে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছে। ডক্টর আবদেল যদি এখানে কিছু একটা ব্লু রেখেই যেতে চান সেটা হতে হবে স্থায়ী কিছু, হতে হবে এমন কিছু যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে। আবার যে খুঁজতে আসবে সে যেন খুঁজে পায়। আর একারণেই সে এমনভাবে কিছু একটা সেট করেছে যাতে কেউ বুঝতেও না পারে আবার সবার চোখেও পড়ে।’
‘ভুবন, তুই এত নাটক করতে শিখেছিস, শারিয়ার রাগের সঙ্গে বলে উঠল। ‘থ্রিলার লেখকদের মতো কাহিনি না প্যাচিয়ে মূল কথাটা বল, তুই কী ভাবছিস?’
শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে ভুবন লাফিয়ে নিচে নামল। ‘দেখো জিনিসগুলো এমনভাবে সেট করা যে আমরা খালি চোখে দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা নিজেরা যদি কিছু নিজেদের চোখে দেখতে না পাই তবে কী করি?’ বলে সে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। শারিয়ার আবারও রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ভুবন হাত নেড়ে দ্রুত বলতে শুরু করল।
‘বলছি বলছি, ধরো তোমার দৃষ্টি যদি কম হয় তুমি চোখে চশমা পরবে, যদি তুমি দূরের কোনো জিনিস দেখতে চাও তবে তুমি দুরবিন ব্যবহার করবে…
‘আমাদের ইগলের চোখ থেকে দেখতে হবে,’ ভুবনের কথা শেষ হওয়ার আগেই শশী বলে উঠল।
‘একজনের হেঁয়ালির ঠেলায় বাঁচছিলাম না, এখন আরেকজন শুরু করেছে,’ শারিয়ার রাগের সঙ্গে টমির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। টমিও আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল।
‘আরে বোঝেননি? এখানে যাই সেট করা হয়ে থাকুক সেটা ওপর থেকে একসঙ্গে দেখতে হবে। তাহলেই কিছু একটা বুঝতে পারার সম্ভাবনা আছে।’
শারিয়ার দু-পা সামনে এগিয়ে এলো। ‘আসলেই তো। এই টমি তোর ড্রোনটা আছে না? বের কর।’
‘জি বস,’ বলে টমি কাঁধ থেকে তার ব্যাগটা নামিয়ে জিনিসটা বের করে আনল। ‘আমি জানতাম এরকম একটা পরিস্থিতি দাঁড়াবে, আর তাই তো জিনিসটা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম,’ সুযোগ পেয়ে টমি বাহাদুরি ভঙ্গিতে বলতে শুরু করেছে, শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিল। কিছুক্ষণের ভেতরেই টমি তার ড্রোন সেট করে সেটাকে ফ্লাই করাল। সবাই ভিড় করে এলো তার পেছনে। ড্রোনটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে আর মনিটরে ওটার নিচের ভিউ দেখা যাচ্ছে। শশী আর টমি বসে আছে পাশাপাশি দুটো পাথরে। আর বাকিরা ওদের কাঁধের পেছন থেকে ভিড় করে দেখার চেষ্টা করছে, কী দেখা যায়। ড্রোনের কন্ট্রোলিং ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ড্রোনটা উঠে যাচ্ছে, পুরো চত্বরটা দেখা গেল প্রথমে, তারপর ভবনটার একাংশ। ধীরে ধীরে পুরো ভবন আর ভবন সংলগ্ন এলাকা একসঙ্গে ধরা পড়ল ওদের চোখে।
‘কই কিছুই তো…’
‘এক মিনিট,’ টমি আরেকটু ওপরে তোলো। কিন্তু খুব বেশি না,’ শশীকে দেখে মনে হচ্ছে সে পারলে ঢুকে যায় স্ক্রিনের ভেতরে। ‘ব্যস ব্যস।’
‘সর্বনাশ,’ অস্ফুটে বলে উঠল শারিয়ার। কারণ ড্রোনটা আরো ওঠাতে মনোযোগ দিয়ে দেখতেই ভবনটার চত্বর, ভবনের ছাদ আর উলটোদিকে বসানো টুকরো টুকরো টাইলসগুলোর ভেতরে একটা সাজুয্যতা ধরা পড়তে শুরু করল। আলাদা আলাদাভাবে বসানো টাইলসগুলো ওপর থেকে একসঙ্গে দেখতেই সেগুলোর একটা নির্দিষ্ট আকৃতি ধরা পড়তে শুরু করল। ড্রোন আরেকটু ওপরে ওঠাতেই ধীরে ধীরে সেগুলোর আকৃতিটা পরিষ্কার হয়ে এলো।
‘এগুলো তো নম্বর মনে হচ্ছে।
‘কেউ একজন লেখো তো,’ বলে শশী টাইলসের আকৃতিতে স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নম্বরগুলো একে একে বলে গেল। ‘টমি ড্রোন নামিয়ে ফেলো,’ বলে শশী লেখাটা শারিয়ারের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল। মোবাইলে লেখা নম্বরগুলো ট্যাবে ওপেন না করে গুগলে বসিয়ে কিছু একটা হিসেব করা শুরু করল সে।
‘কীসের নম্বর এগুলো?’
কিন্তু শশী কারো কোনো কথার জবাব দেয়ার অবস্থায় নেই। সে মনোযোগের সঙ্গে হিসেব করতে ব্যস্ত। ‘আরেকটু কাগজ হবে?’ টমি তার দিকে কাগজ এগিয়ে দিতেই সে সেটাতে কিছু একটা লিখল। তারপর আবারও গুগুলে কিছু একটা ওপেন করে সেই নম্বরটা আবারও এন্ট্রি দিল ল্যাপটপে। কাজ সেরে সে ফিরে তাকাল কয়েকজোড়া কৌতূহলী চোখের দিকে।
‘কীসের নম্বর..?’
‘এলোমেলোভাবে বসানো টাইলগুলো আসলে মোটেও এলোমেলো কিছু না। বরং এই টাইলগুলো যেভাবে বসানো সেগুলোকে ওপর থেকে একসঙ্গে দেখলে কয়েকটা নম্বর পাওয়া যায়,’ বল সে টাইলগুলো দেখাল তার গলা স্থির পানির মতো শান্ত শোনাচ্ছে। ‘এই নম্বরগুলো আর্কিলজিস্ট থেকে শুরু করে নাবিকসহ আরো অনেকেই ব্যবহার করত এবং এখনো করে।’
‘কীসের জন্য?’
‘সেটা পরে বলছি। এই নম্বরগুরোকে এটা ফরম্যাটে বসিয়ে সেগুলোকে দুই ভাগ করে এন্ট্রি দিলে দুটো জিনিস পাওয়া যায়। লঙ্গিচিউট আর ল্যাটিচিউড।’
‘সেটা আবার কী?’ টমির প্রশ্ন।
‘অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ। গ্লোবাল পজিশনিং সিষ্টেমে কোনো জায়গার অবস্থান
বোঝাতে ব্যবহার করা হয় এগুলো।
‘একদম ঠিক,’ শারিয়ারের কথা শুনে শশী খুশি হয়ে বলে উঠল। ‘ডক্টর আবদেলের বসানো নম্বরগুলো থেকে হিসেব করে যা পাওয়া গেছে সেটাকে গুগলম্যাপে এন্ট্রি দিলে একটা জায়গারই অবস্থান পাই আমি। সেটা হলো এই অবস্থান,’ বল সে ট্যাবটা উঁচু করে দেখাল সবাইকে। তার গলায় বিরাট কিছু অর্জনের চাপা আনন্দ।
‘কিন্তু যে অবস্থান দেখাচ্ছে সেখানে তো খালি পানি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না…’ টমি বলে উঠল।
‘আছে,’ ভুবন ট্যাবটা দেখতে দেখতে জানাল। ‘ওটা দক্ষিণের সমুদ্রে। সন্দ্বীপ পার হয়ে যেতে হয় জায়গাটাতে। ওখানে প্রাচীন একটা বন্দর ছিল এক সময়। ভীষণ দুর্গম বলে তেমন কেউ যায় না এখন আর সেদিকে। ছোটোবেলায় আমার একবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল,’ বলে সে সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘জায়গাটার একটা পুরনো নাম আছে। জংলাটিলা বলে ডাকা হতো ওটাকে এক সময়।
ডক্টর আবদেলের নির্দেশনা অনুযায়ী মোঘলদের সেই হারানো সম্পদের মিথ খুঁজে পেতে হলে আমাদের যেতে হবে সেখানে।’
সবাই চুপ করে আছে। হঠাৎ প্রাপ্তির আনন্দে নাকি আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায় সেটা বুঝতে পারল না শারিয়ার। ‘আমরা আর সেই বাড়িতে ফিরব না, ঘোষণা দেয়ার মতো করে বলে উঠল সে। ‘ওই বাংলো আর নিরাপদ নয়। পুলিশ হয়তো ইতোমধ্যেই সেটার সন্ধান বের করে ফেলতেও পারে, শত্রুরাও পারে, শেষ কথাটা সে সবার উদ্দেশ্যে বললেও তাকিয়ে আছে একজনের দিকেই। কাজেই আমরা এখান থেকে যাব টেকনাফ। সেখানে আজ রাতে থেকে কাল সকালে যাত্রা শুরু করব গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।’
‘এটার নাম কী দেওয়া যায়?’ হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠল টমি। ‘অপারেশন জংলাটিলা?’
তার দেওয়া নাম শুনে সবাই হতাশার শব্দ করে উঠলেও শশী সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ‘ফলো ইউর হার্ট, হৃদয়ের কাছাকাছি,’ বিড়বিড় করে বলে উঠল সে। ‘ডক্টর আবদেল কী আবিষ্কার করেছিল সেটা জানার সময় চলে এসেছে। একমাত্র জংলাটিলাতেই পাওয়া যাবে সব জবাব।’