মগরাজ – ৪০

অধ্যায় চল্লিশ – বর্তমান সময়

শুক্রাবাদ, চট্টগ্রাম

‘হ্যালো হামিদ চাচা, শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?’ শারিয়ার বিছানা থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু কথা পরিষ্কার বোঝা না যাওয়াতে গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে শুধু পাজামা পরা অবস্থাতেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো ও। হ্যাঁ চাচা, এখন সব ঠিক আছে… কী আর করা বলেন, আমি কী চেয়েছিলাম… না না কোনো অবস্থাতেই আমার চাচাকে জানাবেন না। আমরা সবাই আছি এখানে, আজ বিকেল থেকে কাজ শুরু করব। সবাই এখন বিশ্রামে আছে। ঠিক আছে, এই নম্বরটাই তাহলে থাক। তুমি যোগাযোগ করোনা। কোনো প্রয়োজন হলে আমিই যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে। ঠিক আছে, আর হ্যাঁ হামিদ চাচা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এই মুহূর্তে তুমি সাপোর্ট না দিলে আসলে… আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে,’ বলে হাসতে হাসতে শারিয়ার ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল লম্বা ঝুল বারান্দাটার একেবারে উলটোদিকের একটা দোলনাতে চায়ের কাপ হাতে বসে আছে ডক্টর শশী।

খালি গায়ে থাকার কারণে শারিয়ার খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল। তবুও একটা হাত তুলে সে বলে উঠল, ‘আপনি ঘুমাননি?’

শশী চায়ের কাপে মৃদু চুমুক দিয়ে শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু অতি ক্ষুধায় যেমন বেশি খাওয়া যায় না ঠিক তেমনি অতি ক্লান্তিতেও অনেক সময় বেশি ঘুমানো যায় না,’ বলে সে শারিয়ারে দিকে হাতের চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিল। ‘আপনাদের কেয়ারটেকারের স্ত্রী চা-টা অসাধারণ বানায়।’

শারিয়ার খানিকটা দ্বিধা করছে দেখে সে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। খালি গায়ের মানুষ আমি জীবনে বহু দেখেছি। তবে আপনার শরীরের পুরনো সব কাটাকুটি দেখে অনুমান করতে পারছি কাল রাতে আমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে আপনি যে পাগলামি করেছেন এরকম পাগলামি আগেও বহুবার করেছেন।

শারিয়ার হেসে উঠে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ল শশীর সামনে। তারপর বাড়িয়ে ধরা চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে আনমনে মাথা নাড়ল। আমি ঠিক চা-কফি এসবের ভক্ত নই। তবুও ভালো লাগল খেতে। আমি আসলে চা-কফি খাই সিগারেট খাবার জন্য, ওগুলো খেলে পরে বিড়ি খেতে ভালো লাগে সেকারণেই খাওয়া।’

‘এই বাড়িটা কী আপনার?’ শশী বাড়িটা ইশারায় দেখিয়ে জানতে চাইল। ‘এমন এলাকায় এরকম একটা বাড়ি থাকাটা দারুণ একটা ব্যাপার, তাই না?’

শারিয়ার চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে আনমনে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘বাড়িটা ঠিক আমার না। দারুণ ব্যাপার বলছেন! আমি তো আজকের আগে জানতামই না যে এরকম একটা বাড়ি আছে আমাদের?’ বলে সে চায়ের কাপটা ফেরত দিল শশীকে।

নিজেদের এরকম একটা বাড়ি আছে জানেনই না। আপনারা কী অনেক বড়োলোক নাকি?’

শারিয়ার হেসে উঠল শশীর প্রশ্ন শুনে। ‘অনেক বড়োলোক কি না, কিংবা কত সম্পদ আছে আমাদের সেসব আমি জানি না। জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি কোনদিন। তবে হ্যাঁ, আমাদের পরিবার দেশের সেরা সম্পদশালী পরিবারগুলোর ভেতরে একটা হবে মনে হয়।’

শশীর চোখের দৃষ্টি অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছে। ‘তাহলে আপনি পুলিশের চাকরি করেন কোনো দুঃখে?

‘পরিবারের সম্পদ তো পরিবারের। আমার নিজের অর্জন হলো একান্তই আমার। আমার কী আছে কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে আমি কী পেয়েছি সেটার চেয়ে বড়ো কথা হলো আমি নিজে কী অর্জন করতে পেরেছি নিজের যোগ্যতা দিয়ে। আসলে,’ শারিয়ার ফিরে তাকাল সামনের খোলা দিগন্তের দিকে। ‘এগুলোও ব্যাপার না। আমি আসলে এতকিছু ভাবিওনি। আমি হলাম অনেকটা পাগলা ঘোড়ার মতো। ছুটে চলেছি আর ছুটে চলেছি সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে। কিন্তু কীসের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছি ঠিক নিজেও জানি না। আর তাই কীসের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছি সেটা বোঝারও চেষ্টা করি না এখন। বরং ছুটে চলাটাই জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে গেছে।’

মনের গহিন কোণে আমরা সবাই খানিকটা ওরকমই। কেউ কেউ আপনার মতো ছুটে চলতে পারে, আর কেউ কেউ পরিবার সমাজ দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতার বন্ধনে বাঁধা পড়ে। এই যা পার্থক্য, শশীর গলায় অনেকটা স্বগোতোক্তির সুর। মূল কথা হলো তাড়না, কীসের এক তাড়নায় যেন ছুটে চলেছি আমরা পুরো মনুষ্য সমাজ। সময় থেকে সময়, যৌবন থেকে বার্ধক্যে সবাই ছুটেই চলেছে। হয়তো আপনার মতো আসলে আমরা কেউই জানি না, কেন ছুটে চলেছি সবাই।’

‘তবে আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি। এই কাজটা আমি উপভোগ করি। এই পেশায় উত্তেজনা আছে, ঝুঁকি আছে। সব চেয়ে বড়ো কথা কখনো কখনো তদন্তে নেমে কোনো একটা জটিল কেস অ্যানালিসিস শুরু করি তখন সেটার কোনো তুলনা নেই। বলতে পারেন এটাই আমার তাড়না,’ বলে শারিয়ার শশীর বাদামি চোখের গভীরে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘আপনার তাড়নাটা কী?’

শশী ওর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বারান্দার দরজার কাছ থেকে কেয়ারটেকার বলে উঠল, ‘স্যার, বেলা তো অনেক অইলো, খাবার দিয়া দিমুনি?’

শারিয়ার তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মোবাইলে সময় দেখল। বেলা প্রায় তিনটে বাজতে চলেছে। ‘এক কাজ করো, আগে সবাইকে ডাকো। একেবারে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসতে বলো। তারপর খাবার দাও,’ বলে শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘দেখা হচ্ছে তাহলে খাবার টেবিলে,’ বলে নিজের জন্য বরাদ্দ কামরায় চলে এলো শারিয়ার। সময় নিয়ে গোসল সেরে কাপড় পালটে ডাইনিং রুমে এসে দেখল প্রায় সবাই পৌঁছে গেছে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল সবাই।

‘সুমন কোথায়?’ সুমনকে কোথাও না দেখে জানতে চাইলে শারিয়ার। ‘খেতে খেতেই আমরা আলোচনা সেরে নেব। টমি, তুই সুমনকে ডেকে নিয়ে আয়।’

কিছুক্ষণের ভেতরেই সবাই খাবার টেবিল জড়ো হতেই খেতে খেতে অলোচনা চালিয়ে গেল ওরা। সবার আগে কথা বলে উঠল শারিয়ারই। ‘সবাইকে এখন মোটামুটি মানুষ দেখাচ্ছে আগের চেয়ে, শারিয়ার দেখল অন্তত কিছুটা বিশ্রাম পাওয়াতে সবার চেহারা খানিকটা হলেও ফ্রেশ দেখাচ্ছে এখন। তবে সবার পরনে বাড়িতে যেসব ছিল সেসব উলটো-পালটা পোশাক পরাতে সবাইকে বেঢপ দেখাচ্ছে।

সবচেয়ে অদ্ভুত লাগছে টমিকে। বিশাল সাইজের একটা ফতুয়ার মতো কিছু একটা পরেছে সে। সেটাতে তাকে লাগছে ম্যাক্সিপরা মধ্যবয়স্ক কোনো মহিলার মতো। ‘বাহ, টমি তোকে তো ম্যাক্সিটায় মানিয়েছে বেশ,’ কথাটা বলতেই সবাই হেসে উঠল।

‘সবাই মন দিয়ে শোন যা বলি। আমরা আমাদের আলোচনা ডক্টর শশীর বাবা মানে ডক্টর আবদেলের পাঠানো চিঠি থেকে শুরু করব। কিন্তু সেটার আগে আমি দুয়েকটা কথা বলে নেই। এই বাড়িতে এই মুহূর্তে আমরা একদম নিরাপদ আছি। কিন্তু কতক্ষণ থাকতে পারব সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এই বাড়ির সন্ধান পুলিশ কিংবা অন্য কারো জন্য জানাটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের সেই নীল মাইক্রো লুকিয়ে ফেলা হয়েছে গ্যারেজে। এর বদলে এখন থেকে আমরা সাদা একটা এসইউভি ব্যবহার করব। সেই সঙ্গে আমার কাছে একটা মোবাইল আছে, আমি চাচ্ছি না এটা বাদে অন্য কারো কাছে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা থাক। আর হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। এই বাড়ি যেহেতু অথরিটি কিংবা শত্রুপক্ষের জন্য বের করাটা অত কঠিন নয় কাজেই এখানে আমরা খুব বেশি সময় অপেক্ষা করব না। বড়োজোর আজকের রাতটা এখানে কাটাব। এরপরে আমাদের এখান থেকে সরে পড়তে হবে, খাবার প্লেটে তুলে নিতে নিতে শারিয়ার বলে উঠল। ‘আমার মনে হয় এখন আমরা ডক্টর শশীর বক্তব্য শুনতে পারি। শশী, আপনি বলুন আপনার বাবার চিঠিতে কী ছিল এবং এরপরে আপনি দেশে আসার পর কী হলো?’

শশী খেতে খেতেই কথা চালিয়ে যেতে লাগল। ‘আগেই বলেছি আমার বাবাকে আমি গত বেশ কিছু দিন যোগাযোগের চেষ্টা করে বাদ দিয়েছিলাম এরপরে প্রায় তিনবছর বাবার সঙ্গে যোগোযোগ নেই। তাই তিন বছর পর হঠাৎ যখন বাবার পার্সেল আমার অফিসে পৌঁছাল স্বাভাবিকভাবেই আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তো বাবার চিঠি খুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে বিস্তারিত জানতে পারল, বাবা আসলে কী নিয়ে গবেষণা করছিল,’ এইটুকু বলে সে একটু থেমে একেবারেই আচমকা জানতে চাইল, ‘আপনারা জলদস্যুদের ব্যাপারে কী জানেন?’

‘অবশ্যই জানি,’ অন্য কেউ জবাব দেয়ার আগে টমিই বলে উঠল টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে। ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান আমার ফেভারেট সিনেমা ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর একটা। উফফ জনি ডেপ যা…’

‘আমি ক্যারিবিয়ানের পাইরেটস নয় বরং আমাদের এই বাঙ্গাল মুলুকের পাইরেটস বা জলদস্যুদের ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম। আপনাদের কারো আইডিয়া আছে বাঙাল মুলুকের ঐতিহাসিক জলদস্যুদের ব্যাপারে?’

‘বাঙাল মুলুকে আবার জলদস্যু আছে নাকি?’ ভুবন মুখভর্তি খাবার নিয়ে বলে উঠল। ‘ভূমিদস্যু আছে জানতাম। কিন্তু জলদস্যু আছে, সে তো জানতাম না

শশী হেসে উঠল তার কথা শুনে। ‘কেন মগ জলদস্যুদের কথা শোনেননি? ঢাকার মগবাজার তো মগ জলদস্যুদের নামেই।’

‘তাই নাকি এটা তো জানতাম না। মগবাজার কে না চেনে, কিন্তু এটা যে মগ জলদস্যুদের নামে সেটা তো জানতাম না,’ এবার শারিয়ার কথা বলে উঠল। ‘তো ওরা কী ওখানে জলদস্যুগিরি করত নাকি?’ তার গলায় খানিকটা টিটকিরির সুর।

‘আপনাদের সবার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, মগবাজার জায়গাটা মগ জলদস্যুদের নামেই নামকরণ করা হয়েছে,’ বলে সে শারিয়ারের দিকে একটা চামচ তাক করে বলে উঠল, ‘মগরা ওখানে জলদস্যুগিরি করত না। কিন্তু ওদের একটা অংশকে জলদস্যুগিরি থেকে মাফ করে ঢাকার ওই বিশেষ এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যেকারণে ওরা ওখানে বাস করত। আর বর্তমানে যেখানে মগবাজার সেখানে ওদের বিরাট একটা বাজার ছিল ওদের বাজারের নামেই এলাকাটার নামকরণ হয়েছে মগবাজার।’

‘তা এই মগদের সঙ্গে আপনার বাবার কী সম্পর্ক?’ শারিয়ার প্রশ্ন করল। ‘উনি কী মগদের পিছু নিয়েছিলেন নাকি?’

‘ব্যাপারটা খানিকটা হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু সত্যি কথা হলো, অনেকটা তাই। সে আসলে ভারতবর্ষের জলদস্যুদের নিয়েই কাজ করছিল। সে এবং তার পার্টনার প্রফেসর ইফতেখার আবদুল্লাহ,’ বলে সে টমির দিকে তাকিয়ে একটা আঙুল তুলল। ‘মিস্টার টমি আপনি যে ক্যারিবিয়ানের পাইরেটস নিয়ে কথা বলছিলেন না, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো পৃথিবীব্যাপী মডার্ন পপ কালচারে সিনেমা থেকে শুরু করে গেইম, মিউজিক থেকে শুরু করে বই, সবখানে পাইরেটস বলতেই বলা হয়ে থাকে ক্যারিবিয়ানের পাইরেটদের কথা। কত শত সিনেমা নির্মাণ হয়েছে এদেরকে নিয়ে। কত শত গল্প উপন্যাস আর ফিকশন লেখা হয়েছে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক, মরগান থেকে শুরু করে ব্ল্যাকবিয়ার্ডসহ বিভিন্ন জলদস্যুদের নিয়ে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে যখন থেকে ইউরোপিয়রা আসতে শুরু করে এর পরের একটা লম্বা সময় ধরে চলেছে জলদস্যুদের উৎপাত। আমাদের এখানেও ইউরোপিয় জলদস্যু থেকে শুরু করে স্থানীয় মগ আরাকানি জলদস্যুদের বিস্তারিত ইতিহাস রয়েছে কিন্তু এর তেমন কোনোটাই সেভাবে উঠে আসেনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা সিনেমাতে। মোদ্দা কথা একরকম বলতে গেলে এরা প্রায় বিস্তৃতির আড়ালেই হারিয়ে গেছে।’

‘এর পেছনে কারণ কী?’ শারিয়ার খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে সবাইকে লিভিংরুমে যেতে বলল, সেই সঙ্গে কেয়ারটেকারকে বলল চা-কফি সার্ভ করতে। সবাই খাওয়া শেষ করে লিভিংরুমে চলে এলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শশী আবারও বলতে শুরু করল তার বয়ান।

‘আপনি যে প্রশ্নটা করলেন শারিয়ার, সেটার জবাব খুঁজে বার করাই ছিল আবার বাবার গবেষণার প্রাথমিক একটা অংশ। এখন একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার যে পাঁচ বছরের গবেষণার প্রক্রিয়ার ফলাফল তো আর পাঁচ মিনিটে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। বাবা চিঠিতে আমাকে যেটা লিখেছিল সেখানে সে বলেছিল সে আর তার পার্টনার প্রথমে একটা সময় ধরে এটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং তারা এর উত্তর বের করতেও সমর্থ হয়,’ শশী এই পর্যন্ত বলে শারিয়ারের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আপনাদের কাছে সিগারেট আছে?’

শারিয়ার নিজে একটা ধরিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল শশীর দিকে। ‘যেটা বলছিলাম, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দস্যুদের জনপ্রিয়তা আর ভারতীয় অঞ্চলের দস্যুদের বিস্তৃতির পেছনে একটা কারণ তারা খুঁজে বের করতে পেরেছিল। স্প্যানিশ মেইন, মানে আপনারা যেটাকে বলেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, সেখানে জলদস্যুতা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল প্রচুর পরিমাণে গোল্ড বা স্বর্ণের ব্যাপার। এর পেছনে একটা কারণও ছিল। স্প্যানিশ অধ্যুষিত ক্যারিবিয়ান অঞ্চল সেটাতে মূলত জলদস্যু ছিল তিন ধরনের। আর ওখানে যেসব ব্যবসা বা অন্যান্য কার্যক্রম চলত সেগুলোর মূল্যস্বরূপ প্রচুর পরিমাণে সোনা বা স্বর্ণের কয়েন, মানে মোহর ব্যবহার হতো। এসব সোনা আবার আসত দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিশ অধ্যুষিত এলাকার বিভিন্ন খনি থেকে। এর ফলে যেটা হতো, ওখানে ব্যবসা বা লাভ যাই হোক না কেন সেটার প্রাপ্তিস্বরূপ পাওয়া লাভের অংশ হয় সোনায় লেনদেন হতো আর না হয় লেনদেনের পর কনভার্ট করা হতো সোনায়। এইসব সোনা আবার জাহাজভর্তি করে পাচার করা হতো ইউরোপে। জলদস্যুদের আক্রমণের টার্গেট থাকত এইসব জাহাজগুলো। জাহাজ লুট হোক, আর যাই হোক, এসব সোনার আবার একটা বড়ো অংশ লুকিয়ে রাখত জলদস্যুরা বিভিন্ন জায়গায়। এর ফলে ক্যারিবিয়ানের জলদস্যুদের মিথ লেজেন্ডগুলোর একটা বড়ো অংশ গড়ে উঠেছে এসব লুকানো সোনা, অভিশাপ, ডুবন্ত সোনা ভর্তি জাহাজ এসব নিয়ে। যা অনেক বেশি আকর্ষণীয় মানুষের কাছে। অন্যদিকে ভারত উপমহাদেশের দস্যুতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল অনেকটাই ভিন্ন। এখানকার জাহাজ বাণিজ্য এবং জলদস্যুতা অনেকটাই ছিল বিভিন্ন পণ দ্রব্যাদি নিয়ে। যেমন ধরেন, মসলা।’

‘মসলা?’ শশী থামতেই ভুবন বলে উঠল। ‘মসলার জন্য জলদস্যুতা?’ অবাক কণ্ঠে বলে উঠল সে। বাকি সবাই কিছু না বললেও সবাই উৎসুক এবং খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘সবাইকে একটা কথা জানাই, এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধগুলোর বেশ কয়েকটাই হয়েছিল এই মসলার বাজার দখল করার জন্য। মসলার জন্য। ইউরোপিয়রা এই উপমহাদেশে এসেছিল এই মসলার জন্যই। এক অর্থে বলতে গেলে আমাদের এই উপমহাদেশের দীর্ঘ শাসন এবং শোষণের ইতিহাস শুরু হয়েছিল এই মসলা থেকেই। আর জলদস্যুতা তো অনেক ছোটো ব্যাপার,’ শশী ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল। ‘যাই হোক, এরকম এলোমেলোভাবে না বলে আমি বরং আরেকটু গুছিয়ে এবং সংক্ষেপে বলি। আমি যখনকার কথা বলছি সেই চতুর্দশ শতকে তখন ইউরোপ অনেকদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্য, ভারতবর্ষ কিংবা দূরপ্রাচ্য অর্থাৎ চায়না থেকে। তখন একরকম বলতে গেলে বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল মধ্যপ্রাচ্য। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের লোকজনই সমুদ্রপথে ভারতবর্ষ, চায়না থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার জাভাসহ আরো অনেক জায়গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে তারাই স্থলপথে বা জলপথে জিনিসপত্র ইউরোপে সাপ্লাই করত। যে কারণে ইউরোপের লোকজনের অনেক চড়া মূল্যে সেগুলো কিনতে হতো। আপনারা তো শেক্সপিয়রের নাটক পড়েছেন, মার্চেন্ট অব ভেনিস। ভেনিসের মার্চেন্ট নিয়েই কেন গল্পটা? কারণ ভেনিস ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাওয়া পণ্যের সবচেয়ে বড়ো বাজারগুলোর একটি, তাই বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ওটা বেশ বড়ো ছিল, আর তাই ভেনিস নিয়ে অনেক গল্পও প্রচলিত ছিল। ইটালির ভেনিসে যেসব জিনিসের লেনদেন হতো তার ভেতরে অন্যতম একটি পণ্য ছিল মসলা। যেটা সবচেয়ে ভালো উৎপন্ন হতো ভারতে। আর মসলার অপরিসীম চাহিদা ছিল ইউরোপে। কারণ লম্বা শীতের সময়ের জন্য তারা মাংস মজুদ করে রাখত এবং সেটাকে স্বস্বাদু করার জন্য দরকার হতো গোলমরিচের মতো মসল্লার। এই মসল্লার মার্কেট পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত মধ্যপ্রাচ্য। আর সেটা করতও খুব চড়া দামে। ইউরোপিয়রা একসময় অনুধাবন করতে পারে তাদের যেকোনো উপায়ে ভারতের জলপথ আবিষ্কার করতে হবে। এই আবিষ্কারের পেছনে অনেক লম্বা ইতিহাস আছে। তবে এক বাক্যে বলতে গেলে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হয়।

‘এখানে একটা কথা বলি। এই ভাস্কো দা গামা সাহেবকে ইতিহাসে যেভাবেই চিত্রিত করা হোক না কেন ইনি কিন্তু খুব ভালো মানুষ ছিল না। বলতে গেলে এই লোক ছিল জলদস্যু। এই লোক একসময় এই উপমহাদেশের মানুষদের ওপরে অপরিসীম অত্যাচার চালিয়েছে। সেই ইতিহাসে আমি যাব না। তবে এই লোক ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কারের পর ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপিয়রা আসতে শুরু করে এবং বাণিজ্য বিস্তার করে। ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার পরিবর্তিত হয়ে ইউরোপের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এরপর আরো বেশি পরিমাণে মানুষ ভারতবর্ষে আসা শুরু করে। পর্তুগিজরা প্রথমে এলেও পরে আসে ওলন্দাজ মানে ডাচরা, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশরা এবং সবশেষে আসে ইংরেজরা। ইংরেজদের আগে একটা লম্বা সময় ভারতে আধিপত্য বজায় রেখেছিল পর্তুগিজরাই। অসাধারণ নাবিক পর্তুগিজরা একরকম বলতে গেলে ভারতের গোয়া থেকে ওদিকে হুগলী হয়ে আমাদের চট্টগ্রাম-আরাকান মানে বর্তমান মায়ানমার হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা পর্যন্ত সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করত। এই সময়ে পর্তুগিজদের ভেতরে যারা ভারতবর্ষে এসেছিল এদের অনেকেই ছিল ভয়ংকর দস্যু। এরাই উপকূলজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সমুদ্রপথে এদের আধিপত্যের সামনে এমনকি মোঘলরাও ছিল অসহায়।

‘বাঙ্গাল মুলুকে পর্তুগিজদের আগমনের অফিশিয়াল তারিখ সম্ভবত ১৫১৮। সেই হিসেবে ২০১৮ সালকে বলা হয়ে থাকে বাংলায় পর্তুগিজ আগমনের পাঁচশ বছর পূর্তির বছর। সম্ভবত ১৫১৭ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়াল একজন ব্যবসায়ীকে বাঙ্গাল মুলুকে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু পিরেস নামে সেই লোক নিজে না এসে পরের বছর মানে ১৫১৮ সালে জোয়াও কোয়েলো নামে আরেকজনকে চারটে জাহাজ দিয়ে বাংলায় পাঠান। কারণ ততো দিনে ইউরোপিয়দের নজর মসলা ছাপিয়ে বাংলার মসলিন থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিসের ওপর পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু ওই সময়ে জোয়াও বাংলায় এলেও সে চট্টগ্রামে নেমে খুব বেশি সুবিধে করতে পারেনি। কারণ বাংলার শাসকরা তখন অনেক সবল ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অবশেষে পর্তুগিজরা গ্যাট হয়ে বসে এখানে। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনের সময়ে গিয়াসউদ্দিন যখন শেরশাহের আক্রমণে বিপর্যস্ত তখন পর্তুগিজরা তাকে সহায়তার নামে শুল্ক আদায়ের অনুমতি নিয়ে নেয়। এরপরে একসময় এমনকি চট্টগ্রাম দখল করে বসে এবং শুরু হয় তাদের লুটপাট।

‘পর্তুগিজরা ছিল নৌবিদ্যায় পারদর্শী। তাই খুব সহজেই চট্টগ্রাম, আরাকান হুগলী থেকে শুরু করে সপ্তগ্রাম তো বটেই এমনকি মক্কাগামী জাহাজও তারা লুট করতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে আবার যোগ দেয় আরেক ডাকাতদল আরাকানের মগরা। সবমিলিয়ে এরা কায়েম করে মগের রাজত্ব। যেখান থেকেই এসেছে মগের মুলুক কথাটা। আর আমাদের গল্পও এই মগরাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের গল্পও শুরু হয় এই মগরাজ থেকেই।’

‘মগরাজ?’ শারিয়ার একটা ভ্রু তুলে জানতে চাইল। ‘আপনার বাবার গবেষণার সঙ্গে মগরাজের সংশ্লিষ্টতা কোথায়?’

‘বলছি। পর্তুগিজরা মগদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিরাট বিরাট বাহিনী বানিয়ে শুধু জাহাজ লুটতরাজেই সন্তুষ্ট ছিল না। একটা সময় সবচেয়ে বাজে একটা কাজ তারা শুরু করে। সেটা হলো মানুষ লুট করা। বাংলার মানুষ সবসময়েই তুলনামূলক শান্তিপ্রিয় আর অরক্ষিত। আর তাই নদীবিধৌত এলাকা হওয়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে নদীর আশেপাশের এলাকা পর্যন্ত এইসব লুটেরারা নিজেদের জালিয়া জাহাজ আর নৌকা নিয়ে হানা দিত আর গ্রাম থেকে শুরু করে স্থানীয় বাজার পর্যন্ত লুট করত মানুষ। এরা ছিল অসম্ভব নিষ্ঠুর। এদের মানবতা বলে কিছু ছিল না। এরা যেখানেই হানা দিতো গ্রামকে গ্রাম, বাজারকে বাজার জ্বালিয়ে দিত। আর মানুষদের ধরে নিয়ে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করত আরাকান, হুগলীসহ নানা বাজারে। এসব চলছিল, এমন সময় বাংলার সুবাদার হয়ে অসে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা। তার সময়েই বাংলা সবচেয়ে সুখে ছিল। কিন্তু শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে তার ছেলেদের ভেতরে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই।’

‘মগরাজ থেকে সোজা মোঘল দরবারে?’ ভুবন টিপ্পনী কাটল।

‘একদম। শাহজাহানের ছিল তিন ছেলে। শাহ সুজা ছিল বাংলার সুবাদার, দারা শিকো ছিল তার বাবার সঙ্গে। অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণে ছিল আওরঙ্গজেব। শাহজাহানের অসুস্থতার খবর শুনে শাহ সুজা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে এবং তার ভাই দারা শিকোর কাছে বাহদুরপুরের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটে। কিন্তু অন্যদিকে দারা শিকোকে পরাজিত করে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আরোহণ করলে সুজা আবারও অভিযান চালিয়ে এবার আওরঙ্গজেবকে পরাজিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিফল হয়ে বাংলায় ফিরে আসে। তার পেছনে তখন বিরাট মোঘল ফৌজ। বাংলায় তার অসংখ্য মিত্র থাকলেও সে জানত এরা তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই সে চট্টগ্রাম দখল করে রাখা মগদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা তাকে অর্থের বিনিময়ে পরিবার-পরিজন আর বাহিনীসহ আরাকানে দিয়ে আসে। আরাকানের রাজা সুজাকে বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করে নেয়। কথা ছিল সে তাকে সুবিধেমতো মক্কায় যাওয়ার জাহাজে তুলে দেবে। কিন্তু সেটা না করে আরাকানের ‘দুষ্টু’ রাজা শাহ সুজাকে পরিবারসহ হত্যা করে।’

‘কেন?’ অনেকক্ষণ পরে টমি জানতে চাইল। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল শশীর বলা কাহিনি। শারিয়ার তাকিয়ে দেখলা সুমন একদম চুপ এবং তাকে খানিকটা অন্যমনস্কও দেখাচ্ছে।

‘অত্যন্ত ভালো প্রশ্ন, কেন তাকে হত্যা করতে যাবে। এর পেছনে অনেক ঐতিহাসিকের অনেক যুক্তি আছে। অনেকেই বলে রাজা আসলে শাহ সুজার সুন্দরী কন্যার প্রেমে পড়ে গেছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সত্য কথা হলো, সে কাজটা করেছিল শাহ সুজার সঙ্গে থাকা বিপুল পরিমাণ মোঘল সম্পদ দখল করার জন্য।’

‘সাংঘাতিক তো। কী ছিল সুজার সঙ্গে?’ ভুবন জানতে চাইল। বোরিং ইতিহাস শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। এবার সে কিছুটা আগ্রহবোধ করতে শুরু করেছে।

শশী হেসে উঠল তার দিকে ইশারা করে সে বাকিদের দিকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘এখন সবাই পার্থক্যটা দেখতে পাচ্ছো তো? ভুবন আমার কথা শুনতে শুনতে হাইম ছাড়ছিল কিন্তু যেইমাত্র আমি স্বর্ণ আর সম্পদের কথা বললাম সেও আগ্রহ বোধ করতে শুরু করল।’

শারিয়ারও হেসে উঠল শশীর কথায়। ‘এ-কারণেই ক্যারিবিয়ানের পাইরেটসরা এত বিখ্যাত। কিন্তু আমাদের বেচারা জলদস্যুরা মসলা আর মানুষ বেচে আর কত বিখ্যাত হবে?’

‘ইতিহাসের এই অংশটুকুই বের করতে যাচ্ছিল ডক্টর সুলতান মানে আমার বাবার গবেষণা। সে দেখাতে যাচ্ছিল যে মোঘলদের হারিয়ে যাওয়া সম্পদের একটা বিরাট অংশের যোগ আছে মগ আর পর্তুগিজ দস্যুদের ইতিহাসের সঙ্গে। এখন প্ৰশ্ন হলো, কী ছিল শাহ সুজার সঙ্গে। সেটা আসলে পুরোপুরি বলা সম্ভব নয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে সাত রাজার সম্পদ যেটাকে বলে সেটাই ছিল তার সঙ্গে। এমনকি এরকমও কথিত আছে যে শুধু মোঘল নয় এমনকি বারো ভূঁইয়াদের সম্পদেরও একটা বিরাট অংশ ছিল শাহ সুজার সঙ্গে। এগুলো টুকরো টুকরো ইতিহাসের বিভিন্ন মিথ। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে বাস্তবের তেমন কোনো সংযোগ পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর সময় নিয়ে এইসব হারানো টুকরোগুলোকে একসঙ্গে করে ডক্টর আবদেল আর তার পার্টনার ইফতেখার আবদুল্লাহ মিলে যে চিত্রটা দাঁড় করিয়েছিল সেটা অনেকটা এমন; অরাকানের রোসাঙ্গে বর্মী রাজার বাহিনী শাহ সুজার পরিবারকে মেরে ফেললেও শাহ সুজার বাহিনীর একটা অংশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপরের অংশটা একেবারেই ঘোলাটে। কেউ বলে শাহ সুজার খুব কাছের একজন নাকি পুরো সম্পদ নিয়ে রোসাঙ্গের ওই জঙ্গল থেকে পালিয়েছিল। আবার কেউ বলে রোসাঙ্গের রাজা আসলে শাহ সুজাকে মারতেই পারেনি। আবার কেউ কেউ বলে শাহ সুজা রোসাঙ্গে যাওয়ার অনেক আগেই বাংলার বুকেই তার নিজের লোক এবং বারো ভূঁইয়াদের সহায়তায় সম্পদটা বাংলাদেশেরই কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিল। আসলে সে নাকি সম্পদগুলো রোসাঙ্গে নিয়েই যায়নি ইত্যাদি। এগুলো সবই মিথ, সবই প্রচলিত কিন্তু কোনোটাই প্রমাণিত নয়। তবে এসব থেকে যেটা ধরে নেয়া যায় সেটা অনেকটা এ রকম; রোসাঙ্গের রাজা সম্ভবত শাহ সুজার সঙ্গের সবাইকে মারতে পারেনি। সম্ভবত শাহ সুজার খুব কাছের কেউ একজন সেখান থেকে সেই বিপুল পরিমাণ ধনরাশি নিয়ে পালিয়ে চলে আসে,’ বলে সে একটু থামল। সবার দিকে একে একে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ডক্টর আবদেল ইতিহাসের সেই হারানো অংশ খুঁজতে গিয়ে সম্ভবত সেই বিপুল ধনরাশির সন্ধান বের করেছিল,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘আর সেই বিপুল ধনরাশি সম্ভবত এই বাংলার বুকেই কোথাও লুকানো আছে।’

শারিয়ার চমকে উঠে তাকাল তার দিকে। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘মোঘলদের হারানো সম্পদ!’ আনমনেই বলে উঠল শারিয়ার।

‘শুধু মোঘল নয়, এমনকি বারো ভূঁইয়াদেরও। হ্যাঁ, এই ব্যাপারটারই প্রাথমিক প্রমাণ লোকজনকে যখন আবদেল দিতে যায় তখন তারা হেসেই উড়িয়ে দেয়। সে সিরিয়াসলি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলে এক পর্যায়ে তাকে পাগল অভিহিত করে তার লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়। মনে হয় কেউই আবদেলের ওপরে ভরসা করেনি, তাকে বিশ্বাস করেনি। এমনকি আমিও না,’ বলে শশী দীর্ঘ-নিশ্বাস ছাড়ল। শারিয়ার মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজের চোখাগাঁফের কিনারায় হাত বুলাচ্ছে।

‘এরপরে সম্ভবত আবদেল মানে বাবা,’ বলে শশী আরেকবার বড়ো করে দম নিলো। ‘এরপরে সে যা করে সেটা আনইথিক্যাল ছিল। কিন্তু সে অথরিটির ওপরে এতটাই রেগে গেছিল এবং ব্যাপারটার সমাধান করার জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, এটাই তার কাছে ঠিক মনে হয়।’

ডক্টর আবদেল রেলিক নামে বিদেশি একটা চক্রের সহায়তা কামনা করেন, ‘ শারিয়ার আনমনেই বলে উঠল।

‘ঠিক। সম্ভবত তাদের সহায়তাতেই সে ব্যাপারটার একটা সুরাহা করার চেষ্টা করে। কিন্তু কী ঘটেছিল সেটা আবদেল চিঠিতে বলেনি। সম্ভত তাদের সঙ্গে কোনো একটা পর্যায়ে মতের মিল না হওয়াতে কোনো ঝামেলা করে। এই সময়ে আবদেল তাদের নজর এড়ানোর জন্য ডুব দেয় একেবারে গহিনে।’

‘আপনাকে চিঠিটা লেখার আগ পর্যন্ত, শারিয়ার ভাবতে ভাবতে বলে উঠল ‘তিন বছর সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল সবার থেকে। ওইদিন রাতে কী হয়েছিল?’

‘আমি তার চিঠি পেয়ে চলে আসি দেশে। আবদেল আমাকে নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা দেয়নি। সে আমাকে চিঠিতে বলেছিল অমুক সময়ে হাইওয়ের অমুক জায়গায় থাকতে। আমি ঠিক সে সময়েই সেই জায়গাতে গিয়ে হাজির হই। তীব্র বৃষ্টির ভেতরে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি এমন সময় রাস্তার ওপারে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। আমি ওদিকে রওনা দিব হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই একদল লোক রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপরে। আবদেল আমাকে ওই অবস্থায় দেখে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।’

শশী এই পর্যন্ত বলতেই ভুবন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। শারিয়ার তাকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ‘তারপর কী হলো? ওই দিঘির ওখানে পাহারাদার আর নৌকাতে আইডি কার্ড কীভাবে এলো?’

যারা আমাকে ধরেছিল ওরা আমাকে ওখান থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে গাড়িতে তোলার পরিকল্পনা করেছিল মনে হয়। কিন্তু বাবাকে ধাক্কা মারা গাড়িটা থেমে গেলে ওটা থেকে কিছু ছেলেপেলে বেরিয়ে আসে আর হঠাৎ এটা পুলিশের গাড়ি ওখানে উপস্থিত হয়। তাই মনে হয় আমাকে আর গাড়িতে না তুলে আমাকে নিয়ে চলে যায় সেই দিঘির পারে। সেখান থেকে নৌকোতে তুলবে এমন সময় পাহারাদার লোকটা বাইরে চলে আসে নিজের ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তাক গুলি করে ওরা। তারপর নৌকাটাকে নিয়ে যায় দেয়ালের কাছে। সেখানে অন্যদিক থেকে একটা ক্রেনের মতো নামিয়ে দেওয়া হয় এপাড়ে।’

এই পর্যায়ে শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে উঠল। আমি বলেছিলাম না, ওরা ওপার থেকে কোনো হেল্প পেয়েছে। না হলে ওভাবে ওঠানোটা খুবই কঠিন হওয়ার কথা। ওই সময়েই কোনো এক সুযোগে আপনি মনে হয় ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো নৌকায় ফেলে দিয়েছিলেন। ওখানে নেয়ার পর আপনাকে কী ওরা কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

‘নাহ, ওরা যখন আমাকে নৌকা থেকে ট্রলির সঙ্গে বাঁধে আমি ব্যাগটা উলটে ফেলে দিই। ব্যাগটা তুলে নিয়ে ওটার ভেতরের জিনিসগুলো রয়ে যায় মনে হয়। এরপরে ওরা আমাকে নিয়ে একটা অফিস রুমে আটকে রাখে। ওখানেই ছিলাম লম্বা সময়। তারপর তোমরা,’ বলে সে জিভ কাটল।

তুমি বললে সমস্যা নেই,’ শারিয়ার গোঁফের কোণে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল। ‘আমিও তাই করব।’

‘ঠিক আছে,’ শশী হাত নেড়ে বলে উঠল। ‘তোমরা যখন আমাকে উদ্ধার করতে এলে, সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে অফিস রুম থেকে সরিয়ে সেই জাহাজে নেয় ওরা। ওখানে কে নাকি আসবে দেখা করতে। সেই রাতে আমাকে ওদিক দিয়ে স্পিডবোটে করে লোকটার সঙ্গে জাহাজে তুলে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তোমরা এলে। এরপর তো তোমরা জানো।’

‘তাহলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, শারিয়ার কেয়ারটেকারকে আরেক রাউন্ড চা-কফি দিতে বলে নিজে একটা সিগারেট লাগাল ঠোঁটে। ‘তোমার বাবা ছিল একজন আর্কিওলজিস্ট। ইতিহাসের হারানো এক অধ্যায় খুঁজতে গিয়ে সে বিরাট এক সম্ভাব্য সম্পদের খোঁজ পায়। কিন্তু ব্যাপারটা সে অথরিটিকে বোঝাতে পারেনি। বরং তারা তাকে ভুল বোঝে, ফলে সে সম্ভবত উলটা-পালটা কারো সঙ্গে হাত মেলায়। একটা সময় তার পিছু লাগে এমন কিছু মানুষ যাদের কারণে সে গা-ঢাকা দিয়ে নিজের গবেষণা চালিয়ে যায়। অবশেষে সে যখন সাফল্যের শেষ ধাপে তখন নিজের মেয়ে, মানে তোমাকে চিঠি দিয়ে জানায় সে কী করেছে কী পেয়েছে। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত তাকে অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছে যায় এক বা একাধিক গ্রুপ। যারা এতদিন ধরে তাকে খুঁজছিল। তারা তার মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় এবং অ্যাক্সিডেন্টে মারা পড়ে প্রফেসর। এখন সেই সমস্ত কিছুর জবাব আছে তোমার কাছে। একমাত্র তুমিই জানো তোমার বাবা যা নিয়ে গবেষণা করছিল সেটা কোথায় আছে?’

‘কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তেমন না। কারণ বাবা কী পেয়েছে সেটা বললেও কোথায় পেয়েছে সেই ব্যাপারে সে চিঠিতে লেখেনি। তার মতো পোড় খাওয়া মানুষ খোলা চিঠিতে সেটা লেখার কথাও নয়। আমার সঙ্গে দেখা করে সেটা বলার কথা ছিল। কিন্তু সেটা তো হয়নি।’

‘সর্বনাশ, এ তো সবই শেষ হয়ে গেছে দেখছি,’ ভুবন আর্তনাদের মতো করে বলে উঠল। ‘এত কাহিনি করে শেষে এসে রাবণ জিতে গেল?’ সবাই তাকিয়ে আছে শশীর দিকে।

‘মোটেই তা নয়,’ শশী বেশ জোর গলায় বলে উঠল। ‘তোমরা ভুলে যাচ্ছো আমিও একজন আর্কিওলজিস্ট। বাবার গবেষণা কেউ যদি বুঝতে পারে বা বের করতে পারে তো সেটা আমিই পারব। বাবা আমাকে বলেছিল তার পুরো পাঁচ-ছয় বছরের গবেষণা তার স্টাডিতে আছে। সেখানে নাকি একটা ডিটেইল ম্যাপিং করেছে সে। আমার বিশ্বাস তোমরা যদি আমাকে সেই স্টাডিতে নিয়ে যেতে পার কিংবা সেই ম্যাপটা দেখাতে পারো আমি সেটা অ্যানালিসিস করে বের করতে পারব বাবা যা পেয়েছিল সেগুলো কোথায় আছে।’

‘সেগুলো তো সব পুড়ে ছাই,’ টমি আনমনেই বলে উঠল।

শশী চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল টমির কথা শুনে সে এক সেকেন্ড টমির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কী? পুড়ে গেছে!’ সে এত জোরে লাফিয়ে সোজা হয়েছে যে তার হাতের কাপটা তো পড়ে গেছেই, সেই সঙ্গে তার হাতে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে উঠেছে সামনের টেবিলের ওপরে থাকা চায়ের পট ইত্যাদি। ‘সর্বনাশ,’ বলে সে নিজের মাথার চুল মুঠি করে ধরল। ‘এই সর্বনাশ হলো কীভাবে? হায় হায়!’ শশীকে দেখে মনে হচ্ছে বাপের মৃত্যুতে সে যতটা কষ্ট পেয়েছিল তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে এই খবর শুনে।

শারিয়ার খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল মেয়েটাকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে একটা হাত রাখল। ‘শান্ত হও শশী। ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল।’

‘মাই ফুট অ্যাক্সিডেন্ট,’ বলে সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ‘কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেল এটা তোমরা কেউ বুঝতেও পারছো না। ওহ হো,’ তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার পুরো জীবনটাই বৃথা হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে সে মাথা তুলল। ‘ঘটল কীভাবে ব্যাপারটা?’

‘আগেই বলেছিলাম যে ওই চায়নিজ লোকটা,’ শারিয়ার বলতেই টমি পাস থেকে তার নাম বলে উঠল I

‘ব্যাটার নাম হুয়ান জিং।’

‘হ্যাঁ, সেই জিং ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের একবার মোলাকাত হয়েছিল ওই বেইজমেন্টে,’ বলে সে ওই দিন বেইজমেন্টে কী হয়েছিল জানাল।

‘উফফ, কত বড়ো একটা ক্ষতি যে হয়েছে। যাই হোক, বাবার মৃত্যুর পর ওখানে পুলিশ যায়নি?’ শশী জানতে চাইল।

‘গিয়েছিল তো…’ শারিয়ার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই পাশ থেকে টমি কথা বলে উঠল।

‘এক মিনিট এক মিনিট, সে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আমরা সবাই একটা পয়েন্ট মিস করছি। ডক্টর আবদেলের রুম মানে গবেষণাগারের দেয়ালে যা ছিল বা ওই রুমে যা ছিল সবই পুড়ে গেছে বুঝলাম। কিন্তু জিনিসগুলো তো আর বাদ হয়ে যায়নি?’

‘মানে?’ শারিয়ার প্রশ্ন করল। তার কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠাতে খানিকটা বিরক্ত সে।

‘মানে হলো ওই দেয়ালে যা ছিল সেগুলো পুড়ে যেতে পারে কিন্তু সেগুলোর ছবি তো আছে,’ বলে সে শশীর দিকে তাকাল সাপোর্টের আশায়।

শশী তালি দিয়ে উঠল। ‘হ্যাঁ, ছবিতেও কাজ চলতে পারে। অবশ্যই সরাসরি দেখতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু ছবি দেখতে পারলেও কিছুটা কাজ হতে পারে।’

‘কিন্তু ছবি তো পুলিশের কাছে,’ ভুবন ফোড়ন কেটে বলে উঠল। ‘যে কাজ করেছি আমরা তাতে তো।’

‘নাহ, ছবি এখানেও আছে,’ টমি আবারও কথা বলে উঠল। তার গলায় পুরনো সেই সুর ফিরে ফিরে আসছে। কাল রাতের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সে আবারও পুরোদমে পুরনো মুডে ফিরে যেতে শুরু করেছে। ‘আসলে আমি তো অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই…’ বলে সে খুব ভাব নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই শারিয়ার ধমকে উঠল।

‘টমি, কাজের কথা বল। ছবিগুলো কোথায় আছে?’

আবারও সেই জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো মিইয়ে গেল সে। ‘আমার ল্যাপটপে আছে। আমি নিয়ে আসছি,’ বলে সে খুশি মুখে চলে গেল ল্যাপটপটা নিয়ে আসতে।

‘তোমার কী মনে হয় ছবিগুলো দেখে কিছু বের করা সম্ভব হতে পারে?’ শারিয়ার প্রশ্ন করল শশীকে।

‘হতে পারে, আবার নাও পারে। কারণ এটা অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করছে। যেমন ছবিটার কোয়ালিটি কেমন, বাবা তার কাজের কতটা সেখানে রেখেছিল। আবার ছবিতে…’ বলে শশী কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ছবিটা না দেখে বা অ্যানালিসিস না করে আসলে কিছুই বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আবার একটা সুবিধাও আছে। বাবার সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। কাজেই তার কাজের প্যাটার্ন সম্পর্কে আমি ভালোভাবে জানি। কাজেই সে ব্যাপারগুলোকে কীভাবে সাজাতে পারে এটা নিয়ে একটা সম্যক ধারণা আছে আমার। দেখি… ওই যে টমি এসে গেছে ল্যাপটপ নিয়ে।’

টমি ল্যাপটপটাকে এনে টি-টেবিলটার ওপরে রেখে চার্জের কানেকশন দিয়ে ডালা তুলল ওটার। সবাই টি-টেবিলের সামনে মেঝের কার্পেটের ওপরে এসে জড়ো হলো ল্যাপটপটার সামনে। শুধু সুমন সোফাতে বসে রইল। একটু পর পর চা খাচ্ছে সে, আর সিগারেট ধরাচ্ছে। তাকে খানিকটা চিন্তিত মনে হলো শারিয়ারের কাছে।

‘সুমন, আর ইউ ওকে?’ শারিয়ার প্রশ্ন করল।

ওর প্রশ্নের জবাবে মৃদু হেসে উঠল সুমন। ‘আমি ঠিক আছি বস, একটু ক্লান্তি লাগছে। আর এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই, তোমরা কাজ করো।’

শারিয়ার হাত নেড়ে ল্যাপটপের দিকে ফিরে তাকাল। ডক্টর আবদেলের দেয়ালে লাগানো সেই বিশদ দেয়ালচিত্রের মতো জিনিসটার ছবিটা ওপেন করেছে টমি। ছবিটা দেখতে দেখতে শিস দিয়ে উঠল শশী।

‘এটা একটা অসম্ভব কাজ, সে ছবিটাতে রীতিমতো বুঁদ হওয়ার মতো ডুব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে। ‘একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান ও স্কলারের তিন বছরের গবেষণা। দেয়ালে ককশিট লাগিয়েছিল ডক্টর অবদেল। তার ওপরে আর্ট পেপার পেস্ট করা হয়েছে। এরপরে সে কাগজপত্রে যা পেয়েছে সেটাকে ধাপে ধাপে পুরোটা উঠিয়ে এনেছে এখানে। এই টেকনিকটাকে আমরা অ্যাকাডেমিকসের ভাষায় বলি মিররিং দ্য ব্রেইন। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, নিজের মাথার ভেতরে যা আছে চিত্রের মাধ্যমে সেটার একটা প্রতিফলন বা মিরর ইমেজ দাঁড় করানো। এই জিনিসটা এতটাই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে দিন দিন যে অ্যকাডেমিক জগৎ থেকে শুরু করে কর্পোরেট বা মিলিটারিতে পর্যন্ত সবাই এটা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এমনকি আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্টুডেন্টদের পরীক্ষা না নিয়ে তাদের পোস্টার প্রেজেন্টেশন দেয়া হয়, যাতে তারা ভিজ্যুয়াল ম্যাটেরিয়াল ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে,’ বলে পা ভাঁজ করে আরাম করে বসল। টমি আর শারিয়ারের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আমার নেট কানেকশনসহ আরেকটা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার দরকার। এটাতে দেখা জিনিস ওটাতে আমরা খোঁজ করে দেখতে পারব।

‘আমি যে রুমে ছিলাম সেটাতে একটা ডেস্কটপ আছে, এখানে থাকতে এলে হামিদ চাচা বা ছোটো আঙ্কেল মনে হয় ওটাতে কাজ করেন। কিন্তু ওটা দিয়ে তো আমাদের কাজ হবে না,’ বলে সে একটু ভাবল। ‘এক কাজ কর টমি,’ বলে সে টমিকে বলল। ‘আমি যে রুমে ছিলাম ওটাতে একটা ট্যাব আছে অ্যাপলের, ওটা নিয়ে আয়। আর আসার সময় বাসার ওয়াইফাইয়ের আইডি আর পাসওয়ার্ড জেনে নিবি কেয়ারটেকারের কাছ থেকে।’

‘জি, বস,’ টমি উঠে যেতেই আবার শশী বলতে শুরু করল।

‘এই দেখো বাবার কাজটা একবারে বিশদ না জানলেও মোটামুটি একটা আউটলাইন আমি জানি। সে থেকে যদি ধরে নিই এই চিত্রটার শুরু হয়েছে এখান থেকে,’ বলে সে ল্যাপটপের স্ক্রিনের এক জায়গাতে আঙুল রাখল। ‘এই দেখো, এখানে প্রথম এন্ট্রি দেওয়া হয়েছে নাম, তারিখসহ। প্রথম তারিখটা ভাস্কো ডা গামার ভারতে আগমনের। এরপরের ঘটনাগুলো নামের সঙ্গে সাজানো হয়েছে তারিখ বসিয়ে বসিয়ে,’ বলে সে ছবিটার আরেকদিকে আঙুল নিয়ে এলো। এখানে বসানো হয়েছে মোঘলদের ঘটনাপঞ্জি। এখানেও দেখো নাম, তারিখসহ দেওয়া হয়েছে দিল্লির দরবারে ঘটে যাওয়া বড়ো বড়ো ঘটনাগুলো। এখান থেকে সোজা নেমে এসেছে বাংলাতে,’ বলে সে আঙুলটাকে নিয়ে এলো ছবির মাঝামাঝি একটা জায়গাতে।

‘আর এই ঘটনাগুলোকে বাঙ্গাল প্রদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে জোড়া লাগানো হয়েছে বিদেশি আগমনকারীদের সঙ্গে, সেই সঙ্গে আবার দিল্লির ঘটনার সঙ্গে। সেই সঙ্গে আবার নিচ থেকে টেনে এনে লাইন করা হয়েছে আরাকান ত্রিপুরা আর চট্টগ্রামে সঙ্গে। অদ্ভুত সুন্দর একটা কাজ করা হয়েছে এখানে। এটা একটা মাস্টারপিস ওয়ার্ক,’ বলে সে সবার দিকে দেখল। ‘নিজের বাবা বলে বলছি না, এরকম কাজ করাটা কতটা দুরূহ ব্যাপার বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এটা আসলে হাতে বানানো একটা অ্যাকাডেমিক থ্রিডি মডেল। পুরো জিনিসটাই একটা অ্যালাইনড ফ্রেমওয়ার্কের মতো কাজ করবে তুমি যদি প্যাটার্নটার বেসিক ব্যাপারগুলো ধরতে পারো। যেমন দেখো, এখানে যদি আমি হাত রাখি তবে দেখতে পাই দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হলেন। এখান থেকে বরাবর ডানে তাকিয়ে ওই সময়ে পর্তুগিজ আর আরাকানরা কী করছে সেটা দেখতে পাবে। আবার ডান পাশে এইসময়ে বাঙাল প্রদেশে কী ঘটছে সেটাও দেখতে পারবে তুমি। ব্রিলিয়ান্ট। এখানে এমনকি বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে শাহ সুজার সংযোগ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুন্দরভাবে।’

‘আসলেই অদ্ভুত, এখন বুঝতে পারলাম জিনিসটা এতটা জটিল আর অদ্ভুত লাগছিল কেন দেখতে,’ পুরো জিনিসটা কীভাবে কাজ করে সেটা ধরতে পেরে ভুবন শিস দিয়ে উঠল। ‘একেই মনে হয় বলে জিনিয়াস। এটা যদি একজন মানুষের মাথা থেকে বের হওয়া এবং বানানো হয়ে থাকে কী আর বলব, ভুবন এতক্ষণ নীরব ছিল কিন্তু জিনিসটা ধরতে পেরে সেও মজা পেতে শুরু করেছে।

‘ওই যে টমি এসেছে,’ শারিয়ার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। ‘পেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ বস। আর বলো না…’

টমিকে কথা শেষ করতে দিল না শশী। ‘টমি, আপনি ট্যাবটার ওয়াইফাই অন করে গুগলটা বের করে রাখবেন। আমি কিছু জানতে বা দেখতে চাইলে জানাবেন,’ বলে শশী ফিরে তাকাল ল্যাপটপের দিকে। ‘আচ্ছা, ছবিটার এই অংশটুকু আমরা বুঝতে পারছি। যা বুঝতে পারছি না তা হলো এখানে এই ছোটো ছোটো লেখা আর নানা ঘটনাবলি কেন যোগ করা হয়েছে। যেমন, এখানে হুগলীর কথা লেখা হয়েছে, আবার সেটা থেকে সাতটা রেখা টেনে কিছু একটা বোঝানো হয়েছে। এটা কী, আমি ধরতে পারছি না। আবার এখানে বারোটা বৃত্তের একটা মডেল বসানো হয়েছে এটা বারো ভূঁইয়াদের কিছু একটা হতে পারে। আবার হুগলীর সঙ্গে কানেকটেড এখানে সাতটা সরলরেখার একটা চতুর্বৃত্ত বানানো হয়েছে। এটাও আমি ধরতে পারছি না। তবে এই মুহূর্তে আমাদের জন্য এটার গুরুত্ব অতটা বেশি বলে মনে হয় না। কারণ সম্ভবত এটাতে আরো অসংখ্য লেয়ার আছে,’ বলে সে মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে আবার সোজা হয়ে বসলো।

‘একমিনিট, আবারও এখান থেকে শুরু করি।’ বলে সে পর্তুগিজদের থেকে শুরু করল। শারিয়ার আর ভুবন, তোমরা দুজনে একটু হেল্প করো।’ বলে সে নিজে আঙুল রাখল চিত্রটার এক জায়গাতে। ‘এখান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নিচে নামছি। শারিয়ার তুমি মোঘলদেরটাতে আঙুল রাখো, শারিয়ার তুমি বাঙাল মুলুকের অংশে। টমি তুমি আরাকানে মগদেরটাতে। আমি যখন যখন একটা একটা ধাপে নামব সেটার সঙ্গে মিলিয়ে তোমরাও এগোবে। বোঝা গেছে?’ সবাই মাথা নাড়ল, সবার একটা করে আঙুল স্ক্রিনের ওপরে। যদিও এভাবে ল্যাপটপের স্ক্রিনে সবাই একসঙ্গে আঙুল রেখে জিনিসটা ধরতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আবার সবাই মজাও পেতে শুরু করেছে এখন।

‘এই, আমি নামলাম এক ধাপ। পর্তুগিজরা গোয়া থেকে রওনা দিয়ে বাংলার দিকে এগোল। এরপরে চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে গেল। দিল্লিতে কী হলো শারিয়ার দেখো। একই সময়ে ভুবন আর টমি,’ সবাই একই সঙ্গে শশীর নির্দেশনা অনুযায়ী নামতে নামতে একটা পয়েন্টে চলে এলো।

‘এবার আমাদের উদ্দেশ্য যেখানে। সেই জায়গাতে চলে এসেছি আমরা, সবাই সাবধানে,’ বলে সে যোগ করল। ‘দিল্লিতে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় এলো,’ শমী বলল।

শারিয়ার তার সঙ্গে যোগ করল। ‘সুজা পালাল আরাকানে। শাহ সুজাকে আরাকানে হত্যা করা হলো।’

‘এখানে লেখা আরাকানের রাজা মগ আর পর্তুগিজদের নিয়ে বাহিনী বানাল, ‘ ভুবন বলল।

‘এখানে আছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা সুজার লোককে উদ্ধার করতে বাহিনী বানাল। টমি কোনোমতে তার আঙুল জায়গামতো রেখে বলতে লাগল।

‘শাবাশ, আমরা প্রায় এক পয়েন্টে চলে এসেছি। এখান থেকে একটা লাইন চলে গেছে,’ এক মিনিট, একটা না তিনটা লাইন চলে গেছে ছবির অন্যপ্রান্তে। সবাই আমরা একসঙ্গে এগোব।’

সবাই যার যার আঙুল সরিয়ে নিতে লাগল, সেই সঙ্গে সবার আঙুল একটা বিন্দুতে এসে থেমে গেল।

‘সাব্বাস, আমরা মনে হয় এখান থেকেই মূল যে জিনিসটা বের করতে পেরেছি সেটার নির্দেশনা শুরু।

‘ঠিক, এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি সেটা ইতিহাসেরই অংশ। স্রেফ টুকরো টুকরো অংশকে বাবা একসঙ্গে এনে জোড়া লাগিয়েছে। কিন্তু যে পয়েন্টটা আমরা এই মুহূর্তে পৌঁছেছি এখান থেকেই মূল নির্দেশনা শুরু হবে। আর সেটা করতে হলে এই ছবির এই অংশটা অ্যানালিসিস করতে হবে,’ বলে শশী খানিকটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেলান দিল সোফাতে। হাত বাড়াল সিগারেটের প্যাকেটের দিকে।

‘কিন্তু ওখানে তো কিছুই নেই দুটো ছবি বাদে,’ ভুবন বলে উঠল।

‘ঠিক এখান থেকেই আমাদেরকে প্রাকটিক্যালি ব্যাপারটা উদ্ধার করতে হবে,’ বলে শশী সিগারেট ধরিয়ে আবার চলে এলো ল্যাপটপের সামনে। টমি হেল্প লাগবে আমার। আমাদের ঠিক করা পয়েন্ট থেকে তিনটা লাইন বেরিয়েছে। তিনটের ভেতরে আমার বিশ্বাস মূল যে রেখাটা বেরিয়েছে সেটাই আমাদের ব্লু।’

‘তুমি নিশ্চিত হলে কীভাবে?’

‘আইডিয়া চুরি ব্যাপারটা জানো তো? কিন্তু অ্যাকাডেমিক জগতেও যে আইডিয়া চুরি হয়, সেটা কী জানো?’ শশী হেসে উঠল বলে। তার কথার সঙ্গে সঙ্গে সিগরেটের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। ‘সব অ্যাকাডেমিশিয়ানরা তাই আইডিয়া যাতে চুরি না হয় সেজন্য কিছু ছলনার আশ্রয় নেয় অনেক সময়। বাবা সবসময় তার আইডিয়াগুলোকে একাধিক প্যাটার্নে সাজাত, যাতে চট করে কেউ বুঝতে না পারে। এখানে দেখো, যে তিনটা রো বেরিয়েছে, একেবারে ওপরেরটা দেখো। এখানে একটা নাম লেখা ‘দেয়াঙ’, টমি গুগলে বাংলায় ওয়াং লিখে সার্চ দাও দেখবে দোয়াঙ হলো চট্টগামের হারিয়ে যাওয়া পর্তুগিজদের পুরনো এক শহর। ঠিক?’

টমি সার্চ দিয়ে পড়তে পড়তে বলে উঠল, ‘ঠিক।’

‘দ্বিতীয় নামটা, আংগারকেল,’ এটা কী আমি জানি ন। কিন্তু আগেরটার মতোই কিছু একটা হবে। টমি?’

‘আংগারকেল সমুদ্রের উপকূলে হারিয়ে যাওয়া পর্তুগিজদের আরেক শহর।’

তালি দিয়ে উঠল শশী। ‘দেখেছ, যা ভাবছিলাম।

‘কিছু বুঝলাম না, শারিয়ার আনমনে মাথা নেড়ে একবার ভুবনকে দেখে নিল। ভুবনও ঠোঁট উলটে বোঝাল সেও কিছু বোঝেনি।

‘শোনো, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। বাবা খুব ভালো করেই জানত, সে যাই করুক আর যতই লুকিয়ে রাখুক কোনো-না-কোনোদিন তার এই চিত্র কারো না কারো হাতে পড়বেই। আর সেরকম কারো হাতে পড়লে তার যদি ঘটে বুদ্ধি থাকে তবে আমরা যেভাবে বিন্দু মিলিয়ে ব্যাপারটা বের করেছি অন্য কেউও সেটা বের করতে পারে। কিন্তু মজা শুরু হবে এরপরে। এখন তুমি যে দুটো শহরের নাম বললে, এটা আসলে পুরোটাই ধোঁকা। যে কেউ এরকম পুরেনো হারানো শহরের নাম দেখবে আবার দেখবে পর্তুগিজদের নাম আছে, সঙ্গে সঙ্গে ভাববে ওাখানেই আছে শাহ সুজার সেই সম্পদ। কিন্তু আসলে এর পুরাটাই ধোঁকা আর ফাঁকিবাজি। সত্যিকার অর্থে সেই সম্পদের ক্লু যদি কোথায় থেকে থাকে তবে সেটা আছে, এই তৃতীয় আর সবচেয়ে লম্বা বিন্দুটাতে,’ বলে সে তৃতীয় লাইনটাতে আঙুল রাখল।

‘এখানে তো আগের দুটোর মতো কিছু লেখা নেই। আছে শুধু দুটো গম্বুজের মতো ছবি। তার নিচে লেখা, শারিয়ার চোখ কুঁচকে দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন।’

‘টমি সার্চ দাও তো। এটার ব্যাপারে আমার আসলে খুব একটা আইডিয়া নেই,’ শশী বলে উঠল।

‘আমার তো জানার প্রশ্নই ওঠে না, শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘ভুবন?’

কিন্তু ভুবন জবাব দেওয়ার আগেই ওদের পেছন থেকে সুমন কথা বলে উঠল অনেকক্ষণ পর। ‘আমি জানি, কারণ ওখানে আমি অনেকদিন ডিউটি করেছি। এইটা চট্টগ্রাম কোর্ট হাউস। অনেক পুরনো বিল্ডিং। পরীর পাহাড়ে।’

সুমন ভাই ঠিকই বলেছেন,’ বলে টমি তার হাতে ধরা ট্যাবটা এগিয়ে দিল শশীর দিকে। ‘এই যে দেখেন, এটা হলো চট্টগ্রামের কোর্ট হাউস। আঠারোশ শতকের শেষ দিকে ইন্দো-ব্রিটিশ স্টাইলে বানানো একটা ভবন। ওখানে লেখা আছে না চট্টগ্রামের পুরনো কোর্ট হাউস। এমনকি ডক্টর আবদেলের ওখানে থাকা মিনার দুটোর ছবিও মিলে গেছে দেখেন,’ বলে সে ট্যাবটা এগিয়ে দিল শশীর দিকে।

শশী ট্যাবটা হাতে নিয়ে সেটাকে ল্যাপটপের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখল। তার কাঁধের ওপর দিকে উঁকি দিচ্ছে বাকিরা। ‘এটাই, এটার কথাই বলা আছে এখানে, ‘ ঘোষণা দেয়ার সুরে বলে উঠল শশী।

‘মানে কী? ওখানে গেলে শাহ সুজার সেই সম্পদ পাওয়া যাবে?’ ভুবনের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো, এরকম বেকুবের মতো কথা সে জীবনে শোনেনি।

‘সেই আশা করো না,’ শশী জোর গলায় বলে উঠল। ‘তবে এটা বলা যেতেই পারে যে ওখানে গেলে ডক্টর আবদেলের সাজানো কোনো না কোনো ক্লু আমরা পাব, যেটা আমাদের এই সার্চের পরের ধাপে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আর সেটা পেতে হলে আমাদের ওখানে যেতে হবে,’ বলে সে ল্যাপটপের ওই ছবি দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওই কোর্ট হাউসে কিছু না কিছু একটা অবশ্যই আছে।’

‘কাল সকালে যেতে হবে আমাদের ওখানে,’ বলে দেয়ালের ঘড়ি দেখাল শারিয়ার। ‘রাত যথেষ্ট হতে যাচ্ছে। আমরাও সবাই ক্লান্ত। একটু পর রাতের খাওয়া সেরে সবাই ঘুমাও। কাল বহুত কাজ। আর শুরুটা করব আমরা কোর্ট হাউস থেকে। ব্যাপারটা আমাদের বর্তমান অবস্থায় যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হতে যাচ্ছে।’

‘খুব ভালো,’ ফোড়ন কাটার মতো বলে উঠল সুমন। ‘পুলিশ থেকে পালিয়ে এমন জায়গায় যেতে হবে যেটা হলো সব আইনের মানুষের আখড়া।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *