মগরাজ – ৩৯

অধ্যায় ঊনচল্লিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

জংলাটিলা, দক্ষিণ উপকূলের সাগর

‘কই আমি তো কিছুই দেখতে পাই না,’ চোখে দূরবীক্ষণটাকে ভালোভাবে চেপে ধরতে গিয়ে আরেকটু হলে শরীরের ভারসাম্য হারাতে বসেছিল কিরান। তীব্র বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের ভেতরেও কোনোমতে শরীরটাকে ঠিক করে আবারও সাবধানে চোখ রাখল দূরবীক্ষণের গোল অংশটাতে। সমগ্র মনোযোগের সঙ্গে সে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে জংলাটিলা আর তদসংলগ্ন সমুদ্র।

তীব্র স্রোতের ভেতরে জংলাটিলা যাওয়ার মোহনা পার হওয়ার পর খুব বেশি সময় যায়নি। জাহাজগুলো একে একে স্রোতধারা পার হয়ে আসার পর সেগুলোকে স্থির করে কিছুক্ষণের বিশ্রামের নির্দেশ দিয়েছে কিরান। কারণ একে তো সবার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে তার ওপরে আবার সামনে যেই মুহূর্তে শত্রুজাহাজ চোখে পড়বে সেই মুহূর্ত থেকে আবারও শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধের তাণ্ডব। তাই ওর নাবিক থেকে শুরু করে যোদ্ধা সবার জন্য এটাই শেষ সুযোগ সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নেয়ার। কিরান জানে শত্রু সামনেই আছে। বাতাসে সে যুদ্ধ আর বিপদের গন্ধ টের পাচ্ছে পরিষ্কার।

সবাই যখন বিশ্রামরত সে উঠে এলো মাস্তুলের সঙ্গে আটকানো কাকের বাসাতে। মাস্তুলের ওপরে একটা ছোটো খাঁচার মতো আটকানো থাকে, কেউ একজন সেটাতে বসে দূরে নজর রাখে, এটাকেই বলে কাকের বাসা। সেখানে বেদু আগে থেকেই ছিল, কিরান উঠে আসতেই সে কাকের বাসাতে কিরানের দাঁড়ানোর জন্য খানিকটা জায়গা খালি করে দিল। কিন্তু যতই চেপে দাঁড়াক, যেখানে একজনের জন্য দাঁড়ানো কঠিন সেখানে দুজন দাঁড়ানো কষ্টকর তো বটেই। তবুও কিরান চেপে-চুপে দাঁড়াল।

কিরান দাঁড়াতেই বেদু দূরবীক্ষণটা ধরিয়ে দিল ওর হাতে। জানাল, সামনে সে পুরো জাহাজ দেখতে না পেলেও একটা জাহাজের মাস্তুলের খানিকটা অংশ একটু আগেই টিলাগুলোর ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে এগোতে দেখেছে। কিন্তু তারপর থেকে চোখে দূরবীক্ষণ লাগিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিরান। ‘তুই কী ঠিক দেখছিস?’

আরে ঠিক মানে, একশ বার ঠিক,’ কিরানের পাশ থেকে কথা বলে ওঠা বেদুর গলার স্বর শুনে কিরান অনুমান করল কিছু একটা তো অবশ্যই দেখেছে সে। কিন্তু সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা তাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। দূরবীক্ষণ থেকে চোখ নামিয়ে কিরান ফিরে তাকাল নিজের জাহাজের দিকে। সেখানে কামাঞ্চি থেকে শুরু করে তিরন্দাজ, লাঠিয়াল আর বন্দুকবাজেরা সবাই গোল হয়ে বসে খাওয়া সেরে তামাক টানছে। জাহাজের পাটাতনের ওপরে স্তূপ করে রাখা আছে নানাবিধ যুদ্ধের উপকরণ। নিচের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ঢাকার কাছেই সে দেখতে পেল গোমেজ আর গোলন্দাজকে। দুজনেই ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। কিরান পেছন ফিরে দেখল পেছনের জাহাজগুলো বিকেলের পুকুরে ভাসতে থাকা হাঁসের মতো স্থির ভঙ্গিতে ভেসে অছে। কিরান জানে একরকম বলতে গেলে সবাই এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একবার যুদ্ধের নির্দেশনা আসামাত্রই ঠিক যেভাবে নিদের্শনা দেওয়া আছে ওরা সেভাবে কাজ শুরু করে দেবে। কিরানদের জাহাজে আছে কিরান, গোলন্দাজ, গোমেজ আর বেদু। সেই সঙ্গে যোদ্ধা আর মাল্লারা। কবি আলাওল, রহমত চাচা আর তার সঙ্গে-থাকা পতিত লোকটাকে রাখা হয়েছে একেবারে পেছনের জাহাজে। কারণ ওখানেই তারা তূলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকবে।

কিরানদের জাহাজের ঠিক পেছনের জাহাজের নেতৃত্বে আছে পট্টবর্ধন আর তার সঙ্গে বিল্লাল শেঠ আর বৈঠা। আর সবশেষ জাহাজে তুলারামের নেতৃত্বে আছে লাঠিয়াল আর বল্লমবাহিনী। ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণে দূরপাল্লার ভাগটা প্রথম জাহাজ থেকে দেখবে কিরান আর গোলন্দাজ। দ্বিতীয় জাহাজে রাখা হয়েছে সবচেয়ে দক্ষ জাহাজি পট্টবর্ধনকে, যাতে সে এই জাহাজটা দিয়ে শত্রু জাহাজের পথ আটকাতে পারে। আর তৃতীয় জাহাজে তুলারামের নেতৃত্বের বাহিনীর প্রায় পুরোটাই ব্যবহৃত হবে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য।

কিরান পেছনের জাহাজগুলোকে দেখে নিয়ে একবার দিগন্তের সূর্যটা দেখে নিল। সন্ধে হতে এখনো দেরি আছে কিন্তু খুব বেশি দেরি নেই। যা করার অন্ধকার নামার আগেই করতে হবে। দিনের আক্রমণ ভাগে ওরা সুবিধে পাবে। তাই যদি শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে ভালো অবস্থানে থাকতে চায় তবে আগে ওদের দিনের আলোতে আক্রমণ চালানোটাই সুবিধে হবে। আর সেটা করতে হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিরান দিগন্তের সূর্যটাকে পরখ করে কোমরে ঝোলানো কম্পাসটাকে আরেকবার পরখ করে নিয়ে ভালোভাবে আবারও চোখ রাখল দূরবীক্ষণে। বীক্ষণটাকে সে ঠিক করল একেবারে টিলার অগ্রভাগে। তারপর সেখান থেকে একে একে জলপথ থেকে শুরু করে প্রতিটি টিলা পর্যন্ত পরখ করল তারপর নিজের দৃষ্টি এনে স্থির করল জংলাটিলা এলাকার মূল প্রবেশ পথে। সেখান থেকে যতদূর দৃষ্টি চলে সে পরখ করল সেই সঙ্গে যতটা সম্ভব ভেতরের দিকে দেখার চেষ্টা চালাল। তারপর জলপথসংলগ্ন টিলার উপরিভাগ পরীক্ষা করতে লাগল মনোযোগের সঙ্গে। কোনো জাহাজের চিহ্নও নেই। কিন্তু যেখানে পুরনো বন্দর থাকার কথা সেখান থেকে সরু চিলতের মতে এক ফালি ধোঁয়া উঠে যেতে দেখল ওপরের দিকে।

মনে মনে খুশি হয়ে উঠল কিরান। বন্দরটাকে দেখতে না পেলেও ওখানে যে কিছু একটা আছে এবং তার প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্ভবত সিলভেরার জাহাজ সেখানেই নোঙর ফেলেছে ব্যাপারটা অনুধাবন করে সে খুশি হয়ে উঠল। সম্ভবত বন্দরে থেমে ওরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ রাতের ভেতরেই তারা ওখানে ঘাঁটি গেড়ে সম্ভাব্য শত্রুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলবে। এরকমই সিদ্ধান্ত। কিরান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে মাস্তুলের ফাঁকে আটকানো একটা পতাকা তুলে নিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে নাড়তে শুরু করল।

প্রথমেই কিরানের নাড়ানো পতাকাটা চোখে পড়ল নিচের পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাকা গোলন্দাজের। মুহূর্তের জন্য বোকার মতো তাকিয়ে রইল গোলন্দাজ, তারপর হুঁশ হতেই সে নিজের হাতে ধরে থাকা পতাকাটা নাড়তে শুরু করল। পতাকা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাটাতনে উপবিষ্ট সকলেই হর্ষধ্বনি করে উঠল। জাহাজের নিচের অংশের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা চিৎকার করে যুদ্ধের ঘোষণার জানান দিয়ে দিল নিচের খোলের ভেতরে থাকা দাঁড়ি আর মাল্লাদেরকে। অন্যদিকে পাটাতনে উপবিষ্ট লোকগুলো যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিরান নিচের পাটাতনের উদ্দেশ্যে হাতের পতাকাটা নেড়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া শেষ করেই সে হাতের পতাকাটা তুলে পেছনের জাহাজের মাস্তুলের ওপরে উপবিষ্ট কাকের বাসায় বসা মানুষটার উদ্দেশে নাড়তে লাগল। নিজের হাতের পতাকাটা নাড়া শেষ হতেই কিরান অন্যহাতে ধরা দূরবীক্ষণটা তুলে দেখতে লাগল পেছনের জাহাজের কাকের বাসায় থাকা মনুষটাও একইভাবে ঠিক ওর মতো করেই পতাকাটা নিচের পাটাতনের উদ্দেশে নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওই জাহাজের পাটাতনে থাকা পট্টবর্ধন নিজের লোকদেরকে নির্দেশনা দেওয়া শুরু করতেই তার জাহাজের পাটাতেনরও একই তৎপরতা শুরু হয়ে গেল।

বেদুকে বাকি নির্দেশনা দেওয়ার পতাকাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে জংলাটিলার দিকে নজর রাখতে বলে সে কাকের বাসা থেকে লাফ দিয়ে ধরে ফেলল পাশের একটা দড়ি। তারপর সেটা বেয়ে তড়তড়িয়ে নেমে এলো পাটাতনের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটু হলেই সে পড়েই যেত। কোনোমতে একটা পিপে ধরে সামলে নিল নিজের ভারসাম্য। কারণ জাহাজের গতি বেড়ে গেছে আগের চেয়ে।

কিরান দেখল জাহাজের পাটাতনের ওপরে ওর নির্দেশ এবং জাহাজে যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়ম আনুযায়ীই কাজ চলছে পুরোদমে। এই জাহাজ থেকে যেহেতু আক্রমণটা পরিচালিত হবে সামনের দিকে কাজেই, জাহাজের সামনের দিকের চোখা মাথাটার দুপাশে সারি দিয়ে চারটে করে আটটা কামান সাজানো হয়েছে। সেখানে গোলন্দাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে নির্দেশনা দিচ্ছে যোদ্ধাদের। যোদ্ধারাও তার নির্দেশনা অনুযায়ী কামানে গোলা ভরছে। কেউ আবার প্রতিটি কামানের পাশে সাজিয়ে রাখছে যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ। আবার প্রতিটি কামানের পাশে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটা করে বারুদের পিপে। সেটার পাশে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে মশলা মাখানো ছোটো ছোটো মশাল। আর মশালের পাশেই জ্বলন্ত কয়লার ঝাঁঝরি। কামাঞ্চিদের সারির পরেই কাজ করছে বন্দুকবাজদের দলটা। বন্ধুকবাজদের দলটাতে আছে কমপক্ষে দশ থেকে বারো জন। প্রথম আক্রমণ কামাঞ্চিরা সামলে নিলেও শত্রুজাহাজ কাছাকাছি হতেই শুরু হবে বন্দুকবাজদের কাজ। শুক্রকে আওতার ভেতরে পাওয়ামাত্রই গুলি চালাবে এরা। আর বন্দুকবাজরা একবার গুলি করতেই বন্দুকে আবার টোটা ভরতে শুরু করতেই তাদের পেছন থেকে সামনে এগিয়ে যাবে তিরন্দাজদের দল। বন্দুকবাজরা যেমন নিজেদের বন্দুক ঠিক ঠাক করে টোটা ভরে বারুদ ঠেসে রাখবে। তিরন্দাজরা ঠিক তেমনি শেষ মুহূর্তে নিজেদের ধনুকে ছিলা পরিয়ে তিরের তূণীরে সব্জিয়ে রাখছে। আর এদের সবার পরে শত্রুজাহাজ যখন একেবারেই চলে আসবে সীমানার ভেতরে লড়াই শুরু

হয়ে যাবে হাতে হাতে। এদের পেছন থেকে কোচ বল্লম আর তলোয়ার হাতে এগিয়ে যাবে লাঠিয়াল বাহিনী। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তাদের মাঝে নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত রঙ্গন মল্লিক। কিরানও গিয়ে হাত লাগাল সবার সঙ্গে।

কাজ খানিকটা গোছানো হয়ে যেতেই গোলন্দাজকে নিয়ে কিরান চলে এলো জাহাজের একেবারে সামনের অংশে। চোখে দূরবীক্ষণ লাগিয়ে জাহাজ দেখতে না পেলেও পরিষ্কার দেখতে পেল জাহাজ থেকে উঠতে থাকা ধোঁয়ার সারিটা আরো মোটা হয়েছে। সামনেই জংলাটিলা এলাকায় প্রবেশের পথ

‘কী মনে হয়, ওইটা দিয়া জাহাজ ঢুকতে কোনো সমস্যা হবে?’ গোলন্দাজ জানতে চাইল। পরিশ্রমের চোটে তার মুখ লাল দেখাচ্ছে। নিজের কোমরের সঙ্গে ঝুলতে থাকা চামড়ার আরকের থলিটা তার দিকে এগিয়ে দিল কিরান। সঙ্গে সঙ্গে সেটা থেকে দুঢোক খেয়ে নিয়ে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে সেটা আবার কিরানের দিকে এগিয়ে দিল গোলন্দাজ। আরকের শেষ বিন্দুটাও গলায় ঢেলে আবারও দূরবীক্ষণ তুলে নিল চোখে।

‘কুনো সমস্যা হইবে না। এরকম জাহাজ দুইটা ঢুকতে পারব ওই রাস্তা দিয়া,’ বলে কিরান চোখ নামিয়ে পাটাতনের তৎপরতা দেখে নিয়ে চিৎকার করে সবাইকে জলদি কাজ করার নির্দেশনা দিল। ‘সমস্যা হবে অন্য জায়গায়,’ সে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে গোলন্দাজের চোখে। ‘পুরনো বন্ধু, মনে আছে তো কী করতে হবে?’

গোলন্দাজও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘অবশ্যই মনে আছে হে বন্ধু,’ বলে সে নিজের হাতটাকে এগিয়ে দিল কিরানের দিকে। কিরান সেটাকে শক্ত করে ধরে একটা ঝাঁকি দিল। ‘অনেক কিছুই তোমার ওপরে নির্ভর করছে। পুরনো দিন, পুরনো মানুষ, পুরনো প্রতিশোধ। এবার আর হারলে চলব না।’

‘কোনোভাবেই হারলে চলবে না,’ বলে সে হাতটা টেনে নিয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল কিরানকে। বুকের বলই আসল বল, অস্ফুটে বলে উঠল সে।

‘বুকের বলই আসল বল,’ বলে কিরানও তাকে জড়িয়ে ধরে রইল কয়েক মুহূর্ত তারপর তাকে ছেড়েই ত্রস্ত পায়ে জাহাজের পাটাতনের ভেতর দিয়ে এগোল সামনের দিকে। ‘জলদি জলদি, যদিও কাজ প্রায় অনেকটাই সারা হয়ে গেছে তবুও সবাইকে আরেক দফা তাড়া লাগাল সে। তারপর গোলন্দাজকে নিয়ে জলদি এগোল জাহাজের সামনের অংশের দিকে। সে আর গোলন্দাজ মিলে ওখান থেকে পরিচালনা করবে একেবারে সম্মুখযুদ্ধটা। কাপ্তান সবসময়ই এভাবেই পরিচালনা করে যুদ্ধ। জাহাজের পাতাটন থেকে সিঁড়ি বেয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল কিরান আর গোলন্দাজ। জাহাজের পাটাতনের দিকে তাকিয়ে দেখল কাজ অনেকটাই শেষ হয়ে এসেছে। নিজের কামরার সামনে সাজানো জিনিসগুলো দেখে নিল সে এক পলক। নিজের কোমরে গুঁজে রাখা জোড়া পিস্তল। রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা বন্দুকসহ সবকিছু শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নিল। তারপর অন্যপাশ থেকে অনেক লম্বা নলের একটা বন্দুক তুলে নিয়ে যত্নের সঙ্গে টোটা ভরল সেটাতে। তারপর সেটা এগিয়ে দিল গোলন্দাজের দিকে।

‘তোমার জন্য বন্ধু, তোমার গ্রামের জন্য।’

জিনিসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল গোলন্দাজ। তারপর মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘পুরনো দিনের জন্য, পুরনো দিনের মতোই।’ বলে বন্দুকটাকে পরীক্ষা করে সেটাকে পিঠের ওপরে ঝুলিয়ে নিল। তারপর এক লাফে নেমে পড়ল পাটাতনে। চিৎকার করে নির্দেশনা দিতে লাগল নিজের লোকদের। কিরান আবারও তুলে নিল দূরবীক্ষণটা। জংলাটিলায় প্রবেশের পথটা প্রায় চলে এসেছে। আর কিছুক্ষণের ভেতরেই ওরা প্রবেশ করবে দুই সারি টিলার মাঝখানের প্রবেশপথের ভেতর দিয়ে। সেই সঙ্গে কিরান অনুমান করল, ওরা দৃশ্যমান হয়ে যাবে শত্রুর চোখে। আর তাই পরিকল্পনাও সেভাবেই মোকাবেলা করার।

ওরা প্রায় জংলাটিলার প্রবেশপথের কাছে চলে এসেছে। কিরান রেলিংয়ের পাশ থেকে একটা পতাকা তুলে বেদুর উদ্দেশ্যে শিস বাজাল। বেদু তাকাতেই সেটা নাড়তে শুরু করল সে। সেই সঙ্গে বেদু ওর উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে নিজের সামনে থেকে তুলে নিল একটা পতাকা। তারপর সেটাকে নাড়তে শুরু করল পেছনের জাহাজের উদ্দেশ্যে। এটা একটা সংকেত। বেদু ইশারা দেবার একটু পরেই সেই সংকেত পৌছে গেল পেছনের দুই জাহাজে। সঙ্গে সঙ্গে কমে আসতে লাগল পেছনের দুই জাহাজের কোলাহল। পেছনে দুই জাহাজের উদ্দেশ্যে সংকেত পাঠিয়ে দিয়ে কিরান এবার নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে সবাইকে শান্ত হয়ে যেতে বলল। ওর নির্দেশ পাওয়ামাত্রই যে যার যার হাতের কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ল জাহাজের পাটাতনের ওপরে। সেই সঙ্গে জাহাজের রেলিংয়ের একপাশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো কামানের মুখগুলো। বন্দুক তির থেকে শুরু করে সমস্ত অস্ত্র নামিয়ে রাখা হলো পাটাতনের ওপরে।

কিরান মনোযোগ দিয়ে দেখছে সামনে। সবাই শুয়ে পড়ামাত্রই ওদের জাহাজটা ঢুকে পড়ল দুই সারি টিলার ভেতর দিয়ে। পুরো জাহাজটাকে যেন আধো অন্ধকার টিলার ভেতরের পথটা গহ্বরের মতো গিলে নিল। কিরান যদিও পাটাতনের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু জাহাজের পাটাতনের সবাই দূর থেকে দৃশ্যমান নয়। দূর থেকে যদি কেউ জাহাজের ওপরে নজর রেখেও থাকে তবুও চট করে কিছু ধরে ফেলতে পারবে না। যদিও এরকম জায়গায় শত্রুজাহাজ ছাড়া অন্য কারো থাকার কোনোই কারণ নেই তবুও দূর থেকে যদি কেউ দেখে তবু মহূর্তের জন্য দ্বিধা করবে। কারণ দূর থেকে দেখে জাহাজের অস্ত্র কিংবা প্রস্তুতি কিছুই সঠিকভাবে চোখে পড়বে না। আর এই সুযোগটাই নিতে চাইছে কিরান। কিন্তু শত্রুজাহাজ কোথায়? চোখে দূরবীক্ষণ লাগাল কিরান।

ওদের দুইপাশে পানি থেকে বরাবর সোজা ওপরে উঠে গেছে ঘাস আর লতাপাতায় ছাওয়া টিলা। সেগুলোকে ঢেকে রেখেছে মোটা ঘাসের জঙ্গল। তার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে স্বচ্ছ পানির ধারা। অনেকটা নদীর মতোই বলা চলে। কিরানদের জাহাজের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ওদের ঠিক পেছন পেছন বরাবর এগোচ্ছে আরো দুটো জাহাজ। কিরান নির্দেশনা দেয়ামাত্রই সেগুলো ছড়িয়ে দুইপাশে চলে যাবে পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু কোনো জাহাজই তো চোখে পড়ছে না।

ওর সামনে একটা টিলা অনেকটাই নদীর ওপরে বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকার মতো ঝুলে রয়েছে। কিরান দেখল গোমেজ টিলাটা দেখামাত্রই ত্রস্ত এবং অভ্যস্ত হাতে জাহাজের হালের চাকাটা ঘোরাতে শুরু করেছে। শেষ মুহূর্তে জাহাজটা বাঁক নিয়ে আবারও সোজা হয়ে গেল। পেছনের জাহাজগুলোও একই কাজ করল। তিনটা জাহাজই একেবারে নিঃশব্দে এক এক করে পেরিয়ে এলো বাঁকা টিলাটা।

আর বাঁকটা পার হতেই ওরা দেখতে পেল বাঁকের ওপাশে নদীটা আরো চওড়া হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। সেখানে গিয়ে মিলেছে আরো দুটো সমান্তরাল, নদীর সঙ্গে। আর তিন দিকের সংযোগস্থলে দানবীয় বিভীষিকার মতোই দাঁড়িয়ে আছে পাল নামানো বিরাটাকায় একটা জাহাজ।

জাহাজটাকে দেখামাত্রই কিরানের অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বর্তমানে নেই, বরং সে ফিরে গেছে অতীতের কোনো এক সময়ে। সেই ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে, চারপাশে শোঁ শোঁ করে ছুটছে তির, বৃষ্টির মতো বর্ষিত হচ্ছে তির। আর আগুনের উত্তাপে মনে হচ্ছে যেন চারপাশের পৃথিবী নিখাদ নরকে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তের জন্য অতীতে হারিয়ে গেলেও পরমুহূর্তে সব হাওয়া হয়ে গেল চারপাশ থেকে। বরং একেবারে শান্ত পানিতে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকা নিঃশব্দ জাহাজ আর ঝির ঝির করে বইতে থাকা মৃদু হাওয়ায় কিরানের বুকের গহিন কোনে বেজে উঠল এক আনন্দ ঝংকার। না, এখনো সে বেঁচে আছে আর সময় এসেছে সেই পঙ্কিল অতীতকে মুছে ফেলে নতুন জীবনের সূচনা করার। কারণ সেই দুঃসহ অতীতের পাপের ছায়া মুছে ফেলার এটাই সুযোগ।

সামনের জাহাজটা বাঁক পেরুতেই কিরান পায়ের কাছ থেকে তুলে নিল একটা বিশেষ পতাকা, সেটা নেড়ে সংকেত দিল সে কাকের বাসায় বসা বেদুকে। সঙ্গে সঙ্গে বেদুও সেই পতাকাই নাড়তে শুরু করল। এই সংকেত পেছনের দুই জাহাজের জন্য। ওদের জাহাজটা সামনে এগোতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাঁকের পুরোভাগটাকে আড়াল করে রাখবে। আর এই সুযোগে ওদের পেছনে থাকা জাহাজ দুটো সংকেত পাওয়া মাত্রই বাঁকের দুপাশের সেই জলধারাদুটো দিয়ে রওনা দিল দুদিকে। পেছনের জাহাজ দুটো দুদিকে চলে যেতেই কিরান ইশারা করল জাহাজের চাকায় হালের কাছে থাকা গোমেজকে উদ্দেশ্য করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গোমেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চাকাটাকে আরেকজনের হাতে ছেড়ে দিল। সংকেত পাঠানো খোলের ভেতরে থাকা মাল্লাদের উদ্দেশ্যে। সেই সঙ্গে একে একে নামিয়ে দেওয়া হলো পালগুলো। জাহাজ এখন প্রায় নিঃশব্দে এগোচ্ছে শত্রু জাহাজের দিকে। পাটাতনের নিচে হয়ে শুয়ে আছে সবাই। এগোতে এগোতে জাহাজের গতি কমে আসতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।

শত্রুপক্ষের জাহাজটা ঠিক যেই মুহূর্তে ওরা দেখতে পেল কিরান দেখল প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে। জাহাজটাতে মৃদু চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে জাহাজের পাটাতনের দিক থেকে বিশেষ একটা পতাকা হাতে নিয়ে নাড়তে শুরু করল ওদের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে গোলন্দাজ আর গোমেজ একসঙ্গে ফিরে তাকাল কিরানের দিকে। ক্ষুধার্ত শার্দুলের দৃষ্টি নিয়ে কিরান তাকিয়ে আছে সামনের জাহাজের দিকে। একটা হাত তুলে সে ওদেরকে শান্ত থাকতে বলল। কিরান মনে মনে গুনতে শুরু করল, এক..দুই..তিন..

জাহাজের গতি কমতে কমতে প্রায় স্থির হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পায়ের কাছ থেকে সুপারিগাছের কাণ্ড চেঁছে বানানো একটা বেইদ তুলে নিল কিরান I সেটাকে দুইপাক ঘুরিয়ে ছুরে মারল গোমেজের দিকে। মুখে এক সূর্য পরিমাণ হাসি নিয়ে গোমেজ দুই হাতে ধরে ফেলল সাদাটে বাদামি রঙের প্রায় সাত ফিট লম্বা চোখা লাঠির মতো জিনিসটা। কিরান হাতের ইশারা করতেই জাহাজের পাটাতনের ওপর দিয়ে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের মতো ছুটল গোমেজ পাটাতনের শেষ প্রান্তের দিকে।

পাটাতনের ওপরে থাকা যোদ্ধাদের অনেকেই গড়িয়ে সরে গেল অথবা লাফিয়ে সরে পড়ল গোমেজকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। বেইদটাকে বর্শার মতো করে ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে গোমেজের গতি বাড়তে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে সে শরীরটাকে বিশেষ একটা ভঙ্গিতে নিয়ে এলো। তারপর পাটাতনের একেবারে কিনারায় গিয়ে সর্বশক্তিতে ছুটন্ত ইগলের মতো তার হাত থেকে ছুটে গেল বেইদটা। সময় যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।

জলের ওপরে ছায়া কেটে বাতাস ভেদ করে সময়কে তাক লাগিয়ে যেন ছুটে চলল জিনিসটা। তারপর অবিশ্বাস্য দূরত্ব পার করে সেটা গিয়ে সোজা বিঁধে গেল শত্রুজাহাজে পতাকা নাড়তে থাকা লোকটার বুকে। তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে শত্রুজাহাজের পাটাতনের ওপরে গেঁথে ফেলল মানুষটাকে। জাহাজে জাহাজে যুদ্ধের ঘোষণার বহু পুরনো রীতি এটা…

বেইদটা লোকটাকে বিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কিরান চিৎকার করে উঠল, ‘এক্ষণ…’ ওদের জাহাজের পাটাতনের ওপর অবস্থান নেওয়া যোদ্ধারা রণহুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। মাটিয়ে শুইয়ে রাখা কামানের মুখগুলো তুলে ফেলা হলো পাটাতনের রেলিংয়ের ওপরে। গোলা আগে থেকে ভরাই ছিল স্রেফ আগুন দেওয়া হলো কামানগুলোতে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে একইসঙ্গে দুই হালি কামান থেকে বর্ষিত অগ্নিকুণ্ড ছুটে গেল শত্রুজাহাজের দিকে। কিরান অনুভব করতে পারল, শত্রুজাহাজের দস্যুরা তাদের পতাকাওয়ালা সঙ্গীর মৃত্যুর ধামাকা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার আগেই দেখতে পেল এক ঝাঁক গোলা ছুটে আসছে তাদের দিকে। পড়িমরি করে ছুটল তারা। সবগুলো না হলেও বেশিরভাগ গোলা আছড়ে পড়ল জাহাজের ওপরে আর না জাহাজসংলগ্ন পানিতে। চিৎকার চেঁচামেচি আর আহাজারির ভেতরেই কিরান দেখল ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে দস্যুরা।

তবে সে জানে ওরাও দক্ষ যোদ্ধা, এরকম পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছে ওরা। কাজেই খুব দ্রুতই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে প্রতিরোধ করে উঠবে লোকগুলো। তবে তার আগেই মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে এদের। প্রথম দফা কামানের গোলা বর্ষিত হতেই কামাঞ্চিরা আবার গোলা ভরতে শুরু করেছে গোলন্দাজের নির্দেশে কামাঞ্চিদের পেছন থেকে সামনে এগিয়ে গেল বন্দুকধারীরা। প্রায় একসঙ্গে এক ডজনের বেশ লোক গুলি চালাল শত্রুজাহাজের ওপরে। কিরান আবারও চিৎকার করে আক্রমণ করার নির্দেশ দিল। এবার বন্দুকবাজদের পেছনে গোলা ভরতে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল তিরন্দাজরা। কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলির বর্ষণে মৌমাছির ঝাঁকের মতো ছুটে গেল এক ঝাঁক তির।

ততক্ষণে গোমেজ ফিরে এসে হাল ধরেছে আবার। সেই সঙ্গে কিরান দেখল রঙ্গনের নির্দেশে গোলা ভরা শেষ হতেই আবারও কামান চালানো শুরু করেছে কামাঞ্চিরা। কিন্তু এর ভেতরেও অপর দিককার জাহাজ থেকে ছুটে এলো কামানের গোলা। তিন-চারটে কামানের গোলা ছুটে এসে উড়িয়ে দিল পাটাতনের একাংশ আর আশেপাশের পানির ওপরে পড়ল বাকিগুলো। কিরান লাফিয়ে নেমে এলো পাটাতনের ওপরে গোমেজকে পূর্ণ বেগে জাহাজ ছোটাতে বলে, সে চলে এলো গোলন্দাজের পাশে। কামাঞ্চিদের হুংকার, রণচিৎকার গুলির শব্দ আর ওপর দিক থেকে ছুটে আসা গোলার শব্দে নরকে পরিণত হয়েছে একটু আগের শান্ত জল উপত্যকা।

‘আবার আবার,’ চিৎকার করে উঠল কিরান। তার চিৎকার চাপা পড়ে গেল তৃতীয় দফা গোলা আর বন্দুকের গুলির শব্দে। কিরান পাটাতনের কিনারায় এসে হন্যে হয়ে চোখ বুলাতে শুরু করল সামনের জাহাজে। ওখানে পাটাতনের ওপর থেকে কামান দাগা শুরু হচ্ছে। বন্দুকের গুলিও করছে অনেকেই। কিন্তু ওই জাহাজের সমন্বয়হীনতার কারণে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। কিরান হন্যে হয়ে চোখ বুলাচ্ছে সিলভেরাকে চোখে পড়ে কি না দেখার জন্য। কিন্তু তার ছায়াও দেখতে পেল না সে। এমন সময় সামনের জাহাজটা নড়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে তীব্র আর শক্তিশালী এক বিজয়োল্লাসের সঙ্গে কিরান অনুভব করল, ওটা পিছু হটতে শুরু করেছে।

আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে কিরানের জাহাজের লোকেরা আক্রমণের জোর বাড়িয়ে দিল আরও। চিৎকার করে আবারও অগ্নিবর্ষণ করার নির্দেশ দিল গোলন্দাজ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূতে পেয়েছে। কিন্তু কিরান জানে এই বিজয়ের কোনো দাম থাকবে না যদি সাপের মাথাটা কাটতে না পারে। অর্থাৎ সিলভেরাকে হত্যা করতে না পারে।

কিরান চিৎকার করে গোমেজকে বলল জাহাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিতে। অপর জাহাজটা এখন বন্দর ছেড়ে পেছনের মোহনার দিকে যেতে শুরু করেছে। কিরান দেখল ওটা থেকে এখন কামানের গোলা আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে সিলভেরা জাহাজটাকে নিয়ে হয় পালাতে চাইছে, আর না হয় সে পিছু হটে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে আক্রমণ করার তালে আছে। সিলভেরার জাহাজটা আরেকটু পিছিয়ে যেতেই কাঠের সঙ্গে কাঠের মর্মর ধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠল বিকেলের বাতাস। উল্লাসের সঙ্গে কিরান দেখতে পেল অপর দিকের মোহনায় পৌছবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে সিলভেলার জাহাজের। কারণ ওদের অন্য দুটো জাহাজ ভিন্ন দিক থেকে এসে পলায়নরত জাহাজটার পথটা রুদ্ধ করে ফেলেছে। কিরান জাহাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিতে বলল। পেছন থেকে পট্টবর্ধনের জাহাজ তো পালাবার পথ আটকে দিয়েছিলই, অপর পাশ থেকে তৃতীয় জাহাজটাও বাড়ি মারল ওটার একপাশে। আবারও কাঠের সঙ্গে কাঠের সংঘর্ষের শব্দে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। আর তিন জাহাজ থেকেই আনন্দধ্বনি ভেসে এলো।

কিরান আরো জোরে জাহাজ ছোটাতে বলে গোলন্দাজকে ডাকতে যাবে তার আগেই শত্রুজাহাজের পাটাতনের ওপরে হালের কছেই একটা বিরাটকায় মূর্তিকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। উলটোদিক থেকে আসা অস্তমিত সূর্যের আবছা আলোতে সে দেখতে পেল, মানুষটার মাথার চারপাশে উড়ছে ধোঁয়া, আর একটা হাত কোমরে রেখে সে দাঁড়িয়ে আছে।

‘সিলভেরা,’ অস্ফুটে বলে উঠল কিরান। ‘গোলন্দাজ, সময় এসে গেছে।’

উন্মাদের মতো নিজের লোকদের একের পর এক আক্রমণের নির্দেশ দিচ্ছিল গোলন্দাজ। কিরানের ডাক শুনেই সে পাটাতনের ওপরে শুইয়ে রাখা নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়ে দৌড়ে চলে এলো কিরানের পাশে। ‘সিলভেরা,’ অস্ফুটে অপর জাহাজে থাকা ছায়াটা দেখিয়ে বলে উঠল কিরান। গোলন্দাজ বন্দুকটাকে জাহাজের রেলিংয়ের ওপরে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, আর একটা হাত তলোয়ারের বাঁটে রেখে পেছন ফিরে গোমেজদের দিকে একবার ইশারা করে কিরান প্রস্তুত হয়ে গেল। ওদের জাহাজ প্রায় শত্রু জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে। কিরানের পেছনে অন্তত বিশ জন যোদ্ধা তলোয়ার, বর্শা, কোচ আর অন্যান্য দেশি অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত।

‘গোলন্দাজ, এক্ষণ।’

বন্দুকটা কাঁধে চেপে গোলন্দাজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পাশেই তলোয়ারের বাঁটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিরান। গোলন্দাজের গুলি ছুটে যেতে না দেখলেও শব্দের চোটে কানে তালা লেগে এলো ওর। সেই সঙ্গে ওদের জাহজাটা গিয়ে ধাক্কা মারল শত্রু-জাহাজে। কিরান আবছাভাবে দেখতে পেল পাটাতনের ওপরে সিলভেরার বিরাট মূর্তিটা পড়ে গেল। উল্লাস ধ্বনির সঙ্গে তলোয়ারের বাঁটে হাত রেখে সে পালের একটা দড়ি ধরে সরাসরি আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে দড়িতে ঝুলে রওনা দিল শত্রুজাহাজের দিকে। দড়িটাতে ঝুলে শূন্যে উড়াল দিয়ে নেমে এলো জাহাজের পাটাতনের ওপরে।

পাটাতনের ওপরে এক গড়ান দিয়েই খোলা তলোয়ার হাতে সোজা হলো সে। ওর পেছনে পেছনে শত্রুজাহাজে নেমে এসেছে আরো অন্তত বিশজন যোদ্ধা। পাটাতনের ওপরে থাকা সবাইকে একে একে কচুকাটা করতে লাগল ওরা। উলটোদিকে তাকিয়ে দেখল ওদের বাকি দুটো জাহাজ থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছে এদিকে। কিন্তু নির্দেশনা অনুযায়ী সরাসরি কেউ আক্রমণ চালায়নি।

কিরান টুকরো কয়েকটা আক্রমণ ফিরিয়েই দৌড় দিল হালের দিকে। পাশ থেকে আবছা অন্ধকারে হালকাভাবে দেখতে পেল হালের ঘুরন্ত চাকার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সিলভেরা। পাটাতনের ওপরে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল সে। একটা রেলিং টপকে শূন্যে লাফিয়ে পড়ে খোলা তলোয়ারটাকে দুই হাতে ধরে সেটাকে নিয়ে সোজা বসিয়ে দিল হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মানুষটার বুকে। ভেবেছিল ছুটন্ত অবস্থাতেই দুয়েকটা গুলি ছুটে আসবে। কিংবা ও তলোয়ার চালানোর আগেই হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সিলভেরা সেটা আটকে দেবে। কিন্তু সেটা তো হলোই না, বরং ওর তলোয়ারটা বুকে নিয়ে গড়িয়ে পাটাতনের ওপরে গেল মানুষটা। স্বস্তির সঙ্গে নিজের পায়ের ওপরে সোজা হলো কিরান। তারপর পায়ের ডগা দিয়ে সোজা করল অমানুষটাকে।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সে। যে মানুষটা পাটাতনের ওপরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সে বিশালাকায় কিন্তু অবশ্যই সে সিলভেরা নয়। কারণ যে পড়ে পাটাতনের ওপরে রক্তে ভেসে যাওয়া বুক নিয়ে সে এদেশীয় মানুষ, বাদামি চামড়ার মানুষ। মানুষটার দিকে তাকিয়ে চূড়ান্ত হতাশ হয়ে কিরান কী করবে মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল নিজের জাহাজের দিকে। বুঝতে পারছে না, আসলে হলোটা কী।

এমন সময় বন্দরের কাছের ছোটো টিলার ওপর থেকে একসঙ্গে এক ঝাঁক কামানের গোলা ছুটে এলো ওদের জাহাজের দিকে। সেই সঙ্গে বন্দরের পেছনের দেখা গেল একটা জাহাজের কোনা। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা জাহাজটা সোজা এসে বাড়ি মারল কিরানদের জাহাজে। সেই সঙ্গে ওপর দিক থেকে ভেসে আসা রণহুংকার শুনে কিরানরা ফিরে তাকাল ওপরের দিকে। টিলার ওপর থেকে দড়ি বেয়ে নেমে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে দস্যুরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওদের দুটো জাহাজের ওপরেই। কিরান চিৎকার করে আক্রমণের নির্দেশ দিতে যাবে তার আগেই বুকের বর্মের ওপরে গুলি খেয়ে পড়ে গেল সে পাটাতনের ওপরে।

যদিও বুকের সঙ্গে বর্ম আটকানো আছে। কিন্তু গুলির তীব্র ধাক্কায় বুকের বাতাস সব বেরিয়ে গেছে। কোনোমতে পাটাতনের ওপর সোজা হলো সে। সেই সঙ্গে সিঁড়ির ওপরে পায়ের আওয়াজ শুনে সে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল। কাপ্তানের যেখানে থাকার কথা সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে বিরাটাকায় একজন মানুষ। মানুষটার এক হাতে বিরাট একটা তলোয়ার আর অন্যহাতে একটা লম্বা নলের পিস্তল।

‘সিলভেরা,’ লোকটার বুদ্ধির কাছে কীভাবে বোকা বনেছে সেটা ভেবে মুহূর্তেই রাগের হলকা বয়ে গেল কিরানের শরীরে। তলোয়ারটা ছুটে গেছে হাত থেকে। কোমর থেকে ড্যাগারটা বের করার জন্য হাতলটা ধরতেই যমদূতের মতোই তার সামনে উদয় হলো সিলভেরা। একটা পা দিয়ে সে চেপে ধরল কিরানের হাত। অন্যহাতে কিরান বের করে আনল নিজের পিস্তলটা। কিন্তু ছোটো বাচ্চাদের হাত থেকে খেলনা কেড়ে নেওয়ার জন্য বড়োরা যেভাবে তাদের হাত চেপে ধরে সেভাবে কিরানের হাত চেপে ধরে শিশুর মতোই তাকে টেনে শূন্যে তুলে ফেলল সিলভেরা।

কিরান দেখল যুদ্ধেও ভেতরেও সিলভেরার মুখে পাইপ। সেটা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মুখভর্তি চুল-দাড়ির জঙ্গলের ভেতর থেকে টকটকে লাল শান্ত একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিরান অবাক হয়ে দেখল লোকটার চোখে কোনো ভাষা নেই। একেবারেই নির্লিপ্ত তার দৃষ্টি। এমনকি তাতে শত্রুকে বুদ্ধিতে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দও নেই। কিরানকে শূন্যে তুলে সে বাচ্চাদের মতোই ছুঁড়ে ফেলে দিল পাটাতনের ওপরে।

কিরানের মনে হলো ওর ঘাড় ভেঙে গেছে। কোনোমতে উলটো থেকে সোজা হলো সে। তার মনে এমনকি হেরে যাবার গ্লানিও কাজ করছে না। সে একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল তার জাহাজ আর সিলভেরার জাহাজের ওপর চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। অন্য জাহাজ দুটোর অবস্থা কী হলো কে জানে। তবে কিরান এসব কিছুই ভাবছে না। তার মনে একটাই ভাবনা, তাকে সোজা হতে হবে। কোনোমতে সোজা হয়ে হেলান দিয়ে বসল সে রেলিংয়ে। পাশেই একটা পিস্তল পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিয়ে গুলি করল এগোতে থাকা সিলভেরার দিকে। কিন্তু খালি পিস্তলটা থেকে গুলি বেরুল না।

কিরান দেখল সিলভেরা আগের মতো নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিরান খালি পিস্তলটা ছুড়ে মারল সিলভেরার দিকে। মাছি তাড়ানোর মতো করে সেটা সরিয়ে দিল সে। বদলে একহাতে চেপে ধরল কিরানের মাথার চুল। অন্যহাতে নিজের বিরাট তলোয়ারটা তুলে ধরল।

কিরান বুঝল সময় ফুরিয়ে এসেছে, সব খেলা সাঙ্গ হতে চলেছে। একবার ডানে তাকাল সে। কেন নিজেও জানে না। কিন্তু সেদিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল ওদের দিকে ছুটে আসছে একটা ক্ষিপ্ত ষাঁড়। সিলভেরাও শেষ মুহূর্তে কিছু একটা টের পেয়ে সেদিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে দুজনকেই একসঙ্গে ধাক্কা মারল গোমেজ।

তীব্র ধাক্কার চোটে সিলভেরা একদিকে আর কিরান আরেকদিকে পড়ে গেল। পাটতনে পড়ে থাকা কিরানকে জড়িয়ে ধরে তুলে ফেলল গোমেজ। সিলভেরা পাটাতনে পড়ে থাকা অবস্থাতেই পিস্তল তাক করল ওদের দিকে। প্রায় একই সময়ে একটা গোলার আঘাতে জাহাজের রেলিংয়ের একটা অংশ উড়ে গেল। কিরান আর তাকে ধরে থাকা গোমেজ দুজনেই পড়ে গেল পানিতে।

কিরান অনুভব করল কালো চাদরের চেয়ে ততোধিক অন্ধকার নোনা পানি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিতে লাগল তাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *