মগরাজ – ৩৮

অধ্যায় আটত্রিশ – বর্তমান সময়

পতেঙ্গা রোড, চট্টগ্রাম

‘আমি জানি আমার অনেক ব্যাখ্যা দেয়ার আছে,’ কথাগুলো শারিয়ারের মুখ দিয়ে যখন উচ্চারিত হলো তখনো নিজের দুই হাত শরীরের দুইপাশে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে ওঠানো। ‘আমি একে একে বলছি, সবাইকে খানিকটা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। বলে সে টেবিলের চারপাশে বসে থাকা ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারাগুলো একে একে দেখে নিল।

কেউ কিছু বলার আগে ডক্টর শশী ঝমঝমে গলায় কথা বলে উঠল সবার আগে, ‘আপনি যেই হোন আর যাই বলতে চান সেটা শোনার চেয়ে আমি মুহূর্তে আগে পরিচ্ছন্ন হওয়ার তাগিদ অনুভব করছি। বাথরুম খালি আছে?’ সে পেছনের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইল।

‘আর আমি তোমার বক্তব্য শোনার আগে আমার পাকস্থলির ডাক শুনতে বেশি আগ্রহী এই মুহূর্তে,’ ভুবন নিজের মোবাইল থেমে মুখ তুলে বলে উঠল।  

‘আমিও,’ ভুবনকে সাপোর্ট জানাল টমি।

শারিয়ার সবার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। একটা চেয়ার টেনে নিতে নিতে সে ডক্টর শশীকে টয়লেটের রাস্তা দেখিয়ে সেদিকে যেতে আহ্বান জানাল।

সেই ডকইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে প্রথমে চায়নিজ লোকটার খপ্পর থেকে তারপর রুম্পাদেরকে কলা দেখিয়ে পালিয়ে আসার পর ওরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে ওখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে শহরের পাশের হাইওয়ের সঙ্গের একটা রেস্টুরেন্টে। যদিও ওখান থেকে সরে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা শারিয়ারের। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে কয়েকটা কারণ ছিল। প্রথমত, ওরা যেখান থেকে সরে এসেছে সেখান থেকে সরে ওরা প্রথমেই শহরে ঢুকবে সবাই এটাই ধরে নেবে আর পুলিশ বা অন্যরা খোঁজও চালাবে সেভাবেই। কিন্তু ওরা এদিকটাতে আসবে এটা ভাবার সম্ভাবনা পুলিশ অথরিটি কিংবা শত্রুপক্ষ সবারই কম। দ্বিতীয়ত, ওরা সেখান থেকে সরে এসেই শারিয়ার ঢাকাতে ওদের ম্যানেজার হামিদ চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করে যেটার সন্ধান কেউই জানবে না। আপাতত চট্টগ্রামে ওদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা করার জন্য শারিয়ার কল করার আধা ঘণ্টার ভেতরেই ওকে একটা বাড়ির ঠিকানা পাঠায় ওর হামিদ চাচা। আসলে ওদেরই একটা বাড়ি আছে এখানে। কিন্তু স্থায়ীভাবে কেউই থাকে না ওখানে। শারিয়ারের চাচা কিংবা পরিবারের কেউ কোনো কাজে চট্টগ্রাম এলে ওটাতে ওঠে। বাড়িটার অবস্থানও ওদের থেকে কাছাকাছি। তার ওপরে ওখান থেকে সরে এসেই প্ৰথমেই শারিয়ার জানায় অথরিটি প্রথমেই ওদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ওদের ভেতরে শারিয়ারের এই নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, টমির কেউ নেই। ভুবন জানায় তা স্ত্রী আর সন্তান এই মুহূর্তে পাহাড়ে তার গোত্রের সঙ্গে আছে। কাজেই তারও কোনো সমস্যা নেই। বাকি থাকে একমাত্র সুমন। তার স্ত্রী বাড়িতে একা। শারিয়ারের পরামর্শেই সে স্ত্রীকে আপাতত ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলে। সে-জন্যই এই রেস্টুরেন্টে আসার পথে সুমন নেমে গেছে। স্ত্রীকে ঢাকার গাড়িতে উঠিয়ে তারপর এখানে আসবে সে।

ওরা সবাই অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। কাজেই ওদের বর্তমান ঠিকানায় সরে পড়ার আগে কিছু খাবার জন্য হলেও কোথাও থামাটা জরুরি ছিল, একারণেই ওরা এখানে থামে। একেবারে কাকভোর আর হাইওয়ের পাশে হওয়াতে হোটেলে জনসমাগম প্রায় নেই বলতে গেলে। হোটেলে এসে শারিয়ার ফ্রেশ হয়ে নিজের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য এই কথা বলেছে।

সবার উত্তর শুনে শারিয়ার একবার কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ঠিক আছে জান বাঁচানোর চেয়ে খাওয়াটাই যদি তোমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে আমার আর কী বলার আছে। ক্ষুধা তো আমারও লাগে,’ বলে সে ওয়েটারকে ডেকে সবার জন্য খাবারের অর্ডার দিল। অর্ডার দেওয়া শেষ করে ভুবন আর টমির দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘শোনো, খাবার আসতে আসতে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে ফেলি। ভুবন, ‘ এইটুকু বলে সে ভুবনের দিকে তাকাল। ‘তুই কী নিশ্চিত যে তোর পরিবারের কোনো সমস্যা হবে না?’

‘না বস,’ দুইপাশে মাথা নাড়ল ভুবন। ‘আমার ছেলের স্কুল বন্ধ এই মাসে। সে-কারণেই বউ আর ছেলে এখন গ্রামে, মানে পাহাড়ে। ওখানে কেউ ওদেরকে রিচ করতে পারবে না। তবুও আমি কথা বলেছি। কোনো সমস্যা নেই।’

‘আচ্ছা কথা বলা থেকে আগে বলে নেই,’ শারিয়ার বলে উঠল। ‘তোমরা দুজনেই এই মুহূর্তে নিজেদের মোবাইল অফ করে আমার কাছে জমা দাও। ডক্টর শশীর কাছে তো মোবাইলই নেই। কাজেই সে-ঝামেলাও নেই। আর সুমন আসামাত্রই ওর ফোনও নিয়ে নিতে হবে। কারণ আমাদের ট্রেস করার প্রধান উপায় হবে মোবাইল ফোন। এটা বন্ধ করতে হবে সবার আগে। তবে মোবাইল অফ করার আগে প্রত্যেকেই যার যার ফেসবুক ইমেইল ইত্যাদি যা আছে সেগুলো থেকে আগে লগ আউট করে নাও। সম্ভব হলে আপাতত অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভেট করে ফেলো।

টমি আর ভুবন নিঃশব্দে নিজেদের কাজ সেরে মোবাইলগুলো জমা দিয়ে দিল। শারিয়ার ফোনগুলো রাখতে রাখতে নিজের মোবাইলটা বের করে নাড়ল। ‘আমারটা আর কিছুক্ষণ ওপেন রাখতে হবে, হামিদ চাচার ফোন আসবে। ওটা আসামাত্রই উনার নির্দেশনা শুনেই অফ করে দেব। আর যেখানে যাব ওখানে ভিন্ন ফোন থাকবে। সেটার রেকর্ড ডাটাবেজে নেই। ওটা দিয়ে কাজ চালাতে পারব আপাতত, এইটুকু বলে শারিয়ার একবার টয়লেটের দিকে দেখে নিল, তারপর নিজের মুখটাকে খানিকটা সামনে নিয়ে এসে ভুবন আর টমির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘ডক্টর শশীকে কেমন মনে হলো তোমাদের কাছে?’

‘তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে,’ ভুবন আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘বস, একটা ব্যাপার মনে রেখো, তার আমাদেরকে খুব বেশি দরকার নেই। কিন্তু তাকে আমাদের দরকার। তার কাছে কী তথ্য আছে সেটার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে এখন।’

‘এবং তার কাছে অনেক মূল্যবান তথ্যই আছে,’ শারিয়ার আনমনেই বলে উঠল। ‘তা-না হলে তার পেছনে এত এত লোক লাগতো না। তার কাছ থেকে সেগুলো আদায় করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, যা ঘটছে আমাদের সঙ্গে সেগুলো এখনো টুকরো টুকরো হয়ে আছে। বিশেষ করে ডক্টর আবদেলের ব্যাপারটা এখনো অনেকটাই ধোঁয়াশা। আমার বিশ্বাস সেসব ব্যাপারে ডক্টর শশীর কাছে তথ্য আছে। কেসটা সমাধান করতে হলে সেগুলো জানতে হবে আমাদের। ওই যে সুমন চলে এসেছে।’

সুমন হোটেলের প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল টমি। ‘সুমন ভাই, এখানে।’

সুমনের হাতে একটা শপিং ব্যাগ। সেটাকে পাশে রেখে একটা চেয়ার টেনে সেটাতে ধপ করে বসে পড়ল সুমন। চূড়ান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না এই অবস্থার ভেতরে আছি,’ বলে সে নিজের মুখ তুলল। ‘কাল বিকেলেও সব ঠিক ছিল।’

‘আগামীকাল বিকেলেও যে আবার সব ঠিক হবে না সেটা তোমাকে কে বলতে পারে?’ ভুবন বিজ্ঞের মতো বলে উঠল। ‘হয়তো আরো ভালোও হতে পারে।’

‘বস, একটা সিগারেট খাওয়াও,’ সুমনকে এখনো অস্থির মনে হচ্ছে। শারিয়ার একটু আগে ওয়েটার ছেলেকে দিয়ে আনানো বেনসনের নতুন প্যাকেট খুলে একটা নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে আরো দুটো এগিয়ে দিল ভুবন আর সুমনের দিকে। ওর ডানহিলের স্টক শেষ হয়ে গেছে গতকাল।

‘দেখি আমাকেও একটা দিন,’ ওদের পেছন থেকে বলে উঠল শশী। যদিও কাপড়চোপড় আর চেহারার অবস্থা এখনো বিধ্বস্ত কিন্তু হাত-মুখ ধুয়ে আসাতে খানিকটা হলেও পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে তাকে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে একটা সিগারেট চাইল সে শারিয়ারের কাছে। শারিয়ার সিগারেট এগিয়ে দিতেই সে ওটাকে ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে। ‘আহ, কতক্ষণ পরে। শালারা আটকে রেখে খাবার ভালো দিলেও সিগারেট দিত না। আচ্ছা নাশতার অর্ডার করা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, অর্ডার করা হয়েছে,’ বলে শারিয়ার সুমনের দিকে শপিং ব্যাগটা দেখিয়ে ইশারা করল। শপিং ব্যাগটা তুলে এগিয়ে দিল ডক্টর শশীর দিকে। ‘ম্যাডাম এখানে আমার স্ত্রীর কিছু কাপড় আছে।’

শশী খুব অবাক হয়ে ব্যাগটা নিল।

‘এটা আমার আইডিয়া ছিল, একটা হাত তুলে বলে উঠল শারিয়ার। কারণ আমরা যেখানে যাব সেখানে সব থাকলেও মেয়েদের কাপড় থাকার সম্ভাবনা কম। আর একবার আমরা সেখানে ঢুকে গেলে কী অবস্থায় পড়ব জানি না। তাই আমিই সুমনকে বলেছিলাম ওর স্ত্রীর কিছু কাপড় নিয়ে আসতে। আশা করি আপনার কাজ চলবে।’

ডক্টর শশী ব্যাগটা হাতে নিয়ে একপলক দেখে নিয়ে আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আমার কী আপনাকে ধন্যবাদ জনানো উচিত নাকি আমাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছেন বলে এখনই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে লোক জড়ো করা উচিত?’ ডক্টর শশীর চোখেমুখে রহস্যময়তা।

শারিয়ার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ তার দিকে। তারপর নিজের একটা হাত মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘আমাদের এখনো ফরমালি পরিচয় হয়নি। আমি শারিয়ার, পিবিআইএসের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার,’ বলে সে ভুবনের দিকে দেখাল। ভুবন, এক্স স্পেশাল অপস কমান্ডো। এই কেসের সাপোর্টিং স্টাফ। টমি, আমাদের আইটি ও টেকনিক্যাল ফরেনসিক সাপোর্ট স্টাফ। সুমন, পিবিআই চট্টগ্রাম ব্যুরোর অফিসার,’ সে পরিচয় দেওয়া শেষ করে তাকিয়ে রইল ডক্টর শশীর দিকে।

‘সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল,’ ডক্টর শশী তার বাদামি চোখের মণিতে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল, ‘যদিও পরিবেশ পরিস্থিতি কোনোটাই আসলে ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তবুও সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। যদিও আমি এখনো অনেক কিছুই জানি না এবং বুঝতেও পারছি না তবুও আশা করছি আমরা পারস্পরিক সহায়তায় এই ক্রিটিক্যাল অবস্থা থেকে উদ্ধার হতে পারব। আমি শশী, কায়রোতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে কাজ করি,’ সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলে উঠল।

‘আপনি বাংলাদেশে এসেছিলেন কেন?’ প্রশ্নটা করে শারিয়ার টমির দিকে ফিরে নোট নিতে বলল। কিন্তু খাবার এসে পড়াতে আবার হাত নেড়ে মানা করে দিল।

সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেটাকে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দুই ঠোঁটের ফাঁকে আটকে পরোটা আর ডিম ভাজির প্লেটটা সামনে টেনে নিল শশী। ‘ডক্টর সুলতান হঠাৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আসতে বলাতেই ওইদিন রাতে আমি ওখানে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমার একটা ব্যাপার জানার ছিল। আমি যখন মানে ওই গুণ্ডাদের হাতে ধরা পড়ি তার আগে ডক্টর সুলতানকে একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে দেখি। উনার অবস্থা কী? মানে কেমন আছেন উনি এখন?’

শারিয়ার জবাব দেয়ার আগে একবার ভুবনের দিকে দেখে নিল। তারপর ডক্টর শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আপনি তো বন্দি ছিলেন তাই জানেন না। ডক্টর সুলতান ওখানেই গাড়ির সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।’

ডক্টর শশী খাবার টেনে নিয়ে সেগুলোকে সাজিয়ে খেতে শুরু করতে যাচ্ছিল, শারিয়ারের কথাটা শুনে টপ করে তার দুই ঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেট টেবিলের ওপরে পড়ে গেল। ‘ডক্টর সুলতান মারা গেছে!’ যেন স্বগোতোক্তি করছে অনেকটা তেমন ভঙ্গিতে বলে উঠল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার বড়ো বড়ো বাদামি চোখজোড়া পানিতে ভরে উঠল

‘আমি সরি,’ শারিয়ার বলে উঠল। ‘আমরা যতটুকু জানি আপনি ডক্টর সুলাতানের অনেক ক্লোজ ছিলেন। কাজেই উনার ছাত্রী হিসেবে…..

‘ডক্টর সুলতান আমার বাবা ছিল, মুখের ভেতরে পানি নিয়ে কথা বললে যেমন শোনায় অনেকটা তেমন ভঙ্গিতে বলে উঠল মেয়েটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলের সবাই খাওয়া থামিয়ে ফিরে তাকাল তার দিকে।

‘ডক্টর সুলতান আপনার বাবা ছিলেন?’ শারিয়ারের গলায় বিস্ময়ের মাত্রা শশীর চেয়েও বেশি। সে টমি আর ভুবনের দিকে তাকিয়ে আনমনেই কাঁধ ঝাঁকালো একবার। দুজনের কেউই জানে না এই ব্যাপারে। ‘আমরা তো জানতাম উনি নিঃসন্তান ছিলেন। বহু বছর আগেই তার স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে….’

‘সে নিঃসন্তান ছিল এটা যেমন ঠিক, তেমনি আমি তার সন্তান ছিলাম এটাও তেমন ঠিক,’ শশীর গলায় আবেগ যেন বাঁধ মানছে না। ‘আমি তার পালককন্যা ছিলাম,’ বলে সে খানিকটা ফুঁপিয়ে উঠল।

শারিয়ার বাকিদের দিকে তাকিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করল। এমন অবস্থায় আসলে কী করা উচিত বা কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না সে। ‘ডক্টর শশী, আপনি শান্ত হোন। আসলে পরিস্থিতি এমন যে আপনাকে আমি কী বলব ঠিক বুঝতেও পারছি না। আসলে ডক্টর সুলতানের ব্যাপারে খুব কমই জানতে পেরেছি আমরা। তার ব্যাপারেও আপনার কাছ থেকেই জানতে হবে আমাদের।’

‘ইটস ওকে,’ বলে শশী মুখ তুলে তাকাল। ‘আমি সরি, আসলে হাজার হলেও নিজের বাবা। আমি বুঝতে পারছি পরিস্থিতি। এখন আবেগ সামলে কাজে নামার সময়,’ বলে সে টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ-চোখ মুছে নিয়ে খাবারের প্লেটটা টেনে নিল। ‘আপনারা খাচ্ছেন না কেন? শুরু করুন,’ বলে সে খেতে শুরু করল। বাকিরা এমন অবস্থায় খাবে কী খাবে না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু শশীকে খনিকটা ধাতস্থ হতে দেখে সবাই যার যার খাওয়া শুরু করল। মিস্টার শারিয়ার, ঘটনা ঠিক কী আমাকে খুলে বলুন তো।’

শারিয়ার খেতে খেতেই এই কেসের সমস্ত কিছু শুরু থেকে সেই ডক ইয়ার্ডে ওদের অভিযান পর্যন্ত খুলে বলল। এই পর্যন্ত বলে সে যোগ করল, ‘এই হলো আমাদের গল্প। এখন আমাদের সঙ্গে আপনার গল্পজোড়া লাগিয়ে আমাদের একটা পুরো চিত্র দাঁড় করাতে হবে। তবে তার আগে আমার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার আছে সবার কাছে। আমরা কেন সেই ডকইয়ার্ডে আন-অথরাইজড অপারেশন চালিয়েছিলাম সেটা আমরা সবাই জানি। কারণ আমাদের হাতে সময় ছিল না। কিন্তু সেখান থেকে বেরুবার পর অফিসার রুম্পা এবং পুলিশের সঙ্গে কেন আমি অমনটা করলাম, এটা সবাই জানার জন্য আকুপাকু করছে। আমার মনে হয়। এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত ছিল। কেন আমি এমন একা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলাম সেটা জানার অধিকার সবার আছে।’

এই পর্যন্ত বলে শারিয়ার খাবার পুরে দিল মুখের ভেতরে। সেটাকে সামলে নিয়ে আবার বলতে লাগাল। ‘গতকাল সন্ধের সময়ে যখন আমরা ডকইয়ার্ডে অভিযান চালাতে যাই তখনই আমি জানতাম ডক্টর শশীকে আমরা উদ্ধার করতে পারি আর না পারি অথরিটির সঙ্গে একটা ক্ল্যাশ আমাদের লাগতে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা নির্জনে সরে কাজ সেরে অথরিটিকে ইনভলভড করব পরে যাতে সরাসরি ক্ল্যাশ না হয়। কিন্তু ইয়ার্ড থেকে বের হওয়ার পরেই ওখানে ওই চায়নিজ হুয়াং আক্রমণ চালাবে, এরপরে আবার অকুস্থলে উপস্থিত হবে রুম্পা। এটা আমি আশা করিনি।’

‘এই দুটো গ্রুপই ওখানে একেবারে সময়মতো পৌঁছলো কীভাবে?’ ভুবনের প্রশ্ন। ‘ওরা জানতে পারল কীভাবে আমরা ওখানে অভিযান চালাতে যাচ্ছি?’

‘আমার ধারণা,’ শারিয়ার খেতে খেতে একটা হাত তুলে বলে উঠল। যদিও এটা স্রেফ অনুমানমাত্র। গতকাল আমরা গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে পিবিআই অফিসে গিয়েই বোকামিটা করেছি। সম্ভবত হুয়ানের কোনো এজেন্ট ওখান থেকেই আমাদের অনুসরণ করেছে। অথবা ওখান থেকেই পিবিআইয়ের কেউ না কেউ অমাদের একসঙ্গে বেরুতে দেখে তাকে জানায়। জোরদার সম্ভাবনা রুম্পাকেও ওখানকারই কেউ জানিয়েছে। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, আরো একটা কারণে ডক্টর শশীকে আমি অথরিটির হাতে তুলে দিতে চাচ্ছিলাম না। কারণ অথরিটির ভেতরে আমাদের শত্রুপক্ষের লোক আছে। অথিরিটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে ডক্টর শশী তো বটেই আমাদেরও প্রাণের ওপরে ঝুঁকি চলে আসত। কারণ আমরা এখনো একেবারেই জানি না আমাদের শত্রু কারা এবং কাকে বিশ্বাস করা যাবে আর কাকে বিশ্বাস করা যাবে না। কাজেই ওখানেই ইন্সট্যান্ট আমি সিদ্ধান্ত নিই। একটা ঝুঁকি নেব। আমরা অথরিটির হাতে বন্দি না থেকেই কাজ করব। এখন তোমরা বলো আমার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল নাকি ভুল। আমার ধারণা অথরিটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে আমরা যা করতাম সেটার ফল ভোগ করার আগেই শত্রুপক্ষের হাতে চলে যেত।’

সবাই চুপ। টমিই প্রথম কথা বলে উঠল, ‘আমি শারিয়ার স্যারের সঙ্গে একমত। এভাবে ব্যাপারটা হয়তো আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে তবে অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে বিষয়টা আরো ভালো হতে পারে যদি আমরা কেসটা সমাধান করতে পারি।’

‘বাহ টমি,’ খেতে খেতে ভুবন বলে উঠল, ‘এক রাতের অভিযান তোকে বেশ ম্যাচিউর করে ফেলেছে দেখছি।’

‘টমি যা বলেছে ঠিকই তো বলেছে, শারিয়ার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ওয়েটার ছেলেটা এসে বিল দিয়ে গেল। শারিয়ার বিল দিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘এখন এই কেসের একটা বড়ো অংশের রহস্যের চাবিকাঠি আছে ডক্টর শশীর হাতে। একমাত্র সেই বলতে পারে আসলে পরের ব্যাপারটা কী নিয়ে। ডক্টর সুলতান আসলে কী নিয়ে গবেষণা করছিল আর কেনই বা তার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হলো। কেন তাকে ঘিরে এত রহস্য, আর শশীকেই বা কেন অপহৃত হতে হলো। সবকিছু না হলেও আমি যা যা বলতাম তার একটা বড়ো অংশের জবাব আছে আমার বিশ্বাস ডক্টর শশীর কাছে। কাজেই তার বক্তব্য আমাদের শুনতে হবে। তবে এখন না, শারিয়ার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠল।

‘আমার ধারণা ইতিমধ্যেই আমাদের নামে রিপোর্ট চলে গেছে। সম্ভবত আমাদের খোঁজার জন্য অভিযানও শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের ভেতরেই। এখানেও আসবে লোকজন। তবে সময় লাগবে। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের নিরাপদ জায়গায় সরে পড়া উচিত। তাই আমরা গাড়িতে বসে কথা বলব,’ বলে সে নিজের মোবাইল বের করে একটা এসএমএস দেখাল সুমনকে। সুমন এই ঠিকানাটা ভালোভাবে দেখে নাও। এখানেই আপাতত উঠব আমরা।

সুমন ঠিকানাটা দেখে নিয়ে মাথা নাড়ল। ‘চিনতে পেরেছি বস।’

‘তুমি গাড়ি চালাবে,’ বল সে নিজের মোবাইল বন্ধ করে দিল। ‘আর তোমার মোবাইলটাও দাও সুমন,’ ওটাও নিয়ে বন্ধ করে দিল সে। ‘আমরা এখন গাড়িতে উঠব। বাকি কথোপকথন গাড়িতে বসে চলবে। ডক্টর শশীর বক্তব্য শুনব আমরা।’

ওর সবাই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। সবাই উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল সুমন।

‘ডক্টর শশী, এবার বলুন আপনি হঠাৎ কেন বাংলাদেশে এলেন। ডক্টর সুলতান আসলে কে ছিলেন এবং কী নিয়ে গবেষণা করতেন? আপনি কীভাবে অপহৃত হলেন? সে-রাতে কী ঘটেছিল? আর আপনাকে অপহরণ করে নেয়ার পর সেখানে আসলে কী হয়েছিল?’ বলে শারিয়ার আপনাতেই একটা হাত তুলল। ‘আমি জানি, আমি অনেক কিছু জানতে চাইছি। কিন্তু আমাদের এসব ব্যাপারে জানতে হবে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আপনি ধীরে ধীরে একেবারে শুরু থেকে বলতে থাকুন।’

‘ডক্টর সুলতান আবদেল একজন খেয়ালি ধরনের মানুষ ছিল,’ শশী বলতে শুরু করেও থেমে গিয়ে শারিয়ারের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘একটা সিগারেট দেওয়া যাবে?’

‘অবশ্যই,’ বলে শারিয়ার বেনসনের প্যাকেট আর লাইটার তার দিকে এগিয়ে দিল। শশী সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেট ফেরত দিতে যাচ্ছিল শারিয়ার ইশারায় সামনের সিটে বসা ভুবনের দিকে দিতে ইশারা করল। শশী প্যাকেটটা ভুবনের হাতে দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল।

‘আমার পালক পিতা ডক্টর আবদেল একদিকে ছিলেন অসম্ভব রকমের জিনিয়াস মানুষ। আবার অন্যদিকে চূড়ান্ত খেয়ালি মানুষ। নিজের কাজ, গবেষণা আর অধ্যাপনা ছাড়া অন্য কিছুতেই তার কোনো সিরিয়াসনেস ছিল না। পরিবারের ব্যাপারটাও তাই ছিল,’ শারিয়ার দেখল শশীর গলায় অদ্ভুত একটা লকেট ঝুলছে সাদা রুপো বা প্লাটিনামের চেইনের সঙ্গে। সেটাকে চেপে ধরে সে বলে চলেছে নিজের বাবার কথা। ‘এ-কারণেই কোনোদিন সে পারিবারিকভাবে সুখী হতে পারেনি। বাবা একেবারে ছাত্রজীবনে থাকতেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আমার মাকে। আমার মা ছিল একেবারেই ভিন্ন ধরনের মানুষ। পুরোদস্তুর গৃহিনী। তাই বাবার সঙ্গে কোনোদিনই তার পুরোপুরি বনেনি। তার ওপরে উনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই সেটা আরো এককাঠি অশান্তির মাত্রা যোগ করছিল তাদের সংসারে। আমার বাবা আর মা মিলে আমাকে দত্তক নেন। কিন্তু দত্তক নেয়ার তিন বছরে মাথায় উনাদের ভেতরে ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি কেন জানি বাবার সঙ্গেই রয়ে যাই। বাবা বেশিরভাগ সময়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর আমি থাকতাম বোর্ডিং স্কুলে। তবে বছর শেষের ছুটিগুলো একসঙ্গে কাটাতাম আমরা। আর তখনই বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম পৃথিবীর নানা প্রান্তের সব প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলো। সেখান থেকে আর্কিওলজির প্রতি একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। কলেজ পাস করার পর ইংল্যান্ডের যেখানে বাবা পড়াত সেই ডিপার্টমেন্টেই পড়তে যাই আমি।’

এই পর্যন্ত বলে শশী একটু থামল। ‘আমি জানি, হয়তো খানিকটা পারিবারিক প্যাচাল পাড়ছি। কিন্তু এর সঙ্গেও এই সব ঘটনার যোগসাজশ থাকতে পারে। তাই এগুলো বলাটাও খানিকটা জরুরি মনে হচ্ছে আমার কাছে। তো যাই হোক, বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করি আমি। আর্কিওলজি পড়ার পেছনে একদিকে আমার নিজের আগ্রহ তো ছিলই অন্যদিকে আমি আসলে বাবার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমারও সেই জগতে প্রবেশ এবং ভালোবাসা গড়ে ওঠে। এখানে আমার বাবার গবেষণার এরিয়া নিয়ে খানিকটা বলি। বাবা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে করতে একটা সময় ওই ফিল্ডের প্রতি খানিকটা বিরক্ত হয়েই ভিন্ন একটা এরিয়া নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। এই বিশেষ এরিয়াটায় ইতিহাসের বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া অংশ খুঁজে বের করা হয়। যেমন ধরেন ইতিহাসের কোনো এক জায়গায় হয়তো কোনো বিশেষ নগরীর কথা উল্লেখ আছে কিন্তু বাস্তবে সেটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবার এরিয়াগুলোর একটা হলো ইতিহাসের বিভিন্ন কু পর্যালোচনা করে সেগুলো খুঁজে বার করা।

‘অনেকটা ইতিহাসের অলিগলিতে চালানো ইনভেস্টিগেশনের মতো,’ শারিয়ার আনমনেই বলে উঠল।

‘এগজেক্টলি,’ শশী তালি দিয়ে উঠল। সে নিজের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলাতে মজা পেতে শুরু করেছে। ‘আগে বাবা কাজ করত মিডল ইস্ট নিয়ে, তো নতুন এই এরিয়াতে গিয়ে বাবা কাজ করতে শুরু করে ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে। এই এরিয়াতে কাজ করতে গিয়ে বাবা খুব মজা পায়। সেই সঙ্গে বার্লিনে একটা কনফারেন্সে পরিচয় হয় তার আরেক পাগলের সঙ্গে প্রফেসর ইফতেখার আবদুল্লাহ-এর সঙ্গে। সেও একই ফিল্ডের মানুষ। দুজনে মিলে নিজের কাজের এরিয়াগুলো গুছিয়ে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। এই জায়গায় এসে বাবার সঙ্গে আমার একটা অ্যাকাডেমিক যুদ্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আমি দূরে সরে যাই বাবার কাছ থেকে। কিছুটা রাগ ছিল কিছুটা অভিমানও ছিল বাবার প্রতি। আমি তখন সবেমাত্র অনার্স শেষ করে নিজের ইন্টার্নশিপের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যেকোনো আর্কিওলজিস্টের জন্য মিডলইস্টে কাজ করাটা হলো স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো একটা ব্যাপার। তার ওপরে যদি সেটা হয় মিশর তবে তো কথাই নেই। আমারও ইচ্ছে ছিল মিশরেই ইন্টার্নশিপ করব। সুযোগও এসে যায়।’

শশীর কথার এই পর্যায়ে শারিয়ার তাকে হাতের ইশারায় থামতে বলে সুমনের কাছে জানতে চাইল, ‘আমরা যেখানে যাবে সেখানে যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?’

‘আরো আধাঘণ্টা সর্বোচ্চ, গাড়ি চালাতে চালাতেই সুমন একবার হাত ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে উঠল।

‘ঠিক আছে, আপনি বলুন প্লিজ।’

শারিয়ারের উদ্দেশে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে শশী আবারও বলতে শুরু করল। ‘আমি মিশরেই কাজ করে যেতে চাইছিলাম কিন্তু বাবা আমাকে যেতে মানা করে। বরং বলেন আমাকেও ভারতবর্ষের ওপরে কাজ করতে। বাবার কথায় আমি প্রচণ্ড আশাহত তো হই, সেই সঙ্গে খানিকটা বিরক্তও। বাবার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আমি মুখ ফসকে বলে বসি আমি যদি তার নিজের সন্তান হতাম তবে উনি এমনটা কোনোদিনই আমার সঙ্গে করতে পারতেন না। সেটা যে কত বড়ো ভুল ছিল আমি কল্পনাও করতে পারিনি। সেটা আজ থেকে পাঁচ বছর আগের ঘটনা। ওখানেই বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমি চলে যাই মিশরে, বাবা চলে আসে এশিয়াতে।’

‘আপনার বাবা কী বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন নাকি ভারতের?’ ভুবন জানতে চাইল।

‘বাবা কী নিয়ে কাজ করেছে আমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। আমি কখনো জানতেও চাইনি। তবে এখানে আরো একটা ব্যাপার আছে। আপনার প্রশ্নটা ঠিক আছে কিন্তু একটা বিষয় আপনাদের বুঝতে হবে। আমরা যারা প্রত্নতত্ত্ব কিংবা ইতিহাস নিয়ে কাজ করি তারা বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করি। দেশ, বর্ডার, কাঁটাতার এসব ব্যাপার কিন্তু অনেক পরে এসেছে কাজেই এসব ব্যপারে প্রায়ই দেখা যায় এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বিভিন্ন ধরনের সংযোগ থেকেই যায়। তো বাবা চলে এলো এখানে। আমি মিশরে চলে গেলাম। মিশরে যাওয়ার পর ওখানে আমি ইন্টার্ন করি। ওখান থেকে মাস্টার্স করার আগেই এক প্রফেসরের অধীনে সরাসরি পিএইচডি করার সুযোগ পেয়ে কাজ শুরু করি। বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার বছর দুয়েক পরে হঠাৎ তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় সিঙ্গাপুরে একটা কনফারেন্সে। বাবাও ওখানে পেপার প্রেজেন্ট করতে গিয়েছিল, আমিও,’ বলে শশী একটা নিশ্বাস ছাড়ল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্লান্তির বোঝা তার ওপরে চাপতে চাপতে আর নিতে পাচ্ছে না সে।

‘আমাকে দেখেই বাবা ছুটে আসে। কিন্তু আমি অনেকটা রাগ আর অভিমান নিয়ে তার প্রতি খুব একটা সহায় ছিলাম না। বাবা আমাকে দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে এটা-ওটা অনেক কিছু জানতে চায়। আমি হু-হাঁ করে কাজ চালানোর মতো জবাব দিতে থাকি। এর ভেতরে এক পর্যায়ে বাবা আমাকে বলে তারা যা খুঁজছিলেন সেটা খুঁজে পাবার প্রায় দ্বারপ্রান্তে আছে। কিছুদিনের ভেতরেই বাংলাদেশ আর ভারত সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলবে। আমি মোটেই তেমন আগ্রহ নিয়ে কথা শুনিনি। আর তখন আমার প্রেজেন্টেশেনর সময় ঘনিয়ে আসছিল, আমি কোনোমতে বিদেয় নিয়ে চলে যাই। সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।’

‘সেটা নিশ্চয়ই আজ থেকে বছর তিনেক আগে, তাই না?’ হাতের কড়ে হিসেব করতে করতে শারিয়ার জানতে চাইল।

শশী একটু অবাক হয়েই তার দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে?’

‘কারণ এরপরেই উনি সম্ভবত ওই কনফারেন্স থেকে এসেই আমাদের অথরিটিকে একটা প্রস্তাব দেন। কী প্রস্তাব ছিল সেটা আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু ওই প্রস্তাবের পরেই তার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয় এবং এর কিছুদিন পরেই উনি লোকচক্ষুর অন্তরালে ডুব দেন, শারিয়ার আনমনেই বলতে লাগল। কিছু একটা হিসেব করার চেষ্টা করছে সে। এই পর্যন্ত বলে সে আনমনেই একবার মাথা নাড়ল। ‘আমার বিশ্বাস এই সময়টাতেই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে।’

‘নাহ, তারও খানিকটা আগে,’ বলে শশী কাঁধ ঝাঁকালো। ‘আমি এসবের কিছুই জানতাম না আসলে। তবে বাবার লাইসেন্স কেড়ে নেয়ার ব্যাপারটা শুনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেকবার ভেবেও বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি সংকোচ আর দ্বিধার কারণে। কিন্তু সব দ্বিধা আর সংকোচ কাটিয়ে যখন বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করি ততক্ষণে সে সম্ভবত লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। এরপরে আমি বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছি বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার কিন্তু কোনোভাবেই আর তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি,’ শশীর চোখে পানি। ‘একজন মানুষ ঠিক যত ভালো আর নিরীহ হতে পারে ঠিক ততটাই গোঁয়ার হতে পারে সেটা বাবাকে না দেখতে কোনোদিনই বুঝতে পারতাম না আমি। যাই হোক, বাবার সঙ্গে এতবার এতভাবে যোগাযোগ করেও আমি কিছুতেই তার কাছ পর্যন্ত পৌছাতে পারিনি। আমার বিশ্বাস বাবা ইচ্ছে করেই এমন ব্যবস্থা করেছিল যাতে করে তাকে কেউ খুঁজে বের করতে না পারে। এরপরে বাবার কাছ থেকে আমি খবর পাই গত সপ্তাহে যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার একটা পার্সেল এসে পৌঁছায়।’

‘কী ছিল সেটাতে?’ চাইলেও নিজের গলার চূড়ান্ত কৌতূহল দমাতে পারছে না শারিয়ার।

‘একটা চিঠি যেটতে বিস্তারিত লেখা ছিল বাবার সবকিছু,’ শশী তাকিয়ে আছে শারিয়ারের দিকে। ‘তার গবেষণা, তার প্রাপ্তি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু। সে গত কয়েক বছরে কী করেছে, কীভাবে করেছে, কী পেয়েছে সব,’ বলে শশী নিজের গলার সঙ্গে আটকানো সেই বিচিত্র লকেটটা চেপে ধরে বলে উঠল। ‘আর ছিল এই লকেটটা। আমি অনুমান করতে পারি বাবা আমাকে এটা পাঠিয়েছিল তার স্নেহ প্রকাশ করার জন্য। সে যে আমার ওপরে আর রাগ করে নেই সেটা বোঝানোর জন্য।’

‘তার মানে আপনার বাবার গবেষণার বিস্তারিত সব সেই চিঠিতে ছিল। সেটা কী আছে আপনার কাছে?’ শারিয়ার জানতে চাইল।

‘নাহ, চিঠিটা আর নেই আমার কাছে। অপহরণের সময়ে ওটা আমার ব্যাগে ছিল। আর—’

‘শারিয়ার ভাই, আমরা চলে এসেছি প্রায়,’ সামনে থেকে সুমন বলে উঠল। ‘ঠিকানাটা বলবে আরেকবার?’

‘আমাকে বলো, এই এলাকা আমি খুব ভালো চিনি,’ ভুবন কথাটা বলতেই শারিয়ার তাকে ঠিকানাটা বলল। ঠিকানা শুনতে শুনতে ভুবন জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল। সে ইশারায় সুমনকে বলে দিল কোনদিকে যেতে হবে। সুমন সেই নির্দেশনা অনুযায়ী একটা দোতলা ডুপ্লেক্স টাইপের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাতেই শারিয়ার নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ও গেটের কাছে এগোতেই দারোয়ান কিসিমের একজন মানুষ দৌড়ে এসে গেট খুলে দিল।

‘আপনে শারিয়ার স্যার?’ হাসিমুখে জানতে চাইল লোকটা। ‘হামিদ স্যারে আমারে ফুন কইরা কইছে আপনে আসতাছেন।’

শারিয়ার তার সঙ্গে কথোপকথন বিনিময় করে গেটটা খুলে দিতে বলল। গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢোকাতেই নেমে এলো সবাই।

‘বাহ বাড়িটা তো সেইরকম,’ ভুবন শিস দিতে দিতে বলে উঠল।

‘শোন, কেয়ারটেকারকে বলা আছে। ও তোমাদের সবাইকে যার যার কামরা দেখিয়ে দেবে। সবাই ফ্রেশ হয়ে ঘুম দাও। ঘুম দিয়ে উঠে দুপুরে খেয়ে ডক্টর শশীর কাছ থেকে সব শুনে আমরা আমাদের আগামী পরিকল্পনা ঠিক করব। বোঝা গেছে?’

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই শারিয়ার ফিরে তাকাল শশীর দিকে। ‘ডক্টর শশী, আপনার ও ডক্টর আবদেলের অতীতটা আমরা মোটামুটি বুঝতে পেরেছি। এরপর সেই চিঠিতে কী ছিল আর সেদিন রাতে কী ঘটেছিল এই দিয়ে আমরা দুপুরের আলোচনা শুরু করব।’

ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় জানাল শশী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *