অধ্যায় সাঁইত্রিশ – বর্তমান সময়
ডকইয়ার্ড এলাকা, চট্টগ্রাম
টমি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। একদিকে সে পুরো ডকইয়ার্ড এলাকাটার সারভেইলেন্স চেক করছে, অন্যদিকে আবার নির্দেশনা দিচ্ছে সেই লোকটাকে-যে ড্রোনটাকে রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর ঠিক তার পেছন থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে চায়নিজ চেহারার সেই লোকটা। মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে সে বেশ আগ্রহের সঙ্গে কথা বলে উঠল, ‘বাহ জিনিসটা তো ভালো,’ বলে সে পেছন থেকে টমির পিঠ চাপড়ে দিল। ‘আমি বহু অপারেশনে বহু ধরনের টেক ব্যবহার করেছি কিন্তু এরকম জিনিস কখনো ব্যবহার করিনি,’ বলে সে নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে হেসে উঠল। ‘কী করছে ওরা?’ বলে সে ল্যাপটপের স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে দেতে পেল শারিয়ার আর ভুবন জাহাজে খোলের খোলা অংশ দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে গেল।
‘এরা এখন ডক্টরকে ঠিকঠাক উদ্ধার করতে পারলেই হয়,’ বলে সে নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘গেট রেডি বয়েজ,’ বলেই সে সুমনকে দেখিয়ে বলে উঠল গাড়ি রেডি করো, নির্দেশনা দেওয়া শেষ করে সে আবারও স্ক্রিনের দিকে ফিরে তাকাতেই টমিকে স্ক্রিনের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বলে উঠল, ‘এগুলো কী?’ বলেই সে নিজের মাথাটাকে এগিয়ে এনে ভালোভাবে দেখে বলে উঠল, ‘সর্বনাশ। এত মানুষ কোত্থেকে এলো,’ বলেই সে একহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে আফসোসের সঙ্গে বলে উঠল, ‘এরা এখন বেরোলেই তো ধরা খাবে। তার চেয়ে বড়ো প্রশ্ন এরা ভেতর থেকে বের হলেও এতটা দূরত্ব পার হবে কীভাবে?’ জাহাজের খোল থেকে শুরু করে ডকইয়ার্ডের গেট পর্যন্ত মাইলখানেকের মতো দূরত্ব দেখিয়ে সে তার কথার শেষ অংশটুকু উচ্চারণ করেছে টমিকে উদ্দেশ্য করে।
টমি কিছু না বলে স্ক্রিন থেকে মাথা তুলে ডানে-বামে নাড়ল। এই ভঙ্গির একটাই অর্থ, এই প্রশ্নের জবাব জানা নেই তার।
***
নিজের গালটাকে এক হাতে চেপে ধরে হতভম্ব ভঙ্গিতে একবার ভুবনকে দেখল শারিয়ার। আনমনেই একবার কাঁধ ঝাঁকাল ভুবন, তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘এভাবে ধন্যবাদ জানানোর রীতি কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই।’
‘ধন্যবাদ জানাইনি, চড়ই মেরেছি,’ বলে রীতিমতো ঝামটে উঠল মেয়েটা শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে। এখনো সে শারিয়ারের দেওয়া রুমালটা দিয়ে মুখ মুছছে। এই প্রথমবারের মতো মেয়েটাকে ভালোভাবে খেয়াল করল শারিয়ার। লম্বা-পাতলা একজন মানুষ, পায়ে কেডস জুতো, জিন্স প্যান্ট আর গায়ে একটা ঢিলা সোয়েটার। চুল থেকে শুরু করে মুখ সোয়েটার থেকে শুরু করে জুতো কোনো কিছুই আর দেখার যোগ্য নেই। গত কয়েকদিন মানুষটার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়-ঝাপটা টের পাওয়া যায় পোশাক দেখলে। কিন্তু সব ছাপিয়ে চোখে পড়ে মানুষটার বড়ো বড়ো বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া।
‘এই মিস্টার, আপনি কী পুলিশ?’ মেয়েটা আবারও ঝামটে উঠেই শারিয়ারের দিক থেকে মুখ সরিয়ে ভুবনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ‘আপনারা কী পুলিশ? পুলিশ এভাবে ঝুঁকি নেয়! আপনার বন্ধু আরেকটু হলেই তো আমার প্রাণটা খোয়াচ্ছিলো। পাগল শালা!’
‘আপনি ডক্টর শশী?’ এবার ভুবন জানতে চাইল। আগে থেকেই সে নিজের ডান হাত গালে দিয়ে রেখেছে সতর্কতাস্বরূপ।
‘আবশ্যই আমি শশী। আপনারা?’ কথাটা চোখ সরু করে বলেই বলে সে তাকিয়ে রইল ভুবনের দিকে। কিন্তু ভুবন উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়ার ফোনের ভেতর থেকে ভেসে এলো টমির কণ্ঠস্বর। ‘বস ভেতরের কী অবস্থা? ডক্টর শশীকে পেয়েছো?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি আমরা বেরুবো…’
‘বস, ভয়াবহ বিপদ। বাইরে রীতিমতো রায়ট শুরু হয়ে গেছে। একদল লোক জড়ো হয়েছে জাহাজের খোলের কাছে। অন্তত বিশ-পঁচিশজন তো হবেই। বস বস…’
‘এই মেয়ে,’ বলে চট করে ডক্টর শশীর এক হাতের কনুই ধরে ফেলল সে। ডক্টর শশী চট করে শারিয়ারের দিকে ফিরে তাকাল রাগত ভঙ্গিতে কিন্তু শারিয়ারের মুখের ভঙ্গি দেখেই সে বুঝতে পারল সিরিয়াস কোনো ব্যাপার ঘটতে চলেছে।
মাথা ওপর নিচ করে সে বলে উঠল, ‘পারব।’
‘ভুবন তুই তো শুনেছিস,’ বলেই সে মেয়েটার দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘একদল লোক জড়ো হয়েছে বাইরে। এদেরকে মেরে কেটে বেরুতে হবে আমাদের। এরপরে আরো মাইলখানেক দৌড়াতে হবে। তাহলে এখান থেকে মুক্তি পেতেও পারি, নাও পারি। বোঝা গেছে?’
‘আপনারা কী পুলিশের লোক না?’ বলে সে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওদের দুজনকে দেখল। ‘আপনাদের ফোর্স কোথায়?’
শারিয়ার নিজের পিস্তল থেকে সাইলেন্সারটা খুলে সেটাকে রেখে দিল পকেটে। তারপর পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রেখে প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনল দুটো স্মোক বল, আর মাটি থেকে সে তুলে নিল বড়ো একটা লোহার পাইপ। ভুবন, ভালো করে শোন, আমি কী বলি,’ বলেই সে নিজের পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বলল ওদেরকে। পরিকল্পনা শেষ করে সে যোগ করলো, ‘যে পর্যন্ত আমরা ফাঁকা না পাব সামনে থাকব আমি তুই পেছনে থাকবি আর ডক্টর শশীকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তোর। বুঝেছিস?’ বলেই সে ডক্টর শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘ডক্টর সাহেবা, আমরা পুলিশের লোক কিন্তু এই অপারেশন আন-অথরাইজড। অথরাইজড অপারেশন চালাতে গেলে আপনাকে আজ রাতে আর উদ্ধার করতে হতো না। কাজেই বাঁচতে হলে এখন আমি যা বলি মন দিয়ে শুনুন, সে নিজের পরিকল্পনায় শশীর করণীয় জানিয়ে দিল।
শারিয়ারের পরিকল্পনা শুনে আবারও ঝামটে উঠল মেয়েটা। ‘আমি এরকম বস্তার মতো থাকব না আপনাদের সঙ্গে,’ বলে সেও আশেপাশে দেখে নিয়ে একটা লম্বা লাটির মতো কাঠের টুকরো তুলে নিল। যদিও আমি দুর্বল কিন্তু আমিও হেল্প করতে পারব,’ বলে সে কাঠের টুকরোটা সামনে বাগিয়ে ধরে সামনের দিকে দেখাল। শারিয়ার ভুবনের দিকে একবার দেখে নিয়ে ইশারা করল সামনে এগোনোর।
জাহাজের খোলের বাইরে অন্তত পনেরো থেকে বিশজন জড়ো হয়েছে তাদের
সামনে আছে একজন নেতা। যারা জড়ো হয়েছে তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করছে যাদেরকে ধরে আনার জন্য তাদের এই গভীর রাতের বেলা ডেকে আনা হয়েছে তারা বেরুলেই হয় একবার। উত্তেজিত লোকগুলো হট্টগোল করছে। হঠাৎ চারটে গোল বলের মতো জিনিস উড়ে এসে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো থেকে ধোঁয়া বেরুতে শুরু করল। জিনিসগুলো কী বুঝতে না পারলেও ওগুলো থেকে বেরিয়ে আসা গলগলে ধোঁয়ায় কেশে উঠল প্রায় সবাই। অনেকের মুখের ভেতরেও ঢুকে গেছে ধোঁয়া।
লোকগুলো কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে শারিয়ার আর ভুবন দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। বেরিয়েই প্রথমে লোকগুলোর মাথার ওপর দিয়ে ফাঁকা গুলি করল অন্তত তিন-চার রাউন্ড। একদিকে ঝাঁঝালো ধোঁয়া, এরপরে আবার প্রকম্পিত গুলির শব্দে লোকগুলো তো বটেই পুরো ইয়ার্ডের একাংশ কেঁপে উঠল। অনেকে ভয়ের চোটে বসেই পড়ল মাটিতে।
লোকগুলোকে প্রথম ধাক্কায় প্রকম্পিত করে দিয়ে একেবারে অন্ধের মতো সামনে লোহার পাইপ আর লাঠি চালাল শারিয়ার আর ভুবন। আতঙ্কিত লোকগুলোর ভেতরে যাদের মোটামুটি সাহস বা ইচ্ছা অবশিষ্ট ছিল তারা রণে ভঙ্গ দিয়েছে দেখেই শারিয়ার চিৎকার করে দৌড়ানোর নির্দেশনা দিল। তিনজনেই জান ছেড়ে দৌড়াতে শুরু করল সামনের দিকে।
ওদেরকে ধরতে আসা লোকগুলো ঝাঁঝালো ধোঁয়ার প্রভাবে আর গুলির শব্দ শুনে এতটাই হতবাক হয়েছে আর চমকে উঠেছে যে, ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শারিয়াররা এগিয়ে গেল অনেকটা সামনে। আর এটাই ছিল ওর পরিকল্পনা। লোকগুলোকে চমকে দিয়ে সরে পড়া। কারণ এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না তাদের সামনে ঠিক একারণেই লোকগুলোকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়ে তিনজনে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। কারণ শারিয়ার এটাও জানে এদেরকে খুব বেশি সময় বোকা বানিয়ে রাখা যাবে না। যেই মুহূর্তে ওরা অনুধাবন করবে মাত্র তিনজন মানুষ ওদেরকে বোকা বানিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করছে সেই মুহূর্তে মানুষগুলো হিংস্র হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে একদিকে লোকগুলোর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যেমন বেড়ে যাবে অন্যদিকে অযথা রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। আর শারিয়ার এটা ভালো করেই জানে যে, এই লোকগুলোর সঙ্গে ওদের কোনো শত্রুতা নেই এরা হয় ভাড়াটে গুণ্ডা, আর না হয় খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিক, হয়তো দুটো টাকার লোভে ইউনিয়ন লিডারদের সাহায্য করছে। কাজেই এদের কাউকে মারতে গেলে একদিকে ওর হাত কাঁপবে তার ওপরে আবার ওরা এখানে এসেছে একটা আনঅথরাইজড অপারেশন চালাতে। কাজেই লোকগুলোকে চমকে দিয়ে যতটা সম্ভব এখান থেকে এগিয়ে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
‘জলদি জলদি,’ বলে চিৎকার করেই শারিয়ার নিজের দৌড়ের গতি আরো বাড়িয়ে দিল। সামনে বাগিয়ে ধরল লোহার পাইপটা। সামনে এক দুজন পড়তেই হয় পাইপ চালাল আর না হয় কাঁধের ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিয়ে অনেকটা রাগবি খেলোয়াররা বল নিয়ে যেভাবে সামনে এগোয় সেভাবে এগোতে লাগল। আর তার ঠিক পেছনেই ডক্টর শশী, আর শশীর পেছনে ভুবন। পাইপের আঘাতে আর কাঁধের ধাক্কায় লোকগুলোকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে পথ করে ওরা বেরিয়ে এলো খোলা জায়গাতে। মূহূর্তের জন্য কোনদিকে এগোবে বুঝতে না পেরে থেমে গেল শারিয়ার। কারণ আধো অন্ধকারের গলি ঘুপচিকে ওর কাছে সবই একই রকম মনে হচ্ছে। কোনোদিক দিয়ে ঢুকেছিল বুছতে পারছে না। ওর ঠিক পেছনেই এসে বাড়ি খেল শশী। হাপরের মতে হাপাচ্ছে মেয়েটা।
‘বস, তুমি আরেকটু এগিয়ে বামে মোড় নিয়ে শখানেক গজ এগিয়ে ডানে ঘুরলেই রাস্তা দেখতে পাবে। সেখান থেকে বাম দিয়ে মেইন গেট সাতশ গজের মতো দূরত্বে, জলদি দৌড়াও,’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেলল টমি। সঙ্গে সঙ্গে তার নির্দেশিত দিকে হাত তুলে দেখিয়ে দৌড়াতে শুরু করল শারিয়ার। ‘ওদিকে।’
শারিয়ার দৌড়াতে শুরু করেছে। তার পেছনে পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে এগোতে লাগল শশী, শশীর পেছনে ভুবন। আরেকটু এগিয়ে শারিয়ার বামে মোড় নিয়ে শখানেক গজ এগিয়ে ডানে মোড় নিল। ভুবন দেখল শারিয়ার এগিয়ে যাচ্ছে আর শশীর গতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, সে শশীর একটা হাত ধরে তাকে রীতিমতো টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে। ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে আসুন,’ বলে সে যতটা জোরে পারে দৌড়তে লাগল হাত থেকে ফেলে দিল কাঠের লাঠিটা।
শারিয়ার ডানে মোড় নিয়ে সামনে এগোতেই প্রায় হোঁচট খেতে খেতে পাকা রাস্তার ওপরে এসে উঠল। হাঁটুতে ভর দিয়ে পেছন ফিরে দেখল শশীকে টেনে নিয়ে আসছে ভুবন কিন্তু দুজনারই গতি কম। ‘জলদি জলদি আয়।’ বলে সে সোজা হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো কম্পাউন্ডের এক অংশ আলোকিত হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠল সাইরেন। শারিয়ার ডানে-বামে তাকিয়ে ভুবন আর শশীকে মেইন গেটের দিকে দৌড়াতে নির্দেশ করে এবার সে নিজেও হাত থেকে ফেলে দিল পাইপটা। এখন প্রাণ নিয়ে দৌড়াতে হবে। পুরো কম্পাউন্ডে খবর পৌছে গেছে। অন্যদিকে পেছন থেকে ভেসে আসছে লোকজনের হইচই।
‘বস তোমাদের পেছনে লোক লেগেছে আর পুরো কম্পাউন্ডে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। জলদি দৌড়াও আর না হলে বেরুতে পারবে না।’
টমি টমি, সুমনকে বল এই মুহূর্তে মাইক্রোটাকে নিয়ে গেটের কাছে চলে আসতে। আমরা যেভাবে পারি ওদেরকে নিয়ে একবার গেটের বাইরে এলেই যাতে গাড়িতে উঠতে পারি,’ বলেই সে ফিরে তাকাল ভুবন আর শশীর দিকে। টমি কী বলে শোনার সময় নেই। ভুবন প্রায় স্বাভাবিক আছে, শশী বসে পড়েছে মটিতে। সে সামনে ঘরঘর শব্দ শুনে দেখতে পেল মেইন গেটটা খুলতে শুরু করেছে। ওটার সামনে একটা লড়ি দাঁড়িয়ে আছে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এই শেষ সুযোগ।
‘ভুবন, গেটটা দেখিয়ে সে চিৎকার করে উঠল দৌড়ানোর জন্য কিন্তু শশী হাত নেড়ে দৌড়াতে অস্বীকৃতি জানাল, আর পারছে না সে। অসহায়ভাবে একবার ভুবনের দিকে তাকাতেই হাতের পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ভুবন এগিয়ে গেল শশীর দিকে। একটানে শশীর হালকা পাতলা শরীরটা কাঁধে তুলে নিয়ে শারিয়ারকে বলল সামনের দিকে এগোতে। শারিয়ার প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল গেটের দিকে। যদিও কাঁধে আস্ত একটা মানুষের ভারী বোঝা কিন্তু ভুবনও ওর সঙ্গে তাল রেখে প্রায় একই গতিতে দৌড়াচ্ছে। গেট আর কয়েকশ গজ দূরে। লরিটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে। একবার ওটা বেরিয়ে গেলেই গেটটা বন্ধ হয়ে যাবে আর বেরুতে হবে না তাহলে। চারপাশ থেকে লোকজনের হট্টগোল ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ স্বরে বাজছে সাইরেন। সেই সঙ্গে গেটের চেকপোস্ট থেকে গার্ডরা চিৎকার করে থামতে বলছে ওদের। কোনো দিকে মনোযোগ না দিয়ে স্রেফ দৌড়াতে লাগল শারিয়ার। তার ঠিক পেছনেই ভূবন। গেটের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখল লরিটা অদৃশ্য হয়েছে গেটের অন্যপাশে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গেটটা।
গেটের গার্ডরা হাতের ইশারায় থামতে বলছে ওদের। এখনো অস্ত্র হাত দেয়নি কেউ। ‘টমি গাড়ি এসেছে?’ দৌড়াতে দৌড়োতেই সে বের করে এনেছে নিজের কিং কোবরা।
‘জি, বস। আমি গেটের একেবারে কাছেই,’ এবার জবাব দিল সুমন।
কারো কথার কোনো জবাব না দিয়ে গেটের গার্ডদের মাথার ওপর কিং কোবরা দিয়ে কয়েক রাউন্ড ফায়ার করল শারিয়ার। গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল পুরো ডক। অস্ত্রে হাত না দিয়ে বরং মাটিতে শুয়ে পড়ল এক গার্ড, অন্য গার্ড অস্ত্র তুললেও গুলি করবে না করবে না সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া গেটের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো ওরা।
গেট থেকে বেরিয়েই মাইক্রোটা দেখতে পেল শখানেক গজ দূরেই। শশীকে নামাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে উলটে পড়ে গেল ভুবন। সঙ্গে শশীও। আর ওদের পাশে বসে পড়ল শারিয়ার। গেট থেকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে ওরা। এখানো লোকজনের হই হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। ওদের মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সুমন একটানে ওদের কাছে নিয়ে এলো মাইক্রোটা। ওটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাতের ইশারায় চিৎকার করে একটানে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা। শারিয়ার নিজে উঠে বসেই টেনে নিল শশীকে। তারপর ওটার দরজায় পা রাখতেই গাড়ি ফুল গিয়ারে দিয়ে টান দিল সুমন।
ওটাকে একটানে ঘুরিয়ে নিয়ে এগোতে লাগল সামনের দিকে।
তিনজনই মরার মতো সিটে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে। ভুবন শুধু দুবার হাত নাড়লেও কথা বলতে পারল না। নিজেও হাত নেড়ে প্রায় অট্টহাসি হেসে উঠল শারিয়ার। কিন্তু কোনো কথা বলল না।
সামনের সিট থেকে সুমন জানতে চাইল, বস, ঠিক আছেন আপনারা? স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছে সে।
শারিয়ার হাত নেড়ে বোঝাল সে ঠিক আছে। কিন্তু কথা বলতে পারল না। বাকি দুজনকে অবাক করে দিয়ে কথা বলে উঠল ডক্টর শশী। ভুবনের কাঁধে হালকা একটা চাপড় দিয়ে সে বলে উঠল, ‘তুমি কে হে বালক?’ এখনো সমানে হাঁপাচ্ছে সে। কিন্তু গলায় সেই আগের মতোই ঝাঁঝ। ‘মানুষ না অন্য কিছু?’ বলে শারিয়ারের দিকে দেখাল। ‘তোমার এই বন্ধু মানুষ না আর কিছু। আমার মতো আস্ত একটা মানুষ কাঁধে নিয়ে কী দৌড়টাই না দিল। তুমি না থাকলে বাপু আজ আর ছুটতে হতো না আমার,’ বলে আবারও ভুবনের কাঁধে জোরে একটা চাপড় মেরে সে হেলান দিল সিটে। ভুবন ইশারায় শারিয়ারকে দেখাল, তার নিজের মাথার পাশে একটা তর্জনী রেখে ঘুরিয়ে বোঝাল এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে। আর তার কথাটাকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মেয়েটা বলে উঠল। ‘ব্যাপক ক্ষুধা লাগছে আমার।’ ভুবন আবারও একই ইশারা করে উঠল।
‘টমি কোথায়, সুমন?’ খানিকটা ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করল শারিয়ার। এই প্রথম সে খেয়াল করল টমি নেই গাড়িতে। কিন্তু কোনো জবাব দিল না সুমন। ইয়ার পিসের ভেতর থেকেও কোনো শব্দ নেই আবারও জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবছে শারিয়ার পৌনে এক মাইলের মতো রাস্তা পেরিয়ে সে মোড়ের ঠিক আগেই একটা জংলা মতো জায়গায় ডানে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল সুমন। গাড়ি থামিয়ে দিল সে।
শারিয়ারের কাছে একটু অবাক লাগছে। সে আবারও জানতে চাইল, ‘টমি কী এখানে নাকি?’ হাতের ইশারায় ভুবনকে থামতে বলবে তার আগেই সে একটানে খুলে ফেলল মাইক্রোর দরজা। সঙ্গে সঙ্গে সামনে দেখতে পেল ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে তিনজন অস্ত্রধারী। ওদের ঠিক পাশেই একজন বিশালাকায় লোক এক হাতে টমিকে বাচ্চার মতো ধরে তার কপালের পাশে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছে। আর ওদের সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে সেই নকল ভুবন, যার সঙ্গে প্রথম টক্কর লেগেছিল শারিয়ারের। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল লোকটা। আর শারিয়ার ফিরে তাকাল সুমনের দিকে।
সামনের সিট থেকে ভিউ মিররে ওর দিকে তাকিয়ে সুমন বলে উঠল, সরি বস, ওরা টমিকে আটকে রেখেছিল। আমার কিছুই করার ছিল না।’
সুমন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লোকটার দিকে তাকাল শারিয়ার। রাগ আর হতাশার একটা হলকা বয়ে গেল ওর শরীরে।
***
ডকইয়ার্ডের যেখান দিয়ে সেই লোকটাকে ফ্লাইং কিকের মাধ্যমে সমুদ্রে ফেলে দিল শারিয়ার সেখান থেকে মাইল খানেকের মতো দূরত্বে সমুদ্রের ভেতরে হালকা ঢেউয়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটা স্পিডবোট। সেটার ওপরে তিনজন মানুষ। স্পিডবোটটা এসেছে আরেকটু ভেতরের সমুদ্রে থাকা একটা ইয়ট থেকে। বাহনটাকে আসলে স্পিডবোট বলা হলেও ওটা সাধারণ যেকোনো স্পিডবোটের চেয়ে অনেকগুণ শক্তিশালী। ঠিক তেমনি অনেক বেশি ইকুইপমেন্ট সমৃদ্ধও।
স্পিডবোটের তিনজন মানুষের ভেতরে একজন মানুষ বোটের ছোট্ট কন্ট্রোলিং হুইলটা ধরে আছে। সে-ই বোটটাকে এই উত্তাল সমুদ্রের ভেতর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে এসেছে এই পর্যন্ত। তিনজনের ভেতরে দ্বিতীয় লোকটা একটা বিরাট আকারের স্নাইপিং রাইফেল তাক করে রেখে সেটার ইনফ্রারেড স্কোপের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে ডক এলাকার দিকে। আধশোয়া রাইফেলধারী তার রাইফেলটা স্পিডবোটের একপাশের কিনারার ওপর একটা ভাঁজ করা তোয়ালে রেখে সেটার ওপর রেখেছে। ঢেউয়ের তালে তালে বোটটা সামান্য নড়ছে, সেই সঙ্গে অন্ধকার আর কুয়াশা তো আছেই। কিন্তু এগুলো কোনো কিছুই তার জন্য কিছু নয়। এই অবস্থাতেও প্রায় পৌনে এক মাইল দূরের ডকে যেকোনো মানুষের দুচোখের মাঝখানে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে। আধ শোয়া অবস্থায় সে ইনফ্রারেড স্কোপে চোখ রেখে অসন্তুষ্টির সঙ্গে মাথা নাড়ল আরেকবার। তারপর বোটে উপস্থিত তৃতীয় মানুষটার দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আপনি নিশ্চিত আমি কিছুই করব না?
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিল না। ছোটোখাটো মানুষটা সাবধানে তাকিয়ে আছে একটা ইনফ্রারেড বায়নোকুলারের ভেতর দিয়ে। মনোযোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছে ডকইয়ার্ডে ঘটতে থাকা ঘটনাবলি। ওখানকার লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি দেখে সে একটু আগে হেসেছিল কিন্তু এখন বেশ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তার বায়নোকুলার থেকে চেখে নামিয়ে সে অন্ধকার আকাশের দিকে কী জানি দেখল একটু। তারপর রাইফেল হাতের মানুষটার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে চীনা ভাষায় বলে উঠল, ‘বলেছি না একবার। কিছু করতে হবে না।’ লোকটার গলার স্বর একেবারে স্বাভাবিক, কোনো ধমক নয়, রাগ তো নয়ই বরং কেমন জানি সগোতোক্তি করার মতো করে বলে উঠল সে। কিন্তু তাতেই জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো মিইয়ে গেল রাইফেলধারী।
অনেকটা মিনমিন করার মতো করে সে বলে উঠল, ‘তাহলে এত ঝামেলা করে মেয়েটাকে ধরে আনালেন কেন, আবার আজ রাতে ওখানে যাওয়ার কথা ছিল সেটাও গেলেন না। এখন আবার মেয়েটাকে নিয়ে ওরা যখন কেটে পড়ছে তখন…’
দুনিয়াতে যা কিছু ঘটে তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। অকারণে কিছুই ঘটে না,’ বলে মানুষটা চোখ থেকে বায়নোকুলার নামিয়ে ফেলল। এবার সে কথা বলেছে মাতৃভাষায়। তার কথায় পরিষ্কার চট্টগ্রাম এলাকার টান। ‘যা ঘটতে যাচ্ছিল সেটা না ঘটে ওই রাতের অ্যাক্সিডেন্টে যা ঘটেছে সেটাও খারাপ হয়নি। কিন্তু এখন যা ঘটাতে যাচ্ছিলাম সেটা মনে হয় একটা ভুল হয়ে যাচ্ছিল। তারচেয়ে এখন যা ঘটতে যাচ্ছে সেটাই মনে হয় ভালো হবে,’ বলে সে আবারও আগের মতো হেসে উঠল। যদিও তার সঙ্গী পরিষ্কার কিছু বোঝেনি, তবু সেও তার বসের সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা হেসে উঠল।
‘বোট ছাড়ো, জাহাজে ফিরে যেতে হবে। আর শোন চোখের আড়াল হলেই আয়ত্তের বাইরে, সেই যুগ চলে গেছে,’ শেষ কথাগুলো অনেকটা বিড়বিড় করে বলেই সে আরেকবার ডকের দিকে তাকাল। ওখানে যা ঘটার ঘটে গেছে এখন বাইরে আবার কিছু না ঘটলেই হয়। এখানে তার ভূমিকা অনেকটা ঈশ্বরের মতো। সবকিছু দেখতে হবে, ওপর থেকে কলকাঠি নাড়তে হবে। তার চেয়ে বড়ো কথা কোনো কিছুকেই চোখের আড়াল হতে দেওয়া যাবে না। ভাবনাগুলো মনের ভেতরে বয়ে যেতে শক্তিশালী বোটের ইঞ্জিন মৃদু গুঞ্জন করে চালু হয়ে গেল। মনে ভাবনার মতো স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ভেসে চলতে শুরু করল স্পিডবোট।
***
‘পৃথিবীটা অনেক ছোটো তাই না মিস্টার শোরিয়ার, নাকি শহরিয়ার?’ বলে লোকটা একবার টমির দিকে দেখল তারপর আবারও শারিয়ারের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলে উঠল, ‘আমাদের সেদিনের মোলাকাতটা ঠিক মনমতো হয়নি তাই ভাবলাম আরেকবার আপনার সঙ্গে দেখা করি,’ খসখসে বাংলায় কথা বলতে বলতে লোকটা এগিয়ে এলো ওদের মাইক্রোর খোলা দরজার দিকে। আরেকটু এগিয়েই ভুবনকে টেনে নামিয়ে দিল সে মাটিতে।
‘আহ, আমার টুইন ব্রাদার,’ বলে সে ভুবনকে একপাশে সরিয়ে মাইক্রোর দরজা দিয়ে ভেতরে দেখে ডক্টর শশীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘হ্যালো ম্যাডাম, দেখেন তো আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা পুরো দল চলে এসেছি,’ বলে সে নিজের লোকদের দেখাল। ‘দেখেন তো আপনাকে কেমন একটা গাড়িতে করে এনেছে ওরা। আমি আপনার জন্য আরো ভালো গাড়ি এনেছি,’ বলে বড়ো সাদা গাড়িটা দেখাল।
‘কী চান আপনি?’ শারিয়ার গম্ভীর মুখে বলে উঠল। যেহেতু সে সবার থেকে পেছনের সিটে আছে কাজেই লোকটার কথার সুযোগে নিজের ডান হাতটা ঢুকিয়ে ফেলল পকেটের ভেতরে।
লোকটা শারিয়ারের হাতের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ‘অফিসার সাহেব, আপাতত আমি চাই আপনি খুব সাবধানে পকেটের ভেতর থেকে হাতটা বের করে আনুন। আমি হয়তো অস্ত্র ধরে নেই। কিন্তু আপনাদের দিকে অন্তত দুইজোড়া অস্ত্র তাক করা রয়েছে। কাজেই সাবধান,’ বলে সে আরেকটু এগিয়ে এলো। ‘কারণ এই মুহূর্তে আপনারা আমার জন্য স্রেফ বোঝা ছাড়া আর কিছুই নন। আমাদের দরকার স্রেফ উনাকে,’ বলে সে হাসিমুখে ডক্টর শশীকে দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে শশী প্ৰায় চিৎকার করে উঠে আরেকটু চেপে এলো শারিয়ারের দিকে। এই সুযোগে হাতটা আবারও পকেটে ঢুকিয়ে অবশিষ্ট স্মোক বলটা চেপে ধরল শারিয়ার। সমস্যা একটাই, টমির মাথার পাশে পিস্তল ধরে থাকা লোকটা।
‘এক মিনিট, এক মিনিট,’ লোকটা প্রায় ধমকে উঠল সবাইকে। ‘আমরা কারো কোনো ক্ষতি করার জন্য আসিনি,’ বলে সে একটা নিজের আঙুল তুলল। মিস্টার শারিয়ার, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। কাজেই বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি কিংবা আপনার লোকদেরকে আমার দরকার নেই। আমাদের দরকার শুধু ডক্টর শশীকে। উনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে দিন, আপনারা নিরাপদ।’
‘আমি যাবো না, যাবো না,’ বলে সে আবারও চেঁচিয়ে উঠল। এই সুযোগে পা দিয়ে ভুবনের পায়ে হালকা একটা লাথি মেরে তাকে সাবধান করে দিল শারিয়ার।
চুপ, ডক্টর শশী আপনি নেমে আসুন…’ বলে সে শশীর দিকে এগিয়ে আসছিল কিন্তু তার আগেই তীব্র একটা আলো এসে পড়ল ওদের ওপরে। সেই সঙ্গে ভীষণ বেগে একটা গাড়ি ঢুকে পড়ল লোকগুলো আর ওদের একেবারে মাঝখানে। দুয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল গাড়িটা সেই সঙ্গে যে যেদিক পারল ছিটকে পড়ল এদিকে সেদিকে। গাড়িটা একটানে আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একেবারে মাঝ বরাবর ধাক্কা মারল লোকগুলোর নিয়ে আসা সাদা গাড়িটার বডিটায়। তীব্র ধাক্কার চোটে গাড়িটা সামনে এগিয়ে রাস্তার পাশের ঢাল থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে।
মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেলেও চট করে সচকিত হয়ে উঠল শারিয়ার। প্রথমেই চিৎকার করে সুমনকে বলল গাড়ি স্টার্ট দিতে। তারপর এক ধাক্কায় শশীকে গায়ের ওপর থেকে সরিয়ে লাফিয়ে নেমে এলো গাড়ি থেকে। ভুবনকে শশীর সঙ্গে থাকতে বলে নিজের পিস্তল বের করে সন্তর্পণে এগোল সামনে। আগে টমিকে উদ্ধার করতে হবে। কাদের গাড়ি, কে এসেছে এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। খানিকটা এগিয়েই দেখতে পেল লোকগুলো ছিটকে পড়েছে এদিকে সেদিকে। সেই লোকটাকে দেখল মাটিতে পড়ে আছে। আর গাড়িটা সাদা গাড়িটাকে আঘাত করে এখন ফিরে আসছে পেছন দিকে। শারিয়ার বাম দিকে তাকিয়ে দেখল টমি আর তাকে ধরে থাকা লোকটা দুজনেই মাটিতে পড়ে আছে। শারিয়ার এগোতেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে টমিকে ধরার চেষ্টা করল। তার পিস্তলটা সম্ভবত পড়ে গেছে মাটিতে। শারিয়ার এগিয়ে গিয়ে সোজা গুলি করল লোকটার কাঁধে। দুনিয়া কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠে পড়ে গেল সে মাটিতে। শারিয়ার এগিয়ে টমির হুডি ধরে টেনে তুলে ফেলল তারপর তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল গাড়িটার দিকে। সেই গাড়িটা ফিরে আসছে দেখে শারিয়ার পিস্তল তুলল কিন্তু সেটার ভেতর থেকে চিৎকার করে ওদেরকে দ্রুত সরে পড়ার নির্দেশনা দিল অফিসার রুম্পা। রুম্পাকে দেখেই শারিয়ার পিস্তল সরিয়ে ফেলল, তারপর টমিকে মাইক্রোর ভেতরে ঠেলে দিয়ে নিজে ঘুরে তাকাল জায়গাটার দিকে। রুম্পার গাড়ি ব্যাকগিয়ারে গিয়ে মেইন রোডে উঠে পড়েছে প্রায়। আর হুয়ানের লোকগুলো এখনো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। শারিয়ার পকেট থেকে হাত বের করে স্মোক বলটাতে একটা চাপ দিয়ে ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে। তারপর লাফিয়ে উঠে বসল গাড়িতে।
গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল, ও উঠে আসতেই সেটাকে প্রথমে ব্যাক গিয়ারে দিয়ে টেনে তুলে ফেলল মেইন রোডে তারপর বনবন করে হুইল ঘুরিয়ে রুম্পাদের গাড়ির পেছনে পূর্ণ বেগে ধাবিত করল সুমন।
‘তুই ঠিক আছিস, টমি?’ পিস্তলটাকে হোলস্টারে রাখতে রাখতে জানতে চাইল শারিয়ার। টমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সবাইকে ঠিকঠাক হতে বলে শারিয়ার একবার পেছন ফিরে দেখে নিল। জংলা জায়গাটা থেকে কাউকেই পিছু নিতে দেখা গেল না।
‘উফফ শান্তি,’ বলেই চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল শারিয়ার। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল বলতে পারবে না ও। হঠাৎ গাড়ির গতি কমে আসতেই চোখ খুলে সে জানতে চাইল। ‘কী ব্যাপার?’
কিছু না বলে সে সামনে দেখাল পুলিশের গাড়িটার গতি কমতে কমতে সেটা একেবারে থেমে গেছে। সেটা থেকে নেমে হন হন করে ওদের গাড়ির দিকে হেঁটে আসছে রুম্পা। তার সঙ্গে আরো একজন সিভিল ড্রেসের পুলিশ অফিসার, আর একজন পুলিশ।
সুমন সামনের গাড়িটাকে গতি কমিয়ে আনতে দেখে সেও গতি কমিয়ে প্রায় থামিয়ে ফেলছিল কিন্তু শারিয়ার পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল, ‘গাড়ি থামিয়ো না সুমন। গতিও কমিয়ো না।’
‘মানে কী?’ পেছন থেকে ভুবন বলে উঠল। ‘কী করতে চাচ্ছো তুমি?’ শারিয়ার দেখল ভুবন তো বটেই শশী আর টমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু শারিয়ার সামনে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, ‘সুমন গাড়ি ছোটাও।’
কিন্তু সুমন গাড়ির গতি বাড়ানোর আগেই রুম্পা আর তা লোকেরা একেবারে গাড়ির সামনে চলে এলো। একটু ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ওদের মাইক্রো। রুম্পা এগিয়ে এসে ইশারা করতেই একটানে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল তার সঙ্গের একজন অফিসার।
‘মিস্টার শারিয়ার, আপনারা করছিলেন কী জানতে পারি?’ বলে সে ঝামটে উঠে একবার চোখ বুলিয়ে নিল মাইক্রোর ভেতরে। সুমন, টমি, মিস্টার ভুবন আপনাদের সাহস হলো কী করে…’ রাগের চোটে সে কথাই বলতে পারছে না। চোখ বুলাতে গিয়ে একবার ডক্টর শশীকে দেখে নিয়ে সে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল শারিয়ারের ওপরে। তারপর আবারও রাগের সঙ্গে ঝামটে উঠে বলে উঠল, ‘মিস্টার শারিয়ার, আপনি এবং আপনার সঙ্গে যারা আজ রাতে ব্যুরোকে ইনফর্ম না করে আনঅথরাইজড অপারেশন চালিয়েছেন আপনাদের সিরিয়াস কিছু ব্যাখ্যা দিতে হবে। তার আগে এই মুহূর্তে আপনাদেরকে ডিউটি থেকে ডিসমিস করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অথরিটির সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত আপনাকে ব্যুরোর মনিটরিং সেলে বন্দি রাখা হবে। বুঝতে পেরেছেন?’ বলে সে জবাবের অপেক্ষায় না থেকে ডক্টর শশীর দিকে ফিরে বলে উঠল।
‘আমার এই অফিসার একজন পুলিশসহ আপনাদের সঙ্গে থাকবে ব্যুরোতে না পৌঁছানো পর্যন্ত। আপনি নিশ্চয়ই ডক্টর শশী? আপনি আমার সঙ্গে আসবেন প্লিজ…’ বলে সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল শশীর দিকে।
‘এক মিনিট,’ বলে শারিয়ার সোজা হয়ে বসলো। ‘উনি কোথাও যাচ্ছেন না। কিংবা আমরাও কোথায় যাচ্ছি না, বলে সে হাসিমুখে সোজা তাকাল রুম্পার দিকে।
রাগে রুম্পার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল এবার তাকে যেন খানিকটা হতবাক দেখাল। মানে, কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?
‘আমি বলতে চাচ্ছি এটা,’ বলে সে নিজের হাতে থাকা কিং কোবরাটা সামান্য নাড়ল। সবাই আঁতকে উঠে দেখল শারিয়ার ইতোমধ্যে তার হাতের পিস্তল বের করে এনেছে কেউই খেয়াল করেনি। এবার সে ওটাকে ওপরে তুলে রুম্পার মুখ বরাবর ধরল। ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি না,’ খুব সবধানে যেন গল্প করছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল শারিয়ার। ‘আমরা সেখানেই যাবো যেখানে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। আপনি বা আপনার কেউ বাধা দিলে আমি গুলি করব,’ বাক্যের শেষটুকু বলার সময়ে তার চেহারা ভীষণ গম্ভীর হয়ে উঠল। ‘গাড়ি স্টার্ট করো, সুমন।’
‘বস, তুমি কী করছো?’
‘মিস্টার শারিয়ার…’ ডক্টর শশী বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু শারিয়ার ওদের দিকে ফিরে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল, ট্রাস্ট মি,’ বলেই সে ফিরে তাকাল রুম্পার দিকে।
রুম্পা থমথমে অবিশ্বাস্য চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে যেন কামড়ে দেবে শারিয়ারকে। যখন কথা বলল গলা থেকে যেন আগুন বেরুল তার। ‘অফিসার, আপনি জানেন না আপনি কী করছেন।’
ট্রাস্ট মি, আমি খুব ভালো করেই জানি,’ বলেই সে সুমনকে বলল গাড়ি নিয়ে আগে বাড়তে। সুমন একবার পেছন ফিরে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িটা রুম্পাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওদের সাদা গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খুবই সতর্ক ভঙ্গিতে দুবার গুলি করল শারিয়ার। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল থেকে ধুপধুপ করে দুটো গুলি বেরিয়ে গেল প্রায় নিঃশব্দে। কিন্তু রুম্পাদের গাড়িটার টায়ার ফুটো হয়ে ভসস করে একটা টায়ার ফেটে বসে গেল। সেই সঙ্গে ধাম করে মাইক্রোর দরজা লাগিয়ে দিল শারিয়ার। দরজা লাগিয়েই সিটে হেলান দিল সে।
মাইক্রোর গতি বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে পেছন দিকে তকিয়ে রুম্পা আর ওর দলের লোকজনকে অবলোকন করছিল ভুবন সে শারিয়ারের দিকে ফিরে কঠিন গলায় বলে উঠল, ‘বস তুমি যা করেছ আশা করি বুঝে করেছ। তা না হলে,’
‘ট্রাস্ট মি…’ চোখ বন্ধ করে শুধু এটুকুই বলল শারিয়ার।
সামনের সিট থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে সুমন আফসোসের গলায় বলে উঠল, ‘একদিকে ওই চাইনিজ ব্যাটা হুয়াং খুঁজবে আমাদের। একদিকে পুলিশ খুঁজবে। তার ওপরে আরো কে কে খুঁজবে কে জানে,’ বলে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘রাইতের প্রথম দিকে চাকরির কথা জিগাইছিলাম। চাকরি তো গেলোই জানটাও থাকবে কি না কে জানে।’ তার বলার ভঙ্গিটা হাস্যকর হলেও কেউ হাসল না।
ডক্টর শশীর বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে শারিয়ার বলে উঠল, ‘ডক্টর শশী, আপনার সঙ্গে সিরিয়াস আলাপ আছে আমাদের।’ শশী কিছু না বলে মাথা নাড়ল। ক্লান্তির কারণে নাকি একের পর এক ঘটনা প্রবাহে সেই তেজোদীপ্ত ভাবটা একেবারেই অনুপস্থিত তার মাঝে।
শারিয়ার সিটে হেলান দিল। অনেক ঝুঁকি নিয়েছে। উদ্ধার করা ডক্টর শশীর কাছ থেকে জানতে হবে অনেক কিছু। এত হাঙ্গামা করে কাকে উদ্ধার করে আনল বুঝতে হবে সেটা।