অধ্যায় ছত্রিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র
রাতের আকাশ চিরে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের পাখিদের আনাগোনা। নিজের ছোটো কামরাটার সামনে থেকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মেলানো সূর্যের আলোর ঝলকানি বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে কিরান। সিরাজির বোতলে আরেকবার চুমুক দিয়ে একটানে অনেকখানি ধোঁয়া টেনে নিল সে নিজের ভেতরে। রাতজাগা ক্লান্ত শরীর বিদ্রোহের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু সে খুব ভালোভাবেই জানে বিশ্রামের পথ বেশ সঙ্কুল এখন।
হঠাৎ প্রায় কোনো কারণ ছাড়াই বাবার কথা মনে পড়ল কিরানের। ছোটোবেলায় বাবা মাঝেমধ্যে তাকে কাঁধে নিয়ে হাটে চলে যেত। কখনো কখনো আবার মাছ ধরতে যেত ওকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে। নিজের পালক সন্তানের প্রতি তৈমূর তালেবের এই অতিরিক্ত ভালোবাসা তেমন কেউই ভালোভাবে নিত না। এমনকি ওর বাবার অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে ওর ভাইদের হাতে নিগৃহীতও হতে হতো ওকে এই কারণে। তবে মা সবসময়ই ওকে ভালোবাসতো। বাবা যেমন ওকে বাড়িতে নিয়ে এলো সেদিন থেকে শুরু করে সবসময় মা ওকে ভালোবেসেছে। বাবা আর মায়ের ভালোবাসাই ওর জন্য যথেষ্ট ছিল। যতদিন না ও বড়ো হয়ে ঘর ছাড়ে।
কিরান যখনই ভাবে, ও যখন বাপের আদেশ অমান্য করে ঘর ছাড়ল কেমন ছিল বাবার অনুভূতি। তার বাপুর মুখের ওপরে কথা বলার মতো সাহস কারো ছিল না। কিন্তু নিশ্চয়ই আড়ালে টিপ্পনি ঠিকই সইতে হয়েছে বাবাকে। কেমন করে সহ্য করত সে নিজের সবচেয়ে আদরের সন্তানের এই বিগ্রহ। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিজের বাপের চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করল কিরান।
পেছনে পায়ের শব্দে চোখ খুলল কিরান। কামরার মাঝামাঝি বিছানাটার শিয়রের কাছে একটা তস্তরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো পোশাক পরা পতিত লোকটা। কিরানকে তার দিকে তাকানোর আগেই মুখ নামিয়ে দ্রুত খাবার আর জলের তস্তরিটা নামিয়ে রাখল সে শিয়রের পাশে। ওটাকে নামিয়ে রেখে সোজা না হয়ে বরং মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নামিয়ে রাখল নিচের দিকে। লোকটার দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল কিরান। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পতিতদের কথা শুনলেও কখনো সামনাসামনি কাউকে দেখেনি কিরান। ওরা নাকি এমনই করে। কারো দিকে তাকায় না, কারো সামনে খায় না। বলতে গেলে লোকসমাজে বসবাস করেও সবার অন্তরালে জীবন কাটায় ওরা। লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কিরানের মনে হলো, লোকটাকে বলে, এভাবে থাকার দরকার নেই ওর জাহাজে। এখানে সবাই এক একজন পতিত। ও নিজেও একজন পতিত। কিন্তু লোকটাকে কিছু বলার আগেই দরজার কাছ থেকে রহমত চাচার গলা ভেসে এলো।
‘কিরান, সবাই জড়ো হয়া গেছে জাহাজের সামনের দিকে,’ রহমত চাচার গলা ভেসে এলো কিরানের পেছন থেকে। সঙ্গে সঙ্গে পতিত লোকটা মাথা নিচু করেই অনেকটা ছায়ার মতো বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বোতলটা রহমত চাচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিরান বিছানার পাশে রাখা চৌপায়ার ওপর থেকে নিজের তরবারিটা তুলে নিল। ‘জাহাজ ভিড়ছে? সবাই আসছে, না কারো আসা বাকি?’
‘পরায় সবাই আইসা পড়ছে, আয়োজন সাজতাছে,’ কিরান তরবারিটা নিয়ে সোজা পাটাতনের দিকে এগোচ্ছে দেখে রহমত চাচা বলে উঠল, ‘কিছু খাইয়া যাও।’
খানিকটা এগিয়ে রহমত চাচার কাঁধে একটা হাত রাখল কিরান, ‘পরে খাবো চাচা,’ বলে সে এগিয়ে যেতে নিয়েও আবার থেমে গেল। রহমত চাচার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘চাচা আইজ বিকালেই মনে অয় কিছু একটা অইয়া যাইবো। তুমি কিন্তু পেছনের জাহাজে চইলা যাইয়ো, এই জাহজটাতে থাইকো না। কারণ এইটাই সবার সামনে থাকব। এই জাহজেই ঝুঁকি সবচায়া বেশি। কাজেই…’ বলে সে এগোতে লাগল। পেছন থেকে রহমত চাচা বলে উঠল, ‘আমি তুমার সঙ্গেই থাকব। তুমার বাপু অইলে কী অন্য জাহাজে চইলা যাইত?’
দরজা দিয়ে বেরুতে বেরতে কিরান ভাবল পেছন ফিরে কিছু একটা বলবে কিন্তু আনমনে একবার মাথা নেড়ে আর বলল না। কারণ জানে বলে খুব একটা লাভ হবে না। দরজা দিয়ে বের হতেই কাপ্তানের জাহাজ নিয়ন্ত্রণের জায়গাটা ছাড়িয়ে সামনের পাটাতনের ওপরের জমায়েতটা চোখে পড়ল। একটা গোল চৌপায়াকে মাঝখানে রেখে গোল হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কিরানকে কাপ্তানের কামরার বাইরে দেখে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। আপনাতেই একবার সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল কিরান। পাটাতনের ওপরে নেমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পেল শুধু মাল্লা আর লস্করেরা বাদে তিন জাহাজের প্রায় সবাই জড়ো হয়েছে পাটাতনের ওপরে।
কিরান সামনে এগোতেই সবাই সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল কিরানকে। কিরান সামনে এগিয়ে দেখল, সবার মধ্যিখানে একটা চৌপায়া রাখা হয়েছে। সেটার ওপরে রাখা হয়েছে একাধিক মানচিত্র। দুটো কাপড়ের ওপরে আঁকা আর একটা মোটা কাগজের ওপরে। কিরান তাকিয়ে দেখল গোমেজ একপাশে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের দু-চারটা কাটাকুটি বাদ দিলে তার চেহারায় কোনো ব্যথা বেদনার চিহ্নমাত্র নেই। কিরান তার দিকে তাকাতেই একহাতে আরকের বোতল আর অন্যহাতে নিজের গদাটাকে তুলে ওটা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে ভালো আছে। আর সেই সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিল, যুদ্ধের ঘোষণায় সে বেশ খুশি। গোমেজ থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে বিল্লাল শেঠ, বৈঠা আর বেদু।
‘তোমরা ঠিক আছ?’ গতকাল রাতের সন্দ্বীপের খণ্ডযুদ্ধের পরে কারো খোঁজ নেওয়া হয়নি। তাই এই জিজ্ঞাসা। কিরানের কথার জবাবে তিনজনেই জানাল তারা একদম ভালো আছে।
ওদের থেকে খানিকটা দূরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলারামের লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধানরা। তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল কিরান। খানিকটা বিধ্বস্ত দেখালেও সবাই বেশ হাসিমুখেই হাত নেড়ে জানান দিল ওরাও ঠিক আছে। কিরান চৌপায়াটার কাছে এগিয়ে এসে দেখল গোলন্দাজ আর পট্টবর্ধন মানচিত্র নিয়ে আলোচনা করছিল, ওকে দেখে থেমে গেল দুজনেই।
গোলন্দাজ ওর মুখের পাশের পট্টিটা দেখিয়ে জানতে চাইল, ‘ওটার কী অবস্থা?’ জবাবে কিরান মৃদু হেসে জানল। ‘ক্ষতটা আমারে মাইরা ফেলার একটা চেষ্টা করছিল কিন্তু কাজটা সিলভেরা করব জানাইতেই ভয়ে পলাইল,’ কিরানের কথা শুনে হেসে উঠল দুজনেই।
কিরান একেবারে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে একে একে নিজের লোকদের সবাইকে দেখে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আজকে এখানে যারাই উপস্থিত আছ তুমরা সবাই জানো কী কারণে এখানে জড়ো অইছি আমরা। এর আগে আমরা সবাই নানাভাবে হয়রানি আর কষ্টের শিকার অইছি যাগো হাতে আইজ সময় আসছে তাগোরে মোকাবেলা করে ধ্বংস করার। আমি জানি গত কয়েকদিনে আমগো সবার জীবন বদলাইয়া গেছে, সামনে আরো বদলাব। গত কয়দিন ধইরা আমরা সবাই যে কারণে কষ্ট করছি সেইটার মোকাবেলা করার সময় চইলা আসছে। আমগো কাছে পাক্কা খবর আছে তালেব তৈমূর কোনো দিকে গেছে,’ ইচ্ছে করেই কিরান বাবা শব্দটা ব্যবহার করল না।
‘এখন আমরা জানি সিলভেরা আর তার বাহিনীরে কোনো জায়গাতে পাওয়া যাবে। কাজেই যুদ্ধের সময় চইলা আসছে। আজকে আমরা যেই কারণে লড়াই করব সেইটার প্রভাব পুরা বাংলার মানুষ আর দক্ষিণের উপকূলের মানুষ ভোগ করব। কাজেই আমি চাই সবাই আমরা আমগো সর্বোচ্চ দিয়া যুদ্ধ লড়ব। শত্রু আমগোর চেয়ে অনেক শক্তিশালী, শত্রু আমগো চেয়ে সংখ্যায় বেশি। এমনও সম্ভাবনা আছে আমরা যা অনুমান করতে পারি তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আমগো অস্ত্র আছে, আমগো পরিকল্পনা আছে। আর আমরা পরিকল্পনাটা যদি কামে লাগাইতে পারি তাইলেই চলব। আর সব চেয়ে বড়ো কথা আমগো মনে বল আছে,’ কিরান এই পর্যন্ত বলতেই সবাই চিৎকার করে উঠল সমস্বরে।
‘আর এই কারণেই আমরা সামনে কীভাবে কী করতে যাইতেছি সেইটা সবার জন্য বোঝাটা খুব জরুরি। আমি পট্টবর্ধনরে অনুরোধ করব সব বলার জন্য।’ কিরান এই পর্যন্ত বলে পট্টবর্ধনের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে তাকে বলার জন্য অনুরোধ জানাল।
‘আমি সব বলতেছি। তোমরা মনোযোগ দিয়া শুনবা,’ বলে সে চৌপায়ার ওপরে গোল করে রাখা একটা মানচিত্র মেলে ধরল। ইশারা করতেই তার হাতে চিকন একটা লাঠি ধরিয়ে দিল একজন। সেটা দিয়ে মানচিত্রের এক জায়গাতে নির্দেশ করে সে বলে উঠল, ‘আমরা এখন আছি এইখানে। আর আমরা যা জানতে পারছি তাতে তালেব তৈমূরের জাহাজ আগের দিন রওনা দিছে জংলাটিলার দিকে। ওইটা হইলো এইখানে,’ বলে সে মানচিত্রের একটা জায়গা নির্দেশ করল। ‘তার জাহাজ ওইদিকে রওনা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে তার পিছে রওনা দেয় সিলভেরার জাহাজ। আর সিলভেরার জাহাজের থেইকা আমরা অন্তত আট কী দশ ঘণ্টা পিছায়া আছি। কিন্তু এইখানে একটা ব্যাপার আছে,’ বলে সে বাকিদের দিকে দেখিয়ে নিজের একটা আঙুল তুলল।
‘এই যাত্রপথের মাঝখানে এইখানে একটা মোহনা আছে, যেইখানে তিনদিকের পানি আইসা মিশে। এই জায়গার পানি কিছুতেই ভাটার সময় ছাড়া পার হওয়া যাবে না। আমি যদি যাত্রার সময় আর পরিক্রমা হিসাব করি তবে মোটামুটি অনুমান করা যায় তালেব তৈমূরের জাহাজ ওই সময়ে রওনা দেয় তাতে তারা পূর্ণ জোয়ারের আগেই ওই জায়গাটা পার হইয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু সিলভেরার জাহাজ যেই সময়ে রওনা দিছে তাতে এইটা পরিষ্কার যে, তারা যতই দক্ষ নাবিক হোক, এই জায়গা তারা ভাটা নামার আগে পার হইতে পারে নাই। তারমানে আমরা তাগো থেইকা বড়োজোর কয়েক ঘণ্টা পিছায়া আছি। যদি আমরা এইখান থেইকা পূর্ণবেগে জাহাজ চালাইতে পারি বাতাসের গতি আর দাড়িগর লগে তাল মিলায়া তবে তারা জংলাটিলা পৌছানোর কিছুটা সময়ে পরে কিংবা কাছাকাছি সময়েই আমরা পৌছাইতে পারব।’
‘কিন্তু ওই মোহনা আমরা পার হবো কেমনে?’ গোলন্দাজ জানতে চাইল।
‘এখন ভোরের সময়, যদি আমরা তড়িৎ গতিতে জাহাজ ছাড়ি তয় জোয়ারের অনেক আগেই ওই জায়গা পর হয়া যাইতে পারব,’ পট্টবর্ধন কথাটা বলেই সবার দিকে একবার দেখে নিয়ে আবারও বলে উঠল, ‘মোট কথা আমার হিসাবে সিলভেরার বাহিনী আর আমরা আগে পরে কাছাকাছি সময়ে ওইখানে পৌছাইতে পারব। এখন ওইখানে পৌছানোর পরে কী করতে অইবে ওইটা কিরান বোঝাবে,’ বলে সে কিরানের দিকে নিজের হাতের লাঠিটা এগিয়ে দিল।
পট্টবর্ধনকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিরান হাতের লাঠিটাকে মানচিত্রের একদিকে ঠেকাল। ‘সবাই মনোযোগ দিয়া শুনবা আমার কথা। আজকে যেই অভিযান আমি চালাইতে যাইতেছি তাতে সবার প্রথমে আমগো উদ্দেশ্য তালেব তৈমূররে সহায়তা করা। মানে তারে বাঁচানো এবং তার সঙ্গের সম্পদ উদ্ধার করা,’ সম্পদের কথা সবার সামনে এই প্রথম উচ্চারণ করল কিরান। আর সেইটা করতে অইলে আমগো প্রধান শত্রু সিলভেরা আর তার বাহিনীরে শেষ করতে হবে। দ্বিতীয় কোনো পথ নাই। সিলভেরার কথা সবাই জানো। তার বাহিনীর কথাও জানো। খুব জোর
সম্ভাবনা আছে তার লগে আরাকানের মগরাও থাকতে পারে। না পারলেও যোগ দিতে পারে। কাজেই এই বাহিনী আরো সাংঘাতিক হবে। কিন্তু এইটা আমগো অস্তিত্বের লড়াই আর আমরা যা বুঝতে পারি তাইলো জংলাটিলায় যাইতে যাইতে প্রথমেই আমগো সিলভেরার বাহিনীর লগেই লড়তে হবে। কাজেই আমি যা বলি সবাই সেইটা বোঝার চেষ্টা করবা,’ বলে সে একবার গোলন্দাজ আর পট্টবর্ধনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। গত কয়েক ঘণ্টায় তারা তিনজন আর তুলারাম মিলে এই পরিকল্পনা ঠিক করেছে।
‘এইটা হইলো জংলাটিলা,’ বলে সে সামনে বসানো ম্যাপটা দেখাল। ‘সবার দেখার দরকার নাই, স্রেফ বুঝো। জংলাটিলা জায়গাটাতে আগে যারা যাও নাই তাদের বলতেসি জংলাটিলা অইলো পানির ওপরে ছোটো ছোটো দ্বীপ আর টিলার সমন্বয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই পানি থাইক্কা সরাসরি টিলা উইঠা গেছে ওপরের দিকে। এরই মধ্যে ছোটো ছোটো গ্রাম আছে কিছু আর পুরান একটা পরিত্যক্ত দুর্গ আছে পাহাড়ের ওপরে। একসময় ওইখানে একটা বন্দর থাকলেও এখন সেইটা পরিত্যক্ত। এর পেছনে কারণ অইলো জায়গাটা অতি দুর্গম আর ওই এলাকাতে জলদস্যুগর উৎপাতের সীমা নাই,’ কিরান এই পর্যন্ত বলতেই আবারও কথা বলে উঠল পট্টবর্ধন।
‘তালেব তৈমূর সন্দ্বীপ থেইক্কা ওইখানে যাওয়ার কারণ কী এইটাও বোঝাটা খুব একটা অসুবিধার না। কারণ ঘোলা পানি, টিলাটক্কর আর জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটা পলানির লাইগা একেবারে ঠিক। তার মতো মানুষের জন্য সিলভেরার হাত থেইকা বাঁচতে অইলে ওই এলাকা একটা ভালো সুযোগ।’
‘আর এই সুযোগ আমগো যেমন আছে তেমনি আছে সিলভেরার লাইগাও। এইটা মনে রাখো সবাই,’ বলে সে আবারও সবার দিকে দেখে নিল। ‘আমগো হিসাব মতে আমরা যখনই অইখানে পৌছাবো আমগো লগে প্রথমেই মোলাকাত হবে সিলভেরার বাহিনীর। কাজেই সেই অনুযায়ীই আমরা পরিকল্পনা ঠিক করছি। এই দেখো,’ বলে সে মানচিত্রে নির্দেশ করল। ‘জংলাটিলায় ছোটো-বড়ো মিলায়া মোট ষোলোটা টিলা আছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড়ো অইলো চাইরটা। এইটা অইলো জংলাটিলা এলাকার মূল প্রবেশপথ। যে কাউরে জাহাজ নিয়া ঢুকতে অইলে এইখান দিয়াই ঢুকতে হবে অই এলাকায়। কাজেই সিলাভেরাও তাই করব। আমরা যখন জংলাটিলার কাছে পৌঁছাব তখন ওরা মাত্র ভেতরে ঢুকব, কী ঢুকব এইরকম অবস্থায় থাকবে।’
কিরান একটু থেমে আবারও বলতে শুরু করল। ‘আমগো কাছে জাহাজ আছে তিনটা। আমরা মূল প্রবেশপথে একসঙ্গে তিনটা জাহাজ নিয়াই ঢুকব। এরপরে কিছুটা ঢুইকা এই জাহাজটা, মানে সবচেয়ে বড়ো জাহাজাটা সরাসরি পিছু নেবে সিলভেরার জাহাজের আর আমগো বাকি দুইটা তুলনামূলক ছোটো জাহাজ মূল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুইকা দুইদিকে ছড়ায়া পড়ব। যদি আমরা সিলভেরার জাহাজরে পরিত্যক্ত বন্দরের কাছে ধরতে পারি তবে আমগো দুইদিকে ছড়ানি দুইটা জাহাজ দুই দিক থেইকা আক্রমণ চালাব। আর এইটা দিয়া আমরা তিনমুখী আক্রমণ চালাব ওগো জাহাজের ওপরে। যদি বন্দর এলাকার কাছে ওগো জাহাজগুলারে আমরা আটকাইতে পারি প্রথম আক্রমণ চলব কামানের। তারপর কামানের আয়ত্তের চেয়ে ভেতরে চইলা আসলে দ্বিতীয়ভাগে চলব বন্দুক বাহিনীর আক্রমণ এরপর ওরা একেবারে কাছে চইলা আসলে সরাসরি লড়াই। এইখান পর্যন্ত এই অইলো আমগো পরিকল্পনা,’ এইটুক বলে কিরান দম নিয়ে সবাইকে’ দেখল একে একে। তিন জাহাজ মিলিয়ে মাল্লারা বাদেই প্রায় ষাটজনে মতো লোক আছে ওর অধীনে।
‘ওই সমুদ্রে,’ বলে সে একটা হাত তুলে দেখাল খোলা সমুদ্রের দিকে। ‘আমগো পরিবার, সমাজ, মাটি আর পানির কিসমত লিখবে কিছু ফিরিঙ্গি দস্যু এইটা আর অইবে না। আমগো মানুষ মারা পড়ব দস্যুগর হাতে এই মাটির সম্পদ সব লুইটা নিব ওরা আর সেইটা অইবে না। আইজ কিসমত লিখবে আমরা, কিরান এটুকু বলতেই সবাই চিৎকার করে উঠল। ‘আইজ আমরা নিজেগর কিসমত নিজেরা লিখব,’ চিৎকার করে বলে উঠল কিরান। বিদেশি দস্যুগর রক্ত দিয়া লিখব আমরা আমগো কিসমত।’
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। বুকের কাছটায় নিজের বাবার দেওয়া লটেকটটা চেপে ধরে ধরে কিরান বিড়বিড় করে বলে উঠল, বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল। সে জানে একবার তীব্র স্রোতের সেই মোহনা পার হয়ে জংলাটিলা এলাকায় প্রবেশ করা মাত্রই শুরু হয়ে যাবে আসল যুদ্ধ।
***
মাথার ওপরে উত্তপ্ত সূর্য দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে চলেছে। আর সেই আলোতে পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের মতোই মানুষটার দিকে অত্যন্ত ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বেশ অনেকদিনই হলো সে মানুষটার ফুট- ফরমায়েশ খাটে। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় লস্কর। সে লোকমুখে শুনেছে এই মানুষটার ফুট-ফরমায়েশ যারা খেটেছে তাদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে টিকে আছে সেই। আরো অনেক ছোটো থাকতে নাকি খোদ কাপ্তেন নিজে তাকে হুগলীর বাজার থেকে কিনে এনেছিল। প্রথমে বাবুর্চির সঙ্গে কাজ করলেও পরে কাপ্তেনের নিজের কামরার পাশেই স্থান হয় তার। সেখানেই থেকে সর্বক্ষণ, কাপ্তেনকে মদের বোতল দিয়ে আসা, তার তামুক সব্জিয়ে দেয়া, তামুকে আগুন দেওয়া থেকে কামরা পরিষ্কার পর্যন্ত সবই করে সে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো মানুষটা জাহাজের সবার ওপরে চূড়ান্ত খবরদারি করলেও কখনোই তাকে, এমনকি ধমক পর্যন্ত দেয় না। এমনকি তার সঙ্গে খুব বেশি কথাও বলে না। কিন্তু কেন জানি মানুষটাকে যমের চেয়েও বেশি ভয় করে সে।
পাহাড়ি টিলার একেবারে চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটা বাবলা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে মানুষটা এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে দূর সমুদ্রে। তার থেকে বেশ খানিকটা পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। সামান্য চোখ তুলে সে দেখল মানুষটার পেছনের অবয়বটা। মানুষটাকে নিয়ে অনেক অনেক কথা প্রচলিত সমগ্ৰ দক্ষিণ উপকূল থেকে শুরু করে একেবারে বোম্বে-গোয়া পর্যন্ত। তার মাথার চারপাশে নাকি সর্বক্ষণ আগুন জ্বলে আর ধোঁয়া ওড়ে, জাহাজ লুট করার সময়ে তার ওপরে নাকি খোদ শয়তান ভর করে, এক কোপে নাকি সে দশজনের মাথা নামিয়ে দিতে পারে, ছোটো শিশুদের গলা কেটে সে নাকি রক্ত পান করে, মাঝেমধ্যে নাকি পূর্ণিমার রাতে সে দানোতে পরিণত হয়। এমনকি তার একটা বাঁকানো বিরাট তরবারি আছে। সেটা থেকেও নাকি অগ্নিবর্ষণ করতে পারে সে। ওটা নাকি সময়ে সময়ে তিনমুখী সাপের মতো ছোবল মারতে পারে শুক্রর ওপরে।
এসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি সে। কারণ জানে এই মানুষটার সঙ্গে বাঁচতে হলে মুখ বন্ধ রাখতে হবে। তবে এই মুহূর্তে মানুষটার পেছনের দিকে তাকিয়ে সে অনুধাবন করতে পারল কেন এই লোকটাকে নিয়ে এত এত কথা প্রচলিত। মানুষটা আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়ের মতো, দেড় মানুষ সমান উঁচু আর কমপক্ষে তিন মানুষ সমান চওড়া। এমনকি তার সাদা চামড়ার সাথিরাও কেউই তার মতো নয়। সত্যিকার অর্থেই তার মুখের চারপাশে উড়ছে ধোঁয়া, একহাতে আরকের বোতল আর অন্য হাতে দূরবীক্ষণ নিয়ে সে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মুখে ফুটে উঠল সামান্য হাসি।
নিজের বিশাল বপু নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দূরবীক্ষণটা ধরিয়ে দিল সে ছেলেটার হাতে। তারপর তার সঙ্গীদের ভেতরে আরাকান থেকে আসা মগ জলদস্যুদের নেতা পঞ্চনামার দিকে ফিরে পর্তুগিজ ভাষায় যা বলে উঠল সেটার বাংলা করলে অনেকটা এমন দাঁড়ায়, ইঁদুরকে তার ফাঁদের ভেতর নিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে।
অ্যালবার্তো দ্য সিলভেরা গল গল করে বেরুতে থাকা ধোঁয়ায় ভরপুর বাঁকানো তামাকের পাইপটা মুখ থেকে সরিয়ে ফেলতেই আরকের প্রভাবে গনগনে আগুনের মতো জ্বলতে থাকা তার টকটকে লাল চোখজোড়া আর লম্বা দাড়ি ভর্তি চেহারার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল মগদের নেতা। দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠল একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
ছেলেটা মাথা তুলে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল তিনটে জাহাজ সারি দিয়ে এগিয়ে আসছে জংলাটিলার দিকে।