অধ্যায় পয়ত্রিশ – বর্তমান সময়
ডকইয়ার্ড এলাকা, চট্টগ্রাম
অফিসরুমের দরজায় যে লোকটাকে দেখা গেল সে সম্ভবত একেবারে প্রস্তুত হয়েই ঢুকেছে। সম্ভবত সে বাইরে তার সঙ্গীদের অজ্ঞান শরীর দেখেছে। লোকটাকে দেখে ঠিক তার বাকি সঙ্গীদের মতো মনে হলো না। বরং সে ওদের ঊর্ধ্বতন কিংবা বস হতে পারে। লোকটা অস্ত্র বাগিয়ে ধরে কানে লাগানো হেডফোনে কথা বলতে বলতে চট করে ঢুকে পড়ল রুমের ভেতরে।
মুহূর্তের জন্য দুই পক্ষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। শারিয়ার আর ভুবন যেমন বুঝতে পারল তাদের প্রতিপক্ষ দক্ষ এবং প্রস্তুত। অন্যদিকে অস্ত্রহাতে লোকটাও দুজনার শরীরিক ভঙ্গি আর ঢাকা মুখ দেখেই বুঝে ফেলল এরা সাধারণ গুণ্ডা-মাস্তান নয়। তার বুঝতে পারার পেছনে আরেকটা কারণ হলো, বাইরেই সে দেখে এসেছে তার এতগুলো লোককে কাবু করে রেখে এসেছে এরা। কাজেই সে ভেতরে ঢুকে সেকেন্ডের জন্য দ্বিধা করেই গুলি চালাল হাতে থাকা হ্যান্ডগান থেকে।
লোকটার একেবারে বরাবর ছিল ভুবন। আর শারিয়ার খানিকটা ভেতরের দিকে। সে সোজা গুলি করল ভুবনকে। কিন্তু ভুবন লোকটার দ্বিধার এক সেকেন্ডের ভেতরেই বুঝতে পেরেছে সে গুলি করতে যাচ্ছে, তাই সে আগেই লাফ দিয়েছে একটা ক্যাবিনেটের দিকে। লোকটাও গুলি করল আর মাটিতে পড়েই এক গড়ান দিয়ে ক্যাবিনেটের আড়ালে সরে গেল ভুবন। প্রথম টার্গেট মিস হয়ে যেতেই যেকোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকের মতোই খানিকটা ঘুরে গিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলো শারিয়ারের দিকে।
শারিয়ার দাঁড়িয়ে ছিল একটা রিভলভিং চেয়ারের পেছনে। লোকটা ভুবনকে গুলি করতেই চেয়ারটাতে লাথি মারল শারিয়ার। ভুবনকে গুলি করে সোজা হওয়ার আগেই চেয়ার তীব্র বেগে এগিয়ে গিয়ে বাড়ি মারল লোকটার বুক বরাবর। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারটাকে হাতের ঝাপটায় সরিয়ে দিল সে। চেয়ারটাকে ঠেলে দিয়েই শারিয়ার লাফ দিয়েছে সামনের দিকে। লোকটা চেয়ার সরিয়ে সোজা হওয়ার আগেই শারিয়ার এগিয়ে এসে দক্ষ কমব্যাট যোদ্ধার মতো লাথি মারল লোকটার হাঁটুতে। একজন সক্ষম মানুষের হাঁটুতে ষাট কেজি ওজনের লাথি লাগলেই হাঁটুর বাটি ডিজলোকেট হয়ে যায়, আর শারিয়ারের বুট পরা পায়ের লাথির ওজন কমপক্ষে একশ কেজি। কিন্তু লাথিটা ঠিকমতো লাগল না। তবে এতেই লোকটা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মাটিতে। তবে দমে যাওয়ার মতো লোক সেও নয়। মাটিতে বসে পড়লেও সে আবারও অস্ত্র তুলল। এবার আর হেলিকপ্টার শট নয় বরং ক্রিস গেইল যেভাবে ছক্কা মারে সেভাবে হাতের পাইপটা চালাল অস্ত্রটার মাঝ বরাবর। শূন্যে উঠে ছিটকে পড়ে গেল ওটা অন্যদিকে। কিন্তু সেই সঙ্গে লোকটাও ঝাঁপিয়ে পড়ল শারিয়ারের ওপরে। বসা থেকেই লাফ দিয়ে ওকে নিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। দুজনেই জড়াজড়ি করে পড়েছে। শারিয়ারকে নিচে পেয়ে তার ওপরে চেপে বসল সে। মুখে ঘুসি মারতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে নিজের পা বাঁকিয়ে লোকটার গলায় ঠেকিয়ে উলটোদিকে টান মারল শারিয়ার। মাটিতে পড়ে গেল লোকটা।
দুজনেই মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। লোকটা এক পা এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে সোজা ঘুসি মারল শারিয়ারের মুখে। কিন্তু শারিয়ার তার ফাঁদে পায় দেয়নি। বরং লোকটা ঘুসি মারতেই তার শূন্যে পাক খাওয়া হাতটা ধরে ফেলল শারিয়ার। শরীরটাকে বাঁকিয়ে লোকটার হাতে নিয়ে এলো নিজের কাঁধের ওপরে। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারে লোকটা। সতর্ক হয়ে উঠল। নিজের শরীরটাকে ঘুরিয়ে ছুটিয়ে নিতে চাইল হাতটা কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কাঁধের ওপরে থাকা হাতটাকে লিভারের মতো উলটো করে ধরে নিচের দিকে চাপ দিতেই কট করে হাত আর কাঁধের জয়েন্ট ছুটে গিয়ে ডিজলোকেট হয়ে গেল কাঁধের হাড়। প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটা বুকে হাত রেখে জোরে একটা ধাক্কা মারল শারিয়ার। ধপ করে লোকটা ছিটকে গিয়ে বসে পড়ল সেই রিভলভিং চেয়ারে। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল শারিয়ার।
পিস্তল হাতে চেয়ারটার পাশে দাঁড়ানো ভুবন জানতে চাইল, ‘ওকে, বস?’ শুধু মাথা নাড়ল শারিয়ার। লোকটা চেয়ারে বসেই কাতরাচ্ছে। শারিয়ারের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেল ভুবন। ‘বস, এখন কী করবে?’ বলে সে কামরাটা দেখিয়ে বলে উঠল, ‘এখানে তো কেউই নেই?’ আমাদের অনুমান তো…’
‘আমাদের অনুমান ঠিকই আছে,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল শারিয়ার। কিছু একটা তো গণ্ডগোল হচ্ছে এখানে,’ বলে সে রুমটা দেখাল। ‘তুই হয়তো খেয়াল করিসনি। কিন্তু কেউ একজন ছিল এখানে বা কিছু একটা হচ্ছিল এখানে,’ বলে রুমের এক কোনায় জড়ো করে রাখা খাবারের প্যাকেট দেখাল। ‘হতে পারে কোনো অফিসিয়াল প্রোগ্রামের খাবার এগুলো কিন্তু ওটা,’ বলে সে রুমের কোনার দিকে প্লাইউডের দরজার সামনে দেখাল। ‘সম্ভবত বাথরুম ওটা। ওটার সামনে দেখ প্লাস্টিকের পাপোসের সামনে একজোড়া মেয়েদের স্যান্ডেল,’ বলে সে রুমটা দেখাল। ‘কেউ একজন ছিল এখানে এবং তাকে সরানো হয়েছে এখান থেকে খুব বেশি সময় হয়নি,’ বলে সে নিজের পিস্তলটা বের করে এনে ভুবনকে ইশারা করল, ‘বাথরুমে দেখ তো। আর কিছু আছে নাকি,’ ভুবন চট করে বাথরুমে চলে গেল। খানিক পরেই সে বেরিয়ে এলো বেশ কিছু মেয়েলি জিনিস নিয়ে।
‘দেখ তো অবস্থা?’ বলেই সে ওগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল। ‘এখন কী করবে? টমিকেও লাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। এই এলাকার কিছুই আমরা চিনি না। আর যে ঝামেলা পাকিয়ে এখানে এসে ঢুকেছি মনে হয় তো কিছুটা হলেও…’
হঠাৎ চেয়ারে বসে কাতরাতে থাকা লোকটা হেসে উঠল। দুজনে তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে চট্টগ্রামে স্থানীয় ভাষায় বলে উঠল, ‘তোরা কারা আমি জানি না, কেন এখানে আইছোস সেও জানি না। খালি জানি এইহান থাইক্কা জিন্দা বাইর অইতে পারবি না। তোরা জানোস না কার লগে টক্কর দিতাছোস…’
শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে নিজের কানের সঙ্গে লাগানো ইয়ার পিসটা ধরে বলে উঠল, ‘এই হারামজাদা টমি গেল কই? কাজের সময়ে ব্যাটা…’ বলেই সে চট করে পা এগিয়ে চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের সামনে। ‘একটা বুদ্ধি আসছে। পিস্তল সাবধানে ধরিস,’ বলেই সে চেয়ার টেনে লোকটাকে কোমরে হাত দিয়ে একটানে লোকটার বেল্ট খুলে নিয়ে এলো। তারপর সেটা দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলল লোকটার হাত।
ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। ‘এই কী করস?’
শারিয়ার কারো কথা শোনার মুডে নেই। লোকটার হাত দুটো বেঁধেই সে এক পা পিছিয়ে এলো। ‘ভুবন, চেয়ারটাকে ধর শক্ত করে।
ভুবন খানিকটা এগিয়ে এসে দ্বিধার সঙ্গে চেয়ারটা ধরল। কিন্তু ততোধিক দ্বিধার সঙ্গে জানতে চাইল, ‘বস, করবেটা কী?’
কিন্তু তার প্রশ্নের জবাব দিল না শারিয়ার। বরং লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল। ‘তুই কে আমি জানি না, ঠিক লোকটার একটু আগের বলার ভঙ্গি নকল করে বলে উঠল, ‘তুই কী করস আমি জানি না,’ বলেই সে চট করে নিজের পিস্তলটা বের করে লোকটার দিকে তাক করল। ‘খালি জানি আমার হাতে একটা পিস্তল আছে। আর তোর কাছে আছে তথ্য তুই আমারে তথ্য দিবি। হয় তোর মাথার ভেতরে যা আছে সেইটা আমি জানবো আর না হয় আমার পিস্তলের ভেতরে যা আছে এইটা তোর মাথার ভেতরে থাকব।’
শারিয়ারের কথা শুনে লোকটা কাতরাতে কাতরাতে জোরে হেসে উঠল। ‘আর কিছুক্ষণের ভেতরে এইহানে অন্তত একশ লোক আসব। তহন তোরা কী করবি?’
‘আগে বল, এখানে কী কেউ বন্দি ছিল? একজন মহিলাকে ধরে এনে এখানে বন্দি করে রেখেছিলি তোরা?’ শারিয়ার পিস্তলটা সামনে এগোল। লোকটার ফাটা ঠোঁটের কোণে হাসি।
‘তুই জিগাইবি আর আমি বইলা দিব…’
শারিয়ার খুব সাবধানে গুলি করল। সাইলেন্সার লাগানো কিং কোবরার গুলি লোকটার কানের পাশ দিয়ে হুঁশশ করে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে লাগল। মুহূর্তের জন্য লোকটার মুখের হাসি সামান্য ম্লান হয়ে গিয়ে আবারও সে জোরে জোরে হেসে উঠল। ‘তুই ভুল মানুষরে ভয় দেখানোর… শারিয়ার আবারও গুলি করল, এবার লোকটার কাঁধের পাশের রিভলভিং চেয়ারটার রেক্সিনে মোড়ানো একটা অংশ উড়ে গেল। গুলির ধাক্কায় চেয়ারটা খানিকটা পিছিয়ে গেল সেই সঙ্গে ভুবনও সরে গেল একপাশে। ‘বস, কী করছো তুমি?’ ভুবন চেয়ারটা একপাশ থেকে ধরে রেখে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল। শারিয়ারকে শান্ত থাকতে বলছে সে।
শারিয়ার তার দিকে তাকালও না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেয়ারে বসা লোকটার দুই চোখের দিকে। ‘শেষবারের মতো জানতে চাচ্ছি। এখানে কী তোরা কাউকে ধরে এনছিলি কি না?’
‘মারা খা শালার…’
লোকটা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই শারিয়ার পাথরের মতো স্থির হাতে ধরে রাখা পিস্তলটা দিয়ে গুলি করল লোকটার মাথার পাশে। ধুপ করে শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লোকটার একটা কানের লতি উড়ে গেল। আবারও প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল লোকটা। ‘বস!’ জোরে ধমকে উঠল ভুবন, আর দুই পা এগিয়ে এসে চিৎকাররত লোকটার মুখ শক্ত হাতে চেপে ধরে নিজের পিস্তলটা লোকটা কপালে ঠেকাল শারিয়ার। তিন-তিনটে গুলি করার পর আগুনের মতো উত্তপ্ত সাইলেন্সারটা দুই চোখের মাঝখানে ঠেকাতেই চড়-চড় করে চামড়া পুড়তে শুরু করল। মুখের ওপরে চেপে ধরা শারিয়ারের হাতটা প্রায় কামড়ে ধরছে লোকটা।
কপালে সাইলেন্সার ঠেকিয়ে শারিয়ার মুখটাকে লোকটার একেবারে কাছাকাছি নিয়ে বলে উঠল, ‘বুঝতেই পারছিস, সময় নেই আমাদের হাতে। সেই সঙ্গে তথ্যটাও জানা দরকার। কাজেই,’ বলেই সে লোকটার মুখ ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। পিস্তলটাকে সোজা লোকটার কপাল বরাবর তাক করে বলে উঠল, ‘আমি তিন গুনব। এরমধ্যে সত্য না বললে তোর কপালের ওই পোড়া জায়গাটাতে একটা লাল টিপ বসিয়ে দেব। এক।’
লোকটার মুখ খুলে যেতেই সে চিৎকার করতে উদ্যোগী হয়েছিল শারিয়ারের ভাবভঙ্গি দেখে সেই হা হওয়া মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না। সে শারিয়ারকে দেখে নিয়ে একবার ভুবনকে দেখল। ভুবন সাবধানে বলে উঠল, ‘বস, আস্তে।’
‘দুই,’ শারিয়ারের কোনো বিকার নেই।
‘এই ভাই,’ লোকটা দুহাত তুলে ভুবনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ভাই, আপনার বন্ধুরে থামান। ভাই।’
‘বস!’
‘আমি তিন গুনবো আর বুলেট ছুটবে,’ বলে শারিয়ার পিস্তলটাকে আরেকটু এগিয়ে আনতেই লোকটা চেঁচামেচি শুরু করে দিল।’
‘ভাই ভাই…’
‘তিন,’ বলে শারিয়ারের আঙুল টিগারে চেপে বসলো।
***
ছোটো বাচ্চাদেরকে স্কুলে পিটি করানোর সময় যেভাবে হাত-পা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, টমি আর সুমনকে অনেকটা সেভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। দুজনেই আধো অন্ধকারের ভেতরে হাত তুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে ওদেরকে বন্দি করা লোকগুলোকে দেখছে মনোযোগের সঙ্গে।
ওদের সঙ্গে কথা বলেছে চায়নিজ চেহারার যে লোকটা সে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে ওদের গাড়িটার ঠিক সামনেই। আর গাড়ির বনেটের ওপরে রাখা টমির ল্যাপটপটার সামনে কাজ করতে থাকা অন্য লোকটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে স্ক্রিনে। লোকটা ল্যাপটপে তার কাজ শেষ করে বিচিত্র ভাষায় সেই লোকটাকে কিছু একটা বলল। কথা শেষ হতেই সন্তুষ্টির সঙ্গে লোকটা গাড়ির সামনে ড্রোনের রিমোট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অপর লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলে উঠল। ওদের দেখতে দেখতে টমি আরেকবার ফিরে তাকাল ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখা অপর চারজনের দিকে।
লোকগুলোকে দেখে এদের ভাবভঙ্গি দেখে টমি অনুমান করল এরা বেশিরভাগই এ-দেশের মানুষ নয়। বাইরে থেকে এসেছে, তবে সবাই এই দেশের সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া আরেকটা জিনিস যেটা টমির মনে হচ্ছে সেটা হলো এরা সবাই যার যার কাজে একদম প্রফেশনাল। অস্ত্র ধরা, দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যাপারেই প্রফেশনালিজমের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
নিজের লোকদের নির্দেশনা দেওয়া শেষ হতেই টমিদের সঙ্গে দাঁড়ানো একজনকে ইশারা করল লিডার। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা টমিকে তার হুডি ধরে টেনে নিয়ে সামনে ঠেলে দিল।
‘আরে আস্তে,’ কেমন জানি খসখসে বাংলা লোকটার। ‘আমরা বন্দি করতে পারি ওদের কিন্তু এক অর্থে তো তারা আমাদের মেহমান,’ বলে সে নিজের অন্য সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। ‘মিস্টার টমি। সব ঠিক আছে। আমার লোকেরা পরীক্ষা করে দেখেছে। এখন তুমি আবার তোমার বসের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রক্ষা করবে। সেই সঙ্গে ঠিক আগে যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছিল সেভাবেই নির্দেশনা দিতে থাকবে। আমার লোক তোমার নিদের্শনা অনুযায়ী ড্রোনটা অপারেট করবে যাতে তোমার সুবিধে হয়। কিন্তু,’ বলে সে টমিকে নিজের দিকে টেনে এনে হুডির কলারটা দুই হাতে মুচড়ে ধরল।
লোকটা মুখের একেবারে কাছাকাছি মুখটাকে টেনে নিতেই টমি কড়া আফটার শেভের গন্ধ টের পেল নাকে। গন্ধটা এতই কড়া যে টমির নাক জ্বালা করে উঠল। যদি তুমি তাদের কোনোভাবে সতর্ক করার চেষ্টা করো তবে তোমার ওই সঙ্গী…,’ বলে সে সুমনকে দেখাল। সুমনের মাথার পাশেই পিস্তল ধরে আছে একজন। ‘তার খুলির ভেতরে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। বোঝা গেছে?’ টমি কিছু না বলে মাথা লাগল।
লোকটা তাকে এক ঠেলা দিয়ে ফেলে দিল গাড়ির বনেটের ওপরে। ‘নাউ ডু অপারেট,’ বলে সে টমিকে কাজ শুরু করতে বলল।
***
শারিয়ারের আঙুল ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করেছে। লোকটা হাউমাউ করে বলে উঠল, ‘ভাই বলতেসি, শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির সঙ্গে পিস্তলটা নামিয়ে নিল। তার চেয়ারটাকে টেনে খানিকটা সামনে এনে বসে পড়লে ওটার সামনে। পিস্তলটাকে তুলে ধরে একেবারে লোকটার মুখের কাছে নিয়ে বলে উঠল, ‘এবার বল, কী ব্যাপার? ঠিকঠাক বলবি। কারণ একটা মিথ্যে বা ভুল বললে তোর খবর আছে।’
‘জি,’ বলে লোকটা একবার ভুবনকে দেখে নিল। শারিয়ারকে তার বেশি ভয়ংকর মনে হচ্ছে। সেই তুলনায় ভুবনকে তার তুলনামূলক ভালো মনে হয়েছে। তাই বারবার ভুবনের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু এবার সে আশার গুড়ে বালি পড়ে গেল। ভুবনের দিকে তাকাতেই সে নিজের পিস্তল নেড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দিতে বলল।
‘ভাই, আমরা কিছুই জানি না। আমরা ভাড়ার লোক। আমরা চাঁটগাওয়ের বাইরে থেকে আসি। কাম করি টাকা নিয়ে সইরা পড়ি আবার চাটগাঁয়ের বাইরে। কয়েকদিন আগে আমরা যার মাধ্যমে কাম পাই হে জানায় বিরাট একটা কাজ আছে। পুরা দল লাগব। তো আমরা আসি। আমগোরে মোবাইল থেকে শুরু কইরা অস্ত্র সব দেওয়া অয়। কওয়া অয় অমুক জায়গা থেকে একজনরে তুলতে হবে। আমরা হেই বেডিরে হোটেল থেকে অনুসরণ কইরা এইখানে আসি। এরপরে দেহি হে বাড়ির ভেতরে যায়, একটু পরে দেহি বেডি দৌড়াইতাসে। আমরা আর ঝুঁকি না নিয়া হেরে তুইলা ফালাই। তুইল্লা এইহানে লইয়া আহি।’
‘আনার সময় ওই পুকুর পাড়ে কেয়ারটেকারকে কে খুন করে?’ ভুবন জানতে চাইল। লোকটা জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। শারিয়ার বুঝল কাজটা ওদেরই কারো। ‘এখানে কেন?’
‘এইটা কী তোদের এলাকা?’
‘না ভাই,’ লোকটার কান থেকে গড়ানো রক্ত মুখের দিকে চলে আসছে। শারিয়ার একবার আশেপাশে দেখ নিল। একে আর বেশিক্ষণ এখানে রাখা যাবে না। সময় কমে আসছে। ‘যারা আমগো কাম দিছে হেরাই এহানে আইন্না রাখতে কইছে, পাহারাও দিতে কইছে। এইহানে এইসব কাম অয়। জাহাজ ভাঙ্গুনের ইউনিয়নে লিডারগো হাত কইরা। হিরুইন-ইয়াবার চালান পাচার, মানুষ পাচার। মাইনষেরে এইনে আইন্না আটাকায়া রাখা, মারা এইগুলান এইনে অয়। এইজন্যই বেডিরে এইনে আইনা আটকাইয়া রাখা অইছিল।’
‘এখন কোথায় গেল সে?’ ভুবনের প্রশ্নে লোকটা দ্বিধা করতে লাগল। শারিয়ার পিস্তলটা হাতে নিয়ে আবারও চেয়ারটাকে টেনে নিল নিজের দিকে। লোকটা আবার হাউমাউ করে উঠল। ভাই, হেই বেডিরে আইজ সন্ধ্যার দিকে সরানি অইছে এইহান থেইকা। আইজ বিকালে ফোন আইলো কে নাকি আইবো দেহা করতে। আমরা হেই বেডিরে আনার পর থেইক্কা হেয় আমগোর দায়িত্বে ছিল। কেউ কিছু কয়ও নই, যোগাযোগও করে নাই। আইজ ফোন কইরা কইলো, কে নাকি দেখা করতে আইবে। প্রথমে কইছিল এহানেই আইবো পরে কইলো সরাইয়া ফালাইতে।’
‘কোথায়?’ শারিয়ার পিস্তলটা আবারে কপালে ঠেকিয়ে জোরে প্রশ্ন করে উঠল। ‘ভাই এইনেই,’ বলে লোকটা এমনভাবে হাত তুলে দেখাল যেন জায়গাটা দেখা যাচ্ছে।
‘এখানে বলতে?’
‘ভাই এইনতে দুই বলক পরে জাহাজ মেরামতির যে ডকইয়ার্ড আছে হেনে একটা পুরান জাহাজের ভেতরে হেরে নেয়া অইছে। যার আসার কথা ছিল সে এহনো আসে নাই।’
‘ওখানে কী তাকে তোদের পাহারাতেই রাখা হয়েছে নাকি বাইরের কাউকে…? কয়জন আছে ওখানে?’
‘না, ভাই আমগো লোকেরাই রাখছে। আছে চাইরজন অইবো,’ দ্বিধার সঙ্গে বলে উঠল সে।
‘ঠিক করে বল,’ ধমকে উঠল ভুবন।
‘বলার দরকার নেই,’ বলে শারিয়ার একটান দিয়ে তুলে ফেলল লোকটাকে,’ তারপর লোকটার জ্যাকেটের হুড়িটা তুলে দিল তার মাথার ওপরে। ‘ও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে,’ বলে সে লোকটাকে ঠেসে সরিয়ে দিল একপাশে। ‘তুই আমাদের সঙ্গে যাবি। আমাদের দেখাবি মেয়েটাকে কোথায় রাখা হয়েছে। এরপরে নিজের লোকদেরে ডেকে বাইরে আনবি। এরপর যা করার আমি করব। বুঝেছিস?’
‘ভাই আমার লোকেরা আমার কথা শুনব। কিন্তু ইউনিয়নের লোকেরা?
‘মানে?’
‘ভাই এহানে তো আমরা ইউনিয়নের শেল্টারে কাম করি। হেরা খুব খারাপ। হেরা যদি…’
‘এত কথা বুঝি না। আগে মেয়েটাকে বের করি। পরে অন্য কথা হবে,’ বলে সে লোকটাকে টেনে একেবারে নিজের পাশে নিয়ে এলো। তারপর লোকটার শোল্ডার ব্লেডের ওপরে পিস্তলটা চেপে ধরে ভুবনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল, ‘খুব সাবধানে, ভুবন। তুই আমার থেকে কিছুটা পেছনে থাকবি।’
ভুবন ইশারায় জানাল, সে বুঝতে পেরেছে।
লোকটাকে টেনে ধরে প্রায় গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। ‘হ্যালো, বস।’ এয়ার পিসের ভেতর থেকে টমির গলা ভেসে এলো। ‘কী রে, টমি? কই গায়েব হয়ে গেছিলি তুই?’
‘বস, টেকনিক্যাল প্রবলেম হইছিল। আর হবে না। তোমরা কই? কী হলো? পেয়েছো ডক্টর শশীকে?’
‘আরে না,’ লোকটাকে শরীরের সঙ্গে এমনভাবে চেপে ধরে হাঁটছে শারিয়ার যেন দুই বন্ধু গল্প করতে করতে এগোচ্ছে। ওদের দুজনার থেকে খানিকটা পেছনেই ভুবন। ‘আমরা এখন সেই অফিস ঘরে। ডক্টর শশীকে পাইনি। কিন্তু এটা জানতে পেরেছি, সে এখানে বন্দি ছিল। এখন এই ইয়ার্ডেরই অন্যদিকে রাখা আছে তাকে। আমরা সেখানেই যাচ্ছি। তুই কী দেখতে পাচ্ছিস আমাদের?’
‘হুমম, পাচ্ছি এখন। তোমার সঙ্গে ওটা কে?’
‘পরে বলব। আপাতত খেয়াল রাখ আমরা কোনোদিকে যাচ্ছি। সাবধানে থাকবি যেন যোগাযোগ ` বন্ধ না হয়। আর ব্যাকআপ দিবি আমাদের। স্বাভাবিকভাবে কথা বল,’ শেষ কথাটা সে বলেছে লোকটার উদ্দেশ্যে। বলেই সে সাইলেন্সারের ডগা দিয়ে লোকটার পিঠে খোঁচা দিল। কারণ ওদের সামনে কয়েকজন এগিয়ে আসছে কথা বলার জন্য।
কয়েকজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ব্যাপার কী? ওদিকে এত হাঙ্গামা কীসের। লোকটা হেসে উঠে জানাল কোনো সমস্যা নেই। বলেই ওরা এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। খানিকটা এগিয়ে বামে মোড় নিতেই ওরা কন্টেইনার রাখার এলাকা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল জাহাজ ভাঙা আর মেরামতির ডক এলাকায়। ‘টমি সামনে দেখত, ক্লিয়ার আছে কিনা?’
‘একদম ক্লিয়ার বস কিন্তু তোমরা যে গলি দিয়ে ঢুকছ সেটার শেষ মাথায় একটা আধা ভাঙা জাহাজের ওখানে লোক দেখা যাচ্ছে।’
‘এই ব্যাটা এই গলির শেষ মাথায় সেই জাহাজ?’ লোকটা জবাবে জানাল, ওটাই। ‘জলদি চল,’ বলেই লোকটাকে আরেক খোঁচা দিয়ে এগোতে লাগল। পেছন ফিরে ইশারায় ভুবনকে সাবধান করে দিয়ে লোকটার পিঠের ওপরে আরো শক্ত করে চপে ধরল সাইলেন্সারের নলটা। ‘সাবধান, কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করবি না। উলটো-পালটা করলেই মরবি।’
লোকটা মাথা নেড়ে জানাল সে উলটো-পালটা কিছু করবে না।
আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল ডকের গলির শেষ মাথায় একটা আধভাঙা জাহাজের ওখানে আলো জ্বলছে। ঘোলাটে বাল্বের হালকা আলোয় দেখতে পেল দুজন লোক দাঁড়িয়ে গল্প করছে ভাঙা অংশটার মুখের দিকে। ভুবনের দিকে ইশারা করতেই ভুবন আরো খানিকটা পিছিয়ে অন্ধকারের ভেতরে হারিয়ে গেল।
‘একদম সাবধান। একদম উলটা-পালটা করবি না,’ বলে লোকটাকে সাবধান করে দিয়ে সে শেষ করল। ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখানে বাইরের কেউই আসেনি। লোকগুলোকে বলবি আমরা সেই লোক যাদের মেয়েটাকে নিতে আসার কথা ছিল। বুঝেছিস?’
শারিয়ারের প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই ওরা পৌঁছে গেল ভাঙা জায়গাটার সামনের দিকে। লোকটাকে দেখে তার সঙ্গীরা কৌতূহলের সঙ্গে জানতে চাইল কী হয়েছে ওখানে, এত হট্টগোল কীসের ছিল? লোকটা হেসে উঠে জবাব দিল তেমন কিছু না। একটু ঝামেলা হয়েছিল বাইরে থেকে যাদের আসার কথা ছিল তাদের নিয়ে। তাই সে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে ওদের।
লোক দুজনার ভেতরে একজন শারিয়ারকে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইল, একজনই এসেছে কেন। লোকটা জবাব দেবার আগেই শারিয়ার আর সে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো কাচের সঙ্গে। পাহারাদার দেখল শারিয়ারের হাতে পিস্তল আর সেই সঙ্গে লোকটাও ছুটে গেল তার পাঞ্জা থেকে। শারিয়ারকে পড়ে যেতে দেখেই লোকটা লাফিয়ে নিজের লোক দুজনার মাঝাখানে গিয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে সাবধান করে দিল নিজের সঙ্গীকে।
শারিয়ার পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলেও দেখতে পেল একজন অস্ত্র তুলতে শুরু করেছে ওর দিকে। শরীরটাকে উঁচু না করে সে বরং গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মাটিতে এক গড়ান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বের করে নিল নিজের পিস্তল। মাটিতে উলটো হয়ে শুয়েই গুলি করল লোকটার হাঁটু বরাবর। কুকুরকে লাথি মারলে যে রকম শব্দ করে ওঠে অনেকটা তেমনই কেউ করে উঠে লোকটা পড়ে গেল। তার অপর সঙ্গী সোজা গুলি করল শারিয়ারকে।
মাটিতে শুয়ে থাকলেও গুলিটা শরিয়ারের বুকে এসে লাগল। ভেস্টের কারণে গুলি গায়ে না লাগলেও ব্যথার চোটে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। ব্যথার চোটে অস্থির হয়ে উঠলেও শারিয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল পিস্তল তোলার কিন্তু অনুধাবন করতে পারল সে পিস্তল তোলার আগেই লোকটার গুলি তাকে বিদ্ধ করবে। কিন্তু গুলি করার আগেই কট করে একটা শব্দ হলো, আর লোকটার মাথা গিয়ে জাহাজের খোলের সঙ্গে বাড়ি লেগে ধাম করে পড়ে গেল সে মাটিতে। বুকে ভীষণ ব্যথা লাগলেও শারিয়ার চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াতে কিন্তু উঠতে গিয়ে আবারও বসে পড়ল মাটিতে। একজোড়া পা এগিয়ে আসতে দেখল তার দিকে।
একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভুবন জানতে চাইল, ‘ঠিক আছ?’ শারিয়ার হাতটা ধরতেই তাকে টেনে সোজা করিয়ে দিল সে। তুমি একটা অমানুষ, এত ঝুঁকি নিতে পারো,’ বলে সে আনমনে মাথা নাড়ল।
ভুবনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে শারিয়ার জাহাজের খোলের ফাঁকা অংশের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইল, ‘এই দুটো তো ঠান্ডা হয়েছে বুঝলাম। কিন্তু যেটাকে ধরে আনলাম সেটা গেল কই?’
‘ভেতরের দিকে গেল, আর কই?’ সে কথা শেষ করার আগেই জাহজের ভাঙা খোলের ভেতর থেকে ভেসে এলো নারীকন্ঠের চিৎকার। ভুবন তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছো?’ বলে সে গুলতিটাকে কোমরে রেখে পিস্তল বের করে আনল। শারিয়ারের দিকে তাকাতেই সে হেসে উঠল।
‘প্রশ্নের জবাব পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছি তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি চিৎকারটা শুনে। অন্তত এটা বুঝতে পেরেছি যে, ডক্টর শশী ভেতরে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে,’ বলে সে নিজের পিস্তলটা চেক করে নতুন সিলিন্ডার ভরে নিল। ‘শোন, এতক্ষণ বাইরে লুকোচুরি খেলেছি অনেক। এবার কিন্তু আর সে সুযোগ নেই। অন্য কারো প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে আমাদের বেশি প্রায়োরিটি দিতে হবে ডক্টর শশীকে উদ্ধার করার ব্যাপারটা,’ এইটুকু বলে সে ভুবনের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘কাজেই শুট টু হিট,’ বলে সে ভেতরের দিকে পা বাড়াল। তাকে কভার করে ঠিক তার পেছনেই ভুবন।
ঠিক বাইরের মতোই ভেতরেও একটা হলুদ বাল্ব থেকে ঘোলাটে আলো ছড়াচ্ছে। বাল্বের ঘোলাটে আলোতে যা দেখল তাতে শারিয়ার অনুমান করল যে জাহাজটার খোলের ভেতরে ওরা প্রবেশ করেছে সেটার ভেতরের সবকিছুই প্রায় ভেঙে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে শুধু খোলটা বাদে জাহাজের আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর সেই খোলের ভেতরেই একদিকে সম্ভবত এনে রাখা হয়েছিল মেয়েটাকে। কিন্তু এখন সেখানে নেই সে। কারণ তাকে দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে, আর ঠিক তার পেছনেই মেয়েটার মাথার পাশে হ্যান্ড গান চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটা যাকে ওরা সেই অফিস থেকে ধরে এনে এই পর্যন্ত পৌঁছেছে। তার ঠিক দুদিক থেকে দুজন অস্ত্র তাক করে আছে শারিয়ার আর ভুবনের দিকে।
‘একদম লড়বি না কইতাছি,’ মেয়েটাকে সাপটে ধমকে উঠে শারিয়ার আর ভুবনকে উদ্দেশ্য করে লোকটা বলে উঠল। ‘একটা কিছু করবি তাইলে মাগিটারে শেষ কইরা দিমু।’
শারিয়ার সাবধানে অস্ত্র বাগিয়ে ভেতরের দিকে এগোল। বলতে গেলে প্রায় ফিসফিস করে ভুবনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘ভুবন, আমি এর সঙ্গে কথা বলছি। তুই চেক কর এই তিনজন বাদে চিপায় চাপায়-অন্ধকারে আর কেউ আছে কিনা,’ বলেই সে আরো দুই ধাপ এগিয়ে গেল। এক হাতের পিস্তলটা শূন্যে একপাশে তুলে অন্য হাতটা নিয়ে গেল নিজের প্যান্টের পকেটের ভেতরে। হাতে খুঁজে পেতেই জিনিসটা চেপে ধরল বাম হাতে। তারপর হাসিমুখে সেই মেয়েটাকে পিস্তল ধরে রাখা হাতটা অন্যদিকে সরিয়ে বলে উঠল, ‘আস্তে আস্তে, একদম সাবধানে। কারো কোনো ক্ষতি হওয়ার দরকার নেই। আমি পিস্তল সরিয়ে নিয়েছি।’
‘পিস্তল ফালা বান্দির পুত, মজা এইবার তুই বুঝবি। কিছু করলেই এই বান্দিটারে মাইরা ফালামু। আর না মারতে পারলেও আর এট্টু দেখলেই আমগো ভাইয়েরা সব আইয়া পড়ব। তারপরে তোরে কাবাব বানামু আইজ রাইতে,’ বলে সে হেসে উঠল। সঙ্গে তার দুই সঙ্গীও। ‘বান্দির পুতে আমারে গুলি করছে। গুলি করছে মাঙ্গিলালে।’
ঠিক আছে, কোনো দরকার নেই ঝামেলা করার,’ পিস্তলের নলটা আরেকটু সরিয়ে দিয়ে গলার স্বর নিচে নামিয়ে জানতে চাইল, ‘ভুবন?’
‘এক মিনিট,’ বলে সে একটু সময় নিয়েই বলে উঠল, ‘নেই বস। এরা তিনজনই।’
ভুবনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শারিয়ার প্যান্টের পকেটে থাকা জিনিসটা মুঠোয় চেপে হাতটা বের করে আনল। সেই সঙ্গে লোকগুলোকে আরেকবার শান্ত থাকতে বলে মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার ইশারা করেই হাতের বলটার নির্দিষ্ট জায়গাটায় চাপ দিয়েই ওটা ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে। ছোট্ট বলটা কীভাবে কাজ করে ঠিক জানে না শারিয়ার। তাই এক মুহূর্তে সে বুঝতেই পারল না ওটা আদৌ কাজ করছে কি না। কিন্তু দম বন্ধ করে জিনিসটাকে অবলোকন করতেই দেখল জিনিসটা মাটিতে একটা ড্রপ খেতেই ওটা থেকে হিসহিস করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ধোঁয়া। বুঝল কাজ করছে ওটা।
‘ভুবন ডানেরটা তোর,’ বলেই সে হাঁটু গেড়ে বসে গুলি চালাল বামের লোকটার দিকে। বলটা ছুটে যেতেই কড়া ধোঁয়ায় প্রভাবে খক-খক করে কাশতে শুরু করেছে সামনের লোকগুলো। তাই লোকটাকে কাবু করতে কোনো বেগই পেতে হলো না। শারিয়ারের গুলি লোকটার রানের ওপরে লাগতেই অনেকটা ডিগবাজি দেয়ার মতো করে পড়ে গেল সে। শারিয়ার চোখের কোনে দেখতে পেল ডানের লোকটাও ভুবনের গুলির আঘাতে পড়ে গেল। দুইপাশের দুজনকে কাবু হয়ে যেতেই শারিয়ার মাটিতে এক গড়ান দিয়ে সোজা হলো পিস্তল হাতে। অনেকটাই এগিয়ে গেছে মেয়েটা আর তার মাথার পাশে পিস্তল ধরা লোকটার দিকে।
বন্দিকারী আর বন্দিনী দুজনেই কাশির দমকে বাঁকা হয়ে গেছে তবুও এর ভেতরেই লোকটা চেষ্টা করছে মেয়েটাকে ধরে রাখার। কিন্তু কঠিন হয়ে গেছে ব্যাপারটা তার জন্য। আর সেই সুযোগেই শারিয়ার এগিয়ে গেল দুজনার দিকে। মাটিতে আরেক গড়ান দিয়ে সে সোজা হলো মেয়েটার কাছাকাছি। তারপর মেয়েটার গায়ের কাপড় ধরে তাকে সর্বশক্তিতে টান দিয়ে সরিয়ে দিল একদিকে। মেয়েটা সরে যেতেই লোকটার পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল শারিয়ার। এক হাতে আধবসা থেকে হাতটাকে কনুই বরাবর চাপ দিয়ে সোজা হলো। তারপর সেটাকে বল ড্যান্সের মতো করে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো নিজের কাঁধের একপাশে। ফলে লোকটার শরীরটা ঝুঁকে পড়ল ওর ওপরে। লোকটাকে কাঁধের ওপরে তুলে নিয়ে সোজা হলো। তারপর দেহটাকে কুস্তির ভঙ্গিতে আছড়ে ফেলল জাহাজের খোলের উলটো দিকে যেখান থেকে একটা প্লাটফর্মের মতো নেমে গেছে নিচের দিকে।
লোকটাকে কাঁধের ওপর থেকে সেখানে আছড়ে ফেলতেই আবারও তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে। হাত থেকে ছুটে গেছে হ্যান্ডগান। লোকটা মাটিতে পড়ে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়াল হাঁচড়ে পাঁচড়ে। শারিয়ার নিজের পিস্তলটা খাপে ভরে দুই পা পিছিয়ে এলো তারপর সর্বোচ্চ গতিতে লাফ দিয়ে সামনে বাড়ল। লোকটার কাছ থেকে দুই পা দূরে থাকতেই শূন্যে উঠে গেল ওর দেহটা। তারপর উড়ন্ত দেহটা ফ্লাইং কিকের ভঙ্গিতে নেমে এলো লোকটার কোমর বরাবর। তীব্র ফ্লাইং কিকের চোটে এক মরণ চিৎকার করে লোকটা হারিয়ে গেল জাহাজের খোলের অন্যপাশে। একটু পরেই ঝপাত করে পানিতে পড়ার শব্দ ভেসে এলো।
শারিয়ার সোজা হয়ে এসে দাঁড়াল খোলের খোলা অংশটার ওখানে। জাহাজের এই অংশটা সমুদ্রের ওপরে। এইদিক দিয়ে খুব সহজেই প্লাটফর্মের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। পানির ওপরে খোলা জায়গাটায় এসে বুক ভরে দম নিল সে। গ্যাস বলের প্রভাব থেকে বাঁচতে এতক্ষণ দমবন্ধ করে রাখাতে বুক ফেটে আসছিল। বুক ভরে দম নিয়ে সে ফিরে তাকাল খোলের ভেতরের দিকে। কাকে উদ্ধার করল বুঝতে হবে। মেয়েটা কাশতে কাশতে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল, ভুবন তাকে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। পকেট থেকে বের করে শারিয়ার রুমাল এগিয়ে দিল তার দিকে।
‘আপনি কী ডক্টর শশী?’ প্রশ্নটা করে সে ভুবনের দিকে ফিরে মৃদু হাসি দিল। আপনাকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের ধন্যবাদ দিতে পারেন আপনি।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা হাত ঘুরিয়ে সপাটে একটা চড় মারল শারিয়ারকে।