অধ্যায় চৌত্রিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম
গোলন্দাজ যে মুহূর্তে বিল্লাল শেঠ, বৈঠা আর তুলারামের বাহিনীর সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা ঠিক করে ওদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গাছে উঠছে সেই মুহূর্তে কিরান আছে ভিন্ন এক পরিকল্পনার মাঝখানে।
একটু আগেও বাজারের ঠিক যেখানে সাতটা রাস্তার কেন্দ্রে ফাঁসি দেওয়ার জন্য কাঠের মঞ্চ বানানো হয়েছে সেখানে থাকলেও এই মুহূর্তে সেখান থেকে খানিকটা সরে এসে ওরা সাতটা গলির ঠিক যে গলিটা থেকে ফাঁসি দেওয়ার জায়গাটা সবচেয়ে কাছে সেখানে এসে একটা দোকান ঘরের ফেলে দেওয়া ঝাঁপির আড়ালে লুকিয়ে আছে। যদিও ভিড়ের কাছাকাছি থাকার সময়েই বাদ্যের শব্দ শুনতে পেয়েছিল কিন্তু এখন সেটা আরো পরিষ্কার কানে আসছে। তারমানে যাকে ফাঁসি দেওয়া হবে তাকে নিয়ে দ্বীপের মূল শাসনকর্তাদের দলটা এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে।
বাদ্যের শব্দ আরো পরিষ্কার কানে আসতেই কিরান তার পাশে উপবিষ্ট মানুষটার দিকে ফিরে তাকাল। বাদ্যের শব্দে সে খানিকটা অস্থির হয়ে উঠেছে কিন্তু তার পাশে থাকা মানুষটার মধ্যে কোনো বিকার নেই। সে একেবারেই স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনের ভিড় আর মঞ্চের দিকে। কিরান থাকতে না পেরে এবার জিজ্ঞেস করেই বসল, ‘সবকিছু ঠিকঠাক হইবে তো? তোমার লোকেরা জায়গামতো আছে?’ কিরানের প্রশ্নের জবাবে মানুষটা কিছুই বলল না। এমনকি সে ফিরেও তাকাল না। নিজের ডান হাতটাকে খনিকটা উঁচু করে অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে ইশারা করল সে। তারপর ফিরে তাকাল কিরানের দিকে।
পুরোদস্তুর পুরুষ মানুষের পোশাক পরিহিত মেয়েটার চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সেই গভীর কালো চোখের দৃষ্টিতে আবার একাধিক ধোঁকার প্রলেপ। কিরানের দিকে তাকিয়ে সেই প্রলেপে যেন আরো কয়েকটা নতুন স্তর যোগ হলো।. তারপর যেন খানিকটা হাসির সুরেই সে বলে উঠল, ‘একটা কথা মনে রাইখো জাহাজি, তুমি আমার কাছে একটা ছিঁড়া তেনার চেয়েও মূল্যহীন। কিন্তু তুমার বাপে আমার লাইগা, আমগো লাইগা অনেক কিছু করছে। আর এইহানে আমরা আইছি তুমার বাপের লাইগ্গা। কাজেই যা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমরা। পরিকল্পনা পুরাপুরি ঠিক আছে। আমার লোকেরা প্রত্যেকেই জায়গামতো আছে। কাজেই নিজের জবানডারে লাগাম দিয়া যেমনে কই এমনে কাম করো, বলে মেয়েটা ফিরে তাকাল সামনের দিকে। আর কিরানের মনে পড়ে গেল একটু আগে সেই পতিতালয়ের সামনে এই পদ্মরানির দস্যুদের সঙ্গে ওদের মোলাকাতের পরবর্তী ঘটনাটুকু।
প্রথম মোলাকাতের পর যখন মেয়ে জলদস্যু পদ্মরানির দলের প্রধান পদ্ম ওদেরকে জানায় ওদের একটা পরিকল্পনা আছে কবিকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে বাজারের এদিক থেকে ভেসে যায় বাদ্যের শব্দ। সবার জানা কথা এই শব্দ তখনই বাজানো হয় যখন কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ঢাকের শব্দ শুনে পদ্ম কিরানের এক হাত চেপে ধরে জানায় ওদেরকে যত দ্রুত সম্ভব বাজারের কাছে যেতে হবে। সেখান থেকে দুটো ভাগ হয়ে দ্রুত ওরা রওনা দেয় বাজারের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে সবাইকে নিয়ে একটা অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে পদ্ম বুঝিয়ে দেয় তার পরিকল্পনা।
পরিকল্পনা খুবই পরিষ্কার এবং ঝুঁকিপূর্ণ। পদ্ম জানায়, তার দলে আছে মোট সাতজন আর কিরানরা আছে চারজন। মোট এগারোজন। অস্ত্র বলতে আছে লাঠি- তির-ধনুক-তলোয়ার আর দুটো ছোটো বন্দুক। ওরা এই এগারোজন তিনটে দলে ভাগ হয়ে বাজারের মঞ্চের কাছে অবস্থান নেবে। ওদের উদ্দেশ্য হবে বাজারের মঞ্চে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হবে তার যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা। বাজারের মঞ্চে প্রথমেই এনে তোলা হবে যাকে ফাঁসি দেওয়া হবে তাকে, তারপর দুই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে আসবে সন্দ্বীপের প্রধান। সে নেমে সবার উদ্দেশ্যে কথা বলবে, তারপর সে নির্দেশ দিতেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
ওদের পরিকল্পনা হলো, ওরা দুটো দল মঞ্চের একেবারে কাছেই থাকবে অবস্থান নিয়ে। আর অন্য একটা দলের তিনজর মঞ্চের উলটো দিকের একটা গলিতে ঢুকে অবস্থান নিয়ে থাকবে। যেই মুহূর্তে দ্বীপের প্রধান শাসনকর্তা মঞ্চে তার বক্তব্য শেষ করবে সেই মুহূর্তে উলটোদিকের গলিতে থাকা দলটা ছোটো একটা বারুদের পুঁটলি আগুন দিয়ে বিকট শব্দ করবে আর তাতে সবার মনোযোগ সরে যাবে সেদিকে। আর ঠিক তখনই মঞ্চের কাছে থাকা দল দুটো সক্রিয় হয়ে উঠবে। প্রথম দল যেটাতে কিরান, পদ্ম আর গোমেজ থাকবে সেই দলটা দৌড়ে গিয়ে মঞ্চের কাছেই থাকা দ্বীপ প্রধানের ঘোড়ার গাড়িটা দখল করে ওটাতে চড়ে বসবে। ঠিক ওই সময়ে অন্য দলটা মঞ্চের মূল বেদির সঙ্গে আটকানো দড়িটা বেঁধে ফেলবে ঘোড়ার গাড়িটার সঙ্গে। ঘোড়া গাড়িটার সঙ্গে দড়ি আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে ওরা গাড়িটাকে ঘোরাতে শুরু করবে মঞ্চের চারপাশে। ওটা এক পাক ঘুরে আসার আগেই মঞ্চের যেদিকে ফাঁসি হওয়ার কথা সেদিকটা গাড়ির টানে ভেঙে পড়বে। আর ওরা গাড়িটাকে নিয়ে ঘুরে এসে কবি লোকটাকে তুলে নেবে ঘোড়ার গাড়িতে। তারপর চম্পট দেবে।
পরিকল্পনাটাতে ঝুঁকির পরিমাণ অনেক। কিন্তু সেই সঙ্গে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা এই অল্প সময়ে এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে বাজারের মঞ্চের একেবারেই কাছে, সেই দোকানের ঝাঁপির আড়ালে।
পদ্ম সামনের দিকে তাকিয়ে আবারও জানতে চাইল, ‘জাহাজি সব মনে আছে তো। মনে রাইখো। একবার বোমাটা ফাটলে কিন্তু আর ফেরার কোনো উপায় থাকব না। আমি গাড়ি ছোটাবো, তুমি গাড়িতে উইঠা বসবা। আমার মাইয়ারা তো সাহায্য করবই, তুমার লাঠিয়ালরা যেন গাড়িটারে পাহারায় রাখে যাতে ওইটারে কেউ আটকাইতে না পারে অথবা ওইটারে কেউ আক্রমণ কইরা সুবিধা করতে না পারে। মনে থাকব?’
কিরান স্রেফ একবার মাথা নেড়ে সে নিজের আড়াল থেকে খানিকটা উঁচু করে দেখে নিল গলিটার অন্যদিকে লুকিয়ে থাকা গোমেজ আর তার সঙ্গের বাকি দুই লাঠিয়ালের দিকে। ওদের ইশারায় সে একেবারে প্রস্তুত থাকতে বলল। ওরাও ফিরতি ইশারায় জানাল ওরা একদমই প্রস্তুত আছে। ইশারা বিনিময় হতেই কিরান ফিরে তাকাল মেয়েটার দিকে। যদিও বসে আছে সে কিন্তু শরীরটা একেবারে ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে মেয়েটার। কিরান তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘আপনার দলের প্রতি আমার আসলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কারণ পরে আর সুযোগ পাই না পাই।’
‘জাহাজি তুমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দরকার নাই। খালি খোদারে ডাকো, যাতে কামডা ঠিকমতো অয়। কারণ তুমার বাপেরে খুঁজি বাইর করতে অইলে কবিরে লাগব তুমার। আর সেই লগে সিলভেরার খোঁজও পাবা ওইহান থেইক্কাই,’ বলে সে আরেকবার কিরানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘আরেকটা কথা জাহাজি, কবিরে যদি এই ফাঁদ থেইক্কা বাইর করতে পারো তাইলে তারে নিয়া সটকায়া পড়ার দায়িত্বও কিন্তু তুমার। একবার এইহান থাইকা সইরা পড়লে আমি আর আমার মাইয়ারা স্রেফ হাওয়ায় মিলায়া যাব। মনে থাকব? খবরদার আমগো খোঁজ করবা না, আর আমগো কথা কাউরেই কইবা না,’ পদ্ম নামক দস্যু মেয়েটার চোখের ভাষা পাথরের চেয়েও কঠিন।
কিরান সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর বলে উঠল, ‘সমস্যা নাই আমার লোকেরা…’
কিরান তার বাক্য শেষ করার আগেই দেখতে পেল মঞ্চে তোলা হচ্ছে মুখ ঢাকা একটা মূর্তি। তাকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে পরিয়ে দেয়া হলো ফাঁসির দড়ি। তারপর মঞ্চে উপবিষ্ট হলো দ্বীপের শাসনকর্তা। সে মঞ্চে উঠেই কথা বলতে শুরু করল। আর এদিকে পদ্ম বলে উঠল, ‘সময় উপস্থিত, জাহাজি।’
কিরান একবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মেয়েটা একবার চারপাশে দেখে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। আর নির্দেশনা অনুযায়ী কিরান হাতের কড়ের পাঁচ পর্যন্ত গুনল তারপর মুখের আবরণটা দিয়ে মুখ ঢেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের লোকদের দিকে ইশারা করে হাঁটতে শুরু করল। ও আরেকটু এগোতেই ওর থেকে হাত দশেকের দূরত্বে এগোতে শুরু করেছে গোমেজ আর তার সঙ্গের লোকেরা। কিরান সামনে তাকিয়ে দেখল সামনেও পদ্মের কথা অনুযায়ী তার দলের আরো কয়েকজন একসঙ্গে হয়ে গেছে। কিরান নিজের কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলের বাঁটে হাতের মুঠি আরেকটু শক্ত করল, তারপর জোর কদমে এগিয়ে যেতে শুরু করল সামনের দিকে। ভিড়ের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় সে দেখতে পেল দ্বীপের শাসনকর্তার কোনো একটা কথায় সমবেত জনতা হইহই করে উঠল। ওরা কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ না করে সামনের দিকে এগিয়ে চললো। কিরান সামনে তাকিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল ওদের সামনে উপবিষ্ট দলটা ফাঁসির বেদির প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেছে এমন সময়ে তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। কিরান অনুধাবন করতে পারল অন্যপাশের গলিতে পদ্মের দস্যুদলের মেয়েরা বারুদের পিপাতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে।
বিস্ফোরণের শব্দে সবাই যখন সকম্পিত হয়ে উঠেছে কিরান নিজের লোকদের দিকে একবার ইশারা করেই দৌড়াতে শুরু করল সামনের দিকে। মঞ্চের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় পদ্ম মেয়েটার হাতে গোল নারকেলের মতো কিছু একটা নিয়ে ওটার এক কিনারায় আগুন ধরিয়ে এগিয়ে দিল ওর দিকে। জিনিসটা হাতে ধরেই কিরান সেটাকে সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে মারল মঞ্চের দিকে। জিনিসটা উড়ে মঞ্চের দিকে যাচ্ছে পদ্ম চিৎকার করে ঘোড়ার গাড়িটা দেখাল। ‘ওটা ফাটলেই…’ সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের সঙ্গে ধোঁয়া বেরুতে শুরু করেছে মঞ্চের ওপর থেকে। ‘কর্তার লোকেরা এদিকে আগায়ে আসবো কবিরে সরায়া ফেলার জন্য। জলদি…’ বলেই সে ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে কিরান আর তার লোকেরা সবাই মিলে দৌড় দিল ঘোড়ার গাড়িটার দিকে। ঘোড়ার গাড়ির কাছে পৌঁছাল আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল ঘোড়ার গাড়ির সহিস। কিরান তাকিয়ে দেখল ইতোমধ্যেই ঘোড়ার গাড়ির সহিসের জায়গার পাশে চড়ে বসেছে পদ্মের দলের একজন। ওরা কাছাকাছি পৌঁছাতেই পদ্ম লাফিয়ে উঠে পড়ল ঘোড়ার সহিসের জায়গায়। সেখানে উঠেই সে সহিসের চাবুকটা সাঁই সাঁই করে দুবার শূন্যে ঘোরাল। কিরান পৌছাতেই লাফিয়ে পেছনে উঠে দাঁড়াল আর একটা মেয়ে। ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে আটকানো দড়িটার একটা প্রান্ত ছুঁড়ে দিল ওদের দিকে। কিরান সেটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দিল গোমেজের দিকে।
দড়িটাকে পেয়েই লাঠিয়াল দুজনকে নিয়ে গোমেজ দৌড়াতে শুরু করল ফাঁসির বেদির দিকে। ‘জাহাজি, জলদি।’ সামনে থেকে পদ্মের চিৎকার শুনে কিরান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে তাকিয়ে দেখল লোকজন ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে। আর তার ভেতর দিয়েই হইহই করতে করতে দ্বীপের সৈন্যবাহিনী এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। কোমর থেকে টান দিয়ে নিজের পিস্তলটা বের করে আনল কিরান। সেই সঙ্গে আপনাতেই সে একবার ফিরে তাকাল মঞ্চে উপবিষ্ট ফাঁসির বেদিটার দিকে। সেখানে দেখতে পেল কবিকে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে ফেলা হয়েছে। অসহায়ের মতো সে গোমেজের দিকে ফিরে চিৎকার করতে যাবে তার আগেই দেখতে পেল লাঠিয়ালদের নিয়ে গোমেজ দড়িটা মঞ্চের বেদির ঠিক নিচের খুঁটিটার সঙ্গে আটকে দিয়েছে। ‘জলদি জলদি, কিরান চিৎকার করে উঠতেই সাঁই সাঁই করে চাবুক কষাল সহিসের জায়গায় থাকা পদ্ম আর সেই মেয়েটা।
লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ঘোড়ার গাড়ি। সামনের লোকজন আর দ্বীপের সৈন্যবাহিনীকে এলোমেলো করে দিয়ে মঞ্চটাকে একটা বৃত্তের মতো পরিধি ধরে ঝড়ের বেগ এগিয়ে যেতে শুরু করল ঘোড়ার গাড়িটা।
কিরান মঞ্চে দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটাকে চড়ানো ফাঁসির দড়িটা টানটান হতে শুরু করেছে। আরেকবার চিৎকার করে উঠল সে। পদ্ম আরো জোরে গাড়ি ছোটাল, আরেকটু এগোলেই গাড়ির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা টান খেয়ে বেদিটা ভেঙে পড়বে, আর না হয় ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো লোকটা মারা পড়বে। ঘোড়ার গাড়িটা আরেকটু এগিয়ে যেতেই টানটান হতে শুরু করল দড়িটা, যেকোনো সময় হয় বেদি ভেঙে পড়বে আর না হয় ফাঁসির দড়িতে আটকোনো লোকটা লটকে পড়বে। কিরান দেখল দুটো দড়িই টানটান হয়ে উঠছে। আর কয়েক ধাপ এগিয়েই ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা টান টান হয়ে গেল।
খুশিতে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল ওদের গাড়ির সামনে জুড়ে দেওয়া ঘোড়া দুটো হ্রেষা ধ্বনি করে নিজেদের দুইপা শূন্যে তুলে ফেলেছে। কিন্তু গাড়ির টানে মঞ্চ তো ভেঙে পড়েইনি বরং দড়িতে টান খেয়ে থেমে গেছে গাড়িটা। ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে লোকটাকে। অসহায়ভাবে চিৎকার করে উঠল কিরান।
অন্যদিকে লাঠিয়াল দুজনকে নিয়ে গদা হাতে মঞ্চের বেদির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল গোমেজ। গাড়িটাকে থেমে যেতে দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখছিল। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। গাড়িটা থেমে যেতেই সে পরিস্থিতি দেখতে পেল মঞ্চের ওপরে মানুষটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে মঞ্চের অন্য দিক থেকে ভেসে এলো কিরানের অসহায় চিৎকার। প্রায় কোনোকিছুই চিন্তা না করে সে নিজের ভারী শরীরটা নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল মঞ্চের দিকে। যে খুঁটিটাতে দড়ি আটকানো ছিল নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে পূর্ণ বেগে দৌড়াতে দৌড়াতে কাঁধ দিয়ে গিয়ে পড়ল সে ওটার ওপরে।
কিরান ফিরে তাকাল মঞ্চের দিকে। চারপাশের হট্টগোলের ভেতরেও পরিষ্কার শুনতে পেল গুলির শব্দটা। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে দেখল যে, চৌকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষটাকে, সেই চৌকাঠে আটকানো দড়ির পাশটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল গুলির আঘাতে। সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে ঝোলানো চৌকাঠ ভেঙে ছিটকে পড়ে গেলে মঞ্চের ওপরে।
তিনটে ঘটনা একসঙ্গে ঘটল; গাড়িটা থেমে গেলেও পদ্ম সাঁই সাঁই করে চাবুক চালাল। অন্যদিকে গোমেজের ভারী শরীরটা আছড়ে পড়ল মঞ্চের খুঁটির ওপরে। সেই সঙ্গে মঞ্চের ওপর থেকে ফাঁসির বেদি ভেঙে মানুষটা ছিটকে পড়ল ঠিক ওই জায়গাটাতেই। একইসঙ্গে তিনদিক থেকে তিনটে চাপ পড়াতে মঞ্চের ওই অংশটাই ভেঙে বসে গেল একপাশে। কিরানদের ঘোড়ার গাড়িটা লাফ দিয়ে আগে বাড়ল তীব্র বেগে। সেই সঙ্গে নিয়ে চললো মঞ্চের গোড়ার সঙ্গে আটকানো খুঁটিটার একটা অংশ। অন্যদিকে গোমেজ খুঁটিটাকে আঘাত করেই সরে আসতে যাচ্ছিল তার আগেই মঞ্চের একটা অংশ ভেঙে পড়ল ওর ওপরে। তার ওপরে ছিটকে এসে পড়ল ফাঁসির দড়ি থেকে পড়ে যাওয়া মানুষটা।
কিরানদের গাড়িটা তীব্র বেগে সামনে এগোলেও পদ্ম সেটার বেগ কমিয়ে গাড়িটাকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল তারপর সেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো মঞ্চের ঠিক যেখানে ফাঁসি হতে যাচ্ছিল সেখানটায়। সেখানে পৌছেই কিরান দেখতে পেল মঞ্চের বেদির একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। সেটার নিচে চাপা পড়া গোমেজকে টেনে বের করে আনছে তার সঙ্গে লাঠিয়ালদের একটা দল সেইসঙ্গে অবাক হয়ে সে দেখল তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বেদু বিল্লাল শেঠসহ আর আরো কয়েকজন।
গাড়িটা ওখানে পৌঁছাতেই নিজের লোকদের চিৎকার করে অজ্ঞান গোমেজ। আর মুখ ঢাকা অন্য লোকটাকে গাড়িতে তোলার নির্দেশ দিয়ে কিরান ফিরে তাকাল বেদু তুলারাম আর বিল্লাল শেঠের দিকে। ‘তোমরা?’
‘হুজুর, আমরা এইখানেই ছিলাম,’ বলেই বেদু ভিন্নদিকে ইশারা করে বলে উঠল, ‘ওইখান থেইকা ওস্তাদ গোলন্দাজ গুলি করছে।’
কিরান সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পারল ফাঁসির চৌকাঠটা কীভাবে ভেঙেছে। সে ওদেরকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এলো পদ্ম মেয়েটা, তার সঙ্গে আরো কয়েকজন। কিরান কিছু বলার আগেই সে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
‘জাহাজি আমগো দায়িত্ব শেষ, এহন এইখান থেইকা পলানো তুমগো কাম। ওই দেখো দ্বীপের সৈন্যরা আইতাছে। মাইরা কাইটা বাইর অইতে অইবো। জলদি করো,’ বলে সে সহিসের চাবুকটা কিরানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের মেয়েদের নিয়ে ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল। কিরান তাকে এমনকি ধন্যবাদ জানানোর সময় পর্যন্ত পেল না। ‘ওস্তাদ, দুইজনরেই তোলা অইছে।’
কিরান একবার ধেয়ে আসা সৈন্যদের দিকে দেখল তারপর ফিরে তাকাল নিজের লোকদের দিকে। ‘জলদি কর। বেদু, তুই আমার লগে বইবি, তুলারাম তুমি তোমার লোকেগো লইয়া আমি গাড়ি নিয়া আগানোর সময়ে পথ পরিষ্কার করবা। আর বাকিরা। আঘাত করবা…’ সে কথা শেষ করার আগেই একটা গুলি লেগে গাড়িটার চলটা উঠে গেল এক জায়গা থেকে। এখন এই গাড়ির ক্ষতি হলে সর্বনাশ। ‘জলদি জলদি। আমরা সইরা পড়লেই তুমরা ভিড়ের ভেতরে মিশা যাবা,’ আরো একাধিক গুলি এসে লাগল গাড়িটাতে। ঘোড়া দুটো অস্থির হয়ে হ্রেষা ধ্বনি ছাড়তে শুরু করেছে। কিরান লাফিয়ে উঠে বসল গাড়ির সহিসের জায়গার ঠিক পাশেই। নিজের ছোটো বন্দুকটা সে ধরিয়ে দিল বেদুর হাতে। বেদুর একহাতে লাঠি, অন্য হাতে ছোটো বন্দুক। কিরানের একহাতে চাবুক, অন্যহাতে গাড়ি সামলানোর দড়ি। সে পেছন ফিরে দেখল তুলারমের দল লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে গেছে ওদেরকে পথ করে দেয়ার জন্য। গাড়ির পেছনে তোলা হয়েছে অজ্ঞান গোমেজ আর কবি লোকটাকে। ওদেরকে দুদিক থেকে পাহারা দিচ্ছে বৈঠা আর বিল্লাল।
‘হুশশ হুশশ,’ করে শূন্যে চাবুক চালাল কিরান। মুখ দিয়ে হ্রেষা ধ্বনি ছেড়ে লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ঘোড়া দুটো। পেছনে প্রায় লাফিয়ে উঠেল ওরা। ‘আস্তে ওস্তাদ,’ পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল কেউ একজন।
বহু বছর ঘোড়ার গাড়ি চালায়নি। তাই অনভ্যস্ত হাতে কোনোমতে সামলে এগোতে লাগল গাড়িটা। পেছন থেকে হই হই শব্দ ভেসে আসছে সেই সঙ্গে অনেক মানুষের হল্লা। আর ধুমধাম গুলি এসে লাগছে এদিকে সেদিকে। গাড়িটাকে প্রথমে বামে নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে কিরান ধরতে পারল ভুল রাস্তায় চলে এসেছে। কোনোমতে ঘোড়াগুলোকে সামলে আবার ডানে নিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ওদের গাড়িটার দিকে ধেয়ে এলো সৈন্যদের একটা দল। তুলারামের বাহিনীকে রীতিমতো ঢালের মতো দাঁড়িয়ে খণ্ডযুদ্ধ চালাতে দেখল কিরান। খণ্ডযুদ্ধের ভেতরেই কোনোমতে অদক্ষ হাতে সামলে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ও গাড়িটাকে।
এমন সময় এক সৈনিক হাতে তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল কিরান যেদিকে আছে সেদিকে। কিরান দড়ি সামলে কোনোমতে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। মুখের এপাশে ধাম করে এসে লাগল কিছু একটা। আরেকটু হলেই সে ছেড়ে দিচ্ছিল ঘোড়ার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলেও মুখের একপাশ থেকে রক্ত ঝরছে পরিষ্কার টের পেল। পেছনে অনুভব করতে পারল বিল্লাল শেঠ আর বৈঠাও লড়াইয়ে ব্যস্ত। দড়িটাকে একহাতে সামলে কোনোমতে চিৎকার করে উঠল, ‘বেদু।’
ওকে সাহায্য করবে তো দূরে, অন্তত দুজন সৈনিককে সামলাতে ব্যস্ত তখন বেদু। ওরাও ঠিক একইভাবে লাফিয়ে উঠে তাকে চেপে ধরেছে একপাশ থেকে। একজন টেনে ধরেছে তার চুল, আরেকজন তার গলার সঙ্গে ঠেকিয়ে তলোয়ার চালিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। চুলওয়ালাকে কনুই দিয়ে আঘাত করে কোনোমতে তলোয়ার ধরা সৈনিকটার বুকে বন্দুক তাক করে ঘোড়া টেনে দিল সে। তীব্র আলো আর শব্দের ঝলকানির সঙ্গে এক চিৎকার করে লোকটা পড়ে গেল নিচে। অন্য লোকটাকে খানিকটা টেনে এনে ঘুসি মারল সে ওটার মুখে। এই লোকটাও অদৃশ্য হয়ে যেতেই সে ফিরে তাকিয়ে দেখল কিরানকে টেনে ধরে প্রায় নামিয়ে ফেলল আরেকজন সৈনিক। পেছন থেকে বিল্লাল শেঠ নিজের হাতের লাঠি দিয়ে প্রাণপণে বাড়ি মারল লোকটাকে। কিরানকে ছেড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ এক চিৎকার করে পড়ে গেল লোকটা। কোনোমতে নিজেকে সামলে সোজা হলো কিরান। তারপর আবারও পূর্ণ বেগে ঘোড়া ছোটাতে শুরু করল।
‘তুমি ঠিক আছ, ওস্তাদ?’ পাশ থেকে বেদু জানতে চাইল।
কিছু না বলে নিজের মুখের বাম পাশ বেদুর দিকে ফিরিয়ে সে জানতে চাইল, ‘দেখ তো বেশি কেটেছে কি না?’
বেদু হালকাভাবে দেখে বলে উঠল। ‘তেমন না। কিন্তু গালের পাশে কানের নিচে মনে অয় সিলাই লাগতে পারে।’
কিরান কিছু না বলে, আরো জোরে চাবুক চালাতে চালাতে জানতে চাইল,
বৈঠা আর বিল্লাল, ঠিক আছস তোরা?’
‘ঠিক আছি, ওস্তাদ,’ পেছন থেকে জানাল বৈঠা।
‘ভালো কইরা দেখ তো গোমেজ বেশি আহত অইছে কি না?’ ওদের ঘোড়ার গাড়ি বাজার এলাকা ছাড়িয়ে এখন জাহাজ নির্মাণের এলাকার দিকে এগিয়ে চলেছে।
‘কেউ আসে না পিছে। আমরা তো আইলাম তুলারামের লোকেরা ঠিক ঠিক আইতে পারলে অয়,’ বেদু আপনমনেই বলে উঠল। কিরানও একবার পেছন ফিরে বাজারে দিকে ধোঁয়া দেখতে পেল আর আগুন ছাড়া আবছাভাবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
‘ওস্তাদ গোমেজ কান্ধে ব্যথা পাইছে, তেমুন কিছু না।’
‘ঠিক আছে,’ গোমেজকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবছে না ও। কারণ এর চেয়ে আরো অনেক ভয়াবহ আঘাত ওকে অবলীলায় কাটিয়ে উঠতে দেখেছে সে।
কিরান সামনে তাকিয়ে রাস্তাটাকে একবার পরখ করে নিল। ‘সবাই ভালো করে শোন। এখন আমরা আগায়া আসছি আর বাজারেও গণ্ডগোল। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই সন্দ্বীপের কর্তার লোকেরা পিছু নেবে। এর আগেই আমগো দ্বীপ ছাড়তে অইবো। তবে আমি ওগোরে আরেকটু ঘোল খাওয়াইতে চাই। যাতে রঙ্গন আর তুলারাম সময়মতো আইসা পৌছাইতে পারে। আমরা ঘোড়া নিয়া কোন দিকে আগাইছি এইটা ওরা দেখছে। কাজেই ওরা এইদিকেই আইবো। আমি যেইটা করব, আরেকটু আগায়া গাড়িটারে অন্যদিকে চালায়া দেব গাড়ি ওইদিকে আগাইতে থাক, ওরা এই পর্যন্ত আইসা সেদিকে যাইব গাড়ির পিছে। আর এই সুযোগে আমরা পৌঁছাইয়া যাইতে পারব। বোঝা গেছে?’ সবাই সম্মতি জানাতেই কিরান আরো জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে আরো আধ মাইলের মতো এগোল, তারপর গাড়ি থামিয়ে বেদুকে নিয়ে নেমে এলো নিচে।
‘ওই মানুষটাকে আমি কান্ধে নিতাছি, কিন্তু সমস্যা তো গোমেজ,’ বলে সে বেদু বৈঠা আর বিল্লালকে দেখল। ‘এই পাহাড় কে টানবে! ওরে তো তুলতে পারলে ভালো অইতো। যাক গা। বৈঠা আর বিল্লাল ওর দুইপাশে দাঁড়াইয়া কোনোমতে ধইরা জোরে-সোরে আগাইতে থাক। এইখান থাইক্কা আমগো নৌকা বেশি দূরে না। বেদু ওরে নামা। প্রথমে লোকটাকে নামিয়ে বেদুর কাঁধে তুলে দিল কিরান তারপর গোমেজকে চারজনে মিলে টেনে নামিয়ে বৈঠা আর বিল্লালের কাঁধে তুলে দিল। তোরা আগাইতে থাক। আমি গাড়িটার ব্যবস্থা কইরা আসি।’
বলে সে লাফিয়ে উঠে বসেই চাবুক চালাল সাঁই সাঁই করে। ঘোড়া দুটোকে আরো সামনে এগোতেই খনিকটা ঘুরে ওরা যেদিকে যাবে সেই জায়গাটাকে ডানে রেখে উলটোদিকে গাড়িটাকে ধাবিত করল কিরান। গাড়িটার গতি বাড়িয়ে দিল আরো বেশ খানিকটা। যত এগোতে লাগল গাড়ির গতি বাড়াতে লাগল সে। ঘোড়া দুটো যখন পূর্ণ বেগে ছুটতে শুরু করেছে তখন চাবুকটাকে রেখে গাড়ি থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল। কয়েক গড়ান দিয়ে যখন সোজা হলো ততক্ষণে গাড়ি খানিকটা তফাতে সরে গেছে এবং পূর্ণ বেগে ঘোড়া দুটোকে ছুটতে দেখে মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর। এবার এটা ছুটতেই থাকবে সামনে যে পর্যন্ত কোনো বাধা না পায়। আর দ্বীপের সৈনিকেরা এই ওটার পিছু নিয়ে ভুল পথে ধাবিত হবে। এই সময়ের ভেতরেই পালাতে হবে।
খানিকটা দম নিয়ে সে দৌড়াতে শুরু করল। মাইলখানেক দৌড়ে এসে দেখল বেদুরা এগিয়ে চলেছে। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বেদুর কাছ থেকে অজ্ঞান কবিকে নিজের কাঁধে নিয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করল জোর কদমে। ‘জলদি আগাইতে হবে, বলে সে এগিয়ে গেল খানিকটা অন্যদের থেকে। মুখের একপাশে অসম্ভব ব্যথা করছে কাটা জায়গায়। আরো খানিকটা এগিয়ে দূর থেকেই দেখতে পেল ওদের রেখে যাওয়া নৌকাগুলোকে। চলার গতি আরো বাড়িয়ে দিল ওরা। কিরান এগিয়ে গেলেও গোমেজের ভারী দেহটাকে বহন করতে থাকা বাকিরা চাইলেও সহজে এগোতে পারেছে না। আরো খানিকটা এগোতেই নৌকার মাঝিরা এগিয়ে এসে ওদেরকে সাহায্য করল।
‘নৌকাগুলা পানিতে নামাও,’ বলে সে নির্দেশ দিল ওদেরকে। কিছুক্ষণের ভেতরেই মাঝিরা নৌকাগুলোকে টেনে নামিয়ে নিল হাঁটু পানিতে। প্রথমেই গোমেজ আর সেই লোকটাকে নৌকায় তুলে দিয়ে বৈঠা আর বিল্লালকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘তোরা দুজন আগে যা। জাহাজে পৌছাইয়াই গোমেজ আর ওই কবির যত্ন নিতে বলবি। পট্টবর্ধন আর রহমত চাচা ভালো বৈদ্য জানে। ওগোরে কবির দেখভাল করতে বলিস,’ বলে ওদের নৌকায় ওঠার নির্দেশ দিয়ে বাকি দুই নৌকার মাঝিকে নির্দেশ দিল নৌকা প্রস্তুত রাখতে। তারপর বেদুকে নিয়ে চলে এলো তীরের কাছে।
‘দূর থেকে আবছা অন্ধকারের ভেতরে লোকজনকে এগিয়ে আসতে দেখে কিরান নিজের তলোয়ার আর পিস্তলটা বের করে বেদুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘প্রস্তুত থাক, শত্রু না মিত্র জানা নাই। কাজেই সাবধান।’
মানুষগুলো আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল ওদের সর্বাগ্রে দাড়িওয়ালা তুলারামকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তুলারামের সঙ্গে আরো বেশি লোক থাকার কথা। মানুষ কম দেখে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলে সে, কিন্তু তুলারামের সঙ্গেই বন্দুক হাতে গোলন্দাজকে দেখে উদ্বিগ্নতা একটু হলেও কমল। ওরা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে এলেও তাদের সঙ্গে আহত কয়কজনকেও দেখতে পেল। গোলন্দাজ আর তুলারাম কাছে আসতেই কিরান দেখল তুলারামের দলের লোকেদের অবস্থা কাহিল। কাছে গিয়ে তুলারামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। ‘বাকিরা কই?’
তুলারাম আনমনেই মাথা নাড়ল, ‘তিনজন মারা পড়ছে। আর দুইজন সাংঘাতিক আহত।’
‘আগে ওগোরে নিয়া তুমি নাওয়ে ওঠো। পরের নাওতে আমরা আসতাসি,’ বলে সে তুলারামকে এগোতে বলে গোলন্দাজের দিকে ফিরে তাকে আবারও জড়িয়ে ধরল। ‘তুমি সঠিক সময়ে গুলিটা না চালাইলে লোকটারে মনে অয় বাঁচাইতে পারতাম না। কিন্তু ওগোরে পাইলা কই?’
‘আমি তো গুলি চালাইয়াই গাছ থেইকা নাইমা আসছিলাম। কিন্তু তুমগোরে পুরা পাকের ভেতরে রীতিমতো যুদ্ধ করতে দেইখা বুঝতাছিলাম না কী করব। তারপর যখন তুমগো গাড়ি বাজার থেইকা বাইর অইয়া গেলো তখন দেখলাম তুলরামের লোকেরা ভিড়ের ভেতরে মানুষের লগে মিইশা গেল। সুযোগ বুইঝা আমিও আগো লগে মিইশা গেলাম। এইখান থেইকা এখন জলদি কাটতে হবে। কারণ যেকোনো সময় কর্তার লোকেরা আসতে পারে,’ বলে সে কিরানের মুখের ক্ষত দেখল। ‘তুমার তো দেখি অনেক কাইট্টা গেছে।’
‘সমস্যা নাই, চলো,’ বলে কিরান বেদু আর গোলন্দাজ দ্রুত এগোতে লাগল পানি ধরে। হাঁটু পানিতে আসতেই ওরা চড়ে বসল নৌকায়। আধ ঘণ্টার ভেতরে ওদের নৌকা জাহাজের কাছে আসতেই দড়ির জালি নেমে এলো ওদের ওপরে ওঠার জন্য। ওপরে উঠে দেখল পুরো জাহাজ আলোকিত, সবাই উত্তেজিত। সন্দ্বীপে কী হয়েছে খানিকটা শুনেছে সবাই কিন্তু আরো শোনার জন্য অস্থির হয়ে আছে। জাহাজের পাটাতনে পা রাখতেই পট্টবর্ধনসহ অন্যরা কিরানের রক্তাক্ত চেহারা দেখে রীতিমতো হইহই করতে করতে এগিয়ে এলো।
‘আরে করো কী?’ কিরান দেখল ওরা উঠে আসতেই দড়ি বেঁধে নৌকাগুলোকে টেনে তোলা হচ্ছে ওপরে। পট্টবর্ধনের দিকে তাকিয়ে সে নির্দেশ দিল, ‘আগে জাহাজের সব আলো নিভাও। তারপর জলদি নোঙর তোলো। এইখানে এখন এক মুহূর্তও থাকাটা ঠিক না। জলদি জলদি।
কিরানের নির্দেশ পেতেই সবাই কাজে লেগে গেল। জাহাজের বেশিরভাগ আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে নোঙর তুলে চলতে শুরু করল তিনটে জাহাজ। ‘গোমেজ আর কবির যত্ন নেওয়া অইছে?’
পট্টবর্ধন কিরানের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাথা নেড়ে জানাল ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সে জানতে চাইল, ‘সন্দ্বীপে অইলোটা কী?’
কিরান জাহাজে ওর কামরার দিকে এগোতে এগোতে ওখানে কী হয়েছে বিস্তারিত জানাল। ‘এখন মানুষটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সে সত্যই আদৌ কিছু জানে কি না,’ বলে সে মুখ বিকৃত করে উঠল ব্যথার চোটে। ‘যেহেতু সে বাপুর সঙ্গে রোসাঙ্গ থাইক্কা আসছে অবশ্যই সে কিছু বলতে পারবে। তবে তার আগে রহমত চাচারে পাঠাও এইটার যত্ন নিতে হবে,’ বলে সে ফিরে তাকাল জাহাজের রসুইয়ের দরজার দিকে। কালো পোশাক পরা মুখ বাঁধা কালো একটা মূর্তি তীব্র আগ্রহের সঙ্গে দেখছিল ওকে। ও তাকাতেই মাথা নিচু করে বসে গেল সে। রাঁধুনির সহকারী সেই পতিত লোকটা। মানুষটাকে কেমন জানি অদ্ভুত লাগে কিরানের কাছে।
আনমনেই একবার মাথা ঝাঁকিয়ে সে দ্রুত এসে ঢুকল নিজের কামরায়। প্রথমেই পরিচ্ছন্ন হয়ে ক্ষতটার যত্ন নিল যতটা সম্ভব। তারপর সেটাতে পট্টি লাগিয়ে পোশাক বদলে বেরিয়ে এলো জাহাজের পাটাতনে।
সঙ্গে সঙ্গে রহমত চাচা দৌড়ে এলো ওর দিকে। ‘তুমার মুখের অইটা…?’
‘লাগব না চাচা। কবি ঠিক আছে?’
‘হের জ্ঞান ফিরছে। খানা দিছি, খাইতাছে,’ রহমত চাচার দ্রুত জবাব।
‘ঠিক আছে চাচা, আমারে এক বোতল আরক আর এট্টু তামুক আইন্না দেও। আর পট্টবর্ধন চাচারে ডাকো। মানুষটার লগে কথা কইতে হবে,’ এত হাঙ্গামা করে কাকে আনল, কেন আনল, জানতে হবে এবার।
***
কিরান এগোল সেই কামরার দিকে যেখানে মানুষটাকে রাখা হয়েছে।
দুজনে মিলে কামরার ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল বিছানাতে আধ বসা হয়ে আছে মানুষটা। কিরান ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। একেবারেই হালকা-পাতলা শরীর। মুখে ফুরফুরা মোচ-দাড়ি। বেশ গভীর একজোড়া চোখ। যদিও এই মুহূর্তে সেই চোখজোড়ায় ক্লান্তি-ভীতি আর বিহ্বলতা সেটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবুও সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষটার ভেতরের প্রজ্ঞার আঁচ টের পাওয়া যায়।
কিরান আর পট্টবর্ধন ভেতরে প্রবেশ করতেই মুখ তুলে তাকাল মানুষটা। বয়স্ক মানুষটার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে গেছে মানুষটার ওপর দিয়ে। কিরান আর পট্টবর্ধন দুজনেই বিছানার দিকে এগিয়ে গেল কিরান। বসে পড়ল তার শিয়রের পাশে উপবিষ্ট আসনে। তারপর মানুষটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জানতে চাইল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
প্রথমে মানুষটা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। তারপর সেই অবসন্ন মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে হাত নেড়ে জানাল সে ঠিক আছে। কিন্তু মুখে কোনো কথা বলল না। কিরান একবার পট্টবর্ধনের দিকে দেখে নিয়ে মানুষটার হাত থেকে পানির পাত্রটা নিয়ে বিছানার পাশে রেখে দিল। সে আবারও পট্টবর্ধনের দিকে দেখে নিয়ে মানুষটার দিকে ফিরে তাকাল। আসলে কীভাবে কথা শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ‘আপনি আমার বাবাকে চিনতেন?’
‘বাবা!’ এই প্রথমবারের মতো বলে উঠল মানুষটা। ‘কোনো-না-কোনোভাবে তুমি কী তালেব তৈমূরের ছেলে?’ মানুষটার কণ্ঠস্বর বয়সের সঙ্গে একেবারেই যায় না। চেহারা না দেখে এই মানুষটার গলা শুনলে মনে হতো কোনো যুবক কথা বলছে। শান্ত সুরেলা কণ্ঠস্বর যেন কবিতা পড়ছে এমন শোনায়।
‘জি, আমি তালেব তৈমূরের ছেলে তালেব কিরান,’ কথাটা কিরানের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হতেই মানুষটার মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠল। কিরান খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মানুষটার মুখের দিকে।
‘তুমি কী জানো তোমার বাবা কী পরিমাণ বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন?’ বলে সে আপনাতেই সামান্য মাথা নাড়ল। ‘আমার ভাগ্য যে, তোমার বাপের মতো মানুষকে আমি অল্প সময়ের জন্য হলেও বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম। এরকম মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যেকোনো মানুষের জন্যই সৌভাগ্যের।’
মানুষটার কথা শুনে কিরানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আর এই মানুষটার কাছ থেকেই কিনা সে জীবনের বেশিরভাগ সময় পালিয়ে বেড়িয়েছে।
‘আমি হাসছিলাম। কারণ, যেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম কেউ না কেউ আমাকে ফাঁসি থেকে বাঁচাতে এসেছে আমি বুঝলাম যে, সেটা হয় তৈমূর নিজে আর না হয় তার ছেলে।
‘আপনাকে ফাঁসি দিতে চাইছিল কেন তারা?’ এবার পট্টবর্ধন জানতে চাইল।
মানুষটা পট্টবর্ধনের দিকে ফিরে তাকাল। ‘সেটা বোঝাতে হলে আরো অনেককিছু জানাতে হবে তোমাদের। কিন্তু তার আগে আমাকে খানিকটা সিরাজি পান করাতে পারবে?’
‘অবশ্যই,’ বলে কিরান দরজার বাইরে থাকা লস্কর ছেলেটাকে ডেকে সিরাজি আনতে বলল। যদি কিছু মনে না করেন আপনার পরিচয়টা জানা হয়নি। আমরা এটুকু জানি আপনি একজন কবি। কিন্তু…’
‘আমার নাম আলাওল, সৈয়দ আলাওল,’ মানুষটা অবসন্ন গলায় বলে উঠল
সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকাল কিরান। আর এক পা সামনে এগিয়ে এলো পট্টবর্ধন। আপনি কবি আলাওল? মানে আরাকানের রাজসভার সভা কবি আলাওল। পদ্মাবতীর আলাওল?’ অনেকগুলো প্রশ্ন করে সে কিরানের দিকে ফিরে তাকাল একবার।
মৃদু হাসিমুখে মানুষটা বলে উঠল। ‘হ্যাঁ, আমিই আরাকানের রাজসভার কবি আলাওল। আমিই পদ্মাবতীর…’ এইটুকু বলতেই লস্কর ছেলেটা দৌড়ে এসে একটা সিরাজির বোতল আর তিনটে গেলাস দিয়ে গেল। মানুষটা গেলাসে না ঢেলে সোজা বোতল মুখে লাগিয়ে তাতে চুমুক দিল। টানা কয়েকটা চুমুক দিয়ে সে ফিরে তাকাল কিরানের দিকে। ‘তোমরা হয়তো মনে মনে ভাবছো আরাকানের রাজসভার কবির সঙ্গে তৈমূরের আবার সম্পর্ক কী? আর তাকেই বা কেন তোমাদের সন্দ্বীপের শাসনকর্তার ফাঁসির মঞ্চ থেকে উদ্ধার করে আনতে হলো,’ বলে সে আবার চমুক দিল বোতলে, তারপর আবারও বলে উঠল।
‘তাহলে শুরু থেকেই শুরু করি। তোমরা জানো কী না জানি না, আমি আরাকানের মানুষ নই। আমার জন্ম এই বঙ্গদেশে। ফরিদপুরর ফতেহাবাদে জন্ম আমার। ষোলো বছর বয়সের সময়ে বাবার সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়ে আমি আর আমার বাবা দাস ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যাই আরাকানে। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর,’ মানুষটা বলে চলেছে আর দৃষ্টি চলে গেছে বহুদূরে, সেটা সিরাজির প্রভাবে, নাকি নিজের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সেটা বোঝা গেল না। ‘তো আরাকানের গল্প অনেক লম্বা। সেই গল্প তোমাদের শোনাব না। কারণ তোমরা জানতে চাইছো ভিন্ন গল্প। তো এটুকু বলি আমি আরাকানের রাজসভাতে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিলাম। কিন্তু বর্তমান রাজার সময়ে সেই ভালো অবস্থা আর আগের মতো নেই। কারণ বর্তমান রাজা আর তার লোকেরা একদিকে যেমন অমানুষ অন্য দিকে তেমনি স্থুল বুদ্ধির মানুষ। এদের শুধু চাই অর্থ, মেয়েমানুষ আর অকারণ দুঃশাসন।
‘তো যাই হোক, আমার দিনকাল যথারীতি কাটছিল। এর মধ্যেই বঙ্গদেশে আর ভারতবর্ষের তক্তপোশে যা ঘটছিল সেটার আঁচ আমরা আরাকানেও টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটার আঁচ সরাসরি টের পাই যখন মোঘল রাজপুত্র বাঙ্গাল মুলুকের প্রাক্তন সুবাদার সম্রাট শাহ সুজা তার যুদ্ধে হেরে আরাকানে গিয়ে আশ্রয় নিল। আরাকানের রাজা তাকে বেশ ভালোভাবে আমন্ত্রণ জানাল। আমরা ভেতরে ভেতরে জানতাম যে, রাজার নজর শাহ সুজার সুন্দরী কন্যা আর তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদের দিকে। আর এইসব ব্যাপারে শাহ সুজা খুব বেখেয়ালি ধরনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তোমার বাবা মানে তৈমূর তাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু শাহ সুজা সেটা শোনেননি। আমি এসবই জানতাম কারণ শাহ সুজার আরাকানে অবস্থানের প্রথম দিন থেকেই তার সঙ্গে আমার গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব। সময় আর সামাজিকতার বাঁধনকে ছিন্ন করে স্রেফ বয়স আর প্রজ্ঞার বন্ধন তিনজন মানুষকে কতটা কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে তারই সবচেয়ে সেরা উদাহরণ ছিল সম্রাট সুজা, তোমার বাবা আর আমার বন্ধুত্ব,’ এই পর্যন্ত বলে মহাকবি আলাওল একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস ছাড়ল। ‘কে জানত এই বন্ধুত্ব এতটা সংক্ষিপ্ত হবে। আমরা সবাই জানতাম রাজা ওপরে ওপরে যতই খাতির জমাক না কেন আর আপ্যায়নের বাহানা দেখাক না কেন ভেতরে ভেতরে সে সাংঘাতিক কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু সেটা যে এত দ্রুত করে ফেলবে আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারিনি। সম্রাটকে বলা হয়েছিল মক্কা রওনা দেয়ার জন্য তাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। এমন সময় হঠাৎই একদিন রাতে সম্রাটের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ভাগ্যক্রমে সেদিন রাতে আমি সম্রাটের বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম। সব তছনছ হওয়ার পরও যে দলটা সামান্যতম হলেও ম্রোহঙের পাশের জঙ্গলে অবস্থান নিতে পেরেছিল আমিও সে- দলেই ছিলাম। সেদিন রাতে তোমার বাবার পরামর্শেই অল্প কিছু লোকজন নিয়ে আমরা সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম সেই জঙ্গলে। এরপরে সেখানেও আক্রমণ হয়। কিন্তু তার আগেই সম্রাটের সঙ্গে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রায় পুরোটাই নিয়ে তোমার বাবা তার খুব কাছের কিছু মানুষ আর আমি সরে পড়তে পারি। সম্রাটের জন্য সরে পড়ার সুযোগ ছিল কিন্তু সে নিজের লোকদের সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সম্রাটের বক্তব্য ছিল, যদি তারা তাকে এই জঙ্গলে খুঁজে পায় তবে তারা অন্যদিকে নজর দেবে কম। এই সুযোগে তার বিরাট সম্পদ তৈমূরের পক্ষে নিয়ে সরে পড়াটা সম্ভব হলেও হতে পারে। পরবর্তীতে আসলে হয়েছেও তাই। সম্রাটের শেষ ইচ্ছে ছিল বিপুল সম্পদ যেন কিছুতেই আরাকানি আর মগদের হাতে না পড়ে। যেভাবেই হোক এই সম্পদ যেন বঙ্গদেশের মানুষদের কাছে পৌঁছায়, এই সম্পদ যেন এই দেশের মানুষের কাজে লাগে,’ কিরান দেখলে শেষ কথাটা বলার সময়ে মানুষটার চোখের কম্পনরত পাতা সামান্য যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।
‘আমার নিজের জন্ম এই বঙ্গদেশে কিন্তু কোনোদিন এই বঙ্গদেশের জন্য আমি কিছু করতে পারিনি। এমনকি দূরদেশে থাকতে থাকতে এই বঙ্গদেশের ভূমি মানুষ আর ভালোবাসা সবই ভুলতে বসেছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হতো এই বঙ্গদেশ যেন আমার জন্য দূরের কোনো স্বপ্ন। কিন্তু আমার সেই স্বপ্নকে আবারও আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল তোমার বাবা আর সম্রাট সুজা। আমি জানি সম্রাট সুজাও আর দশজন সম্রাটের মতোই কলঙ্কমুক্ত নয়। কিন্তু তার যে ব্যাপারটা তোমার বাবা কিংবা আমি অসম্ভব পছন্দ করতাম সেটা হলো, এই বঙ্গভূমির প্রতি তার নিখাদ ভালোবাসা। তুমি বিগত শত বছরের ইতিহাস বিবেচনা করে দেখো এই ভূমিতে যারাই এসেছে সুজলা এই ভূমিকে শুধু ব্যবহারই করেছে, ধর্ষণ করছে বেনিয়ার মতো। সাধারণ মানুষের কথা কেউই ভাবেনি, উন্নয়ন তো দূরে থাক। শুধু লুটপাট করেছে। কিন্তু এই একজন মানুষ সেটা করেছে। একমাত্র তার সুবাদারির সময়েই সবচেয়ে সুখে ছিল, শান্তিতে ছিল এই মুলুকের মানুষ। দক্ষিণ উপকূলের এই দস্যুদের অত্যাচার বাদ দিলে এই মুলুকের মানুষ বিগত বহু বছরে এতটা ভালো আর কখনই ছিল না। এ-কারণেই সম্রাটেরও শেষ ইচ্ছে ছিল মোঘলদের সম্পদের যে বিরাট ভাণ্ডার ছিল সেটা যেন এই বাঙ্গাল মুলুকের মানুষের কাজে লাগে।’
মানুষটা এই পর্যন্ত বলতেই কিরান বলে উঠল, ‘এরপর কী হলো? সম্রাট মারা পড়লেন সেই জঙ্গলে আর আপনারা সরে পড়লেন সেখান থেকে। এরপর বাবার কী হলো, সেই সম্পদ কোথায় আর আপনিই বা সন্দ্বীপে আটকা পড়লেন কীভাবে?’
‘বলছি,’ বৃদ্ধ মানুষটা এত ধকলের পর হাঁপিয়ে উঠেছেন। সিরাজির বোতলে আরেকটা চুমুক দিয়ে সে আবারও বলতে শুরু করল। ‘আমরা ম্রোহঙের কাছের সেই জঙ্গল থেকে চারটা নৌকায় করে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসি আগে থেকে ঠিক করে রাখা জাহাজে। ছোটো এই জাহাজটাতে করেই তোমার বাবা আরাকান থেকে চট্টগ্রামে এসেছিল কাজ সারতে। তারপর কাজ সেরে সে এটাতে করেই ফিরে গেছিল আরাকানে। ইচ্ছে করেই সে জাহাজকে বন্দরের কাছে নিয়ে যায়নি। কারণ একমাত্র তোমার বাবাই বিপদের আঁচ করতে পারছিল। তো যাই হোক, আমরা মাঝরাতের দিকে জাহাজে পৌঁছাই। জাহাজে পৌঁছে সঙ্গে নিয়ে আসা পিপেগুলো তুলতে তুলতে প্রায় ভোর রাত হয়ে যায়। সকালের জোয়ারে আমরা জাহাজ ছেড়ে দেই। পরে খবর পেয়েছি সকাল হতেই পুরো দক্ষিণের এলাকা আরাকানের নৌবাহিনী, মগ দস্যু আর পর্তুগিজদের সহায়তায় বের দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। কিন্তু ওরা বের দেয়ার আগেই আমরা বেরিয়ে যাই। পরে আরো জানতে পেরেছি যে, জলপথগুলো ঘিরে ফেলেই ওরা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে যদি ম্রোহং থেকে কেউ পালিয়ে গিয়েও থাকে তবে তারা অবশ্যই ওদের ঘেরের ভেতরে আটকা পড়েছে। কিন্তু আমরা যে আগেই জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে গেছি এটা ওরা বুঝে পারেনি।’
‘তাহলে আপনারা জাহাজ নিয়ে সরাসরি চট্টগ্রামে চলে আসেননি কেন?’ পট্টবর্ধন জানতে চাইল। সে হাতে তামাক বের করে রেখেছে। কিন্তু কবির সামনে সেটা ধরাবে কিনা বুঝতে পারছে না।
‘এখানে আমাদের কপাল খারাপ ছিল। আমরা জাহাজ নিয়ে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ঘুর পথে ওদের চোখ এড়িয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এরই মাঝপথে আমাদের জাহাজে সমস্যা দেখা দেয়। সেটা ঠিক করতে একদিন লেগে যায়। কিন্তু সেটা ঠিক করার পরও খুব একটা কাজে দেয়নি। জাহাজ চট্টগ্রামে পৌছানোর অবস্থায় আনতে পারিনি তো আমরা। তখন তৈমূর সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রামে না গিয়ে ওখান থেকে তুলনামূলক কাছে সন্দ্বীপে যাবে। কারণ একমাত্র সন্দ্বীপে গেলেই জাহাজও মেরামত করা সম্ভব হবে, সেই সঙ্গে তার পরিচিত এবং নিজের মানুষদের কাছে সে খবর পাঠাতে পারবে।’
‘কিন্তু সন্দ্বীপে পৌঁছানোর একটা বড়ো ঝুঁকি ছিল নিজেদের লুকিয়ে রাখা। কারণ সন্দ্বীপ এতটাই ব্যস্ত এলাকা যে চাইলেই ওখানে লুকিয়ে থাকাটা খুব সহজ নয়। কিন্তু আমরা সেটা পেরেছিলাম। কারণ সন্দ্বীপে তৈমূরের অনেক অনেক বন্ধু ছিল। তারা সবাই আমাদের সহায়তা করে। আমাদের জাহাজ মেরামতির জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন ছিল। সেই সময়ে আমরা সন্দ্বীপেই অবস্থান করি। এই সময়েই সে চট্টগ্রামে আকরাম বেগকে খবর পাঠায় নিদের্শনা জানিয়ে। সে-ই ওখান থেকে বলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা দল নিয়ে ওদের সাহায্য করার জন্য পৌঁছাতে। কিন্তু ওখানে সরাসরি আমরা কোথায় আছি বলা হয়নি। কারণ এতে সরাসরি শত্রুর হাতে খবর চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে সে দস্যু পদ্মের দলকে খবর দেয় নিজেদের নিরাপত্তা সেই সঙ্গে পালানোর পথ করার জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য এবং তোমাদের সন্দ্বীপ পৌছানোর জন্য আরেকটু সময় দরকার ছিল আমাদের। কিন্তু গতকাল দুপুরেই আমরা খবর পাই সিলভেরা তার দল নিয়ে সন্দ্বীপ পৌঁছে যাবে যেকোনো সময়ে। এই সময়ে তৈমূর আর দ্বীপে থাকার সাহস পায়নি। সে দ্রুত নিজের লোকজনকে নিয়ে জাহাজ প্রস্তুত করে সরে পড়ে। আমাকে রেখে যায় যাতে করে তোমরা পৌঁছালে আমি তোমাদের জানাতে পারি সে কোন দিকে গেছে। কারণ অন্য কারো ওপরে সে ভরসা করতে পারছিল না। কিন্তু সেটা হওয়ার আগেই আমি ওদের হাতে বন্দি হই।’
‘তারমানে আপনি জানেন বাবা কোন দিকে গেছেন…’ কিরান চূড়ান্ত কৌতূহলের সঙ্গে জানতে চাইল। এতদিনে সে বাবার সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছানোর মতো অবস্থায় এসেছে। একটা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে জানতে পারছে ওর বাবা কোথায় যাবে। এবার হয়তো সময় এসেছে। বাবার কাছাকাছি পৌঁছে সরাসরি তাকে সাহায্য করতে পারবে সে। সেই সঙ্গে সিলভেরার মুখোমুখি হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু সেটা গৌণ মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার কাছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে বাবাকে সাহায্য করা।
‘হ্যাঁ আমি জানি। তবে সেটা পরে বলছি,’ মহাকবি আলাওল পট্টবর্ধনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কিরানের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আমি আগে বলে নিই কীভাবে ধরা পড়লাম আমি এবং কেন আমাকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করছিল তারা। ব্যাপারটা জানা তোমাদের জন্যও জরুরি। তো সিলভেরার আগমনের খবর পেয়ে তৈমূর নিজের লোকদেরকে নিয়ে দ্রুত জাহাজ সাজানো শুরু করে। স্বল্পতম সময়ের ভেতরে সে যা পারে, যেভাবে পারে সাজিয়ে নিয়ে বিকেলের জোয়ার ধরার জন্য জাহাজ নামিয়ে দেয়। কিন্তু এটা করতে গিয়ে নিজের দুজন লোককে সে ভুল করে ফেলে দিয়ে সন্দ্বীপেই রেখে চলে যায়। ফলে যাদের রেখে চলে যায় সে ওরা দীর্ঘক্ষণ বন্ধুর অপেক্ষা করে ফিরতি পথ ধরে। কিন্তু ততক্ষণে বন্দরে জাহাজ চলে এসেছে, সিলভেরা, তার সঙ্গে সমন্বিত মগ দস্যুদের একটা দল। যারা সরাসরি আরাকান থেকে এসেছে। তৈমূরের লোকটা যখন বন্দরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে ফিরতি পথ ধরে আরাকান থেকে মগদলের একজন পিছু নেয় তার। লোকটা কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝতে না পেরে সে হাম্মামখানার দিকে রওনা দেয় যেখানে তৈমূর আমাকে রেখে গেছে। তার পিছু নিয়ে সেখানে চলে আসে মগদের একটা দল। তারাই লোকটাকে হত্যা করে, সেই সঙ্গে হাম্মামখানার মালিককেও হত্যা করে। হত্যার আগে লোকটাকে নির্যাতন করে জেনে নেয় কোথায় আছে, কোন দিকে গেছে তৈমূরের জাহাজ। সেখান থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দ্বীপের শাসনকর্তার দপ্তরে।’
‘আপনাকে ওরা মারতে চাইছিল কেন?’ পট্টবর্ধন জানতে চাইল। এতক্ষণে সে ধোঁয়ার শলাকাটা ধরিয়ে টান দিতে শুরু করেছে ওটাতে। ‘ওদের যা জানার তা তো জেনেই গেছিল।’
‘ওই লোকটাকে হত্যার পর একমাত্র আমিই জানতাম কোন দিকে গেছে তৈমূর আর সিলভেরা। তাই আমাকে সরানো প্রয়োজন ছিল। তাই দ্বীপের শাসনকর্তা কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তবে আমাকে ওভাবে আয়োজন করে ফাঁসি দেয়ার পেছনে আরেকটা কারণ ছিল,’ বলে সে একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস ছাড়ল। ‘অনেকদিন যাবৎ দ্বীপের লোকজন মানসিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল শাসনকর্তার ওপরে। তার ওপরে শাহ সুজার মৃত্যু, মগদের অতিরিক্ত আসা যাওয়া এমনকি ব্যবসাতেও প্রভাব সৃষ্টি করছিল। তাই শাসনকর্তা এই সুযোগে আমাকে ফাঁসি দিয়ে একদিকে লোকজনকে একটা উত্তেজনার স্বাদ পাইয়ে দিতে চাইছিল সেই সঙ্গে সে এটার মাধ্যমে লোকজনকে খানিকটা সবকও শেখাতে চাইছিল যে তার সঙ্গে শত্রুতার পরিণতি কী হতে পারে।’
‘বাবা কোন দিকে গেছে?’ কিরান অনেকটা আপনমনে বলে উঠল। অন্য কোনো দিকে তার মনোযাগ নেই। ‘সিলভেরা কখন সেই পথে রওনা দিয়েছে?’
কিন্তু মহকবি কিরানের প্রশ্নের জবাব দিল না। বরং পট্টবর্ধনের থেকে সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল কিরানের ওপরে। তার চোখের গভীরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। ‘তুমি কী তোমার সব লোকদের বিশ্বাস করো বালক? তার গলায় কোনো ভাব নেই।
‘এমনকি নিজের চেয়েও বেশি,’ কিরানের জবাবে কোনো দ্বিধা নেই।
‘তুমি কী প্রস্তুত বালক?
‘এই মুহূর্তে সেই বিলাসিতার কী সুযোগ আছে আর?’ মৃদু হেসে বলে উঠল কিরান। ‘তবে এটা বলতে পারি এই দক্ষিণের সমুদ্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবহর আমার হাতে।’ আপনাতেই ডান হাতে সে বুকের লকেটটা চেপে ধরে মনে মনে বলে উঠল, বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল।
‘বালক, তুমি যা করতে চাইছো সেটা করতে হলে শুধু শক্তি আর সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশি কিছু লাগবে…’ বলে সে একটু থেমে আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আমি হয়তো অনেক বেশি চিন্তা করছি,’ বলেই সে খানিকটা এগিয়ে এসে কিরানের হাত ধরে ফেলল। ‘তোমার বাবা তোমার ওপরে অসম্ভব বিশ্বাস করত। তোমার বাবা সন্দ্বীপ থেকে সপ্তগ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে। কিন্তু ওখানে সে নিয়মিত সমুদ্রের পথে যাবে না। বরং সন্দ্বীপ থেকে খানিকটা উত্তর পশ্চিম দিকে জংলাটিলার দিকে রওনা দিয়েছে। সেখানেই তার পরবর্তী অবস্থান। এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
কিরান দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল মানুষটার আকুতিভরা চোখের দিকে। তারপর মুঠোয় ধরা মানুষটার হাতে আশ্বাসের মৃদু চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর পট্টবর্ধনের দিকে ফিরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
‘সবাইরে একসঙ্গে ডাকো, যুদ্ধের ঘোষণা চইলা আসছে।’