মগরাজ – ৩০

অধ্যায় ত্রিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

সন্দ্বীপ, দক্ষিণ উপকূল এলাকা, চট্টগ্রাম

সামনের পাকা বাড়িটার আঙিনাতে বেশ অস্বস্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে কিরান। আশেপাশে সাজগোজ করা নানা ধরনের মেয়ে মানুষের মেলা বসেছে যেন। সেই সঙ্গে খদ্দেরেরও কোনো অভাব নেই। মেয়ে যেমন আছে নানা বর্ণের, নানা ধরনের, নানা রঙের ঠিক তেমনি আছে নানা ধরনের, নানা বর্ণের আর নানা পদের খদ্দের। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে কিরান আরো একবার চারিদিকে তাকাল। এই ব্যাটা ওকে এখানে কেন নিয়ে এলো কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে। কিরান দেখল ওর সঙ্গে লাঠিয়াল ভিখু আর মধুও একইরকম অস্বস্তির সঙ্গে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু ফিরান অত্যন্ত অবাক হয়ে খেয়াল করল, গোমেজ বেশ হাসি আনন্দের সঙ্গে চারিদিকে দেখছে। আশেপাশে ঘুরতে থাকা মেয়েদের সঙ্গে বেশ হাসিমুখে এটা- সেটা ইশারা করছে আর সেই সঙ্গে হাত নাড়ছে। কিরান মৃদু স্বরে গোমেজকে ধমক লাগাল। কিন্তু গোমেজের কোনো বিকার নেই।

কিরান অনুধাবন করতে পারছে এখানে অকারণে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। হয় ওদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে, আর না হয় ভেতরে ঢুকতে হবে। হাতের মুঠোয় আকরাম বেগের দেওয়া চামড়ার থলেটা চেপে ধরে সে চাপদাড়ি ভিখুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ভিখু, আমরা ভেতরে ঢুকব। সাবধানে থাকিস।’

‘হুজুর, ভেতরে,’ বলে সে একবার অস্বস্তির সঙ্গে কিরানকে দেখল তারপর ফিরে তাকাল তার সঙ্গী মধুর দিকে। হুজুর, আপনে নিশ্চিত এইখানে আইতে কইছে আকরাম বেগ হুজুরে?’

কিরান একটু রাগের সঙ্গেই ফিরে তাকাল ভিখুর দিকে। ‘সবকিছু তো তোগো চোখের সামনেই অইলো। দেখলিই তো। আকরাম চাচা যার কাছে পাঠাইছো, তার কাছেই গেলাম। আর হের লুকেরাই তো এইখানে দিয়া গেল আমগো। চল,’ বল দুরুদুরু বুকে ভেতরের দিকে ইশারা করল সে। এই পতিতালয়ে এলেও একটা ব্যাপার ভেবে স্বস্তি লাগছে যে, এটা ওর পরিচিত এলাকার বাইরে। এখানে অন্তত ওর পরিচিত কেউ দেখতে পাবে না। চট্টগ্রাম কিংবা রামু অথবা রাউজানে হলে কেউ দেখে ফেললে মান-ইজ্জত আর কিছু থাকত না। কিরান গোমেজকে একহাতে ধরে ভেতরের দিকে হাঁটা দিল। পাকা বাড়িটার বাইরে থেকে যতটা ছোটো মনে হচ্ছিল ভেতরে ঢুকে কিরান অবাক হয়ে খেয়াল করল, ভেতরটা আরো অনেক বড়ো। ভেতরে একটা গোল আঙিনার মতো। সেটাকে ঘিরে ছোটো ছোটো খোপের মতো ঘর। গোল হয়ে ঘিরে থাকা আঙিনাটাতে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, কথাবার্তা বলছে আর খদ্দেরদের সঙ্গে বনিবনা হয়ে গলে গিয়ে ঢুকে পড়ছে কোনো না কোনো খোপের ভেতরে। কিরান আরো অবাক হয়ে দেখল এখানে সাদা চামড়া আর বিদেশি খদ্দেরই বেশি।

‘এইখানে কেউ বুঝি বেটাগো হাত ধরার লাইগ্গা আসে?’ কিরান আঙিনাটাতে চোখ বুলাচ্ছিলো পেছন থেকে একটা নারী গলা সহাস্যে বলে উঠল। তার সঙ্গে গলা মেলাল একাধিক নারী কণ্ঠস্বর। কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল লাল রংচঙে পোশাক পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আরো দু-তিনজন। নিজের বন্ধুর হাতই ধরাবা, তাইলে ইয়ানে আইছো ক্যান?’ আবারও সহাস্যে বলে উঠল সে। তার পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল। মরদে মনে অয় ডরাইতাছে,’ আরেক দফা হাসির হুল্লোড় উঠল।

কিরান অস্বস্তির সঙ্গে গোমেজের হাত ছেড়ে দিল। সে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই পেছন থেকে রুক্ষ গলার স্বর শুনে চমকে উঠল সবাই। ‘এই বান্দির দলেরা কী করতাছে ইহানে?’ কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল অতিরিক্ত সাজগোজ করা নারী দেহের ওপরে পুরুষ একটা মুখমণ্ডল থেকে গলার স্বরটা বেরিয়ে আসছে। কিরান অবাক হয়ে দেখল একটা হিজড়া। হিজড়াটার ধমক খেয়ে মেয়েগুলো সরে গেল। হিজড়াটা হাসি মুখে এগিয়ে এলো কিরানদের দিকে।

‘আরে, হুজুর, আদাব,’ বলে সে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রায় কুর্নিশ করে উঠল। হুজুর, ভেতরে না আইলে ক্যামনে খিদমদ করব কহেন।’

কিরানের পোশাক-আশাক আর ওর সঙ্গে আসা লাঠিয়ালদের দেখে সে তাকে বড়ো কোনো ব্যবসায়ী ভেবেছে। কিরান তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কঠিন স্বরেই বলে উঠল, ‘আমি আছিয়া নামে একজনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

আছিয়া নামটা শুনে হিজড়াটার মুখের হাসি এক মুহূর্তের জন্য মলিন হয়েও আবার ফিরে এলো সেটা। ‘হুজুর আছিয়া ক্যান, জমেলা, ফাতেহা যারে চান তার লগে মোলাকাত করানো যাবে। আগে আসেন, একটু গলা ভিজান তারপর,’ বলে সে কিরানের একটা হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এলো। কিরান ঝট করে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ‘আমি তোমগো খদ্দের না। এক্ষণ আমারে আছিয়ার কাছে নিয়া চলো, আমি মজাক করতাছি না।’ কিরান কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে হিজড়াটার দিকে। হিজড়াটা কিরানের ধমক খেয়ে বিগলিত দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিল হঠাৎ তার দৃষ্টিটা পরিবর্তন হয়ে প্রায় একইরকম কঠিন হয়ে উঠল।

‘জাহাজি, মনে রাইখো বাড়ি থেইকা অনেক দূরে আছ তুমি,’ বলে সে লাঠিয়াল আর গোমেজকে দেখাল। ‘এইখানে গরম দেখায়া কেউ পার পায় না। আছিয়া এই পাড়ার প্রধান, চাইলেই হের লগে দেখা করা যায় না। হেরে তুমার কী দরকার?

কিরান নিজের দুইহাত তুলল। ‘আমি এইহানে ঝামেলা পাকাইতে আসি নাই। আমি কামে আসছি। আমি আছিয়ারে দরকারেই খুঁজতাছি,’ বলে সে হাতের মুঠোয় থাকা থলে থেকে গোল করে রাখা চামড়ার টুকরোটা ধরিয়ে দিল হিজড়াটার হাতে। কিরানের দিকে একইরকম কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে জিনিসটা হাতে নিয়ে খুলে ফেলল। সে এখনো তাকিয়ে আছে কিরানের দিকেই, ওটা খুলে তাকাতেই মুহূর্তের জন্য সে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে। তারপর তার দৃষ্টি পরিবর্তন হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। চট করে জিনিসটা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেলল সে, তারপর আশেপাশে দেখল। সর্দার কী মরার তাল করছো? আসো আমার সঙ্গে,’ বলে সে একরকম তড়িঘড়ি করে রওনা দিল ভেতরের দিকে। কিরান একবার লাঠিয়াল দুজনকে দেখে নিয়ে গোমেজকে ওর পিছু আসতে বলে রওনা দিল হিজড়াটার পিছু পিছু। হিজড়া ওদেরকে নিয়ে আঙিনা পার হয়ে চলে এলো বাড়িটার পেছন দিকে।

কিরান দেখল বাড়িটার এদিকটা আরো অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। এদিকটা আসলে নাচঘর আর উচ্চ বিত্ত খরিদ্দারদের জন্য। হিজড়াটা এগিয়েই চলেছে, কিরান পেছন থেকে একটা প্রশ্ন করতে চাইছিল কিন্তু সে পিছু ফিরে কিরানকে চুপ থাকতে বলল। তারপর ওদেরকে নিয়ে বাড়ির পেছনের অংশটা ঘুরে চলে এলো একেবারে পেছন দিকে। নিচে নাচঘর থেকে মানুষের উচ্চকিত স্বর ঘুঙরুর শব্দ আর গানের আওয়াজ ভেসে এলো। ওটার একপাশে কিরান লোহার মইয়ের মতো লাগানো। দেখল হিজড়াটা সেটা দিয়ে উঠতে শুরু করল। কিরানও পিছু নিল। ওরা ওপরে উঠে আসতেই দেখল নিচের ঘরের ওপরে ছোটো একটা কামরার মতো বানানো। সেটার সামনে পালোয়ানের মতো একজন লোক বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কিরানরা এগিয়ে যেতেই সে বল্লমটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে ওদেরকে উঠতে মানা করার জন্য হাত বাড়াতে যাচ্ছিল কিন্তু হিজড়াটা তাকে মানা করল। তারপর কিরানের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আইসো সর্দার। আছিয়া বানু এইখানেই আছে। সাবধানে কথা কইবা,’ বলে সে চামড়ার জিনিসটা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার ঠিক পেছনেই ঢুকে গেল কিরান। ভেতরে ঢুকে দেখল ভেতরের কামরাটা বেশ রঙিন আর আলোতে ভরপুর। কামরার ভেতরে এখানে ওখানে ঝুলছে নানা ধরনের রঙিন ঝালর আর রঙিন কাচ আর পুতির কারুকাজ করা দেয়াল চিত্র। রুমের একপাশে একটা লম্বা বিছানার মতো পাতা শতরঞ্জি আর সামনের দুপাশে গদিটা লম্বা জলচৌকিতে বসার ব্যবস্থা। প্রতিটা শতরঞ্জি আর জলচৌকির সামনে সুরাপাত্র আর গড়গড়ার ব্যবস্থা রাখা আছে।

যদিও কামরায় এই মুহূর্তে তেমন কেউই নেই কিন্তু বিছানার মতো বসার জায়গাটাতে রঙিন ঘাগড়া আর এক বস্তা অলংকার পরা এক মহিলা বসে আছে। মহিলার এক হাতে গড়গড়ার নল, অন্যহাতে কিরানের নিয়ে আসা সেই চামড়ার জিনিসটা। তার কানের কাছে হিজড়াটা ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে। মহিলার মুখ পানের রসে লাল হয়ে আছে। কিরানরা ভেতরে ঢুকতেই মহিলার পেছন থেকে দুজন মুশকো পালোয়ানের মতো দেখতে লোক সামনের দিকে এগিয়ে এসে দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল। কিরান কামরায় ঢুকে প্রথম এদের দেখেনি কারণ সম্ভবত এরা অন্ধকারের ভেতরে ছিল।

মহিলা ওদেরকে দেখেও দেখল না যেন। হিজড়াটা কথা শেষ হতেই সে কানে-কানে হিজড়াটাকে কিছু বলল। হিজড়াটা তাকে কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল। হিজড়াটা বেরিয়ে যেতেই মহিলা খানিকটা এগিয়ে এলো। কিরান দেখল মহিলার বয়স ষাটের কম না, টকটকে ফরসা গায়ের রং আর টিকালো নাক দেখে বোঝা যায় মহিলা একসময় দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল। সে সন্দেহের দৃষ্টিতে চামড়ার জিনিসটাতে আরেকবার চোখ বুলাল তারপর কিরানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি সর্দার তৈমূরের পোলা?’ মহিলাকে না দেখে চট করে যদি কেউ তার গলা শোনে তবে ভাবতে পারে কোনো পুরুষের গলা শুনছে।

কিরান এক পা সামনে এগিয়ে গেল। ‘জি,আমি…’

‘তুমার বাপের লগে তো দেহি চেহারার কোনো মিলই নাই,’ মহিলার গলা শুনে বোঝা যাচ্ছে সে তালেব তৈমূরকে খুবই ভালোভাবে জানত। এতে করে কিরান কী খুশি হবে না বেজার হবে ঠিক বুঝতে পারল না। একটা গণিকালয়ের প্রধানের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কে খুশি হওয়া উচিত কিনা কিরান জানে না। আমি তার পালক সন্তান ছিলাম,’ দৃঢ় গলায় বলে উঠল কিরান। ‘আপনি…’

‘বসো,’ বলে সে কিরান আর ওর পেছনের সবাইকে নির্দেশ করল। তুমি আবার খারাপ কিছু ভাইবো না। তুমার বাপেরে আমি বড়ো ভাইয়ের মতো সম্মান করতাম। হেয় না থাকলে…যাগ্গা। তুমারে এইডা কে দিসে?’ বলে সে চামড়ার জিনিসটা দেখাল।

‘আকরাম বেগ। আমরা আসলে…

এবারও কিরান বাক্য শেষ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই মহিলা আবারও কথা বলে উঠল। ‘তুমি কী জানো এইটা কী?’ বলে সে জিনিসটা কিরানের দিকে ছুঁড়ে দিল। কিরান এই প্রথমবারের মতো জিনিসটার গায়ে নিজ থেকে চোখ বুলাল এবং একটু অবাকই হলো সে। পালিশ করা পাতলা চামড়ায় গায়ে একটা নিশান আঁকা। দুইপাশে দুটো তলোয়ারের মাঝখানে একটা পদ্ম ফুল। ‘না, আমি জানি না এইটা কি,’ কিরান তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে।

‘ভালো, না জানা তুমার জন্য ভালো,’ বলে সে গড়গড়ায় টান দিল। ‘এট্টু বসো, তুমার ব্যবস্থা অই যাইতাছে…’

এবার কিরান একটু রেগে উঠল সেই সন্ধে থেকে এর কাছে ওর কাছে এদিকে- ওদিকে বারবার যেতে যেতে রাগ উঠে গেছে ওর। ‘আসলে এইখানে হইতাছেটা কী বলেন তো?’

মহিলা হেসে উঠল। ‘শোন পোলা, যার যটুকু জানা দরকার হে ওটুক জানাই ভালো। বেশি জানার দরকার নাই,’ বলে সে ওদের মাথার পেছনে কারো উদ্দেশ্যে ইশারা করল। ‘যাও, ওগোরে নিয়া যাও। আসল কতা যার বলার হে-ই কইবে।’

কিরান উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বের হওয়ার জন্য। বাকিদেরকেও ইশারা করল, কিরানের মনে হলো দরজার কাছে হিজড়াটাকে পলকের জন্য দেখতে পেল সে কিন্তু বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না ওরা। ব্যাপার কী? নিচে তাকিয়ে দেখল মইয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিরান মই বেয়ে নামতে শুরু করল ওর পেছনে গোমেজ আর লাঠিয়ালরা। প্রায় নেমে এসেছে এমন সময় শপাং করে কিছু একটা এসে লাগল মইয়ের নিচের অংশে। তীব্র টানের চোটে কিরানের মনে হলো ওর শরীরটা শূন্যে উঠে গেছে। তারপর পপাত ধরণীতলে মাটিতে আছড়ে পড়ল ও। মাটিতে পড়ে মুহূর্তের জন্য বেকুব হয়ে গেলেও ব্যথা পায়নি ও। উঠে দাঁড়ানোর জন্য সোজা হয়েই অনুভব করল ওদেরকে ঘিরে ফেলেছে একদল অস্ত্রধারী। ওকে মাটি থেকে উঠতে হলো না, কেউ একজন টেনে তুলে ফেলল ওকে। কিরান দেখল গোমেজসহ বাকি দুজনারও একই অবস্থা।

কিরানকে মাটি থেকে টেনে তুলে সোজা করা হলো। আট-দশ জনের একটা দল। সবার পরনে কালো পোশাক, মাথা থেকে শুরু করে মুখ সব ঢাকা। ওকে টেনে সোজা করতেই চাবুক হাতে এক অস্ত্রধারী এগিয়ে এলো ওর দিকে। এই লোকটাই সম্ভবত মইয়ে চাবুক পেঁচিয়ে টান দিয়েছিল ওটাকে আলগা করে দেওয়ার জন্য। কিরান নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও শক্তিশালী হাতের কারণে পারল না। চাবুকধারী মানুষটা ওর দিকে এগিয়ে একেবারে সামনে এসে কিরানের চোখ বরাবর তাকাল। তারপর খুলে ফেলল। নিজের মুখের আবরণ। কিরান অবাক হয়ে দেখল মানুষটা একজন মহিলা, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে একটা মেয়ে। সে আরো অবাক হয়ে উপলব্ধি করল এই মেয়েটাই তখন আঙিনার মুখে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। কিরান চারপাশে তাকিয়ে আরো অবাক হয়ে অনুধাবন করল ওদেরকে যারা ধরে রেখেছে তারা সবাই মেয়ে। হঠাৎ একটা ভাবনা খেলে গেল ওর মাথার ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে অনেক হিসেব মিলে গেল ওর। এত ঢাক গুড়গুড় এত গোপনীয়তা সব পরিষ্কার হয়ে এলো ওর কাছে। সে অবাক গলায় বলে উঠল, তুমরা তুমরা… দস্যু পদ্মরানির দলের লোক?

কিরান এ-কথা বলতেই সামনের মেয়েটা হেসে উঠল। ‘জাহাজি, আমরা কারা তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অইলো, তুমি যদি তালেব কিরানের পোলা অই থাকো তয় তুমরা দেরি কইরা ফালাইছো। তুমার বাপের খবর যার কাছে আছিল সে ধরা পইড়া গেছে শত্রুর হাতে। আইজ রাতে তার ফাঁসি দেওয়া হইবে, ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠল দক্ষিণের সমুদ্রের একমাত্র নারী জলদস্যু দল পদ্মরানির দলের মেয়েটা।

***

হাম্মামখানার ভেতরে যাওয়ার সময় গোলন্দাজ রঙ্গন আর তার দল আশা করেছিল এখানে তথ্য পাবে কিন্তু এসে পেল মালিকের লাশ। তার ওপরে আবার অন্য কামরা থেকে শব্দটা ভেসে আসতেই সচকিত হয়ে উঠল গোলন্দাজের দলের লোকেরা। গোলন্দাজ যদিও এসব থেকে দূরে আছে আজ অনেকদিন কিন্তু নিজের জীবনের বিশ বছরেরও অধিক সময়ে পার করেছে এসব কাজে। কাজেই কখন কোথায় কী করতে হবে সে বেশ ভালোভাবেই জানে।

শব্দটা ভেসে আসামাত্রই সে নিজের লাঠিয়াল দুজনকে সাবধান করে দিল। ওরা তার দুপাশে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মাঝখানে সে, ওদের পেছনে বৈঠা আর বিল্লাল শেঠ। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল দরজা দুটো যেদিকে সেদিকে।

কামরার অন্য প্রান্তে দুপাশে দুটো দরজা। দুটো দরজার কোনোটার অন্যপাশ থেকে শব্দ এসেছে ওরা জানে না। কাজেই রঙ্গন প্রথমে লাঠিয়াল দুজনকে প্রস্তুত থাকতে বলে বাম পাশের মানে প্রথম দরজাটাতে নিজের হাতের বন্দুকের নল দিয়ে ঠেলা মারল। দরজাটা খুলে যেতেই গোলন্দাজ দেখল অন্যপাশে একটা লম্বা আর ফাঁকা বারান্দা আছে, সেদিকে কেউ নেই। এরমানে হিসেব পরিষ্কার। যদি এখানে কেউ থেকে থাকে তবে সে আছে অন্য দরজাটার ওপাশে। আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে গোলন্দাজ ইশারা করল নিজের লোকদের। ওদেরকে প্রস্তুত থাকতে বলে সে অন্য দরজাটার সামনে এসে দাঁড়াল। ওপাশে কে আছে কারা আছে বা কয়জন আছে জানা নেই। কাজেই যতটুক সম্ভব সাবধানে থেকে দরজাটায় একটা ঠেলা মারল।

দরজার ওপাশে একটা ছোটো রসুইঘরের মতো। আসলে রসুইঘর না, কারণ এসব বাড়িতে রসুইঘর হয়ে থাকে বাড়ির বাইরে। এখানে যে কামরাটা আছে সেটা আসলে একটা গোলাঘরের মতো। এ-ধরনের কামরায় সাধারণত বিভিন্ন জিনিস রাখা হয়ে থাকে, একইসঙ্গে এখান থেকে অন্যান্য কামরায় বা জায়গা অতিথিদের আপ্যায়নের বিভিন্ন জিনিস রাখা থাকে। কামরাটা ছোটো কিন্তু চিকন আর লম্বা। গোলন্দাজ ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেও প্রথমে ভেতরে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু কামরার ভেতরে পা রাখতেই মেঝেতে পায়ের ছাপ দেখতে পেল। রক্তমাখা পায়ের ছাপ চলে গেছে দেয়ালে ঝোলানো একটা বেতের দেয়াল পর্দার আড়ালে।

গোলন্দাজ ফিসফিস করে নিজের দুই লাঠিয়ালকে এগোতে বলল। ওরা দুজন সামনে এগিয়ে জিনিসটার সামনে দাঁড়াল তারপর গোলন্দাজের দিকে ইশারা করে একটানে ওটাকে তুলে ফেলল শূন্যের ওপরে। আর গোলন্দাজ বন্দুক তাক করল ওটার মাঝ বরাবর। কিন্তু ওটার ভেতরে যা দেখতে পেল সেটা দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না মোটেও।

দেয়াল আর তাকগুলো আড়াল করার জন্য ছোটো এই রসুইখানার দেয়ালের বেতের ঝালড় ঝোলানো ছিল, সেই ফাঁকে একজন ছোটোখাটো মানুষ গুটিশুটি মেরে বসে ছিল, গোলন্দাজসহ ভয়ংকর দুজন মানুষকে বন্দুক হাতে ওটার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে এক লাফে হাউ-মাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে একেবারে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর প্রায় চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হুজুর, হুজুর আমারে মাইরেন না। আমি খালি একজন তদারক।’

গোলন্দাজ উঁচিয়ে ধরা বন্দুকটাকে নামিয়ে নিল, তারপর ওদের পেছনে থাকা বিল্লাল শেঠ আর বৈঠাকে ইশারা করল লোকটাকে শান্ত করার জন্য। বিল্লাল শেঠ এগিয়ে এলো লোকটার দিকে। ‘আরে তকি মিয়া, তুমি এইখানে কী করো? ওস্তাদ সফদরের কী অইলো? হেরে মারল কেডা?’

মাটিতে শুয়ে পড়া তকি মিয়া প্রথমে মুখ তুলে তাকিয়েও বিল্লাল শেঠকে চিনতে পারল না। তারপর চিনতে পেরে সে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগল। রঙ্গন মল্লিক খানিকটা বিরক্ত হলেও বুঝতে পারছে লোকটা আসলে ভয়ের চোটে এমন করছে। ‘ওরে ঠান্ডা করো, পানি খাওয়াও তারপর জিগাও এইহানে কী অইছে।’

সে ইশারায় লাঠিয়ালদের বলল বাইরে পাহারা দিতে। কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে ওদেরকে সাবধান করে দিতে। গোলন্দাজ এটা বুঝতে পারছে, এখানে যাই হয়ে থাকুক না কেন বড়ো কিছু একটা ওদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এখনো কিছু জানার সুযোগ আছে হয়তো।

তকি মিয়াকে পানি খাওয়ানো হলো। তাকে খানিকটা শান্ত করে যা জানা গেল সেটা অনেকটা এরকম। আজ বিকেল থেকে হাম্মামখানা বন্ধ করে সফদর পাটোয়ারি কারো জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ কাদের নাকি আসার কথা ছিল। গোলন্দাজ বিল্লালের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছে ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু এরপরে যা শুনল সেটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।

‘ওস্তাদে কয়েকদিন ধইরা একজনরে লুকায়া রাখছিল, হেরে এইহানে রাখা মুশকিল অইতেছিলে তাই হেয় ভাবছিল হেরা আইলে হেগের কাছে উঠায়া দিব হেরে,’ তকি মিয়া এইটুক বলতেই গোলন্দাজ তার দিকে এগিয়ে গেল। একবার বিল্লার শেঠের দিকে দেখে নিয়ে সে তকির কাঁধে হাত রাখল, ‘কারে লুকায় রাখছিল হেয়?’

‘আমি সঠিক জানি না হুজুর,’ তকি হাত জোড় করে বলতে লাগল। ‘তয় এইটা জানি হেয় আরাকান থেইকা আসছিল। হেরেই লুকায় রাখছিল।’ গোলন্দাজ বিল্লালের দিকে তাকালে বিল্লাল কাঁধ ঝাঁকাল, সেও কিছু জানে না এই ব্যাপারে।

‘তারপর?’ গোলন্দাজ তাড়া দিল তকিকে। ‘বিকালের পরে এরপর একদল লুক আইলো। প্রথমে ওস্তাদ ভাবছিল হের লুকেরা আইছে। কিন্তু যারা ঢুকলো হেরা এইহানেরই লুক। হেরা রোসাঙ্গের রাজার লুক। হেরা আইসা প্রথমে ওস্তাদরে মারল। তারপর ভেতরের কামরা থেইকা হেই লুকানি মানুষটারে বাইর করল। তারপর হেরে নিয়া চইলা গেল। আমি পুরা সময় লুকায়া আছিলাম। লুকায়া লুকয়াই শুনলাম হেরে আইজ ফাঁসি দিব সুলতানের বাজারে।’

গোলন্দাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বৈঠার দিকে। ‘ব্যাপার কী? কাকে এনে লুকিয়ে রেখেছিল সফদর পাটোয়ারি? তুমি কী কিছু জানো?’

‘আমি জানি না হুজুর, আমি খবর পাঠাইছিলাম ওস্তাদরে যে, আকরাম বেগের হয়ে এখানে আজকের দিকে খবর নিতে আসব আর কিছু জানি না।’

গোলন্দাজ চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকাল ওদের দুজনার দিকে। ‘আমি জানি না কাকে ধরে এনে রেখেছিল পটোয়ারি কিন্তু সে যেই হোক তার কাছে তালেব চাচার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। এমনও হইতে পারে, সে তালেব চাচার সঙ্গেই রোসাঙ্গ থেইকা আসছিল,’ বলে সে বৈঠার দিকে তাকাল। ‘কিরান আর দলের বাকিগো খবর দিতে পারলে ভালো অইতো কিন্তু সেইটা তো সম্ভব না। কিন্তু আমগো কিছু একটা করতে হইবে। এছাড়া উপায় নাই,’ এইটুকু বলে সে একটু থেমে যোগ করল ‘সুলতানের বাজারে যাইতে হবে। এই ফাঁসি ঠেকাইতে হবে যেমনেই হোক।’

***

গোলন্দাজ যোদ্ধা আর নেতা মানুষ। তার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যতটা সহজ বেদু আর তুলারামের মতো মানুষদের জন্য সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ একে তো ওদের ভেতরে নেতা গোছের কেউ নেই। এছাড়া এরা মাঠের মানুষ; কাউকে মারতে বললে বা ঠেঙাতে বললে এদের জন্য যতটা সহজ, কোনো মাথা খাটানোর কাজ করতে বললে সেটা ওদের জন্য ঠিক ততোটাই কঠিন। আর এ-কারণেই ওদের ভেতরে একটা গোল বেঁধেই আছে।

যেই মুহূর্তে ওরা জানতে পারল আজ সুলতানের বাজারে কারো ফাঁসি দেওয়া হবে প্রথমে ওদের জন্য সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল কিন্তু পরমুহূর্তে ওরা আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারে যেগুলো ওদের কাছে পুরো ব্যাপারটাকে আরো অনেক বেশি ঘোলাটে করে তোলে। সেই সঙ্গে তারা এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করে যে, ওদের আসলে কী করা উচিত।

চণ্ডখানায় বসে যে লোকগুলো ওদের পেছনে বসে কথা বলছিল তাদের কাছ থেকে ফাঁসির ব্যাপারটা জানতে পারে। সেই সঙ্গে এটাও জানতে পারে যে, ফাঁসিটা আজই কার্যকর হবে। তারপর যে লোকটা ওদেরকে চণ্ডু দিয়ে গেছে তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করার পর আরো বিস্তারিত জানতে পারে ওরা। লোকটা বিদেয় নিতেই তুলারাম বেদুকে ইশারা করে ওদের পেছনে যে লোকগুলো আছে তাদের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করে।

তুলারাম প্রথমে লোকগুলোর দিকে ঘুরে বসে বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘জনাব, আপনারা কী এই জাগারই বাসিন্দা?’

দুই বুড়োর ভেতরে একজন তুলারামকে পরখ করে বলে ওঠে। ‘আর কোথায়? আইজ থেকে বিশ বছর আগে আসছিলাম বাড়ি থেকে পলায়ে জাহাজের খালাসি হয়ে। ভাবছিলাম বছর এক দুই থাইকা চলে যাবো। আর পাইলাম কই? বিশ বছর পার হয়ে গেল,’ বলে সে তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। তুলারাম

লোকগুলোকে ভালো করে পরখ করল। পরনে সাধারণ পাজামা আর কাফতান। খুব বেশি পয়সাওয়ালা মনে হচ্ছে না। অবশ্য খুব বেশি পয়সাওয়ালা হলে এই রাস্তার পাশের চণ্ডুখানাতে আসতোও না এরা। তুলারাম হেসে উঠে ওদের জন্য আনা চণ্ডু বুড়ো দুজনকে সাধতেই ওরা খুশি হয়ে ওঠে। ওরা ঘুরে বসে বুড়ো দুজনার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়।

বেদু বলে ওঠে, ‘জনাব, আপনেগো জায়গাটা দারুন। আমরা আইজিই প্রথম এলাম এহানে। মালিকেরা গেছে অমোদ করতে, আমরা ঘুরে বেড়াইতেছি।’

‘বড়ো ভালা দিনে আইয়েছেন,’ অপর বুড়ো বলে ওঠে। ‘আইজ এহানে বিরাট ঘটনা ঘটতে যাইতেছে।’

তুলারাম বেদুর পাঁজরে কনুই দিয়ে সামান্য গুঁতো মারে। ‘তাই নাকি জনাব, ব্যাপারটা আসলে কী?’

বুড়ো চণ্ডুর নলে টান দিয়ে নেশার ঘোরে গড়গড় করে কথা বলতে শুরু করে। ‘আর কইয়েন নাই। আরাকানি আর আর চাঁটগাইয়াগো রাজনীতি এহানটারে শেষ করে দিচ্ছে। তাই ঝামেলা শেষ নাই।’

‘আরে এনু ঝামেলার কী আছে?’ বলে প্রথম বুড়ো বেদুর পিঠে জোরে একটা চাপড় মারল। ‘বিরাট কাহিনি অইছে এহানে। হেরই ফল আজকের ঘটনা। রোসাঙ্গে শাহ সুজারে মাইরা ফালাইছে হেয় তো জানো?’ বেদু বোকার মতো মাথা নাড়তে লাগল। ‘হের কাছের লুকেরা হেগো সয়-সম্পদ লাইয়া পলাইছিল। কিন্তু হেরা বেশিদূরে যাইতে পারে নাই। এদিকেই ঘুরপাক খাইতাছে।’

‘তাই নাকি? হের লগে আইজের ঘটনার মিল কী?’ এবার তুলারাম জানতে চাইল।

‘ঘটনা অইলো যারা পলাইছিল হেগো ভেতরে রোসাঙ্গের রাজার এক সভা কবিও আছিল। হেয় ক্যামনে জানি পলায়া এই সন্দ্বীপে চইলা আইছিল। হ্যাঁয় এহানে সফদর পাটোয়ারি নামে এক ব্যবসায়ীর ওখানে পলায়া ছিল। মনে অয় সুযোগ বুজে দূরের কোনো দেশে পলানির নিয়ত আছিল। কিন্তু রোসাঙ্গের রাজার চর সবখানে আছে। হেয় অইজ ধরা পড়ছে,’ এটুকু বলে বুড়ো গড়গড়া টানতে লাগল।

বেদু আর তুলারাম দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই এই ঘটনার সঙ্গে ওদের কোনো সংযোগ আছে। ‘তারপর?’ বেদু প্রশ্ন করল।

‘এরপরে আর কী হেরা যে পাজি, ওরে কী আর ছাড়ে। এমনিতেই অনেকদিন ধইরা এটা ওইটার কানে মানুষ অস্থির হয়া ছিল। তার ওপরে আবার দিল্লির ঝামেলা, রোসাঙ্গে শাহ সুজারে পরিবারসহ খুন। শুনছি চাঁটগায়েরাও নাকি আরাকানের লগে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করতাছে। সব মিলায় মানুষ অস্থির…’ প্রথম বুড়ো এটুক বলতেই দ্বিতীয় বুড়ো নিজের হাঁটুতে চাপড় মেরে বলে উঠল।

‘আর তাই দ্বীপের শাসকেরা পর্তুগিজ আর আরকানিরা মিলা আইজ ওরে ফাঁসি দিব। আমোদও অইবে, মানুষও ঠান্ডা অইবে, সব ঠিক,’ বলে বুড়া খিকখিক করে হাসতে লাগল।

বেদু তুলারামের দিকে তকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চট করে হাঁটতে শুরু করল পেছনে দুই বুড়ো ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ব্যাপার কী, আড্ডা মাত্র জমে উঠেছে। বুড়োরা ভেবেছিল ওদের কাছ থেকে আরো কিছু চণ্ডু খসানো যাবে। এভাবে উঠে যাওয়াতে রীতিমতো হতাশ হলো তারা।

চণ্ডুর দাম পরিশোধ করে ওরা বেরিয়ে এলো চণ্ডুখানা থেকে। খানিকটা নির্জনে আসতেই বেদু তুলারামকে থামিয়ে জানতে চাইল। ‘নিশ্চিত এই ঘটনার লগে আমাগো কোনো না কোনো যুগাযুগ আছে।’

‘তা আর কইতে?’ তুলারামকেও অস্থির দেখাচ্ছে।

‘এহন কী করব আমরা?’ বেদু জানতে চাইল।

‘ওস্তাদ কিরানরে জানাইতে হবে,’ তুলারাম নির্দেশ অনুসরণ করার লোক, নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা তার নাই।

‘না, না সময় নাই। ওস্তাদের লইগ্গা অপেক্ষা করতে করতে সব শেষ ওয়া যাবো। ততোক্ষণে—’

আরে তাইলে আমরা কী করব। আদেশ না দিলে…’ বেদুকে কথা শেষ করতে দিল না তুলারাম। আর সে কথা শেষ করতে পারল না একটা বিকট শব্দে। অবাক হয়ে ওরা দেখল বাজারের কেন্দ্র থেকে ভেসে আসছে এই উৎকট শব্দ। ফাঁসির সমন জারি করার জন্য দ্বীপের প্রশাসন থেকে বাজানো হয় এই শব্দ। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *