অধ্যায় ঊনত্রিশ – বর্তমান সময়
পিবিআই হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রাম
‘শশী সুলতানা।’
‘ডক্টর শশী সুলতানা,’ চেয়ারে বসা ভুবন বলে উঠল।
রুম্পা তার দিকে সামান্য মাথা নেড়ে হাসি মুখে বলে উঠল। ‘হ্যাঁ, ডক্টর শশী সুলতানা,’ বলে রুম্পা তালুকদার প্রজেক্টের সবার সামনে একটা ছবি দেখাল। প্রজেক্টরের স্ক্রিনে রোদে পোড়া হালকা শ্যামলা মতো সুন্দর চেহারার হাসিমুখের একটা ছবি ফুটে উঠল।
‘আমরা প্রফেসর সুলতান আবদেলের মৃত্যুর স্থান সংলগ্ন জায়গাটা থেকে যে আইডি কার্ডটা পেয়েছি সেটা মূলত এই ব্যক্তিরই। যে আইডিটা পাওয়া গেছে সেটা কায়রোর একটা ইউনিভার্সিটির আর্কিওলোজি ডিপার্টমেন্টের,’ বলে সে মিটিংয়ে উপস্থিত সব টিম মেম্বারদের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত ব্রিফিং শুরু করল।
শারিয়ার মিটিং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে দেখল একবার। যেকোনো কেসের কাজে দুটো ব্যাপার অত্যন্ত ঘৃণা করে শারিয়ার; একটা হলো ফাইল ওয়ার্ক, অন্যটা কেস অ্যানালিসিস মিটিং। শারিয়ার জানে এই দুটো ব্যাপারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপার দুটো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে,কখনো কখনো কেসের কাজ মাঠের চেয়ে ফাইলেই বেশি পরিমাণে সমাধান করা সম্ভব হয় এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেসের স্ট্র্যাটেজি ডেভলপমেন্ট থেকে শুরু করে অনেক মেজর ডিসিশন মেকিংও হয়ে থাকে কেস অ্যানালিসিস মিটিংয়ে। কিন্তু এত কিছু জানার পরেও আজও যেকোনো কেসের কাছে এই দুটো ব্যাপার একেবারেই উপভোগ করতে শিখতে পারল না শারিয়ার। এই মুহূর্তে ওরা বসে আছে পিবিআইয়ের সেই মিটিং রুমে, যেখানে দুপরের মিটিংটা হয়েছিল। সেই দিঘির পাড়ে নৌকার ভেতরে ওই আইডিকার্ডটা পাওয়ার পর খুব দ্রুত কাজ শুরু করে টিমের বিভিন্ন সেকশন। এখন সে বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে মিটিংয়ে। শারিয়ার দেখতে পেল বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে অনেক আগে। মুখের সামনে হাত তুলে হাইম ছাড়তে লাগল সে।
‘মিস্টার শারিয়ার, আপনি শুনছেন?’ হঠাৎ টেবিলের সামনের অংশ থেকে ওর নাম শুনে চমকে উঠে সেদিকে তাকাল সে।
‘ইয়েস, ইয়েস ম্যাডাম,’ বলে সে সামনে রাখা ফাইলটা হাতে তুলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল।
রুম্পা একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও বলতে শুরু করল, ‘ওই দিঘির নৌকাতে আইডি কার্ডটা পাওয়ার পর আমাদের আইটির টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কাজের জন্য। ওরা গত কয়েক ঘণ্টায় বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছে। বিশেষ করে আইডির মানুষটাকে ট্রেস করার ব্যাপারে। আমি টমিকেই বলব ব্রিফ করার জন্য, ‘ সে টমির উদ্দেশ্যে ইশারা করে বসে পড়ল চেয়ারে।
টমি কানে হেডফোন লাগিয়ে কিছু একটা শুনছিল, রুম্পার ইশারা পেয়ে সে কান থেকে হেডফোন সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার পরনে কালো একটা টি-শার্ট। সেটার ওপরে লেখা ‘আই অ্যাম হট’। প্রথম দুটো অক্ষরের চেয়ে হট লেখাটা অনেক বড়ো। আর সেটা ঠেলে বেরিয়ে আছে তার বিশাল ভুঁড়ি।
শারিয়ারের পাশ থেকে ভুবন মুখ তুলে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল, ‘এই ব্যাটা কী প্রেগনেন্ট নাকি। এরকম একটা শরীরে এই আকারের ভুঁড়ি ক্যামনে হয়!’ ভুবনকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বেশ সিরিয়াসলি ভাবছে বিষয়টা নিয়ে। হাতের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল শারিয়ার। রুম্পা একবার ঝাড়ি দিয়েছে। আবার কথা বলতে দেখলে খবর আছে।
‘তো সবাই ভালো আছেন আশা করি,’ খানিকটা ন্যাকা ন্যাকা গলায় টমি বলে উঠল। ‘তো যেটা বিষয়, এই আইডিটা হাতে পাওয়ার পর আমি মানুষটাকে সার্চ করতে শুরু করি খুব অবভিয়াস দুটো জায়গা থেকে। এক, তার বিশ্ববিদ্যালয়। মানে যেটার আইডি কার্ড আমরা পেয়েছি। দুই, সোশাল মিডিয়া। লাকিলি দুটো জায়গাতেই আমরা হিট পাই। প্রথমেই ভার্সিটির ওয়েবসাইটের শিক্ষক তালিকায় উনার নাম আছে। আর দ্বিতীয়ত ফেসবুকেও আছেন উনি। এরপরে উনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায় এই ভদ্রমহিলা গত সপ্তাহ থেকে ছুটিতে আছেন। হোটেল রেকর্ড থেকে জানা যায় সে মৃত্যুর দুইদিন আগে বাংলাদেশে আসে এবং ঢাকায় একটা হোটেলে ওঠে।’
‘মহিলা কী বাংলাদেশের নাগরিক?’ শারিয়ার জানতে চাইল।
‘না, সে বাংলাদেশি অরিজিন হলেও ঢাকার হোটেলে সে যে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিয়েছে সেটা ইংল্যান্ডের। এর মানে সে ইংল্যান্ডের নাগরিক। যাই হোক, সে প্রফেসরের মৃত্যুর আগের দিন সে চট্টগ্রামে আসে। ওঠে নিউ মার্কেটের কাছে একটা হোটেলে। হোটেলের রেজিস্টার এবং সিসিটিভির ফুটেজ থেকে এসব কিছু কনফার্ম করা হয়েছে। এটাও ওখান থেকে জানা গেছে যে, সে ওইদিন মানে, প্রফেসর খুন হওয়ার দিন বিকেলে হোটেল থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। হোটেল থেকে একাধিকবার তার নম্বরে ফোন করে পায়নি। আমরাও হোটেলের রেজিস্টারে লেখা তার নম্বরে ফোন করে পাইনি। এমনকি তার নম্বর ধরে তাকে ট্রেস করার চেষ্টা করেও শেষ অ্যাকটিভ লোকেশন দেখা গেছে ওই প্রফেসরের বাড়ির কাছেই।’
তারমানে এটা পরিষ্কার যে, ওই মহিলা ওইদিন ওখানে গেছিল এবং সম্ভবত প্রফেসরের সঙ্গেই দেখা করতে গেছিল সে ওখানে,’ রুম্পা আবারও দাঁড়িয়ে বলা শুরু করল। সম্ভবত তাকে ওখান থেকেই অপহরণ করা হয়।
‘এটা আমরা ধরে নিচ্ছি,’ শারিয়ার মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে এই কেসে এখন পর্যন্ত যে একটি বড়ো প্রশ্নের উত্তর খালি জায়গা ছিল সেখানে উত্তর হিসেবে আমরা পেলাম প্রফেসর আসলে ওইদিন রাতে এই ডক্টর শশীকে পিক করতেই গিয়েছিল। ঠিক?’ প্রশ্নটা করে আবারও যোগ করল সে। ‘আচ্ছা প্রফেসরের সঙ্গে এই মহিলার কোনো সংযোগ পাওয়া গেছে?’
‘গেছে,’ আবারও টমি বলে উঠল। ‘ইংল্যান্ডে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পড়েছে এবং পরে কাজ করেছে এই মহিলাও সে-জায়গারই ছাত্রী ছিল এবং এই মহিলা কায়রোতেও প্রফেসরের সঙ্গে কাজ করেছে।’
‘তারমানে দাঁড়াল, প্রফেসর ওই বাড়ির বেইজমেন্টে বসে কিছু একটা করছিল এবং একটা পর্যায়ে সে এই মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই মেয়ে প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে এলে কিছু একটা ঘটে এবং তাকে কেউ অপহরণ করার চেষ্টা করলে সে সম্ভবত পালিয়ে ওই দিঘির ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা করে,’ রুম্পা বলতে শুরু করেছে। ‘এরপরে সম্ভবত দিঘির ওই দিকে গিয়ে রুম্পা ঢুকে পড়ে পাহারাদারের রুমে। এটা খুবই সম্ভব যে বৃষ্টি হচ্ছিল পাহারাদারও রুমেই ছিল। কিন্তু যারাই মেয়েটার পিছু নিয়েছিল তারাও সেখানে ঢুকে পড়ে। পাহারাদার বাধা দিতে চাইলে কিংবা তারা কোনো সাক্ষী রাখতে না চাইলে লোকটাকে মেরে তারা ডক্টর শশীকে নিয়ে কেটে পড়ে ওখান থেকে,’ বলে সে হাতে কাগজগুলোর টেবিলের ওপরে ঠাস করে রেখে দিল। ‘প্রফেসর ওইদিন রাতে রাস্তায় কী করছিল সেই জবাব আমরা পেয়েছি’ রুম্পা শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘এখন প্রশ্ন হলো, তিন বছর ধরে প্রফেসর বাড়ির বেইজমেন্টে আসলে করছিল কী?’
শারিয়ার হাত তুলল, ‘এটা অবশ্যই এই কেসের সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়েও বড়ো প্রশ্ন আছে আমাদের হাতে,’ বলে সে একটু থামল। কিন্তু সে আবারও কিছু বলার আগেই ওর পাশ থেকে ভুবন বলে উঠল, ‘ডক্টর শশীকে ওরা নিয়ে গেছে কোথায়?’ বলে সে শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে রইল।
শারিয়ার মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘একদম ঠিক। এই ব্যাপারে কোনো আপডেট?’
রুম্পা নিজে জবাব না দিয়ে টমির দিকে তাকাল। ‘জবাবটা হলো, এই ব্যাপারেও আপডেট আছে। আর আপডেটটা হলো, কোনো আপডেট নেই,’ বলে সে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল। ‘বুঝিয়ে বলছি। আইডিয়াটা ছিল রুম্পা ম্যামের। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে সেখানকার আশেপাশে আমরা কোনো সিসি টিভি পাইনি। কিন্তু ম্যাডামের পরামর্শেই এলাকাটার রেডিয়াস আমরা বাড়াতে থাকি। ধীরে ধীরে আমরা রেডিয়াস বাড়িয়ে কয়েক মাইল করে ফেলি। এরপরে এর ভেতরে যে কয়টা ক্যামরা আছে সেগুলো লোকেট করি।’
‘ভেরি গুড,’ আনমনেই বলে উঠল শারিয়ার। কথাটা সে বলেছে রুম্পার দিকে তাকিয়ে। রুম্পা ইশারায় তাকে ওয়েলকাম জানাল। ‘এরপর?
‘আমরা প্রথমে রেডিয়াস বাড়িয়ে সব ক্যামেরা লোকেট করি। এরপরে ওই দিঘি এবং এর আশপাশ থেকে বের হওয়ার মতো সম্ভাব্য যত রুট থাকতে পারে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করে ফেলি। সেগুলোর অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট সময়ের সিসি টিভি ফুটেজ আনিয়ে পরীক্ষা করে আমাদের টিম,’ সে একটু থেমে যোগ করল। ‘আসলে এখনো কাজ চলছে। এক্ষেত্রে আমরা দুটো সোর্সের ওপরে নির্ভর করছি। প্রথমত ডক্টর শশীর ফেস রিকগনিশনের জন্য স্ক্যান করা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, আমাদের লোকেরা ম্যানুয়াল ওয়েতে নিজেরা দেখে দেখে চেক করছে। আমরা এখনো কিছুই পাইনি। ওটার কাজ এখনো চলছে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এতে আমরা কিছু নাও পেতে পারি। আর ক্যামেরা থেকে না পাওয়ার একশ একটা কারণ থাকতে পারে।
‘অহ, কাম অন,’ রুম্পা রাগের সঙ্গে বলে উঠল। ‘তারা নিশ্চয়ই ওখান থেকে হাওয়া হয়ে যায়নি। কোনো না কোনো দিক দিয়ে তো বের হয়েছেই, তাই না? কাজেই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে,’ রুম্পার গলায় জেদ। ‘ওরা তো আর ওখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। কিংবা উড়ে চলে যেতে পারে না।’
শারিয়ার চট করে রুম্পার দিকে ফিরল। ‘কী বললেন আপনি?’
শারিয়ার এই কথা বলাতে রুম্পা হঠাৎ একটু অবাক হয়ে গেছে, মানে বুঝিনি,’ সে অবাক হয়েই বলে উঠল। একবার তাকাল ভুবনের দিকে।
‘না মানে শেষ কথাটা কী বললেন? উড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে তাই না?’ শারিয়ার জানতে চাইল।
‘আরে আমি দুষ্টুমি করে বলেছি। ওই জায়গা থেকে উড়ে যাওয়া সম্ভব নাকি। এমনকি হেলিকপ্টার আনলেও ওখানে নামানো সম্ভব নয়।’
‘না, আমিও সেটা ভাবছি না,’ বলে শারিয়ার টমির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল
টমি, আমাদের ওই জায়গার ম্যাপটা একটু দেখানো যাবে?’
টমি গুগল ম্যাপে জুম করে ওই জায়গায় নিয়ে এলো। তারপর জানতে চাইল, ‘কোনটা রাখব? ম্যাপ নাকি আর্থ?’
‘আর্থ হলে বেটার,’ শারিয়ার বলে উঠে দাঁড়াল। টমি ম্যাপটাকে সেট করতেই সে কাছে চলে এলো। টেবিলের সামনে থেকে মার্কার উঠিয়ে নিয়েছে হাতে। ‘সিসি টিভির কাজ চলুক। ওতে কোনো বাধা নেই। কাজটা সময়সাপেক্ষ। আর আমাদের হাতে সময় কম। এমনিতেই কেসের অনেক কাজে। বেশ দেরি হয়ে গেছে এই ক্ষেত্রে আমার একটা থিওরি আছে। আইডিয়াটা আমার মাথায় এসেছে রুম্পার উড়ে যাওয়ার কথাটা থেকে,’ শারিয়ার কথাগুলো বলছিল রুমে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে তারপর সে রুম্পার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে মাথা নেড়ে কথা বলতে শুরু করল।
‘আমরা সূত্র জোড়া লাগিয়ে ওই জায়গা থেকে কেয়ারটেকারের ডেড বডিসহ অনেক কিছুই বের করেছি। বিশেষ করে আমাদের ফরেনসিক টিম অনেক কাজ করেছে। কিন্তু আমার কাছে দুটো প্রশ্নের জবাব একেবারেই পরিষ্কার নয়। প্রথমত, দিঘির পাহারাদারকে একেবারে মেরে ফেলা হলো কেন?’
ভুবন হাত তুলল। হয়তো তারা কোনো সাক্ষী রাখতে চায়নি। মানে ব্যাপারটা আমি যেটা বুঝতে পারছি। ওইদিন প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে গেল ডক্টর শশী। তারপর কিছু হলো প্রফেসর মারা পড়ল ওই লোকগুলো ওদের পিছু নিলো, ডক্টর শশী পালিয়ে চলে গেল দিঘির ওদিকে। ওখানে গিয়ে সে আশ্রয়ের জন্য ঢুকল কেয়ারটেকারের ঘরে। তার পিছু নিয়ে ওখানে সত্যিই ঢুকল ওই লোকগুলোও। এক্ষেত্রে পাহারাদারকে মেরে ফেলার একটা অন্যতম কারণ হতে পারে যাতে সে অন্য কাউকে বলতে না পারে সেটা হতে পারে…’
‘একদম, এই কথাটাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম, শারিয়ার তালি দিয়ে উঠল ‘কেয়ারটেকার কী বলতে না পারে?’ সে ভুবনের দিকে তকিয়ে আছে।
‘মানে, ওরা ওখান থেকে কাউকে ধরে নিয়ে গেছে বা এরকম কিছু,’ ভুবন কাঁধ নাচিয়ে বলে উঠল
যদি তাই হয়, তারা যদি ওখানে কেয়ারটেকারকে বেঁধে রেখে যায় তাও তেমন সমস্যা নেই। কারণ লোকটাকে মেরে ফেললেও কয়দিন পর কেউ না কেউ তার লাশ পাবে। যদি বেঁধেও রেখে যায় তবুও কেউ না কেউ এসে তাকে খুলবে। কিন্তু কেউ কেন তাকে মারবে?’
‘যদি না সে বিশেষ কিছু দেখে ফেলে তবে সেটা সে অন্য কাউকে বলতে না পারে,’ রুম্পা বলে উঠল।
‘একদম ঠিক,’ আবারও তালি দিয়ে উঠল শারিয়ার। ‘এখন প্রশ্ন হলো, সেই বিশেষ কিছুটা কী?’ বলে সে অফিসার সুমনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘এখানে আমার আরেকটা ব্যাপারে বলার আছে। আপনারা কী খেয়াল করেছেন আমরা ডক্টরের আইডি কার্ডটা কোথায় পেয়েছি, সুমন বলেন তো?’
‘নৌকাটার ওপরে,’ সুমন বলে উঠল।
যদি ডক্টর শশী পালিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে থাকে তবে তার আইডি এবং ছোটো পার্সটা নৌকায় গেল কীভাবে? তার ওপরে নৌকাটাও ছিল দিঘিটার মাঝামাঝি। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। ঠিক?’ সে এখনো তাকিয়ে আছে সুমনের দিকে। সুমন মাথা নাড়ল, সঙ্গে ভুবনও। ‘ঠিক।’
‘তোমরা কেউ কী খেয়াল করেছিলে নৌকাটা ঘাটে বেঁধে রাখার দড়িটা?’ সবাই চুপ। ‘আমি করেছি ওটা যে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা থাকে সেটা উপরানো ছিল। এর একটাই মানে হতে পারে,’ বলে সে থেমে গেল।
‘কী সেটা?’ রুম্পা জানতে চাইল।
‘ওই দিন রাতে নৌকাটা কেউ না কেউ ব্যবহার করেছে।’
‘আপনি বলতে চাইছেন শশী? কিন্তু উনি কেন…’
‘ডক্টর শশী নয়, আমার ধারণা উনাকে ওইদিন রাতে ওই নৌকায় করে সরানো হয়েছে ওখান থেকে,’ শারিয়ার ম্যাপের মধ্যে দেখাল।
‘কাম অন, মিস্টার শারিয়ার,’ রুম্পা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল। ‘এ কেমন কথা! ওটা একটা বদ্ধ জায়গা, চারপাশে বাউন্ডারি দেওয়া। ওখান থেকে নৌকায় করে ওরা তাকে কোথায় সরাবে? ওখানে তো দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই।’
‘একেবারে ঠিক,’ হেসে উঠল শারিয়ার। ‘আমিও তাই বলতে চাইছি,’ বলে সে প্রজেক্টরের ম্যাপের সামনে চলে এলো। ‘দেখেন এই জায়গার একটা বড়ো অংশ বাউন্ডারির সংলগ্ন পানিতে।’ বলে সে মার্কার দিয়ে লাইন টানলো। ‘অনেকটা জায়গা। আমার বিশ্বাস ওইদিন রাতে পাহারাদারকে খুন করার পর ডক্টর শশীকে যারাই ওখান থেকে কিডন্যাপ করেছে তারা তাকে নিয়ে নৌকাতে উঠে তারপর ওটাকে নিয়ে চলে আসে এই বাউন্ডারির কাছে। এরপর সেখান থেকে দেয়াল টপকে তাকে নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে সরে পড়ে। নৌকাটা খোলা থাকার এবং বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরি করার এটাই ব্যাখ্যা,’ বলে সে একটা আঙুল তুলল। ‘এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা ডক্টর শশীর পার্টস আর আইডি কার্ডটা ওখানে পাওয়া যাওয়ার। কারণ অন্য কোনো জায়গাতে সুযোগ না পেলেও আমার বিশ্বাস যখন তাকে নৌকায় তোলা হয় কিংবা নৌকা থেকে দেয়ালের অন্যপাশে নেওয়া হয়, কোনো এক ফাঁকে সে জিনিসটা নৌকাতে ফেলে দেয়। আর এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা তাকে অন্য কোনো রুট দিয়ে না সরানোর এবং আমার ধারণা যদি ভুল না হয় আগামী কয়েক ঘণ্টা কেন কয়েক বছরের ফুটেজ ঘাটলেও কোনো সিসি টিভিতে ডক্টরকে সরানোর কিছুই পাওয়া যাবে না। কারণ তাকে কোনো রাস্তা দিয়ে ওখান থেকে সরোনোই হয়নি। তাকে সরানো হয়েছে এখানে এবং এই বাউন্ডারির ওপাশে কী আছে আমি জানি না। এমন হতে পারে ডক্টর শশী এখনো ওই এলাকাতেই আছে।’
টানা অনেকক্ষণ কথা বলে থেমে গেল শারিয়ার। সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। টমি প্রথমে বলে উঠল, ‘সম্ভাবনা যাচাইয়ে আমারো মনে হচ্ছে এটা হতে পারে।’
‘আমারও,’ ভুবন যোগ করল। মুখে কিছু না বললেও রুম্পার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে অফিসার সুমনও হাত তুলল।
‘তাহলে আপনি বলতে চাইছেন ওই দেয়ালের ওপাশে কী আছে সেটা জানাটা সম্ভব হলে এই এলাকাটাতে একটা থরো সার্চ করা এখন আমাদের মূল দায়িত্ব?’ রুম্পা জানতে চাইল।
‘একদম ঠিক, শারিয়ার বলল। ‘এবং কাজটা আজকেই করতে হবে। সম্ভব হলে এক্ষুণি। একটা ব্যাপার সবাই মনে রাখবেন, যারাই ডক্টর শশীকে দূরে নিয়ে গিয়ে থাকুক সম্ভবত তারা কয়েক বছর ধরে প্রফেসর আবদেলকে ট্রেস করার চেষ্টা করছিল, পারেনি। না পেরে তারা তার সম্ভাব্য কাছের মানুষ যাদের সঙ্গে ডক্টর যোগাযোগ করতে পারে, তাদের ওপরে নজর রাখছিল। এরপর ডক্টর আবদেল যখন ডক্টর শশীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন সঙ্গে সঙ্গে ওরা ধরে ফেলে এবং তার পিছু নেয়। ডক্টর আবদেলকে কবজা করতে না পারলেও তারা শশীকে ক্যাপচার করতে সমর্থ হয়। কাজেই এর খুবই ডেসপারেট পিপল। আমাদের এক্ষুণি অ্যাকশনে যাওয়া উচিত।’
রুম্পা টমির দিকে ইশারা করে কিছু নির্দেশনা দিল। তারপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘আমরা দশ মিনিটের একটা কফি ব্রেক নেব।’
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, এক কাপ কফি এখন অমৃত মনে হবে,’ শারিয়ার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল রুম্পাকে।
‘আপনাকেও ধন্যবাদ, কেসটাকে একের পর এক সুন্দর ক্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, শারিয়ার আর রুম্পা পাশাপাশি হাঁটছে। ওদের পেছনে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে ভুবন।
‘আরে নাহ, আমি তো আমার কর্তব্য করছি, শারিয়ার মিটিং রুমের বাইরে পরিবেশিত কাপ থেকে কফি নিতে নিতে বলে উঠল
‘আমি একটা সত্যি কথা বলি,’ রুম্পা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সহাস্যে বলে উঠল। ‘আপনাকে যখন এই কেসে আবারও ইনভলভ করতে হলো ঢাকার নির্দেশে আমি খুবই আনহ্যাপি ছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি না থাকলে আমরা কোনো থই পেতাম না। আমি ফ্রাংকলি বলছি, আপনার কাজে আমি সত্যি মুগ্ধ। আসলে পিবিআইয়ের ঢাকা উইংয়ের এত সুনাম শুনেছি এতদিন, কথাটা ভুল নয়।’
শারিয়ার কিছু না বলে স্রেফ মাথা ঝাঁকালো।
‘আপনার কাছে কী মনে হয় ডক্টর আবদেল আসলে-’ সে প্রশ্নটা শেষ করতে পারলে না। মিটিং রুম থেকে কেউ একজন দৌড়ে এসে ডেকে নিয়ে গেল তাকে। ‘আসছি।’ বলে সে কফি কাপ হাতে নিয়ে চলে গেল ভেতরে।
‘কী ব্যাপার, বস? মিষ্টি কথাবার্তা চলছিল দেখলাম,’ বলে সে টেবিলের ওপর থেকে বিস্কিট তুলে কামড় বসাল।
‘বাজে মিষ্টি আলাপ, আমার ভালো চেহারাটা দেখেছে তো… শয়তান চেহারাটা দেখলে ডাণ্ডা মারবে ধরে,’ বল সে ভুবনকে টানতে লাগল। ‘বারান্দায় চল, বিড়ি খেতে হবে,’ বলে সে ভুবনকে টানতে লাগল।
‘আরে আরে কফির কাপটা তো নিতে দাও…’
‘আর শোন, ওই সুমনকেও নিয়ে আয়। আমি দেখেছি ও বিড়ি খায় লুকিয়ে লুকিয়ে,’ বলে সে ফ্লোর সংলগ্ন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করল। ভুবন সুমনকে নিয়ে আসতেই ওদের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিল শারিয়ার।
‘আরে, বস,’ লজ্জা পেয়ে বলে উঠল সুমন।
‘রাখো মিয়া, আগে ধরাও, পরে শরম কইরো,’ বলে শারিয়ার প্যাকেটটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। ‘শাস্ত্রে বলা আছে আগে টানলে পরে বাপের নাম। এখন জিগাইয়া না কোনো শাস্ত্রে আছে,’ বলে সে হেসে উঠল। ওর সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল বাকিদুজনও। ‘সরি, তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম।’
‘না না ঠিক আছে বস, একটা কথা বলতাম-’
‘একটা ক্যান দুইটা বলো,’ শারিয়ার বলল।
‘বস…’ কিন্তু সে কথা বলার আগেই একজন আর্দালি দৌড়ে এসে জানাল রুম্পা ম্যাডাম ডাকছে সবাইকে।
‘চলো চলো দেরি হলে খবর আছে,’ শারিয়ার হাতের সিগারেটে জোরে শেষ টান দিয়ে ওটাকে পিষে এগিয়ে যেতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করল বাকিরা। দ্রুত পা চালিয়ে মিটিং রুমে গিয়ে দেখল রুম্পা আর টমি ব্যস্ততার সঙ্গে কাজ করছে। ওদেরকে দেখে রুম্পা বেশ আফসোসের গলায় বলে উঠল, ‘সরি গাইজ, নিউজ আছে।’
‘কী ব্যাপার?’ শারিয়ার চেয়ার টেনে বসতে বসতে জানতে চাইল।
‘ভালো খবর হলো, বাউন্ডারির ওপাশে কী আছে এবং ওটার মালিক কে আমরা বের করে ফেলেছি। আর খারাপ খবর হলো ওটার ওপাশটা অত্যন্ত প্রভাবশালী একটা পরিবারের সম্পত্তি। ওটা মূলত কনটেইনার রাখার জায়গা আর ওটার সঙ্গে বিরাট এলাকা জুড়ে আছে জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড। আরো খারাপ খবর হলো, ওইখানে ওয়ারেন্ট ছাড়া কোনো কিছুই করার উপায় নেই। আর ওয়ারেন্ট পেতে পেতে কমপক্ষে কাল দুপুর,’ রুম্পা আফসোসের সঙ্গে বলে উঠল।
কিন্তু আজ এরকম দেরি হওয়া মানে অনেক কিছু দেরি হয়ে যাওয়া,’ শারিয়ার কিছু বলার আগে ভুবন বলে উঠল ওর পাশ থেকে।
‘কিন্তু কিছু করার নেই, ওই জায়গাতে হাত দেওয়া মানে আগুনে হাত দেওয়া, রুম্পা জানাল। ‘এমনিতেই যারা ওটার মালিক এরা খুব ফাজিল প্রকৃতির। তার ওপরে এসব ডকইয়ার্ড কন্ট্রোল করে শ্রমিকরা। যারা আবার অ্যাসোসিয়েশন মেইনটেন করে। কাজেই…’ রুম্পা তার কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকাল।
‘কিন্তু…’ সুমনও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বসা থেকে শারিয়ার বলে উঠল। ‘যাক গে, কী আর করা,’ বলে সে উঠে দাঁড়াল। ‘কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। আর সবাই আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। শরীর এবং মাথা ঠিকমতো কাজ করানোর জন্য হলেও বিশ্রাম দরকার আমাদের,’ বলে সে রুম্পার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে সবার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলো মিটিংরুমের বাইরে। বাইরে বেরিয়ে সোজা চলে এলো একটু আগের বারান্দায়।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছিল, পেছন থেকে ভুবনের অবাক গলা শুনে ফিরে তাকাল। ‘তুমি সত্যি সত্যি বিশ্রাম নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছো?’ তার গলায় চূড়ান্ত কৌতূহল। সুমনও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে শারিয়ার বলে উঠল। ‘ভুবন তোর লোকাল কানেকশন কেমন রে? আমার একটা হেল্প লাগবে,’ বলে সে সুমনদের দেখাল। ‘তোমারও।’
ভুবন এবার ভিন্ন প্রকৃতির অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই নাকি? কী বিষয়ে হেল্প? ‘ বলে সে একবার সুমনকে দেখে নিয়ে জানতে চাইল।
শারিয়ার জবাব না দিয়ে মৃদু হেসে উঠল। ‘একটু আগে বলেছিলাম না শয়তানি। সেই শয়তানি করার সময় এসে গেছে।’