অধ্যায় সাতাশ – বর্তমান সময়
পতেঙ্গা রোড, চট্টগ্রাম
জংলা জায়গার অন্যপাশে বিস্তৃত জলাধারটার দিকে বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে শারিয়ার। মেজাজটা পুরোপুরি গরম হয়ে আছে ওর। কারণ ও আসলেই ভাবতে শুরু করেছিল এখানে এসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ধরতে পারছে। সেটা তো হলোই না, বরং এই জলাধারের কিনারায় এসে থেমে যেতে হলো।
‘তো এখন কী?’ শারিয়ারের পাশ থেকে রুম্পা জানতে চাইল।
‘এখন…’ একটু হাতাশ গলায় সে জায়গাটাকে অবজার্ভ করার চেষ্টা করছে। ওরা যেখানে আছে সেদিকটা খোলা হলেও জায়গাটা বেশ বড়ো আর অনেকখানি জুড়ে বাউন্ডারি দেওয়া দেয়াল। জায়গাটা এতটাই বড়ো যে জলাধারের ওপারে বাউন্ডারিটা দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওপাশের দেয়াল খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। সুমন নামের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শারিয়ার জানতে চাইল, ‘এই দিঘির মতো জায়গাটা কীসের, বলতে পারবেন?
‘স্যার, একেবারে সঠিকভাবে বলতে পারব না। তবে যা বুঝতে পারছি এটা একটা প্রাইভেট প্রপার্টি। সম্ভবত পরিকল্পনা করেই করা হয়েছে। ইদানিং এই সিস্টেমটা খুব বেড়েছে, স্যার। শহরের আশপাশের পরিত্যক্ত বা খালি পড়ে থাকা জায়গাগুলোতে প্রক্রিয়া করে মাছ চাষ করা হচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে সামুদ্রিক মাছও। আমার মনে হয় এটাও সেরকমই হবে।’
সুমন ছেলেটার কথাটা পছন্দ হলো শারিয়ারের। ‘ঠিকই বলেছেন,’ এখানেও মাছ চাষ হয়। ওই যে দেখেন,’ জলাধারটাকে পুকুর না বলে দিঘি বলাই ভালো। গোলচে দিঘিটার চারপাশে ছোটো ছোটো বাঁশ পুঁতে কিছু একটা নির্দেশনা দেওয়া। আর দিঘিটার ওপরেও চকচকে ফিতার মতো কিছু একটা দিয়ে লাইন টানা হয়েছে। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে ছোটোবেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল শারিয়ারের। মুখে সামান্য হাসি নিয়ে সে রুম্পার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘ম্যাডাম, কি গ্রামে বড়ো হয়েছেন, না শহরে? পানির ওপরে ওই চকচকে জিনিসটা কী বলতে পারবেন?
শারিয়ারের একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে সামান্য ভ্রু নাচিয়ে সে বলে উঠল, ‘আমি সমুদ্র উপকূল এলাকার মেয়ে। এসব জিনিসের পরীক্ষা আমাদের নিতে নেই। ওটা লাগানো হয়েছে যাতে পাখিরা ভয় পেয়ে দূরে থাকে। মাছ-টাছ খেতে না আসে।’
শারিয়ার হেসে উঠল, ‘ঠিকই বলেছেন, ম্যাডাম। কিন্তু আজকালকার পাখিরা এসব দেখে অভ্যস্ত। এই জিনিস দেখে ওরা কতখনি ভয় পাবে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আচ্ছা, এখানে কোনো পাহারাদার নেই?’ বলেই ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পানির ধারাটা শুরু হয়েছে যতটা দূর থেকে এর মাঝখানে ঘাস আর ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাতলা পায়ে চলা পথটা দেখতে পেল।
‘ধুরো, বিরক্তির সঙ্গে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদিকে ফিরে তাকাল। ‘অকারণে সময় নষ্ট করলাম। আমি ভেবেছিলাম এখানেই পথ শেষ। কেউ এখানে এসে থাকলে এখানেই পথ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু এখান থেকে যে এই পথ দিয়ে খুব সহজেই এদিক দিয়ে এগোনো যেতে পারে ব্যাপারটা মোটেই মাথায় আসেনি,’ বলে ও খানিকটা লাফিয়ে প্রায় অদৃশ্য পায়ে চলা পথটার ওপরে নেমে এলো। সাবধানে আসবেন, ম্যাডাম,’ রুম্পাকে সাবধান করে দিয়ে সুমনের উদ্দেশে বলে উঠল আপনিও আসুন আমাদের সঙ্গে। আর বাকিদের বলুন মূল রাস্তার ওখানে ফিরে গিয়ে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করতে।
শারিয়ার দিঘির পাড়টাকে ডানে রেখে বামের সরু রাস্তাটা ধরে এগোল সামনের দিকে। আসলে এই পায়ে চলা পথটাকে রাস্তা বলার কোনো উপায় নেই সম্ভবত এখানকার কেয়ারটেকার বা এরকম কেউ দিঘির যত্ন নেওয়ার জন্য এদিক দিয়ে চলাচল করে। আর তাতেই পায়ে চলা এই পথটা তৈরি হয়েছে। শারিয়ার খুব বেশি দ্রুতও এগোচ্ছে না আবার এতটাও আস্তে এগোচ্ছে না যে, বেশি দেরি হয়ে যায়। কারণ বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। সন্ধে হতে আর খুব বেশি দেরি নেই
‘আপনার কী মনে হয় মিস্টার শারিয়ার এখানে আসলে আমরা কী পেতে পারি?’ পেছন থেকে রুম্পা জানতে চাইল।
‘কিছুই না, সন্তর্পণে এগোতে এগোতে বলে উঠল শারিয়ার।
‘কিছুই না, তবে?’ আরেকটু হলে রুম্পা এগোতে গিয়ে হঠাৎ উঁবু হয়ে মাটিতে বসে পড়া শারিয়ারের গায়ের ওপরে পড়তে যাচ্ছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে।
‘আবার অনেক কিছুই,’ বলে শারিয়ার ছোটো একটা ডাল দিয়ে মাটির দিকে ইশারা করল। সুমন আর রুম্পা দুজনেই এগিয়ে এসে দেখল মাটিতে আরেকটা পায়ের ছাপ, বুট পরা পায়ের ছাপ। এটাও কোনো না কোনোভাবে বেঁচে গেছে রোদ-বৃষ্টির প্রকোপ থেকে। জিনিসটাকে একটা বড়ো পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শারিয়ার। মুখ-চোখ কুঁচকে আছে ওর। ‘ম্যাডাম, আমি আপনাকে আজ বলেছিলাম না। ক্রাইম সিন হলো পচনশীল মাছের মতো। মাছ যেমন দ্রুত পচতে থাকে তেমনি ক্রাইম সিন দ্রুতই নষ্ট হতে থাকে…’
‘হুমম,’ রুম্পা বলে উঠল।
‘কথাটা ফিরিয়ে নিলাম,’ শারিয়ার মৃদু হেসে বলে উঠল। ‘কারণ মাছ একবার পচে গেলে আর সেটাকে কোনোভাবেই কাজে লাগানো যায় না। কিন্তু ক্রাইম সিন নষ্ট হয়ে গেলেও সেটা থেকে কিছু না কিছু ঠিকই বের করা যায়।’ শারিয়ার পায়ের ছাপটার ছবি তুলে নিল মোবাইলে। সেটা রুম্পা আর সুমনকে দেখাতে দেখাতে বলে উঠল। ‘ওইদিন রাতে এখানে কেউ না কেউ এসেছিল এবং তারা এখান দিয়েই গেছে। আমি অনেকটা নিশ্চিত।’
‘তারা?’ রুম্পা অবাক হয়ে বলে উঠল। ‘বহুবচন কেন? মানে আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন একাধিক মানুষ ছিল?’
শারিয়ার আগে পাওয়া ছাপটার ছবি মোবাইলে দেখাল। তারপর নতুন ছাপের ছবিটা দেখিয়ে বলে উঠল, ‘কী বুঝলেন?’
‘দুটো ছাপ আলাদা পায়ের, মানে আলাদা জুতোর,’ সুমন বলে উঠল।
‘একদম ঠিক, শারিয়ার আশপাশটা দেখে নিতে নিতে বলে উঠল, ‘এখানে একজন নয় বরং একাধিক লোক এসেছিল। কারণ ছাপগুলো দেখে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে, এগুলো এখানে যারা কাজ করে তাদের ব্যবহৃত জুতোর ছাপ। আমাদের দেশের মজুরেরা এসব হেভি ডিউটি বুট ব্যবহার করে না,’ বলে সে আবারও সামনে এগোতে শুরু করল।
‘কিন্তু এখানে আসা কোনো ভিজিটরেরও তো হতে পারে?’ রুম্পা বলল।
‘হ্যাঁ, সেটা হওয়ারও জোর সম্ভাবনা আছে, শারিয়ার চলার গতি বৃদ্ধি করল। ‘আর একারণেই এখানে পাহারাদার বা গার্ড যারাই আছে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি নিশ্চিত, দিঘি যেহেতু আছে আর তাতে মাছও আছে, তবে পাহারাদার থাকতে বাধ্য। কারণ আমাদের দেশের মানুষ এখনো এত ভালো হয়ে যায়নি যে পাহারাদার ছাড়া পুকুরে মাছ রেখে দিবে,’ শারিয়ার এটুকু বলতেই পেছন থেকে সুমন আর রুম্পা দুজনেই হেসে উঠল। ওরা দিঘির পাড়ের রাস্তাটা ধরে এগোতে এগোতে দিঘিটাকে হাতের ডানে রেখে আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে আবারও ডানে মোড় নিল।
‘বাপরে! এত বিরাট জায়গা,’ হাঁটতে হাঁটতে হাঁপাচ্ছে এখন সুমন। ‘ওই যে স্যার, ওইখানে কাউকে পাওয়া যেতে পারে,’ বলে সে দিঘির একপাশে ছোটো একটা ঘাট। আর তার সঙ্গে লাগোয়া ছোটো ঘরের মতো দেখাল। শারিয়ার আগেই দেখতে পেয়ে সেদিকে পা চালাতে শুরু করেছে। বাঁশ দিয়ে বানানো ছোটো একটা সাঁকোর মতো। তবে সেটার পাশেই ছোটো একটা কুঁড়ে আর অন্যপাশে পানির ওপরে একটা ঘরের মতো দেখা যাচ্ছে। ওটার অন্যপাশের পানিতে একটা ছোটো নৌকা ভাসতে দেখা গেল। নৌকাটা দিয়েই সম্ভবত মাছ ধরাসহ অন্যান্য কাজ করা হয়।
‘কী ব্যাপার? কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না,’ রুম্পাও হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠেছে।
শারিয়ার মুখের সামনে দুই হাত জড়ো করে চিৎকার করে উঠল, ‘কেউ আছেন?’ কিন্তু তার চিৎকার বাউন্ডারারির ভেতরে বাড়ি খেয়ে ফিরে এসে যেন ওকেই ব্যঙ্গ করল। আবারও দুবার ডেকে উঠল শারিয়ার, কোনো সারা-শব্দ নেই। আপনাতেই হোলস্টারের ভেতর থেকে পিস্তল বের করে আনল শারিয়ার। কেন জানি সবুজে ঢাকা জায়গাটাতে প্রবাহিত পানির ধারার বহমান শান্তির মাঝে অদৃশ্য এক ধরনের অশান্তি অনুভব করতে শুরু করেছে ও।
‘ব্যাকআপ কল করব?’ রুম্পা জানতে চাইল।
‘রিল্যাক্স, এখনো দরকার নেই,’ নিজে পিস্তল বের করে আনলেও অন্যদের সে মানা করল। ‘আমি স্রেফ একটু সাবধান থাকতে চাইছি,’ বলে সে ঘাটের কাছে এগিয়ে গেল। ঘাটের আশপাশে ছড়ানো-ছিটানো টুকরো টুকরো জিনিসপত্র পড়ে আছে। ঘাটের পাশেই বসার জন্য ছোটো একটা কুঁড়ের মতো। জিনিসটাকে কুঁড়ে না বলে আসলে একটা ছাউনি বলা যেতে পারে বড়োজোর।
‘কেউ থাকলে এখানেই থাকে,’ বলে শারিয়ার ইশারায় ওদের পেছনে থাকতে বলল। তিনজনে মিলে ছোটো বাড়িটার দিকে এগোল। কাছে এগোতেই দেখল পানির ওপরে বাঁশ আর টিন দিয়ে বানানো খুবই সাধারণ একটা বাড়ি। ওটার নিচে ছোটো ছোটো খাঁচার মতো ঝুলছে। সেগুলোতে বেশ কিছু মুরগি কল-কল করছে। গ্রামের বাড়িতে অনেকেই ইদানীং এ-কাজটা করে। পানির ওপরে খোঁয়াড়ে মুরগি পালে। এতে মুরগির বর্জ্য মাছের খাবার হিসেবে সরাসরি কাজে লাগানো যায়। বাড়িটার অর্ধেক ডাঙায় আর বাকি অর্ধেক পানিতে। ডাঙা থেকে বাঁশের টুকরো পাশাপাশি বসিয়ে বাড়িটার ভেতরের দিকে চলে গেছে। ওদের দুজনকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলে হাতে পিস্তল ধরে সাবধানে বাড়িটার দিকে এগোল ও। বাড়ি না বলে একটা রুম বলা উচিত। ভেতরে ঢুকে দেখল একপাশে একটা চৌকি, তাতে দলামোচড়া করে কাপড়চোপড় রাখা। একপাশে একটা মাটির কলস। এই যুগেও মাটির কলস জিনিসটা বেঁচে আছে না দেখলে শারিয়ার ঠিক বিশ্বাস করতেই পারত না। একপাশে একটা চুলা, তার পাশে ভাঙা র্যাকের মতো, তাতে বাসনকোসন রাখার ব্যবস্থা। ঘরটার জানালা দিয়ে অন্যপাশে উঁকি দিয়ে দেখল পুরো দিঘিটা এখান থেকে সুন্দর চোখে পড়ে। নজর রাখার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর হতেই পারে না।
শারিয়ার দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে উঠল, ‘ভেতরে কেউই নেই। এখানে মনে হয় কেয়ারটেকার বা গার্ড থাকে। বাইরে-’ শারিয়ার কথা শেষ করতে পারল না। বাইরে এসে দেখল রুম্পা আর সুমন দুজনেই পানির কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে চোখ গোল গোল করে ফিরে তাকাল দুজনেই।
ওকে উদ্দেশ্য করে সুমন বলে উঠল, ‘স্যার, কেয়ারটেকার এখানে থাকে না, থাকত,’ বলেই বাড়ির নিচের ঘোলাটে ময়লা পানির দিকে ইশারা করল সে। শারিয়ার ভালোভাবে লক্ষ করতেই দেখল ময়লা পানিতে ভাসছে একজন মানুষের লাশ। ‘সর্বনাশ।’
***
সিগারেটে কষে একটা টান দিয়ে শারিয়ার সামনের দিকে মুখ তুলে তাকাল। দিঘিটার পাড়ের একটু আগের সেই শান্ত খোলা প্রান্তর এখন রূপ নিয়েছে কোলাহলমুখর প্রান্তরে। পুলিশের গাড়ি, পিবিআইয়ের গাড়ি, ফরেনসিক সব মিলিয়ে সামনের এলাহি কারবারের দিকে তাকিয়ে শারিয়ারের মুখে খুব অদ্ভুত একটা ভাবনা খেলে গেল। পাশে দাঁড়ানো ভুবনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কেয়ারটেকার লোকটা, মানে যে মারা গেছে, লোকটা কী কোনোদিন ধারণা করতে পেরেছিল তার মৃত্যুতে এত বড়ো বড়ো সরকারি লোকজন এতগুলো গাড়ি এখানে এসে এত কাহিনি করবে? হয়তো লোকটা কোনোদিন এত দামি গাড়িতে চড়েইনি। এরকম একজন মানুষ যে কিনা দিনের পর দিন এখানে একা থাকত, যে লোকটা আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আমরা নোটিশ করতাম না, সেই মানুষটার বিকৃত মৃত্যু তাকে আলোচিত করে তুলল। ব্যাপারটা আসলে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে ভাবা যায়! একজন মানুষের মৃত্যু তার জীবনের চেয়ে অনেক বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করল, এর চেয়ে নিষ্ঠুর আর কী হতে পারে,’ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ওটাকে ফেলে দিল শারিয়ার।
‘কিন্তু তার জন্য এগুলোর কোনোকিছুই আর ব্যাপার না বস,’ ভুবন সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা আনমনেই সে বলে উঠল। ‘জান শেষ তো খেলা শেষ। এখন এখানে কেউ থাকুক আর দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে দাঁড়িয়ে থাকুক ওই মানুষটার জন্য সবই সমান,’ ভুবনের গলায় এক আকাশ উদাসীনতা। ‘তুমি নাকি সেরকম খেল দেখালে সবাই বলাবলি করছে।’
‘হুমম?’ শারিয়ার ঘড়ি দেখে সময়ের হিসেব করছিল। সে শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে একটু চমকে উঠল। একেবারেই ভিন্ন কিছু ভাবছিল ও যে কারণে ভুবনের কথাটা উপলব্ধি করতে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। কথাটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটা আঙুল তুলল। ‘এটা ভালো কিছু নয়,’ বলে সে অদূরেই কয়েকজন ফরেনসিকের লোকের সঙ্গে কাজ করতে থাকা রুম্পার দিকে তাকাল। ‘কেন ভালো না বলছি সেটা পরে বিস্তারিত বলব। এখন আমার বেশ কিছু তথ্য দরকার। কেসটার যত ভেতরে ঢুকছি তত বেশি জড়িয়ে যাচ্ছি ঘটনার সথে। কিন্তু চিত্রটা পরিষ্কার না হয়ে আরো ঘোলাটে হচ্ছে, ব্যাপারটা ভীষণ বিরক্ত লাগছে।’
রুম্পাকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল দুজনেই। ‘মিস্টার শারিয়ার, আপনি যা ধারণা করেছিলেন সেটাই ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বডিটা এখানকার পাহারাদারের। ফরেনসিকের ওরা ধারণা করছে লোকটা খুন হয়েছে…’
‘আজ থেকে দুদিন আগের রাতে। যখন প্রফেসর গাড়ি চাপা পড়ে তার কিছু সময় পরেই,’ বলে ও রুম্পা আর ভুবনের দিকে তাকাল। ‘এই লোকটার মৃত্যু কেসটাকে আরো জটিল আর ঘোলাটে করে তুলবে যদি আমরা এগুলোর সঙ্গে অ্যাডিশনাল কিছু ব্যাপারে সংযোগ না পাই।’
‘অ্যাডিশনাল জিনিস বলতে?’ বলে রুম্পা জানতে চাইল। ‘আপনার কাছে কি মনে হয়, এই লোকটাকে কে বা কারা খুন করল। আর এর খুন হওয়ার পেছনে কারণটাই বা কী?’ রুম্পাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
‘আমি এখানে একটু বলতে চাই,’ ভুবন বলে উঠল। ‘এটা ক্লিয়ার কেস অব কোলাটেরাল ড্যামেজ। মানে লোকটা স্রেফ ঘটনার শিকার ছাড়া আর কিছু না।’
‘কিন্তু,’ শারিয়ার এক হাত তুলে সামনের দিকে দেখাল। ‘সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণ হচ্ছে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্টভাবে জানতে পারছি এখানে কী ঘটেছে। মনে রেখো, এখন পর্যন্ত আমরা স্রেফ দুটো আধা ঝাপসা পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। এ-কারণেই এই মানুষটার মৃত্যু আমাদের কেসের পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে যদি আমরা এখান থেকে কিছু একটা বের করতে পারি। আর না পারলে আমাদের কেসটা আবারও শুরু থেকে শুরু করতে হবে। ম্যাডাম,’ বলে সে রুম্পাকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল।
‘আপনি তো এই কেসের অথরিটি। আপনি ফরেনসিকে যারা কাজ করছে তাদেরকে এই এলাকার প্রতিটা ধূলিকণা পরীক্ষা করতে বলেন। স্পটের প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি জিনিস ঘেঁটে ফেলতে বলেন। ছোটো থেকে ছোটো বিষয় কিছুই যেন বাদ না দেয় ওরা। রুম্পা, মনে রাখবেন, এই জায়গা থেকে আমরা কিছু বের করতে না পারলে আমাদের বড্ড দেরি হয়ে যাবে।’
রুম্পা কিছু না বলে স্রেফ একবার মাথা নেড়ে চলে গেল।
‘বস, ম্যাডামকে কিন্তু খুব একটা সুখী মনে হচ্ছে না,’ ভুবন বলে উঠল ওর পাশে থেকে। কিন্তু শারিয়ার তার কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। সে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিঘি, ওটার সঙ্গে সংলগ্ন এলাকা আর বাড়িটার দিকে। ‘হুমম, আগেই বলেছি সব ভালো ভালো না। বাদ দাও। আমার প্রশ্ন হলো, যদি মানুষটার মৃত্যু কোলাটেরাল ড্যামেজ মানে ঘটনার নিরীহ শিকার হয়ে থাকে তবুও তাকে মরতে কেন হলো? এর জবাব জানতে হবে আমাকে,’ বলতে বলতে সে বাড়িটার দিকে এগোতে লাগল। সেখানে সবাই ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে।
ভুবন আর শারিয়ার পায়ে পায়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। দিঘির কিনারায় দাঁড়িয়ে ভুবন বলে উঠল, ‘জায়গাটা দেখে বস ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তো পাহাড়ি এলাকার ছেলে, আমি আর খালাতো ভাইরা মিলে পাহাড়ের খাঁড়ির ওপর থেকে ছোটো নৌকা নিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে পড়তাম। ব্যাপারটা অনেকটা রোলার কোস্টারের মতো। যেরকম উত্তেজনা সেরকম ঝুঁকি। তখন কি আর এসব মনে আসত,’ বলে সে আনমনে মাথা নাড়ল। ‘নৌকাটা দেখে আমার ইচ্ছে করছে ওটাতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে,’ বলেই সে ঝট করে নৌকাটার দিকে দেখল। ‘বস, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, নৌকাটা কিন্তু পুকুরের ভেতরে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে!’
ভুবনের কথা শুনে শারিয়ার হেসে উঠল। ‘নৌকা কি কোনো প্রাণি নাকি যে এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়াবে, শারিয়ারের পেছনেই ছিল সুমন, সেও হেসে উঠল
‘স্যারের মাথা গরম হয়ে গেছে ডেড বডি দেখে,’ সে হেসে উঠে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভুবনের গরম চক্ষু দেখে থেমে গেল। ‘আরে বস, কথাটা উড়িয়ে দিলেন। ব্যাপারটা খেয়াল করেন, নৌকাটা এখানে কী পারপাসে ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন?’
‘মাছের খাবার দিতে কিংবা মাঝ ধরতে,’ সুমনই বলে উঠল
‘একদম ঠিক, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাহলে নৌকাটা পাড়ে বাঁধা থাকার কথা, ওটা দিঘির মাঝখানে থাকবে কেন?’
‘ভুবন মনে রেখ, লোকটা মারা যাওয়ার পর আজ প্রায় কয়েকদিন পার হতে চলেছে। মাঝে…’ বলে সে থেমে গেল। সুমন ওটাকে এখানে আনানোর ব্যবস্থা করেন,’ সুমন মাথা নেড়ে চলে যেতেই শারিয়ার ভুবনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘তুমি কি ভাবছ ওটা কেউ ব্যবহার…’
‘আমি কিছুই ভাবছি না, বস। ওটা স্রেফ পরীক্ষা করে দেখা দরকার,’ ভুবন সরল মুখে বলে উঠল। পরবর্তী আধা ঘণ্টার ভেতরে নৌকাটাকে টেনে আনা হলো দিঘির পাড়ে। ওটাকে আনার পর ভুবনই ফরেনসিকের একজনকে নিয়ে ওটাতে নামল পরীক্ষা করার জন্য। একটু পরেই সে গ্লাভস পরা হাতে হাসি মুখে তুলে ধরল কিছু একটা। নৌকার পাটাতনের নিচে পড়েছিল জিনিসটা।
কাছে আনতেই রুম্পা বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল, ‘পার্টস। এরকম ব্যাগ তো মেয়েরা সাধারণত হ্যান্ডব্যাগের ভেতরে টাকা বা টুকিটাকি জিনিস রাখার জন্য ব্যবহার করে।’
‘ভেতরে কী আছে, দেখো তো?’ শারিয়ার কিনারা থেকেই বলে উঠল।
‘বস, ভেতরে কিছুই নেই, যা ছিল নৌকার পাটাতনে পড়ে গেছে,’ বলে সে ফরেনসিকের লোকটাকে নিয়ে নৌকার পাটাতন থেকে ভেজা কয়টা নোট তুলে ব্যাগে ভরল। আর একটা লিপস্টিক আর কাজলের ভাঙা পেন্সিল পেল। ‘সাব্বাশ’, ভুবনের খুশির চিৎকার শুনে শারিয়ারও খুশি হয়ে উঠল।
একটু পরেই ভুবন নৌকাটা থেকে উঠে এলো। তার হাতে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ এভিডেন্স ব্যাগের ভেতরে কাগজের মতো সাদা কিছু একটা দেখতে পেল শারিয়ার। হাসিমুখে জিনিসটা শারিয়ার আর রুম্পার দিকে এগিয়ে ধরল ভুবন। ‘বস, তোমার কোলাটোরাল ড্যামেজের প্রমাণ এবং এই কেসের পরবর্তী ভাইটাল পয়েন্ট।’
জিনিসটা হাতে নিয়ে রুম্পা মনোযোগ দিয়ে দেখছে, শারিয়ারও তার পাশে এসে দাঁড়াল। এভিডেন্স রাখার পাতলা স্বচ্ছ ব্যাগের ভেতরে ভেজা একটা আইডি কার্ড। কার্ডটাতে একটা মেয়ের ছবি।
‘কেসের ভাইটাল পয়েন্ট তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রফেসরের ওই বৃষ্টির রাতে বাইরে বের হওয়ার কারণ,’ বলে সে রুম্পার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল।