মগরাজ – ২৬

অধ্যায় ছাব্বিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

জংলাটিলা, সন্দ্বীপ ও সপ্তগ্রামের মাঝের সমুদ্র

অস্তমিত সূর্যের লালিমা দিগন্তের রেখা ছাড়িয়ে লুটিয়ে পড়েছে নীল পানিতে। সেই লালিমার প্রভাবে সমুদ্রের পানি রক্তাক্ত লালকে আক্ষরিক অর্থেই অধিক লাল করে তুলছে। দিগন্তরেখা থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনের পড়ন্ত বিকেলের একরাশ মুগ্ধতার দিকে তাকিয়ে আরকের বোতলে চুমুক দিল পদ্ম। সেই সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল এরকম শান্ত বিকেলের লালচে আলোতেই বদলে গিয়েছিল তার জীবন।

দক্ষিণ উপকূলের চাঁটগাওয়ের অতি সাধারণ এক কায়স্থ তাঁতি পরিবারে জন্ম হয়েছিল পদ্মের। তার প্রকৃত নাম পদ্ম নয়। পদ্মরানি নামটা দস্যু হওয়ার পর সে অর্জন করেছিল নিজের শক্তি আর যোগ্যতা দিয়ে। এর আগে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকার সময়ে তার নাম ছিল করবী। তার তাঁতি বাপ করবী তুলার সুতো দিয়ে বস্ত্র তৈরি করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত বিধায় নিজের তিন ছেলের পর জন্মানো একমাত্র ছোটো মেয়ের নাম রেখেছিল নিজের প্রিয় সুতোর নামে। কিন্তু সে কি জানত যে, নিজের আদরের মেয়ের নাম বেশিদিন তার সঙ্গী হবে না। যে হাত একদিন দক্ষিণের সবচেয়ে মোলায়েম সুতো কাটতে পারতো সেই হাতেই একদিন লোহার তরবারি দিয়ে মানুষের গলা কাটতে হবে।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে-সময়ে পুরো ভারতবর্ষে বাঙ্গাল মুলুকের তাঁতিদের বোনা কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই সুনামে মাত্রা এতটাই বেশি যে, একেবারে মোঘল অন্দরমহল থেকে শুরু করে সাধারণ অবস্থাসম্পন্ন গোমস্তা পরিবারে পর্যন্ত বাংলার তাঁতিদের বোনা কাপড়ের চাহিদা ছিল। এই কারণেই সবচেয়ে উচ্চমানের মসলিন থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ হাতে বোনা সুতোর কাপড় বোনার কাজ শুরু হয়েছে বাঙলার সর্বত্র। নিঃসন্দেহে এই সমস্ত কর্মযজ্ঞের মূলকেন্দ্র বাংলার রাজধানী ঢাকা আর সোনারগাঁয় হলেও তাঁত সংক্রান্ত বিভিন্ন জিনিস যেমন, তাঁত নির্মাণের জন্য বিশেষ কাঠ, তাঁতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ ধরনের বাঁশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের আর নানান বর্ণের সুতোর চাহিদার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। আর তাই ঢাকা ছাড়িয়ে এই সব জিনিসের চাহিদা ছড়িয়ে পড়েছে একেবারে দক্ষিণের উপকূলে।

যখনই বাঙাল মুলুকের বিখ্যাত কাপড়ের বিষয়ে আলাপ হয় তখনই সবার আগে উঠে আসে মসলিনের কথা। নিঃসন্দেহে মসলিন সেরাদের সেরা হলেও মসলিনের পাশাপাশি বাংলায় আরো অসংখ্য ধরনের কাপড় ছিল, সেই সঙ্গে ছিল নানা ধরনের তাঁতের কারবারি। যারা কাপড় বুনতে পারত তাদের মূল্যায়ন সবচেয়ে সেরা হলেও আসলে বাকি কারবারিদেরও মূল্যায়ন একেবারে কম ছিল না। কারণ এরা ঠিকমতো জোগান না দিলেও তাঁতের কারিগরেরা একেবারেই অসহায়। পদ্মদের পরিবার ছিল এরকমই কারবারের কারবারি। কায়স্থ পরিবার হলেও দাদার আমল থেকে নানা ধরনের সুতোর কারবার করে পদ্মদের পরিবার বেশ অবস্থাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে হুগলী, সপ্তগ্রাম, চাঁটগা তো বটেই তাদের পরিবারের বিশেষ সুতোর চাহিদা ছিল এমনকি সুদূর ঢাকা পর্যন্ত। এর পেছনে কারণও ছিল। সুতো নির্মাণ একটা শিল্প বিশেষ। আর পদ্মের পরিবার ছিল এই শিল্পের আক্ষরিক শিল্পী। দরবারে আম, মলমলে খাস থেকে শুরু করে সাধারণ সুতো পর্যন্ত তৈরি হতো তার পরিবারে। আর এইসব সুতোর কারবারের জন্য ছিল দক্ষ থেকে দক্ষতর লোকজন। পদ্মের পরিবারের তুলনায় তার মায়ের পরিবার ছিল খানিকটা নিচু জাতের কিন্তু পদ্মের মাকে তার বাবা বিয়ে করেছিল কারণ পদ্মের মায়ের সুতো চেনা থেকে শুরু করে সুতো নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা ছিল। এই ব্যাপারটা এমন যে, সবাই চাইলেই করতে পারে না। এর জন্য বিশেষ অনুভূতি শক্তি এবং সেই সঙ্গে বিশেষ আঙুল লাগে। একজন শিল্পীর যেমন গানের গলা লাগে, চিত্রকরের লাগে বিশেষ হাত, এই ব্যাপারটাও ঠিক তেমন। তিন ছেলে জন্মের পর পদ্মের জন্ম হওয়ার পর তার বাবা বিশেষ খুশি হয়েছিল কারণ একটা মেয়ের জন্য তার অপরিসীম ভালোবাসা তো ছিলই সেই সঙ্গে পদ্মের জন্ম হতেই তার চিকন চিকন সরু আঙুল দেখেই তার বাপ বুঝতে পেরেছিল মেয়ে জন্মগতভাবেই মায়ের দক্ষতা নিয়ে জন্মেছে। এ মেয়ে একদিন দক্ষিণের সেরা সুতোর শিল্পী হবে।

বাস্তবিক অর্থে হতেও যাচ্ছিল তাই। জন্ম থেকেই পদ্ম বেড়ে উঠছিল নানা ধরনের সুতো আর সুতোর কারবারের ভেতরেই। চার বছর বয়সের সময়েই সে প্রথম সুতো চিনতে শিখে যায়। তার বয়স যখন বারো তখন সে শুধু সুতো নয় বরং সুতো নির্মাণে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পুরো দক্ষিণের অঞ্চলে। একদিকে বলতে গেলে সুতোর দক্ষ শিল্পী আর অন্যদিকে বাপের আদরের দুলালি হিসেবে বড়ো হয়ে উঠছিল পদ্ম। এমন সময় স্বাভাবিক নিয়মেই পনেরো বছর বয়সের সময়েই তাদের নিজেদের গ্রামেরই এক কাপড়ের কারবারি পরিবারের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তার। পদ্মের জীবনটা খুবই সাধারণ আর সুখী ছিল। কারণ নিজের জামাই বাড়ির দু-বাড়ি পরেই নিজের বাপের বাড়ি। সেই সঙ্গে তার পরিবারে সঙ্গেই যৌথ কারবার নিজের শ্বশুরবাড়ির। সেই সঙ্গে পদ্মের সংসার জীবন শুরু করার আগেই নিজের স্বামীর প্রেমে পড়ে যায়। পদ্মের স্বামী তার চেয়ে বড়োজোর বছর দুয়েকের বড়ো হবে। সে সময়ে ছেলেমেয়েদের এমন বয়সেই বিয়ে দেওয়া হতো।

পদ্মের স্বামী মোহন ছিল গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র ছেলেদের একজন। বিয়ের পরে পদ্ম শুধু সংসারই করছিল না সে বাপ আর শ্বশুরের সঙ্গে সুতোর কারবারিতেও অংশীদার ছিল। আর তার স্বামী নিজের বাপ মানে পদ্মের শ্বশুরের কাছ থেকে ধীরে ধীরে শিখে নিচ্ছিল কাপড়ের কারবার। এরই মাঝে বিয়ের বছর দুয়েকের ভেতরেই পদ্মের কোলজুড়ে আসে তার প্রথম সন্তান। নিজের স্বামী-সংসার আর ছেলেকে নিয়ে পদ্মের চেয়ে সুখী কেউ ছিল না কর্ণফুলীর তীরে।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবসা থেকে শুরু করে চাষবাস সব কিছুতেই আক্ষরিক অর্থে সোনা ফলছে। কিন্তু শান্তি নেই বাংলার মানুষদের জীবনে। স্রেফ বহিরাগতদের কারণে। একদিকে দিল্লিতে উত্থান-পতন বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছে বাংলার মসনদ। আবার এদিকে বারো ভূঁইয়া আর অন্যদিকে একে একে আসতে শুরু করেছে সাদা চামড়ার উৎপাত। সবার নজর ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করে সুখী সমৃদ্ধ বাংলার দিকে। বিশেষ করে বাংলার দক্ষিণ উপকূল উত্তাল হয়ে উঠেছে পর্তুগিজ আর মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে। অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত নিষ্ঠুর এসব দস্যুদের অত্যাচারে অস্থির হয়ে উঠেছে উপকূলীয় অঞ্চল। আর দিনে দিনে এতটাই বেড়ে চলেছে এদের সাহস যে, এরা ধীরে ধীরে সমুদ্র অঞ্চল তো বটেই এমনকি নদীপথ আর খাল-বিল বেয়ে ঢুকে পড়তে শুরু করেছে বাংলার ভেতরের দিকে।

এ ফিরিঙ্গি দস্যুদের কথা নিজের স্বামী আর শ্বশুরের মুখে শুনলেও নিজেকে এসব দস্যুর খপ্পরে পড়তে হবে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি পদ্ম। আজ ও মনে পড়ে তার জীবনটা যেদিন এলোমেলো হয় গেছিল সেদিন ছিল বছরের উষ্ণতম দিন। বিরাট একটা কাপড়ের চালান নিয়ে তাদের পরিবারের দুটো বড়ো বড়ো ব্যাপারি নৌকা রওনা দেওয়ার কথা ছিল সপ্তগ্রামের উদ্দেশে। আর তাই কয়েকদিন ধরে টানা কাজ করে চলেছিল ওদের পরিবারের সবাই। প্রতিদিন বেলা ওঠার আগেই কাজ শুরু করত, আর সেই কাজ চলত একেবারে সন্ধ্যা অবধি। সেদিনও তারা সবাই সেই ভোর থেকে কাজ করছিল। কারণ সেদিন দুপুরের পর থেকে কর্ণফুলীর জোয়ার ধরার জন্য দুপুরের ভেতরেই নৌকা বোঝাই করার কথা ছিল। তার আগের দিন গভীর রাত অবধি কাজ করার পর আবার খুব ভোরে উঠে কাজ শুরু করেছিল সবাই। প্রথমে সুতোগুলো শেষবারের মতো পরখ করে সেগুলো ধরন অনুযায়ী আলাদা করা। তারপর সেগুলোর গাটছড়া বাঁধা। তারপর সেগুলোকে নির্দিষ্ট বাঁশের খোলের ভেতরে ভরা। তারপর আবার সেই বাঁশের খোলের ওপরে আলাদা আলাদা করে নিশান লাগানো। সব শেষে বাঁশের খোলগুলাকে আবার একসঙ্গে করে নৌকায় বোঝাই করা।

এই সমস্ত কাজের ভেতরে পদ্মের কাজের পরিমাণই ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ তাকে একাই প্রথমে সুতোগুলোকে পরখ করে সেগুলোকে ধরন অনুযায়ী আলাদা করতে হতো। এই কাজটার জন্য না পদ্মের শ্বশুর না তার বাবা কিংবা স্বামী কেউই তাকে ছাড়া অন্য কারো ওপরে ভরসা করতে পারত না। আর তাই ভোরবেলা সবার আগে কাজ শুরু করতে হতো ওকে। প্রতিটা সুতোর গাঁটে হাত বুলিয়ে সেগুলো পরখ করতে হতো তাকে। পরখ করে আলাদা করার পরেই শুরু হতো বাকিদের কাজ। আর তাই তাকে কাজ শুরু করতে হতো সবার আগে।

যাই হোক সেদিন ভোর থেকে কাজ শুরু করে একেবারে দুপুরের ভেতরে মাল বোঝাই হতেই আবার শুরু হতো তিন নৌকার লোকজনের জন্য খাবার প্রস্তুত করার কাজ। সবশেষে সবাইকে খাইয়ে নৌকায় তুলে বিদেয় জানিয়ে পদ্মসহ বাড়ির বৌ-ঝিরা মিলে শেষ বিকেলে গিয়েছিল নদীতে গোসল করতে।

সারাদিনের অসহ্য ক্লান্তি শেষে বিকেলে ঠান্ডা পানিতে গা জুড়িয়ে গোসল সেরে পদ্ম ভাবছিল বাড়ি ফিরে ভালোভাবে খেয়েদেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে। এমন সময় সাক্ষাৎ যমদূত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপরে।

বাকিদের সঙ্গে নদীতে গোসল সরার সময়ই ওরা দেখতে পেয়েছিল দুটো কোষা নৌকা এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। আর তাতে চট মুড়ি দিয়ে বসে আছে পনেরো-বিশজন মানুষ। বিষয়টা কেউ খেয়ালও করেনি, পাত্তাও দেয়নি। কারণ এরকম অসংখ্য নৌকা প্রতিদিন ঘাটে আসে যায়। এগুলো বেশিরভাগই দূরের সমুদ্রের পানিতে নোঙর করা সদাগরি জাহাজ থেকে নেমে আসা নৌকা হয়ে থাকে। এই নৌকাগুলো যে সাধারণ কোনো নৌকা নয় সেটা ধরতে পারেনি কেউই। এমনকি ঘাটের প্রহরীরাও না।

হার্মাদ ডাকাতদের উৎপাতের কথা শুনলেও, গ্রামের লোকজন জানত যে এসব দস্যুরা উৎপাত চলায় দূরের সমুদ্রে। এরা যে এত ভেতরের গ্রাম পর্যন্ত চলে আসবে কেউ ভাবতেও পারেনি। কোষা নৌকা দুটো ঘাটের কাছে আসতেই চট মুড়ি দেওয়া লোকগুলো গায়ের ওপর থেকে চট ফেলে সোজা হয়েই বন্দুকে গুলি ছুড়তে শুরু করে ছাপিয়ে পড়ে ঘাটের লোকজনের ওপরে। যাকে সামনে পায় হয় গুলি চালায় আর না হয় তলোয়ারের কোপে মাথা আলাদা করে দেয়। সেই সঙ্গে চলে গণহারে আগুন লাগানো। প্রথমে এই কাজটা তারা করে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য। এরপরেই তারা বেছে বেছে মনুষকে ধরতে শুরু করে। একটু শক্ত সমর্থ হলেই বন্দি করে। কারণ মানুষই তাদের কাছে সবচেয়ে দামি লুটের সামগ্রী।

পদ্মেরা এসব কিছুই জানে না। কারণ তারা ছিল ঘাট থেকে খানিকটা দূরে। গোসল সেরে উঠে আসতে গিয়ে প্রায় তিরের কাছে চলে এসেছে এমন সময় পদ্মের পরনের শাড়ি আটকে যায় কিছু একটার সঙ্গে। বারবার টেনেও শাড়ির আঁচল ছোটাতে না পেরে সে চোখ ফিরিয়ে দেখে লম্বা-চওড়া চুল দাড়িতে ভর্তি দানবের মতো এক লোক এক হাতে তার শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছে অন্য হাতে বিরাট একটা তলোয়ার। এরকম কোনো মানুষ পদ্ম কোনোদিন দেখেনি। এরকম ভয়ংকর এক লোক তার শাড়ির আঁচল ধরে রেখেছে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারানোর দশা হয় তার। আঁচল ছাড়ানোর জন্য টানাটানি করবে, নাকি পালাবে বুঝে ওঠার আগেই আরেকজন উদয় হয় সেখানে। দুজনে মিলে টানাটানি করে শাড়ি খুলেই ফেলে তার গা থেকে। একদিকে যুগপৎ আতঙ্ক অন্যদিকে ঘৃণা, লজ্জা আর ভয়ে প্রায় মরার দশা হয় তার। সেই সঙ্গে চারপাশের আগুন আর দানবের উল্লাস ধ্বনির মাঝেই যে শক্তি অবশিষ্ট ছিল সেটাকে এক করে শাড়ি খুলে যেতে সে দৌড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু কাদার ভেতরে কয়েক পা যেতেই তাকে এসে ধরে ফেলে দুই দানব। দুজনেই পাঁজাকোলা করে তাকে নৌকার পাটাতনে নিয়ে ফেলে রাখে।

ব্যথা, ভয় আর আতঙ্কের ভেতর পদ্মের চোখে শুধু ভাসছিল তার ছেলেটার মুখ। সেই অবস্থাতেই সে দেখতে পায় তারই গ্রামের আরো অনেককে বন্দি করে এনে ফেলে রাখা হয়েছে নৌকার পাটাতনে। সবাইকে গণহারে চাবুক মারতে মারতে নৌকার পাটাতনের কাছে স্তূপের মতো রেখে নৌকা ছেড়ে দেওয়া হলো। কোনোমতে একটুখানি মাথা তুলে পদ্ম দেখতে পেল তার গ্রাম, তার শৈশব, নিজের সাজানো সংসার আর সন্তানকে ফেলে নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে অজানার পানে যাত্রা শুরু হয়েছে তার।

হার্মাদ আর মগদের নিয়মই হলো কোনো না কোনো গ্রামে বা হাটে ঝটিকা সফর চালিয়ে যত দ্রুত সম্ভব লোকজন বা নগদ সম্পদ যা পাবে নিয়ে নৌকায় করে দ্রুত সরে পড়া। পদ্মদের নিয়ে আসা নৌকাটা জাহাজের কাছে আসতেই জাহাজের নিচের অংশে খোলের কাছে একটা অংশ আলগা হয়ে গেল।

ঠিক যেভাবে জানোয়ার তাড়ানো হয় সেভাবেই তাড়িয়ে চাবুক মারতে মারতে তাদেরকে নৌকা থেকে নিয়ে ঢোকানো হলো সেই খোলের ভেতরে। জাহাজের অন্ধকারের ভেতরে নিয়ে তাদের সারি দিয়ে দাঁড় করানো হলো। দুইপাশে পর্তুগিজ আর মগ দস্যুদের প্রহরীরা ইচ্ছেমতো চাবুক মারছে একে-ওকে। মেয়েদের ওপরে চলছে গণহারে ধর্ষণ। আর মেয়েদের ভেতরে যারা তখনো দাঁড়ানো, যত্রতত্র যে যাচ্ছে গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাদের বুক টিপে দিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি তো আছেই। সব মিলিয়ে নরক বলতে যা বোঝায় সেটাই নেমে এসেছে জাহাজের খোলের ভেতরে।

শরীরের ওপর ইচ্ছেমতো অত্যাচার চললেও তখনো পদ্ম দাঁড়িয়েই ছিল। কিন্তু সে দেখতে পায় তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই দুই দস্যু আর নিজেদের ভেতরে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছে। বন্দিদের দাঁড় করানো সারিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বন্দিদের একে-একে তাদের হাতের তালুতে ফুটো করে সেটার ভেতর দিয়ে লোহার শিকল গলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারিতে এগোতে এগোতে পদ্মের সময় চলে এলো। কিন্তু তার হাতের তালুতে ফুটো করা হবে এমন সময় কেউ একজন তার হাত চেপে ধরল। পদ্ম দেখল সেই দুই দস্যুর একজন, অন্যটাও আছে ঠিক পেছনেই, তাকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো জাহাজের পাটাতনের ওপরে। তবুও এই বিপদের ভেতরেও খোলা বাতাসে এসে একটু হলেও স্বস্তি পেল সে।

তাকে দুই দস্যু মিলে টানতে টানতে নিয়ে এলো পাটাতনের ওপরে, যেখানে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চাকতি লাগানো থাকে। ঠিক সেখানে এনে তাকে বেঁধে ফেলা হলো একটা খুঁটির সঙ্গে। কী হচ্ছে কিছুই ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও অচেনা দুই দস্যুর ঝগড়া থেকে পদ্ম অনুমান করল দুই দস্যুর ভেতরে সম্ভবত তাকে নিয়ে ঝগড়া চলছে। একজন দাবি করেছে সে তাকে আগে দেখেছে। অন্যজনের দাবি

সে তাকে আগে ধরেছে। এসব অবশ্য পদ্মের বোঝার কথা নয়, সে বুঝতেও পারেনি। শুধু অনুধাবন করল, সে মাঝখানে অর্ধনগ্ন অবস্থায় একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। আর তাকে মাঝখানে রেখে তুমুল ঝগড়া করছে দুই দস্যু। বাকি আরো অনেকেই চারপাশ থেকে হাসিমুখে মজা দেখছে। একজন মানুষের চূড়ান্ত অপমান আর বেদনা যে অন্য অনেকের জন্য আনন্দের অভিজ্ঞতা হতে পারে, এটা প্রথমবারের মতো সেদিনই অনুধাবন করতে পারল পদ্ম। তবে সে জানত না, তার অনুধাবনের তখনও অনেক পথ বাকি।

চারপাশ থেকে হর্ষধ্বনি ভেসে আসছিল কিন্তু হঠাৎই সব কোলাহল একেবারে থেমে গেল একটা ভারী পায়ের শব্দে। পদধ্বনিটা ভেসে আসছিল ওপরের কাপ্তানের কামরার কাছ থেকে। প্রথমেই রেলিংয়ের ওপরে দেখা দিল এক রাশ ধোঁয়া, তারপর লাল কাফতান পরা একজন মানুষের বুট পরা পা দেখা গেল প্রথমে তারপর তার চামড়ার পোশাক পরা অস্ত্রসজ্জিত ভারী পোশাক পরা দেহটা দেখা গেল। আর তখুনি প্রথমবারের মতো মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাতে সমর্থ হলো পদ্ম।

একজন মানুষ তিনজন মানুষের সমান হতে পারে এরকম সে শুনেছিল। কিন্তু নিজ চোখে কোনোদিন দেখবে বলে ভাবতে পারেনি। কিন্তু তাই দেখতে পেল। মুখের চারপাশে উড়ন্ত ধোঁয়ার বলয় নিয়ে একজন বিরাটাকায় মানুষের ভারী পায়ের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল বাকি সব কোলাহল। পদ্ম পরে জেনেছিল মানুষটার নাম সিলভেরা। মানুষটাকে নেমে আসতে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেছে। মগ-পর্তুগিজ, দেশি-বিদেশি, সাদা-বাদামি সব দস্যু একেবারে চুপ হয়ে গেছে। লোকটা নিচে নেমে এসে একবার খুঁটিতে বাঁধা অর্ধনগ্ন পদ্মকে দেখল আরেকবার সে তাকাল দুই দস্যুর দিকে। যদিও তারা তখন আর ঝগড়া করছিল না কিন্তু এদেরকে দেখেই সিলভেরা মুহূর্তের ভেতরেই বুঝে গেল আসলে হচ্ছেটা কী। কারণ এরকম ঘটনা নতুন নয়। সে নিচে নেমে মুখ থেকে ধোঁয়া টানার কালো সরু নলটা সরাল। তারপর বড়ো বড়ো করে ভিন্ন ভাষায় কিছু একটা বলে গেল একটানা। তার কথা শেষ হতেই সবাই সমস্বরে আনন্দধ্বনি করে উঠল। ঘোষণা শেষ করে সে একবার পদ্মকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রওনা দিল ওপরের দিকে।

তার থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই পদ্ম দেখতে পেল, দুই দস্যুর একজন তার কাপড় খুলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। কাপড় খোলা হতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল পদ্মের ওপরে। সেদিন খুঁটিতে বাঁধা পদ্মকে ঠিক কতোজন ধর্ষণ করেছিল ঠিক মনে নেই ওর। বুঝতেও পারেনি। প্রথম দুই তিনজনের সময় তার কষ্ট হয়েছিল, যন্ত্রণা হয়েছিল। পরে সবকিছু ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে আসতে থাকে। শেষদিকে সে কিছুই টের পায়নি। এরপরে অনেকবার জ্ঞান হারিয়েছে, আবার ফিরে পেয়েছে। শেষবার যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন রাতের কালো আকাশ ভেদ করে তিরের মতো ছুটে আসছে পানির ধারা।

আসলে বৃষ্টি পড়ছিল তীব্র বেগে। সে ভেবেছিল মরে গেছে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরে সে হাত-পা নাড়াতে পারছিল। অবাক হয়ে দেখে, তখনো সে খুঁটির কাছেই পড়ে আছে। দুলনিতে বুঝতে পারে জাহাজ চলছে। কিন্তু তার হাত পা খোলা। নিজের রক্তের ধারার ওপরেই শুয়ে আছে সে। কোনোমতে শুয়ে শুয়েই মুখ খুলে বৃষ্টির পানি খেতে থাকে। তীব্র ঘৃণা আর যন্ত্রণায় পুড়তে থাকা গলা-বুক বেয়ে নেমে যেতে থাকে পানির ধারা। তৃষ্ণা মিটে যেতেই সে অনুভব করে বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছে আর উপায় ফুরিয়েছে তার জীবনে। কাজেই এবার মুক্তির পথ তার জন্য একটাই। মৃত্যু। কিন্তু সে তো জানত না শুধু এবারই নয় বরং জীবনে আরো বহুবার তাকে মৃত্যুর চেষ্টা করতে হবে। কাজেই প্রথমবারেই সফল হলে চলবে কীভাবে।

কোনোমতে হাত-পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আহত বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যায় সে জাহাজের রেলিংয়ের কাছে। তারপর ওটা টপকে পড়ে যায় অথৈ জলের রাশিতে। বৃষ্টি আর স্রোতের টান তাকে গিলে নেয় পুরোপুরি। নিজেকে সমুদ্রমাতার বুকে বিলিয়ে দিয়ে পরম শান্তিতে চোখ বুজে পদ্ম। শেষবারের মতো নিজের সন্তানের চেহারাটা একবার মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা করে পানিতে তলিয়ে যায় সে।

তার ঘুম ভাঙে আধো কাদার ভেতরে নিমজ্জিত অবস্থায়। ভেবেছিল মারা গেছে সে। কিন্তু চোখ খুলে সে সামনে দেখতে পায় দুজন মানুষ খানিকটা দূর থেকে অবলোকন করছে তাকে। কোনোমতে সামান্য হাত-পা নাড়তে পারে সে। সে হাত নাড়তেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো বুঝতে পারে বেঁচে আছে সে। দুজনেই দৌড়ে এসে পুরেপুরি নগ্ন পদ্মকে উদ্ধার করে সেই আধো জল-কাদার ভেতর থেকে। তাকে নিয়ে তোলা হয় একটা নৌকাতে। প্রথমদিন সে কিছু বুঝতেই পারেনি। কোনোমতে তাকে যতটা পারে পরিষ্কার করে কিছু একটা খেতে দেওয়া হয়। সেটা খেয়ে ঘুম দেয় সে। লম্বা ঘুম দিয়ে ওঠার পর কিছুটা বল পায় সে। নৌকার পাটাতনের কোনায় সামান্য আড়ালে খড়ের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে সে। ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পায় সামান্য খাবার রাখা আছে তার মাথার কাছে। শুধু তাই নয় তার পরনে প্যাঁচানো আছে একটা শাড়ির মতো কাপড়। হাপুস-হুপুস করে খাবারগুলো খেয়ে খানিকটা বল পেয়ে সে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পায়, নৌকাটা একটা দ্বীপের পাড়ে, নোঙর ফেলা। নৌকার মাল্লারা তাকে দেখে ফিরে তাকায় সবাই। তাদের কাছেই সে জানতে পারে, এটা সপ্তগ্রাম আর হুগলীতে যাতায়াতকারী একটা সদাগরি নৌকা। যাত্রাপথে খাবার আর বিশুদ্ধ পানির জন্য থামে এই দ্বীপে। সে-উদ্দেশে এখানে থেকেই দ্বীপের কিনারায় তাকে দেখতে পায় তারা।

পদ্ম কী বলবে বুঝতে না পেরে ধন্যবাদ জানানোর চেষ্টা করে লোকগুলোকে। জীবনে যে মানুষ কোনোদিন বাইরের পরপুরুষের সামনে কথাও বলেনি সে মানুষ হুট করে এই অবস্থায় এতগুলো পরপুরুষের সামনে স্বচ্ছন্দে কথা বলে উঠবে এটা ভাবাও যায় না। মানুষগুলোর প্রতি মন থেকেই সে শ্রদ্ধা অনুভব করছিল। কিন্তু সেটা কেটে যায় বেলা আরেকটু ফুরোতেই।

আসলে পদ্ম যাদেরকে উদ্ধারকারী রক্ষক ভাবছিল তারাই রাত হতেই পাটাতনের আড়ালে যেখানে সে আছে সেখানে হানা দেয় একে একে। নিজেদের আদিম ক্ষুধা মেটাতে একজন একজন করে প্রবেশ করতে থাকে সেই আড়ালের খোপে। সেদিন আরেকবার পদ্ম অনুভব করতে পারে মানুষ সুযোগ পেলে কতটা ইতর শ্রেণির প্রাণিতে পরিণত হতে পারে। যাদেরকে রক্ষক ভেবে সে পুজো করতে যাচ্ছিল তারাই ভক্ষকের মতো তাকে ভোগ করতে থাকে একের পর এক।

সেই সদাগরি নৌকাতে সাত দিন ছিল সে। সদাগর শেঠ থেকে শুরু করে মাল্লারা কেউই বাদ যায়নি তাকে ভোগ করতে। একপর্যায়ে সে যখন ভাবছিল আরেকবার তাকে মরতে হবে এমন সময় দিগন্ত রেখায় দেখা দেয় হুগলী। লোকগুলো তাকে হুগলীর বাজারে বেচে দেয় দাসী হিসেবে।

সেখানে শুরু হয় পদ্মের আরেক নতুন জীবন। হুগলীর বাজারের দাস ব্যবসায়ীরা একেবারেই পেশাদার। পেশাদারের মতোই তাকে সাজিয়ে বাজারে তোলে তারা। কিন্তু দেখতে ভালো হওয়ার পরও কোনো অদ্ভুত কারণে তাকে প্রথম দুই দিনে বেচতে পারে না তারা। তৃতীয় দিনে যখন তাকে বাজারে তোলা হয় ততক্ষণে বেলা প্রায় ফুরোবার পথে। এই কয়দিনের জীবনে পদ্ম পুরোপুরি নিরাসক্ত হয়ে গেছে। তার মনে তখন একটাই ভাবনা। যেকোনো সময় আরেকবার সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে আবারও মরার চেষ্টা করবে। তার বেঁচে থাকার সমস্ত কারণ শেষ হয়েছে। সে জানতে পেরেছে যেই তাকে কিনে নিয়ে যাক, হয় তাকে নিজের হারেমে নিয়ে তুলবে, আর না হয় কোঠায় বসাবে। আর না হয় রোসাঙ্গের বাজারে নিয়ে আরেকটু বেশি দামে আবারও বেচে দেবে।

তৃতীয় দিনে বাজারের একেবারে শেষ মুহূর্তে বেলা যখন প্রায় ফুরোবার পথে এমন সময় দাসের হাটের পাশ দিয়ে এক ব্যাপারী যাওয়ার পথে চট করে থেমে যায়। পদ্মকে তখন দাঁড় করিয়ে বিক্রির অয়োজন চলছে। বয়স্ক লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায়, সে ব্যবসায়ী। অনেক লোক-লস্কর আর কুলি তার সঙ্গে। মালবহন করছে। দাড়িওয়ালা লোকটা তামাক টানতে টানতে হাটে এসে দাঁড়িয়ে পদ্মের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পদ্ম অবাক হয়ে দেখে লোকটা তাকে প্রচলিত দামের চেয়ে বেশ অনেকটাই বেশি দামে কিনে নেয়। তাকে নিয়ে তোলা হয় লোকটার সদাগরি নায়ে। পদ্ম জানত রাত হলেই আবারও আসবে হায়নারা।

সন্ধে হওয়ার পর সত্যি সত্যি সেই লোক হাতে কিছু খাবার নিয়ে প্রবেশ করে বজরার কামরায়। ভেতরে ঢুকে খাবারগুলো রাখতে রাখতে সে বেশ হাসিমুখে জানায় এই কামরাটায় সে থাকে। পদ্ম খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে তাকে কীসের ইঙ্গিত করছে মানুষটা। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায় না তার ভেতরে। মানুষটা আবারও তাকে খাবার খেতে বলে। এবার পদ্ম প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষ হতেই মানুষটার কথা শুনে একেবাবে চমকে ওঠে সে। প্রশ্নটা বুঝতে পারলেও জবাব না দিয়ে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে লম্বা দাড়িওয়ালা মানুষটার দিকে।

‘মা, তোর বাড়ি কই?’

পদ্ম তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। মানুষটা আবারও কথা বলে ওঠে, ‘ভয় পাসনে, মা। তোর বাড়ি বাঙাল মুলুকে আমি সেইটা অনুমান করতে পারি। কিন্তু জায়গাটার নাম তো বলতে হবে তোকে।’

নিজের বাড়ির সামনের নদীর তীর থেকে দস্যুদের হাতে ধরা পড়ার পর কতদিন পার হয়েছে পদ্মের হিসেব নেই। কী ঘটেছে সেটাও পরিষ্কার মনে নেই। কিন্তু একটা পর্যায়ে এটা সে অনুধাবন করতে পারছিল তার আর এই জীবন রাখার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো লোকটার মুখে মা ডাক শুনে এবং বাড়ির কথা শুনে আর নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারে না সে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

লোকটা তাকে সান্ত্বনা দেয়। সে যে বেঁচে আছে এটাই অনেক বড়ো ব্যাপার। পদ্মও একে একে খুলে বলে সব। কী কী হয়েছে। লোকটাও তাকে জানায় সে চাঁটগায়ের ব্যবসায়ী। হুগলী থেকে মাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল এমন সময় হুগলীর বাজারে তাকে দেখে মানুষটার নিজের এক বোনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই বোন নাকি সতেরো-আঠারো বছর বয়সে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছিল। পদ্মকে দেখে তার সেই বোনের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে তাকে কিনে নিয়েছে। পদ্মকে সে নিশ্চিত করে জানায় চাঁটগায়ে ফেরার পথে তাকে বাড়িতে নামিয়ে দেবে সে। মানুষটার কথায় নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে পদ্ম

কিন্তু বাড়িতে আর ফেরা হয়ে ওঠেনি তার। পরবর্তীকালে যা ঘটে সেটা ভাবলেই পদ্ম মাঝে মাঝে চিন্তা করে সে আসলে কাকে বেশি ঘৃণা করে পরদেশি দস্যুদেরকে নাকি নিজের স্বজাতিকে। নিজের সদাগরি নাও নিয়ে একেবারে পদ্মদের বাড়ির ঘাটে গিয়ে নোঙর করে মানুষটা। পদ্ম ভেবেছিল তাকে দেখে পরিবারে সবাই ছুটে আসবে তাকে বরণ করে নিতে। কিন্তু যা ঘটে সেটা তাকে জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষাটা দেয়।

মানুষটার সঙ্গে নিজের বাড়ির কাছাকাছি যেতেই পদ্মের শ্বশুর নিজের লোকদেরেকে নিয়ে তাকে বাধা দেয়। তার সঙ্গে গলা মেলায় গ্রামবাসী। আর নিশ্চুপ থাকে এমনকি পদ্মের নিজের পরিবার, বাবা-মা ও তার স্বামী।

সবাই তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় সে এখন মগদোষী, তাকে এই গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। বাঙাল মুলুকের মানুষেরা চিরকালই উজবুক, তারই আরেক প্রমাণ এই মগদোষী শব্দটি। এই শব্দ পদ্ম আগে শুনলেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি এই দোষে তাকেও দুষ্ট হতে হবে। একজন নারী স্রেফ ভাগ্যের দোষে ভিনদেশি একদল দস্যুর খপ্পরে পড়ে যখন চূড়ান্তভাবে নিগৃহীত হয়ে কোনোমতে যদি জীবন নিয়ে ফিরে আসতেও পারে লোকসমাজে। যেখানে সমাজের উচিত তাকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা সেখানে সমাজ তাকে মগদোষী নাম দিয়ে বিতাড়িত করে দেয়।

মগরা যেসব নারীদের স্পর্শ করে তাদের বলা হয় মগদোষী। এরা হলো সমাজের অস্পৃশ্য মানুষ যাদের আর সমাজে বাস করতে দেওয়া হয় না। মগদোষীদের না থাকে সমাজে বসবাসের সুযোগ, না থাকে ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ, না থাকে আবারও বিয়ে করে সংসার করার সুযোগ। সে-যুগে মগদোষীদের জন্য দুটো পথ খোলা থাকত, হয় আত্মহত্যা আর না হয় দেহপসারিনী হওয়া। পদ্মকেও এই দুটো পথের একটাই বেছে নিতে হতো যদি না সেই সওদাগর তাকে সহায়তা করত।

নিজের গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে পদ্ম সওদাগরের নাওয়ে ফিরে এসে একদিন টানা কাঁদল। এরপরে একটা সময় সে আবারও মরার কথা ভাবল কিন্তু সওদাগর লোকটা তাকে বোঝাল। অনেক সান্ত্বনা দিল, বলল পদ্ম চাইলে তাকে সে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেখানেও সমাজ তাকে একইভাবে গ্রহণ করবে। কিন্তু পদ্ম যদি নিজের পায়ে শক্ত হয়ে বাঁচতে চায় তবে তার জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।

সওদাগর পদ্মকে চাঁটগায়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ফিরে গেল নিজের বাড়িতে। এরপর আবারও একমাস পর ফিরে এলো সে। আবারও সে হুগলী আর সপ্তগ্রামে যাবে। এবার যাওয়ার সময় পদ্মকে নিজের নাওয়ে উঠিয়ে নিল। মানুষটাকে ততদিনে বাপু ডাকতে শুরু করেছে সে। অনেকটা নিজের মেয়ের মতোই তাকে স্নেহ করে আর বাপের মতোই তাকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে পদ্ম। সেখান থেকে নৌকায় করে পদ্ম সন্দ্বীপ, হুগলী ও সপ্তগ্রাম হয়ে অবশেষে ফেরার সময়ে তাকে অদ্ভুত এক টিলাময় জলাধারের ওখানে নিয়ে গেল। সেখানে পাহাড়ের ওপরে একগ্রামে এসে হাজির হলো তারা। সেখানে ভয়ংকর দেখতে একজন মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে জানাল, এখন থেকে এখানেই থাকবে পদ্ম।

তালেব তৈমূর বিদেয় নিতেই ধীরে ধীরে সেই গ্রামে বসবাস শুরু করল পদ্ম। সেখানে সে জানতে পারল জায়গাটার নাম জংলাটিলা। জায়গাটা সন্দ্বীপ, হুগলী আর সপ্তগ্রামের মাঝামাঝি এমন একটা জায়গায় অবস্থিত যে অবস্থানগত কারণে এই এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জঙ্গুলে টিলা এলাকার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে একদল মেয়ে। কারা এরা? এরা সবাই মগদোষী। পরবাসীদের দ্বারা নির্যাতিত বিধ্বস্ত, সমাজ থেকে বিতাড়িত এমন সব মেয়েদের গোপনে স্থান দেওয়া হয় এখানে, এই গ্রামে। আর তাই এই গ্রামের নাম মগদোষীদের গ্রাম। সেখানে নিজের মনের মতো অনেককেই খুঁজে পেল পদ্ম। সেই সঙ্গে আবিষ্কার করল সে যে ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে এরাও সবাই প্রায় একই পথের পথিক। ফলে একজন আরেক জনের দুঃখে সমব্যথী। ফলে এখানে সবার সঙ্গে সবার মিল-মোহব্বত আর অনেক অন্যরকম মিল। ধীরে ধীরে সেখানে বাস করে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করল পদ্ম।

সেখানে মগদোষীদের গ্রামে সবাই সবাইকে বোন ডাকে। বোনেদের সেই গ্রামে বসবাস করতেকরতে পদ্ম আবিষ্কার করল পুরো গ্রাম দারুণভাবে সুরক্ষিত এবং এদের যেকোনো অবস্থা থেকে শুরু করে এমনকি নিজের জাহাজ পর্যন্ত আছে। সেখান থেকে পদ্ম বুঝতে শুরু করল, এটা সাধারণ কোনো গ্রাম নয়। এটা আসলে একটা জলদস্যুদের গ্রাম। সবকিছু জেনে একদিন সে মুখোমুখি হলো গ্রামের মোড়ল ভয়ংকর দেখতে সেই মহিলার, তাকে সে জানাল, সে যুদ্ধে যেতে চায়। মহিলা হেসে উঠে তাকে জানাল, সব হবে।

সেখান থেকেই শুরু হলো পদ্মের নতুন জীবন। সে ধীরে ধীরে শিখল তলোয়ার, বন্দুক থেকে শুরু করে তির-ধনুক এমনকি কামান চালানো পর্যন্ত। শিখল কীভাবে জাহাজ চালাতে হয়, কীভাবে আক্রমণ করতে হয়। এই গ্রামের নারী দস্যুদের কর্তাকে একটা বিশেষ নামে ডাকা হয়। সেটা অনেকটা উপাধির মতোই পদ্মরানি। মনে-মনে নিজেকে সে জানায়, একদিন নিজের যোগ্যতা বলে সে এই উপাধি নিজের করে নেবে। এই গ্রামের নেতা হবে সে।

সে আরো জানতে পারল এই গ্রামের পেছনে চাঁটগায়ের অনেক ব্যবসায়ীদের ভূমিকা আছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলো সেই সওদাগর। একদিকে তারা অসহায় মেয়েদের পুনর্বাসন করে অন্যদিকে এই দস্যুদলের সঙ্গে রয়েছে তাদের গোপন বাহিনী। এই এলাকার সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে হুগলী থেকে ব্যবসায়ীদের চালান নিয়ন্ত্রণ করা এমনি আরো নানা কাজে গোপনে একদিকে তারা ওদের সাহায্য করে অন্যদিকে ওরা এদের রসদ থেকে শুরু করে বাকি সবকিছু দিয়ে সাহায্য করে। আর এই পুরো ব্যাপারটার নেতা হলো সেই সওদাগর। মগদোষীদের গ্রামেই ধীরে ধীরে নিজেকে শক্তিশালী করে তোলে সে এবং একটা সময় পুরো গ্রাম তো বটেই দস্যুবাহিনীর প্রধান হয়ে ওঠে এবং সে পদ্মরানি উপাধি লাভ করে।

যেদিন সে পদ্মরানি উপাধি লাভ করে সেদিন থেকেই পদ্ম জানত সওদাগর তার জন্য যা করেছে সেটার ঋণ তাকে শোধ করতে হবে। সেই সওদাগরই ছিল তালেব তৈমূর, পদ্ম যাকে বাপু বলে ডাকে। আর সেই মানুষটাই আজ বিপদে আছে।

‘রানি মা,’ জাহাজের পাটাতন থেকে থেকে চোখ সরিয়ে পদ্ম দেখল তার বাহিনীর প্রধান হালেমা দাঁড়িয়ে আছে। তার বাহিনীর প্রধান তো বটেই এই বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারীও হালেমা। ‘বলো, হালেমা।’

‘মাতা,’ এইটাই দলের নেতাকে সম্বোধন করার মাধ্যম। ‘খারাপ খবর আছে।’

পদ্ম কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। শোনার অপেক্ষায় আছে সে।

‘কবি ধরা পড়ে গেছে।’

‘এইটা খারাপ খবর না, সে নিজের কোমরে ঝোলানো বোতল থেকে এক ঢোক আরক টেনে নিয়ে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘কবি ধরা পড়বোই, আমি জানতাম। বাপু বুদ্ধিমান মানুষ কিন্তু তাড়াহুড়ায় কিছু ভুল করছেন উনি। উপায়ও ছিলো না তার। খারাপ খবর অইল এখন তার সঙ্গে কী করা অইবে। বাপুর পোলার খবর কী?’

‘তারা রওয়ানা দিছে সন্দ্বীপের দিকে।’

‘আমরাও সন্দ্বীপ যাব,’ পদ্ম ঘোষণার সুরে বলে উঠল। ‘বাপুর পোলা তো গন্ধ শুইকা ঠিকই কবির কাছে পৌছাইয়া যাইব। তারে আমগোর সাহায্য করতে হবে কবিরে উদ্ধার করতে। কবি অনেককিছু জানে, সেইগুলা বাপুর পোলার জানা দরকার।’

‘জি মাতা,’ বলে সে চলে গেলে।

পদ্ম মনে মনে বলে উঠল, নাটক সাজানো হয়া গেছে, এইবার অভিনয়ের পালা শুরু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *