অধ্যায় পঁচিশ – বর্তমান সময়
পতেঙ্গা রোড, চট্টগ্রাম
মাঠে নেমে কাজের আনন্দই আলাদা।
একবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার রাস্তাটার দিকে ফিরে শারিয়ারের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। একারণেই ফিল্ড লেভেল কাজে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ ভয় পায় সেখানে সে অনেক বেশি আনন্দ পায়। আসলে খাতাকলমে কাজ করা এক জিনিস, আর মাঠে নেমে সত্যিকারের পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সবুজে ছাওয়া গাছপালার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া চওড়া সুন্দর রাস্তাটা যেন শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে ভেংচে উঠল। শারিয়ার হাতের স্পোর্টস ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। সন্ধে হতে আর বেশি বাকি নেই। বড়োজোর ঘণ্টা দুয়েক। মিটিং রুমের আলোচনার পর আরো এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
মিটিংয়ে ওর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সবাই তালি দিয়ে ওঠে। ওর বক্তব্যের পর রুম্পা আর তার টিম নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে তাদের কার্যকরণ ঠিক করে নেয়। মিটিং শেষ করার পর ওর নিজের অভিজ্ঞতা আর নোটবুকে নেওয়া নোটগুলো রুম্পার হাতে দিয়ে শারিয়ার কেসের ব্যাপারে তাকে লাক উইশ করার সময় রুম্পা তাকে জানায়, ঢাকায় হেড অফিসে তার কথা হয়েছে, শারিয়ার চাইলে টিমের অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে। শারিয়ার কিছু না বলে চুপ করে থাকে। কেসে কাজ করার ইচ্ছে ওর ফিফটি ফিফটি। যে ড্যামেজ সে করেছিল নিজের অ্যানালিসিস থেকে একটা নতুন অ্যাঙ্গেল দাঁড় করাতে পেরে সেটা সে কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিয়েছে কাজেই এখন এই কেসে সে কাজ করবে কি করবে না সেটা নির্ভর করবে রুম্পার ওপরে। শুধু হেড অফিসে কথা বলে লাভ হবে না। কিন্তু হেড অফিসে কথা বলার পর রুম্পা তালুকদার তাকে এটাও জানায়, তার কেসের উপদেষ্টা কমিটি, এমনকি তার টিমের মেম্বাররাও চাইছে শারিয়ার যেন টিমের অংশ হিসেবে থাকে। এরপরে শারিয়ার রাজি হয়ে যায়।
ওখানে বসেই ওরা পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে কীভাবে এবং কোথা থেকে কেসটা নিয়ে ওরা আগাবে। প্রথমেই টমি এবং তার সঙ্গে আইটি টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফেসরের কাজ এবং তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তথ্য বের করার, বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে তার গণ্ডগোলের ব্যাপারটা নিয়ে বিশদ জানার জন্য। এরপরে ভুবন এবং তার সঙ্গে রুম্পার টিমের আরো তিনজনকে মিলিয়ে একা দল তৈরি করে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় ইনফর্মার, মানে খবরিদেরকে। টিমটা ঠিক করা হয় স্থানীয়দের কথা মাথায় রেখে। ভুবন নিজে স্থানীয় ছেলে সেই সঙ্গে এই টিমে তাদেরকেই রাখা হয় যারা স্থানীয়। কারণ এই কাজটার জন্য ওদেরকে অবশ্যই স্থানীয় লোক হতে হবে। এছাড়া এখান থেকে কোনো কাজ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। এরপরে তিন নম্বর টিমটা বানানো হয় শারিয়ার, রুম্পা আর ফরেনসিকের দুজনকে নিয়ে, এই টিমটা মূলত তাদেরই যাদের ফিল্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি এবং যাদের ট্র্যাকিং এবং ফরেনসিকের ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা আছে। এরা কাজ শুরু করবে স্পট থেকে। একেবারে বাড়ি এবং তদসংলগ্ন রাস্তাটা থেকে। আর পিবিআইয়ের ভেতরে খতিয়ে দেখার জন্যে কোনো টিম বানানো হয়নি, কিন্তু সেখানে খোজ করা হবে ভিন্ন ভাবে। কাজ ভাগ করে দেওয়ার পর পরই তিনটে টিম মাঠে নেমে যায়।
তৃতীয় নম্বর টিমের সঙ্গে পতেঙ্গা রোডের সেই বাড়িতে চলে আসে ওরা। আর সেখানেই এখন রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে শারিয়ার। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ও চলে এলো যেখানে প্রফেসর মারা পড়েছিল সেখানে। রাস্তার ওপরে মানুষের আকৃতির মার্কিং আঁকা রয়েছে, যেখানে প্রফেসরের বডিটা পাওয়া গেছিল। শারিয়ার সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সেখান থেকে রাস্তা আর বাড়িটার দূরত্ব জরিপ করার চেষ্টা করছে।
‘আমাদের লোকেরা মাঠে নেমেছে,’ পেছনে থেকে রিনরিনে গলা শুনে ফিরে তাকাল শারিয়ার। রুম্পা তালুকদার এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে। শারিয়ার ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল মিটিংয়ের সময়ে তাকে যেরকম বিধ্বস্ত লাগছিল এখন ততটা লাগছে না। মেয়েদের এই এক আজব রহস্য, শারিয়ার যেটা আজ ও ধরতে পারেনি। এই এক মুহূর্তে এরা এলোকেশী থেকে মুহূর্তের ভেতরেই রাজরানি। সম্ভবত সে মিটিংয়ের আগে নিজেকে গোছানোর সময় পায়নি কাজের চাপে। এখন অনেকটাই ফ্রেশ লাগছে তাকে দেখতে। শারিয়ার ফিরে তাকাতেই সে মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘আপনি আবার পোশাক নোংরা করতে গেলেন কেন?’
শারিয়ার মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। মিস রুম্পা, মাঠে তো সবে নামলাম আমরা, আরো কত কী যে নোংরা হবে কে জানে,’ বলে সে বাড়িটার দিকে দেখাল, তারপর ফিরে রাস্তার ওপরে যেখানে বডিটা ছিল সেদিকটা দেখাল। কিছু ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আপনি তো জানেনই, ক্রাইম সিন হলো দ্রুত পচনশীল মাছের মতো। যত সময় পার হয় দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করে। আর এখানে তো মনে হয় অনন্ত কাল পার হয়ে গেছে। তার ওপরে আবার ওইদিন রাতে ছিল বৃষ্টি,’ বলে শারিয়ার কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কাজেই এখান থেকে কিছু বের করাটা খুব কঠিন হবে।
হুমম, তাই মনে হচ্ছে,’ রুম্পাও কাঁধ ঝাঁকাল। তবে আপনার কথাটা আমি মানি,’ চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলল সে। ‘প্রফেসর আসলে এখানে কী করছিল সেটার জবাব এখান থেকেই পাবার একটা সম্ভাবনা আছে। আমার ইন্সট্রাক্টর বলতেন, ক্রাইম সিন আর ডিসেকশন টেবিল হলো খোলা বইয়ের মতো। সবই তোমার চোখের সামনে আছে, তুমি কতটা ধরতে পারছ সেটা পুরোপুরি তোমার ব্যাপার। আর তোমার ধরতে পারার ক্ষমতার ওপরেই নির্ভর করবে তুমি কতটা দক্ষ ইনভেস্টিগেটর হতে পারবে।’
রুম্পার কথা শেষ হতেই শারিয়ার হেসে উঠল। ‘আমরা মনে হয় একই ইন্সট্রাক্টরের অনুসারী ছিলাম,’ বলে সেও মৃদু হেসে উঠল
‘তবুও আপনি আজকের মিটিংয়ে যেভাবে পুরো কেসটাকে ‘সোয়াট’ অনুযায়ী সাজালেন এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না।’
‘এটা একেবারে রিসেন্ট সংযোজন, শারিয়ার মাথা ঘুরিয়ে ক্রাইম সিন রেডিয়াসের ভেতরে রাউন্ড আপে থাকা লোকগুলোকে দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘আসলে খুব বেশি সময় পাইনি, যতটা পেরেছি,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল, ‘বলতে পারেন এটা আমার রিডেম্পশন ছিল, কেসটার প্রতি। যে ড্যামেজ করেছি সেটা পূরণ তো সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাকআপ দেওয়ার একটা চেষ্টা বলতে পারেন। আই ওয়াজ ভেরি ইম্পালসিভ লাস্ট নাইট,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল শারিয়ার।
রুম্পা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সে আবারও মাঠে কাজ করা টিমের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইল, ‘ওরা কতটা রেডিয়াস নিয়ে কাজ করছে?’
রুম্পা টকিতে কথা বলল অন্যদের সঙ্গে। তারপর শারিয়ারের দিকে ফিরে জানাল, ‘একশ মিটার রেডিয়াস নিয়ে কাজ করছে পুরো টিম।’
‘হবে না,’ এক বাক্যে মানা করে দিল শারিয়ার। ‘কমপক্ষে পাঁচশ মিটার রেডিয়াস নিয়ে কাজ করতে বলুন। তা না হলে এই ধুয়ে যাওয়া ময়দানে কিছুই পাওয়া যাবে না।’
‘পাঁচশ মিটার টু মাচ হয়ে যাবে,’ রুম্পা মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল। টিম তো একেবারে ছোটো। আপাতত দুইশ বলি।’
শারিয়ার কিছু না বলে মাথা নাড়ল। মনে মনে ভাবল করুক। এখন মানা করতে গেলে বা বাড়াবাড়ি করতে গেলে তো এটাও করবে না। ‘ওরা কাজ করতে করতে বরং চলুন আরো একটু এটা নিয়ে অ্যানালিসিস করার চেষ্টা করি। আপনার সঙ্গে কেস ফাইলটা আছে?’ শারিয়ার রুম্পার কাছে জানতে চাইল।
রুম্পা জবাব দিল, ‘গাড়ি থেকে আনানো যাবে,’ বলে সে টকিতে নির্দেশ দিতেই ড্রাইভার দৌড়ে এসে কেস ফাইলটা দিয়ে গেল। সেখান থেকে শারিয়ার ক্রাইম স্পটে প্রফেসরের পড়ে থাকার ছবিটা বের করে নিল। বৃষ্টির ভেতরে তোলা ছবিটা খুবই অস্পষ্ট, সম্ভবত এটা অফিসিয়াল ছবিও নয়। স্পটে পৌঁছানো কোনো পুলিশের মোবাইল দিয়ে তোলা। তবুও একটা সাক্ষাৎ দলিল তো আছে। শারিয়ার ছবিটা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটাতে চলে এলো। সেখানে এসে মার্কিংয়ের সঙ্গে ছবিটা মিলিয়ে দেখে সেটা ফেরত দিল। তারপর আবারও আগের মতো বাড়িটাকে সোজা একটা লাইন ধরে বডিটা যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙুলি তুলে একটা মাপ দিল সে বডির সঙ্গে বাড়িটার অ্যাঙ্গেলের।
‘রুম্পা, এখানে একটু আসবেন প্লিজ,’ বলে সে নিজের পাশে আসতে বলল রুম্পাকে। রুম্পা এগিয়ে এসে খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে শারিয়ারের পাশে একইরকম হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ‘এখানে দেখুন, প্রফেসরের বডিটা পড়ে ছিল এখানে। আমরা যদি বাড়িটার বের হয়ে আসার পথটাকে এর সঙ্গে স্ট্রেইট লাইন ধরি তাহলে প্রফেসরের বড়ি পড়ে থাকার অ্যাঙ্গেলটা একদম মিলে যায়। কিন্তু এতে একটা সমস্যা আছে, কী সেটা ধরতে পারছেন?’
রুম্পা এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর জবাব দিল, ‘প্রফেসরের বড়ি পড়ে থাকার অ্যাঙ্গেলটা বাড়ির সঙ্গে এতটা মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা তো হওয়ার কথা নয় কারণ, কারণ খুব স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করে প্রফেসরের দেহটা ছিটকে সরে পড়ার কথা। যেখানে তার বডি পাওয়া গেছে সেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার প্রবেশ পথের একেবারে বরাবর কীভাবে হয়?’ রুম্পা চিন্তিত মুখে বলে উঠল।
‘একদম ঠিক, রুম্পা,’ প্রায় বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠল শারিয়ার। সে একটা আঙুল তুলে বলে উঠল, ‘তার ওপরে খেয়াল করে দেখুন ছেলেমেয়েগুলোর গাড়িটা চালাচ্ছিলো প্রায় আশি কিলোমিটারের ওপর স্পিডে। মানে যেটা বলা আছে ফাইলে। গাড়িটা এতটাই জোরে এসে প্রফেসরের দেহে আঘাত করে যে প্রফেসর স্পটেই মারা যায়। এই আঘাতে দেহ এক জায়গায় পড়ে থাকার কোনো কারণই নেই। তাহলে ব্যাপারটা কী?’
রুম্পা আবারও চিন্তিত মুখে বলে উঠল, ‘এর মানে কি ছেলেমেয়েগুলো প্রফেসরের দেহটা সরিয়েছে বা সরানোর চেষ্টা করছিল?’
‘ডিউটি অফিসার যারা ছেলেমেয়েগুলোকে স্পটেই ধরে ফেলে তাদের ভাষ্যমতে ছেলেমেয়েগুলো প্রফেসরকে ধরেছিল কিন্তু তার দেহ সরানোর আগেই পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায়। এরমানে প্রফেসরের দেহ এখানেই ছিল। এই হিসেবে যদি আমরা ক্যালকুলেট করি তবে প্রফেসর যখন ভালো ছিল তার অবস্থান বাড়িটা থেকে কোনো দিকে হতে পারে বলে আপনার ধারণা?’
রুম্পা ভেবে নিয়ে জবাব দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তার ওয়াকিটকি খড়খড় করে উঠল। টকিতে কথা বলে সে শারিয়ারের দিকে ফিরে আফসোসের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কাজ হয়নি। কিছুই পায়নি ওরা।’
শারিয়ার মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ল, ‘গুল্লি মারেন ওদের,’ সে নিজের রুক্ষ স্বরূপে ফিরে আসছে। ‘এক কাজ করেন, ওখান থেকে সেরা দুজন অফিসারকে এখানে চলে আসতে বলেন। বাকিদের বলেন গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করুক।’
রুম্পা টকিতে সেরকমই নির্দেশ দিল। ‘আপনি আসলে কী করতে চাচ্ছেন বলুন তো আমাকে?’
তার দিকে তাকিয়ে শারিয়ার একটা হাসি দিল তারপর বলে উঠল, ‘আমরা একটু জ্যামিতিক মাপজোখ করব। এই ধরেন অনেকটা হাই স্কুলের সম্পাদ্য- উপপাদ্যের মতো। এখন দেখুন,’ বলে সে বডিটা যেখানে ছিল সেদিকে দেখাল। তারপর দেখাল বাড়িটাকে। ‘যতই রাত হোক, আর বৃষ্টি থাক নিশ্চয়ই প্রফেসর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে না এসে উড়ে আসেনি এখানে। তাই না?’
‘নাহ,’ রুম্পার সরল জবাব।
‘ঠিক আছে। তাহলে সোজাসরলভাবে রাস্তা পার হয়ে এলে তার থাকার কথা হয় ওখানে আর না হয় এখানে। ঠিক,’ বাড়িটা থেকে উঠে আসা রাস্তা বরাবর রাস্তা এপার ওপার দুইদিকেই দেখাল শারিয়ার। তারপর রুম্পার জবাবের অপেক্ষা না করে সে এগিয়ে গেল বডিটার দিকে। ‘কিন্তু বডিটা ছিল এখানে। এখন যদি আমি ধরে নেই,’ সে অন্যদিকে দেখাল। ‘ছেলেমেয়েগুলো আসছিল ওদিকে থেকে, আর যাচ্ছিল ওদিকে। তারমানে, সেদিকে যদি এগিয়ে যাই তাহলে যে গতিতে আসছিল সে গতিতে প্রফেসরের দেহে আঘাত লাগলে প্রফেসর অন্তত এতটুকু এদিকে থাকার কথা ঠিক,’ বলে সে প্রফেসরের বডিটা যেখানে পড়ে ছিল সে দিক থেকে গাড়িটা যেদিকে আসছিল সেদিকে এগিয়ে গেল অনেকটা। ‘তারমানে প্রফেসর তার থাকার বাড়ি বরারর ছিল না। সে এদিকে এগোচ্ছিলো।’
রুম্পা খানিকটা সরে এসে শারিয়ারের হাতের দিকে দেখল, তারপর বাড়িটার সঙ্গে অ্যাঙ্গেল মিলিয়ে একমত পোষণ করল। ‘এটাই হতে বাধ্য, তাছাড়া প্রফেসরের বডি যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে যাওয়ার কথা না।’
‘একদম ঠিক,’ বলে সে আবারও হাত তুলে দেখাতে লাগল। ‘একজন স্বেচ্ছাবন্দি লোক যে নিজেকে দীর্ঘদিন ধরে একটা বাড়ির বেইজমেন্টে আটকে রেখেছিল সেই লোকটা এরকম অন্ধকার বৃষ্টির রাতে নির্জনের ভেতরে এখানে কেন আসবে?’
হতে পারে সে কোনো ইমার্জেন্সিতে পড়েছিল। হয়তো সে কোথায় যেতে চাচ্ছিল,’ রুম্পা বলে উঠল। তার অফিসারেরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। তারাও অবাক হয়ে দেখছে শারিয়ারের কাজ।
‘তাহলে সে বাড়ির বেইজমেন্টে থাকা গাড়ি দুটোর একটাও কেন ব্যবহার করল না? মনে রাখবেন, সে কিন্তু চাইলেই সেটা করতে পারত। কারণ ফাইলে দেখলাম দুটো গাড়ির চাবিই ছিল বাড়ির দারোয়ানের রুমে। হয়তো একটু কঠিন হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল। সে সম্ভাবনা যদি বাদ দিই তবে আরেকটা সম্ভাবনাই থাকে,’ বলে শারিয়ার থামল।
‘সে কারো সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল,’ রুম্পা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠল ‘কিন্তু সে জন্য তাকে বাড়ির বাইরে আসতে হবে কেন?’
‘একটা মাত্র ক্ষেত্রেই সেটা হতে পারে, শারিয়ার ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় যেখানে নেমে গেছে সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওদিকটাকে কী আছে। যদি সে কারো পিছু নিয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে যদি সত্যি কারো পিছু নিয়ে থাকে তবে অ্যাক্সিডেন্টের পর মানুষটা গেল কোথায়? সে কি সরে পড়ল অ্যাক্সিডেন্ট হতে দেখে নাকি অন্য কিছু?’
‘এটাই বের করতে হবে আমাদের, কিন্তু কীভাবে সম্ভব?’ বলে রুম্পা বাড়িটার দিকে দেখল তারপর নির্জন রাস্তা আর আশপাশটা দেখে তার অফিসারদের একজনের কাছে জানতে চাইল, ‘সুমন, বাড়িটাতে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলোর কী অবস্থা চেক করেছিলে?’
‘জি, ম্যাডাম,’ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো সুমন ছেলেটা। ‘সবগুলো ভুয়া। লাগানোর পর থেকে একটাও চেক করা হয়নি কিংবা ঠিক করা হয়নি। শুধু লাগিয়ে রাখা হয়েছে দেখানোর জন্য যে ক্যামেরা আছে। আসলে কিছুই নেই।’
‘আশপাশে তো অন্য কোনো বাড়িও নেই কিংবা এটিএম বুথ কিংবা অফিস যে ওগুলোর কোনোটা থেকে কোনোকিছু পাবার সম্ভাবনা আছে,’ আনমনেই বলে উঠল রুম্পা। তারপর শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল, ‘ওমা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
কিন্তু রুম্পার কথার জবাব না দিয়ে শারিয়ার নামতে শুরু করেছে মূল রাস্তাটা থেকে। সে নামতে নামতে থেমে গিয়ে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, যেহেতু ক্যামেরা ফ্যামেরার বালাই নেই কাজেই আর একটাই উপায় আছে, সরেজমিনে পরীক্ষা করা। এখানে দেখুন, যদি প্রফেসর কারো পিছু নিয়ে থাকে তবে মানুষটা যদি মূল রাস্তা ধরে সরে গিয়ে না থাকে তবে সেক্ষেত্রে দেখেন এদিক দিয়ে তার কোথাও না কোথাও সরে পড়ার কথা। যদি তাই হয়ে থাকে তবে রাস্তার এদিকে-ওদিকে দুদিকে দেখলে ওইপাশে যেহেতু বাড়ি কাজেই এদিকটাই ভরসা। সমস্যা হলো বৃষ্টির কারণে সব ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু এখানে দেখেন,’ বলে শারিয়ার ছোটো- ছোটো কয়েকটা গাছের মতো দেখাল।
‘গাছের ডাল ভাঙা,’ রুম্পা বলে উঠল।
‘বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই গাছের ডাল ভাঙতে পারে না, শারিয়ার রুম্পাকে কথাটা বলেই সে সুমনকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইল, ‘আপনারা কি এদিকে চেক করেছিলেন?’
সুমন মাথা চুলকে আনমনে একবার জায়গাটার দিকে দেখল তারপর নিজের দুই সঙ্গীর দিকে দেখে নিয়ে আবার শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘দেখেছি, মানে রাস্তা থেকে চোখ বুলিয়েছিলাম। মানে, স্যার আপনি যেভাবে দেখছেন সেভাবে…’
তার কথা শেষ করতে না দিয়ে শারিয়ার খুশি হয়ে উঠল। ‘এইটাই আমি জানতে চাচ্ছিলাম, আপনারা কেউ এখানে নেমেছিলেন কি না?’ বলেই সে রুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমাদের লোকেরা কেউই এখানে নামেনি, এর মানে কেউ না কেউ তো এদিক দিয়ে নেমেছিল সম্প্রতি। কারণ মানুষ না নামলে এভাবে…’ সে বাক্যটা শেষ না করে নামতে শুরু করল রাস্তার পাশের ঢাল বেয়ে। রুম্পা বাকিদের ইশারা করল ওদেরকে অনুসরণ করতে।
রাস্তার পাশের ঢাল বেশি গভীর না। আট-দশ ফিট নামতেই রাস্তার পাশের বড়ো ডালপালাওয়ালা গাছ শেষ হয়ে জঙ্গলের মতো জায়গাটার শুরু। শারিয়ার সাবধানে দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। সে পেছন ফিরে রুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘বৃষ্টিতে সব শেষ কিন্তু,’ বলে সে আরেকটু এগিয়েই মাটিতে নিচু হয়ে বসে পড়ল, তারপর জংলামতো জায়গাটার একটা জায়গা থেকে বড়ো একটা গাছের পাতা সরিয়ে খানিকটা খুশি হয়ে রুম্পাকে ডেকে দেখাল। রুম্পা কৌতূহলী হয়ে শারিয়ারের কাঁধের ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, বড়ো পাতার নিচে একটা বুট জুতোর ছাপের বেশ খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ‘কেউ যে এখান দিয়ে গেছে তার সামান্য প্রমাণ। আমার বিশ্বাস এখান দিয়ে একজন নয় একাধিক লোক গেছে, হয় সেদিন আর না হয় সম্প্রতি এবং জুতোর ছাপের ধরন দেখলেই বলা যায় এই ধরনের হেভি ডিউটি বুট আমাদের দেশের মানুষেরা সহজে পরে না। এর মানে…’
‘বিশেষ কেউ গেছে এদিক দিয়ে…’
শারিয়ার উঠে দাঁড়াতেই রুম্পা তার লোকদের উদ্দেশে নির্দেশ দিল ছাপটার ছবি আর নমুনা নিতে। শারিয়ার উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে লাগল। ‘রুম্পা ম্যাডাম, বিশ্বাস করেন যদি আমার অনুমান ভুল না হয় তবে সামনে…’ বাক্যটা শেষ করার আগেই সে ঝোপঝাড়ের ওপাশ থেকে অন্যদিকে চলে এলো এবং সাবধান না হলে সে আরেকটু হলেই পড়ে যেত সামনের বিরাট পুকুরটার একপাশে।
‘সাবধান, ম্যাডাম,’ সে নিজে থেমে গিয়ে সাবধান করে দিল ওর পিছু পিছু আসতে থাকা রুম্পাকে। রুম্পাও জংলা জায়গাটার একপাশে এসে সামনেই বিরাট পুকুরটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছে।
‘ওমা এখানে তো পানি,’ ছোটো পোলাপান অবাক হলে যেভাবে বলে ওঠে সেভাবে বলে উঠল সে। শারিয়ার মাথা চুলকাতে চুলকাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। ওর অনুমান এভাবে বোকার মতো ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি সে। ঠিক যেখান থেকে ওর ধারণাটা ঠিক প্রমাণ হতে শুরু করছিল সেখানেই এভাবে থেমে যেতে হবে কে ভেবেছিল।
খানিকটা বোকার মতোই জলাধারটার দিকে তাকিয়ে রইল সে।