অধ্যায় চব্বিশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র, রামু আর সন্দ্বীপের মাঝামাঝি
প্রবাহিত সময় আর সমুদ্রের স্রোতকেই কাজে লাগাতে হবে, কথাটা মনে মনে একবার নিজেকে মনে করিয়ে দিয়ে নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে কিরান বলে উঠল, ‘পরিকল্পনা-কার্যকরণ-বাস্তবায়ন,’ একবার হেসে উঠল সে। বিশেষ করে পট্টবর্ধন আর গোলন্দাজের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় হেসে বলে উঠল, মনে পড়ে পুরান দিনগুলার কথা?
‘মনে পড়ে মানে,’ হুকোতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গোলন্দাজ কথা বলে উঠল। সে এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। একটা ব্যাপার জানার পরে কিরানও খানিকটা স্বস্তিবোধ করছে যে নুনের ভিটায় হার্মাদ আর মগরা আক্রমণ চালানোর সময়ে ওখানে গোলন্দাজের পরিবার ছিল না। ওর স্ত্রী-ছেলেমেয়ে এর আগের হপ্তায় নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেই সুবাদে গতকালের আক্রমণে গোলন্দাজের পরিবারের কিছু হয়নি। তবে ওদের পারিবারিক ব্যবসা, লবণের ভাণ্ডার, পুরো গ্রাম থেকে শুরু করে ওর সব লোকজনসহ বাকি সবাই বন্দি হয়েছে। তাই প্রথমে খুব বিভ্রান্ত থাকলেও শান্ত হওয়ার পর সে কিরানের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। কারণ ওরা যদি সময়মতো না যেত তবে হয়তো আরো বেশি ক্ষতি হতো। এমনকি সে নিজেও ওদের হাতে ধরা তো পড়তই, হয়তো মারাও পড়ত। কিরান আর বেদু ওই গ্রামে গতকাল যা করেছে সেটা করাতে হয়তো গ্রামের কিছু মানুষ বেঁচেও গেছে। গোলন্দাজ নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কিরানের কাছে ওয়াদা করেছে ও নিজের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেবে কিরানের বাবাকে উদ্ধার আর সিলভেরার শেষ দেখার জন্য। তারপর দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এই বিষয়ে।
‘আমরা বেশিরভাগ সময়ে আলোচনা করতাম জাহাজের খোলের ওপরে,’ গোলন্দাজ হাসতে হাসতেই বলে উঠল। ‘ঠিক এমনে,’ বলে সে কিরানের দিকে ফিরে হাতের হুঁকো উঁচু করে বলে উঠল, ‘কত দিন পরে ওস্তাদ তোমার কারণেই সম্ভব অইতাছে আবার।’
‘আমি ভাবছিলাম আর কুনোদিনই জাহাজে পা রাহা অইবে না,’ গোলন্দাজের পাশ থেকে পট্টবর্ধন বলে উঠল। ‘কিরানের কারণেই ব্যাপারটা সম্ভব অইতাছে আবার। এইবার মরলেও আফসোস নাই আর। হয় জিত না অয় মত্যু,’ বলে সে হাতে ধরে রাখা আরকের বোতলটা তুলে ধরলো মুখের সামনে, তারপর হইহই করে বলে উঠল, ‘কিরানের লাইগা।’ পট্টবর্ধনের সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে হইহই করে উঠল।
খণ্ডালের গুহা থেকে ভোরের জোয়ারের সঙ্গে রওয়ানা দিয়ে কিরানদের তিনটে জাহাজ টানা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দুপুরের ভেতরে পৌঁছে যায় সন্দ্বীপের মোহনার কাছাকাছি। জাহাজ ছাড়ার পর যারা যারা জাহাজ চালনার সঙ্গে সরাসরি নিয়োজিত তারা বাদে বাকিদের কিরান নির্দেশ দেয় দুপুর পর্যন্ত বিশ্রামের জন্য। কারণ সে জানে অন্যরা তো বটেই, এমনকি সে নিজেও কতটা ক্লান্ত। আর জাহাজ একবার সন্দ্বীপে পৌছালে কী অবস্থায় পড়বে কেউ জানে না। কাজেই সবাইকে সে এক বেলা ঘুম দিয়ে নিতে বলে নিজেও দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেয়। ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পায় জাহাজ তিনটে সন্দ্বীপের কাছেই মোহনাতে উপবিষ্ট অবস্থায় নোঙর ফেলা আছে। ঘুম থেকে উঠে নিজে প্রস্তুত হয়ে জাহাজের সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিজেদের কার্যকরণ ঠিক করার জন্য বড়ো জাহাজটার পাটাতনের ওপরে আলোচনায় বসেছে।
সবাই হইহই করে ওঠাতে রেলিংয়ের ওপরে পা তুলে বসে থাকা কিরান সবার দিকে হাসি মুখে ফিরে তাকাল। হাতের আরকের বোতলটা উঁচু করে ধরে বলে উঠল, ‘আমার গুরু, যে আমারে জাহাজি হিসেবে গইড়া তুলছিল,’ বলে সে নিজের শরীরটা দেখাল। ‘আমার শরীরের শিরাগুলোর ভেতর দিয়ে রক্তের চেয়ে বেশির সমুদ্রের নোনা পানি। রক্তের ভেতরে নোনা পানির যে নেশা সেই নেশা ধরা আছিল যে মানুষটা, তরফদার চাচা, সেই মানুষটা আর আমগো লগে নাই। সেই মানুষটার কাছ থেইকা আমি একটা জিনিস শিখছি। সেইটা অইলো নিজের জন্য বাঁচা। চাচা সবসময় কইত জীবনে উত্থান পতন থাকব, বড়ো ছোটো থাকবই, কিন্তু এই মুহূর্তের লাইগ্গা বাঁচবি সবসময়। আমরা সবাই এইহানে যারা আছি বেশির ভাগই আগে একলগে ছিলাম। একলগে অনেকদিন কাম করছি। আমরা একসময় ভাবতাম আমরা কুনোদিন হারব না। আমগো ক্ষয় নাই। কিন্তু আসলে তেমনডা অয় নাই। আমগো সব থাহার পরও আমরা হাইরা গেছিলাম। ছিন্ন-ভিন্ন অয়া গেছিল আমগো জীবন। কিন্তু ভাগ্য আমগোরে আবারও একসঙ্গে করছে। আমি সত্যি ভাবি নাই কুনোদিন আবারও একসঙ্গে অবো। কুনোদিন আবারও সবার সঙ্গে খোলা সমুদ্রে বইসা এমনে কথা কইতে পারব। আমরা সবাই একটা উদ্দেশ্য লইয়া ঘর ছাড়ছি যা আমরা হারাইছিলাম সেইটা ফিরা পাবার লাইগ্গা। সামনে কী আছে আমি জানি না। কিন্তু বন্ধুরা এই মুহূর্তে তুমগো সবার মাঝে, তুমগো সবার লগে থাহার কারণেই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সবচেয়ে সুখী মানুষ,’ বলে সে বোতলটা উঁচু করতেই সবাই আবারও হইহই করে উঠল।
‘আমগো নেতা, আমগো কাপ্তান, আমগো জাহাজি ভাই কিরানের লাইগ্গা, ‘ বলে নিজের সিরাজির বোতলটা উঁচু করে ধরল সবাই।
গল্প করতে করতে পান করতে করতে স্মৃতিচারণ চলল কিছুক্ষণ। তারপর কিরান আবারও হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বলল। ‘বন্ধুরা, এবার আমরা কাজের কথায় ফিরা আসব। তুমরা তো সবাই জানো কী উদ্দেশে আমরা সবাই এইখানে এক অইছি। এত আয়োজন, এত কিছু, সবকিছু একটাই উদ্দেশে।’
কিরান এই পর্যন্ত বলতেই ওর পাশ থেকে পট্টবর্ধন বলে উঠল, চট্টগ্রামের প্রধান, বলা যায় অন্যতম ব্যবসায়ী এবং আরাকানের রাজার রোষ থেকে বাঁইচা যাওয়া সম্রাট শাহ সুজার ডান হাত তালেব তৈমূররে খুঁইজা বাইর করে উদ্ধার করা।’
‘এবং আপনারা সবাই জানেন বাপু মানে, তালেব তৈমূর সম্রাট সুজার ওখান থেকে পালানোর পর তার পিছু নিছে রোসাঙ্গের রাজার লোকেরা। তার পিছু নিছে দক্ষিণের ত্রাস সিলভেরা,’ সিলভেরার নামটা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল কিরান। ‘এই মানুষগুলার কারণে আমাগো নিজের দেশের মানুষ আইজ ঘরছাড়া। এদের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারতাছে না দক্ষিণে। এদের কারণে আজ আমার দেশের মানুষর গরু-ছাগলের মতো বিক্রি অইতাছে। এই সিলভেরা জানা না-জানা কত মানুষের কত পরিবার শেষ করছে তার কোনো গুনতি নাই। এই জন্যই সিলভেরারে উপযুক্ত শিক্ষা দেওনের এইটাই বিরাট সুযোগ,’ বলে কিরান তাকিয়ে আছে সবার দিকে। যদিও সবাই জানত তবুও সিলভেরার নাম শুনে পরিস্থিতি একটু হলেও বদলে গেছে। ‘তোমরা যারা এইখানে আছ সবাই কোনো না কোনো দিক দিয়ে আহত অইছো এই লোকটার কারণে, হয় ধনে না হয় মনে। এই সুযোগ এসেছে শায়েস্তা করার। আগেরবার আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এইবার আমরা প্রস্তুত। আমগো লগে তিনটা জাহাজ আছে, মানুষ আছে, আমগো অস্ত্রের কোনো সীমা নাই। আমগো সেরা জাহাজি আছে,’ বলে সে পট্টবর্ধনের দিকে তাকাল।
সবাই হইহই করে উঠল। ‘আমগো প্রত্যেকটা জাহাজে কামান আছে,’ বলে একটু থেমে কিরান রঙ্গনের দিকে দেখাল। ‘তার চেয়ে বড়ো কথা আমগো লগে দক্ষিণের সেরা কামাঞ্চি আছে, যারে এমনকি সিলভেরার মানুষেরাও ডরায়,’ বলে সে গোলন্দাজের দিকে দেখাল। সবাই আবারও হইহই করে উঠল। ‘আমগো লগে সেরা লাঠিয়াল বাহিনী আছে তুলারামের। সেরা বর্শাবিদ আছে, বেদু-গোমেজ। আর কিছু লাগে?’
সবাই হইহই করে উঠল। কিরান থামতেই পট্টবর্ধন পাশ থেকে বলে উঠল, ‘আমগো সবই আছে, দরকার শুধু সঠিক একটা পরিকল্পনা, আর বুকে বল। আর আমি তুমগো কথা দিতাছি সময় আইলে আমি নিজে সিলভেরার বুকে হয় একটা শিসা ঢুকায়া দিবো আর না হয় ওর বুকের ভিতর থাইক্কা কইলজাটা কাইট্টা বাইর করা নিয়া আসব।’
সবাই হইহই করে উঠল, উঁচিয়ে ধরল যার যার নিজের অস্ত্র। কিরান এবার ইশারা করল ওর লোকদের দিকে। জাহাজের মূল রেলিংয়ের ওপরে কাঠের ফ্রেমে আটকানো একটা কাপড়ের ওপরে হাতে আঁকা একটা ম্যাপ এনে রাখা হলো ওর পাশে। ছোটো একটা লাঠি দিয়ে ম্যাপটা দেখাল কিরান। ‘আমগো পুরা দলের মধ্যে যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছ সবাই এইখানে আসো। আমি আগেই বলছি আমগো সবচেয়ে বেশি দরকার সঠিক পরিকল্পনা। আমগো যাত্রার সবকিছু তুমগো সামনে তুইলা ধইরা এইখানেই সবার লগে আলোচনা কইরা আমরা পুরা পরিকল্পনা ঠিক করব। প্রথমেই আলোচনা হবে, আমরা আসলে কী কী জানি পুরা ব্যাপারটার সম্পর্কে। এইটা আমার মনে হয় পট্টবর্ধন আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে।’
পট্টবর্ধন সোজা হয়ে দাঁড়াল। ‘প্রথমেই তুমগো একটা কথা কই। তুমরা তো জানো, আমরা সবাই সম্রাট সুজারে পছন্দ করি। এর পেছনে মূল কারণ অইলো শাহ সুজা বাংলায় সুবাদার থাকাকালে বাংলার যে উন্নতি অইছে আমরা সেইটা জানি। দিল্লির রাজনীতি সুজা সম্রাট কি সম্রাট না সেইটা আমগো বিবেচনার বিষয় না। আমরা সুজারে পছন্দ করি। সেই সুজারে পরিবারসহ আরাকানে হত্যা করা অইছে। তার কাছের লোকদের ভেতরে তালেব তৈমূর আর গুটিকয়েক মানুষ স্রেফ পলাইতে পারছে। বলা অইতাছে তারা সম্রাট সুজার সম্পদের একটা বড়ো অংশ তালেব তৈমূরের হাতেই ছিল। মূলত এইটার কারণেই আরাকানের রাজা আর সিলভেরা তাগো পিছে লাগছে। এইখানে একটা কথা পরিষ্কার করতে চাই। আমগোরে যারা নিয়োগ দিছে, চাঁটগায়ের ব্যবসায়ীরা-তারা বেশ কয়েকটা কারণে আমগোরে নিয়োগ দিছে। প্রথমত, তালেব তৈমূর হেগো বন্ধু, তারে উদ্ধার করতে চায় তারা। দ্বিতীয়ত, এই সম্পদ যদি বাঙ্গাল মুলুকে ফিরায়া আনা যায় তবে তাতে বাঙ্গাল মুলুকেরই উপকার। তৃতীয়ত, তারা আরাকানের রাজারে একটা শিক্ষা দিতে চায়, সেই সঙ্গে দক্ষিণের সমুদ্রে সিলভেরার অত্যাচার মাত্রা ছাড়ায়া গেছে, তারা এইটারও অবসান চায়। এই কারণেই এত সম্পদ ব্যয় কইরা আমরা হেগো পিছে লাগছি। বোঝা গেছে?’ বলে পট্টবর্ধন একটু থামল।
‘এখন প্রশ্ন অইলো, যে কামে আমরা যাইতাছি এতে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা অইলো তথ্য। আমগো হাতে যথেষ্ট তথ্য নাই। আমরা যা জানি স্রেফ মুখে মুখে শুনছি। বৈঠা আর বিল্লাল শেঠ মিলা কিছু কথা বাইর করছে। চাঁটগায়ের ব্যবসায়ীরা আকরাম বেগ থেইকা শুরু কইরা বাকিরা, আমগো কিছু জানাইছে। আর কিরানের ধইরা আনা ফিরিঙ্গির কাছ থেইকা কিছু ব্যাপার আমরা জানতে পারছি। যা যা আমরা জানতে পারছি হেরে যদি এক করতে পারি তাইলে বিষয়টা এমন দাঁড়ায়; প্রথমে আমরা জানছি সম্রাট সুজারে হত্যা করার সময়ে তালেব তৈমূর আর তার কাছের কয়েকজন মিল্লা পলায়া প্রথমে জাহাজে উঠছে। সেই জাহাজের পিছু নেওয়া অয় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু এই জাহাজ খোলা পানির পরিবর্তে জলা জঙলা আর দ্বীপাঞ্চলে পলায়া থাকে বেশ কিছু দিন। এই কারণে রোসাঙ্গের রাজার বাহিনী জাহাজডা ধরতে পারে নাই। হেগো প্রথম বাহিনী পরাস্থ হয়া ফিরা যাওনের পর তালেব তৈমূর জাহাজ নিয়া কোনদিকে গেছে সেইটা আমরা জানতে পারি নাই। তবে হেগো জাহাজ চাঁটগায়ে পৌছাইতে পারে নাই। পারে নাই হুগলীর দিকে যাইতে। পারে নাই সুন্দরবনের দিকে যাইতে। এর পেছনে কারণ অইলো, রোসাঙ্গ রাজের প্রথম বাহিনী ব্যর্থ অইলেও হেরা খবর চাউর কইরা দিছিল। যে কারণে মাঝি-মাল্লাগো নৌকা থেইকা শুরু কইরা পর্তুগিজ জাহাজে বাহিনীর হাজারো চোখ পানিতে নজর রাখতে শুরু করে। তবে এই খবর আমগো কাছে আছে হেরা এইখান তাইক্কা সন্দ্বীপ গেছিল। এই খবর আকরাম বেগের খাস লোকের দেওয়া। হিসাব করলেও এই খবরের একটা মূল্য আছে। কারণ হেরা যেইখানে ছিল সেইখান থাইক্কা সন্দ্বীপই সবচেয়ে কাছে এবং রসদের লাইগ্গা অইলেও হেগো সন্দ্বীপ যাইতেই হইতো।’
খবরি বিল্লাল শেঠ এইখানে হাত তুলল। ‘আমার ওস্তাদও এইটা নিশ্চিত করছে হেরা সন্দ্বীপ গেছিল। আমরা আবারও খোঁজ নিতে পারবে।’
বিপরীত দিক থেকে গোলন্দাজ বলে উঠল, ‘আমার প্রশ্ন সন্দ্বীপ অইলো পর্তুগিজ দস্যুগো মূল আখড়া। তাইলে হেরা যাগো কাছ থাইকা বাঁচতে চাইতাছে হেইখানেই ক্যান যাইব?’
‘এই প্রশ্ন আমার মনেও আসে নাই তা না,’ কিরান বলে উঠল কিন্তু পট্টবর্ধন যেইটা বলল সেইটাও অসম্ভব না। রোসাঙ্গ থেইকা পলানোর পরে সন্দ্বীপ ছাড়া হেগো আর উপায় ছিল। রসদের লাইগ্গা অইলেও।’
‘এরপরে,’ পট্টবর্ধন আবারও বলতে লাগল। ‘এমনকি কিরানের ধইরা আনা ফিরিঙ্গিও এইটা নিশ্চিত করছে হেরা সন্দ্বীপ ছিল। কিন্তু আমগো যেইটা বড়ো সমস্যা আমরা জানি না, হেরা সন্দ্বীপ থেইকা কোনদিকে গেছে। যদি খবর আর হিসাব আমরা মিলায় দেখতে পারি তয় এইটা নিশ্চিত যে, হেরা সন্দ্বীপ থেইক্কা খুব বেশি দূরে যাইতে পারে নাই। কই আছে, কুন দিকে গেছে বা সিলভেরা আর রোসাঙ্গের বাহিনী এখন কী অবস্থায় আছে জানতে অইলে আমগো একটাই উপায়,’ পট্টবর্ধন থেমে গেল।
‘সন্দ্বীপ যাইতে অইবো আমগো, কিরান আকরাম বেগের দেওয়া মোড়ানো চামড়ার পুঁটলিটা বের করে ফেলল কোমরবন্ধনি থেকে। এখানেই আকরাম বেগের খাস লোকের নাম আছে, যাকে খুঁজে বের করতে হবে সন্দ্বীপে গিয়ে।
‘বুঝলাম,’ বেদু বলে উঠল। নিজের বাঘ-বানর আর ইগলটাকে রেখে আসায় সামান্য মন খারাপ তার। কিন্তু সেইখানে গিয়া আমরা খবর পাব ক্যামনে? ওস্তাদ, ভুইলো না সন্দ্বীপ অইলো মগ আর পর্তুগিজগো আখড়া। সেইখানে গিয়া আমগোর পক্ষে খবর বাইর করা খুব কঠিন অইবে। বিপদের কথা বাদই দিলাম।’
কিরান এক পা সামনে এগিয়ে এলো। মূলত এই পরিকল্পনার লাইগ্গাই আমরা এইখানে আসছি এখন,’ বলে সে সবাইকে দেখল। ‘আমরা এখন যেইখানে আছি সেইখান থাইকা সন্দ্বীপ যাইতে আমগো সময় লাগব ঘণ্টা তিনেক। মানে এখন রওনা দিলে বিকালের ভিতরে পৌছায়া যাব আমরা। আলোচনা শেষ কইরাই রওনা দেব। কিন্তু ওইখানে পৌছাইলেও আমরা দ্বীপের সামনের দিকে মানে যেদিকে জাহাজ ভিড়ানি অয় সেদিক দিয়া যাব না। সত্যি কথা অইলো আমরা জাহাজ নিয়াই সন্দ্বীপ যাব না। আমগো জাহাজ থাকব দ্বীপ থেইকা দূরে, খাড়ির কাছে। আমরা তিনটা দল যাব সন্দ্বীপে, কোষা নৌকা নিয়া। দ্বীপের পেছন দিকে পৌঁছায়া আমরা তিনটা দলে ভাগ হয়ে তিন দিকে যাব খবরের জন্য।’
সে প্রথমেই গোলন্দাজকে দেখাল। ‘প্রথম দলের নেতা হিসেবে থাকব গোলন্দাজ। এই দলটা মূলত যাইব বিল্লাল শেঠের ওস্তাদের কাছ থেইকা খবর বাইর করার লাইগ্গা। এরপরে দুই নম্বর দলে থাকব লাঠিয়াল তুলারাম। এই দলে বেদুও থাকব। এই দলডা যাইব মূল বাজার এলাকার দিকে। এই দলটার উদ্দেশ্য থাকব বাজারে ঘুরাঘুরি কইরা খবর বাইর করা। আর তিন নম্বর দলে থাকব আমি নিজে, আমার লগে থাকব গোমেজ। আমরা যাব আকরাম বেগের দেওয়া মানুষটার সঙ্গে দেখা করনের লাইগা। আমরা সাবধানে যাব, ছদ্মবেশে যাব, অস্ত্র থাকব আমগো লগে। তবে আমরা যেকোনো অবস্থায় যেকোনো গণ্ডগোল এড়ানোর চেষ্টা করব,’ বলে সে হাত তুলে সবাইকে সাবধান করে দিল। ‘সবাই মনে রাখবা, আমগো দলের মূল উদ্দেশ্য থাকব খবর বাইর করা। যেকোনো খবর আমরা বাইর কইরা নিয়া আসব, যেইটা দিয়া আমরা যাত্রার পরের অংশ ঠিক করতে পারি। মনে থাকব সবার?’ সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সে নিজের লোকদের ইশারা করল।
কার দলে কারা যাবে, কীভাবে যাবে, সব ঠিক করে পট্টবর্ধনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল সে। সব ঠিক করা হয়ে গেছে। এবার মাঠে নামতে হবে কাজের জন্য।